Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.৩৫ শাহজাদা হীরার কাহিনী

    এক সময়ে এক দেশে এক ন্যায়পরায়ণ সুলতান ছিলেন। তার নাম সামস শাহ। তার একটি মাত্র পুত্র সন্তান। আচারে ব্যবহারে তার তুল্য শাহজাদা খুব কমই ছিলো সে সময়।

    একদিন শাহজাদা হীরা সুলতানকে বললো, আব্বাজান মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে, আমি দু’ একদিনের জন্যে শিকারে যাবো ভাবছি।

    প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র, তার ইচ্ছা পূরণের কোনই ত্রুটি করলেন না সুলতান। লোকলস্কর সঙ্গে দিয়ে দিনক্ষণ দেখে ছেলেকে শিকারে পাঠিয়ে দিলেন।

    শাহজাদা হীরা তার দলবল নিয়ে এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হলো। একটা বিশাল বটবৃক্ষের নিচে ছাউনি গাড়লো সে। উপরে উন্মুক্ত নীল আকাশ, সামনে কল্লোলিনী ঝরণা অবিরত ঝরে চলেছে।

    এক সময় একটি খরগোেশ তৃষ্ণার্ত হয়ে জলপান করতে এলো সেখানে। শাহজাদার ইশারায় তার দলের লোকেরা খরগোশটিকে ধরবার মতলব করলো। কিন্তু খরগোশটি ওদের চাতুরী বুঝতে পেরে পানি পানের আশা পরিত্যাগ করে প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালো। হীরাও ছুটলো তার পিছনে। কিন্তু খরগোশের গতি রুদ্ধ করতে পারলো না শাহজাদার তাজি ঘোড়া। পিছু পিছু ধাওয়া করতে করতে এক সময় শাহজাদা এসে পৌঁছলো এক জনমানব শূন্য মরুপ্রান্তরে।

    এক সময় এক বালির পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলো খরগোশটি। হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো শাহজাদা। শেষ চেষ্টা করার জন্য সে বালি-পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করলো। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পরও কোনও হদিশ করতে পারলে না খরগোশের।

    পাহাড়ের ওপারে শস্যশ্যামল প্রান্তর দেখে শাহজাদা নিচে নেমে যায়। নানারকম গাছপালার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে এক সময় সে এক মনোরম উদ্যানে এসে উপস্থিত হয়। একটা গাছের নিচে একটি সিংহাসন দেখে সেই দিকে এগিয়ে যায়। সিংহাসনে আসীন ছিলেন এক মুকুটধারী নরপতি। তার অঙ্গে মূল্যবান সাজ-পোশাক, কিন্তু কি আশ্চর্য তার পা দু’খানা নগ্ন।

    শাহজাদা হীরা-সম্রাটকে সালাম জানায়।

    সম্রাট জিজ্ঞেস করেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনও সুলতান বাদশাহর সন্তান তুমি। কিন্তু এই জন-মানুষের অগম্য স্থানে কী করে এলে তুমি। এখানে তো বনের পাখিও কখনও উড়ে আসার সাহস করে না।

    শাহজাদা তার খরগোশ অভিযানের কাহিনী বললো তাকে। তারপর জিজ্ঞেস করলে, কিন্তু মহারাজ আপনি এই সিংহাসনে একা একা বসে আছেন কেন এখানে? মনে হচ্ছে আপনার কাহিনী আরও বিচিত্র।

    সম্রাট বললো, হ্যাঁ, সত্যিই বড় অদ্ভুত সে কাহিনী। আমাকে সে সব কথা বলার জন্য পীড়াপীড়ি করো না। তোমার তা শোনা উচিত হবে না, বাবা। শুধু শুধু তুমি মনে দুঃখ পাবে।

    শাহজাদা বললো সেজন্য আপনি বিচলিত হবেন না সম্রাট, মেহেরবানী করে বলুন, আমি শুনতে ইচ্ছা করি।

    সম্রাট ক্ষণকাল মৌন থেকে কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, তা হলে শোনো, বাবা?

    এই মরুদ্যানে আসার আগে অগণিত পাত্রমিত্র সভাসদ এবং হাজার হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্রবল পরাক্রমে ব্যাবিলনে রাজত্ব করতাম আমি। ঈশ্বরের অনুগ্রহে সাত পুত্র-সন্তানের জনক হতে পেরেছিলাম। বিপুল বিত্ত-বৈভব ধনদৌলতের মালিক হয়ে সুখ-সম্ভোগের মধ্যে রাজত্ব করছিলাম।

    সবই সুন্দর যথাযথভাবে চলছিলো। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলো, যখন আমার জ্যেষ্ঠপুত্র বহু দূর দেশ সিন মাসিনের রাজকুমারীর সাহচর্যে এলো। তার পিতা সম্রাট তামুজের পুত্র সম্রাট কামুস। সে সময়ে সারা পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ নরপতি হিসাবে বিশ্ববিদিত ছিলেন তিনি। রাজকুমারীর রূপের জেল্লার কাছে আকাশের চাঁদ ম্লান হয়ে যেত।

    একদিন এক পর্যটক এসে উপস্থিত হলো আমার দরবারে। তার বিবরণ থেকে জানতে পারলাম সম্রাট কামুস-কন্যা বিয়ে করবে, সেই নিমিত্ত পর্যটক পৃথিবী পরিভ্রমণে বেরিয়েছে। দেশে দেশে ঘুরে সে সমস্ত রাজা বাদশাহদের কাছে এই শুভ বার্তা বিতরণ করে বেড়াচ্ছে।

    রাজকুমারী বিবাহ করবে। কিন্তু পাত্র তার মনের মতো হওয়া চাই। মনের মতো বলতে কি বোঝাতে চায় পর্যটক, জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো, না কোনও পরম রূপবান বীরপুরুষ বা অতুল ঐশ্বর্য্যের মালিক সে চায় না; তার যে স্বামী হবে তাকে একটি মাত্র প্রশ্নের সঠিক উত্তর বাতলে দিতে হবে।

    —কী সে প্রশ্ন? পর্যটক জানালো রাজকুমারীর প্রশ্ন :

    সাইপ্রাস এবং ফারকোনের মধে সম্পর্ক কী? এই প্রশ্নের যিনি প্রকৃত উত্তর করতে পারবেন রাজকুমারী তার গলায় মালা দেবেন। কিন্তু একটা শর্ত, যদি কোনও যুবরাজ তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হন তবে তিনি তাঁর শিরচ্ছেদ করবেন।

    আমার জ্যেষ্ঠপুত্র বললো, আমি রাজি বাবা। রাজকুমারীর প্রশ্নের জবাব আমার জানা আছে। আপনি আমাকে সিন মাসিনে যাত্রা করার অনুমতি দিন।

    পুত্রের নিশ্চয়ই মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, তা না হলে সে এই; ধরনের শর্তে রাজি হয়ে মৃত্যুর দিকে হাত বাড়াতে চায়! হাকিম বদ্যিদের ডেকে এনে তাকে পরীক্ষা করালাম। কিন্তু কেউই তাকে সুস্থ করে তুলতে পারলো না। আমি পুত্রকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার একই গো, সিন মাসিনে সে যাবেই এবং সেই উদ্ভট প্রশ্নের মীমাংসা করে দিয়ে সম্রাট-দুহিতাকে বিবাহ করে আনবে। কোনও ভাবেই যখন তাকে বিরত করা গেলো না তখন আমি তাকে পাল্টা প্রস্তাব দিলাম শোনো বাবা, সেই রাজকুমারীকে বিয়ে করার বাসনা যদি তুমি পরিত্যাগ করতে না পার তবে এক কাজ কর। সিন মাসিনে তুমি যাত্রা কর আমি তাতে বাধা দেব না কিন্তু একা তুমি যেও না সেখানে। আমি আমার এক বিশাল সৈন্যবাহিনী তোমার সঙ্গে দিচ্ছি।বীরের মতো গিয়ে সম্রাট কামুসের কাছে গিয়ে তার কন্যাকে দাবী কর। তাতে যদি সে সম্মত হয় ভালো রাজকুমারীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু সে যদি রাজি না হয় তা হলে যুদ্ধ করে তাকে বন্দী করবে। তাতে প্রয়োজন হলে আমার সমস্ত শক্তি আমি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবো না। ভেবে দেখ এই-ই হচ্ছে রাজধর্ম।

    কিন্তু আমার পুত্র এ কথায় সম্মত হলো না।

    —আপনি ঠিক বলছেন না বাবা। সিন সম্রাট তো আমাদের মর্যাদার কোনও হানি করেন নি। তার প্রস্তাব যথেষ্ট সম্মানজনক। এখানে যুদ্ধের কথা আসে কি করে। না বাবা, আপনি বাধা দেবেন না, সিন মাসিনে আমি একাই যাবো। এ পরীক্ষা তো শৌর্যের বীর্যের না, এ প্রমাণ হবে আপনার পুত্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি। আমাকে সেই শিরোপা আদায় করে নিতে অনুমতি দিন, বাবা।

    আমি বুঝতে পারলাম নিয়তি তাকে টানছে। বাধা দিতে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। আমি তার যাত্রার ব্যবস্থা করে দিলাম। যথাসময়ে সে সিন মাসিনে রওনা হয়ে গেলো।

    যথা সময়ে খবর পেলাম, আমার পুত্র রাজকুমারীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর করতে পারেনি বলে শিরচ্ছেদ করা হয়েছে। শোকে কাতর হয়ে শয্যা নিলাম আমি। সারা রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে এলো।

    এরপর আমার দ্বিতীয় পুত্রের মাথাতেও সেই এক ভূত ভর করলো। আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও তাকে বিরত করতে পারলাম না। সেও গেলো সিন মাসিনের সম্রাট-কন্যার আশায়। কিন্তু

    অনিবার্য কারণেই তারও একই পরিণতি ঘটলো।

    এইভাবে এক এক করে আমার বাকী পাঁচ পুত্রেরও জীবনান্ত ঘটলো ঐ সিন মাসিন সম্রাটের তরবারীর আঘাতে।

    এ আঘাত আমি সহ্য করতে পারলাম না। সাম্রাজ্যের দম্ভ ধূলিসাৎ হয়ে গেলো, বিত্ত বৈভব বিক্রম সব তুচ্ছ মনে হলো আমার কাছে। তাই সব পরিত্যাগ করে বিবাগী হয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম একদিন। চলতে চলতে অবশেষে একদিন জনমানবশূন্য এই মরুদ্যানে এসে আশ্রয় নিলাম। আজ আমি রিক্ত নিঃস্ব একা—বাদ্যবিহীন সম্রাট।

    শাহজাদা হীরা সম্রাটের এই হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনে চোখের জল রোধ করতে পারলো না।

    ব্যাবিলন সম্রাটের কথা এখনকার মতো থাক, এবার শাহজাদা হীরার কাহিনী শুনুনঃ খরগোশটি তাড়া করার সময় শাহজাদা হীরা তার সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে নিতে চায়নি। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো, তবু শাহজাদা ফিরে এলো না দেখে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। এদিক ওদিক সন্ধান করতে করতে এক সময় তারা বিস্তীর্ণ মরু-প্রান্তরে এসে উপনীত হলো। কিন্তু শাহজাদার সন্ধান করতে না পেরে প্রাসাদে ফিরে সুলতানকে সংবাদ জানানো প্রয়োজন মনে করলো।

    এদিকে শাহজাদ হীরা ছাউনিতে ফিরে এসে তার দল-বলের কাউকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে প্রাসাদের উদ্দেশে ফিরে চললো।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো ছয়তম রজনীতেআবার সে বলতে থাকে–

    সুলতান সামস শাহ পুত্রকে ফিরে পেয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন বারংবার। কিন্তু শিকারে গিয়েও তার মনের দুঃখ এতটুকু লাঘব হয়নি দেখে চিন্তিত হলেন।

    হীরা বাবার কাছে সেই মর্মান্তিক কাহিনীটি খুলে বললো। শাহ বললেন, তুমি শান্ত হও বাবা, এমন কাহিনী শুনলে স্বভাবতই মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আমি আজই আমার দূত পাঠাচ্ছি সিন মাসিন সম্রাট কামুসের কাছে। আমি তার কন্যাকে এখানে পাঠানোর জন্য দাবী জানিয়ে খৎ লিখছি। আমার ইচ্ছা ঐ রাজকন্যার সঙ্গে তোমার শাদী দেব। তার যথাযোগ্য মর্যাদা রক্ষার জন্য আমি বহু মূল্যবান রত্ন মণি-মাণিক্য উপটৌকণ পাঠাচ্ছি এই সঙ্গে। সে যদি আমার উপহার গ্রহণ করে তার রাজকন্যাকে সমর্পণ করতে সম্মত হয় তবে কোনও ঝামেলাই থাকবেনা। কিন্তু তা না হলে যুদ্ধ অনিবার্য। আর সে যুদ্ধে সম্রাট কামুসের লাশ লুটিয়ে পড়বে মসনদের নীচে। সে যদি সত্যিই বিচক্ষণ হয় তবে আমার প্রস্তাবে অমত করবে না।

    শাহাজাদা হীরা বললো, না বাবা দূত পাঠিয়ে দরকার নাই। আমি নিজেই যাবো সম্রাট কামুসের সামনে। আমার বুদ্ধির জোরে রাজকুমারী মুরাকে জয় করে আনবো আমি। আপনি আমাকে অনুমতি করুন।

    সুলতান গুম হয়ে থাকলেন ক্ষণকাল। তারপর বললেন, তুমি আমার বংশের একমাত্র সলতে, আমার নয়নের মণি। তোমাকে আমি ঐ পর্যন্ত রাজার সামনে যেতে দিতে ইচ্ছা করি না। ঐ অসম্ভব আজগুবি প্রশ্নের জবাব দিতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র। সেধে মৃত্যুর কাছে মাথা নুইয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

    শাহজাদা হীরা কিন্তু বাবার এ কথায় নিবৃত্ত হলো না। তার একচোখা মনোভাবের কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারলেন না তিনি। বাধ্য হয়ে তিনি ছেলেকে সিন মাসিনে রওনা করে দিলেন।

    তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শাহজাদা সিন মাসিনে এসে উপস্থিত হলো একদিন। রাজার প্রাসাদ বহু দূর থেকে নজর আসে। পাহাড়ের চেয়েও উঁচু তার চুড়া।

    প্রাসাদের সিংহদরজায় প্রবেশ করতে গিয়ে সোনার হরফে লেখা একটি সতর্কবাণী দেখলো শাহাজাদা। যদি কেউ রাজকুমারীকে লাভ করতে চায় তবে তাকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করতে হবে।

    প্রাসাদের দ্বার রুদ্ধ ছিলো। সিংহদরজার সামনে বাঁধা ছিলো বিশাল একটা দামামা। শাহজাদা দামামায় আঘাত করে আকাশ বাতাস কাঁপানো আওয়াজ তুললো। এবং সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো দরজাটা। সশস্ত্র প্রহরী নমস্কার জানিয়ে সাদরে অভ্যর্থনা করে তাকে প্রাসাদের অভ্যন্তরে নিয়ে গেলো।

    সম্রাট বসেছিলেন সিংহাসনে। শাহজাদা হীরাকে দেখে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কত শত যুবরাজ নিজের প্রাণ বলি দিয়ে গেলো তাতেও তুমি চৈতন্য লাভ করতে পারলে না, প্রাণ দিতে এলে বাবা? আমার কথা শোনো, তোমার ঐ অসম্ভব আশা পরিত্যাগ কর। তোমাকে দেখে প্রত্যয় হচ্ছে তুমি খুবই অভিজাত কোনও শাহবংশের সন্তান। আমি তোমাকে আমার দরবারের উচ্চপদে বহাল করছি। তুমি সানন্দে তা গ্রহণ করে নিজের প্রাণ রক্ষা কর! আমার কন্যা কি ধাতুতে গড়া আমি নিজেও জানি না বাবা, ঈশ্বর তাকে এতো জ্ঞান, এতো বুদ্ধি দিলেন কেন তাও বুঝতে পারি না। কয়েক শ’ রাজপুত্র তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নেমে নিজেদের প্রাণ খোয়ালো, এ তো আমার ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু কি করবো, আমার কন্যার এক পণ, তাকে যে তর্কে হারাতে পারবে শুধু তাকেই সে বরণ করে নেবে স্বামীত্বে।

    শাহজাদা হীরা বললো, আপনার উপদেশ আমার মনে থাকবে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এসেছি এখানে তা থেকে বিচ্যুত হবো না কিছুতেই। আপনি রাজকুমারীর সঙ্গে তর্কযুদ্ধের আয়োজন করে দিন, আমি তাকে পরাস্ত করবো।

    সম্রাট কামুস বললেন, পথশ্রমে এখন তুমি ক্লান্ত, উত্তেজিত। এখানে তিনদিন বিশ্রাম কর, খুব ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা বার বার চিন্তা করে দেখ। তারপরও যদি তোমার মত না পালটায় অবশ্যই আমাকে তর্কযুদ্ধের আসর বসাতেই হবে।

    সম্রাটের কথামতো শাহজাদা হীরা প্রাসাদে অতিথি হয়ে রইলো তিনদিন। রাজসিক আদর আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না সম্রাট। শাহজাদা হীরা বিকালে প্রাসাদ-সংলগ্ন উদ্যানে পায়চারী করে বেড়ায়। প্রকৃতির মনোরম শোভা দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যায় তার।

    উদ্যানের এক প্রান্তে একটি সুন্দর ঝরণা দেখে সেইদিকে এগিয়ে যায় হীরা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। ঝরণার জলে ভিজিয়ে দেয় তার সারা অঙ্গ।

    অনেকক্ষণ ধরে ঝরণাধারায় সিক্ত হয়ে এক সময় সে উঠে এসে বসে এক খোলা জায়গায়। গায়ে রোদ লাগিয়ে পরনের সাজ-পোশাক শুকাতে থাকে। যেদিকে তাকায় শুধু ফুল আর ফুল। কত শত বিচিত্র বর্ণের ফুলে ফুলে ভরা সারা বাগিচাটা। আর কত না নাম না জানা সুন্দর পাখি। গাছের ডালে ডালে নাচানাচি করে খেলে বেড়াচ্ছে। দেখে দেখে মন প্রাণ পূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক পরে এক সময় হীরা উঠে প্রাসাদের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ তার চোখ পড়ে ঝরণার পাশে এক গালিচায় অর্ধশায়িতা এক বেহেস্তের হুরীর মতো পরমাসুন্দরী এক তরুণীর ওপর। তার। চারপাশে বসে আছে তার প্রিয়সখিরা।

    হীরা নিজেকে একটা গাছের গুঁড়ির আড়াল করে লুকিয়ে লুকিয়ে সুন্দরীর রূপ-সুধা পান করে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলো। এমন সময় সম্রাট-নন্দিনীর এক সখি তাকে দেখে ফেললো।

    দেখুন রাজকুমারী, ঐ গাছের আড়ালে যেন এক যুবককে দেখতে পাচ্ছি। সবাই চমকে ওঠে। রাজকুমারী মুরা নিজেকে আড়াল করার জন্য স্তব্যস্ত হয়ে সখিদের সামনে দাঁড় করায়।

    রাজকুমারী মুরার সবচেয়ে পেয়ারের সখি মতিয়া। সে বলে, আমার মনে হচ্ছে, এই অপরূপ সুন্দর যুবক ইহজগতের কেউ নয়। হয়তো স্বর্গ থেকে ধরায় নেমে এসেছে।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো সাত রাত্রিতে আবার সে বলতে শুরু করলো :

    মুরা উঁকি দিয়ে দেখলো হীরাকে! মতিয়া বাড়িয়ে বলেনি, সত্যিই এমন রূপবান পুরুষ এর আগে সে দেখেনি কখনও।

    প্রথম দর্শনেই ভালোবাসোকথাটার অর্থ বুঝতে পারতো না সে এতকাল। আজ হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করলো এই মুহূর্তে। এক পলকের মধ্যে তার সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেলো। বুকের মধ্যে কেমন যেন আকুপাকু করতে থাকলো। এরই নাম কি প্রেম?

    মুরা ক্রমশঃ অস্থির অশান্ত হয়ে ওঠে। কাটা মুরগী যেমন ছটফট করতে থাকে সেই রকম আর

    কি।

    হীরার দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারে না। মতিয়া ঠাট্টা করে বলে, তাহলে রাজনন্দিনীর পণ এতদিনে ভাঙ্গলো?

    হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পায় মুরা। প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, না না না, তা কিছুতেই হবে না, হতে পারে না। আমার দাবী পূরণ না হলে কেউ আমাকে পাবে না। কারো নিছক প্রেমে নিজেকে হারিয়ে দেবার পাত্রী আমি নই, মতিয়া। দাঁড়া, তোরা এখানে দাঁড়া, আমি নিজেই ওর সামনে যাচ্ছি।

    রাজকুমারী মুরা শান্ত অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে হীরার সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। ধীর অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বলে, আপনি আমাদের পরম আরাধ্য অতিথি। আপনার জন্য সমাদর মঞ্চ ব্যবস্থা করা আছে। অনুগ্রহ করে সেখানেই আপনি সুখ-বিলাসে সময় অতিবাহিত করুন, ভদ্র। এ উদ্যানে আমরা বিহার করছি। এখানে আপনার থাকা শোভা পায় না।

    রাজকুমারী মুরাকে কাছে পেয়ে হীরা আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। খপ করে ওর একখানা হাত টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলে, অতসব কি হিসেব করে চলে, জীবনটা অঙ্ক নয়, রাজকুমারী রাজকুমারী মুরা জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় হীরার গালে। তারপর হনহন করে হেঁটে বাগান থেকে বেরিয়ে চলে যায় প্রাসাদের অন্দরমহলে।

    হীরা ব্যর্থ বিষণ্ণ হয়ে নিজের কক্ষে ফিরে আসে। সেখানে কিন্তু প্রায় সারা দিন-রাত রাজকুমারীর সখীরা তার পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে নিয়ত। তার পালঙ্কে শয্যা রচনা করা, নানা উপচারে খানাপিনা সাজিয়ে দেওয়া, সুমধুর সঙ্গীত-বাদ্যে মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলা প্রভৃতিতে কোনই ত্রুটি রাখলো না তারা।

     

    পরদিন একসময় মতিয়া হীরাকে একা পেয়ে প্রেম নিবেদন করলো তার কাছে, আমি জানি, আমি তোমার যোগ্য নই, তবু তোমাকে দেখা মাত্র আমি ভালোবাসার আগুনে জ্বলছি। শুধু একটু দয়া কর, তোমার প্রেমের ভিখারিণী আমি, আমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিও না তুমি। অবশ্য তার বদলে আমি। তোমার অনেক উপকার করবো। তুমি যে ফাঁদে এসে পা রেখেছ, এ ফাঁদে কত শত রাজা-বাদশার ছেলে প্রাণ দিয়ে গেছে এর আগে জানো বোধ হয়। তোমারও সেই একই দশা হবে! এ কি অনিবার্য! একমাত্র আমিই পারি তোমাকে। বাঁচাতে!

    হীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কী ভাবে?

    হীরার কিন্তু সন্দেহ জাগে, হয়তো রাজকুমারী মুরাই মেয়েটিকে পাঠিয়েছে চর হিসাবে। মতিয়া বলে, রাজকুমারী মুরার দুঃসাধ্য প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে বহু শত প্রাণ বলি হয়েছে। আমি জানি ঐ কঠিন প্রশ্নের জবাব তুমিও দিতে পারবে না, এবং তোমারও ঐ একই দশা হবে। আমাকে বিশ্বাস কর শাহজাদা, আমি তোমাকে বাঁচার উপায় বাৎলে দেব। কিন্তু একটা শর্ত—আমাকে বিয়ে করে তোমার অঙ্কশায়িনী করতে হবে। আমি হবো তোমার বেগমদের প্রধান। বলো, রাজি?

    হীরা তৎক্ষণাৎ মতিয়ার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বললো, আমি রাজি।

    মতিয়া বলে, আমাদের রাজকুমারীর পালঙ্কের তলায় একটা হাবশী আছে। লোকটা এসেছে ওয়াকাক থেকে। ঐ লোকটার মাথা থেকে বেরোয় যতসব উদ্ভট প্রশ্ন। সবই ফিরকোন এবং সাইপ্রাস সম্বন্ধে। সে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না কেউ। দেওয়া সম্ভবও না। যদি তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর করতে চাও তোমাকে আগে যেতে হবে সেই ওয়াকাক দ্বীপে। সেখানে গেলেই তুমি তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে। কিন্তু সে পথ বড় দুর্গম। তবু তোমাকে যেতেই হবে সেখানে।

    মতিয়ার কাছ থেকে পথ-নির্দেশ নিয়ে হীরা ওয়াকাকের পথে ঘোড়া ছুটালো। চলতে চলতে এক মরূদ্যানে এসে এক গাছের তলায় এক দরবেশের দেখা পেলো হীরা। তার পরিধানে সবুজ আলখাল্লা, পায়ে হলুদ রঙের চপ্পল। ঘোড়া থেকে নেমে যথাবিহিত সালাম সম্মান জানিয়ে হীরা জিজ্ঞেস করলে, মেহেরবানী করে আমাকে ওয়াকাকের পথ বলে দিন, পীরসাহেব।

    পুণ্যাত্মা দরবেশ ক্ষণকাল মৌন হয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, বেটা, তুমি শাহেনশাহর পুত্র, ঐ মানুষের অগম্য স্থানে তুমি যেতে পারবে না, অত দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারবে না তুমি। ওপথে গেলে কেউ আর ফিরতে পারে না, প্রাণ হারাতে হয়। তাই বলছি, বাবা, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।

    হীরা যুক্তকরে মিনতি করে, আপনি মহানুভব পীর, আপনার আজ্ঞা আমি শিরোধার্য করেই বলছি, ফিরে যাওয়ার জন্য আমি পথে বেরোইনি। আপনি আমাকে পথ বলে দিন।

    দরবেশ বুঝলেন শাহজাদাকে নিরস্ত করা যাবে না। তাই বললেন, শোনো বাছা ওয়াকাক দুস্তর কাফ পর্বতমালার ঠিক মাঝখানে। আমি জানি না ঐ দুর্গম গিরিসঙ্কুল পথ পারি দিয়ে কি করে সেখানে পৌঁছতে পারবে তুমি। তুমি কি জান, ঐ কাকে একমাত্র জিন পরীরাই বসবাস করে? সেখানে কোনও মানব-সন্তান অদ্যাবধি পৌঁছাতে পারেনি। এখান থেকে যাওয়ার তিনটি পথ আছে। কিন্তু তার মধ্যে একটিমাত্র পথ কিছুটা চলার উপযোগী। আর দু’টি একেবারেই দুর্লঙ্ঘ। যদি তুমি যাবেই ঠিক করে থাক তবে কাল অতি প্রত্যুষে এই ডানদিকের পথ ধরে এগিয়ে যাবে। যেতে যেতে একসময় এক পাহাড়-পাদদেশে পৌঁছে একখণ্ড শিলালিপি দেখতে পাবে। লেখাটা কিউফিস কায়দায় প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ করা আছে। সহজেই পড়তে পারবে সে লেখা। তা থেকেই তুমি যথাযথ নির্দেশ পেয়ে যাবে।

    পরদিন সকালে যাত্রা শুরু করে যথাসময়ে সে এক পাহাড়-পাদদেশে পৌঁছে সেই প্রস্তরফলক দেখতে পেলো। পাথরে খোদাই করে তিনটি কথা লেখা ছিলো?

    যদি তুমি বাঁদিকের পথ ধরো, তবে তোমাকে অনেক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। যদি তুমি ডানদিকের পথ ধরে চলো, তবে পরিশেষে অনুতাপ করতে হবে। আর যদি মাঝের রাস্তায় যাও তবে দেখবে সে কি দুর্গম ভয়াল ভয়ঙ্কর পথ।

    শিলালিপি পাঠান্তে শাহজাদা হীরা মাঝের দুর্গম পথই বেছে নিলো। এক মুঠি ধরণীর মাটি বুকে করে নিয়ে সোজা ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। আল্লা যদি চান ঐ পাহাড়চূড়ায় ওঠার আগেই ভূপতিত হয়ে রেণু রেণু হয়ে যাবো।

    পুরো একটা দিন আর রাত্রি পার হয়ে গেলো। ভোরের আলো ফুটতেই চোখে পড়লো এক বেহেস্তের মনোরম দৃশ্য। লতাপাতা তরুশাখায় পল্লবিত কুসুমিত এক অনিন্দ্যসুন্দর উদ্যান। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

    আরও কাছে এসে বুঝতে পারলো বাগানের প্রবেশদ্বার এক বিশাল পাথরের চাই-এ অবরুদ্ধ করা আছে। এবং তার পাশেই প্রহরায় দাঁড়িয়ে আছে এক দৈত্যাকৃতি বিকট বিশাল নিগ্রো। তার মাথায় শিরস্ত্রাণ, দেহে লৌহবর্ম বুকে ঢাল এবং হাতে শাণিত খঙ্গ। লোকটা চিৎপাত হয়ে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।

    শাহজাদা হীরা নির্ভয়ে ঘোড়া থেকে নামলো। ঘোড়াটাকে নিগ্রোর মাথার কাছে খুঁটো করে পাথরের চাই বেয়ে ওপরে উঠে বাগানের মধ্যে নেমে গেলো সে।

    খানিকটা এগিয়ে যেতে হীরা দেখতে পেলো একটি সুন্দর কুটীর। দরজা হাট করে খোলা। ঘরের ভিতরে এক রূপসী কন্যাকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে গেলো হীরা।

    মেয়েটিও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করলো, কে গো তুমি সুন্দর, এখানে এই বাগানে একটা পাখি পর্যন্ত উড়ে এসে বসতে সাহস পায় না, আর তুমি একজন মানুষ হয়ে কী করে প্রবেশ করলে?

    এই কন্যার নাম লতিফা। হীরা আভূমি আনত হয়ে অভিবাদন জানালো ওকে।

    –কে তুমি অনিন্দ্যসুন্দরী, জানি না। আমার নাম শাহজাদা হীরা। আমার বাবা…

    নাম ধাম বংশ পরিচয় এবং তার আগমনের উদ্দেশ্য ইত্যাদি একটানা সব গড় গড় করে বলে গেলো হীরা।

    সব শোনার পর লতিফা শাহজাদা হীরার হাত ধরে নিজের পাশে বসালো।

    -কী ভীষণ কাজে তুমি পা বাড়িয়েছ সুন্দর, এতে যে তোমার প্রাণসংশয় হবে। এমন মরণফাঁদে পা দিতে গেলে তুমি? হায় হায়, এখন কী করে এ সর্বনাশা পথ থেকে রেহাই পাবে তুমি? এ যে কী সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর কাজ কী করে বোঝাবো তোমাকে। যদি তোমার নিজের জীবনের প্রতি এতটুকু দরদ থাকে তবে তুমি আর এগিও না, এখানেই বিরত হয়ে আমার দেহ-মনের একমাত্র মালিক বনে থাক আমার কাছে। আমাকে সুখের সায়রে ভাসিয়ে রাখ, এই আমার কামনা। আমার মনে হয় এক ভয়াল ভয়ঙ্কর কালোছায়ার কবলে পড়ে জান কবুল করার চেয়ে আমার মতো এক সুন্দরী মদালসার বুকে আশ্রয় নিয়ে সুখ-সম্ভোগে জীবন পরিপূর্ণ করাই শ্রেয়ঃ তোমার পক্ষে।

    হীরা বললো, তোমার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখতে চাই না সুন্দরী, কিন্তু সবই সম্ভব হতে  পারে যদি আমি ঐ ওয়াকাক দ্বীপে গিয়ে ফিরকোন আর সাইপ্রাস সম্বন্ধীয় কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরতে পারি। এবং আমার বিশ্বাস আমি সে কাজ সমাধা করে সশরীরে ফিরে আসবোই। তারপর তোমাকে সুখ দিতে আমার বাধা থাকবে না, সুন্দরী। কিন্তু এখন আমার চলার পথে তুমি আমাকে বাধা দিও না। কথা দিচ্ছি, ফিরে এসে তোমাকে হৃদয়ের মণি করে রাখবো আমি। তোমার সব কামনা বাসনা চরিতার্থ করবো।

    লতিফা আর্তনাদ করে ওঠে, না-না সে হবে না, হতে পারে না, ঐ মৃত্যুর গহ্বরে তোমাকে প্রবেশ করতে দেব না আমি—কিছুতেই না।

    লতিফার ডাকে তার সখী-সাথীরা এসে বসলো চারধারে। মদের পেয়ালা পরিপূর্ণ করে নিজে হাতে তুলে ধরলো লতিফা, নাও তৃষ্ণা নিবারণ কর, সোনা।

    হীরা একচুমুকে নিঃশেষ করে দিলো পাত্রটি। আবার লতিফা ভরে দিলো পেয়ালা।

    সঙ্গীতে বাদ্যে মুখর হয়ে উঠলো কুঞ্জবন। লতিফা হীরার কণ্ঠলগ্ন হয়ে লাস্যময় কণ্ঠে মিনতি করলো, এতো সুন্দর বেহস্ত ছেড়ে কোথায় যেতে চাও, সোনা?

    হীরা এতক্ষণ সম্মােহিত হয়ে পড়েছিলো। লতিফাঁকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললো, এবার আমাকে যেতে হবে সুন্দরী। বিদায় দাও। আর যদি কিছুক্ষণ এখানে আমি থাকি তবে মহব্বতের যে-আগুন জ্বালিয়ে দিতে চাইছ আমার বুকে, তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে আমার সব প্রতিজ্ঞা শপথ ছাই করে দেবে। সুতরাং আর নয়, এবার বিদায় দাও শাহজাদী। খোদা যদি ইচ্ছা করেন, তবে আবার আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে। সেদিন তুমি আমাকে যেমন ভাবে চাও প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেও, আমি না’ বলবো না।

    লতিফা কুব্ধ ফণিনীর মতো ফণা মেলে রুখে দাঁড়ালো, না, তা হবে না। আমি তোমাকে ছাড়বো না কিছুতেই।

    এই বলে সে বিড় বিড় করে কী যেন সব মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে সামনে এগিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো হীরার বুকে।

    এই অতর্কিত আক্রমণের ধাক্কা সামলাতে না পেরে হীরা চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলো ঘাসের ওপর। গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে দু তিনবার গড়াগড়ি খেলো। ব্যস, তার পরই সে সুন্দর একটি হরিণ শাবকের আকার ধারণ করলো। লতিফা ওর শিং-এ একটি মহামূল্যবান রত্নবলয় পরিয়ে দিয়ে বললো, কী কেমন লাগছে সখা? ঐ দ্রাক্ষাবনে তোমার মতো আরও অনেক হরিণ-শাবকরা চরে বেড়াচ্ছে, যাও তাদের সঙ্গে গিয়ে খেলা করগে, সোনা।

    পিঠে মৃদু করাঘাত করে হরিণ-শাবক হীরাকে আঙুরক্ষেতের দিকে পাঠিয়ে দিলো লতিফা।

    হীরা, কিন্তু অন্য হরিণদের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলো না। সুযোগ বুঝে টুক করে এক সময় বাগানের দেওয়ালের দিকে চলে গেলো। এক জায়গায় প্রাচীরটা বেশ নিচু দেখে এক লাফে বাগানের বাইরে গিয়ে পড়লো হীরা। তারপর দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলতে থাকলো সে।

    কিন্তু হায় একটানা বহুক্ষণ তীরবেগে ছোটার পরও সে বুঝতে পারলো, যেখান থেকে পালিয়েছিলো ঘুরে ফিরে আবার সেই বাগানেই গোলকধাঁধায় এসে পড়েছে সে।

    আবার সে বাগান টপকে বাইরে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। কিন্তু কি আশ্চর্য সেবারও সে ফিরে আসে ঐ বাগানেরই খাঁচায়। এইভাবে পর পর সাতবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বাগানের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এক জায়গায় এসে সে প্রাচীরের গায়ে একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি মতো দেখতে পেয়ে তার মধ্যে দিয়ে শরীরটাকে চালান করে দিলো।

    এবার সে দেখতে পেলো এক সুরম্য প্রাসাদ।

    প্রাসাদের এক গবাক্ষে বসেছিলো এক পরমাসুন্দরী শাহজাদী। হরিণরূপে হীরাকে দেখতে পেয়ে সে আনন্দে নেচে ওঠে। হাতে নেড়ে নেড়ে আদর জানিয়ে কাছে ডাকতে থাকে হীরাকে।

    হীরা জানলার দিকে এগিয়ে যায়। সুন্দরী তখন বাইরে বেরিয়ে এসে হীরার সামনে এক মুঠো ঘাস ধরে ডাকে, আয় আয়।

    হীরা ক্ষুধার্তের মতোই শাহজাদীর কাছে ছুটে যায়। হাতের নাগালের মধ্যে আসতেই শাহজাদী জামিলা খপ করে চেপে ধরে হরিণটাকে।

    এই জামিলা শাহজাদী লতিফার কনিষ্ঠা। ওদের দুজনের বাবা এক কিন্তু মা আলাদা।

    একগাছি রেশমি রশিতে বেঁধে হরিণ-হীরাকে সে প্রাসাদের অন্দরমহলে নিয়ে গেলো। সেখানে সে হীরাকে নানারকম মিষ্টি মিষ্টি ফলমূল খাওয়ালো। এবং হীরা যতটা পারলো পেটপুরে খেয়ে নিলো সব।

    খাওয়া শেষ হলে হরিণ-হীরা তার মাথাটা জামিলার কাঁধের ওপর রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। শাহজাদী ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো খুব।

    এর পর হীরা তার মাথাটা শাহজাদীর পায়ের ওপর রেখে আবার কাঁদতে লাগলো।

    -কী? কী হয়েছে, অমন করে কাঁদছো কেন তুমি? না না, অমন করে কেঁদনা সোনা, তোমার চোখে পানি আমি সইতে পারছি না। আমি তোমাকে জান দিয়ে ভালোবাসবো, আদর যত্ন করবো। আমাকে ছেড়ে পালাবে না তো?

    হীরার কান্না আরও বেড়ে যায়। নানা ভাবে সে মনের ভাষা ব্যক্ত করে বোঝাতে চেষ্টা করে জামিলাকে। জামিলার কেমন খটকা লাগে, বনের পশু এমন মানুষের মতো আচরণ শিখবে কী করে? নিশ্চয়ই এ কোন যাদু করা মানব-সন্তান। কেউ তাকে মন্ত্র দিয়ে হরিণ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।

    কিন্তু লতিফা ছাড়া এ যাদু তো এখানে আর কেউ জানে না। তবে কি তারই দিদির অপকর্ম এটা।

    লতিফাঁকে সে বাঘের মতো ভয় করে, তবু সব ভয় তুচ্ছ করে জামিলা তার দিদির ছোট্ট রত্ন-কৌটোটাকে তার ঘরের কুলুঙ্গী থেকে হাতিয়ে নিয়ে এলো। তারপর প্রথামতো মুখ হাত ধুয়ে নতুন সাজ-পোশাকে খুব সুন্দর করে সাজগোজ করলো সে।

    কৌটোটা খুলে তার ভেতর থেকে খানিকটা মন্ত্রপূত মণ্ডা তুলে নিয়ে হরিণটার মুখের মধ্যে পুরে দিলো জামিলা। আর কি আশ্চর্য সঙ্গে সঙ্গে হরিণটা গা ঝাড়া দিয়ে হীরা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো দশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    আভূমি আনত হয়ে জামিলাকে কুর্ণিশ জানায় হীরা। বলে, তুমি আমাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছ সুন্দরী, কী বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো, কী ভাবে তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো, বুঝতে পারছি না।

    জামিলা বললো, ও সব থাক, এখন এসো তোমাকে মনের মতো করে সাজাই।

    শাহজাদার সাজে পরিপাটি করে সাজালো সে হীরাকে।

    —কেনই বা তুমি এদেশে এসেছিলে, আর কেনই বা তুমি আমার যাদুকরী দিদির জালে ধরা দিয়েছিলে?

    শাহজাদা হীরা আদ্যোপান্ত সব কাহিনীই খুলে বললো জামিলাকে।

    সব শোনার পর জামিলা আতঙ্কিত হয়ে বললো, না না, ও মতলব তুমি ত্যাগ কর সোনামণি। অমন মরণফাদে ঝাপ দিতে যেও না তুমি। তোমার মতো এমন সুন্দর মূল্যবান প্রাণ এভাবে নষ্ট করে দিও না। তার চেয়ে বরং এখানেই তুমি সুখে সম্ভোগে সারাটা জীবন কাটিয়ে দাও। আমি তোমার পেয়ারের বাঁদী হয়ে থাকবে চিরকাল। তোমার জীবনের কোনও সাধই অপূর্ণ রাখবো না আমি। আমি যা বলছি সুবোধ ছেলের মতো কান পেতে শোনো। এর চেয়ে ভালো আর কিছুতেই হবে না তোমার।

    হীরা বললো, তোমার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না কোনও দিন। তুমি অনুগ্রহ করে আবার আমাকে মানুষ না করে দিলে হয়তো যতদিন বাঁচতাম হরিণ-শাবক হয়েইবনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হতো। তারপর হয়তো কোনও দিন কোনও এক হিংস্র বন্য জানোয়ারের পেটে চলে যেতাম। কিন্তু এ সত্ত্বেও আমি তোমার কাছে কয়েকটা দিনের ছুটি প্রার্থনা করছি, সুন্দরী। তুমি আমাকে খুশি মনে বিদায় দাও। ওপরে মেহেরবান আল্লাহ আছেন, তার দোয়ায় আবার আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে। তুমি আমাকে বাধা দিও না, ওয়াকাকদ্বীপে আমাকে যেতেই হবে। সেখান থেকে আনতে হবে ফিরকোন আর সাইপ্রাস সম্পর্কের জটিল সূত্র। ওয়াকাক থেকে ফিরে আসার পর আমি তোমাকে বুকে করে সারাটা জীবন সুখে কাটাবো; কথা দিচ্ছি।

    শাহজাদী জামিলা বুঝতে পারলো হীরাকে কিছুতেই বিরত করা যাবে না। সুতরাং বাধা দিয়ে কোনও লাভ নাই।

    শোনো সোনা, নিয়তিকে কেউই এড়াতে পারে না। তোমার নিয়তি তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় জানি না। যাবে যখন পণ করেছ, আমি তোমাকে আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিনটি বস্তু উপহার দেব। ওগুলো সঙ্গে রাখলে অনেক বিপদ এড়াতে পারবে তুমি।

    একটা সিন্দুক খুলে একখানা সোনার তীরধনুক বের করলো জামিলা। আর বের করলো চীনা ইস্পাতের তৈরি একখানা শাণিত তলোয়ার এবং ঝকঝকে একটি তীক্ষ্ণ ফলা ভোজালী।

    জামিলা বললো, এই যে সোনার তীরধনুক দেখছো, এটা ব্যবহার করতেন পয়গম্বর সালিহ্। এই তলোয়ারখানার নাম বজ্রবিছা—এটা ছিলো সুলেমানের। এর এমন ধার পাথরের চাইও এক কোপে সাবানের মতো কেটে নেমে যেতে পারে। আর এই ভোজালীখানার মালিক ছিলেন পরমাত্মা তামুজের। এর ফলা পূত পবিত্র মন্ত্রে শোধন করা আছে। তাই, এই অস্ত্র হাতে থাকলে সম্মুখসমরে কেউই পরাজিত করতে পারবে না তোমাকে। এগুলো তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসে আবার আমাকে ফেরত দিও। কিন্তু সাতসমুদ্র তেরনদীর পারে ঐ ওয়াকাকদ্বীপে তুমি পৌঁছবে কি করে। ওখানে কি কোনও মানব-সন্তান পৌঁছতে পারে কখনও? তবে হ্যাঁ, আমার চাচা সিমুর্গ যদি তোমাকে সাহায্য করেন তবে তুমি যেতে পারবে। একমাত্র তাঁরই জানা আছে ঐ পথঘাট। শোনো তোমাকে কানে কানে একটা কথা বলছি, খুব খেয়াল করে শুনবে।

    এখান থেকে একটানা একদিন চলার পর একটা ঝরণা দেখতে পাবে। সেই ঝরণার পাশে দেখবে এক বিশাল প্রাসাদ। সেখানকার নরপতি এক নিগ্রো সম্রাট। তার নাম টাকটাক। তার চারপাশে চল্লিশটি দৈত্যাকৃতির লালমুখো ইথিওপিয়ার জাঁদরেল সেনাপতিরা ঘিরে আছে। তাদের প্রত্যেকের অধীন নিগ্রো-সম্রাটের পাঁচ হাজার সৈন্যের এক একটি বাহিনী আছে।

    তোমাকে দেখে নিগ্রো-সম্রাট তোমার বন্ধু হয়ে যাবেন। তার কারণ যে সব মহাস্ত্র তোমাকে আমি দিলাম সেগুলো দেখে তিনি মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়ে যাবেন।

    অবশ্য তুমি তার আতিথ্যে দুটো দিন কাটাবে সেখানে। তারপর তিনি তোমাকে আমার চাচার প্রাসাদে পাঠিয়ে দেবেন। আমার এই চাচাই একমাত্র মানুষ যিনি ওয়াকাকের সঠিক রাস্তা বাৎলে দিতে পারবেন। কিন্তু সোনা, যা বললাম তার এক চুল এদিক ওদিক কিছু করবে না, তাতে প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে। কিন্তু আল্লা না করুন, সে রকম যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তবে আমার এ জীবন আমি আর রাখবো না। আমার দেহ মন প্রাণ সব তোমাকে সঁপে দিয়েছি। এখন থেকে তুমি ছাড়া আমার কোনও দ্বিতীয় চিন্তা থাকবে না। যতদিন তুমি না ফিরে আস, তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো আমি। মুখে খানাপিনা রুচবে না, চোখে নি আসবে না! দারুণ উল্কণ্ঠায় কাটবে আমার দিবস-রজনী। শুধু এইটুকু ভেবে তুমি খুব সাবধানে সতর্কভাবে আমার কথামতো চলবে।

    জামিলা হীরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমায় ভরে দিতে থাকলো।

    জামিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়ায় চেপে পুরো একটা দিন চলার পর টাকটাক সম্রাটের প্রাসাদে এসে পৌঁছলে হীরা।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো এগারোতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–

    প্রাসাদের দ্বাররক্ষী ইথিওপিয়ার হাবসী পালোয়ানদের একজন শাহজাদা হীরাকে দেখে দাঁত বের করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, যাক বাবা এতদিন বাদে একটা ফলার হবে মনে হচ্ছে। একেবারে নধরকান্তি শাহজাদা, তেল চকচকে শরীর, ওহো বেড়ে স্বাদের হবে মাংস

    অন্য এক প্রহরী বলে, আর দেরি নয়, চটপট ওকে কাঁধে তুলে সম্রাটের কাছে নিয়ে যাওয়া যাক, কি বলো?

    সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দশ-বারজন প্রহরী ঘেরাও করে ফেললো হীরাকে। শাহজাদা বুঝতে পারলো বিপদ আসন্ন। তৎক্ষণাৎ সে তরবারী কোষমুক্ত করে বাঁই বাঁই করে চালাতে লাগলো চতুর্দিকে। এবং সুলেমানের আশ্চর্য তরবারীর এক এক কোপে কচুকাটা হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলো সেই সব বীরপুরুষা।

    এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে গিয়ে একজন সম্রাটকে ঘটনার বিবরণ জানালো।

    সম্রাট তো ক্ষেপে আগুন হলেন। প্রধান সেনাপতি মাকসাককে হুকুম করলেন, এই মুহূর্তে পাকাড়াও করে নিয়ে এসো তাকে আমার সামনে।

    এই মাকসাক বিশ্ববিখ্যাত যোদ্ধা। তাকে পরাস্ত করা এ দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রাসাদ-ফটকে ছুটে এসে সে হীরাকে। দেখতে পেয়েই বিকট আওয়াজ তুলে ঝাপিয়ে পড়লো তার ওপর। কিন্তু হীরা তৈরিই ছিলো! পলকের মধ্যে। সে তামুজের ভোজালীখানা সোজা ঢুকিয়ে দিতে পারলো মাকসাকের কলিজায়। একটা পাহাড় যেন খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে গেলো, গগন বিদারী আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো প্রধান সেনাপতি সাহেব। আর উঠলো না।

    প্রধান সেনাপতির পতন দেখে তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে যার প্রাণ নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু হীরা পিছু ধাওয়া করে তাদের জনাকয়েককে কোতল করে ফেললো পলকের মধ্যে।

    মাকসাক নিহত হয়েছে শুনে সম্রাট টাকটাক ক্রোধে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তার তাবৎ সেনাপতিদের হুকুম করলেন, তোমরা এখনও এখানে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছ? যাও, এক্ষুণি লোকটার মুণ্ডু এনে হাজির কর আমার সামনে।

    সম্রাটের হুকুম সত্ত্বেও একটি সেনাপতিও কিন্তু এক পা নড়লো না সেখান থেকে। ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকলো সকলে।

    শাহজাদা হীরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বাইরের ফটকে। আশা করেছিলো আবার হয়তো কোনও বীরপুরুষের আবির্ভাব ঘটবে। কিন্তু তা হলো না দেখে সে পায়ে পায়ে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করলো।

    একটি দরজায় টোকা দিতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো। হীরা প্রবেশ করলো ঘরের মধ্যে। মেয়েটি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো।

    সম্রাট টাকটাক রুখে এলেন হীরাকে খতম করে দেবার জন্য। তার হাতে উদ্যত খঙ্গ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। হীরা বুঝতে পারলো ঐ বিশাল অস্ত্রের সঙ্গে সম্মুখসমরে লড়াই করা তার পক্ষে শক্ত। তাই সে হাতে নিলো সালিহর তীরধনুক।

    অব্যর্থ লক্ষ্য। একটি মাত্র বাণে সম্রাট টাকটাক ধরাশায়ী হলেন। মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠলো, বাবা

    হীরা তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো, কেঁদ না রাজকুমারী, কেঁদ না! ভবিতব্য কেউ খণ্ডাতে পারে না। এইভাবে আমার হাতে তোমার বাবা নিহত হবেন এই তর লিখন ছিলো। সেই কারণেই তা ঘটেছে। আমি উপলক্ষ্য মাত্র। মৃত্যু তার হতোই আজ, ইহজগতের মেয়াদ তার ফুরিয়ে গিয়েছিলো, তাই তাকে চলে যেতে হলো। এ তো আনন্দের কথা, সুখের কথা তুমি বৃথা শোক করো না, সুন্দরী।

    মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, আপনি কোন ধর্মে বিশ্বাসী, সুন্দর? ইসলামই আমার একমাত্র ধর্ম, রাজকুমারী। —আপনার ধর্মের মূল মন্ত্র কী, শাহজাদা?

    হীরা বললো, এককথায় বলতে গেলে আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। তার বাণী : আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই। এবং মহম্মদই একমাত্র পয়গম্বর। তিনি আল্লাহর প্রতিনিধি। যারা মনে প্রাণে ইসলামে বিশ্বাস করে তারাই প্রকৃত মুসলমান। এছাড়া বিধর্মীরা কাফের। তাদের অনন্তকাল দোজকবাস হয়!

    রাজকুমারী আজিজা ইসলামে অনুরক্ত হয়ে পড়লো। বললো, তোমার ধর্মই আমার ধর্ম, তোমার পথই আমার পথ, শাহজাদা। আজ থেকে আমি ইসলামধর্মে দীক্ষা নিলাম।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    নয়শো বারোতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    এবার আপনি আমাকে আপনার বেগম করে নিন, শাহজাদা। আমি আপনার সঙ্গে চলে যেতে চাই।

    হীরা বললো, রাজকুমারী তোমার প্রস্তাব আমি সানন্দে গ্রহণ করে ধন্য হববা! কিন্তু এই মুহূর্তে তা সম্ভব না। তার কারণ যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এসেছি এখানে, আগে সেই কাজ সমাধা করতে হবে। তারপর অবশ্যই তোমাকে আমি শাদী করে দেশে নিয়ে যাবো। আমার মা এবং বাবা শাহেনশাহ সামস শাহ আমার পথ চেয়ে কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছেন। সুতরাং আগে কাজ সমাধা করে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে। ওয়াকাক দ্বীপ না পৌঁছানো পর্যন্ত আমার অন্য কোনও চিন্তা নাই। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে একটু সাহায্য কর। আমি কথা দিচ্ছি, আমার কাজ শেষ হলে তোমাকে শাদী করে সঙ্গে নিয়ে যাব। বলতে পার কোথায় আমি দেখা পাবো জামিলার চাচা সিমুর্গ-এর। একমাত্র তিনিই আমাকে দুর্গম ওয়াকাকের পথ-নির্দেশ দিতে পারেন।

    রাজকুমারী আজিজা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো! কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না শাহজাদা হীরা। আজিজা বুঝতে পারলো চোখের জল ফেলে শাহজাদার শপথ ভঙ্গ করা যাবে না। তাই সে বললো, ঠিক আছে, আমার সঙ্গে আসুন আমি সিমুর্গ-এর কাছে নিয়ে যাবো আপনাকে।

    প্রাসাদের পিছনে বিশাল বাগিচা। আজিজার পিছনে পিছনে অনুসরণ করে চলে হীরা। বাগানের মাঝখানে এক বিশাল বটবৃক্ষ। তার নিচে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে এক বিশাল-বপু ঈগল। হীরার কানে কানে ফিস ফিস করে আজিজা বললো, এই সেই সিমুর্গ, জামিলার চাচা। ঐ বিরাট বিরাট ডানা মেলে অবাধে আসমান পথে উড়ে উড়ে চলে। ঘুম ভাঙ্গার পর ও যদি প্রথমে ডান চোখ খুলে তোমাকে দেখে তবে তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। তুমি যা বলবে অবাধে তাই সে করে দেবে। কিন্তু যদি কপাল মন্দ হয় তবে ঘুম ভাঙ্গলে প্রথমে বাঁ চোখ মেলে দেখবে তোমাকে এবং তোমার সব আশা-ভরসা ইতি হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। আর হাজার চেষ্টা করেও ওকে আকাশে ওড়াতে পারবে না। এখন দেখো, আল্লাহ তোমার ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন।

    এই বলে আজিজা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাগান থেকে প্রাসাদের দিকে ফিরে চললো। হীরা একাই সেখানে দাঁড়িয়ে সিমুর্গের নিদ্রাভঙ্গের প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

    প্রায় এক ঘণ্টা পরে সিমুর্গ আড়মোড়া ভেঙ্গে ডান চোখ খুলে তাকালো হীরার দিকে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে সে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো। তুমি এক মানব-সন্তান, কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, এই নিষিদ্ধ দেশে এসে পৌঁছলে কী করে?

    তখন শাহজাদা হীরা তার সব কাহিনী খুলে বললো সিমুর্গকে। সিমুর্গ বললো, জামিলা যখন তোমাকে পাঠিয়েছে তবে আর কথা নাই। ঠিক আছে, অপেক্ষা কর, দানাপানির আগে বন্দোবস্ত করে নিই তারপর তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়বো! অনেক দিনের পথ, তাই গোটাসাতেক বন্য গাধা মেরে তার মাংসের কাবাব বানিয়ে নিচ্ছি আমি। ঐ কাবাব আর খানিকটা পানি সঙ্গে নিলে আর কোনও ভাবনা থাকবে না।

    তখুনি সে উঠে গিয়ে জঙ্গল থেকে সাতটা বুনো গাধা শিকার করে আনলো। আচ্ছা করে পুড়িয়ে কাবাব বানানো হলো। এক জ্বালা জল আর কাবাবগুলো গলায় বেঁধে হীরাকে বললো সে, এসো, আমার পিঠে চেপে বস। তোমাকে নিয়ে আমি উড়ে যাবো ওয়াকাক দ্বীপে।

    হঠাৎ এক লাফ দিয়ে ওপরে উঠতে থাকলো সিমুর্গ। শোঁ শোঁ করে একটানা উঠে গেলো মেঘের ওপরে। তারপর দিক্-নির্ণয় করে বায়ুবেগে ছুটে চলতে থাকলো। পাখির মত উড়তে উড়তে অবাধে অনেক সমুদ্র পর্বত হ্রদ নদী প্রান্তর পার হয়ে চললো ওরা। চলতে চলতে ক্ষুধার্ত হলে এক সময় ক্ষণকালের জন্য ধরায় নেমে আসে, খানাপিনা শেষ হলে আবার আকাশ পথে যাত্রা শুরু হয়।

    রাত্রির অন্ধকার কেটে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো চৌদ্দতম রজনীতে

    আবার সে বলতে থাকে–

    এইভাবে সাতটা দিনরাত্রি অতিক্রান্ত হয়। হঠাৎ ওদের নজরে পড়লো এক ঝাঁক উজ্জ্বলে পায়রার মতো একটি চমৎকার শহর। নানারকম তরু বৃক্ষ লতাপাতায় ঘেরা একটি রাজ্যপাট।

    সিমুর্গ বললো, তুমি আমার পুত্রতুল্য হীরা। তোমার জন্য এই পথশ্রম আমার কাছে আনন্দেরই হয়েছে। এবার তোমাকে আমি এক বিশাল প্রাসাদের ছাদের ওপর নামিয়ে দেব।

    এই হচ্ছে সেই ওয়াকাক শহর। রাজকুমারী মুরার পালঙ্কের নিচে যে হাবশীটি অবস্থান  করছে, এই তার স্বদেশ, জন্মভূমি। এখান থেকেই তুমি ফিরকোন আর সাইপ্রাস সম্বন্ধীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে।

    প্রাসাদের ছাদে নামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ সিমুর্গ তার মাথার একগাছি চুল ছিঁড়ে হীরার হাতে দিয়ে বললো, যদি কখনও খুব প্রয়োজন হয় এই চুলে আগুন ধরিয়ে দিও। যেখানেই থাকি বায়ুবেগে ছুটে আসবো তোমার কাছে।

    এই বলে সে আবার শূন্যলোকে উঠে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো। ছাদের ওপর বসে বসে একমনে ভাবছিলো হীরা। হঠাৎ তার ভাবনায় ছেদ পড়লো এক মধুর কণ্ঠস্বরে।

    -কে আপনি নরবর, আমার এই প্রাসাদে পদার্পণ করে ধন্য করেছেন আমাকে? আপনার মতো রূপবান মানুষ আমি ইতিপূর্বে কখনও দেখিনি। জানি না মানব-সন্তান এমন নিখুঁত সুন্দর হতে পারে কিনা। আপনি কি বেহেস্তলোকের কোনও জীন?

    শাহজাদা হীরা বলে, না না আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি ধরারই মনুষ্যসন্তান। নিয়তিই আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে।

    নওজোয়ান যুবক হীরার হাতে ধরে সিঁড়ি বেয়ে প্রাসাদের নিচে নেমে গেলো।

    অতিথিশালার এক সুসজ্জিত মনোরম কক্ষ। হীরা মুগ্ধ চোখে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। যুবক বললো, এই আপনার থাকবার ঘর। যদি আদর-যত্নের কোনও ত্রুটি ঘটে নিজগুণে ক্ষমা করে নেবেন।

    দু’জনে বসে একত্রে আহারাদি সমাধা করলো। পরিচয় ক্রমশঃ বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হতে থাকে।

    যুবকের নাম ফারাহ, ওয়াকক সম্রাটের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র।

    কথায় কথায় হীরা বলে, দোস্ত ফারাহ, তোমার কথায় বুঝতে পারলাম সম্রাট তোমাকে বিশেষ নেকনজরে দেখেন। তাহলে এও নিশ্চয়ই সম্ভব, তার সাম্রাজ্যের বহু গোপন বিষয়ও তোমার গোচরে এসেছে।

    ফারাহ বললো, অবশ্যই। তোমার কী কী জানা প্রয়োজন, বলো। আমি যেভাবেই পারি তা সংগ্রহ করে দেব তোমাকে।

    হীরা বললো, মাত্র একটি প্রশ্নেরই সঠিক জবাব আমি জানতে চাই, ফারাহ। তা হলো : ফিরকোন এবং সাইপ্রাসবাসীদের প্রকৃত সম্পর্ক কী? শুধু এই উত্তরটুকু পেলেই আমার এতো শ্রম সার্থক হবে। এই সঙ্গে তুমি আমাকে আর একটি রহস্যের সন্ধান করে দাও, এখানকার এক নিগ্রো যুবক কেনই বা সিন মাসিন সম্রাট-দুহিতা মুরার শয্যাকক্ষে পালঙ্কতলায় অবস্থান করছে?

    হীরার এই কথা শুনে ফারাহর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে। গেলো। ভূত দেখার মতো দু-পা পিছিয়ে গেলো সে।

    -না না, ও কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না, দোস্ত। অন্য যে কোনও কথা জানতে চাও আমি এখুনি তোমাকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু দোহাই তোমার, এই গোপন তথ্য তুমি জানতে চেও না আমার কাছে! আমাদের সম্রাটের ফরমান যদি কোন বিদেশীর কাছে কেউ। সাইপ্রাস বা তার সম্রাজ্ঞী ফিরকোন সম্বন্ধে কোনও কথা উচ্চারণ করে তার ফাঁসী হবে। নিগ্রো এবং রাজকুমারী মুরার ব্যাপার সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। যদি তুমি ইচ্ছা কর আমি তোমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে যেতে পারি। তিনি যদি তোমার আচরণে মুগ্ধ হয়ে কিছু বলেন সে কথা আলাদা।

    হীরাকে সঙ্গে করে যুবক সাইপ্রাস সম্রাটের সামনে এসে অভিবাদন জানালো। হীরাকে দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি। অনেকক্ষণ তিনি অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন হীরার দিকে। হীরা তার গলা থেকে লাল মুক্তোর মহামূল্যবান হারটা খুলে সম্রাটের হাতে তুলে দিলো। এ তার ভেট। সম্রাট বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, হারটা অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য অমূল্য রত্ন দিয়ে তৈরি। তাঁর সারা ওয়াকাক সাম্রাজ্যের তাবৎ সম্পদের চেয়েও দামী। সম্রাট হীরার উপহার সানন্দে গ্রহণ করে বললেন, এর প্রতিদানে তুমি যা চাও, তাই আমি দিতে পারি যুবক, বলো কী চাও?

    হীরা বললো, আপনি মহানুভব সম্রাট, আপনি আপনার নিজগুণে মহিমান্বিত। যদি অভয় দেন তবে আমার আর্জি পেশ করতে পারি।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো পনেরতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    সম্রাট অভয় দিলে বললেন, কোনও ভয় নাই, দ্বিধা না করে নির্ভয়ে তুমি বলো। তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই।

    হীরা মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ক্ষণকাল। তারপর বললো, মহারাজাধিরাজ, অন্ধ ও বধিররাই এ জগতে সুখী। কারণ দুনিয়ার যা কিছু দুরাচার তা তারা দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না। আমি আপনাকে আমার এখানে আগমনের উদ্দেশ্য বিবৃত করছি, আপনি নিজগুণে আমাকে মার্জনা করবেন।

    এই বলে হীরা তার ওয়াকাক আসার আদ্যোপান্ত সমস্ত কাহিনী বর্ণনা করলো সম্রাটের সামনে।

    বলতে পারেন, আমার নিয়তিই আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে আপনার সামনে। এবার আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন নরপতি, এই আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। আপনি বলুন, আমাদের মহানুভব সম্রাটের সঙ্গে মহিয়সী সাম্রাজ্ঞী ফিরকোনের প্রকৃত সম্পর্ক কী? আর রাজকুমারী মুরার শয্যাকক্ষে অবস্থান করছে সেই নিগ্রোটাই বা কে?

    সাইপ্রাস-সম্রাট ক্রোধে আরক্ত হয়ে উঠলেন। পলকে পরিবর্তিত হয়ে গেলো তার মুখমণ্ডল। সে অতি ভয়াল ভয়ঙ্কর। মনে হলো এখুনি বুঝি সে চিৎকার করে গগন ফাটিয়ে দেবে। থর থর করে কাপতে লাগলো তাঁর সারা শরীর। ঘেমে নেয়ে উঠলেন তিনি।

    —কেতুমি পরদেশী যুবক! নেহাতই আজই তোমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, না হলে যে কথা তুমি উচ্চারণ করেছ, তারপর এতক্ষণ তোমার ঘাড়ে মাথাটা থাকতো না।

    প্রচণ্ড জোরে তিনি একটা ঘুষি বসিয়ে দিলেন সিংহাসনের হাতলে।

    হীরা যুক্ত করে মিনতি জানায়, অধমের ঔদ্ধত্য মার্জনা করুন, প্রভু। আপনি আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাই প্রশ্ন তুলতে সাহস করেছি আমি। আপনি কথা দিয়েছেন আমার অভিলাষ অপূর্ণ রাখবেন না।

    নিরূপায় সাইপ্রাস-সম্রাট হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন। নিজের জালেই নিজে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। এখন কিছুতেই মুক্তি নাই তাঁর।

    সম্রাট বললেন, শোনো শামস শাহজাদা, কেন তুমি এ কথা জানতে চেয়ে আমাকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে চাইছ? তার চেয়ে এ প্রশ্ন তুলে নিয়ে অন্য কোনও কিছু যাজ্ঞা কর আমার কাছে। আমি তোমাকে আমার রাজত্বের অর্ধেকও দিয়ে দিতে পারি খুশি মনে। কিন্তু ঐ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেও না আমার কাছে।

    হীরা বললো, আপনার ধন-দৌলত, নারী, সাম্রাজ্যে কোনও অভিলাষ নাই আমার। আমি শুধুমাত্র ঐ দুটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রার্থনা করি আপনার কাছে।

    সম্রাট গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, বেশ, তাই হবে। আমি যখন তোমাকে কথা দিয়েছি, তোমার প্রশ্নের উত্তর পাবে। কিন্তু শুনে রাখ শাহজাদা, আমার গুপ্ততথ্য শোনার পর তোমার মৃত্যু অবধারিত হয়ে যাবে। তাকে অতিক্রম করা তোমার পক্ষে সম্ভব না কিছুতেই।

    হীরা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলে, তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ অনুতাপ থাকবে না আমার মহারাজাধিরাজ। আমি ঐ গোপন তথ্য জানার পর এ মাথা নিজেই আমি পেতে দেব আপনার ঘাতকের খঙ্গতলে। যে কৌতূলহ নিবৃত্ত করার জন্য এতো, দুঃখ কষ্ট তুচ্ছ করে আপনার দরবারে এসেছি সেই কৌতূহল চরিতার্থ, হলেই আমি ধন্য হবো। জীবনের প্রতি আমার কোনও মোহ নাই। আজ হলেও মরতে হবে, কাল হলেও মরতে হবে। এ দুনিয়ায় কেউ চিরকালের জন্য আসেনি।

    সম্রাট গভীর মর্মবেদনায় কাতর হয়ে পড়লেন। মাথা নিচু করে। নীরব হয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর ইশারা করে সবাইকে। দরবারকক্ষ ত্যাগ করে বাইরে যেতে নির্দেশ করলেন।

    দরবারকক্ষ খালি হয়ে গেলো নিমেষে। একটু পরে বারজন ইথিওপিয়ার লালমুখো সশস্ত্র ফৌজ-এর সঙ্গে পরমাসুন্দরী তরুণী এসে দাঁড়ালো সেখানে। তার হাত দু’খানা পীছমোড়া করে  বাঁধা।

    একটি বিরাট গালিচার এক প্রান্তে বসেছিলো হীরা। মেয়েটি গিয়ে বসলো তার অপর প্রান্তে। একটি সোনার রেকাবীতে করে একটি নিগ্রোর কাটামুণ্ডু এনে স্থাপন করা হলো তরুণীর সম্মুখে। দেখে মনে হয় নরমুণ্ডটি সদ্য কেটে আনা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়, এক ধরনের লবণের আরক দিয়ে জারিত করে রাখা হয়েছে মাথাটা। তার ফলে কোনও বিকৃতি ঘটেনি বা পচে যায়নি।

    সাইপ্রাস সম্রাট বললো, এই আমার রাণী ফিরকোন।

    হীরা বললো, মহারাজ, মহামান্যা সম্রাজ্ঞীকে এখানে উপস্থিত না করলেও কোনও ক্ষতি ছিলো না। আম তার দর্শন প্রার্থনা করিনি। আপনার কাছে শুধু জানতে চেয়েছি আমার প্রশ্নের উত্তরটুকু মাত্র।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হলে এলে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো যোতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে—

    হীরার কথা শুনে মহারাণী ফিরকোন হাসলেন একটু, এর পরক্ষণেরই কেঁদে ফেললেন। আর কী আশ্চর্য, তার কান্নার অশ্রু পান্না হয়ে ঝরে পড়লো, এবং হাসির সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি গোলাপ ফুলে ভরে গেলো তার সামনেটা।

    সাইপ্রাস সম্রাট বলতে থাকেন। একদিন আমি শিকারে বেরিয়ে এক ধূ ধূ করা মরুপ্রান্তরের মধ্যে দারুণ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলাম। এদিক ওদিক হন্যে হয়ে ছুটতে থাকলাম এক গণ্ডুষ। জলের জন্য। কিন্তু ঐ তপ্ত বালির মধ্যে জল কোথায় পাবো? ক্রমশঃ আমি ভীত আতঙ্কিত হয়ে উঠতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত যদি তৃষ্ণার জল সংগ্রহ করতে না পারি তবে নির্ঘাৎ বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে এই মরুভূমির মধ্যে।

    খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় এসে একটা বিরাট ইন্দারা মতো দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম বহু প্রাচীন এক কূপ। অতীত কালে কোনও প্রবল পরাক্রান্ত শাহ বাদশা বহ জনবল প্রয়োগ করে এই মরুভূমির তলদেশে জল সন্ধান করেছিলেন।

    দেখে আন্দাজ করতে পারলাম, জল আছে। কিন্তু সে প্রায় পাতালের কাছাকাছি। অত নিচে থেকে ওপরে জল তোলার সরঞ্জাম বলতে তো আমার সঙ্গে নেই কিছু!

    অবশেষে আমার মাথার শিরস্ত্রাণ খুলে দড়ি বেঁধে নামিয়ে দিলাম কূয়ার নিচে। ধাতুনির্মিত শিরস্ত্রাণ জল স্পর্শ করলে বুঝতে পারলাম, আশায় দুলে উঠলোবুক। যাক, এবার পিপাসার জল পাবো, প্রাণে মরবো না এই মরুদেশে।

    কিন্তু কী আশ্চর্য, এই ছোট একটি ধাতুর পাত্র প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওপরে আর ওঠাতে পারলাম না। তুচ্ছ জলের ভার এর কারণ নয়, খটকা লাগলো, নিশ্চয়ই অন্য কোনও বিপত্তি ঘটেছে!

    এদিকে ক্রমশই তৃষ্ণায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে গলা, ছাতি ফেটে যায় যায় প্রায়। আমি তারস্বরে চিৎকার করে উঠলাম, কে আছ কূয়ার তলায়, তুমি জিনই হও আর দৈত্য-দানবই হও, দয়া কর আমাকে। আমার তৃষ্ণার জলটুকু ছেড়ে দাও। না হলে এখনই আমার প্রাণ যাবে।

    বার বার আবেদন করার পর সাড়া মিললো।কুয়ার নিচ থেকে আর্তকণ্ঠ ভেসে এলো, মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভালো। শোনো খোদার বান্দা, যদি এই কূপ থেকে তুমি আমাদের উদ্ধার করতে পার, আমরা তোমাকে তার উপযুক্ত পুরস্কার দেব। মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকা শ্রেয়ঃ, সুতরাং কোসিস কর, আমাদের বাঁচাও।

    সেই মুহূর্তে তৃষ্ণার কষ্টের কথা ভুলে গেলাম আমি। জানি না, কোথা থেকে অত শক্তি আমি আহরণ করতে পারলাম, প্রাণপণ চেষ্টায় দড়ি টেনে টেনে আমার শিরস্ত্রাণ আঁকড়ে থাকা দুটি বৃদ্ধা অন্ধ নারীকে টেনে তুলতে পারলাম ওপরে।

    -তোমরা এখানে আটকা পড়েছিলে কীভাবে? বৃদ্ধারা জানালো, তারা তাদের সম্রাট জীনের কোপে পড়েছিলো। তাই শাস্তি হিসাবে তাদের অন্ধ করে এই কূপে নিক্ষেপ করেছেন তিনি। তুমি আমাদের উদ্ধার করে মহা উপকার করেছ। এবার যদি আমাদের চক্ষুদান করতে পার তাহলে আরও খুশি হবো।

    আমি বললাম, কিন্তু আম কী করে তোমাদের চক্ষুদান করতে পারবো?

    —পারবে, একজন বৃদ্ধা বললো, এখান থেকে সামনের দিকে খানিকটা এগোলে এক নদী পাবে। সেই নদীর ধারে একটি গাভী দেখতে পাবে। ঐ গাভীর গোবর যদি আমাদের চোখে মেখে দিতে পার তবে আমরা চক্ষুম্মান হতে পারবো। কিন্তু সাবধান, ঐ গাভী যেন কোনক্রমেই তোমাকে দেখে না ফেলে। তা হলে তা তোমার পক্ষে অমঙ্গলের কারণ হবে।

    ওদের কথামতো খানিকটা পথ এগোতে একটা নদীর তীরে এসে পৌঁছলাম। কিন্তু এদিক ওদিক খুঁজেপেতেও কোন গরুর সন্ধান পেলাম না। যাই হোক বৃদ্ধাদের কথামতো একটি গুপ্ত স্থান বেছে নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে জল থেকে ওপরে উঠে এলো ধবধবে সাদা একটি গরু। গরুটা সবুজ ঘাসের ওপর চলে বেড়ালো খানিকক্ষণ, তারপর গোবর ছেড়ে আবার নদীর জলে নেমে তলিয়ে গেলো।

    তক্ষুণি আমি ঐ গোবরের খানিকটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেলাম সেই ইন্দারার কাছে। বৃদ্ধা দু’টির চোখে কাজলের মতো লাগিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা দৃষ্টি ফিরে পেলো।

    —মালিক, আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা আমার হাত জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলো, আজ তোমার দয়ায় আমরা জান ফিরে পেলাম, ফিরে পেলাম আমাদের চোখের দৃষ্টি। কী বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো তার ভাষা নাই। কী দিয়ে তোমার এই উপকারের প্রতিদান দিতে পারি, বলল মালিক! ধনদৌলত চাও? অথবা কোনও রূপসী পরী?

    আমি বললাম, ঈশ্বরের কৃপায় শৌর্য বীর্য বা সম্পদের অভাব নাই কিছু। কিন্তু ঐশ্বর্য বা বল-বিক্রমই জীবনের সব অভাব পূরণ করতে পারে। হৃদয় পরিপূর্ণ হতে পারে একমাত্র নারীর ভালোবাসায়। তা যদি দিতে পার, আমি সানন্দে গ্রহণ করতে পারি, মাসী। অন্য কিছু চাই না।

    বৃদ্ধারা এমন এক রূপসী কন্যার বর্ণনা দিলো যা চোখে না দেখা পর্যন্ত আমি বিশ্বাসই করতে পারলাম না—তেমন কোনও নারী আদৌ কোথাও থাকা সম্ভব কিনা।

    –ও আমাদের জিন-সম্রাটের কন্যা। তার রূপের কাছে পূর্ণচাঁদ ম্লান হয়ে যায়। তাকে দেখলে সূর্য নিজের দীপ্তির দৈন্য ঢাকতে মেঘের আড়ালে মুখ লুকায়। মা বাবার মাথার মণি সে। সেই কন্যাকে তোমার হাতে তুলে দেব আমরা। আমরা আশা করি, তাকে পেয়ে তোমার জীবন-যৌবন ধন্য হয়ে যাবে।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো সতেরতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হলো :

    —কিন্তু একটা কথা, কোনক্রমেই যেন জিন-সম্রাট তোমাকে না দেখে ফেলে। তা হলে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে মেরে ফেলবে তোমায়। যাই হোক তেমন কোনও বিপদ যাতে তোমার

    ঘটে তার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। তোমার সারা অঙ্গে একপ্রকার তেল মালিশ করে দেব আমরা। তার ফলে হাজার বছর ধরে যদি তুমি অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে শুয়ে থাক, তোমার একগাছি লোমও পুড়বে না, কোনও তাপ লাগবে না। বরং মনে হবে ইরানের কোনও শাহেনশাহর বিলাসবহুল হামামে বসে সুগন্ধী আতরখনির মধ্যে বসে গোসল করছ?

    এইভাবে প্রলুব্ধ এবং সতর্ক করে ওরা আমাকে জিন-সম্রাটের প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে তুললো।

    প্রাসাদের অন্দরে সম্রাট-নন্দিনীর মহলে এনে হাজির করলো আমাকে। সত্যিই আমি অবাক হলাম। পালঙ্কে নিদ্রিতা স্বল্পবাস সুন্দরীকে প্রত্যক্ষ করে জীবন ধন্য হয়ে গেলো আমার। উদগ্র কামনার বহ্নিতে দগ্ধ হতে লাগলো দেহমন। মনে হতে লাগলো এই-ই পুরুষের একমাত্র ইঙ্গিত বস্তু। এ মেয়েকে অঙ্কশায়িনী করতে না পারলে জীবনে বেঁচে থাকার আর কোনই মানে থাকবে না।

    ওর ফুলের মতো সুন্দর মুখশ্রীর দিকে একভাবে অপলক চোখে কতক্ষণ তাকিয়েছিলাম জানি

    —সম্বিত ফিরে পেলাম সুন্দরীর সুমধুর ভৎসনায়, তুমি তো দেখছি মনুষ্য-সন্তান। কিন্তু এখানে আসার দুঃসাহস তোমার কী করে হলো, সুন্দর? কে তোমাকে নিয়ে এসেছে এখানে? তোমার কী জীবনের ওপর এতটুকু মায়া নাই? জান কি, একটু পরেই তোমার দেহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে?

    তার কথায় আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত বা শঙ্কিত না হয়ে বললাম বিলক্ষণ জানি সুন্দরী। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার যে রূপসুধা পান করলাম তার বিনিময়ে অবহেলায় দিতে পারি এ জীবন। খোদা হাফেজ, তুমি আমারই জন্য জন্মেছ প্রিয়া। আমিও তোমারই জন্য জন্মেছি। তোমার কাজল-কালো চোখের মণিতে সেকথা লেখা আছে, পড়ে দেখ। সুতরাং আর কালবিলম্ব করে আমার সঙ্গে চলো, সুন্দরী।

    হঠাৎ মেয়েটি শয্যাত্যাগ করে ছুটে এলো আমার বাহুবন্ধনে। দারুণভাবে জড়িয়ে ধরলো বুকের মধ্যে।চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দিলো আমাকে। তারপর প্রায় টেনে হিচড়েই নিয়ে এসে ফেললো আমাকে তার পালঙ্কশয্যায়।

    এর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিচার-বুদ্ধিই আমাকে সব বলে দিলো কী ভাবে কী করতে হবে।

    সেই নির্জন কক্ষে আমি সে আর ঈশ্বর ছাড়া চতুর্থ কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিলো না। সারাটা দিন, সারাটা রাত অমৃতসুধা পান করতে থাকলাম আমরা। আমার দেহ মন প্রাণ তার মধ্যে লীন

    করে দিয়ে অমর্ত্যলোকের আনন্দসায়রে ভেসে বেড়াতে থাকলাম।

    এইভাবে পুরো একটা মাস সুখ-সম্ভোগের দিবস-রজনী অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। অবশেষে দুঃখের দিন সমাগত হলো।

    একদিন অতি প্রত্যুষে জিন সম্রাট কন্যা-সন্দর্শনে তার কক্ষে এসে উপস্থিত হলেন।

    এর পরের ঘটনা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছে শাহজাদা। জীন-সম্রাটের প্রহরীরা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো এক কাঠের গাদার সামনে। আমি বুঝতে পারলাম, ঐ কাঠের চিতায় আমাকে পোড়ানো হবে। ইতিমধ্যে সারা প্রাসাদে খবর চাউর হয়ে গেছে। বৃদ্ধা দুটি আমার কাছে এসে বললো, ভয় নাই। এখুনি তোমার সারা দেহে ঐ তেল মালিশ করে দেবে এক নফর।

    এবং তাই করে দিলো একটি নিগ্রো বান্দা। একটু পরে কাঠের গাদায় আগুন দেওয়া হলো। লেলিহান শিখা মেলে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো অগ্নিকুণ্ড। আমাকে নিক্ষেপ করা হলো তার মধ্যে।

    মুহূর্তের মধ্যে গনগনে আগুনের শয্যায় শুয়ে পড়লাম আমি। আর কী আশ্চর্য, দেহে কোনও উত্তাপ অনুভব করলাম না। তার বদলে মনে হতে লাগলো আমি যেন কোনও এক শাহেনশাহর হামামে স্নান করছি।

    সারাদিন রাত ধরে চুল্লীতে কাঠ ফেলা হলো। সম্রাট হুকুম করলেন এবার চিতা নিভিয়ে দিয়ে লোকটার হাড়গুলো এক জায়গায় জড়ো করে আবার তা চিতায় চাপিয়ে দে। প্রহরীরা চিতা নিভিয়ে অবাক হয়ে গেলো, আমি পুড়ে তোে ছাই হই-ই নি বরং তাজা ফুলের মতো আরও সরেস, সজীব হয়ে উঠেছি।

    আমার অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা দেখে জিন-সম্রাট হতবাক হয়ে গেলেন। এমন কাণ্ডও যে ঘটতে পারে তা তিনি ভাবতেই পারেন নি। এমন এক পাত্রের সঙ্গে তার কন্যার বিয়ে দিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি। যখন তিনি আমার বংশপরিচয় শুনলেন তখন আর কোনও আপত্তি রইলো না।

    এইভাবে আমি জিন সম্রাট-কন্যাকে বিবাহ করে প্রাসাদে নিয়ে এলাম।

    শাহজাদা হীরা তুমি যাকে তোমার সামনে দেখছো এখানে এই সেই জিন-সম্রাট-নন্দিনী, আমার প্রিয়তমা রানী।

    আমার প্রাসাদে আসার পর, কেন জানি না সম্রাট-কন্যা ফিরকোন অসুস্থ হয়ে পড়লো।

    –তোমাকে খুব অসুস্থ দেখছি, রানী?

    রানী ফিরকোন বললো, ও কিছু নয়, মহারাজ। আমি বেশ ভালো আছি।

    সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে পড়লো। হাত মুখ ধুয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো, এবং যথারীতি আমার দেহ কামনা প্রশমিত করলো।

    এর কয়েকদিন বাদে আবার সেই একই ঘটনা। ঘরে ঢুকে দেখলাম, প্রায় নেতিয়ে পড়া একটা ঠাণ্ডা সাপের মতো বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছে সে৷ সে দিনও আমি বললাম, কী শরীর খারাপ নাকি?

    সে ধরমড় করে উঠে বসলো শয্যায়। বললো, কই না তো!

    তারপর মুখহাত ধুয়ে এসে যথারীতি আমার সঙ্গে রতিরঙ্গ করলো সে! কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন কিন্তু আর পুরোপুরি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না সে।

    আমার মনে কেমন খটকা লাগলো।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে শাহরাজাদ।

     

    নয়শো ঊনিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আমার রানী ফিরকোনকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। এমন ঠাণ্ডা মেয়ে তো সে ছিলো না! হঠাৎ এই রকম নিরাসক্ত হয়ে গেলো সে কি করে?

    একদিন রাতে ঘরে এসে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এই রকম ভান করে শয্যায় ঢলে পড়লাম। ফিরকোন আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করলো। কিন্তু আমি ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে বললাম, আজ আর শরীর বইছে না রানী, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।

    ফিরকোন আর বিরক্ত করলো না আমাকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমার নাসিকা গর্জন শুরু হলো। ইচ্ছে করেই এমনটা করেছিলাম সে রাতে।

    একটু পরে বুঝতে পারলাম শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ফিরকোন। ঘাপটি মেরে দেখতে থাকলাম, পরিপাটি করে সাজগোজ করলো ফিরকোন। সুরমা কাজল পরলো চোখে, দাঁতে ঘষলো হিন্দুস্তানের মিসি। হীরা চুনী পান্না মুক্তোর রত্ন আভরণ পরলো অঙ্গে। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো পা টিপে টিপে।

    আমিও উঠে পড়লাম। খুব সন্তর্পণে ওকে অনুসরণ করে চললাম।

    ঘোড়াশালে ঢুকলো সে! এবং একটু পরে একটা তাজা ঘোড়ায় চেপে প্রাসাদ ছেড়ে সড়কের পথ ধরলো। আমিও আর কালবিলম্ব না করে আমার প্রিয় ডালকুত্তাটাকে সঙ্গে নিয়ে এক সাধারণ ফৌজের ছদ্মবেশ পরে অন্য একটা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চেপে বসলাম।

    ফিরকোন ছুটে চলেছে বায়ুবেগে, আমিও চলেছি তার পিছনে পিছনে।

    একটানা দুঘণ্টার পথ অতিক্রম করে এক নিগ্রো মহল্লায় এসে ঘোড়ার গতি ঈষৎশ্লথ করলো ফিরকোন। অপেক্ষাকৃত একটা ফাঁকা জায়গায় বস্তি ধরনের একটা জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো সে। আমিও বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে ওকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। ফিরকোন ঘোড়া থেকে নেমে সটান ঢুকে গেলো বাড়িটার অন্দরে। আমিও হনহন করে ছুটে গেলাম দরজার দিকে। কিন্তু হায়! ততক্ষণে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।

    কিন্তু ভাঙ্গাচোরা বাড়িটার একটা নড়বড়ে জানলার ফুটোয় চোখ রেখে সব কাণ্ডকারখানাই দেখতে পারলাম।

    ঘরের ভিতরের নারকীয় দৃশ্য দেখে গা গুলিয়ে গেলো। চারপাশে ছড়ানো পচা মাংসের হাড় আর হাড়িয়ার দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে নাকে রুমাল চাপা দিলাম আমি। কিন্তু অবাক কাণ্ড আমার ফুল-সোহাগী রানী ফিরকোনকে এতটুকু নাক সিটকাতে দেখলাম না। ঘরে ঢুকেই সে কাচুমাচু হয়ে কৈফিয়ত দিতে শুরু করলো, আজও দেরি হয়ে গেলো মালিক, কিন্তু কি করবো বলো, আমার স্বামী হতচ্ছাড়াটা কিছুতেই ঘুমোতে চায় না। তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবে তো আসবো।

    -চুপ কর হারামজাদী, তোর অমন বাহানা আমরা রোজই শুনি।

    ঘরের ভিতরে সাতটা আবলুস কালো মহিষাকৃতির নিগ্রো। প্রত্যেকের হাতে হাড়িয়ার পাত্র। ফিরকোনকে এলাপাতাড়ি পিটতে লাগলো সকলে মিলে, বল শালী, আর কোনও দিন দেরি করবি?

    আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, যে মেয়েকে দেখে মনে হয়েছিলো ফুলের আঘাত সহ্য করতে পারবে না সে যে আজ সাত-সাতটি নিগ্রোর বেদম প্রহার হাসিমুখে সয়ে গেলো? ফিরকোনের মুখ দেখে মনেই হলো না যে নির্দয়ভাবে প্রহৃত হয়েছে এই মাত্র।

    নিগ্রোরা এবার ওর সুন্দর সাজ-পোশাক পাশবিক হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেঁড়ে বিবস্ত্রা উলঙ্গ উদোম করে মাটিতে ফেলে দিয়ে এক সঙ্গে সবাই মিলে রতিরঙ্গে লিপ্ত হলো। ফিরকোন একা মেয়ে আর তার দেহের ওপর চেপে বসেছে। সাত-সাতটা মহিষাসুরের মতো নিগ্রো দানব। আমি তো শিউরে উঠলাম, ফিরকোনের হাড়গোড় বুঝি সব গুড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়ে এক ঘুষিতে জানলাটাকে ভেঙ্গে ঝাপিয়ে পড়লাম ওদের ওপর।

    আমাকে ঐভাবে ঘরে ঢুকতে দেখে পাঁচজন জিন জিন বলে চিৎকার তুলে দরজা খুলে উধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে গেলো। বাকী দু’জনকে আমি গড়মড় করে চেপে। ধরেছিলাম। তার মধ্যে একজন আমার কজা থেকে ছাড়িয়ে। ছুটে পালালো কিন্তু অন্য জনকে প্রচণ্ড এক ঘুষিতে কাবু করে মাটিতে ফেলে দিলাম আমি। এরপর ফিরকোনকে তোলবার জন্য হাত বাড়ালাম।কিন্তু বজ্জাত মেয়েছেলেটা ততক্ষণে আমার তলপেটে এক লাথি বসিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড আঘাতে ব্যথায় ককিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম আমি। সেই মওকায় নিগ্রোটা আমার বুকের ওপর চেপে বসে দু’হাতে গলাটা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে আমাকে খতম করতে মরিয়া হয়ে উঠলো। সেদিন আমার এই ডালকুত্তাটা না বাঁচালে ঐ নিগ্রোর হাতেই আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। কুকুরটা ঝাপিয়ে পড়ে নিগ্রোটার টুটি চেপে ধরলো। তৎক্ষণাৎ। আত্মরক্ষার জন্য সে তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে কুকুরটাকে ঠেকাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারলো না।

    ক্ষত-বিক্ষত নিগ্রোটা মরার মতো নেতিয়ে পড়লো। আমি ওকে ঘোড়ার লেজের সঙ্গে বেঁধে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে প্রাসাদে নিয়ে এলাম। ঘোড়ার পিঠে চড়বার আগে ফিরকোনকে এইভাবে পিছ-মোড়া করে বেঁধে আমার সামনে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। সেই থেকে ওর হাতের বাঁধন আর খুলে দিইনি। নিগ্রোটাকে আমি নিজে হাতে কোতল করেছি। এই যে তোমার সামনে রেকাবীতে কাটা মুণ্ডু দেখছে—এটা তারই। লবণের আরক দিয়ে জারিয়ে রেখেছি, তাই দেখে। মনে হচ্ছে, সদ্য বুঝি কাটা হয়েছে ওকে।

    যে নিগ্রোটা আমার কজা থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো সে এখন আছে সিনমাসিনে সম্রাট কামুসের প্রাসাদে। সে এখন তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে তার কন্যা মুরার শয্যাকক্ষে অবস্থান করছে।রাজকুমারী মুরার সে এখন পেয়ারের নাং। তার কথাতেই সে ওঠে বসে।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    নয়শো বিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    এই হলো আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত গোপন কাহিনী। এ রাজ্যে দ্বিতীয় কোনও মানুষ এ কাহিনী জানে না। এবং আমার কড়া হুকুম আছে যদি কোনও ভাবে কেউ জানতে পেরে থাকে এ ঘটনা, তাকে কোনও মতেই জিন্দা রাখা হবে না। তোমার কাছে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গোপন তথ্য বললাম। এরপর তো আমি তোমাকে সশরীরে এই দরবার-কক্ষের বাইরে যেতে দিতে পারি না, শাহজাদা হীরা। তোমার শির এখানে রেখে যেতেই হবে। কারণ আমি চাই না, আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত কেচ্ছা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক।

    হীরা অবিচলিত কণ্ঠে বললো, আমি আপনার দণ্ড মাথা পেতে নেব, মহারাজ। কিন্তু তার আগে আমাকে খোলসা করে বুঝিয়ে দিন, ঐ সপ্তম নিগ্রোটা দুনিয়ার এতো জায়গা থাকতে ঐ সিনমাসিন সম্রাটের কাছেই বা আশ্রয় ভিক্ষা করতে গেলো কেন? এবং কী করেই বা সে রাজকুমারী মুরার অত নেকনজরে পড়তে পারলোযাতে সে তাকে সোজা নিয়ে গিয়ে তুললো তার শোবার ঘরে? এই ব্যাপারটায় কেমন একটু ধাঁধা লাগছে আমার। দয়া করে এই ব্যাপারটা আর একটু খোলসা করে বলে আমার সংশয় দূর করুন, নরপতি। তারপর আমি আপনার খতলে মাথা পেতে দেব হাসিমুখে।

    শাহজাদার এই অদ্ভুত কৌতূহল দেখে সাইপ্রাস-সম্রাট অবাক হয়ে বললেন, তোমারই বা এতসব খুঁটিনাটি জানার এতো আগ্রহ কেন যুবক? পৃথিবীতে কত আজব ঘটনাই নিত্য ঘটে। তা নিয়ে ক’জনই বা নিজের মাথা ঘামায়? তোমার এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ নয়, শাহজাদা। এটা আমার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য একান্ত গোপনীয়। একথাটা বলা হলে আমার তথা আমার সাম্রাজ্যের পতন ঘটতে পারে। সুতরাং এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না তোমাকে। তার বদলে আমি তোমাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিলাম। এ দরবার, এদেশ ছেড়ে যেখানে খুশি তুমি চলে যেতে পার, আমি তোমার কোনও স্বাধীনতাতেই বাধা দেব না।

    হীরা কিন্তু সম্রাটের কথায় দরবার ত্যাগ করার কোনও ইচ্ছাই প্রকাশ করলো না। সম্রাট অধৈর্য হয়ে বললেন, এখন এই মুহূর্তে আমি তোমাকে মার্জনা করেছি, সুতরাং আর কালবিলম্ব না করে বিদায় নাও। কি জানি হয়তো পরে আবার আমার মতের পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে।

    এবার আর চুপ করে বসে থাকতে সাহস করলো না হীরা। সম্রাটকে যথাবিহিত অভিবাদন করে দরবার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

    আসল কাজ সমাধা হয়েছে এবার ফিরে যাবার পালা। সিমুর্গের দেওয়া চুলটায় আগুন ধরিয়ে দিতেই অল্পক্ষণের মধ্যে সে এসে হাজির হলো তার সামনে। হীরা বললো, আপনার অনুগ্রহে

    আমি কার্যোদ্ধার করতে পেরেছি। এবার আমাকে দয়া করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে চলুন।

    সিমুর্গ তাকে পিঠে চাপিয়ে আকাশপথে উড়ে আজিজার প্রাসাদে এনে নামিয়ে দিলো। হীরার বিরহে আজিজা কাতর হয়ে পড়েছিলো। প্রিয়তমকে ফিরে পেয়ে আবার তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

    কয়েকটা দিন আজিজার সঙ্গে মধুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ থেকে চাঙ্গা হয়ে উঠলো হীরা। সিমুর্গের কাছে গিয়ে বললো, কাকা, আপনি আমাদের দু’জনকে আপনার ভাতিজার গৃহে নিয়ে চলুন দয়া করে।

    সিমুর্গের পিঠে চেপে ওরা জামিলার প্রাসাদে এসে নামলো। জামিলাও হীরার শোকে মুহ্যমান হয়েছিলো। হীরার সঙ্গ পেয়ে আবার সে হাসি গানে উজ্জ্বল উদ্দাম হয়ে উঠলো।

    সিমুর্গ বললো, কিন্তু লতিফা তোমার সঙ্গে যে আচরণ করেছে তা ক্ষমা করা যায় না বেটা। তার উপযুক্ত সাজা দেওয়া দরকার। শয়তান মেয়েটাকে গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে শকুনি দিয়ে খাওয়ান দরকার।

    আজিজা বললো, না ওসব করে দরকার নাই। যা করেছে তার জন্য সে যদি অনুতপ্ত হয় তবে তাকে এবারের মতো মার্জনা করে দেওয়া দরকার।

    আজিজার কথায় জামিলাও সায় দিলো, ঝোকের মাথায় একটা ভুল সে অবশ্যই করেছে। তা বলে ঐ ভাবে তাকে জানে মেরে ফেলাটা উচিত হবে না।

    দুই বেগমের ইচ্ছায় হীরা লতিফার সব অপরাধ ক্ষমা করে তাকেও শাদী করে সঙ্গে নিলো।

    এবার তারা যাবে সিনমাসিনে কামুসের সাম্রাজ্যে। তার কন্যা মুরার সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে তাকে।

    সিনমাসিন শহরে প্রবেশ দ্বারে তাঁবু গেড়ে সেখানে তিন বেগমকে রেখে হীরা একাই সম্রাট কামুসের প্রাসাদে চলে এলো।

    খবর পেয়ে মতিয়া ছুটে এলো দেখা করতে। হীরা বললো, শহরের বাইরে আমি তবু গেড়েছি। সেখানে আমার আরও তিন বেগমকে রেখে এসেছি। তুমি যদি ইচ্ছা কর আমি তোমাকে এখুনি সেখানে নিয়ে যেতে পারি।

    মতিয়া তক্ষুণি এক বস্ত্রে হীরার সঙ্গে তাঁবুতে চলে এলো। অন্যান্য বেগমদের সঙ্গে মতিয়ার আলাপ করিয়ে দিলো।

    এরপর আসল কাজের উদ্দেশ্যে হীরা প্রাসাদের প্রধান ফটকের সামনে এসে সেই দামামায় আঘাত করলো।

    যথারীতি সিংহদরজা উন্মুক্ত হয়ে গেলো। সশস্ত্র প্রহরী অভিবাদন জানিয়ে শাহজাদা হীরাকে সম্রাট-সমীপে উপস্থিত হওয়ার জন্য অভ্যর্থনা জানালো।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো একুশতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে– সম্রাট কামুস শাহজাদা হীরাকে দেখা মাত্র চিনলেন।

    —ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন, বেটা। এখনও কি তুমি আমার কন্যার প্রশ্নের মুখোমুখি হবার

    বাসনা ত্যাগ করতে পারনি? 19, হীরা বললো, আল্লাহর দোয়ায় আমি তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে। পিরবো মহারাজা। আপনি চিন্তিত হবেন না। যে গোপন তথ্য একমাত্র

    আপনার কন্যাই জানেন বলে অহঙ্কার করছেন তার সে অহঙ্কার আমি চুর্ণ করে দেব। আসল চাবিকাঠির আমি হদিশ পেয়েছি। আপনি আসরের আয়োজন করে দিন, সম্রাট।

    সম্রাট কামুস হতাশ হয়ে বললেন হায় বেচারা! মউৎ তোমার সামনে হাজির হয়েছে। নিয়তিরই নির্দেশ, কী করে তুমি তাকে এড়াবে, বলো? যথাসময়ে মঞ্চাসরে উপস্থিত হলো মুয়া। হীরা পূর্বাহ্নেই সেখানে আসন দখল করে রাজকুমারীর আগমন প্রতীক্ষা করছিলো।

    আড়চোখ একবার দেখে নিলো তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে। চমকে উঠলো মুরা। এই না সেই শাহজাদা, এর আগে একবার এসেছিলো এ প্রাসাদে, তার আতিথ্যের সময় ফুলবাগিচায় মোলাকাতও হয়েছিলো একবার। সেবার সে কায়দা করে সটকে পড়েছিলো।কিন্তু এবার? এবার

    সে এসেছে প্রাণ খোয়াতে? এবার সে বাঁচবে কী করে?

    শাহজাদা হীরার প্রতি সে তীক্ষ্ণ প্রশ্নবান হানলো, আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছ? সাইপ্রাস সম্রাট আর ফিরকোনের আসল সম্পর্কটা কী? জান এর উত্তর?

    হীরা নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিলো, অবশ্যই জানি। ওদের সম্পর্ক খুবই খারাপ। সম্রাটের মহারানী কতকগুলো নিগ্রোর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলো, এই অপরাধে সে আজ বন্দিনী। তার দু’হাত পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে রেখেছেন সাইপ্রাস সম্রাট।

    রাজকুমারী মুরা শিউরে উঠলো। সারা মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই জোর করে নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করে বললো, তুমি মিথ্যা বলছ না, তার প্রমাণ কী?

    হীরা বললো, যদি তুমি আমাকে বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করতে বাধ্য কর, অবশ্যই আমি তা বলবো। তার আগে বলল, তুমি এক কুমারী কন্যা হয়ে এই তথ্য কোথায় কার কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পেরেছ। নিশ্চয়ই, ওয়াকাক শহরের এমন কোনও মানুষের সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা ঘটেছে, যে তোমাকে এই একান্ত গোপন বার্তা জানিয়েছে?

    এরপর হীরা সম্রাট কামুসকে উদ্দেশ্য করে বললো, মহামান্য সম্রাট আপনি আপনার এবং আপনার কন্যার ইজ্জতের জন্য রাজকুমরী মুরাকে সব সত্য ঘটনা অকপটে খুলে বলতে আজ্ঞা করুন!

    সম্রাট কামুস মুরাকে খবরের উৎস জানাবার জন্য ইশারা করলেন। কিন্তু রাজকুমারী নিরুত্তর হয়ে রইলো।

    হীরা তখন উঠে দাঁড়িয়ে সম্রাটের সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো, আপনি মেহেরবানী করে আমাকে রাজকুমারীর শয়নকক্ষে নিয়ে চলুন, সম্রাট। আমিই সব ধাঁধার অবসান ঘটিয়ে দিচ্ছি।

    হীরাকে সঙ্গে নিয়ে সম্রাট মুরার শোবার ঘরে এলেন। হীরা পালঙ্কের তলা থেকে নিগ্রোটাকে টেনে বের করে সম্রাটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো, এই সেই শয়তান, সাইপ্রাস সম্রাটের কঞ্জা থেকে পালিয়ে এখানে এসে আপনার কন্যার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। এরা সাতটি নিগ্রো মিলে সাইপ্রাস সম্রাটের মহারানী ফিরকোনকে উপভোগ করতো।

    লজ্জায় অপমানে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইলেন সম্রাট কামুস।মৃদুকণ্ঠে হীরাকে বললেন, আর কোনও প্রমাণের দরকার নাই বাবা। আমি সব বুঝতে পেরেছি। মুরাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। এখন থেকে তুমিই তার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ইচ্ছা করলে ওকে জিন্দা রাখতে পার, ইচ্ছা করলে ওকে জ্যান্ত কবরও দিতে পার। আমার কোনও আপত্তি থাকবেনা। তবে এই আমার শেষ কথা, ঐ রকম ব্যভিচারী মেয়ের জীবনে আর মুখদর্শন করবো না। তার কোন কণ্ঠস্বর যেন না আমার কাছে পৌঁছয় কখনও। বাবা হীরা, তোমার কাছে আমার আবেদন, এই মুহূর্তে তুমি তাকে আমার প্রাসাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জা!

    সেইদিনই নিগ্রোটাকে শূলে চাপানো হলো। শাহজাদা হীরা রাজকুমারী মুরার হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে তার তাঁবুতে নিয়ে এলো। সিমুর্গ ওদের ছয়জনকে পিঠে করে উড়ে চললো শাহেনশাহ শামস শাহর শহর অভিমুখে এবং যথাসময়ে এসে নামিয়ে দিলো শহরের প্রবেশ দ্বারে। এরপর সিমুর্গ চিরদিনের মতো বিদায় জানিয়ে আবার আকাশপথে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    সারা শহরে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তে। পুত্র হীরা ফিরে এসেছে শুনে শামস শাহ আনন্দে কেঁদে ফেললেন।

    হাজার হাজার সৈন্যসামন্ত কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে নগরপ্রান্তে এসে হাজির হলো শাহজাদা হীরাকে স্বাগত জানাবার জন্য।

    রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো বাইশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে।

    শাহজাদা হীরা তার অভিযানের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলো পিতার কাছে। সব শুনে শামস শাহ বলেন, যাকে লাভ করার জন্য মন-প্রাণ আকুল হয়েছিলো

    তোমার, সে আজ তোমার করায়ত্তে এসেছে। এতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি বেটা!

    কিন্তু বাবা, হীরা বললো, ঐ ব্যভিচারিণীকে পেয়ে আমার কী ফয়দা হবে? তার চেয়ে আপনি আদেশ করুন, আমি ওকে চরম সাজা দিই।

    শাহেন শাহ জানতেন হীরা রাজকুমারী মুরা সম্পর্কে কতখানি দুর্বল, বললেন, তোমার কথা ঠেলে ফেলবার নয় বাবা। তবুবলবো, অনেক দুঃখ কষ্ট সয়ে জীবন বিপন্ন করে যাকে ঘরে এনেছ হঠাৎ কোনও উত্তেজনাবশে তাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত কর এখনি, তা আমি চাই না। অনেক কষ্টে সমুদ্রমন্থন করে যে মুক্তো হাতে পেলে তা যদি প্রথম বিচারে ঝুটা বলেও প্রমাণিত হয় তাকে তখুনি পানিতে নিক্ষেপ করো না? এই আমার অভিমত। তাছাড়া, আরও একটা কথা তোমার মনে রাখা উচিত, তুমি যখন তার বাগিচায় প্রবেশ করে তার হাত চেপে ধরেছিলে তা অত্যন্ত গর্হিত কর্ম হয়েছিলো। তোমার কৃতকর্মের জন্য রাজকুমারী তখনি তোমাকে প্রাণদণ্ডের সাজা দিতে পারত। কিন্তু তা সে করেনি। সে কথা ভেবেও তার অনেক দোষ ক্ষমার চোখে, দেখতে পার তুমি।

    পিতার এই পরামর্শে শাহজাদা হীরার চৈতন্য হলো। তখনি সে মনস্থির করলো মুরাকে সে শাদী করে বেগমের মর্যাদা দেবে।

    এরপর হীরা পাঁচটি বেগম নিয়ে সুখে সম্ভোগে দিন কাটাতে থাকলো।

    গল্প শেষ হলো। শাহরাজাদ থামলো।

    সুলতান শারিয়ার বললেন, চমৎকার-চমৎকার তোমার কিসসা শাহরাজাদ।

    শাহরাজাদ বলে, এরপরে আরও চমৎকার কাহিনী আপনাকে শোনাবো, জাঁহাপনা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }