Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ১.১৫ তৃতীয় কালান্দর ফকিরের কাহিনী

    তৃতীয় কালান্দর ফকিরের কাহিনী 

    এবার তৃতীয় কালান্দার এগিয়ে এসে তার কাহিনী বলতে শুরু করে :

    শুনুন মালকিন, মনে করবেন না, আমার কাহিনী ওদের দু’জনের চেয়ে আরও চমৎকার। তা নাও হতে পারে। তবে সত্যি ঘটনা-এটুকু বলতে পারি। কারণ এর সবই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

    ওদের দুজনের মতো আমারও বহু বিড়ম্বিত ভাগ্য। তবে ওদের দু’জনের মতো অতোটা না। আমার এই বঁ। চোখটা হারিয়েছি। একমাত্র আমার নিজের দোষে। এর জন্য অন্য কাউকে দোষ দিতে পারি না।

    আমি এক বাদশাহ। আমার বাবাও ছিলেন বাদশাহ। আমার বাবা কাসিব যখন মারা গেলেন। আমি তখন সিংহাসনে বসি। আমার ন্যায়বিচারে প্রজারা খুব খুশি ছিলো আমার ওপর। ছোটবেলা থেকেই সমুদ্র যাত্রা আমার বড় প্রিয়। তার একটা কারণ বোধহয় আমার সলতানিয়তের প্রধান শহরটা ছিলো সমুদ্রোপকূলবর্তী। বহুদূরব্যাপী সমুদ্রের মধ্যেকার দ্বীপগুলো ছিলো আমার দখলে। দশখানা রণতরী সাজিয়ে মাসাধিককাল ধরে যাত্রা করতাম আমি। আমার অধিকৃত দ্বীপগুলো পরিদর্শনে যেতম। এই রকম একবার যাত্রাপথে দারুণ ঝড়ঝঞ্জার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো আমাকে-সারাদিন সারারাত্রিব্যাপী। রাত্রি অবসান হলো। ঝড়ও থামালো। আবার হাসি ঝলমল দিন উপছে পড়লো। কিন্তু আমি দেখলাম, একটি ছোট্ট দ্বীপের চড়ায় এসে আটকে গেছে আমার জাহাজগুলো।

    সমুদ্র তখন শান্ত অবোধ শিশুর মতোন। তার ঘন নীল জলে কাব্যের গন্ধ। কে বলবে গত রাত্রে সংহার মূর্তি ধারণ করেছিলো সে।

    দিন দুই সেই দ্বীপে একটু জিরিয়ে নিলাম। তারপর পাল তুলে পাডি দিতে থাকলাম আবার। কুড়িদিন কেটে গেলো। তবু হারানো পথের নিশানা খুঁজে পেলাম না। তখন আমরা ভাসছি। এক অজানা সমুদ্রে। দিশাহারা পাখীর মতো। নীড়ের সন্ধান চাই।

    কাপ্তেনকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কত দূর? কোথায় এলাম আমরা?

    উত্তর পেলাম, জানি না, বলতে পারবো না।

    এ সমুদ্র পথ তার অচেনা। কখনও সে কোনও দিন আসেনি এই পথে। উপােয়ন্তর না দেখে একজন ডুবুরিকে নামিয়ে দিলাম জলে। কিছুক্ষণ বাদে সে ফিরে এলো। বললো, সমুদ্রের ওধারে বড় বড় মাছ দেখলাম অনেক। আরও দূরে দেখতে পেলাম একটা পাহাড়। তার খানিকটা অংশ সাদা আর খানিকটা কালো।

    ডুবুরীর কথায় ডুকরে। কেঁদে উঠলো কাপ্তেন—আর রক্ষা নাই। মৃত্যু অবধারিত। ডুবুরি যা দেখে এসেছে ওটা একটা মরণ-ফাঁদ-চুম্বক পাহাড়। পাহাড়টার গায়ে গাঁথা আছে হাজার হাজার চুম্বক লোহার বর্শা। আমাদের জাহাজ যতই তার কাছে যেতে থাকবে সেই চুম্বকের প্রচণ্ড আকর্ষণ হিড় হিডি করে টেনে নেবে। আর পাহাড়ের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে জাহাজগুলো। মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে এসেছে আমাদের। এখন আল্লাহর নাম জপ করা ছাড়া আর কোন পথ নাই, জাঁহাপনা। আগামীকালই আমরা পাহাড়ের দুর্বর আকর্ষণে প্রাণ হারাবো। সবাইকেই মরতে হবে। কেউ বাঁচতে পারবে না। এ পর্যন্ত যত নাবিক পথ হারিয়ে এই পাহাড়ের আকর্ষণ-আওতায় গিয়ে পড়েছিলো তারা কেউই ফেরেনি। আমাদেরও আর ফেরা হবে না।

    কাপ্তেনের দুগাল বেয়ে বয়ে চলেছে জলের ধারা। অসহায় শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। কঁদিতে কঁদিতেই আবার বলে, ঐ পাহাড়ের চূড়ায় একটা গম্বুজ আছে। দশটা পিতলের খুঁটির উপরে সেই গম্বুজ। আর গম্বুজের উপরে রয়েছে এক ঘোড়-সওয়ার। ব্রোঞ্চের তৈরি। এক হাতে ঢাল অন্য-হাতে তারোয়াল। দেহে বৰ্ম, মাথায় শিরস্ত্ৰাণ-রণসাজে সজ্জিত এক যোদ্ধা। সীসার ফলকে উৎকীর্ণ করা এক দৈববাণী-আঁটা আছে তার বুকে। শুনুন শাহজাদা, লোকে বলে, ঐ পাহাড়ের চুড়ায় যতদিন ঐ ঘোড়সওয়ার ঐ ভাবে অবস্থান করবে ততদিন কোন জাহাজের নিস্তার নাই। তার আকর্ষণ-আওতার মধ্যে পড়লেই প্রচণ্ড বেগে টেনে নিয়ে খান খান করে দেবে। এইভাবে কত যে জাহাজ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, কত শত সহস্ব নাবিক প্ৰাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্ত নাই। ঐ ঘোড়সওয়ারকে ওখান থেকে ফেলে দিতে না পারলে এমনি ধ্বংসের তাণ্ডব চলতেই থাকবে।

    মৃত্যুর আশঙ্কায় কাপ্তেনের দেহে কঁপুনি ধরে যায়। আমরাও সকলে ভয়ে আঁতকে হিম হয়ে যাই। মোউৎ অনিবার্য। তার কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। হায় আল্লাহ, কী এমন পাপ করেছিলাম, যার জন্যে বিদেশ-বিভুঁই-এ এইভাবে বেঘোরে জানি কবুল করতে হচ্ছে।

    পরদিন প্রত্যুষে কাপ্তেন জানালো, সেই কোষ্ঠী-কালো চুম্বক-পাহাড়ের কাছে এসে পড়েছি আমরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জাহাজগুলো ভেঙে গুডিয়ে যাবে। আল্লাহর নাম নাও সবাই!

    প্রচণ্ড শব্দে জাহাজগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। উত্তাল ঢেউ-এর প্রলয় নাচনের মধ্যে পড়ে কে যে কোথায় হারিয়ে গেলাম কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। কে মরলো, আর কে বেঁচে থেকেও মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে লাগলো তার কোনও হদিশই করতে পারলাম না।

    সারাটা দিন অশান্ত ঢেউ-এর মুখে মুখে ওঠা-নমা করতে করতে নাম-না-জানা ঠিকানার উদ্দেশে ভেসে চলেছি-যারা বেঁচে আছি তখনও। সে কি দুর্যোগ, সে কি নিদারুণ ঝড়ঝঞঝা! এলোপাথাড়ী হাওয়ার দাপটে উত্তালতরঙ্গমালা ভেঙেচুরে প্রচণ্ড জলোচ্ছাস-এ পরিণত হতে লাগলো। আর কিছু মনে নাই। অজ্ঞান হয়ে গেছি।

    রাখে কৃষ্ণ মারে কে? আল্লাই বঁচালেন সে যাত্রা। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি, সেই পাহাড়টার নিচে এক বালির চুড়ায় আটকে আছি আমি। জলোচ্ছাসের প্রচণ্ড আঘাতে মরিনি, হাঙর কুমীরেও খায়নি, আশ্চর্য! সবই আল্লাহর দোয়ায়।

    উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম, সামনেই একটা পথ, সোজা উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। খোদা ভরসা করে উপরে উঠতে লাগলাম।

    এই সময় রাত্রি ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    পরদিন পঞ্চদশ রাত্রি। শাহরাজাদ গল্প শুরু করে :

    তৃতীয় কালান্দার তার জীবন কাহিনী বলে চলেছে। আর শুনছে। সেই তিন বোন, কুলি

    আর সেই সাতজন সশস্ত্র নিগ্রো-প্রহরী।

    আল্লাহর কি অপার মহিমা, আমি যখন সেই খাড়াই পথ বেয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে চলেছি তখন হঠাৎ হাওয়ার দিক পরিবর্তন হয়ে গেলো। এবং এই হাওয়ার আনুকূল্যে তরতর করে উঠে যেতে পারলাম ওপরে। বিপরীতমুখী হাওয়ার বেগ অগ্রাহ্য করে। এ-পথ বেয়ে এক পাও এগুনো সম্ভব নয় কোন মানুষের।

    যাই হোক, উপরওয়ালার কৃপায় উপরে উঠে এসে সেই গম্বুজের নিচে এসে দাঁড়ালাম। আনন্দে আমার শরীর তখন কাঁপছে।

    সারা দিনের শ্রান্তিতে অবশ্য অবসন্ন হয়ে এলো শরীর। গম্বুজের নিচে-যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানেই—শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলাম, এক দূরাগত কণ্ঠের বাণী-শোনো কাসিবের পুত্র, ঘুম থেকে জেগে উঠে তোমার পায়ের ঠিক তলায় গর্ত খুঁড়ে দেখো, একখানা তীর আর ধনুক পাবে। এই তীরন্ধনুকটা দৈবশক্তিসম্পন্ন। তারপর ঐ ধনুকে তীরটা জুড়ে গম্বুজের মাথার ওপরে ঐ ঘোড়সওয়ারকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দাও। তাহলে ব্রোঞ্জের ঘোড়সওয়ারটা সমুদ্রে পড়ে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। দুনিয়ার মানুষ পরম উপকৃত হবে চিরকালের মতো। সঙ্গে সঙ্গে তোমার হাত থেকেও খসে পড়ে যাবে ধনুকটা। যে গর্ত খুঁড়ে তুলেছিলে সেই গর্তেই ধনুকটা রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিও। এর পর সামনে তাকালে দেখতে পাবে, সমুদ্রের জল ফুলে উঠছে। ফুলতে ফুলতে এক সময় দেখবে, তোমার পায়ের তলার পাহাড়ের চুড়া-সমান হয়ে গেছে। এই সময় দেখবে, একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে আসছে একটা লোক। তোমারই দিকে। কাছে এলে পরিষ্কার মনে হবে, সেই ঘোড়সওয়ার—অবিকল তার চেহারার সঙ্গে মিল আছে এই ডিঙ্গির লোকটার। আসলে কিন্তু তা ঠিক না। নৌকোটা আরও কাছে এলে দেখবে, মরার মাথার খুলিতে ভর্তি নৌকের পাটাতন। ভয় পেয়ো না। তোমাকে নিরাপদে সাগর পার করে দেবার জন্যেই সে আসবে। সেই রূপই নির্দেশ দেওয়া আছে তাকে। কিন্তু সাবধান, তার নৌকোয় উঠে। ভুলেও কখনও আল্লাহর নাম মুখে এনে না। নৌকোয় উঠলে সে একটানা দশ দিন সমুদ্র পাডি দিয়ে তোমার দেশের চেনা শান্ত নিরাপদ সমুদ্র এলাকায় পৌঁছে যাবে। সেখানে দেখবে সওদাগরের এক নৌকে। তারা তোমাকে তুলে নিয়ে তোমার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আবারও বলছি, ভুলেও কখনও তাদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে না।

    ঘুম ভেঙে গেলো। খোয়াব কেটে গেলো। উঠে দাঁড়ালাম। পায়ের তলার মাটি খুঁড়ে পেলাম সেই ধনুক আর তীর। ধনুকে তীর জুড়ে ঘোড়সওয়ারকে লক্ষ্য করে ছুড়লাম। প্রচণ্ড এক শব্দে নিচে সমুদ্রের জলে পড়ে গেলো মূর্তিটা। আর তৎক্ষণাৎ দেখলাম, সমুদ্র এক ভীষণ রূপ ধারণ করছে। টগবগ করে ফুটতে লাগলো অনন্ত জলরাশি। ফুসতে ফুসতে ফুলতে ফুলতে ক্রমশ পাহাড়ের সমান উঁচু হয়ে গেলো। দেখলাম দূরে একখানা ছোট নৌক বেয়ে নিয়ে আসছে একটি লোক। হুবহু যেমনটি দেখেছিলাম স্বপ্নে, সেই রকম সব ঘটে যেতে লাগলো। নৌকোটা কাছে আসতে লোকটাকে দেখলাম, ঠিক ঐ ঘোড়সওয়ারের মতো। কিন্তু স্বপ্নে জেনেছিলাম, দেখতে এক রকম হলেও ওরা এক না। আমার হাত থেকে ধনুকটা খসে পড়ে গেছে মাটিতে। ঐ গর্তাটায় রেখে মাটি চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়লাম। নৌকোটা ততক্ষণে আরও কাছে—একেবারে আমার সামনে এসে থেমে গেছে। দেখলাম, লোকটার এক হাতে অনেকগুলো মড়ার মাথার খুলি। আর কি আশ্চর্য, যদিও নৌকো বাইছে, লোকটা কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ না। পিতলের তৈরি এক মানুষের মূর্তি। তার বুকে আঁটা এক সীসার ফলক। তাতে উৎকীর্ণ করে লেখা আছে এক দৈববাণী।

    আমি কোন কথা না বলে নৌকোয় উঠে বসলাম। সেই পিতলের মানুষটা বেয়ে চললো নৌকোটা। এক-দুই-তিন। এইভাবে দশটা দিন কেটে গেলো। অবশেষে দেখলাম, আমাদের দেশের চেনাজােনা সমুদ্রে এসে পড়েছি। আনন্দে উল্লাসে আমি তখন আত্মহারা। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, আল্লাহ তোমার মহিমা অপাের। তোমার দোয়াতেই আমি আমার জীবন ফিরে পেয়েছি, আজ আমার নিজের দেশের মুখ দেখতে পেয়েছি। তুমি সর্বশক্তিমান একমাত্র ঈশ্বর। তোমাকে ছাড়া অন্য কোন অলৌকিক শক্তিতে আমার আস্থা নাই। তুমিই একমাত্র পথ।

    আমার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। দেখলাম, সেই পিতলের মূর্তিটা বাঁ হাত দিয়ে তুলে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে দিলো আমাকে। তারপর নৌকোটা নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো কোথায়!

    আমি খুব ভালো সাঁতারু। সমুদ্রের নীল জলে গা ভাসিয়ে দিলাম। এইভাবে সারাটা দিন কেটে গেলো। আমার হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো। ভয় হলো, এবার মৃত্যু অনিবাৰ্য। আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় মসজিদ চুড়ার মতো উচু উত্তাল ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে চললো আমাকে। সমুদ্র-কূলের দিকে। তারপর এক সময় অনুভব করলাম, আমাকে তীরে ছুঁড়ে দিয়ে ঢেউটাি আবার সমুদ্রে ফিরে গেছে। বুঝলাম এও তারই এক মহিমা।

    সমুদ্র সৈকতে উঠে এসে জামাকাপড় খুলে শুকাতে দিয়ে বালির ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে শুকনো জামাকাপড়গুলো পরে সামনে চেয়ে দেখি, এক সবুজ শস্যক্ষেত্ব। আনন্দে নেচে উঠলো মন। এপাশ ওপাশ চক্কর দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। যেদিকে তাকাই শুধু জল আর জল আর জল। সমুদ্রের মধ্যে ছোট্ট একটা দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছি আমি।

    একটা জায়গায় বসে পড়লাম। আমার অধম অদৃষ্টের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। নিজেকে এক হতভাগা বলে মনে হতে লাগলো! একটা ভুলের জন্যে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো আমাকে। ঠিক করলাম, এবার থেকে দেখে শুনে সাবধানে চলতে হবে। অদৃষ্ট যখন সাধ দিচ্ছে না। তখন, যখন-তখন বিপদ-আপদ আসতে পারে।

    এমন সময় নজরে এলো, একখানা জাহাজ এই দিকেই আসছে। না জানি, আবার কোন বিপদ হয়, এই ভেবে একটা গাছের উপর উঠে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলাম পাতায় ঢেকে। জাহাজটা এসে নোঙর করলো। জনা দশেক নফর নামলো। সবাইর হাতে একখানা করে মাটিকাটা কোদাল। ওরা ঐ শস্যক্ষেত্রের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কি যেন একটা খুঁজতে লাগলো। তারপর একটা জায়গায় মাটি কেটে গর্ত করতে থাকলো। আমি গাছের ডালে বসে দেখলাম, খানিকটা গর্ত করার পর একটা গুপ্ত দরজার সন্ধান পেলো তারা। দরজার পাল্লা খুলে ফেললো। এরপর আবার তারা ফিরে গেলো জাহাজে। নানারকম দামি দামি খাবার দাবার মাথায় নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলো! গুপ্তদরজা দিয়ে নিচে নেমে গিয়ে সামানগুলো রেখে আবার ফিরে গেলো জাহাজে। আবার নিয়ে এলো সাজপোশাক ইত্যাদি। এইভাবে নানারকম জিনিসপত্তর নামিয়ে রেখে এলো মাটির নিচের সেই ঘরে। মোট কথা, একটা খানদানি পরিবারে যা যা দরকার তার সবকিছুই ছিলো তার মধ্যে। তারপর জাহাজ থেকে নেমে এলো জরাবার্ধক্যে জীর্ণ এক থুরথুরে বৃদ্ধ—একটা ফুটফুটে কিশোরের হাত ধরে। পিছনে পিছনে নফরগুলো। তাদের হতে মণিমুক্তা-খচিত সূক্ষ্মকারুকার্যকরা বাদশাহী শাল। ওরা সবাই সেই গুপ্ত দরজা দিয়ে নিচে নেমে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে সেই ছোট্ট কিশোর বালকটি ছাড়া আর সবাই উঠে এসে জাহাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।

    জাহাজটা যখন অনেক দূরে চলে গেছে, গাছ থেকে নামলাম আমি। ঐ জায়গাটায় গিয়ে মাটিগুলো সরিয়ে গুপ্ত দরজাটা খুলে ফেললাম। পাথরের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। এক সুরম্য অট্টালিকা।একটু এগোতেই চোখে পড়লো, দামি মখমলের পর্দা দেওয়া একটা দরজা। পর্দা সরিয়ে ভিতরে পা রাখতে সাহস হলো না। ঝকঝকে তকতকে আনকোরা বহু মূল্যবান পারস্য গালিচায় প্রকাণ্ড ঘরটার পুরো মেজেটা মোড়া। সুন্দর সুন্দর সোফা কোচ, টেবিল আলমারীতে চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরটা। মাথার উপরে কারুকার্যখচিত ঝাড়বাতি। টেবিলের উপর সাজানো সুন্দর কাজ-করা এক ফলের বাঁপি আর মিঠাই মণ্ডার রেকবী। তার মাঝখানে প্রকাণ্ড এক ফুলদানী ওপাশে সোনার পালঙ্কে বসে সেই কিশোর বালক সোনার পাখায় হাওয়া খাচ্ছে। আমাকে দেখা মাত্র ভয়ে আঁৎকে উঠলে সে। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, কোন ভয় নেই, বন্ধু। আমিও মানুষ-এক বাদশাহর ছেলে। এবং নিজেও আমি বাদশাহ, আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। বরং তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করতে এসেছি। ওরা তোমাকে এই পাতালপুরীতে রুদ্ধ করে হাওয়া হয়ে গেলো। এখান থেকে কোন ভাবেই তুমি বেরিয়ে বাঁচতে পারবে না। তাই আমি তোমাকে বাঁচাতে এলাম।

    আমার কথা শুনে কিশোর একটু হাসলো! কি সুন্দর তার ঠোঁটের হাসি। যেন মুক্তো ঝরে। পড়লো। তার আয়ত চোখ, উন্নত নাসিক, প্রশস্ত ললাট দেখে মনে হয়, এক খানদানী বংশের ছেলে সে। ইশারায় তার পাশে গিয়ে বসতে ডাকলো আমাকে —শুনুন মালিক, ওরা আমাকে এখানে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। আমার মৃত্যুও তাদের আদৌ কাম্য নয়। বরং ঠিক তার উল্টো। মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই ওরা আমাকে লোকচক্ষুর অগোচর এই পাতালপুরীতে লুকিয়ে রেখে গেলো।

    তুমি হয়তো আমার বাবার নাম শুনে থাকবে। তামাম দুনিয়ার মধ্যে সব চেয়ে সেরা জহুরী আমার বাবা। তার মতো ধনী লোক বোধহয় খুব কমই আছে। দুনিয়ার এমন কোন সুলতান বাদশাহ নাই যার কাছে আমার বাবা হীরে-জহরৎ বিক্রী করেনি। তার খ্যাতি নাম জগৎজোড়া। বাবার বৃদ্ধ বয়সের সন্তান আমি।

    আমার জন্মের সময় এক সিদ্ধবাক গনৎকার বলেছিলো, এই শিশু তার পিতামাতার জীবদ্দশাতেই মারা যাবে। এর বয়স যখন পনেরো হবে সেই সময় বাদশাহ কাসিবের পুত্রের হাতে এর মৃত্যু ঘটবে।

    গণৎকার আরও বিস্তারিত বিবরণ রেখে গেছেন। এক সময় বাদশাহ কাসিবের পুত্র সমুদ্র যাত্রায় জাহাজ ডুবি হয়ে এক কষ্টি-পাথর পাহাড়ে গিয়ে উঠবে। সেই পাহাড়ের চুড়ায় এক পিতলের ঘোড়সওয়ারকে সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়ে চিরকালের মতো হাজার হাজার নাবিকের প্রাণ বাঁচাবে।

    আমার বাবা এই পনেরো বছর ধরে আমাকে খুব সাবধানে চোখে চোখে রেখে মানুষ করেছে। কয়েক দিন হল খবর ছড়িয়ে পড়েছে কাসিবের পুত্র সেই পাহাড়ে উঠে পিতলের ঘোড়সওয়ারটাকে জলে ফেলে দিয়েছে। এই খবর শোনার পর থেকে আমার মা-বাবার চোখে ঘুম নাই। এই কাঁটা দিনের মধ্যে আমার বাবার শরীর বার্ধক্যে একেবারে ভেঙে পড়েছে। দেখলে চেনা যায় না, এমন। আমার মা কেঁদে অন্ধ হয়ে গেছে। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

    গণৎকারের ভবিষ্যৎবাণী শোনার পর থেকেই বাবার চিন্তা, কি করে আমাকে কাসিবের পুত্রের হাত থেকে রক্ষা করবে। অনেক ভেবে চিন্তে শেষে এই নির্জন দ্বীপে মাটির তলায় এই প্রাসাদপুরী বানিয়ে রেখেছে সে। পনেরো বছর বয়সের সময় যাতে সে লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে এনে আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারে। কাসিবের পুত্র সেই পিতলের শীঘোড়সওয়ারকে জলে ফেলে দিয়েছে। তাই আজ আমাকে সে এখানে লুকিয়ে রেখে গেলো। গণৎকারের ভবিষ্যৎ বাণীতে বলা হয়েছিলো, ঘোড়সওয়ারকে জলে ফেলে দেবার চল্লিশ দিনের মধ্যে এই ঘটনা ঘটবে। তাই বাবা আমাকে চল্লিশ দিনের জন্য এখানে লুকিয়ে রেখে গেলো। বাবার এবং আমার নিজেরও বিশ্বাস, এই দূরধিগম্য পাতালপুরীর সন্ধান কিছুতেই পাবে না সে।

    রাগে কাঁপতে লাগলো আমার শরীর। কী মিথ্যেবাদী, ভণ্ড এই সব গণৎকারগুলো। নিরীহ মানুষের মনে এরা আতঙ্ক জাগিয়ে তোলে। ওই ব্যাটাদেরই খুন করা দরকার। এমন সুন্দর ফুলের মতো এক কিশোর-নিষ্পাপ নির্মল—তাকে কিনা আমি হত্যা করবো। গাঁজাখুরি বানানো একটা গল্পো শুনিয়ে ভয় ধরিয়ে দিয়ে গেছে। এদের মনে। এই বালকের জীবন রক্ষার জন্যে, যদি প্রয়োজন হয়, আমার জীবনও তুচ্ছ করে দিতে পারি। শয়তান গণৎকারটাকে-পেলে একবার শুনিয়ে দিতাম। সে কথা। গলা চড়িয়ে বেশ জোরেই বললাম, শোনো বাছা, উপরে আল্লাহ আছেন। তোমার মতো একটা ফুলের কুড়িকে ছিড়ে ফেলবে কেউ, তা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, সে যেই হোক, তোমাকে যে হত্যা করতে আসবে তাকে আমি হত্যা করবো আগে। আমাকে না মেরে তোমাকে ছুঁতে পারবে না কেউ। আমি তোমার পাহারায়, তোমার সঙ্গে বাস করবো। এই চল্লিশ দিন। দেখি, কে তোমাকে মারে। তারপর চল্লিশ দিন কেটে গেলে, তোমার বাবার অনুমতি নিয়ে তোমাকে সঙ্গে করে আমার দেশে যাবো আমি। তুমি হবে আমার প্রাণের বন্ধু। তোমাকেই আমি বসিয়ে যারো আমার সিংহাসনে।

    জহুরীর ছেলে খুশী হলো খুব। বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানালো আমাকে। আমার উপর তার গভীর আস্থা লক্ষ্য করে আনন্দ হলো মনে।

    অনেক গল্প কাহিনী শোনালাম তাকে। সেও শোনালো। খুশিতে ভরে গেলো আমাদের মন। নানারকম খানাপিনা করলাম। এতো খাবার দাবারে ঘর ভর্তি যে, শখানেক লোক সারা বছর ধরে খেয়েও তা ফুরাতে পারবে না।

    আমার ব্যবহারে মুগ্ধ হলো কিশোর। তাকে যে আমি গভীর ভালোবাসার চোখে দেখছি সে কথা বুঝতে বেশী দেরি হলো না তার।

    সারা রাত বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমুলো সে। আমিও। সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে দুজনে নাস্তা করলাম। তারপর নানারকম মজার মজার কিসসা শুনালাম তাকে। খেলাধুলা করলাম অনেকক্ষণ ধরে। তারপর সুগন্ধী আন্তর দেওয়া জলের চৌবাচ্চায় অবগাহন করে গোসল করলাম আমরা। দুপুরের খানাপিনা সেরে একটু বিশ্রাম করে আবার শুরু হলো আমাদের গল্প, খেলা। রাত্ৰিবেলায় পরিপটি করে বিছানা পেতে দিলাম তাকে। দুজনে একসঙ্গে বসে মাংস রুটী, মাখন, ফল, দুধ, মধু, মিঠাইমণ্ডা দিয়ে রাতের আহার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    দিনের পর দিন এইভাবে খেলাধূলা, হাসি-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে কেটে যেতে লাগলো। তার মা-বাবার আদর্শন, তার মরণভীতি, সব ভুলিয়ে দিলাম আমার বন্ধু-সুলভ ব্যবহার দিয়ে, আমার আন্তরিকতা দিয়ে। এইভাবে কি করে যে চল্লিশটা দিন কেটে গেলো আমিও টের পাইনি, সেও বুঝতে পারেনি।

    সেদিন সে ফিরে যাবে তার দেশে। তার বাবা আসবে তাকে নিয়ে যেতে। সকালে উঠেই এক হাঁডি গরম জল বসালাম। গরম জল-ঠাণ্ডা জলমিশিয়ে খুব আচ্ছা করে ঘসে মেজে স্নান করালাম তাকে নিজের হাতে। খুব ভালো করে দামি সাজপোশাকে সাজালাম। আতরের খুশবু ছড়িয়ে দিলাম। তার গায়ে।

    পালঙ্কের ওপর শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে, বাবা আসবে। সে চলে যাবে। আর আমি ভাবছি। এ ক’দিনের দোস্ত, আবার কোথায় হারিয়ে যাবে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়।

    তন্ময় হয়ে কি ভাবছে দেখে আমি কথা বললাম, কিগো সাহেব, কি খাবে বলো?

    ছেলেটা বললো, তরমুজ খাবো।

    একটা বড়সড়ো পাকা তরমুজ নিয়ে এলাম। পালঙ্কের ওপাশের দেওয়ালে টাঙানো ছিলো একখানা ছুরি। তরমুজটা কাটবো বলে ছুরিটা নামিয়ে আনার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম পালঙ্কের ওপর। কাঁটায় ঝোলানো ছুরিটা খুলে হাতে নিয়েছি। এমন সময় ঘটলো সেই কাণ্ডটা। ছেলেমানুষের খেয়াল, দুষ্টুমীতে ভরা মন। আমি যখন নাগালের খানিকটা ওপরে ঝুলানো সেই ছুরিটা হাতের মুঠোয় খুলে নেবার জন্য করসৎ করছি তখন তা দেখে হয়তো বা শিশু-সুলভ সারল্যে মজা অনুভব করেছিলো ছেলেটা। আমার উঁচু হয়ে যাওয়া পায়ের গোড়ালীতে সুড়সুডি দিলো। ঐ অবস্থায় আমার কি দশা হয় তাই দেখার মজায় পেয়ে বসেছিলো তাকে। অতর্কিতে তার কাতুকুতুর জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না আমি। চমকে উঠে পােটা সরিয়ে নিতে গিয়েই শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে হুমডি খেয়ে পড়ে গেলাম ছেলেটার ওপর। চিৎ হয়ে শুয়েছিলো সে। আমার হাতের শানিত ছোরা আমূল বিদ্ধ হয়ে গেলো তার বুকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়ে গেলো আমারই হাতের উপর।

    মালকিন, তখন আমার কি অবস্থা একবার কল্পনা করুন। আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। নিজের জামাকাপড় নিজেই ছিড়ে কুটিকুটি করতে লাগলাম। কেঁদে গড়াগডি দিচ্ছি, হাত-পা চূড়ছি, চোখের জলে বন্যা বয়ে চলেছে। হায় আল্লাহ একি হলো। একি করলাম আমি। কি এমন পাপ আমি করেছিলাম, যার জন্যে এই শোক অনুতাপে পুড়তে হলো আমাকে! না, একেই বলে নিয়তি!! একটা দিন পরে হলেও গণৎকারের ভবিষ্যৎবাণীই তো সত্যি হলো। আল্লাহ তুমি আমাকে শাস্তি দাও। আমি মাথা পেতে নেবো। এ জীবন আমি আর রাখতে চাই না। আমাকে মৃত্যু দাও। আমি মরতে চাই।

    ছেলেটার বাবা বৃদ্ধ জহুরী আসবে সন্ধ্যাবেলা। কি করে তার সামনে দাঁড়াবো আমি। কি ভাষায় সান্তুনা দেব তাকে। না-না, আমি পারবো না। পুত্রশোকের সেই নিদারুণ দৃশ্য আমি নিজের চোখে কিছুতেই দেখতে পারবো না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। গুপ্ত দরজা বন্ধ করে মাটি চাপা দিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দিলাম।

    মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, এখন কি করা যায়। কোন জায়গায় লুকিয়ে থেকে সমস্ত ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করতে হবে। তা না হলে, ঐ নফরগুলো আমাকে দেখতে পেলেই খুন করে ফেলবে।

    সেই গাছটায় উঠে গেলাম। একটা ডালে পাতার আড়াল করে বসে রইলাম। খণ্টাখানেক বাদে সেই জাহাজটা এসে ভিড়লো। নেমে এলো সেই দশজন নফর আর সেই বৃদ্ধ জহুরী। হন হন করে এগিয়ে এলো আমার গাছের নিচে। গুপ্ত দরজার জায়গাটায় চোখ পড়তে ভয়ে শিউরে উঠলো তারা। একি, গর্তের মাটি তো মনে হচ্ছে। সদ্য সরানো হয়েছিল। তবে? তবে কি বাছা আমার বেঁচে নাই। জহুরী চিৎকার করে ওঠে, তোমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে কি দেখছে? চটপট মাটি সরাও। দরজা খুলে নিচে যাও। নিয়ে এসো আমার জানের কলিজাকে।

    নফরগুলো অনায়াসেই সদ্য বুজানো মাটিগুলো সরিয়ে ফেলে নিচে নেমে গেলো। গাছের উপরে বসে সব দেখতে লাগলাম আমি। ছেলের নাম ধরে তারস্বরে ডাকতে লাগলো বৃদ্ধ। কিন্তু কে উত্তর দেবে! সে তো বেঁচে নাই। আমার হাতের ছুরি তার বুকে বিদ্ধ হয়ে গেছে। সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে সে। সে-ঘুম আর কোনদিন ভাঙ্গবে না তার।

    নফররা এসে বৃদ্ধিকে নিচে নিয়ে গেলো। সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তার যে কি অবস্থা আমি গাছের ডালে বসেই তা অনুমান করতে পারলাম। একটু পরে নফরগুলো ধরাধরি করে বৃদ্ধর অচৈতন্য দেহটা উপরে নিয়ে এসে গাছের তলায় শুইয়ে দিলো। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে জ্ঞান ফিরে এলো তার। ছোট শিশুর মতো চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। সে দৃশ্য আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো, এখনি বুঝি নিচে পড়ে যাবো। এর পর নফরগুলো নিচে নেমে গিয়ে ছুরিবিদ্ধ কিশোরকে উপরে নিয়ে এলো। পাশেই একটা জায়গায় কবর খোঁড়া হলো। কবরের তলায় তার মৃতদেহটা শুইয়ে দিয়ে মাটি চাপা দিলো তারা। তারপর পাতালপুরীর সামানপত্তর সব জাহাজে তুলে নিয়ে চলে গেলো।

    আমি গাছ থেকে নিচে নোমলাম। সেই ছোট্ট দ্বীপটার চারদিকে চক্কর দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। চারদিকে অনন্ত জলরাশি। যতদূর চোখ যায়, তীরের সন্ধান নাই। অথচ তীরের সন্ধান চাই। কেঁদে কেঁদে দিন কাটে। গাছের ফল খাই, গাছের তলায় শুই। দেশে ফেরার আশা প্ৰায় ছেড়েই দিয়েছি। এমন সময় একদিন দেখলাম সমুদ্ব শুকিয়ে যাচ্ছে ক্বমশঃ অবাক কাণ্ড!! এমনও আবার হয় নাকি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেখলাম, জল সরে গিয়ে বালির চড়া পড়ে গেছে। যত দূর চাই শুধু ধুধু করা বালি। হাঁটতে হাঁটতে দিন শেষ হয়ে এলো। দেখলাম, শক্ত মাটির আসল তীরে পৌঁছে গেছি আমি। কৃতজ্ঞতায় মাথা নত এলো তীর উদ্দেশে।

    মাঠের পথ বেয়ে হেঁটে চলেছি। এমন সময় দেখলাম, দূরে এক লাল আগুনের শিখা। মনে আশা হলো, কাছেই কোনও লোকালয় আছে। হয়তো বা কেউ ভেড়া পোড়াচ্ছে! কিন্তু কাছে আসতে ভুল ভাঙ্গলো। অবাক হয়ে দেখলাম, এক বিরাট প্রাসাদ। আর গোটা প্রাসাদটাই পিতলের তৈরি। সূর্যাস্তের লাল আভা এসে পড়েছে পিতলের উপর। তাই মনে হচ্ছে, গানগনে আগুনের এক কুণ্ড জুলছে।

    প্রাসাদের সামনে দাঁড়াতেই দশজন যুবক এসে দাঁড়ালো প্রাসাদের সিংহ দরজায়। তারা সবাই সুঠাম দেহী সুন্দর সুপুরুষ। কিন্তু সবারই বাঁচোখ কানা—ঠুলি পরা। তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো এক অশীতিপর বৃদ্ধ। জরা বার্ধক্যে গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু দেখলে বোঝা যায়, যৌবনে এক রূপবান পুরুষ ছিলো সে। আটজন সঙ্গী নিয়ে এগিয়ে এলো বৃদ্ধ। শুধু দুজন দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায়। সবাই আমাকে স্বাগত জানালো। আমিও সালাম জানালাম। তারপর আমার ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনের এক নিষ্ঠুর কাহিনী সব খুলে বললাম তাদের কাছে। সে কাহিনী আপনারা সবাই এতক্ষণ শুনলেন, তাই আর পুনরুক্তি করবো না। এখানে। আমার দুঃখের কাহিনী শুনে তারাও খুব দুঃখিত হলো। সাদরে প্রাসাদের অন্দরে নিয়ে চললো। বিরাট প্রাসাদ। মহলের পর মহল পার হয়ে চলেছি। কিন্তু শেষ আর হয় না। প্রাসাদ কক্ষগুলো আগাগোড়া সাজানো গোছানো ঝকঝকে তকতকে। শেষে প্রকাণ্ড দরবার কক্ষে এসে আমরা থামলাম। এইটিই সব চেয়ে বড় কক্ষ। এবং প্রাসাদের ঠিক মাঝখানে। কি সুন্দর করে সাজানো। দেখলে প্ৰাণ জুড়িয়ে যায়। দশখানা বিরাট বিরাট পারস্যের মূল্যবান গালিচায় মোড়া দরবার কক্ষের চারপাশ। আর মাঝখানে সুন্দর সব কাজ করা আর একখানা আরও দামি গালিচা পাতা। বৃদ্ধ গিয়ে বসলো সেই গালিচায়। আর যুবকরা গিয়ে বসলো চারপাশের সোফায়। বৃদ্ধ করজোড়ে আমাকে বললো, মালিক, মেহেরবানী করে বসুন।

    আমাকে একটা সব চেয়ে উচু আসন দেখিয়ে বসতে অনুরোধ জানালো সে। বললে, চুপ করে বসুন ওখানে। কোন কথা বলবেন না, আমরা আপনার জন্যে প্রার্থনা জানাবো তার কাছে।

    কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলো বৃদ্ধ। তারপর উঠে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক পায়চারী করলো একটু। তারপর মাংস আর মদ এলো আমাদের জন্যে। অন্য দশজন এবং আমি মোট এগারোজন। একসঙ্গে বসেখানাপিনাসারলাম। বৃদ্ধ নিজে হাতে করে আমাদের এঁটোকাটা পরিষ্কার করলো। তারপর আবার তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। কিন্তু কোন কথা বললো না।

    বেশ রুক্ষ মেজাজেই যুবকদের একজন বললো, প্রার্থনা জানাবার জন্যে আমাদের দরকারী সামানপত্তর না। এনেই বসে পড়লে কেন?

    বৃদ্ধ কোন উত্তর দিলো না। উঠে অন্য ঘরে চলে গেলো! এক এক করে দশবারে সুদৃশ্য সাটিনের ঢাকনায় ঢাকা দশটা পাত্র এবং দশটা চিরাগ বাতি নিয়ে এসে ঐ যুবকদের প্রত্যেকের পাশে রাখলো। কিন্তু আমার জন্যে কিছুই আনলো না সে। যে যার সবাই পত্রগুলো হাতে তুলে নিয়ে মুখের ঢাকনা খুলে ফেলতেই দেখলাম, উনুনের ছাঁই, চিরাগের কালি আর কাজলে ভরা সেই পত্রগুলো। ওরা সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমাদের পাপের ফল।

    ছাঁইগুলো নিজের নিজের মাথায় ছড়িয়ে দিলো, মুখে মাখলে চিরাগের কালি, আর ডান চোখে পরলো সেই কাজল।

    ভোরবেলা আবার সবাই ধুয়ে মুছে সাফ করলো সেই ছাই, কালি আর কাজল। পাট করা পোশাক পরলো। একেবারে ফিটফাট সাহেব আগের মতো।

    ওদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। ব্যাপার স্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। কৌতূহল হলো। কিন্তু কোন কথা বলার উপায় নাই। আগেই বারণ করে দিয়েছে বৃদ্ধ—কোন কথা বলবে না, চুপ করে বসে থাকবে শুধু। কিন্তু এইরকম কৌতূহল কি চেপে রাখা যায়। পর পর তিন রাত্রি কেটে গেলো। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগলো। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। ওদের কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা মালিক, এ সব কী ব্যাপার? কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি জানি, এসব কথা জানতে চাওয়া বারণ আছে। কিন্তু এমন অদ্ভুত সব কাণ্ড—না জেনেই বা থাকি কি করে? আমার ভাগ্যে যা আছে হবে। তবু আমি আজ শুনবো। বলুন, কেন আপনাদের সবারই বা চোখটা কানা? আর প্রতি রাত্রে কেনই বা আপনারা মাথায় মাখেন। ছাই, মুখে মাখেন কালি, আর চোখে পরেন কাজল?

    —এ কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? তোমার যে সর্বনাশ হবে। কেন জানতে চাইছো এসব।

    আমি তখন বেপরোয়া। বললাম, তা হোক, তবু বলুন, আমি শুনতে চাই।

    –-কিন্তু সে কথা শুনলে তোমারও বাঁ চোখটা যাবে।

    —তা যাক, তবু বলুন, আমি শুনবো। সারা জীবন ধরে একটা অদম্য কৌতূহল জীবিত রাখার চেয়ে আমার বাঁচোখটা কানা হওয়াও ভালো। কৌতূহল যদি কুরে কুরে খায় আমাকে, তবে কি হবে আমার চোখ দিয়ে। আপনারা বলুন। আমার ভাগ্যে যা ঘটে ঘটুক-আমি শুনবোই।

    তখন সেই যুবকদের একজন বললো, আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজেদের দোষে বঁচোখ হারিয়েছি। তুমিও হারাবে তোমার নিজের দোষে। এ জন্যে পরে আমাদের দায়ী করো না। তোমার বাঁচোখ কানা হবার পর কিন্তু এখানে তোমার ঠাই হবে না। কারণ, মাত্র দশজনেরই জায়গা আছে। এখানে, এগারোজিনের জায়গা হবে না।

    এমন সময়ে সেই বৃদ্ধ একটা জ্যান্ত ভেড়া নিয়ে ঢুকলো ঘরে। কোন কথা বললো না, একখানা ছুরি দিয়ে জবাই করে মারলো ভেড়াটাকে। ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে আবার চলে গেলো।

    যুবকদের একজন বললো, এই ভেড়ার চামড়ার মধ্যে তোমাকে ভরে, সেলাই করে এই প্রাসাদের ওপরে চুড়ায় রেখে আসা হবে। রুখ পাখী জানো? একটা আস্ত হাতীকে ঠোঁটে তুলে উড়ে যেতে পারে। সেই রুখ পাখী এসে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে। তার ধারণা, তুমি বুঝি বা সত্যিই একটা ভেড়া। তোমাকে ফলার বানিয়ে খাবে, এই তার ইচ্ছা। উড়তে উড়তে সে গিয়ে বসবে একটা বিরাট উচু পাহাড়ের মাথায়। মানুষের সাধ্য নাই, সেখানে ওঠে। তোমাকে সেলাই করে ভরার আগে একটু ছুরি দেবো সঙ্গে। তুমি সেই ছুরি দিয়ে সেলাই কেটে বেরিয়ে আসবে। ভয় নাই, রুখ পাখী কখনও মানুষ খায় না। তোমাকে দেখা মাত্র সে উড়ে পালিয়ে যাবে। তারপর তুমি চলতে থাকবে। চলতে চলতে একসময় দেখতে পাবে এক বিশাল প্রাসাদপুরী। এই প্রাসাদের প্রায় দশ গুণ বড় আর এর চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর সাজানো গোছানো। ঝলমলে। বলতে গেলে সারা প্রাসাদটাই সোনার পাতে মোড়া। দেয়ালে দেয়ালে হীরে চুনী পান্না বসানো। দেখে তোমার তাক লেগে যাবে। এমনটা হয়তো তুমি রূপকথার গল্পেই পড়েছে। কিন্তু নিজের চোখে দেখোনি কখনও। এখানেই তোমার বাঁচোখ কানা হবে। আমরা সবাই যেভাবে বাঁচোখ হারিয়েছি, তুমিও ঠিক সেই ভাবেই হারাবে। প্রতি দিন রাত্রে আমরা তার কাছে এইভাবে প্রার্থনা জানিয়ে একটু আত্মতুষ্টি লাভ করি মাত্র। এই হলো মোটামুটি ব্যাপার। বিস্তারিত বিবরণ শোনাবার দরকার কী? আপনা থেকেই তো সব জানতে পারবে।

    দেখলাম, তারা আমাকে ভেড়ার চামড়ার মধ্যে ভরবার তোড়জোড় করছে। আমার হাতে একটা ছুরি দিয়ে বললো, এটা তোমার সঙ্গে রাখে। সেলাই কেটে বেরুবার সময় দরকার হবে।

    ছুরিটা নিলাম। ওরা আমাকে ভেড়ার চামড়ার খোলের মধ্যে পুরে সেলাই করলো। তারপর কাঁধে তুলে নিয়ে রেখে এলো প্রাসাদের চূড়ায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখলাম ঈগলের মতো প্রকাণ্ড বড় একটা পাখী উড়ে এসে ছোঁ। মেরে আমাকে তুলে নিয়ে গেলো মহাশূন্যে। ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে গেলো আমার; যদি তার ঠোঁট থেকে খসে পড়ে যাই? যদি আমার ভার সে বইতে না পারে? কিন্তু না, আমাকে নিয়ে গিয়ে নামলো মানুষের দুর্লঙ্ঘ্য আকাশ ছোয়া এক পৰ্ব্বত শিখরে। চটপট ছুরিটা দিয়ে সেলাই কেটে লাফিয়ে বেরিয়ে আসলাম। তারপর পাখীটাকে ভয় দেখাবার জন্যে বিকট এক আওয়ার্জ তুলে চিৎকার দিলাম। নিমেষে উড়ে পালিয়ে গেলো সে। এবার ভালো করে দেখলাম, কি বিশাল তার আকার, কি ভয়ঙ্কর তার রূপ। দশটা হাতী জোড়া দিলে যা হয়, সেইরকম তার বপু। আর কুড়িটা উটপাখী পিঠে পিঠে উঠে দাঁড়ালে যতটা উচু দেখাতে পারে, ততটা সে উঁচু।

    আর তিল মাত্র না দাঁড়িয়ে চলতে লাগলাম। কৌতূহল এমনই বস্তু তার নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত সে হনন করে চলে। আমার আর ধৈর্য সয় না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকি। সেই প্রাসাদের সন্ধান চাই। দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছলাম সেই প্রাসাদের সামনে। ঐ দশজন যুবক প্রাসাদের অনেক গুণকীর্তন শুনিয়েছিলো আমাকে। তা থেকে মোটামুটি একটা ছবি একে নিয়েছিলাম মনে মনে। কিন্তু চোখের সামনে যা প্রত্যক্ষ করলাম তা কল্পনাতীত। এমন সুরম্য প্রাসাদ আমি জীবনে দেখিনি কখনও! সিংহ দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। নিরানব্বইটা বিরাট বিরাট চন্দন কাঠের দরজা পেরিয়ে প্রাসাদের মাঝখানের প্রশস্ত কক্ষে এসে দাঁড়ালাম। যে দিকে তাকাই-হীরা চুনি পান্নার মেলা। দেওয়ালের গায়ে বসানো এই সব অমূল্য রত্নগুলো ঝকমক করছে। মনে হলো, দুনিয়ার সব মণিমাণিক্যই বুঝি এখানে এনে রাখা হয়েছে।

    একটা ঘরে দেখলাম, বেহেস্তের পরীর মতো পরমাসুন্দরী চল্লিশটি যুবতী। আমার তেমন কোন ভাষা নাই—তাদের রূপের বর্ণনা দিতে পারি। এক কথায়, এমন নিখুঁত অনিন্দ্য সুন্দরী নারী সারা দুনিয়া টুড়েও একটা মিলবে না। আর কি আশ্চর্য, চল্লিশজনের প্রত্যেকেই একই রকম দেখতে। কারো সঙ্গে কারো এক ফোটা অমিল নাই। হুবহু সবাই এক ছাঁচে ঢালা পুতুলের মতো। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো তারা। মধুঝরা মিষ্টি গলায় স্বাগত জানালো। তুমি আমাদের আজ মেহমান। আমাদের কাছে মন প্রাণ খুলে দাও। আনন্দ করো। তুমি আমাদের ঘরের লোক আজ।

    একটা উঁচু মঞ্চের উপরে নিয়ে গিয়ে বসালে আমাকে। আর ওরা বসলো নিচে-দামি কার্পেটের উপর। বললো, মালিক, আমরা তোমার দাসী। যা হুকুম করবে তাই করে। ধন্য হবো আমরা। তুমি আমাদের প্রভু। মাথার মণি। তোমার আগমনে আমরা আনন্দে আত্মহারা। তুমি আমাদের ভাগ্যবিধাতা। তোমার সুখেই আমাদের সুখ। তোমার আনন্দেই আমাদের আনন্দ। তোমার ইচ্ছাতেই আমাদের ইচ্ছা। আমরা সবাই একান্তভাবে তোমারই!

    একজন তোয়ালে আর গরম জল নিয়ে এলো। আর একজন আমার পা ধুইয়ে দিলো। একজন খানিকটা সুগন্ধী আন্তর ঢেলে দিলো আমার গায়ে। আর একজন আমাকে পরিয়ে দিলো সিস্কের দামি পোশাক। সোনার তৈরি একটা বেল্ট দিয়ে এটে দিলো আমার পাতলুম। একজন এনে ধরলো এক পেয়ালা গুলাবী সরবৎ। কেউ আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো, কেউ মুচকি হেসে চোখের বান হানলো, কেউ ভ্ব নাচিয়ে ইশারা করলো। কেউ বা শায়েরী আওড়াতে লাগলো। কেউ ধরলো গান। কেউ বা ঠেলাঠেলি করে সামনে এসে দাঁড়ালো। কারো মুখে বাঃ, কী সুন্দর’। কেউ বা বলে, ‘কী মিষ্টি চেহারা রে’! তার জবাবে আর একজন বলে, ‘চেটেপুটে খেয়ে নে’। সবাই মিলে হো হো করে হেসে ওঠে। একজন গেয়ে ওঠে, তুমি যে রূপের আগুন জ্বলিয়ে দিলে মোর প্রাণে’—আর একজন হাত ধরে বলে, ‘তুমি হবে মোর প্রিয়তম, আমি হবো তব দাসী।’ একজন লাফিয়ে এসে পড়ে আমার কোলে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, নানা না, তুমি আর কারো না। রূপটা তোমার খাসা। তুমি আমার-শুধু আমার ভালোবাসা।’

    আমার চারপাশে মৌচাকের মতো ঘিরে বসলো মেয়েগুলো; কেউ আমাকে ঠেলা মেরে আদর করে। কেউ চিমটি কাটে। কেউ সুড়সুডি দেয়। চুল ধরে টানে কেউ। কেউ বা কোমর ধরে। সবাই মিলে আব্দার করে, তোমার জীবনের কাহিনী শোনাও, মালিক। আমরা এখানে বনবাসের মতো দিন কটাই। কালেভদ্রে কোন পুরুষের সঙ্গ পাই। আজ তোমাকে পেয়েছি; অনেক দিন পরে। এবার আমরা খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেবো। তুমি আমাদের ভালোবাসা দেবে, আদর করবে, সুখের সাগরে ডুবিয়ে দেবে।

    আমি আমার জীবনের কিছু কিছু ঘটনা সংক্ষেপে বললাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত।

    সূর্য গেলো অস্তাচলে। আঁধার নেমে এলো। মেয়েরা অসংখ্য মোটা মোটা মোমবাতি এনে জেলে দিলো। দিনের আলোর মতো ঝলমল করে উঠলো প্ৰাসাদ কক্ষ। চারপাশের দেয়ালের হীরা মণিমাণিক্যের ছটা এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

    ফরাসের উপর নতুন চাঁদর পাতালো। তারপর এক এক করে খানা নিয়ে এসে সাজাতে লাগলো তারা। মুরগীর মাংস, দামী সরাব। ফল। মিষ্টি। তারপর আরম্ভ হলো নাচ গান বাজনা। একদল বাজাতে থাকলো। একদল ধরলো নাচের তালের গান। আর একদল নাচতে লাগলো। মোহিনী রূপ ধরে। সে নাচে পুরুষের রক্ত নাচে। আগুন ধরে বুকে। আমি মদ আর মাংস খেতে খেতে দেখতে থাকলাম, তাদের এই অনিন্দ্যসুন্দর মনোরঞ্জন।

    আমার খানাপিনা শেষ হলো। ওরাও গানবাজনা থামালো। একজন এগিয়ে এসে বললো, রাত হলো, এবার শোবে চলো, মালিক। আমাদের এই চল্লিশজনের মধ্যে যাকে খুশি তোমার বেছে নিয়ে যাও। আজকে রাতে সে হবে তোমার প্রিয়া-তোমার সাখী। সে তোমাকে সুখ দেবে, আনন্দ দেবে—ভালোবাসায় দেবে ভরিয়ে! তোমার যাকে পছন্দ বেছে নাও। আমাদের কারো মনে কোন হিংসা বা কোন ক্ষোভ থাকবে না। আমরা চল্লিশটি বোন পালা করে চল্লিশটি রাত কাটাবো তোমার সঙ্গে।

    একথা শুনে আমার সব তালগোল পাকিয়ে গেলো। কাকে ছেড়ে কাকে নেবো? চোখ বুজে আন্দাজে খপ করে ধরলাম। একজনকে। ই সবাই হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়লো। চোখ খুলে দেখি,  আমার বাহুপাশে আবদ্ধ এক ষোড়শী। আমার হাত ধরে নিয়ে গেলে সে তার শয্যায়। সারা রাত ধরে সে দুধের সায়রে ডুবিয়ে রাখলো। চল্লিশবার পান করালো তার অমৃত। আমিও তাকে খাওয়ালাম আমার মধু-চল্লিশবার। সেও খেলো লেহন করে করে-প্ৰাণ ভরে।

    এইভাবে চল্লিশটা সুখের রাত্রি কাটালাম আমি। চল্লিশটি বোন এক এক করে চল্লিশটি রাত্রে আমার প্রিয়া আমার সাকী হয়ে দুধের সায়রে ডুবিয়ে তাদের অমৃত পান করালো আমাকে। আমিও তাদের প্রাণ ভরে খাওয়ালাম আমার মধু। প্রতিটি রাত্রিবাসের পর আমার প্রিয়া আমার সাকী নিয়ে যেতো আমাকে হামামে। ঘসে মেজে সাফ করে স্নান করাতো আমাকে। নতুন পোশাক পরাতে। অন্তর মাখাতো গায়ে।

    এমনিভাবে চল্লিশটা দিনরাত্রি কেটে গেলো। মেয়েগুলো সবাই এলো আমার শয্যা পাশে। কেঁদে আকুল হলো। মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো! তাদের সেই আকুলিবিকুলি কান্নার মধ্যে একটা কথা শুনতে পেলাম।–তুমি ছিলে আমাদের চোখের মণি, আজ তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে। এর আগে যারা এসেছিলো, তাদেরও একদিন বিদায় দিতে হয়েছে। তারা সকলেই আমাদের সুখ আনন্দ আর ভালোবাসা দিয়েছিলো। কিন্তু মালিক তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি তুলনা তার নাই। সিংহের মতো তোমার ঐ পৌরুষ আর কোন পুরুষের দেহে দেখিনি আমরা। আমাদের জীবনে যত পুরুষ এসেছে।–তুমিই সবার সেরা। তোমার দুরন্ত যৌবনের অসভ্য দুষ্টুমি পাগল করে দিয়েছে-মাতাল করে দিয়েছে আমাদের। আবার তোমারশান্ত সৌম্য ব্যবহারেও মুগ্ধ হয়ে গেছি আমরা। তবুও আজ তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। আমরা চল্লিশ বোন, জনমানব বর্জিত এই প্রাসাদপুরীতে সারাটা বছর নিঃসঙ্গ যৌবন যন্ত্রণায় দিন কটাই। খোদা মেহেরবান, বৎসরান্তে মাত্র চল্লিশ দিনের জন্য তিনি একজন পুরুষ পাঠিয়ে দেন। এখানে। সারা বছরে আমরা প্রত্যেকে একটিমাত্র রাতে পৌরুষের স্পর্শ পাই।

    আমি জিজ্ঞেস করি, কিন্তু আমাকে ছাড়বেই বা কেন তোমরা? কেন বিদায় দেবে আমাকে?

    একজন জবাব দেয়।—আমরা একই বাবার চল্লিশ বোন। কিন্তু আমাদের সকলের মা আলাদা। আমাদের বাবা এখানকার শাহেনশাহ। সারা বছর ধরে আমরা এই প্রাসাদে বাস করি। তারপর বছরের চল্লিশ দিন বাকী থাকতে আল্লাহ একজন পুরুষ পাঠিয়ে দেন আমাদের যৌবন রক্ষার জন্য। এই চল্লিশ দিন পরে বছরের শেষে আমরা বাবা-মাকে দেখতে চলে যাই। আজ দিন-বছরের প্রথম দিন। আজ আমাদের চলে যেতে হবে তোমাকে ছেড়ে। কিন্তু প্ৰিয়তম মন চায় না। তোমার গভীর প্রেমে মাজে গেছি আমরা ফি বছর একজন পুরুষ আসে। কিন্তু তোমার মতো এমন রূপ এমন উন্মত্ত যৌবন কারো দেখিনি। তাই তোমাকে ভালো লেগেছে খুব। তোমাকে ছেড়ে যেতে যে কি কষ্ট তা বোঝাবো কি করে? কিন্তু কী উপায় বলো, যেতেই যে হবে!

    —কিন্তু সোনারা, আমি তো তোমাদের ছেড়ে এখান থেকে যাবো না কোথাও। বেশ তো, তোমরা যাও, তোমাদের মা বাবাকে দেখে এসো। আমি এখানে অপেক্ষা করবো।

    মেয়েগুলো নেচে উঠলো।–সত্যি? সত্যি থাকবে তুমি? তা হলে এই নাও, চাবির গোছা। প্রত্যেকটি দরজার চাবি আছে এতে। তোমার নিজের ঘর মনে করে থাকবে এখানে। আজ থেকে এই প্রাসাদের মালিক তুমি। কিন্তু সাবধান, বাগিচার ওপাশে যে তামার দরজা আছে, ওটা কিন্তু ভুলেও খুলো না। তা হলেই সর্বনাশ হবে। যদি খোলো জীবনে আর তোমার সঙ্গে আমাদের মোলাকাৎ হবে না। কখনও।

    এক এক করে সবাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমার কাছে বিদায় নিলো। তাদের সেই করুণ বেদনার্ত চোখের চাহনি আজও আমি ভুলতে পারিনি, মালকিন।

    তারা চলে গেলো। আমি এক পড়ে রইলাম সেই বিশাল শূন্য-প্রসাদ কক্ষে। হাতে আমার এক গোছা চাবি। ওরা দিয়ে গেছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ক’দিন কি অপরূপ হাসি আনন্দ গানে উচ্ছ্বাস উচ্ছলতায় কেটে গেলো বেশ! কিন্তু আজ সেই প্রাসাদপুরী শূন্যতার হাহাকারে ভরা। এমন নীরব নিস্তব্ধতা মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। চারদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। যেদিকে তাকাই কি অপরূপ কারুকর্ম। নিপুণ শিল্পীর নিখুঁত শিল্প নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এর সর্বাঙ্গে 1 মেয়েগুলোকে নিয়ে মশগুল ছিলাম। এ ক’দিন, তাই এসব দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। আজ চোখ সার্থক হলো। তাদের রূপের জৌলুষে চোখ আমার ধাঁধিয়ে ছিলো। তাই এই শিল্পরূপ আমার চোখে পড়েনি।

    প্রথম চাবিটা দিয়ে প্রথম দরজাটা খুললাম। এক সুন্দর ফলের বাগান। এমন নানা জাতের ফলের গাছ একটা বাগানে আগে কখনও দেখিনি। আপেল, আঙ্গুর, কমললেবু, শশা, কলা, পেয়ারা আরও কত নাম নানা জানা মিষ্টি মধুর ফল। প্রাণভরে পেটপুরে খেলাম। এর পর দ্বিতীয় দরজা খুললাম।

    ফুলের সৌরভো ভরে গেলো দেহমান। এমন ফুলের মেলা কেউ কি দেখেছে কখনও? আমি তো দেখিনি। হয়তো বা নবাব বাদশাহদের বাগিচায় থাকতে পারে। যুঁই, বেল, মালতী, রজনীগন্ধা, গোলাপ, হাসনুহানা, টগর, মল্লিকা, সূৰ্যমুখী, ক্রিসেন্মথিমাম, পারিজাত আরও অসংখ্য। সব নাম ক’জনেই বা জানে। এমন এক স্বপ্নের দেশে, এমন এক কল্পনার কল্পলোকে এসে প্ৰাণ আমার নেচে ওঠে।

    আর একটা চাবি দিয়ে তৃতীয় দরজা খুললাম। নানা জাতের নানা রঙের হাজার হাজার পাখীর কলকাকলীতে মুখরিত হচ্ছে সারা বাগিচা। মনে হলো, দুনিয়ার সব রকম পাখীই বোধহয় জোগাড় করে রাখা হয়েছে। সেখানে। সারাদিন ধরে পাখীদের সঙ্গে খেলা করলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।

    পরদিন চতুর্থ দরজা খুলতেই দেখি, বিশাল এক প্রাঙ্গণ। তারপর চারপাশে চল্লিশটা বড় বড় কক্ষ চন্দনকাঠের বিরাট বিরাট দরজা। দরজাগুলো সব খোলা। একটা ঘরে ঢুকেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। সারা ঘরের মেজেয় ঢালা আছে কয়েকশো মণি মুক্তা। এতো বড় বড় মুক্তো কখনও দেখিনি আমি। পায়রার ডিমের মতো প্রায়। মুক্তোর আলোর ছটায় সারা ঘরটায় পূৰ্ণচাঁদের হাট। পাশের ঘরে এলাম। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্তহীরা আর রুবীতে ঠাসা। তৃতীয় ঘরে থরে থরে সাজানো ছিলো চুনী, পান্না, তার পাশের ঘর সোনার তাল-এ ভরা। পরের ঘরটায় সোনার মোহরের পাহাড়। এতো মোহর এলো কোথা থেকে। যতই দেখতে থাকি অবাক হই। তার পাশের ঘর রূপোর বাটে ভর্তি। পরের ঘরে শুধু রূপের মুদ্রা।

    পর পর ঘরগুলো সবই দেখলাম মহামূল্যবান ধনরত্ন মণিমাণিক্যে ঠাসা। দেখলাম আর অবাক বিস্ময়ে ভাবলাম, এতো সম্পদ আমার গোটা সলতানিয়ৎ-এ নাই।

    আমার কোন কাজ নাই, প্রত্যেকদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটার পর একটা চাবি দিয়ে দরজা খুলতে থাকি। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে দিন কাটে। কী অপার ঐশ্বর্য, কী বিচিত্র সংগ্রহ। তারিফ না করে পারা যায় না।

    এইভাবে উনচল্লিশ দিন পার হয়ে গেলো। একটি ছাড়া সবগুলো দরজাই খুলে দেখেছি। এবার মাত্র একটি চাবিই বাকী আছে। কিন্তু মেয়েগুলো আমাকে দিব্বি দিয়ে বারণ করে গেছে এই চাবিটা দিয়ে যেন আমি না খুলি সেই তামার দরজা। কিন্তু মন আমার ভীষণ কৌতূহলী। অজানাকে জানার ইচ্ছে আমার জন্মাবধি। না দেখাকে দেখার আগ্রহ আমার শিরায় শিরায়। কিন্তু মেয়েগুলোর সেই করুণ মিনতি, সেই জলভরা চোখ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওরা বলেছিলো, খুলো না, কোন কারণেই খুলো না সেই সৰ্ব্বনাশা তামার দরজা। আর যদি না শোনো আমাদের কথা, যদি খোল, চিরদিনের মতো তোমার সঙ্গে আমাদের আর মোলাকাৎ হবে না। তোমাকে আমরা হারাতে চাই না, সোনা। তুমি শুধু এই কথাটা আমাদের রেখো। খুলে না—খুলো না, কিছুতেই যেও না। ওই দরজার কাছে।

    চাবিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর ভাবি। কী সুন্দর পরীর মতো মেয়েগুলো। কী রূপ আর কী উচ্ছল, উদ্দাম যৌবন। তাদের মধুর ব্যবহার, তাদের নোচ, তাদের গান, তাদের আদর যত্ন, তাদের দেহ আমাকে চল্লিশটা দিন স্বৰ্গসুখ দিয়েছিলো। প্রতিটি দিনের স্মৃতি প্রখর স্পষ্ট হয়ে রয়েছে প্রদীপশিখার মতো আমার হৃদয়ে। ভুলবো না, কখনও ভুলবো না। এই পরম পাওয়ার চল্লিশটা দিন-রজনী। আর ভুলতে পারবো না সেই মেয়েগুলোকে—যারা আমাকে ভরে দিয়েছিলো—হাসি আর গানে। যৌবনের পূর্ণ সুধাপাত্ব আকণ্ঠ পান করিয়েছিলো যে সব যৌবন মন্দেমত্তা পরম রমণীয় নারী, -কেমন করে ভুলবো তাদের? কিন্তু কৌতূহল এমনই এক বস্তু তার নিবৃত্তি না হলে সব তুচ্ছ মনে হয়। জানি আমার সর্বনাশ হবে, জানি এই স্বৰ্গসুখ, এই নারী সংসর্গ থেকে চিরকালের মতো বিদায় নিতে হবে। তবু কৌতূহল দমন করা গেলো না। তামার দরজাটা খুলে ফেললাম। শয়তান যখন পিছনে লাগে তার আর নিস্তার নাই।

    দরজাটা খুললাম বটে-কিন্তু কিছুই দেখলাম না। একেবারে শূন্য ঘর। শুধু কেমন একটা গন্ধ ভেসে আসতে লাগলো। গন্ধটা ক্রমশ উগ্রতর হতে লাগলো। আমার শরীরটা কেমন বিমঝিম করতে থাকে। মাথাটা বেঁী বেঁী করে ঘুরে উঠলো। তারপর আর মনে নাই। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।

    অনেকক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরে এলো। উঠে বসলাম। গন্ধটা বেশ হালকা হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরটা দেখার জন্য পা বাড়ালাম। ওপাশে আর একটা দরজা। আর একটা ঘর। প্রকাণ্ড বড়। জাফরানে রং করা দেওয়াল। মোমবাতির মিষ্টি আলোয় এক মায়াজাল সৃষ্টি করেছে। আতরের খুশবুতে ভরে গেছে। সারা ঘর। ঘরের চারপাশে চারটে সোনার তৈরি চিরাগবাতি জুলছিলো। সেই পোড়া তেলের অপূর্ব এক মিষ্টি গন্ধও ছড়িয়ে পড়েছিলো ঘরময়। ঘরের এক পাশে একটা কালো ঘোড়া চোখে পড়লো। জবরদস্ত তাগড়াই। তার কপালে একটা সাদা তারার ছাপ। পিছনের দিকের বা পা আর সামনের দিকের ডান পায়ে সাদা মোজা পরানো। তার পিঠের জীন সোনার তৈরি। নিপুণ স্বর্ণকারের সূক্ষ্ম কারুকর্ম করা। যবের আটা আর বার্লির জাবনা তার সামনে। আর একটা বারকোষে খানিকটা জল।

    ঘোড়াটা দেখে আমার ভীষণ লোভ হয়। ছোট বেলা থেকেই দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার হিসাবে সারা দেশে নাম ছিলো আমার। বাঘা বাঘা জাঁদরেল–ঘোড়সওয়ারকে পাল্লায় হারিয়ে দিয়েছি একসময়।  পিঠে চড়ে ঘরের বাইরে বাগানের মাঝখানে নিয়ে এলাম ঘোড়াটাকে। আর নড়তে চায় না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। একেবারে বেয়াড়া বেহুদা জানোয়ার। সপাং সপাং করে ঘা কতক লাগাতেই চি-হি-হি করে লাফিয়ে উঠলো। আর কী আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে দু’খানা পোল্লাই পাখা ছড়িয়ে পড়লো, দু-পাশে এমনভাবে গোটানো ছিলো যে, চোখেই পড়েনি এতক্ষণ। এর পর অদ্ভুত ধরনের এক আওয়াজ তুলে শো শোঁ করে আকাশের দিকে যেতে লাগলো। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঘর-বাডি মানুষজন সব ছোট হতে হতে আরও ছোট হয়ে আসতে লাগলো আমার চোখে। অনেক উপরে উঠে গেছি তখন। একেবারে মেঘের কাছাকাছি। এবার ঘোড়াটা বাজপাখীর মতো তীর বেগে ছুটে চললো শক্ত করে লাগামটা ধরে বসে রইলাম। ভয় আমি পাইনি। বরং এক অপূর্ব শিহরণ বোধ করছিলাম সারা দেহে!

    আকাশ পথে দেশদেশান্তর পেরিয়ে উড়ে চললো সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া। তারপর এক সময় দেখলাম সেই তাম্র-প্রাসাদের ছাদে গিয়ে নামলো সে। এক মুহুর্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তারপর প্রচণ্ড এক ঝাকুনি দিয়ে গাঝাড়া দিয়ে আমাকে ফেলে দিলো নিচে—ছাদের উপর। আমি সামলে ওঠার আগেই ছুটে এসে তার একখানা পাখার ঝাপটা মারলে আমার এই বঁ। চোখে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে পড়ে গেলাম আমি। আর তক্ষুণি শো শোঁ করে মহাশূন্যে উঠে গিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। সে।

    এক হাতে বা-চোখটা চেপে ধরে প্রাসাদের সিডি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সেই দশজন বঁ-চোখ কানা যুবক বেরিয়ে এলো।

    —অতো পইপই করে বারণ করেছিলাম সেদিন, কিন্তু আমাদের কথা গ্রাহ্য করলে না। এখন ঠেলা বুঝলে? তোমাকে আগেই বলেছিলাম দশজনের বেশী জায়গা নেই এখানে। আর দশজন আমরা হয়েই গেছি। তোমার জায়গা হবে না। এখন নিজের পথ নিজে দেখো। তবে তোমাকে একটা পথের নিশানা বলে দিতে পারি। সেই পথ ধরে যদি যাও তবে দিন কয়েক পরে বাগদাদ শহরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে। সেখানকার খলিফা হারুন-অল-রাসিদ পরম দয়ালু। তার কাছে গেলে তোমার আশ্রয় মিলতে পারে, তার দান ধ্যানের খ্যাতি জগৎ-জোড়া। তিনিই তোমার ভাগ্যবিধাতা।

    দাড়ি গোঁফ কমিয়ে এক কালান্দার ফকিরের বেশে পথে নেমে পড়লাম। কেউ চিনবে না, কেউ জানবে না। আমি বাদশাহ কাসিবের পুত্র। দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে আজ সন্ধ্যায়। এই বাগদাদ শহরে পৌঁছেছি। কোথায় যাবো, কোথায় পাবো একটা আস্তানা—আজকের রাতের মতো, সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতে একটা রাস্তার চৌমাথায় এসে দাঁড়ালাম। সেখানে দেখি আমারই মতো আরও দুজন কালান্দার। তাদেরও দাড়ি গোঁফ কামানো। আমার মতো তাদের দুজনেরও বা চোখে ঠুলি পরা। কানা। ওরাও শহরে নবাগত। রাতের আশ্রয় খুঁজছে। তিনজনের একই সমস্যা। এক সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম আস্তানার সন্ধানে। রাতের মতো একটু আশ্রয় পেয়ে যাবো। এই আশায় তোমাদের দরজায় কড়া নাড়লাম।

    এই হলো আমার হতভাগ্য জীবনের করুণ কাহিনী। এই হলো আমার বাঁ চোখ হারানো আর গোঁফদাড়ি কামানোর ইতিবৃত্ত।

    সেই সুন্দরী তিন বোন তৃতীয় কালান্দারের কাহিনী শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হতবাক। বড়বোন বললো, খুব খুশি হয়েছি তোমার কাহিনী শুনে। যাও এক্কেবারে ছুটি।

    –কিন্তু মালকিন, এখানে আর যারা আছেন তাদের কাহিনী শুনবো না?

    ছোটবোন তখন খলিফা জাফর আর মসরুর-এর দিকে চেয়ে বললো, এবার আপনাদের কাহিনী শোনান।

    জাফর বললো, আমাদের যা কাহিনী তা তো দরজায় ঢোকার মুখেই তোমাকে বলেছি, মা এর বেশী বলার মতো কোনও ঘটনা আমাদের জীবনে নাই।

    বড়বোন বললো, ঠিক আছে, সবাইকে আমি মুক্তি দিলাম। যে যেখানে যেতে চাও যেতে পারো।

     

    খলিফা ফিরে এসে ঘুমুতে গেলো। কিন্তু ঘুম আর আসে না। বাকী রাতটা পায়চারী করে কাটায় ঘরময়। সকাল হতে দরবারে গিয়ে বসে। জাফরকে বলে, সেই তিনটি মেয়েকে আর তাদের ঐ মাদী কুকুর দু’টো আর ঐ তিন কালান্দারকে হাজির করো এখানে—এখুনি।

    একটু বাদেই তাদের হাজির করা হলো দরবারে। আমির-ওমরাহ পারিষদে গম গম করছে। দরবার। তখন উজির জাফর বলতে লাগলো, কাল রাতে আমরা তোমাদের হাতে বন্দী হয়েছিলাম। তখন অবশ্য তোমরা জানতে না আমাদের পরিচয়। তবু বলবো, কোন খারাপ ব্যবহার করোনি আমাদের সঙ্গে। এখন শোনো, তোমরা পঞ্চম আব্বাস খলিফা হারুন-অলরসিদের দরবারে এসেছে। যা বলবে সত্য বলবে, কোন মিথ্যা বলবে না। এখন বলো, কী তোমাদের কাহিনী, আর এই রহস্যজনক মাদী কুকুর দুটারই বা ইতিবৃত্ত কী?

    জাফরের এই কথা শুনে বড়বোন এগিয়ে এসে খলিফাকে কুর্নিশ জানালো। বললো, আপনি মহানুভব মেহেরবান শাহেনশাহ। আপনি আল্লাহর পয়গম্বর। আপনার কাছে কোন মিথ্যা বলবো না। কিন্তু আমার কাহিনী এতোই অদ্ভুত, শুনে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করবেন। হুজুর। এক বৰ্ণও মিথ্যা বানিয়ে বলবো না কিছু।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.