Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৪.৩৭ তুফা অল কুলবের কাহিনী

    সুলতান হারুন অল রসিদের সভা-গায়ক ছিলো সঙ্গীতের যাদুকর-মণ্ডলের স্বনামধন্য ওস্তাদ ইশাক অল নাদিম। খলিফার প্রিয়পাত্র ছিলো সে। হারুণ অল রসিদের হারেমের জন্য পরমাসুন্দরী বাদীদের সংগ্রহ করে এনে প্রথমে ইশাকের কাছে গান-বাজনার তালিম নিতে পাঠানো হতো। যে সব মেয়েরা ইশাকের শিক্ষার গুণে সঙ্গীত-সুধাকরী হতে পারতো তাদের সে খলিফার সামনে হাজির করতো গান শোনাবার জন্য। সুলতান সন্তুষ্ট হলে তারা হারেমে প্রবেশের অধিকার পেত। কিন্তু যে সব বাদীরা গান শুনিয়ে সুলতানের মন ভোলাতে সমর্থ হতো না আবার তাদের ফিরে যেতে হতো ওস্তাদ ইশাকের প্রাসাদে।

    একদিন খলিফার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিলো। কিছুতেই কিছু ভালো লাগছিলো না। তখন তিনি উজির জাফর, ওস্তাদ ইশাক, দেহরক্ষী মাসরুর, জাফরের ভাই অল ফাদল এবং ইউনুসকে সঙ্গে নিয়ে ছদ্মবেশে পথ-পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লেন। সকলেরই একই রকম বেশবাস। কাউকে দেখে চেনার উপায় ছিলো না, কে বাদশা, কে বান্দা আর কে বা উজির অমাত্য।

    চলতে চলতে তারা একসময় টাইগ্রিস উপকূলে উপস্থিত হলেন। এবং একখানা ছোট পানসী ভাড়া করে আল-তাকের দিকে রওনা হয়ে গেলেন।

    আল-তাকে পৌঁছে নৌকা ছেড়ে তীরে নেমে আবার ওঁরা এক অলক্ষ্য অভিযানের যাত্রী হয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে পথ চলতে থাকলেন।

    চলতে চলতে এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ওদের। ইশাকের সামনে দাঁড়িয়ে সে সঙ্গীতগুরুকে অভিবাদন জানিয়ে বললো, আমার কি পরম সৌভাগ্য, আপনার দর্শন পেলাম। এই বান্দা প্রাসাদের কর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখায়। আপনাকে আমি দুর থেকে দেখেছি অনেকবার। কিন্তু সামনে যাবার সুযোগ পাইনি কখনও।

    বোঝা গেলো বৃদ্ধ মৌলভী একমাত্র ইশাক ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারেনি। বৃদ্ধ বলতে থাকে, আপনার কাছে আমার একটা নিবেদন আছে, মালিক।

    ইশাক বলে, বেশ তো, বলল না—

    —আমার বাড়িতে একটি পরমাসুন্দরী কিশোরী বাদী আছে। তাকে আমি গান-বাজনা শিখিয়ে সুলতানের হারেমের যোগ্যা করে তুলতে চাই। আপনি যদি মেহেরবানী করে আপনার ঘরানায় তাকে ভর্তি করে নেন তবে আমি ধন্য হয়ে যাই। আর যদি আপনি না করেন তা হলে আর কী করবো। ও মেয়েকে তো আমার গরীবখানায় মানাবে না। অগত্যা কোনও সওদাগরের কাছেই বেচে দিতে হবে। যদি আপনার এক পল ফুরসত হয় তবে মেয়েটাকে একবার আপনি স্বচক্ষে দেখুন, মালিক, এই আমার আর্জি।

    ইশাক একবার অপাঙ্গে খলিফার দিকে তাকালো। এবং খলিফার ইশারা বুঝতে পেরে বৃদ্ধকে বললো, বেশ তো কোথায় তোমার ঘর, চলে যাওয়া যাক। আমার সঙ্গে এই বন্ধুরা রয়েছেন এঁরাও যাবেন।

    বৃদ্ধের আনন্দ আর ধরে না। সে যেন হাতে চাঁদ ধরে ফেলেছে। বললো, এই কাছেই। ঐ যে দেখছেন গিরিমাটি রঙের বাড়িটা-ওটাই আমার গরীবখানা। মেহেরবানী করে আপনারা সকলেই চলুন।

    বাড়িটা নেহাত ছোটখাট নয়। বেশ ঝকঝকে তকতকে। পরিপাটি করে সাজানো গোছানো।

    একখানা সুসজ্জিত বড় ঘরে বসালো সে। একটুক্ষণ পরে তানপুরা হাতে এসে বসলো একটি নবযৌবন-উদ্ভিন্না অলোক-সামান্যা সুন্দরী তরুণী। আভূমি আনত হয়ে অভ্যাগত অতিথিদের সালাম জানালো সে। তারপর গালিচার ওপর বসে একটি গান ধরলো।

    কেমনে তরাবো বলল, এ অকুল দরিয়া।
    যৌবন বিফলে গেলো, তোমারে স্মরিয়া।।

    কী অপূর্ব সুললিত কণ্ঠ। খলিফা ছটফট করে ওঠেন। কিন্তু নিজের ছদ্মবেশের কথা ভেবে মুখ ফুটে বাহবা জানাতে পারেন না। মনে মনে তারিফ করতে থাকেন, সুন্দরী, যেমন তোমার রূপ তেমনি তোমার গুণ। এমন কোকিলকণ্ঠ কোথায় পেলে তুমি? খোদাতালার তুমি এক অপূর্ব সৃষ্টি।

    ইশাক পঞ্চমুখে মেয়েটির মধুর কণ্ঠের গুণগান করতে থাকে। আত্মপ্রশংসা শুনে আরক্ত হয়ে কানে হাত চাপা দিয়ে উঠে আসে সে ইশাকের সামনে। গড় হয়ে পায়ের ওপর মাথা ঠেকায়।

    -আপনি দুনিয়ার সেরা ওস্তাদ, আপনার সামনে বসে আপনাকে গান শোনাবো এ যে আমার কল্পলোকের বাসনা ছিলো এতকাল। বাস্তবে তাই আজ ঘটে গেলো দেখে নিজেকে আর সহজভাবে ধরে রাখতে পারছি না, ওস্তাদ। সারা শরীর আমার টলমল করে কাপছে যেন। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসছে। আজ এই মুহূর্তে আমি বুঝি আর একটাও গান শোনাতে পারবো না। আপনারা আমাদের ঘরে মেহেমান হয়ে এসেছেন। আমার গান শুনতে চেয়েছেন, কিন্তু আমি, একি হলো আমার, আর এখন গান শোনাতে পারবো না আপনাদের।

    এই বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মেয়েটি।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    নয়শো সাতাশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    মেয়েটার মর্মবেদনায় ইশাক বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ে।

    -তুমি আল্লাহর আশীর্বাদ নিয়ে জন্মেছ মেয়ে, এতে দুঃখ করার কী আছে। তোমার প্রকৃত পরিচয় কী সুন্দরী?

    মেয়েটি লজ্জায় মাথা নত করে বসে থাকে। একটিও কথা বলে না। ইশাক বুঝতে পারে, এতো মানুষের সামনে হয়তো সে মুখ খুলতে চায় না।

    —তোমার যদি সকলের সামনে বলতে আপত্তি থাকে তবে চলো আমরা পাশের ঘরে গিয়ে বসি, কেমন?

    মেয়েটি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

    পাশের ঘরে ইশাককে একা পেয়ে মেয়েটি সহজ হয়ে বোরখার নাকাব সরিয়ে দেয়। মেয়েটির নিখুঁত মুখাবয়ব দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে ইশাক। এমন অলৌকিক রূপলাবণ্য সে খুব কমই দেখেছে জীবনে।

    -এবার তুমি নির্ভয়ে বলো বাছা, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ এখানে? আর কেনই বা তোমার চোখভরা অশ্রু আর মুখ এমন বিষণ্ণ বেদনা-মধুর?

    মেয়েটি বলে, আমার দীর্ঘসময়ের প্রতীক্ষা আজ সফল হয়েছে। আপনার পথ চেয়েই আমি দিন গুনছিলাম। অবশেষে আজ আপনার দর্শন পেয়ে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারিনি, ওস্তাদ। কান্না আমার নিত্য সঙ্গী। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে রোজ আমি শুয়ে শুয়ে কাদি। কেঁদে কেঁদে চোখের কোলে হয়তো আমার কালি পড়েছে। মুখের লাবণ্য ঝরে যেতে বসেছে।

    ইশাক বাধা দিয়ে বলে, ওকথা সত্যি নয়, বাছা। তোমার রূপের জেল্লার কাছে চাঁদও হার মানবে। এমন অপরূপ রূপ-লাবণ্য এর আগে আমি কোথাও দেখিনি। নিজের দেহ-সৌন্দর্যকে এতো ছোট করে ভাব কেন তুমি? তোমার মতো ফরসা সুন্দরী কন্যা ক’টা আছে দুনিয়ায়?

    মেয়েটি বলে, সত্যিই আমি সুন্দরী ছিলাম ওস্তাদ। কিন্তু দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার মধ্যে মাসের পর মাস কাটছে আমার। এতো চিন্তা ভাবনা মাথায় থাকলে কী মানুষ বাঁচে? হরবখত আমাকে নীলামে দাঁড়াতে হয়। কত দালাল সওদাগর দর দিয়ে যায়। কবে কোথায় যে বিক্রি হয়ে যাবো তার ঠিক নাই। কার হাতে গিয়ে যে পড়বো শেষ পর্যন্ত কিছুই জানি না। সে মানুষ কেমন হবে, কী ভাবে আমাকে গ্রহণ করবে কে জানে?

    আমার জীবনের একমাত্র সাধ আপনার সঙ্গীত-পাঠশালায় আমি গান শিখবো। তার জন্যে যে-কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত আছি আমি: যে-কোন কষ্ট স্বীকার করতে সম্মত আছি। আপনি আমাকে দয়া করে আপনার পায়ে আশ্রয় দিন, ওস্তাদ।

    এই সময় বৃদ্ধ ঘরে প্রবেশ করলো। ইশাক তাকে জিজ্ঞেস করলো, কত দাম নেবে এর? তার আগে বলো, এর নামটা কী?

    বৃদ্ধ বলে, ওর নাম তুফা অল কুলুব। কিমত অন্ততপক্ষে দশ হাজার দিনার। এই দাম অনেকেই দিয়ে গেছে। কিন্তু দামটাই সব নয়। মেয়ের সম্মতিই আসল। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই মেয়েকে রাজি করাতে পারিনি। ওর একমাত্র বায়না আপনার কাছে গান-বাজনা শিখবে। আপনি যদি সম্মতি হন তবে ঐ দশ হাজারেই আমি দিয়ে দেব আপনাকে। টাকাটাই এখানে বড় নয় ওস্তাদজী। ওকে মানুষ করতে আমার তার চেয়ে বেশিই খরচ পড়েছে।

    ইশাক হেসে বললো, ঠিক আছে, দশ হাজার কেন, বিশ হাজারই দেব তোমাকে। আমি জেনেছি, এ মেয়ের মূল্য আরও অনেক বেশি হতে পারতো। ঠিক আছে, তা হলে ঐ কথাই রইলো, একে আমার প্রাসাদে পাঠিয়ে দাও। টাকাটা হাতে হাতেই দিয়ে দেব!

    এরপর ইশাক ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে এসে খলিফাকে সব জানালো। খলিফা শুনে – পুলকিত হলেন। তারপর তারা বৃদ্ধের বাড়ি ছেড়ে নতুন অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন।

    ইতিমধ্যে বৃদ্ধ তুফা অল কুলুবকে ইশাকের প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে নগদ বিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে ফিরে এলো।

    ইশাকের খুদে খোজা-নফররা তুফাকে হামামে নিয়ে গিয়ে আচ্ছা করে ঘষে মেজে সুগন্ধী আতরজলে গোসল করালো। তার মূল্যবান সাজ-পোশাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। পরিয়ে দিলো নানারকম রত্ন আভরণ।

    ইশাক ফিরে এসে তুফাকে বাদশাহী সাজ-পোশাকে সজ্জিতা দেখে প্রথমে যেন চিনতেই পারে না। আহা এমন ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটি মাত্র কয়েকটা মাস থাকবে তার কাছে। তার পাঠশালায় গান বাজনা শিখবে। তারপর যথাস্থানে সুলতানের হারেমে পাঠিয়ে দিতে হবে!

    ভাবতেও মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায় ইশাকের। দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা এই সুগন্ধী পুষ্পটি লালন করে প্রস্ফুটিত করারই শুধু দায় আছে তার। ওকে আঘ্রাণ করার অধিকার একমাত্র খলিফা হারুন অল রসিদের, আর কারুর নয়।

    ইশাক তার খোজা-নফরদের নির্দেশ দিলো তুফাকে খুব আদর-যত্নের মধ্যে যেন লালন করা হয়।

    একদিন বিকালে তুফা প্রাসাদ-সংলগ্ন উদ্যানে আপন মনে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় সেখানে ইশাক এসে উপস্থিত হলো। তুফা কিন্তু ইশাকের উপস্থিতি বুঝতে পারলো

    না।

    সঙ্গীতের সুললিত সুরে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইশাক। এমন গান যার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হতে পারে নিশ্চয়ই সে কোনও মানবী নয়! তার পাঠশালায় এসেছে, সে গানের পাঠ নিতে। কিন্তু এ সঙ্গীত যার কণ্ঠে, তাকে সে কী শেখাবে, কী শেখাতে পারবে? সঙ্গীতের উচ্চমার্গে যে বিচরণ করছে তাকে সে আর কী শেখাতে পারবে?

    হঠাৎইশাককে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুফা ছুটে যায় তার কাছে, কী ব্যাপার, আপনি এমন মনমরা হয়ে শুকনো মুখে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, ওস্তাদ?শরীর-টরীর খারাপ হয়নি

    তো?

    ইশাক সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, এমন গান তুমি কোথায় শিখেছ, তুফা?

    তরুণী তুফা লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠে। কোনও জবাব দিতে পারে না। ইশাক বলে, তোমার গলায় যাদু আছে, বাছা। এ বস্তু শুধু তালিম নিয়ে রপ্ত করা যায় না।

    তুফা বলে, আপনি আমার ওস্তাদ। আপনার আশীর্বাদেই যা কিছু সম্ভব হয়েছে।

    –ও কথা বলো না, তুফা। তুমি যে সঙ্গীত-সুধার অধিকারিণী আমি আজ তা সংগ্রহ করতে পারিনি। তোমার সঙ্গীতের মূল্য যদি দিনার হয়, আমার সঙ্গীতের দাম হতে পারে মাত্র একটি দিরহাম। তুমি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, তোমাকে শেখাবার মতো স্পর্ধা আমার নাই। চলো আর কালবিলম্ব না করে এখুনি তোমাকে খলিফার হাতে তুলে দিয়ে আসি। তাঁর অনুগ্রহে তুমি হারেমের সেরা বাদী হয়ে দিন কাটাতে পারবে, এ বিশ্বাস আমার হয়েছে। কিন্তু তখন এই অধম ইশাককে তুমি ভুলে যেও না, তুফা।

    তুফা কেঁদে আকুল হয়ে ওঠে, এ কি কথা মুখে আনছেন ওস্তাদ, আপনিই আমার ঝর্ণার একমাত্র উৎস। তাকে আমি ভুলে যাবো?

    ইশাক একখানা কোরান এনে তুলে দিলো তুফার হাতে। কোরানখানা মাথায় ঠেকিয়ে তুফা শপথ করলো, জীবনে যতদিন বাঁচবো, কোনও দিন আপনাকে ভুলবো না ওস্তাদ।

    ইশাক বললো, তোমার অদৃষ্টের লিখন অপূর্ব। এবং তারই ফলে আজ তুমি খলিফার অঙ্কশায়িনী হতে চলেছ। আমি প্রার্থনা করি, তুমি চিরসুখী হও। এবার আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ। কর তুফা। এইমাত্র যে গানটি তুমি গাইছিলে, যাবার আগে, আর একবার ঐ গানটি আমাকে শুনিয়ে দাও। আর একটা কথা, খলিফার সামনে যখন তুমি উপস্থিত হবে এই গানটাই তাকে শুনিয়ে প্রথমে।

    তুফা আবার ধরলো গানটি। শেষও করলো এক সময়। ইশাক কিন্তু মুদিত-নয়নে তন্ময় হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। তারপর বললো, এবার তোমার জীবনের কাহিনী শোনাবে না, তুফা? আমি জানি যেখানে তুমি ছিলে এতকাল, সে তোমার প্রকৃত জায়গা নয়। কিন্তু কী করে কক্ষচ্যুত হয়ে তুমি অমর্ত্যলোক ছেড়ে অতি সাধারণ এক দরিদ্র ঘরে এসে উঠেছিলে?

    তুফা মৃদু হেসে বলতে থাকে, আপনি আমার মালিক, প্রভু, ওস্তাদ। আপনার কাছে লুকাবার আমার কিছুই থাকতে পারে না। তবে আমার জীবনের কাহিনী বড়ই বিচিত্র—পুঁথির পাতায় লিখে রাখার মতো। তবে আজ নয়, সময় মতো আর একদিন, শোনাবো আপনাকে। এখন চলুন সুলতানের প্রাসাদে যাই আমরা।

    একটু পরে জমকালো সাজপোশাক পরে ইশাকের সামনে এসে দাঁড়ালো তুফা।

    সুলতানের প্রাসাদে এসে বিরাট একটা সুসজ্জিত কক্ষের মাঝে তুফাকে বসিয়ে ইশাক বললো, এখানে তুমি বসো। আমি খলিফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি।

    খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে ইশাক নিবেদন করলো, বেহেস্তের এক ডানাকাটা পরীকে নিয়ে এসেছি জাঁহাপনা।

    খলিফা বললেন, যাকে আমরা সেই বৃদ্ধের বাড়িতে দেখেছিলাম? যার মধুর গান শুনেছিলাম?

    -হ্যাঁ জাঁহাপনা, আপনার স্মরণ আছে দেখছি!

    তাকে কি ভোলা যায় ইশাক? সে যে সকালবেলায় শিশির, সন্ধ্যাকালের শুকতারা। তার গান একবার যে শুনেছে, সে কি কখনও তাকে ভুলতে পারে? যাও যাও, শিগ্নির তাকে নিয়ে এসো এখানে। তার গান শুনে জীবন সার্থক করি।

    এই সময় রাত্রিও প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো উনত্রিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে :

    একটু পরে ইশাক তুফাকে সঙ্গে করে খলিফার সামনে এসে দাঁড়ালো। খলিফার চোখ প্রজ্জ্বল হলো। হৃদয় নেচে উঠলো। খলিফা দেখলেন সুন্দরী তাকে কুর্ণিশ জানাচ্ছে। তিনি আশীর্বাদ জানালেন, খোদা তোমাকে চিরসুখী করুন, সুন্দরী।

    মসনদ ছেড়ে নেমে এসে তুফার হাত ধরলেন খলিফা। তারপর তার বোরখার নাকাবটা নামিয়ে দিলেন নিজের হাতে। এর অর্থ এখন থেকে সে সুলতানের হারেমের বাদী হলো।

    এরপর হাতে ধরে মসনদে নিয়ে গিয়ে তুফাকে তার পাশে বসালেন খলিফা। গান শুরু হলো। সেই গান।

    সঙ্গীতের অপূর্ব মূছনায় খলিফা বিমোহিত হয়ে পড়লেন।

    —এমন সঙ্গীত তুমি কোথায় পেয়েছ, সুন্দরী? খলিফার প্রশংসায় অন্তর নেচে ওঠে তুফার। কিন্তু লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারে না। খলিফা বলতে থাকেন, তুমি হলে আল্লার শ্রেষ্ঠ অবদান। তারপর ইশাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, একি হে ইশাক, এ যে গুরুমারা বিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছ তোমার ছাত্রীকে! আমার তো মনে হয় এ গান তুমিও এমন করে গাইতে পারবে না।

    —আপনি যথার্থই বলেছেন জাঁহাপনা, এমন মধুর গান আমার কণ্ঠ থেকে বেরুবে না। আল্লাহর দোয়ায় যা কিছু আমি পেয়েছি, শিখেছে তার সবটাই, তুচ্ছ হয়ে গেছে এই সঙ্গীতের কাছে। এখন ভাবছি, এতো যে আমার দেশ জোড়া নাম, তার কিই বা মূল্য আছে।

    খলিফা বললেন, বহুত আচ্ছা। এতদিন পরে তোমার দম্ভ ভাঙ্গলো, তাহলে, ইশাক। স্বীকার করলে, তুমি যা জান তাই শেষ কথা নয়?

    —এ গান শোনার পর সত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠা নাই আমার ধর্মাবতার। সত্যিই আমি এতকাল ধরে সঙ্গীত-সাগরে নুড়ি কুড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম মাত্র।

    তুফা আর একটি গান গেয়ে শোনালো, খলিফা মাসরুরকে বললেন, যা, একে হারেমে নিয়ে যা। দেখিস যেন আদর যত্নের কোনও রকম ত্রুটি না হয় কখনও।

    তুফা মাসরুর সঙ্গে অন্দরমহলে চলে গেলে খলিফা বললো মেয়েটি অসাধারণ রূপ-গুণেরই অধিকারিণী নয়, রুচিও বড় সুন্দর। কেমন সুন্দর করে সেজেছে। আর অত জমকালো সাজ-পোশাকই বা কোথায় পেলো সে?

    ইশাক বললো, এই বান্দাই পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলো জাঁহাপনা। তবে পোশাক যতই মূল্যবান হোক তা মানানসই করে পরতে না জানলে মোটেই সুন্দর দেখায় না। আর সবার ওপরে জাঁহাপনার প্রসন্ন দৃষ্টিই তাকে আরও সুন্দর করে তুলতে পেরেছে।

    খলিফা জাফরকে ডেকে বললেন, ইশাক আজ আমাকে যা দিয়েছে, কড়ির মূল্যে তা কেনা যায় না জাফর, এক লক্ষ মোহর ওর প্রাসাদে বকশিস পাঠিয়ে দাও। সেই সঙ্গে দশটি মূল্যবান সাজ-পোশাকও দিও।

    সন্ধ্যা সমাগত হলে খলিফা সুন্দরী তুফার কক্ষে এলেন। দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নতুন রোমাঞ্চে পুলকিত হয়ে উঠলেন তিনি। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলেন তুফা আজ পর্যন্ত অনাঘ্রাতা অপাপবিদ্ধা একটি ফুল। তারই ভোগের পাত্রী হয়ে অপেক্ষা করছিলো সে এতদিন।

    সেইদিন থেকে তুফা খলিফার হৃদয়-সিংহাসনে সর্বোচ্চ সমাদর ও ভালোবাসায় অধিষ্ঠিতা হয়ে রইলো। খলিফা তুফার শিক্ষা দীক্ষা বুদ্ধি বিচক্ষণতা দেখে মুগ্ধ হয়ে বলতে গেলে তার হাতেই সরকার পরিচালনার চাবিকাঠি তুলে দিলেন। মাসে দু লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা মাসহারা বন্দোবস্ত করা হলো! এবং তার পরিচর্যার জন্য পঞ্চাশটি নফর চাকর পরিচারিকা দাসী বাঁদীর ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি।

    ভালোবাসার আকর্ষণ দিনে দিনে এমনই ভাবে বাড়তে থাকলো যে, খলিফা আজকাল বড়ো একটা অন্য কোনও বাঁদী বেগমের ঘরে রাত কাটান না। দরবার শেষে সোজা চলে যান তিনি তুফার মহলে। সেখানেই তার সর্বাধিক সময় কাটে।

    অন্য কোনও খোজার প্রহরাকে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তুফার মহল ছেড়ে চলে আসার সময় তিনি নিজ হাতে দরজায় কুলুপ এঁটে দেন। আবার ফিরে এসে নিজে হাতেই সে তালা খুলে তুফার ঘরে প্রবেশ করেন।

    একদিন খলিফা তুফার ঘরে প্রবেশ করে ওর একখানা হাত টেনে নিয়ে আদর জানিয়ে চুম্বন করলেন। কিন্তু ফল হলো বিপরীত, ক্ষোভে ফেটে পড়লো তুফা। রাগের মাথায় কী করবে ভেবে না পেয়ে সাধের তানপুরাটাই দু’খানা করে ভেঙ্গে ফেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। খলিফা হতভম্ব তুফার গোসার কারণ কি কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না।

    —কী হলো মনি, কী করলাম আমি? অমন করে কাঁদছো কেন? তোমার চোখে পানি দেখলে যে আমি আর ঠিক থাকতে পারি না। বলল আমার কী দোষ হয়েছে?

    —দোষের কথা নয় জাঁহাপনা, তুফা ফুপাতে ফুপাতে বলে, আপনি আর আগের মতো আমাকে ভালোবাসেন না।

    হায় আল্লাহ, এই তুমি আবিষ্কার করলে? তুমি তো জান না সোনা, তোমার জন্য আজকাল আমি সরকারী কাজেও গাফিলতি আরম্ভ করেছি। তোমাকে চোখের আড়াল করে একদণ্ড আমি সুস্থির থাকতে পারি না। আর তুমি কিনা বললে, আমার ভালোবাসায় ভাটা পড়েছে।

    তুফা বলে, তা নয় তো কী? আপনি একটা নিয়ম রক্ষার জন্য শুধু আমার হাতখানা নিয়ে চুমু খেলেন কেন? আমি কী রূপ-যৌবন সব খুইয়ে ফেলেছি এর মধ্যে। আমার অধরে কি কামনা নাই? আমার বুকে কি আর মধু পান না আপনি? শুধু শুকনো একখানা হাত টেনে ঠোঁট ছুইয়ে কর্তব্য শেষ করতে চাইছেন।

    উত্মার আসল কারণ অনুধাবন করতে পেরে সুলতান দু’হাতে তুফার দেহখানা টেনে নেন বুকের মধ্যে, চুম্বনে চুম্বনে আরক্ত করে দেন ওর অধর, স্তন, নাভিস্থল, জঙ্ঘা।

    -ও, এই জন্য তুমি রাগ করেছ মনি। তুমি জান না আমি তোমায় কত ভালোবাসি। আমার চাচার মেয়ে জুবেদা আমার খাস বেগম—তাকেও আমি এতো ভালোবাসি না সোনা। তুমি আমার সারা হৃদয় মন অধিকার করে বসে আছ।

    একদিন খলিফা শিকারে বেরিয়ে গেছেন, তুফা একা একা তার ঘরে বসে একখানা বই পড়ছিলো, এমন সময় সেখানে বেগম জুবেদা এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ নাকে একটা সুমধুর সুগন্ধ ভেসে আসতে চোখ তুলে তাকাতেই জুবেদাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে আভুমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানিয়ে কাচুমাচু মুখে বলতে লাগলো, আপনি অপরাধ নেবেন না বেগমসাহেবা। এ ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুবার আমার অনুমতি নাই, তাই আপনার সঙ্গে ইচ্ছা থাকলেও, সাক্ষাৎ করতে যেতে পারিনি। বাঁদীর ঘরে আপনি নিজেই যখন এসেছেন, মেহেরবানী করে আসন গ্রহণ করে ধন্য করুন।

    জুবেদা তুফার প্রায় গা ঘেঁষে বসে পড়লেন। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে বলতে লাগলো আমি শুনেছি তুমি খুব উঁচুমানের মেয়ে। তোমার মধ্যে দয়া, মায়া, মমতা, স্বার্থত্যাগের কোনও অভাব নাই। আজ তোমার সামনে এসে তোমার বিনয়াবনত ব্যবহার দেখে আমারও সে কথা মনে হচ্ছে। সহজাত মহত্ত্বই তোমার ভূষণ। আমার স্বামীর দিব্যি নিয়ে বলছি, তার পেয়ারের বাঁদীদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ানো আমার স্বভাব নয় তুফা। তা সত্ত্বেও তোমার কাছে কেন এলাম? শোনও তাহলে বলি : যে দিন থেকে এই হারেমে তুমি এসেছ, সেইদিন থেকে আমার সুখের দিন শেষ হয়েছে তুফা। একদিকে সুলতানের কাছে তোমার সমাদর, আদর সোহাগ যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে আমার বেলায় তেমনি ভাটা পড়েছে। আজকাল বলতে গেলে, সুলতান আর আমার মহলে পা-ই রাখেন না। আমি যেন প্রায় অবহেলিত হয়ে এই প্রাসাদের এক কোণে পড়ে আছি এক নগণ্যা নারীর মতো। এই হারেমে একদা সুলতান-সোহাগিনী অনেক বাঁজা বাঁদী পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। আমার ভয় হচ্ছে, অবশেষে আমাকেও কি তাদের দলে নাম লেখাতে হবে! না হলে আমি তার ধর্মপত্নী, ভুলেও তিনি একবার আমার খোঁজ করেন না আজকাল!

    জুবেদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বেগমসাহেবার দুঃখে তুফাও চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না। সেও কাঁদতে লাগলো।

    কিন্তু জুবেদা শুধু কাঁদতেই থাকলেন না, কাঁদার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলাও অব্যাহত রাখলেন তিনি।

    আমি তোমার কাছে একটি আর্জি নিয়ে এসেছি বোন, তুমি এই বড় বোনের মুখের দিকে চেয়ে মাসে অন্তত একটি রাতের জন্য—সুলতানকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও! শুধু একটি মাত্র রাত—এক মাসের মধ্যে। কী পারবে না তাকে ছেড়ে দিতে? যত যা ঘটুক আমি তো তার কেনা বাঁদী নই–কোরান ছুঁয়ে শপথ করে ধর্মমতে শাদী করেছেন তিনি আমাকে।  •

    জুবেদার করতলে অধর রাখলো তুফা, অব্যক্ত বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুট স্বরে বলতে পারলো না না শুধু একরাতের জন্য নয় বেগমসাহেবা, সারা মাসের প্রতিটি রাত্রি তিনি আপনার কাছে অতিবাহিত করবেন। আপনার চোখে পানি-না না, সে মহাপাপ আমার পক্ষে। আমি না জেনে যে গোস্তাকি করেছি আপনি নিজগুণে আমাকে তা ক্ষমা করুন বেগমসাহেবা। আমি আপনার চিরকাল দাসী বাদী হয়ে থাকতে চাই।

    এই সময় জুবেদা দেখলেন সুলতান শিকার শেষ করে প্রাসাদে ফিরেই তিনি সোজা তুফার ঘরের দিকে ছুটে আসছেন। জুবেদা আর তিলমাত্র অপেক্ষা করলেন না তুফার ঘরে। বললেন, তা হলে আজ চলি, ভাই।

    সুলতান ঘরে ঢুকেই তুফাকে কোলে টেনে নিয়ে সোহাগ করতে থাকলেন, জান মনি, শিকারে গিয়ে আর কিছুই ভালো লাগে না। তুমি পাশে নাই, শিকারে মন বসে! একটা খরগোশও মারতে পারলাম না।

    দু’জনে সরাবের পাত্র পূর্ণ করে নিলেন। খানা-পিনা শেষ করে বিবস্ত্র হয়ে শয্যায় যাওয়ার জন্য সুলতান তুফাকে আকর্ষণ করতে লাগলেন। তুফা খলিফাকে সোহাগ জানাতে জানাতে – বললেন, আজ আমার একটা কথা রাখতে হবে জাঁহাপনা।

    -তোমার কোন কথা আমি রাখিনি, সোনা। তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই, বলো কী করতে হবে?

    তুফা বললো, আপনি বেগমসাহেবার প্রতি প্রসন্ন হোন, আজ রাতটা তার মহলেই কাটিয়ে আসুন, এই আমি চাই জাঁহাপনা।

    খলিফা একটু হকচকিয়ে গেলেন তুফার কথায়, বেশ তো, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। হ্যাঁ, অনেক দিন তার কোনও খোঁজখবর নিতে পারিনি, বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু মনি, আমি যখন তোমার ঘরে এলাম তখন না বলে যখন সাজ-পোশাক খুলে নগ্ন নাগা হয়ে শুতে যাবো সেই সময় একথা বললে কেন?

    তুফা বললো, মহাজন বলেছেন, যখন তুমি কিছু প্রার্থনা করবে তখন তুমি অবশ্যই নগ্ন বিবস্ত্র থাকবে।

    তুফার মুখে উপদেশের বাণী শুনে ওকে দু’হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন সুলতান। তারপর যা ঘটার তাই ঘটেছিলো।

    তুফার মহলে তালা এঁটে জুবেদার মহলে চলে এলেন সুলতান।

    এরপর তুফার জীবনে যা ঘটেছিলো তা বড়ই বিচিত্র—এক কথায় অনন্য সাধারণ বলা যায়। যাই হোক সেই কাহিনীই ধীরে ধীরে শোনাবো আপনাকে, জাঁহাপনা

    রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো তিরিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    সুলতান চলে গেলে তুফা একখানা বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারলো না। বইখানা রেখে দিয়ে তানপুরাটা তুলে নিয়ে গান ধরলো।

    সঙ্গীত-মূর্ঘনায় বিভোর হয়ে গেছে তুফা, এমন সময় সে দেখল ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে এক বৃদ্ধ। তুফার সারা শরীর ভয়ে কেঁপে উঠলো, এমন সুরক্ষিত হারেমে পরপুরুষ প্রবেশ করলো কী উপায়ে? সে কি স্বপ্ন দেখছে জেগে জেগে?

    বৃদ্ধটা কাছে এলো না কোনও কথা বললো না। তুফা আর সেদিকে তাকালো না, গানও থামালো না। যেন কিছুই ঘটেনি, কেউই আসেনি সেখানে এমনই ভাব করে আপন মনে গাইতেই থাকলো।

    আড়চোখে লক্ষ্য করে দেখতে থাকলো তুফা; নোকটা গানের তালে তাল মিলিয়ে অপূর্ব ছন্দে নেচে চলেছে।

    এক সময় সে গান থামায়। বৃদ্ধের নাচও বন্ধ হয়ে যায়। এবার সে কাছে এগিয়ে এসে বলে, আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ? ভয়ের কিছু নাই তুফা। আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই জানি। আমার দ্বারা কোনও রকম অনিষ্ট তোমার হবে না।

    বুকে সাহস টেনে তুফা বলে, কে তুমি?সুলতানের এই হারেমে তো কোনও পুরুষের প্রবেশ অধিকার নাই। তুমি এলে কি করে এখানে?

    বৃদ্ধ বললো, আমার গতি অবাধ, আমাকে কেউ রুখতে পারে না। তুফা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, তবে কি তুমি কোনও জিন? বৃদ্ধ বলে; তোমার অনুমান সত্য, আমি জিনিস্তান থেকে আসছি। আমার নাম ইবলিস।

    —ইয়া আল্লাহ! তুফা আর্তনাদ করে ওঠে, একি করলে তুমি? আমি তো কখনও বিধর্মের কথা চিন্তা করিনি?

    বৃদ্ধ ইবলিস আরও কাছে এসে তুফার হাতে চুম্বন করে বললো, আমাকে ভয় করো না, বাছা। হতে পারি জিন, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোমার ক্ষতি করতে আসিনি এখানে। বরঞ্চ, বহুদিন ধরে তোমাকে আমি আড়াল করে রেখেছি, যাতে কেউই তোমার কেশাগ্র স্পর্শ না করতে পারে। আমাদের মহারানী জিন-সম্রাজ্ঞী কামারিয়াহ তোমাকে প্রাণাধিক ভালোবেসে ফেলেছেন। আমি তারই আজ্ঞাবহ, সকল বিপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তিনি আমার ঘাড়ে দিয়েছেন। তুমি জান না, কত দিন গভীর রাতে আমাকে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এখানে। আমি দেখেছি, সারাটা রাত তিনি অপলকভাবে তোমার নিদ্রিত দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার রাতের অন্ধকারেই স্বরাজ্যে ফিরে গেছেন। তোমাকে দেখে দেখে তার যেন আর আশ মেটে না।

    কিন্তু আজ আমি একাই এসেছি তার দূত হয়ে। যদি তুমি আমার ওপর ভরসা রেখে আমার সঙ্গে এই রাতে জিনিস্তানে চলো তবে তোমাকে মাথায় করে রাখবেন মহারানী। আজ একটা পরম শুভদিন। আজ আমার কন্যার বিয়ে হচ্ছে, আর ছেলের হচ্ছে ছুন্নত। দারুণ আনন্দ উৎসবের বান ডেকেছে সারা জিনিস্তানে। এই শুভদিনে মহারানী তোমাকে একান্তভাবেই কামনা করছেন। তুমি উপস্থিত থাকলে, আমাদের উৎসব আনন্দ আরও দশগুণ বেড়ে যাবে। আমার অনুরোধ, তুমি না করো না, চলো আমার সঙ্গে। সেখানে তুমি যতদিন বা যতক্ষণ থাকতে চাও থেক, তারপর যদি না ভালো লাগে, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আবার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব এখানে।

    ইবলিসের এই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করার সাহস হলো না ভয়ার্ত তুফার। সে জানতো না’ বললে হিতে বিপরীত হবে। তখন সে জোর করেই তাকে নিয়ে যাবে।

    ঘাড় নেড়ে সে সম্মতি জানালো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইবলিস তুফাকে পিঠে বসিয়ে কী এক আশ্চর্য যাদুবলে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে উর্ধ্বাকাশে উড়ে চলতে থাকলো।

    নিচের দিকে তাকিয়ে তুফা বুঝতে পারলো সে কত ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ইবলিসের পিঠে চেপে। মাথাটা কেমন বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগলো। তারপর কখন যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, আর বুঝতে পারেনি।

    যখন জ্ঞান ফিরলো, চোখ মেলে সে দেখলো এক স্বপ্নে দেখা সোনার প্রাসাদপুরীতে এসে পৌচেছে। যেদিকে তাকায় চোখ জুড়িয়ে যায়, হীরা চুনী, পান্না, মুক্তোর ছড়াছড়ি। প্রাসাদের দেওয়াল মহামূল্যবান মনি ও রত্ন দিয়ে কারুকার্য করা। আলোর ছটায় ঝলমল করছে চতুর্দিক।

    জিন-সম্রাজ্ঞী স্বর্ণসিংহাসনে অধিষ্ঠিতা ছিলেন। তুফাকে দেখা মাত্র সহাস্যে নেমে এলেন তিনি। তার পিছনে পিছনে এসে দাঁড়ালো তিনটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। সকলেই তুফাকে স্বাগত জানিয়ে অভিবাদন করলো। মহারানী এগিয়ে এসে একখানা হাত টেনে নিয়ে চুম্বন করলেন।

    তুফার বুঝতে অসুবিধে হলো না এই সেই মহারানী কামারিয়াহ।

    তুফাকে হাতে ধরে মহারানী তাঁর সিংহাসনে নিয়ে গিয়ে পাশে বসালেন। দু’হাত বাড়িয়ে বুকে চেপে ধরে আদর সোহাগ করলেন অনেকক্ষণ।

    এমন সময় বৃদ্ধ ইবলিস আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে আমিই বাদ পড়ে গেলাম শুধু। এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো একত্রিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে—

    সঙ্গে সঙ্গে হাসির তুফান উঠলো। সে হাসিতে তুফাও যোগ না দিয়ে পারলো না।

    মহারানী কামারিয়াহ বললেন, আমি তোমাকে কি যে ভালোবাসি বোন, কি করে বোঝাবো তোমাকে! তোমাকে কাছে পাবো বলে আমার আকুতির অন্ত নাই।

    তুফা বললো, আপনাকে দেখে আমি মোহিত হয়ে গেছি মহারানী। আপনার এই আদর সোহাগ আমার চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে।

    এই বলে তুফা কামারিয়াহর সামনে গড় হয়ে নমস্কার জানালো। মহারানী দু’হাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নিলেন তুফাকে।আদর চুম্বন করে বাকী তিন নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এরা আমার বোন, সম্রাটের অন্য তিন পত্নী। তুফা ওদেরও অভিবাদন জানালো।

    পরিচারিকারা নানারকম খানাপিনার থালা সাজিয়ে দিলো সামনে। মহারানী বললেন, নাও খেয়ে নাও ভাই।

    সিংহাসনের দুই পাশে দুটি দৈত্যের মতো বিরাট এবং কুৎসিত কদাকার দুই জিন দানব দণ্ডায়মান ছিলো। ওদের দেখে তুফার অন্তরাত্মা শুকিয়ে উঠছিলো। খিদে তেষ্টা সব উঠে গিয়েছিলো ওর। তুফা সাহস করে মহারানী কামারিয়াহর কানে কানে ফিসফিস করে বললো, আচ্ছা মহারানী, ওরা অত ভয়ঙ্কর কুৎসিত কেন?

    মহারানী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, ভয় নাই, ভাই, ওদের একজনের নাম অল শিসবান, আর একজন স্বনামে ধন্য মাইমুন, আমার দেহরক্ষী। ওরা দেখতে অসুন্দর হলেও ভয়ের কিছু নাই। তোমার কোনও অসম্মান যাতে না ঘটে, তাই ওরা সতত প্রস্তুত।

    —আমি যে ওদের দিকে চাইতে পারছি না, মহারানী! ঐ মাইমুন যেন আরও বেশি ভয়ঙ্কর। আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে।

    তুফার কথায় আবার হো হো করে হেসে উঠলেন কামারিয়াহ। হাসির কারণ বুঝতে না পেরে শিসবান জিজ্ঞেস করলো, কি হলো, অমন হাসছেন কেন, মহারানী? এমন কি মজার ব্যাপার ঘটলো?

    জিনেদের দুর্বোধ্য ভাষায় মহারানী ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলো ওদের। তা শুনে রুষ্ট হওয়ার বদলে দু’জনেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে আর কি?

    তুফার মনে আর সংশয় রইলো না। ভয়-টয় উবে গেলো তৎক্ষণাৎ। হাসি গল্প কথার মধ্য দিয়ে আহারাদি শেষ করলো সে।

    এরপর ইবলিস মদের একটা পাত্র এনে হাজির করলো তুফার সামনে। বললো, অবশ্য এই ঝারির মদের আর তেমন প্রয়োজন নাই, তোমার রূপের মদিরাতেই আমরা সবাই মাতাল হয়ে উঠেছি এরই মধ্যে।

    আবার হাসির গমকে ফেটে পড়লো মহারানীর মহল।

    বৃদ্ধ বললো, তোমার সুললিত কণ্ঠের সঙ্গীত একমাত্র আমিই শুনেছি! সে যে কি বস্তু তা ব্যক্ত করে বোঝাবার ভাষা আমার নাই। তাই মালকিন, আমার অনুরোধ সেই অলৌকিক সঙ্গীত একবার এখানে শুনিয়ে দাও মহারানীদের।

    তুফা গান ধরলো, আর তার তালে তালে নাচতে থাকলো বৃদ্ধ ইবলিস। গানের গমকে চনমন করে ওঠে সকলে। মহারানী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, আজকের আনন্দের তুলনা নাই। একি শোনালে ভাই? এ কণ্ঠ তুমি কোথায় পেয়েছ? তোমার গান শুনে আমার দেহের রক্তও তার পথে চলতে ভুলে গেছে। হাত দিয়ে দেখ আমার বুকের কলিজাও তার কাজ বন্ধ রেখে তোমার গান শোনার জন্য উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে। আহা। কি মধুর গানই শোনালে, মন প্রাণ জুড়িয়ে গেলো! আর একখানা শোনাবে ভাই?

    তুফা বললো, সে আর বেশি কি কথা। আমার গান আপনার ভালো লেগেছে তাতেই আমি ধন্য। আপনার যতক্ষণ ভালো লাগে শুনুন, আমি গাইছি।

    গানে গানে উদ্দাম হয়ে উঠলো জিন হুরী। স্থান কাল পাত্র ভুলে ছোট বড় সকলে থৈ থৈ করে নাচতে লাগলো।

    এইভাবে একটানা গানের মাইফেল চললো অনেকক্ষণ। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে এক সময় থামলো তুফা। মহারাণী কামারিয়াহ ওকে জড়িয়ে ধরে অন্তরের সোহাগ জানালেন।

    —আমার মুখে ভাষা নাই বোন, যে তোমার গানের উপযুক্ত প্রশংসা করতে পারি। তুমি আমাদের যে আনন্দ দিলে তার কোনও তুলনা হয় না। শুধু শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে খাটো করতে চাই না।

    তুফা আহ্বাদে ফেটে পড়ে, আপনারা খুশি হয়েছেন এই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আজ আমি এখানে পৌঁছনোর পর ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। না হলে এতক্ষণে আরও অনেক রকমের গান শোনাতে পারতাম আপনাদের। আবার যদি কখনও সুযোগ হয় আমি আসবো আপনার কাছে। তখন দেখবেন কত গান শোনাই। কিন্তু আজ আর নয়, রাত শেষ হয়ে আসছে, এবার ইবলিস দাদু আপনি আমাকে মেহেরবানী করে আমার প্রাসাদে রেখে আসুন। আমার মালিক ধর্মাবতার খলিফা যদি আমাকে ঘরে না দেখেন তবে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে কন্যার শাদী এবং পুত্রের ছুন্নত দেখে যেতাম কিন্তু আজ আর এখানে অবস্থান করার শক্তি এবং সাহস আমার নাই।

    বৃদ্ধ ইবলিস বললো, এখনি চলে যাবে শুনে ব্যথায় বুক ফেটে যেতে চাইছে। কিন্তু কীই বা উপায়, তোমাকে তো ফিরতে হবে সেখানে। যাই হোক, আরও একটু সময় কাটিয়ে যাও, এই আমাদের ইচ্ছা তুফা। কী, পারবে না? সবে আমরা মদের পাত্র অধরে রেখেছি। এমন সময় তুমি পেয়ালা নামিয়ে রেখে মৌতাত ভেঙ্গে দিতে বলছো ভাই? আর একটু সময় কি তুমি যাওয়াটা পিছিয়ে দিতে পার না তুফা? ‘

    তুফা বললো, আর আমাকে ধরে রাখবেন না দাদু। আমার হাত পা বাঁধা, আপনি অবশ্যই জানেন। এখুনি আমাকে খলিফার হারেমে ফিরে যেতে হবে। আমি মাটির সন্তান, মাটিতেই আমার সুখ শান্তি। এই জিন হুরী যতই সুন্দর হোক, এ জায়গা মানুষের জন্য নয়। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি আর আমাকে এখানে ধরে রাখবেন না। অবশ্য আপনারাও নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে আটকে রাখতে চান না।

    -তোমার কথা শিরোধার্য সুন্দরী, ইবলিস বললো, তবে যাবার আগে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আমি জানি তোমার ওস্তাদ স্বনামধন্য ইশাক ইবন ইবরাহিম। তিনি আমাকে বেশ ভালো করেই জানেন। এক শীতের সন্ধ্যায় একটা ব্যাপার কি ঘটেছিলো। সময়মতো তোমাকে সব বলবো। আজ শুধু এইটুকু জেনে যাও, তোমার গুরুইশাক আজ জগৎ বিখ্যাত হতে পেরেছে আমারই কল্যাণে। আর তুমি? তুমিই বা এই কোকিল কণ্ঠ পেলে কী করে? সেও আমারই দেওয়া! ইশাকের ওপর আমি যতটা প্রসন্ন, তোমার ওপর তার চাইতে অনেক বেশি। তুমি যখন গান গাইতে শুরু কর আমি তোমার কণ্ঠে ভর করি। তাই তোমার গান শুনে সবাই পাগল হয়ে ওঠে। এরপর আমি, তোমাকে যে সুর দেব তা শুনে সারা দুনিয়া অবাক হয়ে যাবে। খলিফা তোমাকে মাথার মণি করে রাখবেন চিরকাল। সুতরাং ভেবে দেখ, কী করবে, তুফা?

    ইবলিস তুফার তানপুরাটা তুলে নিয়ে গান ধরলে তুফা চমকে উঠলো, এমন নতুন সুর তো কখনও সে শোনেনি কোথাও?মুহূর্তের মধ্যে সে বুঝতে পারলো, এতদিন ওস্তাদইশাক তাকে যা শিখিয়েছে তা এর কাছে নেহাতই ভুলে ভরা।

    ইবলিসের হাত থেকে তানপুরাটা নিয়ে সে ঐ গানটা হুবহু গেয়ে দিলো। মহারাণী এবং তার সঙ্গীনিরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন। চমৎকার—চমৎকার তুফা, জবাব নাই! তুমি একেবারে উচ্চমার্গে পৌঁছে গেছ, আমি তোমাকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধিতে বরণ করলাম। আজ থেকে তুমি সঙ্গীত-সম্রাজ্ঞী হলে।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো ছত্রিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    একখানা সুদৃশ্য মোরগের চামড়ার ওপর ইবলিস নিজ হাতে মানপত্র রচনা করে তুফার হাতে তুলে দিয়ে বললো, এ সম্মান পৃথিবীর কোনও মানুষ আজ পর্যন্ত লাভ করতে পারেনি তুফা, তুমিই শুধু পারলে?

    এর পর তুড়ি বাজাতেই বারটি সুন্দরী মেয়ে প্রত্যেকে একটা করে সোনার বাক্স মাথায় করে প্রবেশ করলো সেখানে। বাক্সগুলি মহামূল্যবান রত্ন অলঙ্কারে ভরা ছিলো। ইবলিস খুলে খুলে দেখালো বাক্সগুলো, এই সবই তোমার। মহারানী তোমাকে উপহার দিলেন।

    মহারানী কামারিয়াহ সিংহাসন ছেড়ে নেমে এসে তুফাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন, আমি জানি কোনও কিছু দিয়েও তোমাকে ধরে রাখতে পারবো না এখানে। তবে এই বড় বোনকে মনে রেখ। আবার তুমি সময় মতো এসো আমাদের মাঝখানে, দুদণ্ডের আনন্দ ভালোবাসায় আবার আমার মহল মুখর করে তুলল, এই আমার অনুরোধ, বোন! প্রতি রাতেই আমি তোমাকে দেখতে যাই তোমার প্রাসাদে। আজও ইবলিসের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারনি। কারণ আমি অশরীরি হয়েছিলাম তখন। তাই তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। এরপর আমি সশরীরে একটি ছোট মেয়ের রূপ ধরে তোমার ঘরে গিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে জাগাবো তুফা। তুমি রাগ করবে না তো?

    তুফা বলে, কি যে বলেন, না না, আমি খুব খুশি হবো মহারানী, আপনি যাবেন আমার ঘরে! আপনার হাতের স্পর্শে যদি আমার ঘুম ভাঙ্গে তার চেয়ে আর আনন্দের কি হতে পারে, মহারানী?

    শেষ বারের মতো কামারিয়াহ তুফার কপোল চুম্বন এঁকে দিয়ে বিদায় জানান।

    ইবলিস হামাগুড়ি দিয়ে বসে তুফাকে পিঠে বসিয়ে আবার উড়ে চলে আকাশ পথে। চলার গতি বিদ্যুতের প্রায়। এবার কিন্তু তুফার ভয় করে না, অজ্ঞান হয়ে পড়ে না।

    উড়তে উড়তে প্রাসাদে এসে অতি সন্তর্পণে তুফাকে তার পালঙ্ক-শয্যায় নামিয়ে দেয় ইবলিস। তারপর কুর্নিশ জানিয়ে নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে যায়।

    তুফার চোখে ঘুম আসে না। তানপুরাটা তুলে নিয়ে সে গান ধরে।

    গানের আওয়াজে অবাক হয়ে উঁকি দেয় খোজা প্রহরী সাবাব। একি ভুতুড়ে কাণ্ড রে বাবা। যে মেয়েকে সারা প্রাসাদ তোলপাড় করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, হঠাৎ আবার সে তার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো কী করে? চারদিকে সতর্ক পাহারা ফাঁকি দিয়ে একটা পতঙ্গেরও তো ঢোকার উপায় নাই এই হারেমে। সেক্ষেত্রে তুফা বাঁদী কি করেই বা রাতারাতি অদৃশ্য হতে পেরেছিলো, আবার কি করেই বা সে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে আবার নিজের ঘরে প্রবেশ করতে পারলো?

    কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে সে খলিফার খাস দেহরক্ষী মাসরুরের কাছে ছুটে গেলো।

    সব শুনে মাসরুর বললো, কী, আজ বুঝি মাত্রাটা বেশি হয়ে গেছে? খলিফা শুনলে তোর গর্দান নেবে।

    সাবাব বললো, কিন্তু নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করতে পারছি না মাসরুরজী। বিশ্বাস না হয়, আপনি চলুন, স্বচক্ষে দেখবেন তাকে।

    অবশেষে সাবাবের কথার অসারতা প্রমাণ করার জন্যেই মাসরুর এলো তুফার কামরার সামনে।

    তাজ্জব ব্যাপার! এ কি করে সম্ভব? ছুটে গেলো সে খলিফার কক্ষে। সুলতান হারুন অল রসিদ তখন ঘুমে বিভোর। সে সময় তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ করা মহা অপরাধ। কিন্তু হতবুদ্ধি মাসরুর তখন সে সব নিয়ম-কানুন বেমালুম ভুলে গিয়ে খলিফাকে ডেকে তুললো।

    স্বভাবতই সুলতান ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। ওরে পাষণ্ড, তোর এতো সাহস, আমার ঘুম ভাঙ্গালি? কী, কী ব্যাপার, কোন্ সরকারী কার্য রসাতলে যেতে বসেছে যে, এই রাত দুপুরে তুই আমার ঘুম ভাঙ্গাতে সাহস করলি? জানিস এর সাজা কী?

    মাসরুর বলে, জানি ধর্মাবতার, মৃত্যু। কিন্তু এদিকে যা দেখে এলাম, এই মুহূর্তে আপনাকে তা না জানাতে পারলে তাতেও আমাকে মৃত্যুদণ্ডই নিতে হতো। সেই কারণে জানের মায়া ত্যাগ করে এখুনি আপনাকে জানাতে বাধ্য হয়েছি।

    -কী এমন আজব খবর?

    —জী, মহামান্য মালকিন তুফা ফিরে এসেছেন।

    সুলতান হো হো করে হেসে উঠলেন, ব্যাটা নচ্ছার, কুত্তাকা বাচ্চা, চরস টেনেছিস্? এই অপরাধে তোকে শুলে চড়াবো কাল।

    —তা আপনার যা অভিরুচি করবেন, জাঁহাপনা। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখে এলাম তিনি তাঁর পালঙ্কে বসে গান ধরেছেন।

    সুলতান বললেন, দ্যাখ মাসরুর, এই দুপুর রাতে আমাকে তুই আবার তুফার ঘরে দৌড় করাবি? কিন্তু মনে থাকে যেন, তোর কথা যদি মিথ্যে হয় তবে নির্ঘাৎ ফাঁসী দেব তোকে। আর যদি সত্যি সত্যিই তুফাকে আমি দেখতে পাই তবে দু’লক্ষ দিনার ইনাম পাবি তুই। আর সেই সঙ্গে আজই তোকে আমার গোলামী থেকে খালাস করে দেব।

    মাসরুরকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান তুফার মহলে চলে এলেন। সত্যিই অবাক কাণ্ড, অপূর্ব সুললিত কণ্ঠের সঙ্গীত ভেসে আসছে তুফার কক্ষ থেকে। এবং এ কণ্ঠ তো তার বহুং চেনা-তুফা ছাড়া এমন মধুর করে কেই বা এ গান গাইতে পারে?

    সুলতানকে দরজার সামনে দেখামাত্র গান থামিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তুফা। ভূত দেখার আতঙ্কে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে তুফার বাহুপাশ মুক্ত করে নেন, কে তুমি?

    -সে কি জাঁহাপনা, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি আপনার সোহাগের তুফা।

    —কিন্তু তুমি তো জিনের কবলে পড়েছিলে? একবার যার ওপর জিনের নজর পড়ে, সে তো আর ফিরে আসতে পারে না! এলে কী করে?

    তখন তুফা আদ্যোপান্ত পুরো ঘটনাটা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। বললো, এই দেখুন ধর্মাবতার এই সেই মানপত্র। স্বয়ং ইবলিস দিয়েছেন আমাকে। আর এই দেখুন বারটি.সোনার তৈরি রত্নালঙ্কারের বাক্স। সবগুলো বাক্সই মহামূল্য মণি-রত্নে ভরা আছে।

    এই বলে সে কেশের ভিতর থেকে সেই মানপত্রখানা বের করে দিলো সুলতানের হাতে। এবং বাক্সগুলোর ডালা খুলে বিপুল ঐশ্বর্য আভরণ দেখাতে থাকলো।

    এরপর সুলতান হারুন অল রসিদ সব বিশ্বাস করলেন তুফার কথা। এবার তিনি নিজেই এগিয়ে গিয়ে তুফাকে টেনে নিলেন বুকের মধ্যে।

    সুলতান হারুন অল রসিদের আনন্দের আর অবধি রইলো না। সারা শহর প্রাসাদ আলোকমালায় সজ্জিত করতে বললেন তিনি।

    উৎসবের ধূম পড়ে গেলো। ধন-ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো গরীবদের জন্য। একমাস ধরে চললো দরিদ্র-সেবা।

    কাহিনী শেষ করে শাহরাজাদ থামলো। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেছেন সুলতান শারিয়ার। ভাবলেন, উজির-কন্যা শাহরাজাদকে আর হত্যা করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে তার জীবনে আল্লাহর আশীর্বাদের মতো এসে উপস্থিত হয়েছে। তার মত অসাধারণ গুণবতী মেয়েকে হত্যা করা সঙ্গত হবে না। ওকে বাঁচিয়ে রাখলে ওর কাছ থেকে হয়তো আরও অনেক চমৎকার গল্প কাহিনী শুনতে পাওয়া যাবে।

    শাহরাজাদকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন সুলতান শারিয়ার। চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন, তুমি আল্লাহর বরপুত্রী, তোমার কিসসা আমার সুব দুঃখ বেদনা ভুলিয়ে দিতে পেরেছে, শাহরাজাদ। আর যদি কিছু কাহিনী শোনাতে চাও, শুরু করে দাও। তোমার কি শোনার জন্য আমি অধীর হয়ে বসে আছি।

    শাহরাজাদ বলে, আমি আপনার বাঁদী জাঁহাপনা, আপনার চিত্ত-বিনোদন করাই আমার একমাত্র ব্রত। আপনি যদি শুনতে ইচ্ছা করেন, অফুরন্ত কাহিনী শোনাতে পারি আপনাকে। কিন্তু সে সব গল্প আপনাকে খুশি করতে পারবে কিনা জানি না।

    সুলতান শারিয়ার বললেন, যে সব কাহিনী তুমি আমাকে শুনিয়েছ, তাতে প্রত্যয় হয়েছে, তুমি এরপর যা শোনাবে তা আমার ভালো লাগবে, বলো। আমার বেগমের বিশ্বাসঘাতকতার পর নারীজাতি সম্পর্কে আমার একটা তীব্র ঘৃণা জন্মেছিলো। কিন্তু তোমার সান্নিধ্যে আসার পর থেকে ধীরে ধীরে সে ভাব আমার গেছে। এখন বুঝতে পারছি সব নারীই একই প্রকৃতির নয়।

    শাহরাজাদ বললো, এবার জাঁহাপনাকে অল-মালিক অল-জাহির রুক অল-দিন বাইবারস অল বুন্দুকদারি এবং তার সিপাইসর্দারের কিসসা শোনাবো আমি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.