Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ১.১৬ বড় বোন জুবেদার কাহিনী

    বড় বোন জুবেদার কাহিনী

    পরদিন রাত্রে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ। শুনুন শাহজাদা, সেই সুন্দরী তিন বোনের বড় জন তখন দরবার কক্ষে খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে তার জীবনের কাহিনী বলতে লাগলো—

    জাঁহাপনা, আমার নাম জুবেদাহ, আমার ছোট যে, অর্থাৎ মেজো, তার নাম আমিনাহ আর সবার ছোটর নাম ফহিমাহ। আমাদের তিন বোনের বাবা এক কিন্তু মা আলাদা। আমার বাবার তিন বিবি। প্রথম বিবি আমার মা। তার আরও দুই মেয়ে ছিলো আমার সহোদরা। তারা দু’জনই আমার চেয়ে বড়ো। কিন্তু আমার দুই বিমাতার এই দুই কন্যা—আমিনা আর ফহিমার চেয়ে আমি বয়সে কিছু বড়।

    আমার বাবা মারা যাবার সময় পাঁচ হাজার দিনার রেখে গিয়েছিলো আমাদের জন্য। ফহিমা আর আমিনা চলে গেলো তাদের মায়ের কাছে। আমি আর আমার দুই বড়বোন একত্রে রয়ে গেলাম।

    কিছুদিনের মধ্যে আমার বড় দুই বোন শাদী করলো। দিদিদের পয়সাকডি যা ছিলো তাই দিয়ে সওদাগরী ব্যবসা করবে। আমার দুই ভগ্নিপতি একদিন সমুদ্ব-যাত্রা করলো। দিদিরাও তাদের সঙ্গে চলে গেলো।

    চার বছর কেটে গেলো। একদিন দীন ভিখারীর বেশে ফিরে এলো তারা। তাদের শতছিন্ন নোংরা ময়লা জামাকাপড় দেখে প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি। শীর্ণকায় দেহ। রুক্ষ এলোমেলো চুল। কলিবৰ্ণ গায়ের রং। গর্তের মধ্যে বসে গেছে চোখ। তুবড়ে গেছে গাল! চোয়ালের হাড় বেরিয়ে গেছে। দুঃখে কষ্টে অনাহারে অনিদ্রায় হারিয়ে গেছে রূপের জৌলুষ। হাড় জিরজিরে কঙ্কাল-সার দুটি রূপ যৌবন খোয়ানো মেয়েছেলেকে দেখে কি করে বিশ্বাস করি এরাই আমার সেই পরমা সুন্দরী রূপবতী দুই দিদি। পরিচয় দিতে তবে বুঝলাম।

    রাতারাতি বড়লাক হবার বাসনায় সওদাগর হয়ে বিদেশে বাণিজ্য করতে বেরিয়ে সব খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়। সওদা সামান, পয়সাকডি সব ডাকাতরা লুঠ করে নিয়েছিলো। তারপর একদিন এক অচেনা শহরে তাদের দু-বোনকে অচেনা লোকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায়। তারা। অনেক দুঃখে কষ্টে এতোদিনে দেশে ফিরে আসতে পেরেছে। দিনের পর দিন শুধু নদীর জল খেয়ে আর গাছতলায় শুয়ে কাটাতে হয়েছে। দু-বছরের মধ্যে গোসল করতে পারেনি তারা। পরনের একখানা মাত্র বস্ত্ব সম্বল। তাও শতছিন্ন ময়লা।

    তাদের দুঃখের কাহিনী শুনতে শুনতে চোখে জল আসে আমার! সান্ত্বনা দিয়ে বলি, যা হয়েছে তা নিয়ে আর দুঃখ করো না দিদি। আল্লাহর বোধহয় এইরকমই ইচ্ছে ছিলো। তার বিধান কেউ খণ্ডাতে পারে না।

    নতুন জামাকাপড় দিলাম। ভালো করে ঘসেমোজে সাফ করে গোসল করলে তারা। এক সঙ্গে বসে খানাপিনা করলাম। নতুন করে জীবন গড়ার অনেক কথাই হলো। বললাম, তোমরা আমার বড়বোন। বাবা মারি অবর্তমানে বলতে গেলে তোমরাই আমার একমাত্র আপনজন, অভিভাবক। আল্লাহর দেয়ায় আমি যা পেয়েছিলাম, এই ক’বছরে তা বেড়ে অনেক হয়েছে। সেই লাভের টাকাটা নিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য করে রুজি রোজগারের ধান্দা করো। দেখো সুখে স্বচ্ছন্দে দিব্যি চলে যাবে আমাদের।

    আমার কাছেই তারা রইলো বছরখানেক। একদিন দুই বোন এসে আমাকে বললো, দেখ ছোট, বিয়েই মেয়েদের কাছে সব চেয়ে বড়। আমরা ভেবেছি আবার শাদী করবো।

    শঙ্কিত হয়ে বললাম, দেখ দিদি একবার শাদী করেও তোমাদের শিক্ষা হয়নি। কী মধু পেয়েছ। শাদী করে? আজকাল দুনিয়ায় সাচ্চ মানুষ কটা খুঁজে পাবে? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়।

    কিন্তু ওরা আমার কথায় কান দিলো না। আমাকে গোপন করেই শাদীর পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেললো ভিতরে ভিতরে। অবশ্য সবই আমি জানতে পারলাম। পরে। আমার মত না থাকলেও নিজেই সব ব্যবস্থ-পত্র করে শাদী দিয়ে দিলাম দু’জনের। আমার সাধ্যমত পয়সাকডি দান সামগ্ৰী সবই দিলাম। তাদের এই নতুন স্বামীরাও কিন্তু আবার সেই একই ভাবে বিদেশে রওনা হয়ে গেলো বাণিজ্য করতে। আমার দিদিদেরও নিয়ে গেলো সঙ্গে।

    আবার সেই কাণ্ড। এবার আর বেশি দিন দেরি হলো না। কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরে এলো তারা সব খুইয়ে, একেবারে কপর্দক শূন্য ভিখিরি হয়ে। তাদের স্বামীরা দু’জনেই ঠগ প্রবঞ্চক। এক অজানা বন্দরে ভুলিয়ে ভালিয়ে নামিয়ে দিয়ে জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। ওরা এসে বললো, দেখ ছোট আমাদের বকবিকি করিসনে। ভুল আমরা করেছি। ঠিকই। কিন্তু হাজার হলেও তোর বড়বোন তো আমরা। তোর না হয় বুদ্ধিসুদ্ধি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তা বলে কি আমাদের ফেলে দিবি? এবারকার মতো ক্ষমাঘেন্না করে নে বোন। কথা দিচ্ছি। এ পোড়ার মুখে আর কখনও বিয়ে শাদীর নাম উচ্চারণ করবো না।

    আমি তাদের আদর আপ্যায়ন করে বসালাম। বললাম, তা ভুল মানুষেরই হয়। ভুলের জন্য অনুতাপ হলেই যথেষ্ট। কী আছে, আবার নতুন করে শুরু করো জীবন।

    বছরখানেক কেটে গেছে। আমরা তিন বোন একসঙ্গে থাকি। আমি মনে মনে ঠিক করলাম, বাণিজ্যে যাবো। সব ব্যবস্থা পাকা করে দুই দিদিকে বললাম, আমি বিদেশে বাণিজ্যে যাবো ঠিক করেছি। তোমরা যদি সঙ্গে যেতে চাও চলো। না হলে বাড়িতেই থাকে।

    তারা বললো, তারাও যাবে আমার সঙ্গে। সুতরাং ওদের দু’জনকে সঙ্গে করে একদিন সমুদ্রযাত্রা করলাম। সব টাকাটা আমি সঙ্গে নিলাম না। অর্ধেকটা লুকিয়ে রেখে গেলাম বাড়িতে। বাকী অর্ধেক নিলাম সঙ্গে কি জানি, বিদেশে বিভূঁই। যদি খোয়া যায়। তবে খালি হাতে দেশে ফিরে পথে না বসি।

    দিনের পর দিন সমুদ্র পাডি দিয়ে চলেছি। কিন্তু কুলের হদিশ পাওয়া গেলো না। চিন্তিত হলাম আমি। কপ্তেন বললো, আমাদের বরাত খারাপ। পথ হারিয়ে ফেলেছি। এক অচেনা সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। জানি না কি হবে। এখানকার জল বড় বেয়াড়া। এমন এলোপাথাড়ি মারাত্মক ঢেউ আমাদের সমুদ্রে কখনও হয় না।

    যাই হোক, জাহাজের গতি ঘুরিয়ে নিয়ে দিন দশেক বাদে একটা বন্দর পাওয়া গেলো। কাপ্তেন বললো, এ বন্দর তার অচেনা। এর আগে কখনও সে আসেনি। এখানে। এই সমুদ্রের নামও তার অজানা। তবে এটুকু বোঝা যায়, বিপদ অনেকটা কেটে গেছে। একেবারে অকূল পাথরে পড়ে প্রাণ হারাতে হবে না। এখন শহরটা ঘুরে দেখতে হবে। সওদাপত্র কিছু হয় কি না। আমি বললাম, জাহাজ নোঙর করো, দেখা যাক, কিছু বাণিজ্য করা যায় কিনা।

    ঘণ্টাখানেক বাদে বন্দরে পৌঁছনো গেলো। কাপ্তেন জানালো, বন্দরের নাম ডিসেম্বার্ক। আল্লাহর নাম করে শহরে ঢুকে পড়ে। দেখা কি হয়।

    শহরে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। কিন্তু কি অবাক কাণ্ড, যেদিকে তাকাই সমস্ত ঘরবাড়িগুলো দেখলাম কলো পাথরের তৈরি। পথেঘাটে কোন জনপ্ৰাণী নাই। কিন্তু দোকান-পাট সব সাজানো গোছানো, ঝকঝকে তকতকে। দামি দামি সোনা রূপার তৈরি সামানপত্রে ঠাসা। কী ব্যাপার, কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না।

    রাস্তার চৌমাথায় এসে আমরা চারজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লাম। সবারই উদ্দেশ্য, দামি দামি সোনারূপার গহনা আর বাহারী সাজপোশাক সংগ্বহ করা।

    আমি চললাম প্রাসাদের দিকে। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো, বিশাল এক প্রাসাদ। তার সিংহ দরজাটা পুরো সোনার তৈরি। ভিতরে ঢুকে প্রাসাদের প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেটাও সোনার। মখমলের পর্দা ঝুলছে। পর্দা উঠিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। বিরাট এক দরবার মহল। হীরা মণি মাণিক্যখচিত সিংহাসনে বাদশাহ বসে আছেন। তার দুই পাশে উজির আমীর ওমরাহ, গণ্যমান্য ব্যক্তি। কেউবা সোনা কেউ বা রূপার চেয়ারে আসীন। দরবার কক্ষের চারপাশে সশস্ত্র সিপাহী মোতায়েন। কিন্তু সবাই অনড় অচল নিম্প্রাণ পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু কেন? কার অভিশাপে? কিছুই অনুমান করতে পারলাম না।

    দরবার ছাড়িয়ে ভিতরে ঢুকলাম। হারেম। আরও সুন্দর আরও মনোহর। দরজা জানালা, খািট পালঙ্ক চেয়ার টেবিল যাবতীয় আসবাবপত্র সব সোনার তৈরি। সূক্ষ্ম কারুকার্য করা সিল্ক আর মখমলের পর্দায় ঢাকা জানালা দরজাগুলো। হারেমের মাঝখানে এক দঙ্গল বেগম, পরিচারিকা, দাসী, খোজা। যে যেমনভাবে ছিলো, পাথর হয়ে গেছে। মূল্যবান হীরা মণিমুক্তার রত্নাভারণে সজ্জিতা এক যুবতীকে দেখে বুঝলাম, হারেমের সে প্রধান বেগম। নিশ্চল নিথর পাথরের মূর্তি হয়ে পালঙ্কে অর্ধশায়িতা।

    আরও একটু এগিয়ে একটা রূপার দরজা খুলে আরও অবাক হই। একটা বিরাট চবুতরা। সাতটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। শ্বেত পাথরে তৈরি এই মঞ্চটা আগাগোড়া কর্পেটে মোড়া। কাপোিটখানা সোনার জডি দিয়ে তৈরি। একপাশে মখমলের গদি বিছানো এক বিরাট ফরাশ। অন্য দিকে একখানা বাদশাহী শয্যা। সারা মঞ্চটা আলো ঝলমল করছিলো, এতো আলোর উৎস কিন্তু একটা বিরাট হীরা। একটা ছোট্ট মেহগনি কাঠের টুলের ওপরে রাখা ছিলো

    সারা মঞ্চটা নিপুণভাবে সাজানো গোছানো। মনে হয়, কোন জীবন্ত মানুষের হাতের ছোঁয়া আছে সর্বত্র। তা না হলে এমন ঝকঝকে তকতকে থাকতো না সব। হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে কেউ। এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করতে লাগলাম। কিন্তু না, অনেকগুলো মহল ঘুরলাম-কোথায়ও কোন জীবন্ত মানুষ দেখলাম না। যাদের দেখলাম সবই পাথরের। এটুকু বেশ বোঝা যায়, ওরা সবাই একদিন রক্তমাংসের মানুষ ছিলো। হয়তো কোন কারণে কোন এক মুহুর্তে পাথর হয়ে গেছে। পাথর হওয়ার আগে যে যে ভঙ্গীতে ছিলো সে সেই ভঙ্গীতেই রয়ে গেছে।

    সমস্ত ব্যাপারটা জানার জন্যে তখন আমার মন আকুলি বিকুলি করছে। কিন্তু কোন জীবন্ত মানুষের সন্ধান পাওয়া না গেলে কে বলবে সে সব কথা। এবং আমার মনে হলো, কেউ না কেউ আছেই। আছে যে, তার কিছু প্রমাণও আমি পেয়েছি। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। তখন আমার নেশায় পেয়ে বসেছে। সব ভুলে গেলাম। কে আমি—কোথা থেকে এসেছি। আমার জাহাজ, আমার বাণিজ্য, সব মন থেকে হারিয়ে গেছে তখন। এমহল থেকে ওমহলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সন্ধ্যা নেমে এলো। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ফিরে এলাম আবার সেই ঘরে। ফ্ল্যেখানে চবুতরার ওপরে সোনার কার্পেটের ওপর ফরাশ আর এক দিকে ছিলো বাদশাহী শয্যা। সেই সাতটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে শয্যায় শুয়ে পড়লাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে পড়েছি। একখানা শাল টেনে নিলাম বুক অবধি। মাথার কাছে রাখা ছিলো একখানা পবিত্র কোরান। শোবার সময় রোজ রাতে কোরান পড়া আমার বহুকালের অভ্যাস। আল্লাহর বাণী পড়তে পড়তে মনটা বেশ প্রশান্ত হয়ে যায়। তখন ঘুমিয়ে পড়ি। সারারাত বেশ সুখ-নিদ্রা হয়। কোরানখানা তুলে নিলাম! সোনার পাত দিয়ে বাঁধানো, সোনার জলে লেখা একখানা খুব সুন্দর বই। আমাদের ধর্মগ্রন্থ। কয়েকটা উপদেশবাণী পড়লাম। তাঁর অপার মহিমার কথা পড়তে পড়তে দেহ মনের সব শ্রান্তি কেটে গেলো! এবার একটু ঘুমোবার চেষ্টা করতে থাকলাম।

    রাত্রি যখন দ্বিতীয় প্রহর তখনও আমি জেগে। এপোশ ওপাশ করছি, কিন্তু ঘুম আসছে না। হঠাৎ একটা হাল্কা এক সুমধুর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। বেশ কিছু দূরে কে যেন কোরাণের পয়ার সুর করে আবৃত্তি করছে। শয্যা ছেড়ে উঠে পড়লাম। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। একটা ছোট্ট খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হলো আওয়াজটা এদিক থেকে ভেসে আসছে। ভিতরে ঢুকলাম। আমার হাতে ছিলো একটা চিরাগবাতি। তার আলোয় দেখলাম, ভিতরটা এক মসজিদ। একটা সবুজ রঙের স্তিমিত বাতি জুলছে। মেজের ওপর একখানা কম্বল বিছানো। তার উপর পূর্বদিকে মুখ করে হাঁটুগেড়ে নামাজের ভঙ্গীতে বসে এক প্রিয়দর্শন নওজয়ান পবিত্র কোরান পাঠ করছে। কী অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠ, আর কী পরিষ্কার উচ্চারণ! মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে একাগ্র চিত্তে কোরান পাঠে মগ্ন হয়ে গেছে সে। কে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে–কোন দিকে খেয়াল নাই তার।

    আমার মনে তখন একটা কথাই হানা দিচ্ছে। এই প্রাসাদপুরীতে—অথবা আরো ভালো বিশেষণে ভূষিত করলে বলতে হয় পাষাণ পুরীতে সবাই যখন কোন কারণে পাষাণে পরিণত হয়ে গেছে তখন এই যুবক কী করে অব্যাহতি পেলো? সে যদি সেই মুহূর্তে প্রাসাদের বাইরেও কোথাও থেকে থাকতো। তবু তো এ অভিশাপ থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার কথা নয়। কারণ, গোটা শহরটারই তো এই একই দশা।

    আমি তার পাশে গিয়ে সালাম জানালাম। সেও আমাকে সালাম জানালো। আমি বললাম, তোমার অপূর্ব কোরান পাঠ আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। তুমি বন্ধ করো না, আল্লাহর পবিত্র বাণী শুনে আমিও ধন্য হই।

    সে একটু হাসলো। বললো, আচ্ছা সুন্দরী, আগে বলো, এখানে এলে কি করে তুমি? তারপর তুমি যা শুনতে চাইবে শোনাবো আমি।

    আমি আমার কাহিনী শোনালাম তাকে। এবার তাকে প্রশ্ন করলাম, এ শহরে প্রবেশ করেই তাজ্জব বনে গেছি। এখানকার জনমানব পশুপক্ষী সব পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে কী করে? আর একমাত্র তুমিই বা কী করে অব্যাহতি পেয়ে গেছে?

    কোরানখানা বন্ধ করে একটা সাটিনের থলের মধ্যে ভরলে সে। আমাকে তার পাশে বসতে বললো। আমি বসলাম। তার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। রূপের মাধুর্যে ভরা অপূর্ব সুন্দর সেই মুখ। যেন এক পূর্ণ চাঁদের মায়া। তার সৌম্য প্রশান্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কী সুঠাম সুন্দর তার দেহের গড়ন।

    তখন তন্ময় হয়ে রূপের সমুদ্রে আমি স্নান করছি। সারা শরীরে শিহরণ লেগেছে আমার। বুকের মধ্যে বহ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে। কিন্তু কেন? আগে তো কখনও দেখিনি তাকে। এই তো প্রথম পরিচয়। তবে কেন এমনভাবে আমার সব ওলোটপালট হয়ে যেতে লাগলো। কী যাদু আছে তার ঐ রূপে? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, শাহজাদা, মেহেরবাণী করে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

    সে বললো, নিশ্চয়ই। এবার বলছি, শোনো সুন্দরী!

    এ শহরের সুলতান ছিলেন আমার বাবা। ধনে জনে পূর্ণ ছিলো তার সাল-তানিয়া। কারো কোনও অভাব ছিলো না। প্রজারা প্ৰাণ দিয়ে ভালোবাসতো আমার বাবাকে। বাবারও খুব নাম যশ ছিলো প্রজাবৎসল হিসাবে। কিন্তু এমনি নিয়তি, আজ সারা দেশের মানুষজন, পশুপক্ষী সব পাষাণ হয়ে গেছে। ঐ যে দরবার মহল দেখছো, সিংহাসনে যিনি বসে আছেন। পাথর হয়ে, তিনি আমার বাবা। আর হারেমে দেখেছো, প্রধান বেগম-যিনি পালঙ্কে অর্ধশায়িত-পাষাণ-প্রতিমা, তিনি আমার মা। এঁরা দুজনেই যাদুবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নারদুন-এর উপাসক পরম নাস্তিক আমার মা-বাবা ইসলামে বিশ্বাস করতেন না। শয়তান নারদুন তাদের ঘাড়ে ভর করেছিলো।

    বহুকাল পর্যন্ত বাবা-মার কোন সন্তানাদি ছিলো না। আমিই তাদের ঘরে একমাত্র পুত্র জন্ম নিলাম। স্বভাবতই বুঝতে পারছে আদর যত্নের সে কী ভীষণ ঘটা। আমাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত। আমার খাওয়া দাওয়া, আমার খেলাধূলা, পড়াশুনা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে সবাই তটস্থ। বাবা-মোর শুধু চিন্তা—আমি কি করে মানুষের মতো মানুষ হবো। বড় হয়ে আমি তার শাসনভার হাতে নিয়ে সুনামের সঙ্গে প্রজােপালন করবো—এই তীর একমাত্র বাসনা ছিলো। সেই সঙ্গে আর একটা ইচ্ছেও তার ছিলো, আমি যাতে সেই ভয়ঙ্কর শয়তান নারদুন-এর ভক্ত হই।

    আমাদের এই প্রাসাদে এক বৃদ্ধা মহিলা ছিলো। গোপনে গোপনে সে আল্লাহর নামাজ করতো। আল্লাহর পয়গম্বর হজরত মহম্মদের নামগান করতো। কিন্তু বাবা-মার কাছে এমন ভাব দেখাতো যেন মনে হতো ইসলামের সব চেয়ে বড় শত্রু সে। বাবা তাকে খুব ভালো চোখে দেখতেন। আমার দেখ-ভালের ভার পড়লো তার উপর। বাবার ধারণা ছিলো, বৃদ্ধাও তীর ধর্মে বিশ্বাসী। ছেলেকে সে তার মনের মতো করে মানুষ করে তুলবে। এই অগাধ বিশ্বাস বাবার ছিলো। আমার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব বৃদ্ধার ওপর চাপিয়ে দিয়ে বাবা তাকে বলেছিলেন, তুমি বিদ্যায় বুদ্ধিতে এই প্রাসাদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। তোমার হাতে আমার একমাত্র সন্তান, আমার বুকের কলিজাকে তুলে দিচ্ছি। তুমি ওকে আদর্শ মানুষ করে গড়বে। যাতে সে এক আদর্শ সুলতান হয়ে আমার মুখ উজ্জ্বল করে, দেশের মুখ উজ্জ্বল করে। আর তাকে আমার একমাত্র উপাস্য দেবতা সর্বশক্তিমান নারদুনের মন্ত্রে দীক্ষা দেবে। যাতে সে তার যোগ্য ভক্ত হতে পারে।

    বৃদ্ধ বাবাকে আশ্বাস দেয়, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, জাঁহাপনা। আমি তাকে শিক্ষায় দীক্ষায় আদর্শ মানুষ করে তুলবো।

    কিন্তু সে আমাকে ইসলামের ধর্মে দীক্ষা দিলো। সর্বশক্তিমান আল্লাহর অপোর মহিমা, তার বাণী তার ফরমান শোনাতে লাগলো। পবিত্র কোরান পড়ে শোনাতো আমাকে। আল্লার পয়গম্বর মহম্মদের কাহিনী শোনাতো। আমি প্ৰাণ-মন দিয়ে শুনতাম। সে-সব ধর্মকথা। ধীরে ধীরে এক সাচ্চা মুসলমান হয়ে উঠতে লাগলাম আমি।

    বৃদ্ধ আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলো, দেখো বাবা, তোমার আব্বাজান যেন ঘৃণাক্ষরেও টের না পায়। তাহলে গর্দান যাবে আমার। আমি তোমাকে আদর্শ মানুষ করে গড়তে চাই। কিন্তু ইসলাম বিশ্বাসী না হলে আদর্শ মানুষ হতে পারে না কেউ। তোমার বাবার ধর্ম অসত্যের, অবিশ্বাসের, ধ্বংসের ধর্ম। নারদুন এক মহা শয়তান। ঝাড়ফুক মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে সে লোককে বশ করতে পারে। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা দয়া দান উদারতা মহত্ব তার ধাতে নাই। সে শুধু জানে জ্বালাতে পোড়াতে, ধ্বংস করতে।

    আমার শিক্ষা দীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে আসছে এমন সময় একদিন সেই বিদুষী বৃদ্ধ দেহ রাখলো।

    একদিন গভীর রাতে শহরের সবাই যখন নিদ্রামগ্ন আল্লাহ স্বপ্ন দেখালেন প্রত্যেক শহরবাসীকে।—তোমরা জাগো, ওঠে। আমিই একমাত্র আল্লাহ-আমার হুকুমেই তামাম দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই জগতে যা কিছু দেখছো সবই আমার সৃষ্টি। আবার আমাতেই লয় হবে তারা। আমি ছাড়া তোমাদের কোন গতি নাই। তোমরা এখন মোহাচ্ছন্ন হয়ে ঘোর পাপে লিপ্ত আছো। শয়তান নারদুন তোমাদের যাদু করে রেখেছে। তাকে তোমরা একমাত্র উপাস্য বলে মনে করছে। কিন্তু ভুল। সে তোমাদের মোক্ষদাতা নয়। পাপের পঙ্কিল থেকে সে কখনও উদ্ধার করতে পারবে না তোমাদের। কারণ, সে ক্ষমতা তার নাই। পাপই তার একমাত্র সহায়। ধ্বংসই তার একমাত্র সম্বল। কী করে সে নিয়ে যাবে তোমাদের পুণ্য লোকে। কী করে সে দেবে সৃষ্টির আনন্দ? ওঠো-জাগো। আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে থেকে না। আমার নামগান করো। মুক্তির আনন্দ পাবে।

    পরদিন সকালে শহরবাসীরা সন্ত্রস্ত, ভীতচকিত হয়ে সুলতানের দরবারের এসে হাজির হলো। সব শুনে সুলতান অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। ঘাবড়াও মাৎ। ওই শয়তানটা আমাকেও ওই একই স্বপ্ন দেখিয়েছে। ভয় দেখিয়ে বলেছে, আমি যদি তার কথা না শুনি তবে নাকি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। হা-হা-হা-। ধ্বংস হবে না ঘণ্টা হবে। ঐ সব শয়তানের শয়তানিতে ডরো মাৎ। আমি সব শায়েস্তা করে দেবো নারদুনকে দিয়ে। ওসব দুশ্চিন্তা বিলকুল মুছে ফেলো মন থেকে নিজের নিজের কাজকাম করো, খাওদাও, নাচো গাও। ওসব মনে রেখো না। নারদুন সর্বশক্তিমান–তিনিই রক্ষা করবেন।

    প্রজারা অবনত মস্তকে ফিরে গেলো। একটা বছর কেটে গেছে। প্রজারা ভুলে গেছে সে রাতের স্বপ্নের কথা। এমন সময় আর এক রাত্রে আকাশ থেকে দৈববাণী শোনা গেলো। তোমরা আমার ফরমান শুনছে না। এখনও সময় আছে। শয়তানের কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে আমার প্রতি আস্থা রাখে। না হলে সর্বনাশ হবে।

    গগন বিদারী সেই আওয়াজে হৃদকম্প ধরে যায় শহরবাসীর। কিন্তু আবার সেই সুলতানের তাড়ফানী। কোন ভয় নাই। অগ্নির উপাসনা করে যাও তিনিই একমাত্র মোক্ষদাতা।

    পরের বৎসর আবার ঠিক সেই দিনে-গভীর রাতে আবার সেই গগন ভেদী আওয়াজ শোনা গেলো। এভাবে আরও জোরালো আরও ভয়ঙ্কর হুকুমনামা শোনা গেলো।

    এইভাবে পর পর দিন বৎসর ঠিক একই দিনে—একই সময়ে  আল্লাহর ফরমান শোনা গেলো। কিন্তু সুলতান তার সেই এক গোঁ ধরে বসে রইলো।

    এর পরিণাম হলো ভয়াবহ। একদিন সকালে সবাই যখন শতকর্মেরত তখন আকাশপথে এক উস্কার আবির্ভাব হলো। সারা শহরটা বিজলীর আলোয় চমকে উঠলো এক মুহুর্ত। ব্যাস, উত্তরপরই সব শেষ। শহরের প্রতিটি মানুষ পরিণত হয়ে গেলো পাষাণে। গাধা, ঘোড়া,  উট, খচ্চর—সব প্রাণী পাথর হয়ে যে যেখানে যেমনটি ছিলো, দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু আমি-একমাত্র প্ৰাণী ইসলামে বিশ্বাসী–বেঁচে গেলাম।

    সেই থেকে আমি একা। আল্লার নামগান করে, কোরান পাঠ করে দিন কটাই। সঙ্গী সাখী। বলতে কেউ নাই আমার। আমি বড় একা। আজ বহুকাল বাদে তুমি এলে, তাই প্ৰাণ খুলে দুটো কথা বলতে পারলাম। তোমাকে আজ কাছে পেয়ে কি যে ভালো লাগছে, সুন্দরী, কী বলবো?

    তার কথা বলার ঢং-এ কী এক যাদু আছে—আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বললাম, আমাদের বাগদাদ শহরে চলো না, দেখবে তোমার আরও ভালো লাগবে। সেখানে কেউ কাউকে ঠকায় না। সবাই সবাইকে ভালোবাসে। আর সেখানকার সুলতান-খলিফা হারুন-অল-রশিদ আল্লার পীর। দয়ার সাগর। তার কাছে হাত পাতলে কেউ কখনও বিমুখ হয় না। দুনিয়াতে যদি বেহেস্ত কোথাও থেকে থাকে। তবে সে বাগদাদে।। চলো, ওখানে চলে যাই আমরা। সেখানে ইসলামের অনেক আদর্শ লোকের সঙ্গে তোমার মোলাকগৎ হবে। তাদের কাছ থেকে ইসলাম ধর্মের আরও গভীর তত্ত্বের সন্ধান পাবে। আর দ্বিধা করো না চলো কাল সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। সেখানে আমার প্রাসাদের মতোবাড়ি আছে। ধনদৌলত যা আছে, বেশ চলে যাবে আমাদের। বাগদাদ শহরে আমার যথেষ্ট খ্যাতি প্রতিপত্তি নাম যশ আছে। লোকে খাতির করে আমাকে। তোমাকেও করবে। এতোকাল আমি শাদী নিকা করিনি। তার কারণ বোধহয় তুমি, তোমাকে পাবো বলেই অন্য কাউকে মনে ধরেনি। চলো, আমরা বাগদাদে গিয়ে ঘর বাঁধবো, স্বৰ্গ রচনা করবো। তুমি হবে আমার মালঞ্চের মালাকার। আমি হবো তব প্রিয়া। আল্লাহর বোধহয় এইরকমই ইচ্ছ। তা না হলে সমুদ্রে পথ হারিয়ে অচেনা-অজানা সমুদ্রে গিয়েই বা পড়বো কেন। আর কেনই বা ভেড়াবো। আমার তরী–এই নাম না জানা বন্দরে! সবই নিয়তি। এ শহরে না এলে তোমার দেখা পেতাম?

    এই সময় শাহরাজাদ দেখলো ভোর হয়ে আসছে। কাহিনী থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

     

    পরদিন সপ্তদশ রজনী।

    -শুনুন, জাঁহাপনা, শাহরাজাদ বলতে শুরু করে, জুবেদা তখন সেই শাহজাদার প্রেমে ডগমগ। সে রাত্রে সেই প্রিয়দর্শন যুবকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করার সাধ্য ছিলো না তার। তাদের সারাটা রাত কিভাবে কেটেছিলো সে বর্ণনা খলিফা-হারুন-অল-রাসিদের কাছে দেয়নি জুবেদা। দেয়নি অথবা দিতে পারেনি, সে কথা জানি না। অল্প অল্প কথাবার্তা শেষে বাকী রাতটায় সে কি পেয়েছিলো অথবা পায়নি তা তার জবানীতে বলা হয়নি। আপনি অনুমান করে নিন, কী ঘটতে পারে!

    সকালবেলায় দেখা গেলো, জুবেদা সেই যুবকের পায়ের কাছে শুয়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে।

    এবার জুবেদার জবানীতেই কাহিনী শুরু করি :

    সকালবেলায় ঘুম ভাঙ্গতেই উঠে পড়লাম। প্রাসাদের মূল্যবান, ধনরত্ন, যতটা পারলাম পোটলা বেঁধে নিলাম। শাহজাদাকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে ফিরে এসে দেখি কাপ্তেন, আমার দিদিরা আর কুলিকামিন সবাই দারুণ উৎকণ্ঠায় বসে আছে। আমাকে দেখে হাসি ফুটলো তাদের মুখে। দিদিরা জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছিলো তোর। কাল ফিরলি না কেন? আর এ কে?

    আমি বললাম, এ হচ্ছে এখানকার বাদশাহর ছেলে; আমাদের সঙ্গে বাগদাদে যাবে। আমার সঙ্গে থাকবে। ঘর বাধবো আমরা।

    তারপর গতকালের আদ্যোপান্ত সব কাহিনী বললাম। তাদের। কপ্তেন এবং আমার জাহাজের কর্মচারীরা মহা খুশী হলো। কিন্তু লক্ষ্য করলাম আমার দুই দিদির মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। এতো ধন-দৌলত এবং তার সঙ্গে সুন্দর সুপুরুষ এক শাহজাদা জোগাড় করে এনেছি দেখে খুশি হতে পারলো না তারা।

    জাহাজ ছেড়ে দিলো। শাহজাদা আমার কাছ ছাড়া হয় না। সারা দিন-রাত আমরা ভালোবাসার সায়রে গা ভাসিয়ে থাকি। আমার দিদিরা হিংসায় জ্বলতে লাগলো। দু’ দুবার শাদী করে সংসারী হওয়ার সাধ করেছিলো তারা। কিন্তু বিধি বাম। কপালে নাইকে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী।

    এমন সুন্দর সুপুরুষ শাহজাদা তারাও আশা করেছিলো জীবনে। কিন্তু তার বদলে জুটেছিলো ঠগ প্রতোরক জংলীজানোয়ার। দুই বোন মিলে ফন্দী আঁটতে লাগলো। খতম করতে হবে আমাদের দুজনকে। তাহলে বুকের জ্বালাও জুড়াবে, আবার আমার ধনদৌলতও সব হাতানো যাবে। আমি কিন্তু তখন অন্য জগতে। ভালোবাসার এমন মধুর স্বাদ এর আগে তো কখনও পাইনি। তাই আমরা দুজনে তখন একান্ত আপন হয়ে এই সব হিংসা দ্বেষের অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছি। নিকষিত হেম আমাদের প্রেম তখন সমাজ সংসার ছাড়িয়ে ইন্দ্রলোকের অমৃত আহরণে ব্যাকুল।

    হাওয়া আমাদের অনুকূল। জাহাজ চলেছে। সমুদ্র শান্ত। চিন্তার কোন কারণ নাই। এমন চলতে থাকলে তাড়াতাডিই পৌঁছে যাবো দেশে। দিনকয়েক পরে বসরাহ বন্দরে পৌঁছে গেলাম। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জাহাজ নোঙর করা হলো। খানাপিনা সেরে সবাই আমরা শুয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা।

    কিন্তু আমার দুই দিদি ঘুমোলো না। তারা পা টিপে টিপে আমাদের কামরায় এসে দাঁড়ালো। খুব সন্তৰ্পণে আমাদের ঘুমন্ত মানুষ দু’টোকে তুলে নিয়ে গিয়ে জলের মধ্যে ছুঁড়ে দিলো। অন্ধকার রাত। সমুদ্রের জলে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। ছোটবেলোয় সাঁতার শিখেছিলাম। সাঁতার কেটে কুলে এসে উঠলাম। এক সময়। কিন্তু শাহজাদা-আমার ভালোবাসার কোন হদিশ করতে পারলাম না! সেই নিরন্ধ অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। তবু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম তাকে। কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম না তার।

    সিক্ত জামাকাপড়ে সমুদ্রসৈকতে বসে বসে বাকী রাতটা কাটিয়ে দিলাম। ভোর হলে দেখলাম, ঢেউ-এর মুখে উথালি পাথাল হতে হতে জাহাজ ছেড়ে অনেক দূরে এসে গেছি আমি। এদিক-ওদিক লক্ষ্য করতে করতে একটা পায়ে চলা পথ চোখে পড়লো। আশায় দুলে উঠলো মন। তাহলে জনবসতি লোকালয় আছে কাছে পিঠে। পথটা ধরে চলতে থাকি। হঠাৎ দেখলাম একটা ছোট্ট সাপকে তাড়া করে আসছে একটা প্রকাণ্ড বড় সাপ। এখনি হয়তো মেরে ফেলবে ওকে। আহা বেচারা। বড় মায়া হলো। ছোট সাপটা আমাকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ছুটছে। আর বড় সাপটা ধরি। ধরি করেও ধরতে পারছে না। তাকে। কাছেই পড়েছিলো একটা পাথরের চাই। দু হাতে তুলে নিয়ে তাক করে ছুঁড়ে মারলাম। বড় সাপটার মাথা থেতলে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মরে গেলো। আর তক্ষুণি, আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে, ছোট্ট সেই সাপটা পা মেলে শূন্যে উঠে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    রাত্রির সেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই আর অনিদ্রায় দেহ আর চলছিলো না। কাছেই একটা গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখি আমার পায়ের কাছে বসে আছে এক হাবাসী কিশোরী। কালো হলে কি হয়, দেখতে খুব সুন্দরী। মেয়েটা আমার পা টিপে দিচ্ছে দেখে অবাক লাগলো। পা দু’টো সরিয়ে নিয়ে বললাম, কে গা তুমি? আমার পায়ে হাত দিয়েছে। কেন? কী হয়েছে তোমার? কী চাও?

    মেয়েটি সলজ্জভঙ্গীতে বললো, আজ আপনি আমার জানি বাঁচিয়েছেন। আমি এক জিনিয়াহ। ছোট্ট একটা সাপের রূপ ধরে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিলাম। আমার পিছনে তাড়া করে আসছিলো একটা বড় সাপ। সে আমার শত্ৰু, একটা জিনি। আমার উপর বলাৎকার করতে চেয়েছিলো। আমাকে ধরতে পারলে আমার সর্বনাশ করতো, তারপর মেরে ফেলতো সে। তুমি আমাকে রক্ষা করেছে। সেই কৃতজ্ঞতায় তোমার একটু উপকার করতে তখুনি আমি উড়ে গিয়ে তোমার জাহাজ থেকে তোমার দুই বোনকে উধাও করে নিয়ে এসেছি। ঐ দাখো তাদের দুজনকে যাদু করে কালো কুক্তি বানিয়ে রেখেছি আমি। তোমাকে ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। তাই আমি ওদের এই শাস্তি দিয়েছি। তুমি যদি না চাও তবে ওদের আবার যেমন ছিলো তেমনি মেয়েছেলে করে দেবো।

    আমি বললাম, না, ওইরকমই থাক। কিন্তু আমার ভালোবাসা সেই বাদশাহজাদা কোথায় বলতে পারো?

    মেয়েটি মুখ নিচু করলো। হতভাগ্য সে আর বেঁচে নাই। তার দিন ফুরিয়ে এসেছিলো। আল্লাহ তাকে কোলে টেনে নিয়েছেন। সাঁতার জানতো না সে। জলে পড়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে তলিয়ে গেছে।

    কান্নায় চোখ ফেটে জল এলো। বুকের মধ্যে হাহাকার করতে লাগলো। আমার বোন দু’টোকে, তখন মনে হচ্ছিলো ঠেঙিয়ে মেরে ফেলি। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। হাজার হলেও ওরা আমার মায়ের পেটের বোন।

    হাবশী কিশোরী তখন আমার দুই বোন—সেই কালো কৃত্তি দু’টোকে এক হাতে এবং অন্য হাতে আমাকে নিয়ে আকাশে উড়লো। উড়তে উড়তে এক সময় এসে নামলো আমার নিজের দেশ এই বাগদাদ শহরে—আমার বাড়ির দরজায়।

    ঘরে ঢুকে দেখলাম আমার জাহাজের সব ধনদৌলত থরে থরে সাজানো আছে চারপাশে।  জিনিয়াহ জানালো, আমি যখন ঐ গাছতলায় ঘুমিয়ে ছিলাম, সেই সময়ে সে ওগুলো জাহাজ থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে রেখে গেছে। জিনিয়াহ বললো, এবার আমার যাবার পালা। যাবার আগে আমি শাহেনশাহ সুলেমানের ফরমান জানিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে। এই দুই কুক্তিকে প্রতিদিন তিনশো ঘা করে চাবুক মারবে। যদি কোনওদিন মারতে ভুলে যাও তবে আমি ফিরে আসবো পরদিনই। এবং ওদের আবার ফিরিয়ে দেবো। আগের দেহরূপ। আমি বললাম, তোমার কথা আমার মনে থাকবে।

    সেই থেকে প্রতি রাত্রে আমি তাদের নির্মমভাবে প্রহার করি।

    এই আমার দুঃখের কাহিনী, জাঁহাপনা। এবার আমার বোন আমিনাহ তার বিচিত্র কাহিনী শোনাবে আপনাকে।

    এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে জুবেদার কাহিনী শুনছিলেন খলিফা হোঙ্কন-অল-রাসিদ। এবার উচ্ছসিত কণ্ঠে বললেন, তোমার জীবনের ঘটনা বড় বিচিত্র, বড় করুণ, বড় ভালো। খুব খুশি হলাম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.