Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৪.১৮ আলিবাবা ও চল্লিশ চোর

    শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :

    অনেক অনেক দিন আগে পারস্যের কোনও এক শহরে কাসিম ও আলিবাবা নামে দুই ভাই বাস করতো।

    ওদের বাবা নেহাতই এক সাধারণ গৃহস্থ মানুষ ছিলো। সে যখন মারা গেলো, দুইভাগে সামান্যই পেলো ওরা পিতৃসম্পদ!

    কিছুদিন পরে দুই ভাই-ই একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লো। দিনান্তে দু’খানা রুটির সংস্থানও আর রইলো না।

    বড় ভাই কাসিম এক ছোকরা পাগলা বুড়োর নেকনজরে পড়ে গেলো। তার দৌরাত্ম্য সহ্য করে দাঁত মুখ কামড়ে সে পড়ে রইলো বুড়োর লেজুড় ধরে। বুড়োটা কাসিমকে সত্যিই ভালোবাসতো। তাই, তার নিজের বলবীর্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন বুঝতে পারলো সবই ফুরিয়ে শেষ হয়ে গেছে তখন সে সুন্দরী একটা মেয়ের সঙ্গে কাসিমকে শাদী দিয়ে দিলো। মেয়েটির সঙ্গে সে নগদ বেশ কিছু অর্থ এবং বাজারে একখানা সওদাগরী দোকানের মালিক হয়ে গেলো। এইভাবে সে দারিদ্র্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলো একদিন।

    আলিবাবা একটু ভিন্ন ধাঁচের ছেলে। সে সভাবে খেটে খেতে চায়। তাই সে বনে বনে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে আহার্য সংগ্রহ করতে লাগলো।

    আলিবাবার কোনও বাবুগিরি ছিলো না। খুব মিতব্যয়ী ছেলে সে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে যা রোজগার করে তার নামমাত্র খানা-পিনায় খরচ করে বাকীটা সে সযত্নে জমিয়ে রাখে।

    কিছুদিন বাদে আলিবাবা তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একটি গাধা কিলো। কিছুদিন পরে একটি এবং তারও কিছুদিন পরে আরও একটি গাধার মালিক হলো সে।

    প্রতিদিন গাধা তিনটিকে সঙ্গে নিয়ে সে বনে যায়। তাদের পিঠে চাপিয়ে বেশ মোটা মোটা কাঠ লকড়ি নিয়ে শহরে ফিরে আসে।

    তিন তিনটি গাধার মালিক হওয়ার পর কাঠুরেদের মধ্যে ভীষণ আদর ইজ্জত বেড়ে গেলো আলিবাবার। এক সতীর্থ কাঠুরে তার কন্যাকে শাদী করার জন্য প্রস্তাব পেশ করলো আলিবাবার কাছে। বললো, দেনমোহর হিসেবে ঐ গাধা তিনটে শাদীনামায় লিখে দিলেই যথেষ্ট হবে।

    বাবা বিশেষ গরীব, শাদীর সময় মেয়েকে কিছুই দিতে পারলো না কাঠুরে। যাক, ও নিয়ে ভেবে কি লাভ। আল্লাহর মেহেরবানী থাকলে গরীবের বড় লোক হতে আর কতটুকু সময় লাগে?

    শাদীর কয়েক বছরের মধ্যে আলিবাবার বেশ কয়েকটি ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চাকাচ্চা হলো। আনন্দে ভরে উঠলো ওদের সংসার। নাই বা থাকলে প্রাচুর্য, যা জুটছে, তাই যদি খুশি চিত্তে ভোগ করতে পারা যায় তার চাইতে বেশি আনন্দ আর কোথায় মিলবে?

    একদিন আলিবাবা যথা নিয়মমতো বনে ঢুকে গাধা তিনটিকে চরতে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো কাঠের সন্ধানে। ঘুরতে ফিরতে এক সময় গভীর গহনে ঢুকে পড়লো। অবশ্য সেখান থেকেও সে বেশ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল গাধাগুলোর সুললিত কণ্ঠস্বর।

    কিন্তু একটুক্ষণ পরে গর্দভ রব ছাপিয়ে অশ্বখুরধ্বনি শুনতে পেয়ে চমকে উঠলো আলিবাবা। এই বনাঞ্চলে এমন অশ্ববাহিনীর আগমন ঘটতে পারে কি উদ্দেশ্যে? আলিবাবা আঁচ করতে পারে না। ভয়ে শিউরে উঠলো সে। নিশ্চয়ই কোনও দুর্ধর্ষ দস্যুদল অথবা ফৌজবাহিনী হতে পারে।

    তাড়াতাড়ি একটা ঝাকড়া গাছের গুড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো সে। একটার শাখা-ডালে বসে নিজেকে পাতার আড়ালে ঢেকে, নিচের বনপ্রবেশ নিরীক্ষণ করতে লাগল।

    একটু পরে দেখলো, একদল ডাকাত এসে থামলো তার গাছের নিচে। টুপটাপ করে নেমে পড়লে তারা গাছতলার তৃণ-ঘন সবুজ শয্যায়।

    লোকগুলোর চেহারা দেখলে পিলে চমকে ওঠে। উফ, কি তাদের দৈত্যসদৃশ আকৃতি। চোখগুলো যেন সব জ্বলন্ত আঁটা। সকলের দাড়িই দু’ভাগ করে দু গালের দিকে পাকানো, মুখের চোয়াল কঠিন। ভয়াল ভয়ঙ্কর ওদের চাহনি। মনে হয়, অনেক চুরি ডাকাতি রাহাজানি নরহত্যার ফেরারী আসামী এরা। ওদের যে সর্দার তার মুখের দিতে তাকাতে পারে আলিবাবা। অমন কুৎসিত কদাকার বীভৎস মানুষ কখনও কল্পনা করতে পারেনি সে।

    জীনে ঝোলানো গোটাকয়েক থলে খুলে আনলো তারা। এক গোছা যবের শুকনো রুটি। গোগ্রাসে সবাই খেতে লাগলো সেগুলো। গাছের ওপর থেকে আলিবাবা গুণে দেখলো ওরা মোট চল্লিশজন।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

    ।

    আটশো বাহান্নতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে।

    খানাপিনা শেষ করে চল্লিশ চোর ঘোড়ার পিঠ থেকে বাক্স প্যারাগুলো নিজের নিজের মাথায় তুলে গভীর জঙ্গল ভেঙ্গে এগোতে লাগলো বনের মধ্যে। আলিবাবা গাছের শাখায় বসে দেখতে থাকলো ডাকাতগুলোর ক্রিয়াকাণ্ড। সেই পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে থামলো তারা। সবাই সামানপত্র নামিয়ে সার হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ চোর সর্দার পাহাড়ের দিকে মুখ করে চিৎকার করে উঠলো, চিচিং ফাঁক।

    এবং তখুনি দেখা গেলো পাহাড়ের তলদেশ থেকে মাটি দু’ভাগ হয়ে সরে গেলো খানিকটা। সর্দারের নির্দেশে এক এক করে সব সাগরেদরা সামানপত্র তুলে নিয়ে ফাটলের গর্তে ঢুকে গেল! সব শেষে নামলো সর্দার। আবার আওয়াজ উঠলো চিচিং বন্ধু।

    আর কি আশ্চর্য, আলিবাবা প্রত্যক্ষ করলো ফাটল বন্ধ হয়ে জোড়া লেগে গেলো পলকের মধ্যে।

    আলিবাবা ভাবলো, যাক বাবা, ওরা তাকে লক্ষ্য করেনি, এই যা রক্ষে!

    একই ভাবে গাছের ডালে বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

    অনেকক্ষণ পরে প্রচণ্ড শব্দ কানে এলো। আলিবাবা দেখলো, পাহাড়ের মা তলার ঐ জায়গাটা আবার দু’ভাগ হয়ে গেছে। এবং এক এক করে ঐ চল্লিশ জন চোর তাদের খালি বাক্স প্যাটরাগুলো নিয়ে আবার ওপরে উঠে আসছে।

    সকলে উঠে আসার পর সর্দার গুণে দেখলো, উনচল্লিশ জনই উঠে এসেছে কিনা। তারপর সে এ আবার হাঁক ছাড়লো, চিচিং বন্‌ধ্‌।

    তৎক্ষণাৎ ফাটলের মুখ জোড়া লেগে গেলো। ডাকাতগুলো আবার আলিবাবার গাছের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেলো স্ক ওর। যদি কোন রকমে ওরা আলিবাবার অবস্থিতি টের পায় তবে আর রক্ষা রাখবে না, একেবারে কোতল করে দেবে।

    কিন্তু না লোকগুলো এসে ওদের ঘোড়াগুলোর পিঠে চেপে আবার বন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলো।

    প্রাণে ভয়, অথচ অদম্য কৌতূহল মনে। আলিবাবা সেই মুহূর্তে ভুলে গেলো ওর তিনটি গাধার কথা, ভুলে গেলো ওর বিবি-বাল-বাচ্চাদেরও। গাছ থেকে নেমে সে উঁকি ঝুঁকি মেরে এদিক ওদিক খুব ভালো করে দেখে নিলো। নাঃ, কেউ কোথাও নাই। ডাকাতগুলো এতক্ষণে বন পেরিয়ে শহরের সীমায় পৌঁছে গেছে হয়তো বা।

    পায়ে পায়ে সে জঙ্গল ভেঙ্গে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু কি আশ্চর্য, কোথাও তো ফাটলের রেখামাত্র দেখতে পেলো না আলিবাবা। কিন্তু সে নির্ঘাৎ জানে, স্বচক্ষে দেখেছে, ঠিক এইখানেই চোরগুলো এসে দাঁড়িয়েছিলো। এবং এখানেই একটা গর্তে নেমে গিয়েছিলো তারা।

    তবে কি পুরো ব্যাপারটাই ভেল্কি! তবে কি চিচিং ফাঁক’ কথাটার মধ্যেই যাদুটা লুকিয়ে আছে? সেই মুহূর্তে আলিবাবা সব শঙ্কা ভয় ঝেড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠলো, চিচিং ফাঁক।

    দুটি মাত্র শব্দ। কিন্তু তারই কি আশ্চর্য যাদু, সঙ্গে সঙ্গে সামনের মাটি দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে গেলো। আলিবাবা দেখলো, বিরাট একটা গুহার মুখ! উন্মুক্ত হয়ে গেছে ওর সামনে। কিন্তু ভিতরটা মিশমিশে কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

    ভয়ে কেঁপে উঠলো আলিবাবা। দৌড়ে পালাবে কিনা ভাবলো। কিন্তু ভাগ্যই তাকে আটকে রাখলো সেখানে।

    সাহস করে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।

    একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। নিচে একটা প্রকাণ্ড ঘর। ঘরের দেওয়ালগুলো পাথর কুঁদা। কে বা কারা পাহাড়ের কঠিন শিলা কেটে বানিয়েছে।

    আল্লাহর নাম স্মরণ করে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। ওপরের ছাদটাও এবড়ো খেবড়ো পাথরের।

    ঘরের ঠিক মাঝখানে রাশি রাশি সামানপত্র পালা দেওয়া ছিলো। গাঁট গাঁট দামী রেশমী কাপড়, কতকগুলো বাক্সে চাদীর চাই ভর্তি, কতকগুলোয় সোনার দিনার। এছাড়া আরও কতশত দামী দামী সাজপোশাক, অলঙ্কার, নানাবিধ শখের সামগ্রী এবং খাবার-দাবার।

    আলিবাবা দেখতে পেলো ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে স্তুপীকৃত করে রাখা হয়েছে। হাজার হাজার জড়োয়া গহনা, মূল্যবান মণিমাণিক্য ইত্যাদি।

    এক কথায় সারা ঘরময়ই ঐশ্বর্যের মেলা। পা ফেলতে গিয়ে পায়ে জড়িয়ে যায় দামী দামী হার, পায়ের মল, মাথার টায়রা, আরও কত কি! আলিবাবা ভেবে পায় না, কত সহস্র লক্ষ টাকার মূল্যবান সামগ্রী বৃত্তাকারে পড়ে রয়েছে ঘরময়। এ সব ওরা পেলো কোথা থেকে? সবই চুরি ডাকাতির ধন? ভাবতেও গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। এ সব সংগ্রহ করতে কত শত সহস্র নিরীহ মানুষকেই না খুন জখম করেছে তারা। তা না হলে এই বিপুল ঐশ্বর্য, যা কোনও সুলতান বাদশাহর ভাণ্ডারেও দুর্লভ, ওরা পাবে কোথায়?

    আলিবাবা ভাবে, মাত্র চল্লিশ জন দস্যু সারাজীবন ধরে ডাকাতি রাহাজানি করে এই পর্বত প্রমাণ সম্পদ সংগ্রহ করবে কি করে? অসম্ভব, এ ধনভাণ্ডার দু’এক পুরুষের সংগ্রহে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যুগ যুগ ধরে বহু পুরুষ ধরে এসব জমা করা হয়েছে এখানে। মনে হয় ঐ ডাকাতগুলো ব্যাবিলনের সেই কুখ্যাত দস্যুদেরই বংশধর।

    গুহা অভ্যন্তরে ঐ অনন্ত ঐশ্বর্যভাণ্ডারের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে সেইক্ষণে আলিবাবার মনে হলো, যে ধনের সন্ধান সে পেয়েছে তা বোধহয় সম্রাট সুলেমান বা আলেকজাণ্ডারও চোখে দেখেননি কখনও!

    আলিবাবা ভাবলো, তার সত্য নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম এবং পরিবারের পরিজনদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং আল্লাই তাকে এই অপ্রতুল ইনাম-এর দরজা খুলে দিয়েছেন। এ সম্পদ আহরণের ইতিহাস অবশ্যই রক্তে রাঙা। কিন্তু যে-শয়তান দস্যুরা ভোগ করবে বলে নির্বিচারে নরহত্যা করে ধনরত্ন ছিনিয়ে আনে তা তাদের মতো পাপাচারীদের ভোগবিলাসে আসে না কখনও। আলিবাবা এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, পাপীদের ভোগ করার কোনও অধিকার রাখেননি আল্লা। দুনিয়ার তামাম সুখসম্পদ পুণ্যাত্মদের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছেন তিনি। সুতরাং এ সব আমার। আমার বিবি-বাল-বাচ্চাদের সুখের জন্যই এ ধনরত্ন এখানে জমা হয়ে আছে।

    একটা খাবার ভর্তি থলে মেঝেয় উপুড় করে ঢেলে দিয়ে সোনার দিনারে ভরে নিলো আলিবাবা। চাঁদী-টাদীর দিকে সে নজর দিলো না। কারণ এক বস্তা সোনার দিনার বয়ে নিয়ে যাওয়াই কষ্টকর, অন্য কিছু নেবে কি করে?

    বস্তাটা কাঁধে তুলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসে আলিবাবা। গুহার মুখের ধাপে নামিয়ে রেখে আবার নিচে নেমে যায়। আরও একটা বস্তা খালি করে সোনার মোহর এবং হীরে মণিমাণিক্য বোঝাই করে। এইভাবে এক এক করে অনেকগুলি বস্তা সে মহামূল্যবান ধনরত্নে বোঝাই করে সিঁড়ির ওপরের ধাপে নিয়ে আসে। আলিবাবা ভাবে, আর না, তিনটে গাধা এর বেশি ভার বইতে পারবে না। আজ এই পর্যন্ত থাক। পরে আবার আসা যাবে।

    এর পর সে হাঁক ছাড়ে চিচিং ফাঁক।

    আর সঙ্গে সঙ্গে গুহার মুখটা খুলে যায়।

    আলিবাবা ওর গাধা তিনটাকে নিয়ে আসে। বস্তাগুলো সমান ভাগ করে চাপিয়ে দেয় ওদের পিঠে। তারপর, চিচিং বন্ধু’ বলতেই গুহার মুখ নিখুঁতভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর গাধা তিনটেকে নানারকম শ্রুতি-সুখকর আদর সোহাগের সম্বোধন করে তাড়াতে তাড়াতে শহরে ফিরে আসে সে।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো তিপ্পান্নতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    বাড়ির সামনে এসে আলিবাবা দেখল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কেন জানি না, আপনা থেকেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, চিচিং ফাঁক। আর তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গেলো। গাধাগুলোকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো আলিবাবা। পিছন ফিরে বললো, চিচিং বন্ধ। এবং তখনি বন্ধ হয়ে গেলো দরজাটা।

    আলিবাবার বিবি গাধার সুমধুর আওয়াজ শুনে ঘরের বাইরে এসে তাজ্জব বনে গেলো।

    হায় আল্লা, সদর তো নিজে হাতে বন্ধ করেছিলাম আমি, তুমি ঢুকলে কি করে গো?

    আলিবাবা বিবির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো, এই বস্তাগুলো আল্লাহর দেওয়া ইনাম, বিবিজান। একটু হাত লাগাও, এগুলোকে ঘরে তুলি।

    আলিবাবার বিবি বস্তায় হাত দিয়েই বুঝতে পারে, টাকায় ভর্তি। সব যে সোনার মোহর ভাবতে পারে না সে। মনে করে হয়তো বা তামার চাকতি হবে। ভয়ে তার বুক কেঁপে ওঠে! তবে কি তার স্বামী কোনও ডাকাত দলের সামিল হয়েছে? সর্বনাশ!

    .-একি করেছ গো, শেষ পর্যন্ত চোর ডাকাতের দলে নাম লিখিয়েছ? কেন মোটা ভাত মোটা কাপড় কি আমাদের জুটছিলো না? না, গতরে তোমার ঘুন ধরেছে! হায় আল্লাহ, এ কি করলে তুমি, আমার দুধের বাচ্ছারা এবার না খেতে পেয়ে মরবে যে? এত পাপ কি সইবে ভেবেছ,, কতকাল তুমি সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে কাটাতে পারবে?

    আলিবাবার বিবি কপাল চাপড়তে থাকে। আলিবাবা রাগে দাঁত কড়মড় করে ওঠে, চুপ কর শয়তান মাগী, কী আবোল তাবোল বকবক করছিস?

    —এমন অলক্ষুণে জিনিসপত্র ঘরে আনলে কেন তুমি? এতো পাপ কি সইবে? আমার বালবাচ্চাদের অমঙ্গল হবে যে গোনা না, আমার কথা শোনো, আবার এগুলোকে গাধার পিঠে চাপিয়ে তুমি বাড়ির বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে এসো। আমি তোমার দুটি পায়ে ধরছি চাচার পো, আমার মিনতিটুকু রাখ।

    আলিবাবা আর ধৈর্য রাখতে পারে না, ইয়া আল্লা, এ কি নির্বোধ মেয়েছেলের হাতে পড়েছি আমি। আচ্ছা, তোমার কি ধারণা, এই বস্তাগুলো আমি চুরি করে এনেছি? এমন জঘন্য নীচ ধারণা তোমার জন্মালো কি করে বিবিজান?তবে জেনে রাখ, তেমন কোনও অধঃপতন আমার ঘটেনি। আজ সকালে বনে কাঠ কাটতে গিয়ে এগুলো পেয়ে গেছি আমি। নাও ধর, এগুলো ঘরে তুলি আগে, তারপর তোমাকে সব বৃত্তান্ত খুলে বলছি।

    ঘরের মেঝেয় একটা মাদুর বিছিয়ে বস্তাগুলো সব ঢেলে দিলো আলিবাবা। তারপর সেই মোহরের টিলার মাথায় উঠে বসে গর্বে বুক ফুলিয়ে ঐ রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের কাহিনী সবিস্তারে শোনালো তার বিবিকে।

    সব শোনার পর বিবির মন থেকে ভয়ের কুয়াশা কেটে গেলো। খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো সে।

    ওঃ কত টাকা! কত সোনা! মোহর! উফ, আমরা আর গরীব থাকবে না, না গো? খুব, খুব, বড়লোক হয়ে যাবো তাই না? খোদা মেহেরবান, দেখ, সৎপথে খেটে রোজগার করে খেলে আল্লাহ এমনি ভাবে দু’হাত ভরে দেন একদিন। কিন্তু আমি ভাবছি, এতো টাকা পয়সা ঐ শয়তানরা কত মানুষজনকে জখম করেই না জমিয়েছিলো! তা অত পাপের সম্পত্তি কি ভোগে লাগে?

    আলিবাবার বিবি একটা একটা করে মোহরগুলো গুনতে বসে যায়। আলিবাবা হাসে, দূর পাগলী, ও কি করছো? ঐভাবে সারাদিন রাত ধরে গুনেও তুমি শেষ করতে পারবে না। রাখ, ওসবের দরকার নাই। এখানে ঘরের মেঝেয় এভাবে ফেলে রাখলে তো চলবে না। এক কাজ কর রসুইঘরের মেঝেয় একটা বড় করে গর্ত কর। ওখানে পুঁতে রাখবো সব। চটপট কর, তা না হলে বলা যায় না হুট করে হয়তো পড়শীদের কেউ এসে পড়তে পারে। তা হলেই পাঁচ কান হতে হতে কোতোয়ালের কাছে চালান হয়ে যাবে খবর।

    কিন্তু আলিবাবার বৌ সে কথায় তেমন কোনও গুরুত্ব দিলো না। তার দারুণ কৌতূহল, সে জানতে চায়, কত টাকার সে মালিক হয়েছে আজ।

    ঠিক আছে, গুনতে না পারি ওজন করে দেখে নিই? তুমি একটু দাঁড়াও, পাশের বাড়ি থেকে একটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আসি আমি। তুমি ততক্ষণে গর্তটা খুঁড়তে থাক, তোমার খোঁড়া শেষ হতে হতে আমি মেপে শেষ করে দেব। রোজ রোজ তো আর গর্ত খুঁড়ে তোলা যাবে না, ছেলেমেয়েদের জন্যে কি সম্পত্তি কতটা রেখে দিলাম তার হিসেব তো একটা জানা থাকা চাই!

    যদিও ব্যাপারটা নিরর্থক, তবু বিশেষ প্রতিবাদ করলো না আলিবাবা। বললো, ঠিক আছে। ছুটে যাও, নিয়ে এসে চটপট ওজন করে ফেলো, আমি গর্তটা খুঁড়ে ফেলছি তাড়াতাড়ি। কিন্তু খুব হুঁশিয়ার, কাউকে কিছু বলবে না, কাকপক্ষীটি টের পায় না যেন।

    আলিবাবার বৌ সোজা কাসিমের বাড়িতে যায়। কারণ ওর বাড়িটাই ওদের লাগোয়া। কাসিমের বৌটা কুৎসিত কদাকার। যেমন দেখতে তেমন রুচি প্রকৃতিতে। ভুলে সে কখনও আলিবাবার বাড়ির দিকে পা মাড়ায় না। তার প্রধান কারণ, আলিবাবা গরীব, যদি কখনও কিছু চেয়ে বসে।

    আলিবাবার বিবি সেধেই আলাপ জমাতে যায়। কিন্তু কাসিম-গৃহিণী তেমন পাত্তা দেয় না। ভাবে, হয়তো বা কিছু চাইতে এসেছে।

    —তোতামাদের দাঁড়িপাল্লাটা একটু দেবে দিদি? এখুনি দিয়ে যাবো। কাসিমের বৌ দাঁড়িপাল্লার কথা শুনে কৌতূহল হয়ে মুখ তোলে, অবাক হয়, সে জানে আলিবাবা ভীষণ গরীব, দিন আনে দিন খায়। আজ হঠাৎ দাঁড়িপাল্লার কি দরকার পড়লো তার!

    -কি এমন সুলতান বাহশাহর ধন ঘরে এনেছে রে তোর সোয়ামী, যে দাঁড়িপাল্লার দরকার হলো? তা ছোট পাল্লাটা নিবি না বড়টা দেব?

    কাসিম-বিবি বাজিয়ে দেখে নিতে চায়, আলিবাবা কি পরিমাণ মালপত্তর ঘরে এনেছে।

    —ছোটটা হলেই চলবে দিদি।

    কাসিমের বৌ রসুইখানায় ঢোকে পাল্লাটা বের করার জন্য। মেয়েটা শয়তানের ধাড়ি। প্যাচে প্যাচে বদবুদ্ধি। একটুখানি আটারডেলা দাঁড়ির পাল্লায় এঁটে দিলো সে। উদ্দেশ্য আলিবাবা যে দানা শস্য ওজন করবে তার দু’চারটে পাল্লায় আটকে থেকে যাবে। এবং তা দেখে সে জানতে পারবে কি বস্তুর সে ওজন করেছিলো, অথবা আদৌ করেনি কিছু।

    —এই নে ভাই। ওপরের মই-এ ভোলা ছিলো, তাই পাড়তে একটু দেরি হয়ে গেলো।

    আলিবাবার বিবি পাল্লাটা এনে চটপট মাপতে লেগে গেলো। এক একটা পাল্লা মাপা হয় আর এক একটা কাঠকয়লার দাগ কাটে সে মেঝেয়। এইভাবে অনেক তাড়াহুড়ো করে মাপা সত্ত্বেও সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। আলিবাবার গৃহিণী ভাবতে পারেনি ওজন করতে এতো সময় লাগবে। কাসিম-বৌকে সে বলে এসেছিলো একটু পরেই ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ইস, বৌটা কি ভাবছে তার সম্বন্ধে।

    যাই হোক, ওজন শেষে রসুইখানার গর্তে বোঝাই করে মাটি চাপা দিয়ে দিলো দুজনে। তারপর পাল্লাটা তুলে নিয়ে ছুটে গেলো সে কাসিমের বাড়িতে।

    —এই যে দিদি। বড্ড দেরি হয়ে গেলো। কিছু মনে করো না যেন।

    আলিবাবার বিবি ঘরে ফিরে এলো, কিন্তু সে বুঝতেই পারলো না কাসিমের বৌ-এর কারসাজির ফাঁদে সে পা দিয়েছে। পাল্লায় লেপে দেওয়া আটার সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে গেছে একটি সুবর্ণমুদ্রা।

    আলিবাবার বিবি ফিরে গেলে কাসিমের ধূর্ত বৌটা পাল্লাটা মেলে ধরে দেখলো, না, গম নয়, যব নয়, ভুট্টাও নয়, আটার সঙ্গে সেঁটে একটি সোনার মোহর ঝলমল করছে।

    ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতার আগুন দপ করে জ্বলে উঠলো তার বুকের পাঁজরায়।

    -সোনার মোহর! এতো টাকার মালিক সে, গুনে শেষ করতে পারবে না, পাল্লা দিয়ে ওজন করতে হয়? ওরে বাবা, আমার কি হবে রে—

    কাসিমের বৌ-এর মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। হা-হুতাশে পুড়ে যেতে থাকে কলিজাটা। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে যায় চোখ মুখ। অনর্গল অভিসম্পাত নিসৃত হতে থাকে মুখ দিয়ে, খোদা, একমাত্র তুমিই এর বিহিত করতে পার। ঐ ছাঁটা বেহুদাটা এতো সোনা পেলো কোথায়? ওর সব যেন উচ্ছন্নে উড়ে পুড়ে যায়, আল্লাহ। তাহলে পীরের দরবারে সিন্নি দিয়ে আসবো আমি। সারা বাড়িময় দাপাদাপি করতে লাগলো সে। প্রায় উন্মাদিনীর মতো অবস্থা।

    কাসিম সন্ধ্যার অনেক পরে দোকানপাট বন্ধ করে বাড়ি ফেরে। ততক্ষণ পর্যন্ত। ধৈর্য-ধরে সে বসে থাকতে পারবে না। তাই তখুনি সে দোকানে চাকর পাঠালো, শিগ্নির যা ডেকে নিয়ে আয় তোর মনিবকে। বলো গে আমার শরীর খারাপ।

    কাসিম অসময়ে দোকানপাট বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসে। তাকে দেখা মাত্র কাসিমবিবির ক্রোধ, ক্ষোভ, আক্রোশ শতগুণ হয়ে শিলাবৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে থাকে।

    বিবি কেন এতো উত্তপ্ত কিছুই আঁচ করতে পারে না কাসিম। কাছে এগিয়ে এসে গলায় খুব দরদ ঢেলে জিজ্ঞেস করতে যায়, কী, কি হয়েছে জান, তোমাকে এতো উত্তেজিত দেখছি কেন?

    -থাক, অত আর শুকনো সোহাগ জানাতে হবে না। বলি চোখ কানের মাথা কি একেবারে খেয়ে বসে আছ নাকি?

    —কেন, কী হয়েছে কী?

    —আমার মাথা হয়েছে। এই দ্যাখো, কী হয়েছে।

    এই বলে সোনার মোহরটা সে কাসিমের নাকের ডগায় ছুঁড়ে মারলো।

    —দেখ, চোখ মেলে চেয়ে দেখ। তোমার গুণধর ভাইটির বাড়ি থেকে খয়রাতি এসেছে আমার ঘরে। তুমি তো একখানা দোকানের মালিক হয়ে গরবে মাটিতে পা রাখ না। তোমার অহঙ্কার, তোমার মতো রোজগার আর করতে পারেনা কেউ। কিন্তু ভুল, ভুল, সব তোমার মিথ্যে অহঙ্কার। তোমার ভাই-এর মাত্র তিনটে গাধা। জ্বালানীর লকড়ি বেচে খায়। তার ঘরে আজ টাকা রাখার জায়গা নাই। এতো টাকা হাতে গুনতে পারে না—আমার কাছ থেকে দাঁড়িপাল্লা নিয়ে গিয়ে ওজন করে দেখতে হয়। আর তুমি? তুমি একটা অপদার্থ। আমার বাপের তৈরি করা একটা

    দোকান হাতে পেয়েও সেটাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে মোটা পয়সা ঘরে আনতে পার না?

    কাসিম ভেবে পায় না একথার কি জবাব দেবে সে। কিন্তু জাঁহাবাজ বৌ ছাড়বার পাত্রী নয়। হিংস্র বাঘিনীর মতো সে ঝাপিয়ে পড়তে চায় তার স্বামীর ওপর।

    -না, চুপ করে মুখ বুজে সহ্য করা চলবে না। যাও, তোমার ভাই রত্নটিকে গিয়ে জেরা কর, কোথায় পেলো সে এতো মোহর! কী তার সূত্র, আমি জানতে চাই। সে না তোমার ভাই?

    বিবির যুক্তিতর্কে কাসিম বুঝতে পারলো যে-কোনভাবেই হোক তার ভাই আলিবাবা নিজের ভাগ্য বিবর্তন ঘটিয়েছে। ভাই-এর সৌভাগ্যের কথা শুনে সেও কিন্তু খুশি হতে পারলো না। হিংসায় কাতর হয়ে পড়লো সে।

    একটু পরে প্রকৃত ব্যাপারটা কি জানবার জন্য কৌতূহলী হয়ে সে আলিবাবার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো।

    এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো চুয়ান্নতম রজনী।

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলিবাবা তখন কোদালটা সাফ করছিলো। কোনও রকম সভ্যতা-ভব্যতার বালাই না দেখিয়ে রাগে গরগর করতে করতে কাসিম বলে, কি রে গাধার বা কী, ব্যাপার কী? আমার সঙ্গে তুই বড়লোকী দেখাতে যাস কোন সাহসে? তোর না হয় পয়সা-কড়ি হয়েছে, তা বলে দাঁড়ির পাল্লায় মোহর গুঁজে দিয়ে নবাবী চাল মারবি? এতো বড় আপা তোর?

    আলিবাবা হকচকিয়ে যায়। ভয়ে বুক দুরুদুরুকরে ওঠে। সে জানে কাসিম আর তার বিবি কি লোভী আর ধূর্ত।

    —খোদা কসম, তুমি কি বলছো, বড়ভাই, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। একটু খোলসা, করে বলবে, ব্যাপারটা কী? তুমি আমার সহোদর ভাই, রক্তের সম্পর্ক আছে তোমার সঙ্গে। কিন্তু আজ কতকাল একটিবার আমাদের খোঁজ খবর নিতে আস না। আজ হঠাৎ এসেই এইভাবে রাগারাগি করছো কেন বড় ভাই। ঠিক আছে, কী জানতে চাও বলল, আমি কথা দিচ্ছি, তোমার কাছে কিছু গোপন করবো না।

    –আলিবাবা, গর্জে ওঠে কাসিম, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তুমি কিছু জান না বলে ন্যাকাটি সাজলে তো আমি শুনবো না। আমি জানি, কি তুমি লুকাতে চেষ্টা করছে আমার কাছে।

    এই বলে সে আলিবাবার নাকের ডগার সামনে সেই মোহরটা মেলে ধরে বললো, দেখো, চিনতে পারছো? এরকম চিজ কতগুলো বাক্সে ভরেছ? চোর কাঁহিকা—তুই আমাদের বংশের কলঙ্ক, কুলাঙ্গার।

    আলিবাবা কি বলবে কিছুই ভেবে পায় না। তার বিবির হঠকারিতার জন্যই এই অপকর্মটি হয়ে গেছে।

    —বড় ভাই, সব খোদার মেহেরবানী। তিনি দিলে ঘরে রাখার ঠাই হয় না। আর কেড়ে নিলে বাদশাহর ভাণ্ডারও শূন্য হয়ে যায়।

    এরপর সে আদ্যোপান্ত সমস্ত কাহিনী খুলে বললো কাসিমকে। শুধু সেই চিচিং ফাঁক-এর মাহাত্ম্যটুকু গোপন রাখলো।

    তুমি আমার সহোদর ভাই, তোমার সঙ্গে আমার লুকোছাপা কিছু থাকতে পারে না, দাদা। আমি যা পেয়েছি, যা ঘরে এনে তুলেছি তাতে আমার যেমন অধিকার তোমারও তেমনি সমান অধিকার আছে। তুমি এসো, ঘরের ভিতরে এসো দাদা, সমান আধাআধি বখরা করে নিয়ে যাও। আমি তোমাকে খুশি মনে দিয়ে দিচ্ছি।

    কাসিম কিন্তু ভীষণ লোভী, সে আলিবাবার প্রস্তাবে সম্মত হলো না। বললো, না, না, ওসবে আমার দরকার নাই। তুই বল, সেই গুহার মধ্যে কি উপায়ে আমি ঢুকতে পারি। তোকে আর কিছু করতে হবে না। আমার যা দরকার আমি নিজেই নিয়ে আসবো ওখান থেকে। কিন্তু হুঁশিয়ার, আমাকে ভুল পথের নিশানা বলে ভাঁওতা দেবার চেষ্টা করবিনা। তা হলে জানে খতম করে দেব একেবারে। সোজা গিয়ে কোতোয়ালীতে এজাহার দিয়ে আসবো তোর নামে। তুই একটা মহাচোর। চুরির মাল তোর ঘরে খুঁজে পেলে তোর কি অবস্থা হবে একবার ভাব।

    আলিবাবা সম্য বুঝতে পারলো, কাসিমের অসাধ্য কিছুই নাই। চুরির দায়ে সে তাকে অতি সহজেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। এবং তা যদি ঘটে, তবে তার বৌ-বাল-বাচ্চাদের কি হাল হবে ভাবতেও তার বুক কেঁপে ওঠে।

    আলিবাবা আর দ্বিধা না করে ঐ গুহা অভ্যন্তরে প্রবেশের চাবিকাঠি সেই চিচিং ফাঁক এবং চিচিং বন্ধ যাদুমন্ত্র দু’টি কাসিমকে বলে দিলো।

    কাসিম আর ক্ষণকাল অপেক্ষা করলো না সেখানে। রাতারাতি কোটিপতি কুবের বনে যাবার খোয়াবে তখন সে মশগুল। আলিবাবার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে হন হন করে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলো।

    পরদিন সকাল হতে না হতে কাসিম দশটা খচ্চরের পিঠে কুড়িটা খালি জালা ঝুলিয়ে সেই জঙ্গল প্রান্তে এসে হাজির হলো। আলিবাবার পথ-নির্দেশ মতো এগোতে এগোতে এক সময় সেই পাহাড় পাদদেশের নির্দিষ্ট স্থানটিও খুঁজে পেলো সে।

    কাসিমের সর্বাঙ্গ এক অভূতপূর্ব পুলকে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। অফুরন্ত ধনভাণ্ডারের সামনে এসে পড়েছে সে। এবং এই কুবের সম্পদ সবই তার হবে। সে হবে জগতের সবচেয়ে সেরা ধনী মানুষ। উ ভাবতেও সারা শরীর শির শির করে ওঠে।

    আলিবাবার বর্ণনামতো গুহামুখে চিহ্নটিও সে আবিষ্কার করতে পারলো। কাসিম আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে বলে উঠলো-চিচিং ফাঁক।

    আর কি আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে, পাহাড় পাদদেশের মাটিতে ফাটল ধরলো। ক্রমশ সে ফাটল বিস্তৃত হতে হতে একটি গর্তর মতো হয়ে গেলো।

    কাসিম ঝুঁকে পড়ে দেখতে পেলো, একটা পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। আলিবাবা যেমনটি বর্ণনা করেছিলো হুবহু একই রকম সব মিলে গেলো। কাসিম আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। তড়বড় করে নেমে গেলো নিচে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আবার ফাটলটা জোড়া লেগে গুহার প্রবেশ পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো। তা যাক, কাসিম ভাবে, খোলার যাদুও তো তার জানাই আছে, ও নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে লাভ নাই। এখন দেখতে হবে কোথায় কী কী ধনদৌলত জড়ো করা আছে চারদিকে। এবং কী ভাবে সেগুলোকে বস্তাবন্দী করে ওপরে উঠানো যাবে, তারই ফন্দি ফিকির ভাজতে থাকলো সে।

    গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা মাত্র মণি-মাণিক্যের জেল্লায় চোখে ধাঁধাঁ ধরে গেলো কাসিমের। দুনিয়াতে এতো ধনদৌলত থাকতে পারে সে কল্পনাও করতে পারেনি।

    একের পর এক বস্তা বোঝাই করতে থাকলো কাসিম। শুধু সোনার মোহর, আর দামী দামী রত্ন মণি ছাড়া অন্য কিছু সে নিলো না। কতই বা নিতে পারবে সে।মাত্র দশটা খচ্চর সঙ্গে এনেছে, ওরা কত ভারই বা বইতে পারবে।

    বস্তাগুলো ভরে এক এক করে টেনে এনে সিড়ির তলায় রাখলো কাসিম। এবার গুহার মুখ খুলে বাইরে বেরুবার পালা। কিন্তু সেই যে কী ফাঁক—দূর ছাই কিছুতেই তো মনে পড়ছে না! সর্বনাশ!

    অনেক চেষ্টা করেও চিচিং শব্দটা সে কিছুতেই মনে করতে পারে না।

    মুহূর্তে কাসিমের মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। ভয়ে গলা কাঠ হয়ে আসে। জোরে সে চিৎকার করে ওঠে, সীম ফাঁক—

    কিন্তু দরজা একটুও ফাঁক হয় না।

    কাসিম আবার গর্জন করে, লাউ ফাঁক, শসা ফাঁক, ক্ষীরা ফাঁক।

    কিন্তু দরজা ফাঁক হয় না। কাসিম ঘামতে শুরু করে। ভয়ে শিউরে ওঠে সে। দাঁত মুখ খিচে সে প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে সে চিচিং শব্দটি। কিন্তু দুনিয়ার যত রাজ্যের বস্তুর নাম মনে আসে শুধু ঐ চিচিং ছাড়া।

    অসহায় ভাবে সে দু’হাতে কপাল চাপড়াতে থাকে। ইহা আল্লাহ, একি হলো আমার, একটু আগেও যা মুখের ডগায় ছিলো এখন দারুণ প্রয়োজনে সে কথা মনে পড়ছে না কেন? কেন?

    পাথরের দেওয়ালে মাথা কুটতে থাকে সে। কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হয় না।

    হতাশায় চোখে অন্ধকার নেমে আসে। দেহ অবসাদগ্রস্ত হয়। নেতিয়ে পড়ে যায় সে পাথরের মেঝেয়। ক্লান্তিতে শরীর অসাড় হয়ে যায়। চোখে তন্দ্রা নামে।

    কিন্তু সে স্বল্পকালের জন্য। আবার সে উঠে দাঁড়ায়। স্মৃতির সঙ্গে মনের লড়াই চলে অনেকক্ষণ ধরে। কত শব্দ মনে পড়ে। কত ফলের নাম, কত শস্যের নাম, কত সজীর নাম, কিন্তু আসল বস্তুটির নাম আর মুখে আসে না।

    কাসিম বুঝতে পারে, এ আল্লাহরই কারসাজি। তিনি তাকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্যই তার স্মৃতি থেকে শব্দটিকে লোপাট করে নিয়ে গেছেন। তার অত্যধিক লোভ লোলুপতার জন্য এ সাজার বিধান করেছেন খোদা।

    ইয়া আল্লাহ, আমাকে মার্জনা কর প্রভু, আমি আর লোভ করবো না কখনও। আমাকে এই সোনার কয়েদখানা থেকে মুক্তি দাও তুমি। আমি কথা দিচ্ছি, কসম খাচ্ছি, এই সোনাদানা মণি রত্ন কিছুই আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো না। আমাকে বিশ্বাস কর খোদা, আমি তোমাকে মিথ্যে ধাপ্পা দিচ্ছি না। সত্যিই আমি আর কোনও সম্পদে লোভ করবো না। একটি বার—শুধু একবারের জন্য আমাকে ক্ষমা কর, মুক্তি দাও।

    কিন্তু কাসিমের খোদা সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। গুহামুখ উন্মুক্ত হলো না।

    এরপর কাসিম-এর অবস্থা উন্মাদের মতো হয়ে উঠলো। বড় বড় হীরে জহরত গুলো মুঠি ভরে নিয়ে পাথরের দেওয়ালে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে থাকলো।

    কিন্তু তাই বা কতক্ষণ! অবসাদে এলিয়ে পড়ে দেহ। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসে চোখ। সেই এবড়ো খেবড়ো পাথরের মেঝের ওপরেই অসাড়ে পড়ে ঘুমাতে থাকে সে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখে, হঠাৎ কারা যেন গুহামুখ খুলে দিয়েছে। এক ঝলক সূর্যালোক এসে পড়েছে তার মুখে। ওঃ কি আরাম! এই অন্ধ কারার মধ্যে একি মুক্তির আশ্বাস! কিন্তু ও কাদের পায়ের শব্দ। মনে হয়, একদল জাঁদরেল মানুষ সশব্দে নিচের দিকে নেমে আসছে!

    এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো পঞ্চান্নতম রজনী।

    আবার সে বলতে থাকে– দুপুরের ঝা ঝা রোদে তেতে পুড়ে এসে হাজির হলো চল্লিশ চোর। পাহাড়ের পাদদেশে, ঠিক গুহামুখের পাশে। অদূরে দশটা খচ্চর বাঁধা দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো ওরা। এই নির্জন বন-প্রান্তরে এই জানোয়ারগুলোকে এখানে নিয়ে এলো কে?তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে এদিকে ওদিকে তন্ন তন্ন করে তল্লাস করতে থাকলো সকলে। কিন্তু কোথাও কোনও মানুষের সাড়া পাওয়া গেলো না। সর্দারটি বললো, সর্বনাশ! আমাদের ডেরার সন্ধান পেয়ে গেছে কেউ।

    অন্য একজন বললো, কিন্তু সন্ধান পেলেই বা কী? ঢুকবার চাবিকাঠি জানবে কি করে।

    সর্দার বলে, লোকটা নিশ্চয়ই আমাদের পিছু ধাওয়া করে সবই দেখে শুনে জেনে নিয়েছে। যাক আর দেরি না, এবার তোমরা সব তলোয়ার বাগিয়ে নিচে নেমে পড়। চিচিংফাঁক।

    গুহার মুখ খুলে গেলো। এবং শাণিত অস্ত্র কাঁধে চেপে এক এক করে সবাই নিচে নেমে গেলো।

    সিঁড়ির মুখে বস্তা বস্তা মোহর আর হীরে জহরত দেখে বুঝতে আর বাকী রইলো না চোরের ওপর বাটপাড়ি করার জন্য কেউ প্রবেশ করেছে ভিতরে।

    গর্জে উঠলো সর্দার, দুশমন কো খতম করো।

    সর্দারের সিংহ-গর্জনে কাসিমের ঘুম ছুটে যায়। স্বপ্ন টুটে যায়। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে। সে। কিন্তু উঠে আর দাঁড়াতে পারে না। সর্দারের এক ঘায়ে ধরমুণ্ডু আলাদা হয়ে যায়।

    শয়তান, চোট্টা কাঁহিকা।

    যদিও একবার মাত্র আর্তনাদ করেই কাসিম স্তব্ধ হয়ে পড়ে গেলো তবু ক্রুব্ধ সর্দার নিরস্ত হলো না, নিপ্রাণ ধরটার ওপর কোপের উপর কোপ বসিয়ে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলতে থাকলো কাসিমের দেহটাকে। তারপর সাগরেদদের হুকুম করলো, ইসকা লাসকো বাহারমে ফেক দে।

    এইভাবে কাসিমের মৃতদেহটা ছয় টুকরো আকারে একটা বস্তাবন্দী অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়ে গুহা মুখের কাছেই পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে রইলো। এই তার পরিণতি!

    কাসিমকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার চোররা গুহাভ্যন্তরে গিয়ে বস্তাগুলো খালি করে আবার যথাস্থানে সাজিয়ে রেখে গোল হয়ে বসে মতলব আঁটতে থাকে।

    কিন্তু অনেক জল্পনা কল্পনা করেও কেউই কোনও সূত্র উদ্ভাবন করতে পারে না। কে এই লোকটা, কী করেই বা সে তাদের অনুসরণ করে গুহার দরজা খোলার গুপ্ত মন্ত্র জেনে নিয়েছিলো কিছুই অনুমান করতে পারে না কেউ। সর্দার বললো, এই জঙ্গলের পরে ফাঁকা মাঠ। মাঠ পার হলে শহর। এ ছাড়া এদিকে কোনও জনবসতি নাই। আমার ধারণা ব্যাটা ঐ শহরেরই কোনও অঞ্চলে বসবাস করতো, নিশ্চয়ই সেখানে তার বৌ-ছেলে মেয়ে বা অন্য আত্মীয়স্বজন আছে। তারা চিন্তিত হয়ে বসে আছে তার জন্য। এখন আমাদের কাজ তাদের খুঁজে বের করা।

    সর্দারের একথায় সকলে বলে উঠলো, অত বড় শহর কত শত সহস্র মানুষের বাস। কত জনপথ, অলিগলি-ইয়ত্তা আছে। তার মধ্যে কে বা কারা আপনজনের প্রতীক্ষায় ম্রিয়মাণ হয়ে পথ চেয়ে বসে আছে, কি করে আন্দাজ করা যাবে!

    অন্য একজন বললো, আর তাছাড়া শয়তানকে তো খতমই করে ফেলা হয়েছে। এখন আর খোঁজাখুজি করে কী ফয়দা?

    সর্দার একথায় সায় দেয়, তা ঠিক, যে ব্যাটা আমাদের এই গুপ্ত গুহার সন্ধান পেয়েছিলো তাকে তো সাবাড় করেই দিয়েছি।

    সুতরাং এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তার কিছু নাই। তবে এখন থেকে আরও সাবধানে সতর্ক হয়ে গুহার দরজা খুলতে হবে।

    এরপর সকলে গুহা থেকে বেরিয়ে চিচিং বন্ধ বলে দরজা বন্ধ করে আবার নতুন ধান্ধায় বেরিয়ে পড়লো। যাবার আগে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিরীহ খচ্চরগুলোকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যেতে কসুর করলো না ওরা।

    কাসিমের মৃত্যুর জন্য তার শয়তান বৌটাই একমাত্র দায়ী! সে যদি ঐ মোহরটা দেখিয়ে তার স্বামীকে প্রলুব্ধ না করতো তা হলে এইভাবে প্রাণ হারাতে হতো না তাকে।

    কাসিমের বৌ নানারকম মুখরোচক খানা পাকিয়ে স্বামীর পথ চেয়ে বসে রইলো। তার চোখে লোভ লকলক করছিলো। সারাক্ষণ সে একটা কথাই ভাবছিলো-স্বামী দশ দশটা খচ্চরের পিঠে বোঝাই করে জালা জালা সোনাদানা নিয়ে আসছে। উফ্, কী আনন্দ। অত সোনা সে রাখবে কোথায়? কী ভাবে রাখবে?

    এই সব রঙিন চিন্তায় চিন্তায় দিনটা শেষ হয়ে যায় এক সময়। রাতের কালো ঘনিয়ে আসতে থাকে! এবার বৌটা চিন্তিত হয়ে ওঠে। এই অন্ধকারে ঐ জঙ্গলে তো জনমানুষ থাকতে পারে না! হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের আড্ডা হয় সেখানে। বেশি রাত করে ফিরতে গেলে বাঘ-ভাল্লুকের মুখে পড়বে না তো মানুষটা!

    কথাটা মাথায় আসতেই শিউরে ওঠে সে। তাড়াতাড়ি ছুটে যায় আলিবাবার বাড়িতে। আলিবাবা তখন দাওয়ায় বসে কুঠারে শান দিচ্ছিল।

    – শোনও ছোট শেখ, রাত এক প্রহর উৎরে গেলো, কিন্তু তোমার বড় ভাই এখনও ফিরলো না। কী ব্যাপার বলতো! বড় চিন্তা লাগছে মনে। আলিবাবা বলে, ও এখনও ফেরে নাই বুঝি! তা চিন্তার কিছু নাই বিবিজান, অমন ধনদৌলত নিয়ে দিনের আলোয় ফেরার অনেক ঝুঁকি আছে। লোক জানাজানি হয়ে গেলে সরকারের কানে চলে যেতে পারে খবরটা। বড় ভাই আমার এদিকে দারুণ হুঁশিয়ার আদমী। এই সব সাতপাঁচ ভেবেই বোধহয় একটু বেশি রাত করে রওনা দেবে সে।

    আলিবাবার কথায় যুক্তি ছিলো, খানিকটা আশ্বস্ত হতে পারে বৌটা। আলিবাবা বলে, তা এখানেই বসো না একটু। আমার মনে হয় এখুনি এসে পড়বে।

    রাত আরও বাড়তে থাকলো, কিন্তু কাসিম ফিরলো না। বৌটা আবার অধৈর্য উৎকণ্ঠিতা হয়ে আলিবাবাকে জিজ্ঞেস করে, এখনও কী তুমি মনে করছো এই নিশুতি রাতে সে ফিরে আসবে?

    আলিবাবা বললো, না বিবিজান আজ আর তার ফেরার কোনও আশা নাই। আমার মনে হচ্ছে মালপত্র বস্তাবন্দী করতেই তার সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। জঙ্গলটা জব্বর, সাপ খোপ তো আছেই, মানুষ-খেকো জন্তু-জানোয়ারদেরও অভাব নাই। তাই বোধহয় সে গুহা থেকে বের হয়নি রাতের মতো। ঠিক করেছে কাল সাত-সক্কালে কাকপক্ষী জাগার আগেই সবার অলক্ষ্যে সে ঘরে এসে পৌঁছাবে। তুমি কোনও দুশ্চিন্তা করো না বৌ, কাল সকালেই বড় ভাই ফিরে আসবে। তুমি মিলিয়ে নিও আমার কথা।

    কিন্তু আলিবাবার ধারণা সত্য হলো না। পরদিন অনেক বেলা হলো, তবু কাসিম ফিরে এলো দেখে আলিবাবাও চিন্তিত হয়ে পড়লো।

    -নাঃ, আর তো চুপচাপ ঘরে বসে থাকা যায় না বৌ, আমি একবার দেখে আসি, কী হলো তার।

    খচ্চর তিনটাকে সঙ্গে করে জঙ্গলের পথে রওনা হয়ে যায়।

    পাহাড়ের কাছে এসে কাসিমের দশটা খচ্চরের বিচ্ছিন্ন দেহ আর রক্তের ঢল দেখে সে আঁতকে ওঠে। সর্বনাশ তবে তো তার ভাই আর জীবিত নাই। নিশ্চয়ই ডাকাতদের হাতে ধরা পড়ে তার জান শেষ হয়েছে। ভীত কম্পিত কণ্ঠে সে কোন রকমে উচ্চারণ করতে পারে চিচিং ফাঁক।

    সঙ্গে সঙ্গে গুহার মুখ উন্মুক্ত হয়ে যায়। তর তর করে নিচে নেমে যায় আলিবাবা। সিঁড়ির নিচেই চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আলিবাবার বুঝতে অসুবিধা হয় না ডাকাতরা কাসিমকে কেটে ফেলেছে। কিন্তু সারা গুহা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার লাশের সন্ধান পায় না সে। বিষাদে মুহ্যমান হয়ে উপরে উঠে আসে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে অদূরে একটা রক্তমাখা বস্তা দেখতে পেয়ে সেইদিকে এগিয়ে যায়।

    বস্তাটার মুখ খুলতেই সে শিউরে ওঠে। ডাকাতরা তার দাদাকে টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় পুরে ফেলে রেখে গেছে।

    চটপট সে বস্তাটাকে খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়।

    আলিবাবার কেনা বাঁদী মরজানা বয়সে তরুণী শক্ত সামর্থ্য দেহ-বল্লরী শাণিত তলোয়ারের মতো। বাড়ির দরজায় পৌঁছেই আলিবাবা মরজানাকে ডাকে।

    মনিবের সাড়া পেয়ে ছুটে আসে মরজানা! আলিবাবা বলে, বস্তাটায় একটু হাত লাগা তো, মা।

    দু’জনে ধরাধরি করে কাসিমের খণ্ডিত দেহভর্তি বস্তাটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তোলে। বুদ্ধিমতী মরজানা পলকে বুঝে নেয় ব্যাপারটা কী?

    আলিবাবা বলে, মা জননী আমি জানি তোর অনেক বুদ্ধি। এখন যে-বিপদ সামনে তাকে সামলাবার মতো মগজ আমার নাই। তুইমা একটা উপায় বালা, যাতে সব দিক রক্ষা হয় ঠিকমতো।

    মরজানা বলে, আপনি, কিছু চিন্তা করবেন না আব্বাজান, সব আমি সামাল দিয়ে দেব।

    আলিবাবা বলে, দাদার দেহটাকে কবর দিতে হবে তার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু এই টুকরো টুকরো করা লাস দেখলে পাড়াপড়শীরা আঁৎকে উঠে হাট বসিয়ে দেবে বাড়িতে।

    মরজানা বলে, আপনি কি পাগল হয়েছেন, আব্বাজান, এই অবস্থায় গোর দেওয়া যায় তাকে? আমি সেই ব্যবস্থাই করতে যাচ্ছি, ভালো মুচি ডেকে এমন নিখুঁতভাবে সেলাই করিয়ে নেব যা দেখলে আপনিই তাজ্জব বনে যাবেন, সেলাই-এর জোড়া খুঁজে পাবেন না।

    কাসিমের বৌ খণ্ডিত দেহ স্বামীকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠতে চায়। মরজানা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, একদম কাঁদবেন না এখন চাচী, সর্বনাশ হয়ে যাবে। দাঁড়ান আগে আমি বিধি-ব্যবস্থা করি তারপর যত পারেন কাঁদবেন খনি।

    কাসিমের বৌ ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যায়। মরজানা দ্রুত পায়ে পাড়ার হাকিমের দাওয়াখানায় চলে আসে।

    হাকিম সাহেব আমার চাচার বহুত বিমার, বুকে কফ জমেছে, দরদ আছে ভাত বন্ধ হয়ে গেছে, জলদি দাওয়াই দিন মেহেরবানী করে।

    হাকিম আরও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে এক শিশি ওষুধ দিলো, মরজানাকে। বললো, বিমার বড় খারাপ বেটি, আজ রাতটা যদি টিকে তবে আশা আছে, খানিকটা। যাই হোক কেমন থাকে কাল সকালে আমাকে জানিয়ে যেও।

    পরদিন সকালে মরজানা কাঁদতে কাঁদতে দাওয়াখানায় ঢুকে বলে, না হাকিম সাহেব কোনও উপকার হলো না। রুগী আরও খারাপ হয়ে পড়েছে। আপনি আরও ভালো দাওয়াই দিন।

    হাকিম বিষণ্ণ হাসি হেসে বলে, দাওয়াইতে আর কোনও কাজ হবে না মা। এবার খোদার নাম জপ করতে বলো গে।

    রাত্রি শেষ হলে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    আটশো ছাপ্পান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    মরজানা ঘরে ফিরে এসে কাসিমের বৌকে বলে, চাচী নাও, এবার মরা কান্না কাঁদতে শুরু কর।

    এই বলে সে নিজেও কাঁদতে বসে গেলো।

    মরার খবর বাতাসের আগে যায়। মুহূর্তে পাড়াপড়শীরা সবাই জেনে গেলো আলিবাবার বড় ভাই কাসিম মাত্র দুদিনের বিমারে ইন্তেকাল করেছে।

    মরজানা ভাবলো একটা পর্ব তো চুকলো; কিন্তু এখন আসল কাজটাই বাকী। হন হন করে সে ছুটলো শহর প্রান্তের সুদক্ষ কারিগর এক মুচির বাড়িতে। লোকটার হাতের কাজ বড় চমৎকার। এর আগে সে ওর দোকান থেকে জুতো বানিয়ে এনেছে—যেমন গড়ন তেমনি সুক্ষ্ম সেলাই।

    মুচি তখন তার দোকানে বসে জুতো তৈরি করছিলো। মরজানা মুখে মধু ঢেলে বলে, শেখ মুসতফা, আজ তোমাকে আমার বড় দরকার। আমার বাড়িতে গিয়ে একটা খুব দরকারী কাজ করে দিয়ে আসতে হবে। তবে হ্যাঁ, তার জন্য আমি তোমাকে পুষিয়ে দেব।

    এই বলে সে গোটা একটা মোহর বাড়িয়ে দেয় মুচির দিকে। সোনার মোহরটা চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারে না মুচি বেচারা! সারা মাস ধরে খাটলে দু’টো মোহর রোজগার হয় না আর একদিনের একটা কাজের ইনাম আস্ত একটা মোহর। ফ্যাল ফ্যাল করে সে তাকিয়ে থাকে মরজানার মুখের দিকে, রসিকতা কিনা বুঝতে পারে না, তাই হাত পেতে নিতেও ভরসা হয় না তার। মরজানা বুঝতে পেরে মোহরটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, নাও আর দেরি করা চলবে না—এখুনি যেতে হবে। এটা তোমার কাজের আগাম দিলাম। কাজ শেষ করে দিলে পুরো মজুরী পাবে।

    মেয়েটা বলে কী? একটা কাজের জন্য এই মোহর ছাড়া আরও পারিশ্রমিক দেবে সে? কী এমন কাজ?

    মরজানা বলে, কাজটা কিন্তু খুব গোপনীয়। কসম খেয়ে বলতে হবে শেখ এ জিন্দগীতে কাউকে সে কথা বলতে পারবে না কখনও। এবং এই কারণেই তোমার যা যোগ্য মজুরী তার অনেক বেশি তোমাকে দেব।

    মুচি দু’কানের লতি টিপে ধরে বলে, তোবা তোবা, আপনি বারণ করছেন সে কথা কি কাউকে বলতে পারি কখনও। এই কসম খাচ্ছি, যদি কাউকে বলি জিভ আমার খসে পড়বে।

    মরজানা বলে, তা হলেও বিশ্বাস নেই বাপু, তুমি এক কাজ কর। এই ফেটিখানা দিয়ে চোখ দুটো বেঁধে নাও। আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো, আবার সঙ্গে করে দিয়ে যাবো এখানে। তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। আমি চাই না তুমি আমার বাড়ির ঠিকানা জেনে রাখ।

    মুচি ঘাড় নেড়ে বলে, ঠিক আছে, তাই ভালো হবে চাঁদবানু। কি দরকার ঠিকানা পত্র মনে রেখে। হয়তো কে জানে কখন মনের খেয়ালে ফস করে বলে ফেলব। তার চেয়ে এই-ই ভালো, আমার ইচ্ছে থাকলেও কাউকে বলতে পারবো না।

    মরাজানা বলে, তাহলে এসো আর দেরি করো না। আমি নিজে হাতে তোমার চোখ দু’টো ভালো করে বেঁধে দিই।

    মুচি মাথাটা এগিয়ে দিলো। মরজানা সঙ্গে করে একখানা কালো রঙের বড় রেশমী রুমাল এনেছিলো। তাই দিয়ে সে মুচির চোখ দুটো বেঁধে সঙ্গে করে রাস্তায় বেরুলো।

    এ গলি সে গলি করে অনেক গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক সময় সে মুচিকে নিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছলো।

    ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়ে মরজানা মুচির চোখের পটি খুলে দেয়। বলে, এই দেখ,একটা লাশের ছ’খানা টুকরো। এমন নিখুঁত হাতে নিখুঁতভাবে সেলাই করতে হবে যাতে তুমি নিজেই পরে জোড়া খুঁজে না পাও, বুঝলে? আমি তোমার হাতের কাজ জানি। সারা দেশের মধ্যে তোমার মতো খলিফা চর্মকার আর দুটি নাই! নাও, আর দেরি করো না, কাজ শুরু কর। আর হ্যাঁ, এই দিনার দু’টো রাখ। কাজ দেখে খুশি হলে আরও বকশিশ দেব।

    মুচি কম্পিত হাতে মোহর দু’টো মুঠোয় ধরে ট্যাকে গোঁজে।

    মুচি। তারপর কাজে মন দেয়।

    ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কাসিমের দেহের টুকরোগুলো সুন্দরভাবে ( জোড়া লাগিয়ে দেয় মুচিটা। মরজানা খুশি হয়ে বলে, বাঃ চমত্তার হাত তোমার শেখ। এই নাও ধর তোমার বকশিশ।

    মুচি তাকিয়ে দেখলো, আর দু’টি স্বর্ণমুদ্রা তার হাতের তালুতে এসে পড়েছে।

    আবার যথারীতি চোখে কালো রেশমী রুমালের ফেটি বেঁধে এ গলি সে গলি – ঘুরিয়ে মুচিকে তার বাড়িতে ফেরত দিয়ে এলো মরজানা।

    এরপর শোক মিছিলের পর্ব। পাড়াপড়শিরা কাসিমের মরদেহ গোরস্তানে বয়ে নিয়ে চললো। তাদের পিছনে পিছনে মরজানা তার চাচার জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে কেঁদে সারা হতে থাকলো।

    এইভাবে যথানিয়মে কাসিমের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়ে গেলো।

    এদিকে মাসখানেকের পরে চল্লিশ চোর চুরি ডাকাতির পাট শেষ করে নিজেদের ডেরায় ফিরে এলো একদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য, পাহাড়ের পাদদেশে এসে তারা কাসিমের লাশের টুকরো ভর্তি বস্তাটাকে যথাস্থানে খুঁজে পেলো না।

    এবার সর্দার হুঙ্কার ছাড়ে, হুম, দুশমনেরা দেখছি শেষ হয়নি। আমরা যাকে খতম করেছি, সে যে একা নয় এখন তো তোমরা তার প্রমাণ পেলে? তা হলে? পিছনে শত্রু রেখে আমরা কি করে নিশ্চিত থাকতে পারি বলো?

    সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো, খুঁজে কের করতেই হবে। শত্রুর লেশ রাখতে নাই। যে ভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করবোই।

    সর্দার বললো, শোনো, এই পাশের শহরেরই বাসিন্দা তারা। তাদের বাড়ির ঠিকানা আমার চাই। সবংশে নিধন করতে হবে ওদের সকলকে। তা না হলে আমাদের ধন-দৌলত কিছুই রক্ষা করা যাবে না এখানে। এমনকি জানেও বেঁচে থাকতে পারবো না। সুতরাং আজ থেকে জান প্রাণ লড়িয়ে দিতে হবে তাদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য। আচ্ছা এবার কে আগে এই কাজে ঝাপিয়ে পড়তে চাও বলো। তাকে আজই ছদ্মবেশে শহরে ঢুকে পড়তে হবে। তার মনে থাকে যেন, ভুল খবর এনে আমাকে ফালতু হয়রানি করবে না কিছুতেই। তাহলে আমি গর্দান নেব, বলো, কে যাবে?

    সর্দারের এই শর্ত মেনে নিয়ে চোরদলের একজন এগিয়ে এসে বলে, আমি যাব। আমিই খুঁজে বার করবো তাকে, সর্দার।

    দরবেশ-বেশি চোরটা সারা শহরের নানা বসতবাড়ি দোকানপাট ঘুরতে ঘুরতে কয়েকদিন পরে সেই মুস্তাফা মুচির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার এক হাতে ভিক্ষাপাত্র, অন্য হাতে ধূপদানী।

    মুচি তখন নিবিষ্ট মনে এক জোড়া জুতো সেলাই করছিলো। দরবেশ চোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার নিপুণ হাতের কারুকার্য দেখতে থাকে।

    এক সময় মুচিমুখ তুলে দরবেশকে দেখে স্বাগত জানায়। দরবেশ চোর বাহবা দিয়ে বলে, বাঃ এই বয়সেও তোমার হাতের কাজ তত বড় সূক্ষ্ম দেখছি!

    মুস্তাফার অহঙ্কার জেগে ওঠে, তা ফকির সাহেব, খোদার মেহেরবানীতে এখনও একবারেই সূচে সুতো পরাতে পারি। হাতের কাজ বলছেন? তা একটা মানুষকে ছ’টুকরো করে কেটে দিন, আমি এমন নিপুণভাবে সেলাই করে জোড়া দিয়ে দেব যে হাজার খুঁজেও আপনি তার জোড়া ধরতে পারবেন না।

    দরবেশ চোর সূত্র-সন্ধানের সম্ভাবনায় পুলকিত হয়ে ওঠে। বলে, তোমার হাতের কাজের নমুনা দেখেই বুঝতে পারছি। বহুত গুণী কারিগর তুমি। তবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জোড়া লাগাতে পার কিনা তা অবশ্য জানি না।

    মুস্তাফা বাধা দিয়ে বলে, এতো আর আন্দাজে বলছি না, দরবেশ সাহেব। নিজে হাতে করে দেখেছি আমি। জোড়া লাগাবার পর আমি নিজেই তাজ্জব হয়ে গেছি নিজের কাজ দেখে। খোদা কসম, বিশ্বাস করুন, শত চেষ্টা করেও আমার নিজের হাতের সেলাই-এর জোড় আমি ধরতে পারিনি।

    দরবেশ অবাক হওয়ার ভান করে বলে, একটা মানুষের ছ’ খণ্ড দেহ সেলাই দিয়ে জোড়া দিয়েছ? কোথায়? কবে?

    মুস্তাফা বলে, বানিয়ে বলছি না ফকির সাহেব। এই মাসখানেক আগে এক জানানা  এসেছিলো আমার দোকানে। আমার চোখ দুটো রুমাল দিয়ে বেঁধে বোরখা পরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো তার বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখি একটা লোককে ছ’টুকরো করে কাটা হয়েছে। মেয়েটি আমার হাতে ঝকঝকে মোহর গুঁজে দিলো গোটাকতক।বললো, সূক্ষ্মভাবে সেলাই করে জুড়ে দিতে হবে। কাজ ভালো হলে বকশিশ পাবে।

    আমিও দেখিয়ে দিলাম আমার কেরামতি! এমন কাজ করে দিলাম, দেখে খুব তারিফ করলো সে। আমাকে আরও কয়েকটা মোহর দিয়ে আবার চোখ বেঁধে পৌঁছে দিলো এখানে।

    দরবেশ চোর ন্যাকার মতো প্রশ্ন করে, তা তোমাদের এ দেশের বুঝি এই রকমই প্রথা? কোনও লোক মারা গেলে তাকে ছ’টুকরো করে কেটে তারপর সেলাই দিয়ে জুড়ে গোর দিতে হয়?

    মুস্তাফা হো হো করে হেসে ওঠে, আরে না না, দরবেশজী, ও রকম উদ্ভট প্রথা কেন থাকবে? ব্যাপারটা যে কী তা আজ পর্যন্ত আমি ঠাওর করতে পারিনি। কেই বা সে লোক? কেনই বা তাকে ছটুকরো করে কাটা হয়েছিলো, কেই বা কেটেছিলো-কিছু জানি না আমি। জানবার কোনও উপায়ও ছিলো না। আমার সঙ্গে শুধু কাজের সম্পর্ক ছিলো ওর। আমার আশার অতিরিক্ত পয়সা দিয়েছে সে, যেমনটি কাজ করতে বলেছে, করে দিয়েছি। এর বেশি কিছু জানবার চেষ্টাও করিনি, জানতেও পারিনি। তা আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নিয়ে কী ফয়দা, বলুন?

    দরবেশ চোর বলে, তা বটে, কিন্তু মুস্তাফাজী, আমার কিন্তু বড় কৌতূহল জাগছে। এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার কী করে ঘটতে পারে। আচ্ছা, এক কাজ করতে পার? আমাকে নিয়ে যেতে পার ঐ বাসাটায়?

    -এই দেখুন, বললাম না, রুমালে কষে বেঁধে দিলো আমার চোখ দুটো তারপর বোরখায় সারা অঙ্গ ঢেকে নিয়ে গিয়েছিলো সে সঙ্গে করে। কী করে বলবো আপনাকে, কোথায় কোন বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি?

    দরবেশ চোর বলে, ঠিক আছে। আমিও তোমার চোখ বেঁধে দিচ্ছি। তারপর তুমি হাতড়াতে হাতড়াতে চলল আমার সঙ্গে। মনে করার চেষ্টা কর, কত দূর সোজা গিয়ে কোনদিকে বাঁক নিয়েছিলে। তারপর আবার কতটা চলার পর কোনদিকে ঘুরেছিলে। আমার মনে হয়, ঠিক মতো ইয়াদ করলে বাড়িটা তুমি খুঁজে বের করতে পারবে।

    মুস্তাফা বলে, হু, ঠিকই বলেছেন পীরসাহেব। যাদের চোখ নাই—অন্ধ, তারা তো আন্দাজেই হাতড়ে হাতড়ে সারা শহর দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। চোখে দেখতে না পেলেও তারা মন দিয়ে দেখে।

    দরবেশ চোর উৎসাহ দিয়ে বলে, ঠিক বলেছ, চোখে না দেখলেও অনুভবে দেখে তারা। তুমিও পারবে—নিশ্চয়ই পারবে। তা আমার এ খেয়াল মেটাতে তোমাকে খেসারত দিতে হবে কেন? অনেকটা সময় তোমার কাজের ক্ষতি হবে। সেইজন্যে এই নাও, ধর, এই মোহরটি রাখ।

    একটা চকচকে সোনার মোহর গুঁজে দিলো সে মুচির হাতে। মুচির চোখ নেচে ওঠে, দরবেশকে আপ্যায়ন করে বসায়, বলে, আপনি এক পলক বসুন, পীরসাহেব। আমি দোকানটা বন্ধ করে আপনাকে নিয়ে বেরুচ্ছি এখুনি।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো সাতান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    চোর দরবেশ মুচির চোখ রুমালে বেঁধে দেয়। মুচি অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে চলে। এপথ সেপথ ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সে চোরকে সঙ্গে নিয়ে এক বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, এই-এই সেই মকান।

    চোর দরবেশ মুচির চোখের বাঁধন খুলে দেয়। তারপর একখণ্ড চকখড়ি দিয়ে দরজার গায়ে একটি চিহ্ন এঁকে দেয়। মুচির হাতে দুটো দিনার গুঁজে দিয়ে বলে, এই নাও তোমার বকশিশ। এখন থেকে আমাদের যা জুতো লাগবে সব তোমার দোকান থেকে কিনবো, বুঝলে?

    মুচি গদগদ হয়ে বলে, সেলাম সাহেব, আচ্ছা তা হলে আমি চলি!

    চোর ছুটতে ছুটতে জঙ্গলে চলে যায়। সর্দারকে সব বলে।

    মরজানা দোকানের সওদা কিনতে বাড়ির বাইরে বেরুতেই দেখতে পায় দরজার গায়ে সেই সাদা খড়িমাটির চিহ্ন। সন্দিগ্ধভাবে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ভেবে পায় না, কে এবং কেন এই অদ্ভুত ধরনের চিহ্নটি এঁকে দিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কোনও দুরভিসন্ধি আছে এর পিছনে।

    মরজানা এক টুকরো সাদা চক এনে পাড়ার সবকটি বাড়ির দরজায় অবিকল ঐ একই ধরনের চিহ্ন এঁকে দেয়।

    পরদিন সকালে ঐ চল্লিশ চোর দু’জন দু’জন করে নানা দলে বিভক্ত হয়ে শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কিন্তু প্রতিটি বাড়ির দরজায় একই সাঙ্কেতিক চিহ্ন গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকে তারা। ক্রোধে ফেটে পড়ে সর্দার। যে চোরটাকে সন্ধান করতে পাঠিয়েছিলো তার ওপর ভীষণ ক্ষেপে ওঠে।

    -ব্যাটা ধাপ্পাবাজ, শয়তান, আমার সঙ্গে ইয়ারকি! দাঁড়াও ডেরায় ফিরে গিয়ে তোমার মজা দেখাচ্ছি আমি।

    বলাবাহুল্য, জঙ্গলে ফিরে গিয়ে সর্দারের তরবারির এক কোপে গুপ্তচর লোকটার প্রাণান্ত ঘটেছিলো।

    সর্দার এবার আর একজনকে পাঠালো সেই মুচির কাছে। সে-ও যথারীতি মুচির চোখ বেঁধে তার পিছনে পিছনে এসে হাজির হলো আলিবাবার বাড়ির সামনে। মুচির চোখের বাঁধন খুলে যথাবিহিত ইনাম বকশিশ দিয়ে গুপ্তচরটি একখণ্ড নীল রঙের খড়িমাটির সাহায্যে দরজার গায়ে নতুন ধরনের এক সংকেত চিহ্ন এঁকে দিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেলো।

    পরদিন সকালে চোরগুলো দুই-দুইজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে আবার শহরাভ্যন্তরে এসে পৌঁছয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেদিনও তারা প্রতিটি বাড়ির দরজায় একই চিহ্ন অঙ্কিত দেখে বিভ্রান্ত এবং ক্রোধান্বিত হয়ে জঙ্গলে ফিরে গিয়ে গুপ্তচরের প্রাণ সংহার করলো।

    চোর সর্দার এবার আর অন্য কাউকেই ভরসা করতে না পেরে নিজেই দরবেশের ছদ্মবেশে মুচির দোকানে এসে হাজির হয়। একই ভাবেমুচি তাকেও আলিবাবার বাড়ির দরজায় নিয়ে যায়। সর্দার তাকে বকশিশ দিয়ে বিদায় করে। তারপর একখণ্ড লাল চকখড়ি দিয়ে দরজার গায়ে মোহর এঁকে দিয়ে জঙ্গলে ফিরে যায়।

    সর্দার বুঝেছিলো শুধু খড়িমাটির চিহ্ন এঁকে গেলেই যথেষ্ট হবে না। কারণ নিশ্চয়ই কেউ আড়াল থেকে তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রত্যেক বাড়ির দরজায় একই চিহ্ন এঁকে রাখে। তাই সে যাবার আগে আলিবাবার বাড়িটার আশেপাশের বাড়িঘর, গাছপালা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যাদি মনে গেঁথে নিয়ে চলে যায়।

    গুহার ডেরায় ফিরে এসে সে সাঙ্গপাঙ্গদের বলে, এবার আর চোখে ধাঁধা দিতে পারবে না আমার। এমন চিহ্ন মনে এঁকে দিয়ে এসেছি যা কখনো ভুল হবার নয়। যাক,এবার তোমরা এক কাজ কর। বাজার থেকে আটত্রিশটা বড় বড় মাটির জালা কিনে নিয়ে এসো। বেশ চওড়া মুখ আর পেট মোটাওলা হওয়া চাই। একটায় শুধু জলপাই তেল ভরতে হবে। আর বাকীগুলো খালি থাকবে, যাও, জলদি বেরিয়ে পড় তোমরা।

    সর্দারের হুকুমে চোররা সকলে ঘোড়ায় চেপে বাজারের পথে বেরিয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্দারের নির্দেশমত একটি জালায় জলপাই তেল ভর্তি করে এবং বাকী সাঁইত্রিশটা শুন্যাবস্থায় কিনে ফিরে এলো।

    সর্দার বললো, প্রত্যেক ঘোড়ার দুই পাঁজরে দু’টি জালা ঝোলাতে হবে। তার আগে তোমরা সকলে সাজপোশাক খুলে ফেলে একেবারে উদোম হও। শুধু মাথায় থাকবে পাগড়ী আর পিঠে ঝুলবে নাগরা।

    সর্দারের হুকুম শিরোধার্য, তৎক্ষণাৎ সকলে বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়ালো। সর্দার বললো, প্রথমে একজন এসো, এই তেলের জালাটা এক পাশে থাকবে, আর এক পাশে আরেকটি জালার ভিতরে কুকুর-কুণ্ডলী হয়ে বসতে হবে একজনকে। তা হলে দু’পাশের ভার সমান হবে। বাকী তোমরা ছত্রিশজন ছত্রিশটা জালার মধ্যে ঐ একই ভাবে গুটিসুটি মেরে বসে পড়। তার আগে রশি দিয়ে জোড়া জোড়া জালার গলা বেঁধে এক একটা ঘোড়ার পিঠের দুপাশে ঝুলিয়ে দাও।

    সর্দারের কথামতো চোরগুলো প্রথমে প্রত্যেকটি ঘোড়ার দুই পাঁজরে দু’টি শূন্য জালা ঝুলিয়ে দিলো। তারপর এক একটিতে এক একজন ঢুকে পড়লো।

    প্রতিটি জালার মুখে হাল্কা করে নারকেলের ছোবড়া গুঁজে তালপাতার ঢাকা দিয়ে এমন ভাবে বেঁধে দিলো, যাতে ওদের শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে ফেলতে খুব একটা অসুবিধা না ঘটে। তারপর সে প্রতিটি জালার গায়ে একখানা ভোজালী এবং একখানা ডাণ্ডা বেঁধে দিয়ে তৈল সহযোগে নানা বিচিত্র ধরনের আঁকিবুকি এঁকে দিলো।

    এরপর সে ঘোড়াগুলোকে শহরের পথে চালিয়ে নিয়ে চললো।

    তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আলিবাবার বাড়ির সামনে এসে হাজির হলো সর্দার। সে সময় আলিবাবা তার ফটকের দোরগড়ায় আয়াস করে বসে জিরোচ্ছিল।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থাপিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো আটান্নতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    চোর সর্দার বিনয়ের অবতার হয়ে আলিবাবাকে সালাম সওগাত করে বলে, আমি এক সামান্য তেল ব্যবসায়ী, মালিক। এ শহর আমার একেবারে অচেনা, এই প্রথম এসেছি। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে, এখন কোথায় রাতটা কাটাই সেই সমস্যায় পড়েছি। যদি কিছু মনে না করেন এ বান্দা আজকের রাতটা আপনার আশ্রয়েই কাটাতে চায়। আপনার বাড়ির আঙ্গিনাটাও বেশ বড়সড়। আমার ঘোড়াগুলোও আরামে থাকতে পারবে।

    আলিবাবা সদাশয় মানুষ, তখুনি সে বিনীত হয়ে বললো, আপনি পরদেশী, মুসাফির, আমার ঘরে অতিথি হতে চান, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! আপনার কুণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নাই, মেহেরবানী করে অন্দরে আসুন। এ ঘর আপনার নিজের ঘর মনে করুন, আমি ধন্য হবে।

    সর্দারের হাত ধরে সে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসে।

    -মরজানা, ও মরজানা, দেখ কে এসেছে আমাদের ঘরে।

    মরজানা ছুটে আসে। আলিবাবা বলে, মুসাফির মেহেমান। খুব আদর যত্ন করবে। দেখো যেন কোনও ত্রুটি না হয়। ঘোড়াগুলোকে ভিতরে নিয়ে এসো। তেলের জালাগুলো সব সাবধানে নামিয়ে রাখ এক পাশে। আর ঘোড়াগুলোকে জাবনা দাও।

    সকলে মিলে ধরাধরি করে মাটির জালাগুলোকে অতি সন্তর্পণে নামিয়ে চত্বরের একপাশে সারবন্দি করে বসানো হলো। ঘোড়াগুলোকে যব আর ভোলা খেতে দিলো মরজানা। আলিবাবা মহামান্য অতিথিকে নিয়ে আদর আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে রইলো।

    বাড়ির বড় শোবার ঘরটায় চোর সর্দারের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা হলো। নানারকম ভুরিভোজে পরিতৃপ্ত করে চোর সর্দারকে শয্যা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়ে আলিবাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, নিশ্চিন্তে নিদ্রা যান মালিক, এ ঘর আপনার নিজের ঘর বলে মনে করবেন।

    সর্দার বলে, ও নিয়ে আপনি ভাবনা করবেন না শেখ সাহেব। আমার কোনও অসুবিধে হবে না। শুধু রাতের বেলায় পায়খানা প্রস্রাব পেলে কোথায় যাবো, জায়গাটা একটু দেখিয়ে দিয়ে যান।

    আলিবাবা সর্দারকে আঙ্গিনার একপাশে এসে পায়খানাটা দেখিয়ে বলে, দরকার হলে এখানে চলে আসবেন, মালিক।

    সর্দার দেখলো, পায়খানার পাশেই জালাগুলো রাখা হয়েছে। বললো, বহুত আচ্ছা, আর কোনও অসুবিধে হবে না। এবার আপনি নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন শেখ সাহেব।

    আলিবাবা চলে গেলে চোর সর্দার জালাগুলোর কাছে মুখ নামিয়ে ফিস ফিস করে বলে, শোনো সাঙ্গাতরা, আমি যখন জালার গায়ে ছোট একটা ঢিল ছুঁড়ে আওয়াজ করবো তৎক্ষণাৎ তোমরা তড়িঘড়ি জালা থেকে বেরিয়ে আমার ঘরের দিকে ছুটে আসবে। বুঝতে হবে তখনি শুরু হবে খতমের পালা।

    আর ক্ষণমাত্র সেখানে না দাঁড়িয়ে ঘরে ফিরে এলো সর্দার। মরজানা তখন একটা স্বল্পালোকের চিরাগ বাতি এনে ঘরের এক প্রান্তে রেখে সর্দারকে শুভরাত্রি জানিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

    মরজানা লক্ষ্য করে তেল-সওদাগর পালঙ্কে শোয়ামাত্র নাক ডাকাতে শুরু করেছে!

    মরজানার তখনও অনেক কাজ বাকী। রসুইখানায় ঢুকে সে বাসনপত্র বোয়ামোছা করতে থাকে।

    কিছুক্ষণ পরে মরজানার চিরাগের তেল ফুরিয়ে আসে। আলোটা নিভুনিভু হয়। কিন্তু তখনও সব কাজ তার শেষ হয়নি। সন্ধ্যাবেলায় দোকানে যাবে ভেবেছিলো, কিন্তু ঘরে অতিথি এসে পড়ায় আর তেল কিনে আনা হয়ে ওঠেনি।

    নিভন্ত চিরাগ হাতে সে আলিবাবার ঘরে আসে, এখন কী হবে মালিক, ঘরে এক ফোটা তেল নাই। সন্ধ্যাবেলায় দোকানে যাওয়ার ফুরসত পাইনি।

    আলিবাবা হাসতে হাসতে বলে, দূর বোকা মেয়ে। ঘরে তেল নাই কি বলিস, জলজ্যান্ত আটত্রিশটা তেলের জালা বসানো আছে আঙ্গিনায়। তোর আর কতটুকু তেল লাগবে? এখন যা, রাত হয়েছে, শুয়ে পড়গে। কাজ কাম যা বাকী আছে কাল সকালে সারলেই হবে।

    মরজানা আলিবাবাকে আর বিরক্ত না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পাশের বড় ঘরটায় তখন মহামান্য মেহেমান সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে নাসিকা গর্জন করে চলেছে। মরজানা আঙ্গিনায় নেমে আসে জালাগুলোর কাছে। একটুখানি তেল সে চিরাগে ভরে নেবে। কিন্তু একটা জালার মুখের ঢাকা খুলতে তেলের বদলে নারকেলের ছোবড়া দেখে ভড়কে যায়। যাই হোক ছোবড়াগুলে টেনে তুলতেই আরও অবাক হয়ে যায়। ঘাড় মুখ গুজে ঘাপটি মেরে বসে আছে একটা দামড়া লোক। ভয়ে শিউরে ওঠে মরজানা। সর্বনাশ, একি! তাড়াতাড়ি সে জালার মুখটা ঢাকা দিয়ে পাশের আর একটা জালার কাছে যায়।

    এক-এক করে সাঁইত্রিশটা জালা পরীক্ষা করে একই বস্তু প্রত্যক্ষ করে তাজ্জব বনে যায়। এ যে একটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র তা আর বুঝতে বাকী থাকে না তার।

    শেষের জালাটিতে তেলের সন্ধান পেয়ে আনন্দে নেচে ওঠে ওর চোখ। রান্নাঘরে গিয়ে উনুনে খানিকটা কাঠ ভরে দিয়ে কাপড় সিদ্ধ করার বিরাট কড়াটা চাপিয়ে দেয়। তারপর তেলের জালাটা টেনে এনে কড়াতে সবটা তেল ঢেলে দেয়।

    কিছুক্ষণের মধ্যে কড়া আগুনের জ্বালে টগবগ করে ফুটে ওঠেকড়ার তেল। আস্তাবল থেকে একটা বালতি আর মগ নিয়ে.আসে মরজানা। সেই ফুটন্ত তেল বালতি ভরে নিয়ে জানালার কাছে আসে সে।

    প্রথম জালাটার ঢাকনা খুলে ছোবড়া তুলে চোরটার মাথায় একটা গাঁট্টা মারতেই লোকটা কাঁক করে আওয়াজ তুলে ওপরের দিকে মুখ বাড়ায়। এবং তৎক্ষণাৎ মরজানা তার মুখের হার ভিতরে ঢেলে দেয় এক মগ ফুটন্ত তেল। লোকটা অদ্ভুত এক আর্তনাদ তুলে স্তব্ধ হয়ে যায় মুহূর্তে।

    মরজানা আর একটা জালার কাছে এগিয়ে যায়।

    এইভাবে এক এক করে সাঁইত্রিশটা জালার জঠরে তৈলদগ্ধ হয়ে সাঁইত্রিশ জনেরই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।

    এর পরের ঘটনার জন্য মরজানা রসুইখানায় ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকে।

    বেশ কিছু পরে, তখন মাঝ রাত হবে, মহামান্য অতিথি সাহেবের নাক ডাকার আওয়াজ থেমে যায়। মরজানা বুঝতে পারে সর্দারজীর ঘুম ভেঙ্গেছে। এবার তার খেলাটা শুরু হবে।

    এক মুঠো পাথরের নুড়ি সঙ্গে এনেছিলো সর্দার। এক এক করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে থাকে জালাগুলো লক্ষ্য করে। লক্ষ্য অব্যর্থ, সবগুলো জালার গায়েই টঙ্কার তোলে। কিন্তু সর্দার অবাক হয়, তার সাঙ্গাতরা কেউই মাথা তুলে দাঁড়ায় না। বিশ্রী ভাষায় সে গালাগাল দিয়ে ওঠে, শালা হারামীকা বাচ্চা, সব ঘুমে লটকে পড়েছে। দাঁড়া মজাটা আমি দেখাচ্ছি।

    মরজানা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে থাকে, সর্দারটি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে জালাগুলোর কাছে আসে। কিন্তু পোড়া তেল আর কাঁচা মাংস ঝলসানোর বিশ্রী গন্ধে নাকটা কুঁচকে ওঠে।

    ধীরে ধীরে সে একটা জালার মুখের ঢাকনা খুলেই আঁৎকে ওঠে, সর্বনাশ, তার সব ফন্দী ফিকির ফাঁস হয়ে গেছে! এ যে তার জালার তেলেই তার সঙ্গীসাথীদের সবাইকে পুড়িয়ে মেরেছে এরা।

    কয়েকটা জালার মুখ খুলে একই দৃশ্য দেখতে পেলো আর এক তিল সে দাঁড়ালো না। ঝটপট সদর খুলে ফোঁচা দৌড় দিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    সেই নিশুতি নিঃশব্দ রাতের অন্ধকারে মরজানা একা একা হেসে লুটোপুটি হতে থাকলো। রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    আটশো ঊনষাটতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে :

    মরজানা বুঝেছিলো আপাতত রাতের মতো বিপদ কেটে গেছে। তাই সে রাতে সে আর। আলিবাবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে খবরটা জানাবার দরকার মনে করে না।

    খুব সকালে আলিবাবার ঘুম ভাঙ্গে। দরজা খুলে সে বাইরে এসে দেখে মরাজানা ঘরের কাজ সারছে।

    —কী রে মরজানা, এই সাত সকালে উঠে পড়ে কাজে লেগেছিস। মরজানা মুখে কোনও কথা না বলে ইশারায় জালাগুলোর কাছে আসতে বলে আলিবাবাকে।

    —আপনি নিজে হাতে এই জালাগুলোর ঢাকা খুলে দেখুন মালিক, কাল রাতে কাকে আপনি মেহেমান বলে আপ্যায়ন করে ঘরে তুলেছিলেন।

    তাবৎ দৃশ্য দেখে শিউরে ওঠে আলিবাবা। মরজানার উপস্থিত বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতার কথা ভেবে অবাক হয়ে যায় সে।

    -মরজানা, তুমি যা করেছ তার কোনও জবাব নাই। আজ থেকে আমার এই সংসারের সব দায়-দায়িত্ব তোমার কাধে চাপিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হচ্ছি। আমি জানি, তুমি যেভাবে চালাতে পারবে তা আর কেউই পারবে না।

    আবদাল্লার সহযোগিতায় সেইদিনই ঐ সাঁইত্রিশ চোরের লাশ সমাধিস্থ করলো আলিবাবা। বাড়ির পাশেই একটা বাগান, সেই বাগানের মাঝখানে পেল্লাই বড় একটা গর্ত খুঁড়ে সবগুলো মড়াকে একসঙ্গে গণসমাধি দেওয়া হলো।

    আলিবাবার বড় ছেলে এখন কাসিমের দোকানে বসে। একদিন বাবাকে বললো, আমি তো দোকান-পাটের কিছুই জানতাম না আব্বাজান, আমাদের বাজারের হুসেনসাহেব আমাকে হাতে ধরে ধরে সব শিখিয়ে পড়িয়ে লায়েক করে তুলেছেন। এতো ভালো মানুষ বড় একটা দেখা যায় না। দিন দিনই তার কাছে বড্ড বেশি ঋণী হয়ে যাচ্ছি। প্রায়ই সে আমাকে তার সঙ্গে খানা-পিনা করতে ডাকে। আমি না বলতেও পারি না। কিন্তু বড় লজ্জা করে। কারণ আমি তো তাকে কোনও দিন খানা-পিনায় ডাকতে পারি না! আব্বাজান, আমার মনে হয়, ওকে একদিন আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো দরকার।

    আলিবাবা বলে, একশোবার দরকার। বেটা, তুমি আগে বললানি কেন, এমন সদাশয় লোকের পায়ের ধুলো পড়লেও বাড়ি পবিত্র হয়। না না, আর দেরি করো না, কালই আমি ভোজের আয়োজন করছি, তুমি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। কাল জুম্মাবার, শুভদিন তোমাদের দোকানপাটও বন্ধ থাকবে, বিশ্রামের দিন, সেই ভালো হবে। তাকে আমার তরফ থেকে নিমন্ত্রণ জানাবে। তাতে যদি সে লজ্জা বা বিনয় করে কোও অজুহাত দেখাতে চেষ্টা করে তুমি তার কোনও ওজর শুনবে না, ধরে নিয়ে আসবে।

    সুতরাং পরদিন সকালে আলিবাবার পুত্র হুসেনকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলো। আলিবাবা সাদর অভ্যর্থনা জানালো নতুন সওদাগরকে। হুসেনের বলিষ্ঠ সুন্দর চেহারা, মুখে চাপ দাড়ি। আলিবাবা আলাপ করে বড় প্রীত হলো।

    হুসেন বিনয়াবনত হয়ে বলে, আপনার আদর অভ্যর্থনায় আমি আহ্লাদিত হয়েছি, মালিক। কিন্তু খানা-পিনা থাক ও সবে আমার আবার অনেক বাছ-বিচার, থাক ওসব, এই যে আলাপ পরিচয় হলো, এর তো কোনও তুলনা নাই।

    আলিবাবা অবাক হয়ে বলে, খানা-পিনায় যদি বাছ-বিচার থাকে, বেশ তো সে সব জিনিস বাদ দিয়েই না হয় খাবে। কি কি খেতে মানা বলল, আমি সেই মতোই ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমার গরীবখানায় যখন পায়ের ধুলো দিয়েছ, শুধু মুখে যেতে দেব না, বাবা।

    হুশেন বলে, আমার মানত আছে বাড়ির বাইরে যদি কোথাও মাংসাদি খাই নুন দিয়ে খাব না।

    –বেশ তো এ আর বেশি কথা কী! নুন ছাড়াই তোমার জন্যে খানা পাকাতে বলছি। কোনও অসুবিধে হবে না।

    আলিবাবা ছুটে রসুই ঘরে গিয়ে মরজানাকে বলে, আজকের খাবারে কোনওরকম নুন দিও মরজানা। মেহেমান নুন খাবে না।

    কথাটা শুনে মরজানার কেমন খটকা লাগলো। এ কেমন কথা। খাবারে নুন খাবে না কেন সে?

    সন্ধ্যায় খাবার সাজানো হলো টেবিলে। আমন্ত্রিত অতিথি হুসেনকে পাশে নিয়ে খেতে বসলো আলিবাবা আর তার পুত্র। মরজানাই পরিপাটি করে পরিবেশন করলো সকলকে। মরজানা বেশ বুঝতে পারলো, সওদাগরটি বয়সে প্রবীণ হলে কী হবে, ক্ষণেক্ষণেই সে মরজানার রূপ-যৌবন দেখে চঞ্চল হয়ে উঠছে।

    খানাপিনা শেষ হয়ে গেলো। তিনজনে বসে তখন খোশ গল্প করছিলো। এমন সময় অপরূপ নর্তকীর সাজে সজ্জিত হয়ে মরজানা প্রবেশ করলো ঘরে। শুধু হুসেন নয়, আলিবাবা এবং তার পুত্রও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো মরজানার সাজ-সজ্জার বাহার দেখে। সূর্মা কাজলে এঁকেছে চোখ, পরণে দামী রেশমী শালোয়ার, কোমরে সোনার কোমরবন্ধ, একপাশে সোনার খাপে ঝোলানো একখানা ছোট্ট ভোজালী। গায়ে জমকালো কামিজ। তার ওপরে নানা মণিমুক্তো খচিত একটি খাটো জ্যাকেট। মাথায় সুন্দর একটি কাজ করা টুপী। এক কথায় বুকে আগুন ধরানো রূপ।

    মরজানার পিছনে তরুণ আবদাল্লা—তার হাতে নাচের বাদ্যযন্ত্র। হাতের যাদুতে সে অপূর্ব এক নৃত্যতাল বাজাতে শুরু করেছে। সে তালে তাল মেলাতে চাইবে না এমন বেরসিক কেবা আছে! আপনা থেকেই সে ছন্দে হৃদয় নেচে ওঠে-পা তাল ঠুকতে শুরু করে।

    মরজানা প্রথমে আলিবাবার সামনে এসে কুর্নিশ করে শ্রদ্ধা জানালো। তারপরই পাখীর মতো ফুড়ুৎ করে চলে গেলো ঘরের অপর প্রান্তে।

    শুরু হলো নাচ। অপূর্ব তাল-মান-লয় জ্ঞান তার। একেবারে নিখুঁত। তিনজনের সকলের মুখের ভাষা গেছে হারিয়ে। অপলক চোখে তারা মরজানার অপূরপ নৃত্যকলা দেখে মুগ্ধ হতে থাকে।

    একটানা কতক্ষণ নাচতে পারে মরজানা? মেয়েটির সারা অঙ্গের প্রতিটি মাংসপেশী নাচতে থাকে। নাচতে থাকে সেই ঘরের প্রতিটি ধূলিকণা, বাতাস।

    কত রকম নৃত্যই যে সে দেখাতে থাকলো তার সীমা সংখ্যা নাই। কখনও সে ইহুদীদের নাচ নাচে, কখনও জিপসী নাচ ধরে, আবার কখনও গ্রীক, কখনও পারসী, কখনও বা ইথিওপিয়ার গ্রাম্য নাচে মেতে ওঠে।

    তিন দর্শক যখন নিজেদের সত্তা ভুলে গিয়ে মরজানার তালে তাল। মিশিয়ে দিয়েছে সেই সময় মরজানা ভোজালী নৃত্য শুরু করে। ছোরা। হাতে সে নাচতে নাচতে ছুটে আসে দর্শকদের সামনে। আবার পলকে ঘরের অপর প্রান্তে ছিটকে পালিয়ে যায়। পরমুহূর্তেই সে বুকে তুফান তোলা ছন্দে নাচতে নাচতে আবার ফিরে আসে ওদের সামনে। ছোরাটা বাগিয়ে ধরে আলিবাবার পুত্রের বুকে। মনে হলো, এই বুঝি বসিয়ে দেবে সে। কিন্তু না তক্ষুণি সে পলকে পালিয়ে চলে যায় অপর প্রান্তে।

    পলে পলে উত্তেজনা, আশঙ্কা, শিহরণ—সব মিলে মরজানা এমন এক রোমাঞ্চকর নৃত্যকলা রচনা করে চলেছে যা মনপ্রাণ উত্তাল করে তোলে।

    ক্রুদ্ধ ফণিনীর মতো ছোরা হাতে ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটে আসে মরজানা। এমনভাবে ছোরাটা সে বাগিয়ে ধরে আসে যে, মনে হয় এই বুঝি কারো বুকে বসিয়ে দেবে সে। কিন্তু ওদের সামনে এসেই মরজানা ভোজালীটা মুহূর্তের মধ্যে নিজের বুকেই বাগিয়ে ধরে। মরজানার দেহটা ময়ূরীর পেখমের পিছন দিকে বেঁকে নুইয়ে পড়তে থাকে। ডান হাতের মুঠিতে ধরা ছোরাটা তখনও তার নিজের বুকেই তাক করা।

    আলিবাবা চঞ্চল হয়ে ওঠে। সর্বনাশ, যদি কোনও কারণে মরজানার পা ফসকে যায় তবে ছুরিটা আমূল বসে যাবে তার বুকের মধ্যে। একি সর্বনেশে নাচরে বাবা! দম বন্ধ হয়ে আসে।

    মরজানার চোখের ইশারায় আবদাল্লাহ পেয়ালার পাত্র মেলে ধরে দর্শকদের সামনে। আলিবাবা ভাবে মরজানা বকশিশ না পেলে এই আত্মহত্যার নাচ থামাবেনা। তাই সে জেব থেকে একটা মোহর বের করে আবদাল্লাহর পাত্রে ছুঁড়ে দেয়। বাবার দেখাদেখি ছেলেও একটি স্বর্ণমুদ্রা বকশিশ দেয়।মহামান্য অতিথি হুসেন সাহেবই বা হাত গুটিয়ে বসে থাকে কিকরে। সেও কোমর থেকে তোড়া খুলে তার মধ্যে হাত ঢোকায়। এবং সেই মওকায় মরজানা ঝাপিয়ে পড়ে হুসেনের ওপর। কোনও রকম সুযোগ না দিয়েই সে ভোজালীখানা আমূল বসিয়ে দেয় সে হুসেনের কলিজায়। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গগনভেদী আর্তনাদ তুলে হুসেন গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়।

    আলিবাবা এবং তার পুত্র দু’জনেই শিউরে ওঠে? একি সাংঘাতিক কাণ্ড?মরজানার কী মাথা খারাপ হয়ে গেলো?

    -না মালিক, মরজানা শান্ত সহজ কণ্ঠে বলে, মাথা আমার ঠিক আছে। আপনারা যাকে মহামান্য অতিথি মনে করে ঘরে এনেছিলেন আসলে সে কোনও সওদাগর নয়—ঐ শয়তান ডাকু সর্দার। এর আগে সে এসেছিলো তেল ব্যবসায়ী হয়ে।

    আলিবাবা অবাক হয়ে বলে, কিন্তু তার তত দাড়িগোঁফ ছিলো না কিছু?

    —এ দাড়িগোঁফও এর নিজের নয় মালিক, পরচুলা। এই দেখুন আমি টেনে খুলে দিচ্ছি, এবার নিশ্চয়ই চিনতে অসুবিধে হবে না?

    পিতাপুত্র উভয়েই বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগলো সেই তেল-ব্যবসায়ীই বটে!

    কৃতজ্ঞতায় রুদ্ধ হয়ে এলো আলিবাবার কণ্ঠ।

    —বেটি, তুমি দু’দুবার আমাদের গোটা পরিবারের জান বাঁচিয়েছ। তোমার বুদ্ধি বিচক্ষণতার তুলনা হয় না। আমি চাই তুমি আমার সংসারের মণি হয়ে চিরকাল এই সংসারেই বাস কর। আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। তুমি আর আমার কেন বাঁদী রইলে না। এবার তুমি স্বাধীন। আমার প্রস্তাব আমার ছেলেকে শাদী করে তুমি যদি আমার ঘর আলো করো, মা জননী, আমি খুব সুখী হবো।

    মরজানা লজ্জায় মাথা অবনত করে বলে, আপনাকে সুখী করা ছাড়া আমার আর দ্বিতীয় কোনও চিন্তা নাই, আব্বাজান।

    রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    আটশো ষাটতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলিবাবার পুত্রের সঙ্গে মরজানার শাদী হয়ে যাওয়ার পরে অনেকদিন মরজানা আলিবাবাকে সেই পর্বত গুহায় যেতে দেয়নি। তার কারণ চল্লিশ চোরের বাকি দু’জন হয়তো তখনও ঐ গুহাভ্যন্তরেই রয়ে যেতে পারে। কিন্তু ওরা কি করে ভাববে সে দু’জনকে চোরসর্দারই নিজের হাতে হত্যা করেছিলো।

    এইভাবে পুরো একটা বছর কেটে গেছে। আলিবাবা ছেলেকে সঙ্গে করে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যায় আর ঘরে থাকে মরজানা।

    একদিন আলিবাবা বায়না ধরলো, ঢের দিন চলে গেছে মা জননী, আমার মনে হয় ওদের আর কেউ বেঁচে বর্তে নেই দুনিয়ায়। তাহলে কি আমাদের রেয়াৎ করতো সহজে। এবার তুমি অনুমতি দাও, আমি একবার গুহায় গিয়ে ধনরত্নগুলো ঘরে এনে তুলি?

    মরজানা বলে, ঠিক আছে আব্বাজান, কাল সকালে আপনাদের সঙ্গে আমিও যাবো ঐ গুহা দেখতে।

    পরদিন তিনজনে অতি সন্তর্পণে গুহা সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়। মরজানা সূক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্না মেয়ে। সে দেখলো, গুহার দিকে যাওয়ার পথটা লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গলে সমাকীর্ণ হয়ে গেছে। ভালো করে লক্ষ্য করে বোঝা যায় এ পথে বহুদিন কোনও জন-মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। চোর দু’টো যদি সত্যিই জীয়ন্ত থাকতো তবে নানা কারণেই তারা বাইরে আসতে বাধ্য হতো। এবং তাদের যাওয়া আসার একটা ছাপ অবশ্যই আঁকা থাকতো এখানে। মরজানা বললো, চলুন আব্বাজান, গুহার ভিতরে ঢোকা যাক। আমি নিশ্চিত, এখন আর এখানে কেউ যাতায়াত করে না। আমরা নির্ভয়ে ঢুকতে পারি এখন।

    আলিবাবার মনে তখনও ভয়ের কালো মেঘ দানা বেঁধে ছিলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে হাঁক ছাড়ে চিচিং ফাঁক!

    সঙ্গে সঙ্গে গুহামুখ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তিনজনেই নিচে নেমে যায়। আলিবাবা দেখে যেমনটি সে দেখে গিয়েছিলো ঠিক তেমন রয়েছে সবকিছু। কেউ কিছু সরিয়ে নিয়ে যায়নি।

    খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব মণিরত্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওরা তিনজনে সবচেয়ে মূল্যবানগুলো তিনটি বস্তায় ভরে নিয়ে বাড়ি চলে এলো।

    এরপরে আর তারা কখনও ঐ রত্নগুহায় যায়নি। যাওয়ার দরকারও হয়নি। যে ধনরত্ন তারা নিয়ে এসেছিলো সেদিন তারই কল্যাণে সারা মুলুকে তাদের মতো ধনী মানুষ আর কেউ ছিলো না। আলিবাবা বলতো, এই আমাদের অফুরান, আর বেশি সম্পদে কাজ নাই। আল্লাহর কৃপা থাকলে কোনও কিছুরই অভাব হয় না। তিনি হাত গুটিয়ে নিলে সোনামুঠিও ধুলো হয়ে যায়।

    মহানুভব শাহেনশাহ, এই আমার কিসসা। জানি না কেমন লাগলো আপনার।

    শাহরাজাদ থামলো। সুলতান শাহরিয়ার বলেন, সত্যিই বড় চমৎকার তোমার কাহিনী শাহরাজাদ, তুলনা হয় না। আজকের দিনে মরজানার মতো বুদ্ধিমতী বিচক্ষণা নারী চোখে পড়ে না। কিন্তু আমি নিত্য নতুন নারী-সম্ভোগ করে তার শিরচ্ছেদ করি। এর প্রতিশোধ নেবার জন্যে হয়তো কোনওদিন তেমন এক মেয়ে আমার সামনে এসে এর সমুচিত জবাব দিয়ে যাবে।

    শাহরাজাদ দেখলো। সুলতান কিছু বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তাই সে নতুন কাহিনী শুরু করতে দ্বিধা করতে লাগলো।

    কিন্তু পরক্ষণেই সুলতান নিজেকে সহজ করে নিয়ে বললেন, তাহলে নতুন কিত্সা শুরু কর, শাহরাজাদ, রাত এখন অনেক বাকী।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.