Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৪.১১ সুন্দরীর নূরের পাণিপ্রার্থীরা

    কোনও এক সময়ে এক দুর্জয়-সাহস সুলতান প্রতাপের সঙ্গে সব প্রাজা পালন করতেন। সুলতানের তিন পুত্র। বড়টির নাম আলী, মেজটির নাম হাসান এবং ছোট ছেলের নাম ছিলো হুসেন। তিন পুত্রই দেখতে ছিলো খুব সুন্দর। সুলতানের এক সম্পর্কে বোনের হাতে তাদের লালন পালনের ভার দেওয়া হয়েছিলো।

    ছেলেরা প্রাসাদের মনোরম পরিবেশে বড় হতে থাকে। তাদের তিন ভাই-এর সঙ্গে মা-বাপ-মরা অনাথ এক মাসতুতো বোনও মানুষ হচ্ছিল। এই মেয়েটির নাম নুর অল-নিহার। অপরূপ সুন্দরী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী। ওর হরিণীর মতো কাজল-কালো টানাটানা চোখের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না।

    চার ভাই-বোন এক সঙ্গে খায় দায়, খেলাধুলা করে এবং একই সঙ্গে ঘুমোয়। সুলতান ভেবেছিলেন, নুর বড় হলে পাশের কোনও সুলতান বাদশাহর পুত্রের সঙ্গে শাদী দিয়ে দেবেন। কিন্তু মেয়েটির দেহে যখন প্রথম যৌবন উন্মেষ ঘটলো তখন তাকে পরদা নসীন করে রাখার জন্য পুত্রদের সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, তার তিন পুত্রই নুরের প্রতি সমান ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। সুলতান ভাবলেন, এ অবস্থায় যে কোনও দুই পুত্রকে বঞ্চিত করে একজনের হাতে যদি নুরকে তুলে দেন তবে ভাইএ ভাইএ বিবাদ বেঁধে যাবে। আবার যদি ওদের বাদ দিয়ে অন্য কোনও দেশের শাহজাদাদের কারও সঙ্গে শাদী দিয়ে দেন তাহলেও অশান্তি বাড়বে। সুতরাং কী ভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা করা যায় কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

    তিন ছেলেকেই সুলতান ডেকে পাঠালেন।

    –শোনও বাবা, তোমরা সবাই আমার চোখে সমান। কারও ওপর কোনও পক্ষপাত আমি করতে পারি না। অথচ তোমাদের তিন জনের সঙ্গেই তো নুরের সাদী দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু উপায় একটা খুঁজে বের করতেই হবে। তোমাদের ভাইদের যাতে সদ্ভাব বজায় থাকে সে ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে।

    সুলতান বললেন, শোনও, আমি একটা উপায় উদ্ভাবন করেছি। তোমরা তিন ভাই নিজের নিজের পছন্দ মতো তিন দেশে যাত্রা কর। আমি দেখতে চাই তোমরা নিজেদের হিম্মতে কে কতটা অবাক করার মতো কী করে আসতে পার। যার কাজে আমি সব চেয়ে বেশি মুগ্ধ হবো সেই পাবে নুরকে। কী, তোমরা রাজী?

    ছেলেরা বাবার প্রস্তাবে একবাক্যে সম্মতি জানালে সুলতান বললেন, তাহলে যাত্রার আয়োজন কর। কার কী টাকা পয়সা প্রয়োজন বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

    খাজাঞ্চীখানা থেকে বস্তা বস্তা সোনা বের করা হলো। এবং যার যতটা ইচ্ছা, প্রত্যেক ছেলে সেগুলো সঙ্গে নিলো।

    দিনক্ষণ দেখে একই সময়ে ওরা বণিকের ছদ্মবেশে রওনা হয়ে গেলো। যাওয়ার সময় সুলতানকে বলে গেলো, এক বছর পরে আবার ঠিক এই দিনে ওরা সকলে প্রাসাদে ফিরে আসবে।

    শহর ছেড়ে বড় সড়ক ধরে ওরা তিন ভাই একসঙ্গে চলতে চলতে একসময় অন্য এক শহর প্রান্তের এক সরাইখানায় এসে উপস্থিত হয়। এখান থেকে সড়কটা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে চলে গেছে। ঠিক হলো, এবার ওরা তিনজনে তিন দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে যাবে।

    সন্ধ্যা হয়ে এসেছিলো, সে রাতটা ওরা তিন ভাই সরাইখানাতেই আশ্রয় নিলো। রাতের খাবার খেতে বসে তিনজনে পরামর্শ করলো, সফর শেষে এক বছর পরে ঠিক এই দিনে ওরা প্রথমে এই সরাইখানেতে এসেই মিলিত হবে। তারপর তিন ভাই এক সঙ্গে প্রাসাদে ফিরবে। যদি কেউ আগে এসে পৌঁছয় তবে সে অন্য ভাইদের জন্য এখানে অপেক্ষা করবে।

    পরদিন খুব ভোরে যাত্রার পূর্বে তিন ভাই পরস্পরে শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় আলিঙ্গন বিনিময় করে যে যার পথে রওনা হয়ে গেলো।

    এক টানা তিন মাস ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে অনেক দুর্গম গিরি প্রান্তর অতিক্রম করার পর বড় ছেলে আলী একদিন ভারতের সমুদ্র উপকূলের বিশানগড় সাম্রাজ্যে এসে উপস্থিত হলো। শহরের সব চেয়ে সম্ভ্রান্ত সরাইখানার একটি বিরাট সুসজ্জিত কামরা ভাড়া করে নিলো সে।

    অনেক দিনের পথের ক্লান্তিতে দেহ অবসন্ন হলে এসেছিলো। সেদিন সারাটা দিন পড়ে পড়ে ঘুমালো আলী। এবং সন্ধ্যার একটু আগে সেজে গুজে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লো।

    শহরের ঠিক মাঝখানে একটা বেশ সাজানো গোছানো বাগিচা তার মাঝখানে বিরাট একটা জলের ফোয়ারা। তার চারপাশটা শ্বেত পাথরে বাঁধানো। বাগানের মধ্যে নানা রকম বাহারী ফুলের সমারোহ। চোখ জুড়িয়ে যায়।

    চার পাশে নানারকম দোকান পাট। হরেক কিসিমের ভারতীয় পণ্যের মেলা। যা দেখে তাই বড় সুন্দর মনে হয় আলীর। দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে হরেক জিনিসের দাম জেনে নিতে থাকে সে।

    আলী বিদেশী এ শহরে নবাগত, তার সাজ পোশাক, চাল চলন দেখে সবাই বুঝতে পারে। এক দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেশ ভাবই জমে ওঠে। দোকানী বলে, যদি কিছু মনে না করেন তবে চলুন, আমার গরীবখানায় একটু পায়ের ধুলো দেবেন আজ।

    এ আমন্ত্রণ এড়াতে পারে না আলী। নতুন দেশে এসেছে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ সালাপ জমাতেই হবে। তাই সাগ্রহে রাজি হয়ে যায়।

    দোকান বন্ধ করে আলীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে আসে দোকানী। আপ্যায়ন করে বাইরের ঘরে বসিয়ে সে অন্দরে চলে যায়।

    আলী জানালার পাশে বসে পথচারীদের যাওয়া আসা দেখতে থাকে।

    একটু পরে একখানা ছোট্ট গালিচা হাতে করে একটা লোক হাঁকতে হাঁকতে এগিয়ে চলেছে, গালিচা নেবে গা—বহুৎ আজব গালিচা! একদম জলের দরে বিকিয়ে যাচ্ছে। মাত্র তিরিশ হাজার মোহরে দিয়ে দেব।

    আলী হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। বলে কী? নামাজ পড়ার যোগ্য ছোট্ট একখানা গালিচার দাম তিরিশ হাজার? লোকটার কী মাথা-টাথার কিছু গোলমাল আছে? লোকটা আরও কাছে ওর জানালার সামনে আসতে আলী ওকে ডাকে, এই শোনো, দেখি তোমার গালিচাখানা। এতো দাম হাঁকছ কেন?

    লোকটা নির্বিকার ভাবে বলে, এতো দাম কোথায়, কত্তা। আমার মালিক বলে দিয়েছে, চল্লিশের কমে বিক্রি করবি না, তা রাত হয়ে যাচ্ছে, হাত খালি করে ঘরে ফিরতে নাই, তাই তিরিশ হাজারেই ছেড়ে দেব ঠিক করেছি—একেবারে জলের দাম।

    আলী পরীক্ষা করে দেখলো। অতি সাধারণ একখানা গালিচা। ভেবে পেলো না, এইটুকু একখানা সাধারণ গালিচার এতো দর কেন হাঁকছে লোকটা? পারস্যের সূক্ষ্ম কারুকাজ করা একলোখানা ঘরজোড়া গালিচার তো তিরিশ হাজার টাকা দাম নয়!

    নিশ্চয়ই তোমার গালিচার অন্য কোনও মাহাত্ম্য আছে মনে হচ্ছে। তা না হলে এতো দাম চাইছো কেন?

    লোকটি এবার আলীর দিকে চোখ তুলে ভালো করে তাকালো, হ্যাঁ সাহেব আপনি ঠিকই ধরেছেন। এ গালিচা মন্ত্রঃপূত। এর ওপর বসে আপনি যেখানে যাওয়ার বাসনা করবেন সেখানেই আপনাকে নিয়ে যাবে। তা সে হিমালয়ের চূড়াতেই হোক বা ভারত মহাসাগরের মাঝখানেই হোক। সাগর প্রান্তর গিরি নদী কোনও বাধাই এর কাছে বাধা নয়। চোখের পলকে যেখানে খুশি চলে যেতে পারবেন।

    আলী বলে, তোমার কথা যদি ঠিক হয়, যদি প্রমাণ পাই তোমার গালিচা ঐ রকম অলৌকিক গুণধর, তবে তিরিশ কেন চল্লিশ হাজারই দেব তোমাকে। এ ছাড়া দালালী হিসাবে আর এক হাজার বেশি দেব তোমাকে! আগে তোমার কারিকুরি দেখাও দেখি লোকটির চোখে কেমন অবিশ্বাসের প্রশ্ন, কোথায়, আগে একচল্লিশ হাজার মোহর আমাকে দেখান, তা হলে এখুনি ভেল্কীবাজি দেখিয়ে দেব আপনাকে।

    আলী বলে, টাকা আমার ডেরায় আছে। এই শহরের সব চেয়ে সেরা যে সরাইখানা—সেখানে আমি একখানা ঘর ভাড়া করে উঠেছি। সওদা হয়ে গেলে আমার সঙ্গে যেও হাতে হাতে টাকা দেব, মাল নেব।

    লোকটি এবার উৎসাহিত হয়ে বলে, সরাইখানার পথ তো এখান থেকে নেহাত কম নয়। তা পায়ে হেঁটে গিয়ে কী লাভ, আসুন এই গালিচায় এসে বসুন আমার পাশে, এক পলকে পৌঁছে

    যাবো আপনার ঘরে। গালিচায় বসে আপনি মনে মনে স্মরণ করবেন একবার, কোথায় যাবেন। ব্যস আর কিছু করতে হবে না, সোজা পৌঁছে দেবে পলকে।

    হলোও তাই। গালিচায় বসে চোখ বন্ধ করে মনে মনে একবার মাত্র ভেবেছে, এখন ঘরে ফিরতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে দেখলো, সেই সুরম্য সরাইখানায় তার নিজের কক্ষে এসে পড়েছে সে।

    তাজ্জব ব্যাপার! আলী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নফরকে বললো, একে একচল্লিশ হাজার মোহর দিয়ে। দে।

    আলী ভাবে সার্থক তার ভারতে আসা। অতি অল্পকালের মধ্যেই এমন এক আজব বস্তু সংগ্রহ করতে পেরেছে যা তার অন্য দুই ভাই কখনোও করতে পারবে না। যে দেশেই যাক, আর যত চেষ্টাই করুক, এমন অলৌকিক যাদুকরী জিনিস ওরা পাবে কোথায়? সুতরাং কেল্লা ফতে-নূর অল-নিহার তারই বুকে মাথা রাখবে। বাবা বিচক্ষণ সুলতান, বিচারে তিনি পক্ষপাতিত্ব করবেন না। আর ন্যায় বিচার হলে তাকে টেক্কা দিতে পারবে না অন্য কোনও ভাই।

    কিন্তু সমস্যা হলো—বছরের সবে তিনটি মাস অতিক্রান্ত। কথা আছে, এক বৎসর পরে ওরা তিন ভাই সেই সরাইখানায় মিলিত হবে, তারপর এক সঙ্গে হাজির হবে সুলতানের সামনে। এখন এই দীর্ঘ সময় কোথায় কাটাবে সে।

    পরদিন থেকে সে শহরের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো। সারা শহরব্যাপী হিন্দুদের কত মজার মজার মন্দির। আর সেই সব মন্দিরে কত বিচিত্র রকমের সব মূর্তি। কোনওটা পিতলের কোনওটা তামার আবার কোনওটা বা সোনার তৈরি। সকাল সন্ধ্যায় ঘণ্টা-ধ্বনি হয়, নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজে, হাজার হাজার ভক্ত নর-নারীর সমাগম হয়। পুরোহিত সকলকে আশীর্বাদ করে, প্রসাদ হয়, ভক্তরা যে যা পারে প্রণামী দিয়ে চলে যায়।

    আলী অবাক হয়ে দেখে সব। পুরোহিতগুলো বেতন পায় না। ভক্তদের প্রণামীর দাক্ষিণ্যে তাদের জীবিকা চলে।

    হিন্দুদের বারমাসে তের পার্বণ। উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই আছে। মাঝে মাঝেই মেলা বসে। দূর দূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা আসে। আসে সওদাগররা। কত রকম সুন্দর সুন্দর জিনিস কেনা বেচা হয়।

    এইভাবে দেখতে দেখতে প্রায় বছরটা ফুরিয়ে আসে। আলী ভাবে এবার দেশে ফিরতে হবে। নফরটাকে সব গোছগাছ করে নিতে বলে। তারপর একদিন গালিচাখানা পেতে ওকে পাশে বসিয়ে দেশের সেই সরাইখানায় যাবার ইচ্ছা করে মনে মনে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘ তিন মাসের দুর্গম পথ পলকে পার হয়ে এসে পৌঁছয় ওরা ঐ সরাইখানার সামনে।

    বছর পুরতে আর কদিন বাকী। আলী ঠিক করে একটা দিন সে সরাইখানাতেই অপেক্ষা করবে ওর ভাইদের জন্য।

    আলী-ওরা ভাইদের জন্য বসে থাক ওখানে, আমরা এবার মেজভাই শাহজাদা হাসানের কথা বলি।

    চলতে চলতে হাসান পারস্যের এক শহরে গিয়ে পৌঁছলো। সেখানকার সেরা সরাইখানাতে একখানা ঘর ভাড়া করে মালপত্র এবং নফরটাকে সেখানে রেখে হাসান বেরুলো শহর পরিক্রমায়। কত রকম সুন্দর সুন্দর শৌখিন জিনিসের কত সব দোকান। দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়।

    হাসানের রূপে এবং ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে একসওদাগর তাকে পাশে বসিয়ে খাতির যত্ন করতে থাকে। এমন সময় হাসান লক্ষ্য করলো এক অশীতিপর সদাশয় বৃদ্ধ হাতে একটা ছোট্ট হাতীর দাঁতের চোঙ্গা নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে এগিয়ে আসছে, একেবারে পানির দামে বিকিয়ে গেলো—মাত্র তিরিশ হাজার দিনারে দিয়ে দেব। পয়সা দিয়েও এ বস্তু বাজারে কিনতে পাবেন না কেউ। একেবারে মাটির দাম—মাত্র তিরিশ হাজার।

    হাসান অবাক হয়ে সওদাগরকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা শেখ সাহেব বৃদ্ধটি এসব কী আবল তাবল বকছে! লোকটি পাগল নয় তো!

    দোকানী বলে, না না মালিক খুব সাচ্চা আদমী। আমরা বহুকাল দেখছি, কাউকে এক পয়সা ঠকায় না। ভুলেও মিথ্যে কথা বলে না কখনও। দামী দামী শখের জিনিসের দালালী করে খায়। ওর হাতে যে জিনিসটা দেখছেন ওটা ও কিনে আনেনি। কোনও সুলতান আমির ঘরের জিনিস বিক্রি করতে পাঠিয়েছে। বিক্রি হলেও কিছু দালালী পাবে মাত্র।

    হাসান বৃদ্ধকে কাছে ডাকে, আপনার ঐ হাতীর দাঁতের ছোট্ট চোঙাটির কী যাদু আছে, যে তিনিশ হাজার দিনার দাম চাইছেন?

    বৃদ্ধ হাসে, ঠকিয়ে একটা ফুটো পয়সা নেব না মালিক। লক্ষ দিনার দিলে বাজারে মিলবে না এ-জিনিস। আমার মনিবও চল্লিশ হাজারের কমে বেচতে বারণ করেছে। কিন্তু সারা শহরটা ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেলাম, একটা শৌখিন মালদার মানুষ দেখতে পেলাম না।

    —তা বস্তুটির অলৌকিক কী গুণ আছে শুনি? চোঙাটি হাসানের হাতে দিয়ে সে বলে এতে একটা চোখ রেখে আপনি যা দেখতে বাসনা করবেন তাই দেখতে পাবেন, দেখুন না–

    হাসান কৌতুক বোধ করে। অবিশ্বাস্য মনে হয় বৃদ্ধের কথা। চোখে ধরে সে নূর অল-নিহারকে দেখার বাসনা করে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রাসাদের হারেমের সুরম্য হামামে বহু সখী-পরিবৃতা হয়ে বিবসনা নূরকে জলকেলী রত দেখতে পেয়ে রোমাঞ্চিত এবং বিস্মিত হয়ে ওঠে সে। এও কি সম্ভব? এমন অপার্থিব বস্তুও পয়সা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় এদেশে? হাসান বলে, আমার সরাইখানায় চলুন, এখুনি আপনার দাম মিটিয়ে দিচ্ছি। তিরিশ হাজার নয় চল্লিশ হাজারই পাবেন আপনি। এবং আপনার দালালী হিসেবে আরও এক হাজার বেশি দেব। হাসান ভাবে, এমন এক আজব জিনিস সে হাতে পেয়েছে—তাকে আর হারায় কে? তার ভাইরা দেখলে হাঁ হয়ে যাবে না?

    হাসানেরও একই সমস্যা হলো। বছর শেষের অনেক বাকী। কিন্তু তার আগে দেশে ফেরাও যাবে না। তাই পারস্যেরই নানা দর্শনীয় জায়গা দেখে সে দিন কাটাতে লাগলো।

    তারপর বছরের শেষের দিকে সময় হিসেব করে একদিন সে ঐ সরাইখানায় এসে হাজির হলো।

    আপনারা সবাই জানেন তার আগে বড় ভাই আলী সেখানে পৌঁছে গিয়েছে।

    এবার ছোটজন হুসেনের কথায় আসি।

    চলতে চলতে হুসেন এসে পৌঁছল সমরখন্দে—জাঁহাপনার ছোট ভাই শাহজামান এখন যেখানে সুলতান হয়ে আছে।

    যথারীতি সেও শহরের এক সম্ভ্রান্ত সরাইখানায় আশ্রয় নিয়েছিলো।

    একদিন শহর দেখতে পথে বেরিয়েছে হুসেন, এক ফেরিওয়ালার হাতে তরমুজ সদৃশ বিরাট আকৃতির একটি আপেল দেখে সে কৌতূহলবশে জিজ্ঞেস করলো, এতো বড় আপেল তো কখনও দেখিনি গো? এটা কোন দেশের মাটিতে ফলে?

    লোকটি হেসে বললো, না মালিক এ ফল গাছে ধরেনি। এক বিজ্ঞানী যাদুকরের তৈরি।

    -কত দাম?

    –মাত্র তিরিশ হাজার দিনার পেলে দিয়ে দেব। আমার মালিক চল্লিশ হাজারের কমে বেচতে বারণ করেছে। কিন্তু সারা শহর ঘুরে একজন সমঝদার মানুষ পেলাম না। তাই ঠিক করেছি, তিরিশ হাজারেই দিয়ে দেব।

    হুসেন বলে, তুমি কী মস্করা করছো আমার সঙ্গে একটা ফলের দাম তিরিশ হাজার দিনার?

    মস্করা কেন করবো, জনাব! আপনি এর আজব গুণের কথা জানেন না, তাই অবাক হচ্ছেন। এ আপেল খাওয়ার জন্য নয়, এর গন্ধ শুকলে দিল খুশ হয়ে যায়, দুরারোগ্য বিমারী সেরে যায়।

    হুসেন পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। নাকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আপেলটায় আঘ্রাণ করতেই দেহের সকল অবসাদ কেটে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে ওঠে সে।

    লোকটি বলে, কী অবাক হয়ে গেলেন? দাঁড়ান এখনও আসল প্রমাণ আপনাকে দিইনি।

    একটা লোক কুরুগীকে পিঠে বেঁধে নিয়ে আসছিলো। লোকটি আপেলটা ঐ পঙ্গু কুরুগীর নাকে নিয়ে গিয়ে ধরতেই রুগীটা চটপট করে ঝোলা থেকে লাফিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে পড়লো। হুসেন দেখলো, ওর দেহে আর কোনও ক্ষত বা দাগ কিছুই নাই। দিব্যি সুস্থ তাগড়াই একটি জোয়ান মানুষ।

    হুসেনের মন আনন্দে নেচে উঠলো। এমন অলৌকিক বস্তু যদি তার হাতে থাকে তবে তাদের ভাইদের সে ডরাবে কেন? তারা যত চেষ্টাই করুক, এর চেয়ে আজব জিনিস আর কী জোগাড় করতে পারে।

    লোকটিকে সরাইখানায় নিয়ে গিয়ে একচল্লিশ হাজার দিনার গুণে দিয়ে আপেলটা সে কিনে নেয়।

    বছরের বাকী সময়টা সমরখন্দে নানা জায়গা সফর করে যথাসময়ে একদিন সে সেই সরাইখানায় এসে বড় দুই ভাই-এর সঙ্গে মিলিত হয়।

    একটা বছর পরে আবার একত্রিত হতে পেরে সকলেই খুব খুশি হয়ে আনন্দে আলিঙ্গন করে।

    খানা-পিনা শেষ হলে বড় ভাই বলে, এবার আমরা কে কি সংগ্রহ করে এনেছি—এসো দেখাই।

    আলী তার আশ্চর্য গালিচা বের করে বলে, এর সাহায্যে পলকের মধ্যে পৃথিবীর অপর প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। এসো আমরা তিন ভাই এর উপর চেপে বসি। তারপর দেখবে কোথায় নিয়ে যাবো তোমাদের।

    পলকের মধ্যে দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সাত সমুদ্র তের নদী পারের এক দেশে নিয়ে গেলো আলী। এবং পর মুহূর্তেই আবার সরাইখানায় ফিরে এলো তিনজন।

    মেজ ভাই বের করলো সেই হাতীর দাঁতের চোঙাটা। বললো, জিনিসটা দেখতে অতি সাধারণ, কিন্তু এতে চোখ রেখে দুনিয়ার যা কিছু দেখতে চাইবে দেখতে পাবে। এই মুহূর্তে আমাদের বোন নুর কী করছে, দাঁড়াও, দেখে আমি বলে দিচ্ছি।

    এই বলে হাসান চোঙাটা ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠলো।

    দুই ভাই বুঝতে না পেরে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কী? কী দেখলে?

    হাসান বলে, আর কী হবে এসবে? নুর মৃত্যুশয্যায়। বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। তার চারপাশে হারেমের মেয়েরা ঘিরে আছে। তাদের সকলের চোখে মুখে কী নিদারুণ হতাশা। আমরা পৌঁছবার আগেই নুর হয়তো ইন্তেকাল করবে।

    হাসান-এর হাত থেকে চোঙটা নিয়ে আলী চোখে লাগিয়ে হাসানের কথার সত্যতা যাচাই করতে যায়।

    -না না, আর তো দেরি করা যায় না, চলো, এখুনি প্রাসাদে পৌঁছে যাই। এসো আমার গালিচায় বস তোমরা।

    ঘোড়াগুলো সঙ্গে দিয়ে নফরদের রওনা করে দিয়ে তিনভাই গালিচায় চেপে তক্ষুনি প্রাসাদের হারেমে এসে পৌঁছায়। নূর বিছানার সঙ্গে লীন হয়ে গেছে। বাহ্যজ্ঞান সব লোপ পেয়ে গেছে। তা না হলে আজন্মের সাথী তিন ভাইকে সামনে দেখেও চিনতে পারে না? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

    হুসেন আপেলটা নাকের কাছে ধরতেই নূর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে। এক বছর বাদে তিনভাইকে এক সঙ্গে দেখে খুশিতে ডগমগো হয়ে বলে, বিদেশে সবাই ভালো ছিলে ভাইজান?

    —আমরা ভালোই ছিলাম। কিন্তু তোমাকে এমন বিমার দেখে আমরা তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যাক, এখন কেমন লাগছে?

    নূর বলে, খুব ভালো, আমি তো আগের চেয়েও সুস্থ হয়ে গেছি। এখন আমার একটু অসুখ নাই, ভাইজান।

    রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো দশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে : তিন ভাই সুলতানের কাছে এসে তাদের নিজ নিজ সংগৃহীত পরমাশ্চর্য বস্তুর অলৌকিক গুণাবলী প্রদর্শন করলো। সুলতান হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তিনটি জিনিসই তিন দিক থেকে অনন্য সাধারণ। কোনও ভাবে কাউকে খাটো করে দেখতে পারি না আমি। সুতরাং এখন নতুন এক সমস্যার মধ্যে পড়লাম আমি। এ অবস্থায় তোমাদের কোন ভাই-এর হাতে নূরকে সঁপে দিতে পারি আমি? যাই হোক, আর একটা পরীক্ষা তোমাদের দিতে হবে। কাল সকালে পোলো মাঠে হাজির হবে তোমরা। তিন ভাইকেই তীর ছুঁড়তে হবে। যার তীর সবেচেয়ে বেশি দূর যাবে, সেই পাবে নূরকে।

    পরদিন সকালে যথাসময়ে তিন ভাই হাজির হলো পোলো মাঠে। আলী এবং হাসানের চেয়ে হুসেন অনেক বেশি দূর পাঠিয়ে দিলো তার তীর। সুলতান এবার একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক, এবারে একটা ফয়সালা হয়ে গেলো। তোমাদের দুজনের মনে কোনও খেদ থাকার কারণ নাই, হাসানই নুরকে লাভ করার যোগ্যতম পাত্র। আর দেরি করতে চাই না, আজই আমি ঘোষণা করে দিচ্ছি, হাসানের সঙ্গে নূর-এর শাদী হবে।

    দুঃখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো আলী। প্রকাশ্যে সে জানিয়ে দিলো সুলতানকে, মসনদে তার লোভ নাই এতোটুকু। ভোগ-বিলাস থেকে বিরত হয়ে সে দরবেশের বেশে পথে বেরিয়ে পড়লো।

    ছোট ভাই হুসেন কিন্তু মনের দুঃখে বিবাগী হতে পারলো না। ওর মনে একটা সংশয়-এর কুণ্ডলী পাকাতে থাকলো। বড় ভাই আলীর তীর বেশি দূরে যেতে পারিনি। কিন্তু হুসেনের তীর দৃষ্টির অগোচরে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু সুলতান হাসানের তীর আরও বেশি দূরে গেছে বলে রায় দিলেন।

    হুসেন ঠিক করলো তীরখানা খুঁজে বের করবেই। পোলো মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ। হুসেন তীরখানা খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূর চলে গেলো। কিন্তু না কোথাও দেখতে পেলো না। অবশেষে সে মরিয়া হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। কিন্তু না, কোথাও দেখতে পেলো না সে তীর। হুসেন অবাক হয়ে ভাবে, কোথায় যাবে, আর কত দূরই বা যেতে পারে? আরও খানিকটা ওপরে উঠতে একটা পার্বত্য পথের নিশানা পেয়ে সেইদিকে চলতে থাকলো সে। চলতে চলতে একটি বিশাল বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এই দরজার পাল্লায় গেঁথে গেছে তীরখানা। আশ্চর্য! পোলো মাঠ থেকে এতো দূরে এ তীর এলো কী করে!

    যাই হোক, দরজা থেকে টান দিয়ে তীরখানা সে খুলে নিলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজাখানা খুলে গেলো ওর মুখের সামনে।

    এক অলোক সামান্যা সুন্দরী বেরিয়ে এলো বাইরে। তার সঙ্গে এক দঙ্গল সহচরী। তরুণীর বিলাসবহুল বেশবাস এবং রূপের জেল্লা দেখে হুসেনের বুঝতে অসুবিধে হয় না, এ মেয়ে সাধারণ কেউ নয়, নিশ্চয়ই কোনও শাহজাদী হবে।

    হুসেন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি প্রশ্ন করে, কী দেখছো, শাহজাদা হুসেন?

    হুসেন! তার নাম সে জানলো কী করে?

    -আপনি কে? আমি বুঝতে পারছি না, আমার নাম কী করে জানলেন আপনি?

    মেয়েটি বললো, উঁহু, এখানে বাইরে দাঁড়িয়ে কোনও কথা নয়, আগে ভেতরে চলো, তারপর তোমার সব কথার জবাব দেবো।

    হাত ধরে শাহজাদী হুসেনকে প্রাসাদের অভ্যন্তরে নিয়ে গেলো। কক্ষের জাঁকজমকে চোখ ঝলসে যায়। একটা শৌখিন মখমলের গদীতে ওরা দু’জনে পাশাপাশি বসলো। মেয়েটি বললো, তোমার প্রতীক্ষাতেই এতকাল এখানে বসেছিলাম। আমি জিন-সম্রাটের কন্যা। তোমার সঙ্গেই আমার ভাগ্য বাঁধা হয়ে আছে। আমারই অলৌকিক ক্ষমতায় তীরখানা আমার দরজায় এনে রেখেছিলাম। জানি, তুমি ঐ তীরের সন্ধান করতে করতে আমার এখানে আসবেই। আমার হিসেব কিন্তু নির্ভুল। দ্যাখো, সত্যিই তুমি এলে। আমারই যাদুবলে বিশানগড়ে গালিচা, সিরাজে হাতীর দাঁতের চোঙা এবং সমরখন্দে ঐ আপেল সংগ্রহ করতে পেরেছিলে তোমরা।

    তোমাদের বোন নূর অল-নাহারকে পাওয়ার জন্য তোমরা পাগল হয়েছিলে। তোমার বড় ভাই আলী তো মনের দুঃখে ঘর ছেড়ে ফকির দরবেশ হয়ে গেলো। এখন তুমি কি করবে? ঐ তীরখানা বুকে গেঁথে আত্মহত্যা করবে কী?

    জিন-সম্রাট-কন্যা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলে, দ্যাখো, আমার দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে দ্যাখো, হুসেন। আমি কী তোমার ভগ্নীর চেয়ে কিছু কম সুন্দরী? কী, আমাকে তোমার পছন্দ হয় না? তুমি যদি অমত না কর, আমি তোমাকে শাদী করতে চাই, হুসেন। করবে আমাকে শাদী?

    মেয়েটির এই আচমকা প্রশ্নের কী জবাব দেবে হুসেন? সত্যি সে তুলনাবিহীন পরমাসুন্দরী। নূর অল-নাহার-এর রূপের খ্যাতি দেশ-জোড়া। কিন্তু এর কাছে তার রূপম্লান হয়ে যায়। হুসেন বললো, কিন্তু তোমার মা বাবার মত হবে কেন? তুমি জিন-সম্রাট-নন্দিনী, আবার আমি মানব-সন্তান, এ শাদীতে সম্মত হবে কেন তারা?

    আবার সুন্দর করে হাসল মেয়েটি, ওসব নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। মা বাবা কেউ নয়। আমি নিজেই আমার মালিক। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাই সব। এখন তোমার মতকী, তাই বলো।

    হুসেন বলে তোমাকে পেলে আমি ধন্য হবো। মেয়েটি আবার হাসে, কেন, তোমার ভগ্নী নূরের জন্য মন খারাপ করবে না?

    -না। সে এখন আমার জীবনে মৃত। আর তা ছাড়া রূপে গুণে কোনও দিক থেকে সে তোমার সমকক্ষ হতে পারে না। তুমি বিশ্বাস কর, তোমাকে পেলে আমার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে

    উঠবে।

    মেয়েটি এবার হুসেনকে দু’হাতে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে গভীর আশ্লেষে চুম্বন করে।

    —এই আমাদের শাদী হয়ে গেলো। এখন থেকে তুমি আমার স্বামী, আর আমি তোমার সহধর্মিণী। আচ্ছা, চলো, এবার পাশের ঘরে যাই। খানা-পিনা সাজিয়েছে ওরা, খেয়ে দেয়ে শুতে যাবো আমরা।

    পাশের ঘরটায় হাজারো রকমের খাবার-দাবার সাজানো ছিলো টেবিলে। দু’জনে পরিতৃপ্তি করে আহার পর্ব শেষ করে পাশের আর একখানা ঘরে এলো। জিন-কন্যার শোবার ঘর। এমন সুন্দর করে সাজানো-গোছানো স্বপ্নপুরীর মতো বাসরঘর হুসেন কল্পনাও করতে পারেনি এর আগে।

    সাকী মদ ঢেলে দিলো সোনার পেয়ালায়। একটা পেয়ালা তুলে হুসেনের ঠোঁটে ধরলে জিনিয়াহ। বললো, চুমুক দাও।

    হুসেনের সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেলো। এমন অনাস্বাদিত আনন্দ সে এই প্রথম অনুভব করলো।

    সুখের সায়রে ভাসতে ভাসতে দুটা মাস অতিবাহিত হয়ে গেলো। একদিন হুসেন বললো, অনেক দিন প্রাসাদ ছেড়ে এসেছি। বাবা বড় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একবার তার সঙ্গে দেখা করে আসা দরকার।

    জিনিয়াহ বললো, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারি, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে বাঁচবো কি করে? না, না, একটা দিন, একটা পলও তোমাকে চোখের আড়াল করতে পারবো না আমি।

    হুসেন জিনিয়াহকে আদর করে চুমু খেয়ে বললে, আমি চিরকালের জন্য তোমারই গোলাম হয়ে গেছি সোনা। আমিই কি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো? শুধু বাবার সঙ্গে একবার দেখা করেই আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে। কিন্তু তুমি না বললে তো আমি যেতে পারবো না।

    জিনিয়াহ বললো, বেশ, মাত্র তিন দিনের জন্য তোমাকে আমি যেতে দিতে পারি। আমার সশস্ত্র প্রহরীরা তোমার সঙ্গে যাবে। যদি কোনও বিপদ আপদ ঘটে, ওরা তোমাকে রক্ষা করবে।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    আটশো বারতম রজনীঃ

    আবার সে বলতে থাকে–

    আর একটা কথা, ভুলে কখনও তোমার বাবা বা অন্য কাউকে বোলো না, তুমি একটি জিন-কন্যাকে শাদী করেছ। এবং আমার এই প্রাসাদের ঠিকানাও যেন তারা কেউ জানতে না পারে। শুধু তোমার বাবাকে বলবে, ভাববার কোনও কারণই নাই, তুমি খুব সুখ সম্ভোগের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছো।

    জিনিয়াহ হুসেনের নিরাপত্তার জন্য কুড়িজন সশস্ত্র ঘোড়-সোয়ার সৈন্য সঙ্গে দিয়ে রওনা করে দিলো।

    বেশি দূরের পথ নয়, অল্পক্ষণের মধ্যেই হুসেন সদলবলে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলো। অনেকদিন পরে পুত্রকে ফিরে পেয়ে সুলতান আনন্দে কেঁদে ফেললেন। পুরবাসীরা উৎফুল্ল, কলমুখর হয়ে উঠলো। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সানয়নে সুলতান বললেন, আবার যে তোকে ফিরে পাবো, ভাবতে পারিনি, বাবা। ভেবেছিলাম মনের দুঃখে তুই বুঝি আত্মঘাতী হয়েছিস।

    হুসেন বললে, আপনি যা আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তা মিথ্যে না, আব্বাজান। ভালোবাসার শেকড় তো এক পলকে উপড়ে ফেলা যায় না। নূরকে হারানোর দুঃখ কি সহজে ভোলা সম্ভব? যাক, সে এখন আমার বড় ভাই-এর বেগম, তার সম্বন্ধে কোনও কামনা বাসনা পোষণ করা পাপ। আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ। আমি এই ক’মাসে নূরকে মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পেরেছি, বাবা।

    সুলতান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কী করে পারলে বাবা?

    হুসেন বলে, এর বেশি আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আব্বাজান, বলতে পারবো না। বারণ আছে। আর জেনে রাখুন, আমি খুব সুখে আছি। আমার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর বেশি কিছু আর আমার চাইবার নাই।

    সুলতান বললেন, শুনে খুব সুখী হলাম বাবা। কোনও পিতাই তার সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই জানতে চায় না। আমি চাই, যে ক’টা দিন বাঁচি, তুমি আমার পাশেই থাক। কিন্তু তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে যে তুমি পারবে না।

    হুসেন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, আব্বাজান। আমি মাঝে মাঝে এসে আপনাকে দেখে যাব। আপনার যখন দেখতে ইচ্ছে হবে তক্ষুনি এসে যাব আমি।

    সুলতান ম্লান হাসলেন, কিন্তু আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা কি করে জানতে পারবে তুমি। কোথায় কত দূর দেশে থাক তুমি তার তো কোন ঠিকানা দিতে চাও না তুমি। প্রয়োজন হলে কী করেই বা খবর দেব তোমাকে?

    হুসেন বলে, আমি কসম খেয়ে এসেছি, ঠিকানা আপনাকে আমি দিতে পারছি না, আব্বাজান। তবে কথা দিয়ে যাচ্ছি, প্রায়ই আমি এসে আপনাকে দেখে যাবো। মাসে অন্তত একবার আসবই।

    তিন দিন তিন রাত্রি কাটানোর পর চতুর্থ দিনে খুব ভোরে আবার সে সদলবলে প্রাসাদ ছেড়ে পাহাড় উপত্যায় জিনিয়াহর কাছে ফিরে এলো হুসেন। বলা বাহুল্য, তারই পথ চেয়ে বসেছিলো জিনিয়াহ। হুসেনকে পেয়ে খুশির বন্যায় ভেসে গেলো সে। হাসি নাচে গানে মুখর হয়ে উঠলো জিনিয়াহর প্রাসাদ। অমন অমর্ত্যলোকের আনন্দ হুসেন জীবনে কখনও উপভোগ করেনি।

    এই আনন্দধারায় একটি মাস কেটে গেলো। হুসেন মনে করলো, বাবাকে সে কথা দিয়ে এসেছে মাসান্তে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। দলবল নিয়ে সে রওনা হলো সুলতানের প্রাসাদ অভিমুখে।

    এদিকে এই মাসখানেকের মধ্যে সুলতানের পার্শ্বচররা নিয়ত তার কানে কুমন্ত্রণা দিতে কসুর করেনি।

    —শাহজাদা হুসেনের জাঁকজমকের বহরটা লক্ষ্য করেছেন জাঁহাপনা? যে সাজ-পোষাক সে পরে এসেছিলো, তেমন মহামূল্য বস্তু সারা আরব দুনিয়ার কোনও সুলতান বাদশাহর প্রাসাদে নাই। আর তা ছাড়া, আপনি তার পরমারাধ্য পিতা। কোথায় অবস্থান করছে, ঠিকানা জানাতে সে অস্বীকার করলো কেন? মনে হচ্ছে এর পিছনে কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে।

    আর একজন পারিষদবললে, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন, জাঁহাপনা?শাহজাদার দেহরক্ষী ঐ সৈন্যগুলো কেমন ঝকঝকে থাকে! ওদের জমকালো পোশাক-আশাকে এতোটুকু ধুলোবালি লাগেনি। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সদ্য সেজেগুজে এসে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এ থেকে বুঝতে কি অসুবিধে হয় যে শাহজাদা আমাদের শহর থেকে খুব বেশি দূরে কোথাও থাকে না।

    উজির ঘাড় নেড়ে সায় দিলো এ কথায়, হুঁ, ঠিক, ঠিক বলেছ। এই শহরেরই আশেপাশে কোনও গোপন ডেরায় সে আস্তানা গেড়েছে। মনে হচ্ছে, উদ্দেশ্য মহৎ নয়, জাঁহাপনা।

    সুলতান ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, কী কী বলতে চাও তোমরা?

    উজির বললো, শাহজাদার আড়ম্বর এবং ভাবভঙ্গী দেখে মনে হলো, সে প্রাচুর্যের মধ্যে বেশ বাদশাহী মেজাজেই দিন কাটাচ্ছে। এবং এও পরিষ্কার, এ শহর থেকে সে খুব বেশি দূরেও থাকে না । আমার ধারণা গোপনে গোপনে সে শক্তি সঞ্চয় করছে। এবং এখন সে জাঁহাপনার একান্ত অনুরক্ত থাকলেও খুব শিগিরই একদিন তার নিজের স্বরূপ দেখাতে দ্বিধা করবে না।

    সুলতান টেবিলে ঘুষি মেরে চিৎকার করে ওঠে,-খামোকা এসব কথার মানে কী? উজির বিনীতভাবে বলে, অর্থ একটাই জাঁহাপনা। এবং তা অত্যন্ত স্বচ্ছ। সময় এবং সুযোগ বুঝে সে আপনাকে সিংহাসনচ্যুত করবে।

    –অসম্ভব। আমার হুসেনকে আমি চিনি। এসব তোমাদের মনগড়া আশঙ্কা।

    উজির বলে, আপনার কথাই সত্যি হোক, ধর্মাবতার, আমাদের আশক্ষা যেন মিথ্যাই হয়। কিন্তু একটা কথা আপনি ভেবে দেখুন, জাঁহাপনা, শাহজাদি নূর অল-নাহার তার নয়নের মণি ছিলো। আপনি

    তার বাড়াভাতে ছাই দিয়েছেন। আপনার বিচার যত সূক্ষ্মই হোক, শাহজাদা হুসেন কিন্তু তা উদার চিত্তে মেনে নিতে পারেনি। তা হলে সে ঐ ভাবে প্রাসাদ থেকে অন্তর্ধান হয়ে যেত না। এই ক’মাস বাদে আবার সে ফিরে এসেছিলো আপনার কাছে, তা কিন্তু শুধু পিতৃভক্তি বা ভালোবাসার টানেই নয়, তার পিছনে অন্য একটা সুপরিকল্পিত গৃঢ় উদ্দেশ্য ছিলো।

    —গূঢ় উদ্দেশ্য?

    সুলতান বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে উজিরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

    -হ্যাঁ, জাঁহাপনা, গভীর এক কূট উদ্দেশ্য নিয়ে সে এসেছিলো আপানর কাছে। তাকে দেখা মাত্রই আপনার কি মনে হয়নি, অন্তত অর্থবলে সে আপনার চেয়ে অনেক বলীয়ান? তার সাজ-পোশাকে যে মহামূল্য মণিরত্নাদি বসানো ছিলো তার কিমত আপনার সমগ্র সলতানিয়তের চাইতেও বেশি!

    সুলতান গম্ভীরভাবে বললেন, দেখেছি। হ্যাঁ, সে কথা একসোবার ঠিক। কিন্তু তাতে আমি ঈর্ষান্বিত হব কেন। বরং এ তো আমার গৌরবের কথা!

    উজির বলে, আপনি বড় উদার মহৎ সরল প্রাণ। কিন্তু হুকুমমত চালাতে গেলে বিচক্ষণ কূটনীতিজ্ঞ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সে তার ঐশ্বর্য দেখাতে এসেছিলো। এবং একথা তো আপনি মানেন, পয়সা যার হাতে পৃথিবী তার পায়ে।

    সুলতান, বললো, এ তো সবাই জানে। মানবো না কেন?

    উজির বলে, তাহলে বুঝুন, পয়সা দিয়ে সে শৌর্য বীর্য বিক্রম সবই কিনতে পারে। সুতরাং আজ না থাকলেও কালক্রমে সে আপনার চেয়ে অনেক বলশালীও হতে পারে। এবং তখন যদি সে আপনাকে মসনদ থেকে নামিয়ে কারারুদ্ধ করে তাতে কী অবাক হবেন?

    -না না না, সে কখনও হতে পারে না। হুসেন—আমার হুসেন কখনও অমন কাফের হতে পারে না উজির।

    —কিন্তু জাঁহাপনা, এই-ই ইতিহাস। যুগে যুগে এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে আসছে—

    -না না। ওসব বলে আমার সব গোলমাল করে দিও না তোমরা। হুসেন কখনও অমনটি হতে পারবে না।

    উজির কুর্ণিশ জানিয়ে বলে, গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, সুলতান মহনুভব, আমরা অধম হীনমন্য মানুষ, কী বলতে কী বলে আপনার দুঃখের কারণ হলাম—এজন্য গভীর অনুতপ্ত বোধ করছি।

    সুলতান উদভ্রান্তের মতো বললেন, জানি না, কী বিশ্বাস করা উচিত আর কী বিশ্বাস করা উচিত নয়। যাই হোক, তোমাদের এই পরামর্শের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতে আমি সজাগ থাকবো এ ব্যাপারে।

    সুলতান সেদিনের মতো তার হিতাকাঙ্ক্ষীদের বিদায় করে দিলেন।

    শাহজাদা হুসেন সুলতানের কাছে এসে ভক্তিভরে প্রণামাদি জানিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলো, আব্বাজান, আপনার শরীর ভালো ছিলো তো এক মাস?

    সুলতান ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই যেদিন থেকে ভালো আছিস শুনেছি, সেদিন থেকে আমি খুব ভালো আছি বাবা।

    ছেলেকে কাছে পেয়ে তার মনে সকল সংশয় অন্তর্হিত হয়ে গেলো নিমেষে। হুসেনের অপাপবিদ্ধ মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, ওরা মিথ্যেই সন্দেহ করেছে, নানা, শিশুর মতো সরল এই হুসেন কখনও নৃশংস নির্মম হতে পারে না। মিথ্যে, মিথ্যে ওদের সবসন্দেহ।

    পরদিন সকালে কিন্তু সুলতান শহরের এক নামকরা যাদুকরী বৃদ্ধাকে ডেকে এনে বললেন, দেখ বুড়ি, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। লোকে বলছে, আমার ছেলে হুসেন নাকি এই শহরের আশেপাশে কোনও গোপন ডেরায় বাস করে। সে তার ঠিকানা বলেনি আমাকে। তোমাকে এই কাজটি গোপনে করে দিতে হবে। কাল সকালে হুসেন প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাবে। তুমি ঐ সময় তাকে অনুসরণ করে পিছনে পিছনে যাবে।

    বুড়ি বললো, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন জাঁহাপনা, সব নাড়ি নক্ষত্র আমি জেনে এসে বলবো আপনাকে।

    মাসখানেক বাদে হুসেন আবার বাবার সঙ্গে দেখা করতে জিনিয়াহর প্রাসাদ ছেড়ে সদলবলে বেরিয়ে পড়লো। একটু এগোতেই দেখতে পেলো এক অশীতিপর বৃদ্ধা জরাগ্রস্ত রুগীর মতো এক প্রস্তরখণ্ডের ওপর শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। হুসেন এগিয়ে এসে ডাকলো, কে গো, এখানে শুয়ে কে?

    —আমি মালিক, আমি এক অথর্ব, জ্বরে ব্যথায় আর চলতে না পেরে এখানেই পড়ে আছি কাল থেকে।

    হুসেন জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে তুমি?

    যাবো তো শহরে। কিন্তু আমার যা শরীরের হাল, তাতে এক পা চলার সাধ্যি নাই। উঃ বাবাগো, ম’লাম!

    হুসেন রক্ষীদের বললো, বুড়িকে প্রাসাদে নিয়ে চলো। মনে হচ্ছে, কঠিন অসুখ করেছে। দাওয়াই পত্র না খেলে হয়তো আর বাঁচবে না।

    দু’জন রক্ষী বুড়িকে তুলে ধরাধরি করে পাহাড়-প্রাসাদে নিয়ে আসে। হুসেনকে ফিরে আসতে দেখে জিনিয়াহ ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, ফিরে এলে যে?

    হুসেন বলে, এই বৃদ্ধা পাহাড়ের নিচে একটা পাথরের চাঁইয়ের উপর শুয়ে কাতরাচ্ছিল, মনে হচ্ছে ভারি অসুখ করেছে। ওকে একটু সেবা যত্ন করে সুস্থ করতে হবে।

    বৃদ্ধার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিলো জিনিয়াহ। তারপর হুসেনকে উদ্দেশ্য করে বললো, তোমার দয়ার শরীর, অন্যের দুঃখ কষ্ট দেখলে তুমি আর ঠিক থাকতে পার না! যাই হোক, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, ওর কোনও রকম অযত্ন হবে না। মনে রেখো আমার নিজের অসুখ করলে যে ভাবে সেবা যত্ন হতো, তার চেয়ে কম করা হবে না ওর জন্য! তবে শোনো, কে এই বৃদ্ধা, কী কী তার পরিচয়, কী উদ্দেশ্যেই বা ওকে এখানে পাঠানো হয়েছে এবং কেই বা পাঠিয়েছে, সব আমি জানতে পেরেছি। কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে যে চক্রান্তই হোক, আমার ওপর ভরসা রেখ, কেউ তোমার এক কণা অনিষ্ট করতে পারবে না। আমি মন্ত্রবলে আগে থেকেই সব জানতে পারি। কার কি মনের অভিসন্ধি সব আমি জানি। সে জন্যে তার উপযুক্ত ব্যবস্থাও আমার পাকা করা আছে। তুমি নির্ভয়ে বাবাকে দেখতে যাও। কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না।

    যাদুকরী বুড়িকে একটা পালঙ্কে শুইয়ে দিলো জিনিয়াহর সহচরীরা। একজন এক গেলাস জল এনে বুড়ির সামনে ধরে বললো, এই পানিটুকু খেয়ে নাও তো, সব বিমার এখুনি সেরে যাবে। সিংহ-ঝরনার পানি। এ পানি খেলে সব রোগ সেরে যায়।

    বুড়ি জলটুকু এক নিঃশ্বাসে পান করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে শুয়ে রইলো। তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে অবাক হয়ে বললো, বাঃ চমৎকার দাওয়াই তো। শরীরটা একেবারে ঝরঝরে চাঙ্গা হয়ে উঠলো। নিজে নিজেই সে পালঙ্ক ছেড়ে নেমে দাঁড়ালো। পরিচারিকাদের বললো, তোমাদের মালকিনের কাছে নিয়ে চলো আমাকে, তাকে আমার সুক্রিয়া জানাবো।

    একটার পর একটা নয়ন-মনোহর কক্ষ পেরিয়ে সে এক বিশাল মহলে এসে দাঁড়ালো। দরবার মহল। ঠিক মাঝখানে এক সোনার সিংহাসনে বসেছিলো জিনিয়াহ! বুড়ি আভূমি অবনত হয়ে কুর্নিশ জানালো জিনিয়াহকে।

    —আপনার কৃপায় আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছি। জিনিয়াহ বললো, আপনার যতদিন খুশি এ প্রাসাদে অবস্থান করুন। আমার মেয়েরা আপনার সেবা যত্ন করবে।

    বুড়ি বললো, না মালকিন, আমি বেশ সেরে গেছি, এখন আমার ঘরে ফিরে যেতে চাই।

    জিনিয়াহ বললো, বেশ আপনার যা অভিরুচি।

    প্রাসাদের সবগুলি কক্ষের জাঁকজমক এবং আড়ম্বর দেখে সে হতবাক হয়ে গেলো। এতে ঐশ্বর্য কোথা হতে এলো এখানে?

    শহরে ফিরে এসে সুলতানকে সবিস্তারে সব জানালো সে। উজির আমিররা বললো, জাঁহাপনা, আমরা যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা তো মিথ্যে নয়! আপনি আর সাপ নিয়ে খেলবেন না। এবার শাহজাদাকে কারাগারে নিক্ষেপ করুন। না হলে সেই আপনাকে কারারুদ্ধ করবে।

    সুলতান বললেন, ঠিক আছে আমি এক্ষুনি হুসেনকে ডেকে পাঠাচ্ছি।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই হুসেন এসে দাঁড়ালো। সুলতান বললেন, বেটা তোমার গরীব বাবার চেয়ে তুমি বিত্তে এবং বীর্যে অনেক বেশি বড় হয়েছ, এ আমার গর্বের কথা। আমি তোমার কাছে সামান্য একটা জিনিস উপহার চাইছি। লড়াই ক্ষেত্রে বাস করার মতো ভালো তাঁবু নাই আমার। তুমি যদি আমাকে একটা তাঁবু এনে দাও খুব খুশি হবো।

    হুসেন বললো, এ এমন বেশি কি কথা আব্বাজান, আমি আজই এনে দিচ্ছি।

    জিনিয়াহর প্রাসাদে ফিরে এসে হুসেন স্ত্রীকে বললো, বাবা আমার কাছে একটা। তাঁবু চেয়েছেন।

    জিনিয়াহ শুনে অবাক হলো, সে কি, এতো বস্তু থাকতে সামান্য একটা তাঁবু। চাইলেন তিনি? যাই হোক, এক্ষুনি আমি ভাড়ার থেকে আনিয়ে দিচ্ছি।

    খাজাঞ্চীকে ডেকে সে হুকুম করলো, সাইবাহকে বলল, সে যেন একটা। বিরাট বড় দেখে তাঁবু নিয়ে আসে এখানে। তাঁবুটা যেন খুব বড় হয়, যাতে গোটা একটা সেনাবাহিনী ঘুমোতে পারে।

    একটু পরে সাইবাহ এসে হাজির হলো। লোকটার চেহারা বড় অদ্ভুত। লম্বায় সে বড় জোর এক হাত; কিন্তু লোকটার গোঁফজোড়া ইয়া বড়-তার দেহের চেয়েও বিরাট। তার এক কাঁধে একখানা গদা সদৃশ লোহার ডাণ্ডা। অন্য কাধে গুটানো একখানা তাঁবু। খুব ছোট্ট একটা পুটলির মতো।

    জিনিয়াহ ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললো, এইটুকু একটা তাঁবু এনেছ? আমি তো বলেছিলাম অনেক বড় দেখে আনতে।

    সাইবাহ কুর্নিশ জানিয়ে সবিনয়ে বললো, জী, বহুত বড়ই এনেছি।

    এই বলে সে তাঁবুখানা ভাজ খুলে দেখালো, গোটা একটা সৈন্যবাহিনী দিব্যি শুয়ে বসে কাটাতে পারে তার ভিতর।

    জিনিয়াহ খুশি হয়ে বললো, বাঃ বেশ এনেছ! এখন ওটা নিয়ে তুমি আমার স্বামীর সঙ্গে তার বাবার প্রাসাদে যাও। সুলতানকে ভেট দিয়ে এসো।

    সাইবাহ বললো, জো হুকুম মালকিন। রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো চৌদ্দতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    সাইবাহকে সঙ্গে নিয়ে হুসেন সুলতানের দরবারকক্ষে প্রবেশ করে। সুলতান তখন উজির আমির পরিবৃত হয়ে মসনদে আসীন ছিলেন! হুসেন বললো, আপনার তাঁবু এনেছি জাঁহাপনা, আপনি মেহেরবানী করে গ্রহণ করুন।

    সুলতান সন্তুষ্ট হয়ে হুসেনকে কাছে ডেকে মসনদে বসিয়ে দিয়ে বললেন, আমার বয়স হয়েছে বাবা, এখন আমি মক্কায় গিয়ে আল্লাহর নাম গান করবো। এখন থেকে তোমাকেই আমি সুলতান করলাম। তুমি আদর্শ শাসক হয়ে প্রজা পালন কর।

    সেইদিন থেকে হুসেন সুলতান হয়ে দেশ শাসন করতে লাগলো।

    শাহরাজাদ নতুন কাহিনী বলতে শুরু করে :

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.