Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৪.৫৩ জাফরের অন্তিম দশা

    এই দুঃখদায়ক রক্তঝরা কাহিনী বলতে আমার বুক কেঁপে উঠছে। খলিফা হারুন অল রসিদের সময় কালের কাহিনী এটা। যত রক্তপাতের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো তাতে চারটি নদীতে বান ডেকে যেতে পারতো।

    আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন জাঁহাপনা, উজির জাফররা চার ভাই। তার বাবা ইয়াহিয়া ইবন খালিদ ইবন বারমাকও সুলতানের উজিরপদে বহাল ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

    জাফরের বড় ভাই অল ফাদল ও অল রসিদ একই স্তন্যে পালিত হয়েছিলো। তার কারণ খলিফার পরিবারের সঙ্গে বারমাকী পরিবারের বহুকালের বন্ধুত্ব সৌহার্দের সম্পর্ক ছিলো। অল রসিদের মা খাইজারান এবং ফাদল-এর মা-এর মধ্যে গভীর অন্তরঙ্গতা ছিলো। সেই সূত্রে শিশুকাল থেকে কৈশোর পর্যন্ত অল রসিদের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে ইয়াহিয়ার বাড়িতে। অল ফাদলের সঙ্গে একই মায়ের স্তন্য পান করে ওরা দুটিতে মানুষ হয়েছিলো। এই কারণে অল রসিদ ইয়াহিয়াকেও বাবা বলে ডাকতেন।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    নয়শো পঁচানব্বইতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    এই বারমাকীরা খুরাসনের বলখ শহরে বাস করতেন। সেখানে তারা যশ খ্যাতি প্রতিপত্তির শিখরে উঠেছিলেন। হজরত মহম্মদের প্রবর্তিত হিজরা সনের কম বেশি একশো বছরের মধ্যে এই খ্যাতি তারা লাভ করতে পেরেছিলেন।

    এরপর বারমকীরা দামাসকাসে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তখন বাদশাহ উমর মসনদে আসীন ছিলেন।

    সুলতান হাসিমের শাসনকালে বারমাকী পরিবারের প্রধান মাজিয়ান ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।

    কিন্তু আব্বাস-বংশই সর্বপ্রথম বারমাকীদের বাদশাহী সম্মানে ভূষিত করেছিলো। খালিদ ইবন বারমাকই সর্বপ্রথম আবুল অল আব্বাসের প্রধান উজির পদে বহাল হয়েছিলেন। এবং আব্বাসের তৃতীয় পুরুষ সুলতান মহেদী বারমাকী ইয়াহিয়াকে অল রসিদের গৃহ-শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। অল রসিদের জন্মের মাত্র সাত দিন আগে ইয়াহিয়া-পুত্র অল ফাদলের জন্ম হয়েছিলো।

    জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অল হাদীর আকস্মিক মৃত্যুতে অল রসিদ খলিফা হয়েই প্রথমে ইয়াহিয়াকে প্রধান উজিরে বহাল করলেন। ইয়াহিয়া তার দুই পুত্র অল ফাদল এবং জাফরকে তার সহকারী উজির করে পাশে পাশে রেখে শিক্ষাদান করেছিলেন। এর ফলে খলিফার শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে লাগলো। প্রজারা খলিফার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো।

    এই সব কারণে বারমাকীরা সুলতান-পরিবারে একান্তভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। এবংইয়াহিয়া ও তার পুত্ররা কালক্রমে অসীম ক্ষমতার অধিকার অর্জন করতে পেরেছিলো। সারা সলনিয়ত তাদের আঙ্গুলের ইশারায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছিলো। এবং হারুন অল রসিদের কালেই খলিফা বংশ খ্যাতি ও শৌর্যবীর্যের শীর্ষে পৌঁছতে পেরেছিলো।

    কবি আবু নবাস তাই লিখেছেন–

    যতকাল চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা জ্বলবে।
    তোমাদের কীর্তিকথা মুখে মুখে চলবে।

    ওঁরা সকলেই স্বনামধন্য, জনপ্রিয়, জ্ঞানবান বিচক্ষণ উজির হতে পেরেছিলেন। ওঁরা ছিলেন দেশের ও দশের গর্বের বস্তু। ওঁরা ছিলেন দেশের মহামূল্য রত্ন। কর্তব্যে বজ্ৰাদপি কঠোর এবং বাৎসল্যে কুসুমের মতো কোমল ছিলো তাদের হৃদয়। অমন জ্ঞানবৃদ্ধ এবং সৎ পরামর্শদাতা আর জন্মাবে না। ওঁদের উদারতা এবং মহত্ত্ব হাতিমতাইকে মনে করিয়ে দেয়। ওঁরা শান্তির পিরবার ছিলেন।

    শুধু এই-ই সব নয়, ওঁদের অসামান্য সমর-কুশলতায় খলিফা অল রসিদ তার সলতানিয়তের পরিধি একদিকে মধ্য এশিয়ার সমতল থেকে সুদূরে উত্তারঞ্চলের অরণ্যভূমি, অন্যদিকে মরোক্কো এবং আন্দালুসিয়া থেকে চীন সীমান্ত এবং তাতার অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

    এরপর হঠাৎ একদিন বারমাক-সন্তানরা চরম খ্যাতির চূড়া থেকে ধপাস করে পড়ে গেলেন একেবারে মরণ-খাদে। ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর পরিহাস, একদিন যাঁরা এক বিশাল সলতানিয়তের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা হয়েছিলেন, যাঁরা এক সময়ে সুলতানের প্রিয় হতে প্রিয়তর হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা সব খুইয়ে বসলেন।

    একদিন অল রসিদ মক্কা থেকে ফিরে এসে নৌকোয় চেপে আনবার শহর অভিমুখে যাত্রা করলেন। এবং পথের মাঝখানে তিনি অল উমরের এক সেনাবাসে রাত্রি কাটালেন। তাকে আদর আপ্যায়নের জন্য খানাপিনার এলাহী ব্যবস্থা করা হয়েছিলো সেখানে।

    কিন্তু এই সময়ে খলিফার নিত্য সহচর জাফর সঙ্গে ছিলো না। দিনকয়েক আগে সে শিকারে গিয়েছিলো নদীর ধারের এক জঙ্গলে। খলিফা বড় নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলেন। তখুনি তাঁর নির্দেশে বনে জঙ্গলে দূতবাহিনী পাঠানো হলো। যেখানেই থাক, আজ রাতের মধ্যেই তাকে নিয়ে আসতে হবে খলিফার কাছে।

    অতি অল্প সময়ের মধ্যেই জাফর এসে খলিফাকে সঙ্গ দান করেছিলো সে রাতে।

    সেদিন খলিফার সঙ্গে ছিল তার একান্ত হেকিম জিব্রিল বখচিয়াসু, প্রিয় অন্ধ কবি আবু জাফর। খলিফা ওদের বললেন, জাফর অসুস্থ। তোমরা ওকে নিয়ে একটু আমোদ প্রমোদ কর।

    তখন রাত বেশি হয়নি, সান্ধ্য আহার শেষ করে আসর জাঁকিয়ে বসেছেন জাফর। অন্ধ গায়ক ম্যাণ্ডোলিন বাজিয়ে হাল্কা রসের গানে বেশ জমিয়ে তুলেছে।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো ছিয়ানব্বইতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে–

    হঠাৎ খলিফার দেহরক্ষী উদ্যত খঙ্গ হাতে এসে জাফরের সামনে উদ্ধত ভঙ্গীতে দাঁড়ালো! চোখে মুখে তার ক্রোধের ছাপ।

    জাফর বেশ অবাক হয়ে তাকালো, মাসরুরকে সে আশৈশব থেকে জানে।কখনও তার বিনয় নম্র ব্যবহারে এমন ঘটনা ঘটেনি আজ পর্যন্ত। হঠাৎ একি হলো?বলা নাই কয়া নাই, হুট করে সে ঢুকে পড়লো তার তাঁবুতে! মাসরুর তো কখনও এমনটা করে না। উজিরের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে সালাম কুর্নিশ জানাতে কখনও সে ভুল করে না। কিন্তু আজ একি তার অবিনয়ী উদ্ধত মেজাজ? একবার সে মাথা নোয়ালো না?

    জাফর নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি টেনে মাসরুরকে স্বাগত জানায়, এই যে মাসরুর, এসো এসো। তোমাকে দেখলেও আহ্লাদ হয়! কিন্তু মাসরুর ভাই, ব্যাপারকী আজ তোমাকে যেন কেমন উদ্ভান্ত দেখছি? এই প্রথম দেখলাম, তুমি আগে খবর না পাঠিয়ে, সোজা ঢুকে পড়েছ আমার কামরায়।

    মাসরুর বললো, ব্যাপার বড় খারাপ, ওসব আদব কায়দা দেখাবার মতো সময় নাই আমার। সুলতানের হুকুম, এই মুহূর্তে তোমার শির নিয়ে গিয়ে হাজির করতে হবে তার সামনে। না, আর দেরি নয়, জাফর, ওঠ, চলো বাইরে চলো।

    জাফর উঠে দাঁড়ালো।

    —একমাত্র খোদা ছাড়া আর ভরসা নাই। তাঁর কাছ থেকে আমরা এসেছি এ দুনিয়ায়, আবার তার চরণেই ফিরে যেতে হবে সময় হলে, চলো।

    তাঁবু থেকে বেরিয়ে জাফর মাসরুরকে বললো, আমার কি মনে হয় জান মাসরুর, জাঁহাপনা মাত্রাধিক সুরাপান করে বেহেড হয়ে গিয়ে তোমাকে এই সব বলেছেন। কাল সকালেই দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন খলিফার কাছে ফিরে যাও, দেখবে একটু আগে তিনি যা হুকুম করেছেন এখনই তা আর স্মরণ করতে পারবেন না।

    মাসরুর বললো, সে হয় না। হয় তোমার শির নিয়ে যাবো, হয় আমার শির দিতে হবে। কাজ অসমাপ্ত রেখে আমি ফিরে যেতে পারবো না। তোমার যা শেষ কথা বলার আছে তুমি একখানা খতে লিখে দাও, আমি অবশ্যই সেখানা পৌঁছে দেব তার হাতে। তোমার সঙ্গে আমার বহুকালের বন্ধুত্ব। সেই কারণে তোমার এইটুকু উপকার আমি করতে পারি, জাফর।

    জাফর বললো, দেখ আমরা আল্লাহর বান্দা। আমাদের শেষ ইচ্ছা বলে কিছু থাকতে নাই। সুতরাং লেখারও কোনও প্রশ্ন আসে না। আল্লাহ খলিফাকে দীর্ঘজীবি করুন, এই আমার শেষ বাসনা জাফর! আর কিছু বলার নাই। এবার তোমার কাজ তুমি সমাধা কর।

    তাঁবুর বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে হাঁটু গেড়ে মাটিতে মাথা ঠেকালো জাফর। আর সেই মুহূর্তে মাসরুরের শাণিত খঙ্গের একটি আঘাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো তার মুণ্ডটা।

    এরপর আজ্ঞাবহ মাসরুর জাফরের কাটা মুণ্ডটা একখানা রেকাবীতে করে বয়ে এনে খলিফার সামনে টেবিলের ওপর বসিয়ে দিলো। খলিফা উঠে এসে একটু নিচু হয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন জাফরের ছিন্ন মস্তকটি। তারপর থুথু করে থুথু ছিটিয়ে দিলেন তার মুখের উপর।

    এতেও তিনি ক্ষান্ত হলেন না! তখনই হুকুম জারী করে দিলেন, জাফরের দেহটাকে ক্রুশে বিদ্ধ করে বাগদাদের বড় সেতুর এক প্রান্তে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। আর অন্য প্রান্তে ঝুলতে থাকবে তার এই মুণ্ডটা।

    অপরাধের সাজা হিসাবে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক অপরাধীকেই। কিন্তু এমন মর্যাদা হরণ খুব কম হতভাগ্যেরই জীবনে বা মরণে হয়েছে এর আগে।

    সুলতান আরও হুকুম-নামা জারি করলেন; ছয় মাস কাল ধরে জাফরের ধড় আর মুণ্ড বড় সেতুর এপার ওপারে ঝুলতে থাকবে। তারপরও যদি কোনও দেহাবশেষ থেকে যায় তবে তা গাধার গোবরের খুঁটের আগুনে পুড়িয়ে ছাই করবে। এবং সেই ছাই পায়খানার চাড়িতে চাড়িতে ছুঁড়ে দেবে।

    ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! খাজাঞ্চীখানার তহবিলদার তার হিসাবের খাতায় বারমাকী পরিবারের পাতায় যেখানে একবার লিখেছিলো, ধর্মাবতারের নির্দেশেমহামান্য উজির জাফরকে জমকালো শাহী সাজ-পোশাক ও অন্যান্য উপহার দেওয়া বাবদ খরচ চার লক্ষ স্বর্ণ দিনার, ঠিক তার নিচেই আর এক ছত্রে সে লিখলো সেদিন, কাঠ খড় এবং গাধার গোবর দিয়ে জাফরের দেহ পুড়িয়ে ছাই করা বাবদ খরচ দশ দিরহাম।

    এইভাবে জাফরের জীবনান্ত ঘটেছিলো। প্রায় সারাটা জীবন সে খলিফার একমাত্র পরম প্রিয় বন্ধু, পথপ্রদর্শক, সৎ পরামর্শদাতা রূপে উচ্চাসনে আসীন ছিলো। কিন্তু জীবন-সায়াহ্নে কোথায় উবে গেলো সেই প্রেম মহব্বৎ ভালোবাসা? এমন মহৎ প্রাণের কি এইভাবেই শেষ পরিণতি ঘটে?

    পরদিন প্রত্যুষেই পেয়াদারা জাফর পিতা ইয়াহিয়া এবং অল ফাদলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলো। খলিফার নির্দেশে তাদেরও হত্যা করা হলো। বারমাকী পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেন খলিফা। এই ইয়াহিয়া তার শৈশবের শিক্ষক। তাকে তিনি পিতা

    সম্বোধন করে ডাকতেন। আর অল ফাদল—তার সঙ্গে তো তিনি এক মায়ের বুকের দুধ ভাগ করে খেয়েছেন।

    ইয়াহিয়া পরিবারের বাকী সকলকে বন্দী করে এনে অন্ধকার কূপ-কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো। এদের সংখ্যাও সহস্রাধিক। সবাই নিস্পাপ নিরীহ মানুষ। কারো বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ ছিলো না।

    আর যারা পড়ে রইলো তারা গৃহ সম্পদ-হারা ভিখারী হয়ে পথে পথে ফিরতে লাগলো। তাদের অনেকেই অনাহারে মারা গেলো, কেউ বা আত্মসম্ভ্রম বাঁচাতে গলায় দড়ি দিতে আত্মহত্যা করলো। কিন্তু ইয়াহিয়া, তার পুত্র অল ফাদল এবং মহম্মদকে নির্মম নিপীড়ন করে হত্যা করা হয়েছিলো।

    শাহরাজাদ এক মুহূর্ত থেমে আবার বলতে শুরু করলো। জাঁহাপনা, আপনার নিশ্চয়ই এই – হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে ইচ্ছে করছে! তা হলে শুনুন :

     

    এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পরে একদিন অল রসিদের কনিষ্ঠ ভগ্নী আলিয়াহ বড় ভাইয়ের কাছে এসে বললো, ধর্মাবতার, অনেক দিন ধরে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো করবো ভাবছি, কিন্তু সাহস পাই না।

    খলিফা হারুন অল রসিদ ভগ্নীকে কাছে বসিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী কথা বোন, নির্ভয়ে বলো।

    আলিয়াহ বললো, জাঁহাপনা, জাফরের মৃত্যুর পর একটা দিনও তোমাকে সুস্থির শান্ত হতে দেখলাম না। এমন কী সে করেছিলো যার জন্য আজও তোমার ক্রোধ প্রশমিত হলো না?

    অল রসিদের সারা মুখে কালো মেঘ নেমে আসে। ভগ্নীকে দুরে ঠেলে দিয়ে বলে, ওসব কথা জেনে তোমার কী ফয়দা হবে? সে কথা মনে হলেই আমার মন অশান্ত হয়ে ওঠে। যাও অন্দরে যাও।

    এই বলে খলিফা বোনকে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন।

    আজ পর্যন্ত যত ঐতিহাসিক গবেষক এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে যে সব তথ্য দাঁড় করিয়েছেন, তাদের একজনের সঙ্গে অন্য জনের বড় একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেকের বক্তব্যই আলাদা ধরনের।

    এখানে তার দু একটা নমুনা তুলে ধরছি?

    কেউ বলেন, খলিফা হারুন অল রসিদ শেষ পর্যন্ত জাফরের স্বেচ্ছাচারে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। শেষের দিকে নাকি জাফরই বকলমে সুলতানদের কার্যভার পরিচালনা করতো। বাইরের কোনও ব্যক্তি সরাসরি খলিফার কাছে তাদের আর্জি পেশ করতে পারতো না। যা কিছু বক্তব্য আগে জাফরের কাছে পেশ করতে হতো। সাধারণতঃ সেই ফরমান দিয়ে দিত। কখন সখনও সে খলিফার কাছে দু-একজনের অভাব অভিযোগ পাঠাতে মাত্র। খলিফা বুঝতে পেরেছিলেন, জাফর তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলছে।

    দরবারের সমস্ত উচ্চপদে জাফর তার পরিবারের আপনজনদের নিয়োগ করেছিলো। শুধু দরবারে বা দপ্তরেই নয়, সেনাবাহিনীর প্রধান খুঁটিগুলোতেও ছিলো তার নিজের লোক। এছাড়া সরকারী অর্থ আত্মসাতেরও নাকি অনেক তথ্য পাওয়া যায়। জাফরের সময়কালে বারমাকী পরিবারের বিষয় সম্পদের পরিমাণ নাকি সহস্র গুণ বেড়ে গিয়েছিলো।

    অল রসিদের ব্যক্তিগত হকিম জীবরিলের জবানবন্দী থেকে এই তথ্য জানা যায়ঃ একদিক আমি অল রসিদের টাইগ্রীস তীরের প্রমোদ-ভবনে আহুত হয়েছিলাম। বারমাকী পরিবার বাস করতো নদীর অপর তীরে। মাঝখানে শুধুমাত্র নদীটির ব্যবধান।

    কথা প্রসঙ্গে খলিফা আমাকে বললেন, এখন আমি আর শাসন কাজ বড় একটা নিজে দেখা শুনা করি না। সবই তুলে দিয়েছি জাফরের হাতে। ওরা আমাদের বেতনভোগী কর্মচারী মাত্র নয়, আমাদের আব্বাস বংশের বহুকালের পরম সুহৃদও বটে। ওরা আমার কাঁধ থেকে সব বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে নিশ্চিত করেছে। আমি এখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো নীলাকাশে পাখা মেলে ঘুরে বেড়াই। কোনও চিন্তা ভাবনা দায় দায়িত্ব আমার এখন নাই।

    কিন্তু অন্য আর একদিন এই খলিফাই আমাকে বললেন, বারমাকীদের বাড়াবাড়িতে আমি বিশেষ বিচলিত বোধ করছি হকিম। ইয়াহিয়া আর তার পুত্ররা আমার সলতানিয়তের শাসন পরিচালনার ভার নিজেদের হাতে নিয়ে আমাকে যেন দিন দিন দূরে ঠেলে দিতে চাইছে। আমার যেন কেবলই মনে হচ্ছে ওরাই আসল শক্তি, আমি যেন ওদের হাতের পুতুল মাত্র।

    খলিফার মুখ থেকে শোনার পর থেকে নিশ্চিত বুঝতে পারলাম বারমাকী পরিবারদের অধঃপতন অনিবার্য হয়ে এসেছে।

    অন্যত্র ঐতিহাসিক বলেন, বারমাকী পরিবারের সৌজন্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এ জাফরের তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীরাই খলিফার কানে বিষ ঢালতে শুরু করেছিলো। কারণে অকারণে তারা মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে খলিফার কাছে গিয়ে বারমাকীদের সম্বন্ধে লাগান ভাঙ্গান করতো।

    আবার অন্য এক গবেষকের অভিমত : একদিন খলিফা জাফরকে নির্দেশ করেছিলেন, অতি গোপনে মহম্মদের কন্যা ফতিমা ও আলীর একমাত্র বংশধর সাঈদ ইয়াহিয়া ইবন আবদাল্লা অল হুসেনকে খতম করে ফেলতে হবে। জাফর নাকি খলিফার সে আদেশ পালন না করে আলি বংশধরকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করতে সহায়তা করেছিলো। খলিফা এই লোকটিকে আব্বাস বংশের বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে মনে করতেন।

    খলিফা যখন জাফরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তার হুকুম তামিল করা হয়েছে কিনা, তখন জাফর মিথ্যা ভাষণ করেনি তার কাছে।

    —আমি যা করেছি তা আমার প্রভুর মঙ্গলের জন্যই করেছি, জাঁহাপনা। -বাঃ চমৎকার, বেশ ভালোই করেছ, জাফর। সুলতান মনের ক্রোধ চেপে মুখে হাসি ফুটিয়ে জাফরকে মিথ্যা বাহবা দিলেন। কিন্তু সেইখানেই মনে মনে বললেন, তোমার এতো বড় স্পর্ধা, মরবার পাখা গজিয়েছে?

    আর এক ঐতিহাসিক বলেছেন : বারমাকীদের পতনের আসল কারণ ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামীর মূলে তাদের কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হওয়া। বারমাকীরা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আগে বল-এ বসবাস করতো। তখন ওরা মাজিয়ান ধর্মী ছিলো। মাজিয়ানরা পুতুল পূজায় বিশ্বাস করতো।

    খুরাসান অভিযানের সময় জাফর তার সৈন্যবাহিনীকে মাজি মন্দির এবং দেবদেবীদের ধ্বংস করতে নাকি নির্দেশ দিয়েছিলো। এ সংবাদ খলিফা হারুন অল রসিদের কানে পৌঁছতে বেশি সময় লাগেনি। এরপর থেকে ইসলামে বারমাকীদের আস্থা সম্বন্ধে খলিফার মনে গভীর সংশয় জাগে।

    বারমাকীদের পতনের আরও কিছু কিছু যুক্তিবহ তথ্য তুলে ধরেছেন ইবন খিলিকান এবং ইবন-অল আখির। তারা বলেছেন—

    খলিফা হারুন অল রসিদের এক ভগ্নী ছিলো। তার নাম আব্বাসা। তার মতো রূপবতী রমণী যে সময়ে আর দু’টি ছিলো না। বড় হয়ে খলিফা স্বয়ং এই নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আব্বাসাকে না দেখে তিনি এক মুহূর্ত ২ স্থির থাকতে পারতেন না। দরবারে অথবা বিশ্রাম কক্ষে যেখানেই থাকতেন খলিফা সব সময় আব্বাসাকে কাছে কাছে রাখতেন।  কিন্তু এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। আব্বাস বংশের এক কন্যা সব সময় নিজের স্বামী ছাড়া অন্যের সাথী হয়ে দিন কাটাবে—তা হয় না।

    অবশেষে খলিফা একদিন জাফরকে তার হৃদয়ের অতৃপ্ত বাসনার কথা জানালেন।

    —আমি ইচ্ছা করি জাফর, তুমি আব্বাসাকে শাদী কর। কিন্তু একটা শর্ত তোমাকে পালন করতে হবে। আব্বাসার সঙ্গে তোমার কোনও দৈহিক সম্পর্ক থাকবে না। একমাত্র আমার উপস্থিতিতে তোমরা একত্র হতে পারবে।

    জাফর সুলতানের একান্ত অনুরক্ত উজির। সে বললো, আপনার অভিলাষ আমি পূরণ করবো, জাঁহাপনা।

    শাদীর পর প্রতিদিন আব্বাসার সঙ্গে জাফরের সাক্ষাৎ হয় খলিফার দরবারে বা বিশ্রামকক্ষে।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    নয়শো সাতানব্বইতম রজনী।

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    এই ব্যবস্থায় অল রসিদ পুলকিত হলেও নবপরিণীতা দম্পতি বিশেষ প্রসন্ন হতে পারলো না। স্বামী-স্ত্রীর প্রেম প্রণয়ের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি একেবারেই অবাঞ্ছিত। যদিও জাফর সুলতানকে খুশি রাখার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারছিলো, কিন্তু নব-যৌবন-উদ্ভিন্না আব্বাসা এ অত্যাচার বরদাস্ত করতে চাইলো না। একদিন সে গোপনে চিঠি লিখে পাঠালো জাফর-মাতা ইতাবার কাছে।

    —মা, আজ আমি আপনার পুত্রবধূ। আপনার পুত্র জাফর বিধিসম্মত ভাবে আমাকে গ্রহণ করেছেন। এরপর আমি আর এই প্রাসাদে অবস্থান করতে চাই না। আপনি আমাকে বরণ করে ঘরে নিন, এই আমার একমাত্র সাধ। তার আর দশটা বাঁদীর পাশে আমাকেও একটু জায়গা করে দিন।

    ইতাবা কিন্তু গোপন বিবাহ মঞ্জুর করলো না। আব্বাস বংশের কন্যা তাদের ঘরে বাদী হয়ে আসবে, সে কী কথা? এতে যে সারা দেশে ঢি ঢি পড়ে যাবে। এবং খলিফার রুদ্ররোষে পড়তে হবে তাদের। তাই সে জবাব লিখে পাঠালো, আমার এখানে পুত্রবধূ হয়ে আসা এবং থাকা তোমার পক্ষে উচিত হবে না।

    এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো আব্বাসা। সে হুমকী দিয়ে লিখলো, আমি যাবোই, তাতে যদি দুনিয়া রসাতলে যায় যাবে। কিন্তু আমার বিধিসম্মত বিবাহিত স্বামীর দাবি আমি কিছুতেই ছাড়বো না। তার জন্যে যদি আমাকে ফাঁসীতেও ঝুলতে হয় ঝুলবো।

    সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি জানাতে বাধ্য হলো ইতাবা।

    আব্বাসাকে সে গোপনে নিয়ে এলো নিজের বাড়িতে। রঙ চঙ মাখিয়ে একেবারে নতুন একটি বাঁদী সাজিয়ে হাজির করলো জাফরের সামনে। জাফর তখন নেশায় বুদ হয়ে ছিলো, আব্বাসাকে দেখেও চিনতে পারলো না। ইতাবা বললো, আজকের বাঁদী বাজার থেকে তোর জন্যে পছন্দ করে কিনে এনেছি, বাবা।

    জাফর বললো, বেশ তো শাদীর পাট চুকিয়ে ফেলো তাড়াতাড়ি। আজই মধুযামিনী যাপন করা যাক।

    সেই রাতে বাসরঘরে জাফর আব্বাসাকে বিবস্ত্র হয়ে কাছে আসতে বললো।

    আব্বাসা বললো, আচ্ছা মালিক, শাহজাদীদের সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা? তাদের কেউ আপনার বাদী হয়ে এলে আপনার জিন্দগী একেবারে বরবাদ হয়ে যাবে? সুলতান-তনয়ারা কী বাজারে কেনা বাঁদী থেকে আলাদা কিছু?

    -শা-হ-জা-দী? বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে আব্বাসার দিকে তাকালো জাফর, তুমি কী কোনও সুলতান কাদশার কন্যা নাকি?

    —শোনো জাফর, আমি শাহজাদীও বটে, তোমার বাঁদীও বটে। আব্বাসের বংশে আমার জন্ম।

    সব মনের নেশা মুহূর্তে উবে গেলো জাফরের। শয্যার ওপরে সোজা হয়ে বসলো সে। তারপর চীৎকার করে উঠলো, এ তুমি কী করেছ আব্বাসা? নিজেও মরবে, আমাকেও মারবে?

    ছুটে গেলো সে মায়ের কাছে, মা এ তুমি কী সর্বনাশ ডেকে এনেছ? মা কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে বললো, বাবা এ ছাড়া কোনও উপায় ছিলো না আমার। এরপর সে আব্বাসার চিঠিপত্রের সব কথা জাফরকে শোনালো। যথাসময়ে প্রাসাদের হারেমে আব্বাসা একটি পুত্র-সন্তানের জন্ম দিলো। পুত্রটিকে সে তার একান্ত বিশ্বাসভাজন এক নফর বিয়াসের হাতে তুলে দিয়ে বললো, একে গোপনে মানুষ করবে। এর দেখা-শোনার জন্য আমার পরিচারিকা বারাহ তোমাকে সাহায্য করবে। একে নিয়ে আজই তোমরা দু’জনে মক্কায় চলে যাও। এখানে থাকলে, যত সাবধানেই থাক, লোক জানাজানি হয়ে যাবে।

    কিন্তু যত গোপনতাই অবলম্বন করুক, এমন মুখরোচক সংবাদ চাপা রইলো না হারেমে।

    ইয়াহিয়া অবশ্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি করেনি। তিনি প্রাসাদ তথা হারেমের রক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সন্ধ্যা হতে না হতেই তিনি প্রাসাদের সব মহলের দরজা তালা বন্ধ করে দিতেন। এতে বেগম জুবেদা ক্ষুব্ধ হয়ে একদিন ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে নালিশ জানালো খলিফার কাছে।

    খলিফা ইয়াহিয়াকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আব্বাজান, জুবেদা আপনার নামে নালিশ করছে কেন, কী করেছেন আপনি?

    ইয়াহিয়া বললেন, কেন, সে কি আমার কাজের কোনও গাফিলতি দেখেছে? আমি কি ঠিকমতো হারেম দেখা শোনা করছি না?

    -না সে সব কিছু নয়, আব্বাজান। —তাহলে, ওর কথায় কান দিও না, ধর্মাবতার। আমি আমার কর্তব্যে কখনও অবহেলা করি।

    এরপর থেকে ইয়াহিয়া আরও সকাল সকাল হারেমের দরজায় কুলুপ লাগাবার ব্যবস্থা করেন।

    জুবেদা আবার এলো খলিফার কাছে। অল রসিদ সেবার বেশ কড়া ভাবেই জানিয়ে দিলেন জুবেদাকে, ইয়াহিয়া আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে শৈশবকালে যে শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, তারই ফলে আজ আমি এতবড় বিশাল সলনিয়তের শাসন কার্য চালাতে সক্ষম হচ্ছি। তাকে আমিই নিয়োগ করেছি হারেম দেখাশুনার জন্য। আমি জানি, তিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আদেশ মোতাবেকই তিনি কর্তব্য করে চলেছেন। আমার এখনও স্মরণ আছে আমার পাঠ শেখার সময়ই তিনি এমনি কঠোর হাতে আমাকে শাসন করেছিলেন। এবং তার ফলেই আমি সত্যিকারের মানুষ হতে পেরেছি।

    জুবেদা বিদ্রুপের বাণ ছুঁড়ে বলতে থাকে, তা তিনি আপনাকে যেমন কঠিন শাসন মানুষ করেছিলেন তেমনি করে নিজেরটাকে শিক্ষা দিতে পারেন নি কেন? সেটা তো একটা অমানুষ হয়েছে।

    —তুমি কী বলতে চাও, বেগমসাহেবা? কে অমানুষ?

    অল রসিদ ভীষণ রেগে গেলে জুবেদাকে বেগমসাহেবা বলে সম্বোধন করতেন।

    জুবেদা তখন জাফর আর আব্বাসার সমস্ত গোপন কাহিনী শুনিয়ে দিলো খলিফাকে।

    খলিফা গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এর কোনও প্রমাণ আছে?

    —এই প্রাসাদ হারেমের একটি অবোধ শিশুও যে কথা জানে, তা আবার প্রমাণের অপেক্ষা রাখে নাকি? আর তাছাড়া সে ছেলে তো এখনও জীবিত।

    খলিফা জানতে চাইলেন, কোথায় আছে সে?

    —মক্কা তীর্থে সে এখন লালিত হচ্ছে।

    -তুমি ছাড়া আর কে কে জানে এ কথা?

    —হারেমের সব বাঁদীই জানে। অল রসিদ আর একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারলেন না। সেইদিনই তিনি জাফরকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা রওনা হয়ে গেলেন।

    এদিকে আব্বাসা তার এক গুপ্তচরের মারফতে মক্কায় বিয়াসের কাছে বার্তা পাঠালো, অবিলম্বে পুত্রকে নিয়ে ওখান থেকে পালাও। স্বয়ং খলিফা সেখানে যাচ্ছেন তার সন্ধানে। তোমরা অতি শীঘ্র শহর ত্যাগ করে ইয়ামিনে চলে যাবে।

    মক্কায় পৌঁছে খলিফা দিকে দিকে চর পাঠালেন। তারা দু’একদিনের মধ্যে খবর এনে দিলো, শাহজাদী আব্বাসার পুত্রকে ইয়ামিনের এক গৃহে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সে বেশ সুস্থ আছে।

    কয়েকদিনের মধ্যে ছেলেটিকে উদ্ধার করে খলিফা বাগদাদে নিলে এলেন।

    এর পরের ঘটনাটা ইউফ্রেট নদী-তীরে অল উমরের সেনাছাউনিতে সংঘটিত হয়েছিলো। এবং সে যে কী নিদারুণ হৃদয়বিদারক ঘটনা তা তো আপনারা শুনেছেন।

    আব্বাসা এবং তার শিশু পুত্রকে গোবরের গাদায় জ্যান্ত পুঁতে ফেলেছিলেন খলিফা।

    এরপর রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    নয়শো আটানব্বইতম রজনী :

    আবার সে বলতে থাকে : এবার খলিফা হারুন অল রসিদ সম্বন্ধে শুনুন, জাঁহাপনা :

    সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড শেষ করে খলিফা বাগদাদে ফিরে এলেন। কিন্তু অতি অল্পকালের মধ্যেই অনুভব করতে পারলেন, যে বাগদাদ তার কৈশোরের ক্রীড়াভূমি এবং যৌবনের উপবন ছিলো, আজ এই বিকেল বয়সে তা বিষবৎ হয়ে উঠেছে।

    সুলতান বাগদাদ পরিত্যাগ করে রাখাতে চলে গেলেন। এরপর আর কখনও তিনি ফিরে আসেননি। চির সুখের আবাসস্থল বাগদাদ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে কবি আব্বাস ইবন অল আহন লিখেছিলেন–

    যাবার সময় ওরা আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করেছিলো,
    আবার ফিরে এসো, ফিরে এসো এই নন্দনকাননে
    কিন্তু আমরা বেশ বুঝেছিলাম, এ শুধু বিদায় অভিনন্দন।
    তাই তো আমরা হাত নেড়ে বলেছিলাম, বিদায় বাগদাদ
    চির বিদায় তোমাকে।

    বন্ধু-বিয়োগের যে জ্বালা, খলিফা তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন। শেষের দিকে তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। যাকে তাকে ডেকে বলতেন, তোমরা কেউ আমার জাফরকে ফিরিয়ে দিতে পার? তার বদলে আমার গোটা সলনিয়ত দিয়ে দেব, পার কেউ আমার এ দুঃখ ঘোচাতে?

    বারমাকীদের সম্বন্ধে যদি কেউ কখনও একবিন্দু নিন্দা অপবাদ দিতখলিফা ক্রোধে ফেটে পড়তেন, খবরদার, জিভ কেটে ফেলবো।

    যদিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার বিশাল সলতানিয়তের একমাত্র নিয়ামক ছিলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বলতে গেলে তার হাতে তেমন কোনও ক্ষমতাই ছিলো না। তার চারপাশে মাছির মতো ভনভন করতে যারা, তারা ছিলো সবাই ছদ্মবেশী শয়তান। মুখে তোষামদ করতো খলিফাকে, কিন্তু আড়ালে আড়ালে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতো।

    খলিফা সব সময় শঙ্কিত থাকতেন, নিজের ঔরসজাত পুত্ররাই হয়তো তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে। তাদের ধারণা অল রসিদ অনেক কাল তখতে বসে আছেন। এখন আর সেটা আঁকড়ে থাকা তাঁর পক্ষে উচিত নয়।

    খলিফা স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন তার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। একান্ত অনুরক্ত বিশ্বস্ত নফর চাকররা দিন দিন কেমন বিগড়ে যাচ্ছে। এই সব তার দুই পুত্রের কারসাজী। মাসরুরের মতো অনুগত নফর তাঁর প্রিয় পুত্র অল মামুনের গুপ্তচর হয়ে খলিফার পাশে পাশে থেকে নজর রেখে চলে। খলিফার ব্যক্তিগত হাকিম জিবরিল—সে আবার অল আমিনের দূত হয়ে সকাল সন্ধ্যা সব খবর পাচার করে দেয়।

    এ সবই খলিফার জানা। তিনি জানতেন, তার দিন শেষ হয়ে এসেছে, কোনদিন তার ছেলেদের হাতেই তার মৃত্যু ঘটবে।

    একদিন খলিফা একটি স্বপ্ন দেখলেন : কে যেন তার মাথায় খানিকটা রাঙা মাটি ছড়িয়ে দিয়ে বলছে এই মাটিতেই তোর শান্তি হবে। আবার যেন প্রশ্ন করলো, কোথায় পাওয়া যাবে এ মাটি? উত্তর শোনা গেলো তুস-এ।

    খলিফা আর বিলম্ব করলেন না। পরদিনই তাঁর তাজি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন। তুস-এ যেতে হবে তাকে।

    কয়েকদিন একটানা চলার পর তুস-এ প্রবেশ করেই খলিফা মাসরুরকে বললেন, যা দেখতো এখানে শেথায় পাওয়া যায় সেই রাঙা মাটি—নিয়ে আয় খানিকটা।

    ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এলো মাসরুর। তার হাতে টকটকে লাল রঙের এক চাই মাটি। খলিফা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, পেয়েছি, পেয়েছি। আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে মাসরুর! এই লাল মাটিই স্বপ্নে দেখেছিলাম। আর কোনও চিন্তা নাই, এবার আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তিনি আমাকে ডেকেছেন, যেতে হবে।

    এরপর আর তার ইরাকে ফেরা হয়নি।

    পরদিনই খলিফার দেহ-মন দুর্বল হয়ে পড়ে। তার পার্শ্বচরদের তিনি বললেন, সেই পরম লগ্ন সমাগত। আমি সারা দুনিয়ার ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু জানি, আজ তারাই আমার জন্য দু ফোটা চোখের জল ফেলতে দ্বিধা করবে না।

    জামাদা মাসের তৃতীয় দিবসে খলিফা তুস ভূমিতে দেহ রাখলেন। সনটা ছিলো একশো তিরানব্বই হিজরী। আবুল ফিদার হিসেব মতে সাতচল্লিশ বছর পাঁচমাস পাঁচদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন খলিফা হারুন অল রসিদ।

    আল্লাহর তার সকল ভুল ভ্রান্তি মার্জনা করে দয়াপরবশ হোন। তিনি ছিলেন এক ধর্মান্ধ গোঁড়া সুলতান।

    শাহরাজাদ দেখলো, তার কাহিনী শুনতে শুনতে সুলতান শাহরিয়ার গভীর বেদনাহত হয়ে চোখের জল মুছছেন। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে শাহরাজাদ একটি মিষ্টি মধুর প্রেম উপাখ্যান শুরু করে দিলো।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.