Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ১.২৪ দর্জির কাহিনী

    দর্জির কাহিনী

    দর্জি তার কাহিনী শুরু করে :

    আপনি মেহেরবান, সারা দুনিয়ার বাদশাহ, আমার কাহিনী পেশ করছি, অনুগ্রহ করে ধৈর্য ধরে শুনে আমাকে কৃতার্থ করুন :

    এই হতভাগ্য কুঁজোর মৃত্যুর আগে আমি এক নিমন্ত্রণ বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে শহরের অনেক গণ্যমান্য এবং আমার মতো অতি সাধারণ মানুষের সমাগম হয়েছিলো। যেমন—দর্জি, নাপিত, ধোপা, ছুতোর, মুচি, মুর্দাফিরাস এবং আরও অনেক জাতের লোক।

    একটা বিরাট বাড়ির প্রকাণ্ড মহলে আয়োজন করা হয়েছিলো এই উৎসবের। সকাল হতে না হতেই আমন্ত্রিতরা এসে জড়ো হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো সমস্ত কক্ষ। কিন্তু উৎসবের আসল হোতা গৃহস্বামী তখনও অনুপস্থিত। আমরা সবাই তার প্রতীক্ষায় বসে আছি। এমন সময় এক প্রিয়দর্শন তরুণকে সঙ্গে করে গৃহস্বামী প্রবেশ করলো। তরুণের সাজ ফিটফট কেতাদুরস্ত। দেখে মনে হয় বাগদাদবাসী। অন্তত তার সাজপোশাকের ধরন আর বাহার দেখে তাই মনে হয়।

    আসরে ঢুকেই বাগদাদী কায়দায় সালাম জানালো সবাইকে। আমরাও জানালাম আলেকুম সালাম। দেখতে সে সুঠাম সুন্দর সুপুরুষ, কিন্তু আহা, একটা পা খোঁড়া।

    সবাইকে সালাম জানিয়ে খুশি খুশি ভাব নিয়ে এসে বসলো আমাদের পাশে। কিন্তু প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই, কি জানি কি হলো, সারা মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো তার। এবং ঘর

    থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াতে আমরা তাকে আটকালাম। কী ব্যাপার, কিছুই তখন বুঝতে পারছি না। গৃহস্বামী বললেন, কিন্তু কী আমার ত্রুটি হলো, এভাবে চলে যাবে কেন, বাবা, খুলে বলো, না হলে বুঝবো কী করে?

    আজ আপনার নিমন্ত্রিতদের মধ্যে এমন একজন। এখানে উপস্থিত আছে যাকে আমি মনে প্ৰাণে ঘৃণা করি। আল্লাহর নামে দিব্যি করেছি, জীবনে তার আর মুখদর্শন করবো না, এক সঙ্গে বসবো না বা এক সঙ্গে খানাপিনা করবো না। সেই জন্যে আমি নীরবে আসর ত্যাগ করে চলে যেতে চাই। আপনার অভ্যাগত আমন্ত্রিতরা কেউ আহত অপমানিত হোক, তা আমি চাই না। এই কারণে তার নামও আপনাদের বলতে চাই না।

    গৃহস্বামী বললো, কিন্তু তুমি আমাদের আজ এক মুসাফীর মেহমান, যে কারণেই হোক, তোমাকে আমরা এইভাবে চলে যেতে দিতে পারি না। যতো অপ্রিয় হোক, সব কথা খুলে বলে। আমরা শুনবো। কে সেই লোক, তাকে দেখাও; কেনই বা তোমার এতো গুসসা?

    তখন সেই তরুণ এক নাপিতকে দেখিয়ে বললো, এই লোকটার জন্যে আমি ল্যাংড়া হয়েছি। এর জন্যে আমি দেশত্যাগী হয়ে এই সুদূর চীন দেশে চলে এসেছি। একটা উদ্দেশ্য তার আর মুখ-দর্শন করবো না জীবনে। সে আমার জীবনের এক ধূমকেতু—অভিশাপ। আল্লার নামে দিব্যি করেছি, তার সঙ্গে একসাথে বসবো না, একসাথে খানা-পিনা করবো না। কিন্তু এমনই আমার মন্দভাগ্য এই দূর প্রবাসে এসেও তাকে এড়াতে পারলাম না। আমার আগেই সে এখানে এসে হাজির।

    এই কথা শুনে সেই নাপিতের মুখ ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেলো। মাথা গুজে চুপচাপ বসে রইলো। কোনও প্রতিবাদ করতে পারলো না।

    আমরা সবাই সেই তরুণকে চেপে ধরলাম। শোনাতে হবে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী। আমরা শুনতে চাই।

    তখন সেই খোঁড়া তরুণ তার কাহিনী শুরু করলো :

    আপনারা শুনে হয়তো খুশি হবেন, আল্লাহর মেহেরবানীতে আমার বাবা বাগদাদের সেরা এক সওদাগর ছিলেন। অর্থের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও আচার বিনয় বিদ্যা সব গুণেরই অধিকারী ছিলেন তিনি। এবং আমিও তার কিছুটা উত্তরাধিকার সূত্রেই লাভ করেছিলাম। আমার শিক্ষাকাল সমাপ্ত হওয়ার পরই তিনি দেহ রাখলেন। এবং আমি একই তার বিশাল বিষয় সম্পত্তির মালিক হলাম।

    তখন থেকে খানাপিনা শাখ-শৌখিনতা আমার বেড়ে গেলো। দামীদামী সাজপোশাকে সেজে থাকতাম। ভালো ভালো খানা খেতাম। মোট কথা বিলাসিতার ক্রটি ছিলো না কিছুই। কিন্তু একটা ব্যাপার ছাড়া। কোন মেয়েমানুষের ছায়া মাড়াতাম না আমি। কেন জানি না, মেয়েছেলে দেখলেই আমার গারিরি করে উঠতো।

    একদিন পথ দিয়ে যাচ্ছি এমন সময় দেখলাম, এক দঙ্গল মেয়ে আসছে। ওদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে আশঙ্কায় সঙ্গে সঙ্গে পাশের এক অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়ি। একটা বাড়ির রোয়াকে বসে তাদের পার হয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বসে আছি, হঠাৎ আমার সামনের বাড়ির দোতলার একটা জানলা খুলে গেলো। একটি পরমা সুন্দরী মেয়েকে দেখলাম। জানলার কানিশের ওপরে রাখা ফুলগাছের টবে জল দিতে লাগলো সে। অসাধারণ তার রূপ আর যৌবন। অমন রূপ আমি আগে কখনও দেখিনি নারী সম্পর্কে এত বিরূপতা নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেললাম তাকে। মেয়েটি যতক্ষণ জানলার পাশে ছিলো অপলক ভাবে শুধু দেখতে থাকলাম তাকে। মেয়েটি কিন্তু আমার দিকে একবার মাত্র তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফুলের গাছে জল দিতে থাকলো। একটু পরে জল দেওয়া শেষ হলে আবার জানালোটা বন্ধ করে দিলো; আমি কিন্তু বসেই রইলাম। আবার যদি খোলে। তাহলে আবার দেখতে পাবো তাকে। কিন্তু না, সন্ধ্যা অবধি বসে রইলাম। আর খুললো না। বিষণ্ণ মনেবাড়ি ফিরে। এলাম। বুকের মধ্যে কেমন হুহু করে যেতে লাগলো। যতই মনকে শান্ত। নিরস্ত করতে চেষ্টা করি ততই আরো বেশী করে তার কথা মনে পড়ে। তার রূপ, তার যৌবন আমাকে আকর্ষণ করতে থাকে।

    দিন যায় রাত্রি আসে। না পাওয়ার বেদনা বাড়তেই থাকে। শেষে। এমন হলো, যদি না তাকে পাই, আমার জিন্দগীই বরবাদ হয়ে যাবে। খেতে পারি না, ঘুমুতে পারি না। এ কি যন্ত্রণা! শুধু ভাবি তার কথা অহরহ। সব কাজকর্ম ডকে উঠলো। তা উঠুক। কোন দিকে তখন আমার ভ্রূক্ষেপ নাই।

    আমি আবার যাই ঐ বাড়ির সামনে। রোয়াকে গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু জানলা আর খোলে না সে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই। শুধু একবার জানলাটা সে খুলুক। দেখে নয়ন সার্থক করে চলে যাই। কিন্তু না, জানলা আর খোলে না। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না, দেখলাম খচ্চরের পিঠে চেপে সুলতানের কাজী নফরচাকর পরিহিত হয়ে এসে ঐ বাড়ির দরজায় নামলো। দরজাটা খুলে গেলো। সবাই ঢুকে গেলো ভিতরে। তারপর আবার বন্ধ হয়ে গেলো দরজা। বুঝলাম বাড়িটা কাজী সাহেবের।

    আর অপেক্ষা করা সমীচীন নয়। ঘরে ফিরে এসে শয্যা নিলাম। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলাম। মানসীর চিন্তায় শুকিয়ে যেতে লাগলো শরীর। আমার নফরচাকর দাসদাসী চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমার কোন কঠিন অসুখ করেছে ভেবে বড় হেকিমকে ডেকে আনবে কিনা জানতে চাইলো। আমি তাদের বারণ করলাম, আমার কোন অসুখ করেনি। এ অসুখ কোন হেকিম কবিরাজ। সারাতে পারবে না।

    একদিন আমি বিছানায় শুয়ে আছি, এক বৃদ্ধ মহিলা এলো আমার ঘরে। চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, বাবা, তোমার শরীর যে দিনদিন হাড়ডিসার হয়ে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষ, এভাবে নেতিয়ে পড়ে থাকলে তো মরে যাবে। ওঠ। খাও দাও, মৌজ করো। দেখো, মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে।

    প্রতিদিনই আত্মীয়স্বজন পাড়াপাড়শী অনেকেই আমাকে দেখতে আসে। অনেকেই অনেক জ্ঞান দিয়ে যায়। সব শুনি। কিন্তু কিছুই কানে ঢোকে না। ভাবলাম এও সেই রকমই সমবেদনা জানাতে এসেছে। কিন্তু না, বৃদ্ধ এসেছিলো অন্য উদ্দেশ্যে। ঘর থেকে অন্য সবাই বিদায় নিলে সে আরও একটু এগিয়ে এলো আমার কাছে। গলাটা খাটো করে বললো, তোমার অসুখটা কি জানি বাবা। তা সব খুলে বলো দিকিনি, আমি কি করতে পারি, দেখবো।

    আমি তাকে সব কথাই বললাম। বৃদ্ধ বললো, কিন্তু মুসকিল হচ্ছে, মেয়েটার বাবা হচ্ছে বাগদাদের কাজী! ভীষণ রাশভারী লোক। যাই হোক, মেয়ে আর বাবা এক বাড়িতে থাকলেও আলাদা মঞ্জিলে, আলাদা মহলে বাস করে। কাজী থাকে নিচতলায়, আর মেয়ে থাকে। ওপরে। যদিও মেয়ের মহলে কোন নফরচাকির বা কেউই যেতে পারে না, একই থাকে, তবু বাড়ির পাহারা চৌকির এমন কড়া বন্দোবস্ত একটা মাছি ঢুকতে পারবে না। যাই হোক, বাবা, তুমি কিছু ভেবো না। উপায় আমি একটা বের করবোই! ওঠ, নাওয়া খাওয়া করো। তুমি না পুরুষ মানুষ।

    বৃদ্ধার কথায় বুকে বল পাই, আশা হয়, হয়তো সে কোন ব্যবস্থা করে দেবে। খুশি মনে উঠে পড়ি। খাওয়াদাওয়া কাজ কামে মন দিই। বাড়ির সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

    পরদিন বৃদ্ধ আবার আসে। আমি ভাবি কোন সুখবর আছে। কিন্তু তার মুখ দেখে সে আশা নিভে যায়, বৃদ্ধ বলে, বাবা, আমি পারলাম না। মেয়েটি আমাকে অনেক গালমন্দ করে তাডিয়ে দিলো। তার কাছে প্রস্তাব রাখতেই সাপের মতো ফুসে উঠলো সে। বললো, এক্ষুণি আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। তোমার মতো শয়তান মেয়েছেলের সঙ্গে আমি আর একটাও কথা বলতে চাই না। তুমি আমাকে খারাপ পথে নামাতে চাও। তোমাকে এমন শাস্তি দেবো জীবনে ভুলতে পারবে না।

    আমি আর এক মুহুর্ত দাঁড়াই নি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আমিও দমবার পাত্রী নই। যেমন করে হোক। রাজি তাকে করাবোই, বাবা।

    বৃদ্ধার এই নিরাশ কথা শুনে আমি আবার শয্যা নিলাম। নাওয়াখাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।

    দিনকয়েক বাদে আবার এলো সেই বৃদ্ধা। এবারে সে খুশিতে ডগমগ। বললো, কই গো বাছা, আগে মেঠাই মণ্ডা নিয়ে এসো। তারপর সুখবর দেবো।

    আমি বললাম, তা দাদী কত মেঠাই খেতে পারো? যত পারো খাওয়াবো। শুধু খাবে কেন, যা খুশি চাও দেবো।

    বৃদ্ধ বলে, গতকাল আবার গিয়েছিলাম। বাবা। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম, বাছা, তোমার জন্যে আমার জনের কলিজা, আমার চোখের মণিকে হারাবো। সে আর বাঁচবে না।

    আমার কথায় মেয়েটি আঁৎকে উঠলো, কেন কি হয়েছে দাদী। আমার জন্যে বাঁচবে না কেন? আমি তার কি ক্ষতি করেছি?

    –তুমি তো সজ্ঞানে কিছু কর নি, বাছা। তোমার এই আগুনের মতো রূপ যৌবন দেখে পাগল হয়ে গেছে ছেলে। নাওয়াখাওয়া বন্ধ করেছে। হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে শরীর। তা আর বেশী দিন বাঁচবে না। হেকিম কবরেজ এ রোগ সারাতে পারবে না—একমাত্র তুমিই পারো তার মুখে হাসি ফোটাতে।

    বুঝলাম কাজ হলো। মেয়েটির চোখে মুখে আশঙ্কা ভয়ের ছাপ ফুঠে উঠলো। কিন্তু ছেলেটি কে? তাকে কি আমি চিনি? দেখেছি কখনও?

    সে আমার নিজের ছেলে না হলেও তার বাড়া। তার কষ্ট দেখে আমার পাঁজর বাঁজরা হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে সে তোমাকে দেখে গেছে। তুমি জানলা খুলে ফুলের গাছে জল দিচ্ছিলে, তখন সে তোমাদের সামনের বাড়ির রোয়াকে বসে তোমাকে দেখেছিলো। আর সেই থেকেই তোমার প্রেমে পাগল। ক’দিন আগে তোমার কাছে এই জন্যেই এসেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার কথা ভালো করে না শুনেই তাডিয়ে দিলে। সেই কথা শোনার পর থেকে বাছা আমার আরও কাহিল হয়ে পড়েছে। এখন এমন অবস্থা, বাঁচানো দায়। যদি বাঁচে তোমার দয়াতে বাঁচতে পারে। আর না হলে আল্লাহ ভরসা।

    ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেলো মেয়েটির। বললো, আমার—আ-মা-র জন্যে সে আজ মৃত্যু শয্যায়?

    —তা ছাড়া আর কী বলবো? এখন যদি তোমার দয়া হয়—সে বাঁচতে পারে। ভেবে দেখো, যা বলতে চাও বলে। আমি গিয়ে তাকে বলবো।

    —তুমি আর দেরি করো না দাদী। শিগ্‌গির গিয়ে তাকে খবর জানাও, আমি তার ব্যথায় সমব্যাখী। কাল জুম্মাবার। নামাজের পরে তার প্রতীক্ষায় বসে থাকবো আমি। সে যেন ঐ সময় অবশ্যই আসে। আমার বাড়ির আমার ঘরের দরজা খোলা থাকবে। ঘণ্টাখানেক তার সঙ্গে কাটাতে পারবো। কিন্তু তাকে বলে দিও, তার বেশী দেরি যেনো সে না করে। তা হলে আব্বাজান নামাজ সেরে এসে পড়বে।

    বৃদ্ধার কথা শুনে লাফিয়ে উঠি আমি। সব শোক দুঃখ উবে যায় মুহূর্তে। আনন্দের চোটে মোহরে-ভর্তি আমার বটুয়া সুদ্ধ ধরে দিই তার হাতে। এমন সুখবর যে এনেছে তাকে আমার না দেওয়ার কী আছে?

    বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন উল্লসিত হলো আমার মুখে হাসি দেখে। খানাপিনা হৈ হল্লায় সারাবাড়ি আবার সরগরম হয়ে উঠলো।

    সারাটা রাত অধীর আগ্রহে কাটালাম। কখন সকালে হবে। কখন নামাজের সময় আসবে—শুধু সেই চিন্তা। সকালবেলোয়ই সেজেগুজে বসে রইলাম। বৃদ্ধ আবার এলো।—রাতে ঘুম হয়েছিলো, বাবা? শরীর ভালো আছে?

    আমি বললাম ঘুম আর কী করে আসে। তবে শরীর মন বেশ ভালো আছে।

    বৃদ্ধ বললো, এক কাজ করো, হামামে গিয়ে আচ্ছা করে গোসল করো। সাবান দিয়ে হাতমুখ সাফা করে নাও। দেখো, সুরৎ আরও চেকনীই হবে। এখনও অনেক সময় আছে।

    আমি ভাবলাম, তাই তো! এতদিন নাওয়া খাওয়া করিনি। চেহারাটা কালি পড়ে আছে। এইভাবে কি অভিসারে যায়। কেউ? নফরকে ডেকে বললাম, একটা নাপিত ডেকে নিয়ে আয়, ভালো করে কমিয়ে তারপর হামামে ঢুকবো। দেখিস যাকে তাকে ধরে আনিস নি। এমন নাপিত আনবি যে ভালো করে চুল ছাটতে জানে। দেখে যেনো কেউ হাসি মজাক না করে।

    কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নফর একটা নাপিত ডেকে আনলো। আপনারা, এখন ঐ যে লোকটা দেখছেন, এ সেই নাপিত-আমার জীবনের অভিশাপ।

    ঘরে ঢুকেই সে আমাকে সালাম জানালো। আমিও জানালাম। তবে সে বললো, আল্লাহ আপনার সকল দুঃখ শোক কাটিয়ে দেবেন। আপনি আবার খুশিতে মেতে উঠবেন। আল্লাহ আপনার মনোবাঞ্ছা পূৰ্ণ করবেন।

    আমি বললাম, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

    নাপিতটা বলতে লাগলো, মালিক, আপনার জন্যে মস্ত একটা সুখবর এনেছি, দারুণ সুখবর। আর শুধু সুখবরই বা বলি কেন আপনার শরীর স্বাস্থ্য মন মেজাজ চাঙ্গা হয়ে উঠবে এমন দাওয়াই। আপনি তো জানেন মালিক, আল্লাহর পয়গম্বর ইবন-আব্বাস বলে গেছেন, প্রতি জুম্মাবার নামাজের আগে যে ব্যক্তি ক্ষৌরকর্ম করে সারাটা সপ্তাহ তার খুব ভালোভাবে কাটে। সত্তরটা নানা ধরনের বিপদ-আপদ কাটাতে তার বেগ পেতে হয় না। তবে এও তিনি বলে গেছেন, জুম্মাবারে যে ব্যক্তির রক্তপাত হয়, নানারকম দুর্ঘটনা দুর্বিপাকে পড়ে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে।

    আমি বিরক্ত হই। সক্কলবেলা জ্ঞান দিতে লাগলো লোকটা। এখন কী এসব ভালো লাগে আমার। বললাম, ওহে নাপিত কুলপতি এবার তোমার বচন থামাও। আমার মাথাটা এগিয়ে দিচ্ছি। একটু অনুগ্রহ করে ভালো ভাবে চুলটা ছোট দাও। আমার তাড়া আছে, একটু জলদি করে।

    নাপিতটা উঠে দাঁড়ালো। একটা কাপড়ে বাঁধা যন্ত্রপাতির বাণ্ডিল খুলে ধরলো। ছুরি, কঁচি, ক্ষুর, শান, জলের খুরি, বুরুশ, সাবান ইত্যাদি। আমি ভাবলাম ও বুঝি ক্ষুর কাঁচি বের করছে। কিন্তু না ক্ষুরের বদলে বের করলে একখানা জ্যোতিষ দর্পণ। অদ্ভুত ধরনের দেখতে সাতামুখওলা একখানা আর্শি। ঘর ছেড়ে প্রাঙ্গণে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথার উপরে জ্যোতিষ দর্পণখানা তুলে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন করে করে কি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করলো। তারপর এসে বললো শুনুন, আজ হিজরী সন সাতশে তেষট্টি সালের দশই শকর শুক্রবার। আজকের দিনে যে যে কামনা-বাসনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবে, সব মনোস্কামনা পূৰ্ণ করবেন। তিনি। জ্যোতিষ শাস্ত্র আমার নখদর্পণে। মঙ্গল আর বৃহস্পতি একঘরে এসেছেন আজ। এখন সাতটা ছয় মিনিট। এই সময় ক্ষৌরকর্ম-এর পক্ষে উত্তম। শুধু বিধি সম্মতই না, এই সময়ে যে ব্যক্তি ক্ষৌরকর্য সম্পাদন করে তার বহুদিন-আকাঙিক্ষত অভীষ্ট অচিরে সিদ্ধ হয়; জ্যোতিষ গণনায় আমি দেখতে পাচ্ছি, আজ আপনি কোন প্রিয়া-সন্নিধানে যাবার উদ্যোগ করছেন। কিন্তু আপনাকে জানিয়ে রাখা আমার কর্তব্য, এই অভিসার আপনার পক্ষে ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। সেই রূপসীর সঙ্গে আপনার দেখা হওয়ার পর কী কী ঘটনা ঘটবে। আমি তা জানি, কিন্তু সে-সব কথা বলা আমার গুরুর বারণ আছে। তাতে আমার বিদ্যার অহঙ্কার প্রকাশ পাবে। সুতরাং ও ব্যাপারে এখন কিছু বলবো না।

    আমি অধৈৰ্য হয়ে চিৎকার করে উঠি, দোহাই তোমার, একটুখানি চুপ কর। আমি তোমার বকবকানি শুনতে ডাকিনি। এখন দয়া করে চুলটা ছাঁটবে? আর একটাও বাণী ছাড়বে না। নাও, এসো।

    নাপিতটা আহত হলো। আমার মাথার পাশে এগিয়ে এসে বললো, আপনার যেমন অভিরুচি তাই হবে মালিক। তবে একথা জেনে রাখুন, হুজুর, যদিও চুলদাড়ি কাটাই আমার পেশা এবং জাতেও আমি নাপিত, তবু জানবেন শুধু একটা নাপিতই আমি নই। জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার অগাধ পড়াশুনা আছে। এমন কোষ্ঠী বিচার করে দেবো, এমন নিখুঁতভাবে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে দেবো। তাজ্জব হয়ে যাবেন আপনি। কতদূর দেশ থেকে আমার কাছে লোক আসে। আমাকে হাত দেখায়। কোষ্ঠী-বিচার করায়। আর শুধু জ্যোতিষ কেন, আমার মতো কবরেজ কাটা আছে। এই বাগদাদ শহরে। কত লোকের দুরারোগ্য ব্যাধি আমি সারিয়ে দিই। ধন্বন্তরী গাছগাছড়ার জডিবাড়ি দিয়ে। আর কাটা-ছেড়াতেই বা আমার জুডি কোথায়, কে আছে? এছাড়া জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, অঙ্ক, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল সাহিত্য কি না জানি আমি। সব বিদ্যা আহরণ করা হয়ে গেছে আমার। সেরা সেরা কাব্য গাঁথা আমরা সব কণ্ঠস্থ। আমি আপনাকে কতকগুলো ভবিষ্যৎবাণী করে দেবো তার সবগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে। আমার গণনাও কখনও ভুল হয়নি। কখনও ভুল হয় না। আপনি আপনার একখানা ঠিকুজি কুণ্ঠী বানিয়ে নিন। তাতে আমি লিখে দেবো আপনার ভাগ্যলিপি। আপনি মিলিয়ে নেবেন অক্ষরে অক্ষরে। আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি, মালিক। আপনি ভাববেন না। আমার অন্য কোন মতলব আছে। আমি আপনার কাছে কোন টাকা পয়সা চাই না শুধু চাই আপনি ঠিক পথে চালিত হোন। আপনার কল্যাণ হোক। আপনার বিপদ আপদ যাতে কেটে যায় সে জন্যে বিনা পারিশ্রমিকে আপনাকে সৎ পরামর্শ দিতে চাই। যদি ইচ্ছা করেন। সারা বছর ধরে আপনার কাছে প্রতিদিন এসে আপনার প্রতিদিনের ক্রিয়াকর্মর বিধান দিয়ে যেতে পারি। থাক, আর বেশী বাক্য ব্যয় করবো না। এবার আপনার ক্ষৌর কর্ম সম্পাদন করে দিচ্ছি। আপনি যদি চান প্রত্যহ এসে আপনার ক্ষৌরকর্মও আমি করে দিয়ে যাবো। ভাববেন না কোন পারিশ্রমিক-এর লোভে একথা বলছি। একটা কানাকডিও নেবো না এজন্যে।

    এবার আমি আর ধৈর্য রাখতে পারি না।–তুমি কি আমাকে পাগল করে দেবো? মনে হচ্ছে তোমার ক্ষুরটা দিয়ে তোমার গলাটা আমি কেটে নামিয়ে দিই। হায় আল্লাহ, একি ফেরে পড়লাম আমি।

    এই সময়ে শাহরাজাদ দেখলো, প্রভাত সমাসন্ন।

    গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

     

    উনত্রিশতম রজনী।

    শাহরাজাদ কাহিনী শুরু করে : তারপর শুনুন জাঁহাপনা, সেই তরুণ খোঁড়া যখন নাপিতের বক্তৃতায় অধৈর্য হয়ে তাকে বললো, ক্ষুরটা দিয়ে তোমার গলাটা নামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নাপিত তখন বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললো, আপনি যথার্থ কথাই বলেছেন, মালিক। কিন্তু একটা জায়গায় আপনি মস্ত ভুল করছেন। আপনার ধারণা আমি অহেতুক বেশী কথা বলি, কিন্তু মোটেও তা ঠিক না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথা আমার মুখ থেকে বেরুবে না। এজন্যে অনেকেই আমাকে মৌনমানুষ বলে বিদ্রািপ করেন। আমার আরও ছটি ভাই আছে। একবার যদি তাদের পাল্লায় পড়েন। আপনি, প্ৰাণ আপনার অতিষ্ঠা করে তুলবে। তাদের সবারই গুণের কথা আমি এক এক করে বলছি। বড়জনের নাম অল-বাকবুক-মানে ভরা কলসী থেকে জল ঢালার সময় যে শব্দ হয়। দ্বিতীয় জনের নাম অল-হাদদার অর্থাৎ উটের আওয়াজ। আর তৃতীয় জনের নাম বকবক-কথাটার অর্থ-মোরগের ডাক। চতুর্থ জন অল-কুজ-যুসংবান-মানে কলসী ঠোকার শব্দ। পঞ্চম জনের নাম অল-আসার-তার মানে উট পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। আর ষষ্ঠ জনের নাম সাক-কাসিক-তার অর্থ হলো, গুগুলি ফাটানোর শব্দ। আর সপ্তম ব্যক্তির নাম সামিত—তার মানে হলো, মৌনব্রতী—এই অধম।

    নাপিতের এই নতুন বক্তৃতা শুনতে শুনতে সারা শরীর গুলিয়ে গেলো আমার। আমি চিৎকার করে উঠলাম, এই, কে আছিস, এই নাপিতটাকে একটা সিকি দিনার দিয়ে এখান থেকে বিদেয় কর! আমি আর এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারছি না। আমার চুল ছাঁটার সাধ মিটে গেছে।

    আমার কথা শুনে নাপিত বললো, মালিক, আপনার হয়তো ধারণা হচ্ছে। আমি খুব অবাস্তর কথাবার্তা বলে চলেছি। কিন্তু আদৌ তা ঠিক না। আমি নিজে তো বলিই না, অন্যে কেউ বললে তা সহ্যও করতে পারি না। আপনি গোড়াতেই মস্ত ভুল করেছেন। আপনার এখানে এসেছি আমি এক গভীর উদ্দেশ্যে নিয়ে। মহৎ কার্য সম্পাদনের জন্যে। কোন অর্থের লোভে আসিনি। আমার দ্বারা আপনার যদি কোন উপকার হয়, নিজেকে কৃতাৰ্থ মনে করবো। তাই বলে তার বিনিময়ে কোন মূল্য গ্বহণ করবো-সে। আমি ভাবতেও পারি না। ছিঃ ছিঃ! আমি যখন আপনার কোন কাজেই আসিনি, তখন পারিশ্রমিক নেবো কিসের জন্যে? আপনি ভাবতে পারলেন কি করে সে কথা? এহেন অবস্থায় আপনার কাছ থেকে একটা কানাকডিও যদি গ্রহণ করি মহাপাতকের কাজ হবে আমার পক্ষে। আল্লাহর দরবারে গিয়ে কী জবাবদিহি করবো। আমি? না না, আপনি আমাকে কোনও পয়সাকডি নিতে হুকুম করবেন না। আমি ভেবে দুঃখ পাচ্ছি, আপনি আমার কদর বুঝতে পারলেন না। কিন্তু আপনি আমার মূল্য বুঝতে পারলেন না বলে আমিও যে আপনার মূল্যায়ন করতে পারবো না তা তো ঠিক না। আমি জানি, আপনি আপনার পিতার উপযুক্ত পুত্র। আপনার পিতার মতো উদার মহৎ ব্যক্তি সচরাচর চোখে পড়ে না। তার মহত্বের কথা যখন ভাবি, চোখে জল আটকে রাখতে পারি না! আহা, তিনি আমাকে কতো না স্নেহ করতেন! তিনি ছিলেন সত্যিকারের গুণী ব্যক্তি। গুণের কদর বুঝতেন। তার মতো বোদ্ধা মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার প্রকৃত মূল্য। একদিন তার কাছে এসে দেখি, দেশ-বিদেশের বহু আদর্শ ব্যক্তি তাকে ঘিরে আছেন। কিন্তু আমাকে দেখামাত্র সবাইকে ছেড়ে দিয়ে পাশে ডেকে বসালেন। বললেন, ‘আমার বা হাতে একটা ফোড়া উঠেছে। তা থেকে আজ আমার কিছু রক্তপাত ঘটেছে। দেখো তো হে, জ্যোতিষ, কোন অমঙ্গল হবে কিনা! তার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার জ্যোতিষ দর্পণ বের করলাম। সূর্যের উচ্চতা মেপে দেখলাম। এবং গণনা করে জানতে পারলাম। সে দিনে সেই সময়ে রক্তপাতে দারুণ অমঙ্গলের আশঙ্কা। মারাত্মক কোন বিপদের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যাই হোক, আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি আপনার গ্বহ-শান্তি করে দেবো। আজ বেলা বারোটা বত্ৰিশ মিনিট একুশ সেকেণ্ড গতে আপনার ফোড়া কাটার প্রশস্ত সময়। ওই সময়ে কেটে পুঁজিরক্ত সব বের করে দাওয়াই লাগিয়ে দেবো। আপনি নিরাময় হয়ে উঠবেন। তারপর উপযুক্ত সময় সমাগত হলে আল্লাহর নাম করে ফোঁড়াটায় ছুরি বসালাম। আমার অব্যৰ্থ অস্ত্ৰোপচারে ফোড়া সেরে গেলো। আপনার পিতা মহাখুশি হয়ে আমাকে একশত স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দিলেন।

    নাপিতটা যখন তার নিজের গুণ-কীর্তনে খৈ ফোটাচ্ছে। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না।-আমার বাবা আজ স্বর্গে গেছেন, তার মতো নিরাহঙ্কার নিরীহ বোকা-সোকা মানুষকে তুমি যে কি ভাবে জগ দিয়েছে তা বুঝতেই পারছি।

    নাপিত বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে একটু করুণার হাসি হাসলো।–গেছে, এক্কেবারে গেছে। এই কাম-জুরে আপনার মাথার ইসকুরুপগুলো সব টিলে হয়ে গেছে, মালিক। আপনার কথাবার্তা কেমন সব উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। তা আপনি কিছু ভাববেন না, আমি সব ঠিক করে। দেবো। খোদার আশীর্বাদে সব বিদ্যা আমার নখদর্পণে। এখন শুধু একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। স্বয়ং আল্লাহর বাণী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে লেখা আছেঃ ‘অন্যের দোষ ক্ষমা করে, যে নিজের ক্ৰোধ সংযত রাখে, আল্লাহ তার সহায় থাকেন।’ আল্লাহর এই বাণী প্রত্যেক নামাজের পর একশো আটবার জপ করবেন। দেখবেন, আপনার দিব্যজ্ঞান লাভ হবে। আপনি আমাকে যে সব। কটুবাক্য বলেছেন সে জন্য আমার কাছে কোন ক্ষমা চাওয়ার দরকার নাই। কারণ, আমি নিজগুণে ওগুলো তখনই ভুলে গেছি। এ কান দিয়ে শুনে ওকান দিয়ে বের করে দিয়েছি। কিন্তু একটা কথা বুঝতে একটু অসুবিধে হচ্ছে, মালিক। আজ আপনি এতো অধৈৰ্য উতলা হয়ে পড়েছেন কেন? এতো আপনার স্বভাবজাত নয়! আপনি জেনে রাখুন, আপনার প্রজ্ঞ পিতা আমার উপদেশ ছাড়া কোন নতুন কাজে হাত দিতেন না। ‘যে ব্যক্তি গুণীজনের উপদেশ গ্রহণ করে, তার কখনও কোনও বিপদ হয় না।’—খোদার এই বাণী সব সময় জপ-মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করবেন। দুনিয়াতে উপদেশ দেওয়ার লোকের অভাব নাই। কিন্তু উপদেশ দেবার যোগ্যতা ক’জনের আছে? আমি তো সারা দেশ টুড়ে একমাত্র আমাকে ছাড়া আর কোন যোগ্য ব্যক্তি পাইনি। এর অবশ্য কারণ আছে—আমার মতো সবজান্ত পণ্ডিত এবং বিচক্ষণ মানুষ তো আর ঝুডি ঝুডি মেলে না। লাখে একটা।–তাও দেখা যায় না। যাই হোক, আর কথা বাড়াবো না, বুঝতে পারছি, আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। এখুনি আপনি চিৎকার করে উঠবেন। কিন্তু আমাকে দেখুন, আমার কোন বিকার নাই। আমার ধৈর্য অসীম। আল্লাহ এই জিনিসটা আমাকে দরাজ হাতে ঢেলে দিয়েছেন। আমার কী দরকার ছিলো বলুন, আপনাকে এতো ভালো মূল্যবান উপদেশ দেবার? শুধু একটাই কারণ। সে হচ্ছে আপনার পিতা। তিনি আজ নাই। কিন্তু তার কথা স্মরণ করে, আপনার প্রতি উপদেশবাণী দেওয়া আমার নৈতিক কর্তব্য এবং দায়িত্ব বলে মনে করি।

    —উফ, আল্লাহ, আমি অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলি, একি অসহ্য অত্যাচার। আমি তোমাকে চুল ছাঁটতে ডেকে এনে মহা অপরাধ করেছি, এবার ক্ষমা দাও নাপিত প্রবর। তোমার অনেক জ্ঞানগর্ভ উপদেশ আমি ভক্ষণ করেছি। সোনারীচাঁদ, এবার তুমি কেটে পড়ো বাবা। আর সোজা আঙ্গুলে যদি ঘি না ওঠে, তবে এই যে গামছা দেখছো, এটো তোমার গলায় দিয়ে…

    রাগে দাঁত কড়মড় করে আমি লাফিয়ে উঠি। ইচ্ছে করে লোকটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিই। কিন্তু আমার মাথায় তখন সাবান জলের ফেনা।

    কিন্তু সে ব্যাটা আমার এই রাগ উত্তেজনা, গ্রাহ্যই করলো না। তখনও একটানা বলে চলেছে, আমার মনে হচ্ছে, আপনি কিছু ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সেই কারণে আমার প্রতি ঈষৎ ক্ৰোধ প্রকাশ করছেন। কিন্তু আমার মতো প্রবীণ প্রাজ্ঞব্যক্তির এ সব তুচ্ছ ব্যাপার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওসবে আমার কিছু এসে যায় না। আর তা ছাড়া মনে করার কী আছে? প্ৰেম-জুরে আপনার মাথা তো একটু গড়বড় হয়ে গেছে। ঐ ধরনের ভুলবিক স্বাভাবিক। যাই হোক আপনার এখন কঁচা বয়সী। ঠিক মতো চিকিৎসা করলে নিৰ্ঘাৎ সেরে যাবে। এবং আমিই সারিয়ে দেবো। ছোটবেলায় আপনার সেই মাদ্রাসা যাওয়ার কথা মনে পড়ে, মালিক? আমি আপনাকে কাঁধে করে মাদ্রাসায় দিয়ে-নিয়ে আসতাম। আর আপনি আমার কঁধ থেকে নেমে ছুটোছুটি করার জন্যে আমাকে এস্তার কিল চড় লাথি মারতেন। রাগে দাঁত কড়মড় করতেন। মনে আছে? আপনার আজকের চেহারা দেখে আমার সেইসব কথা মনে পড়ছে।

    আমি এবার কাতর অনুনয় করে বললাম, তুমি আমার নাপিত সোনা ভাই, এবার আমাকে ক্ষান্তি দাও। আজ আমার একটা জরুরী কাজ আছে। এখুনি যেতে হবে। তোমার দু’খানা হাতে ধরে বলছি, আজকের দিনের মতো তুমি আমাকে রেহাই দাও। আর যদি আমার কথা না শোনো, তাহলে…

    এই বলে আমার গায়ের দামী শালখানা দুফাল করে ছিঁড়ে ফেললাম। রাগে চোখ দু’টো আমার ছানাবড়ার মতো গোল গোল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিলো, লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর নাকটা কামড়ে দিই। সত্যি সত্যিই ও আমাকে পাগল করে দেবে।

    লোকটা এবার একটু থমকে গেলো। এক মুহূর্ত। তারপর ক্ষুরটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে, বা হাতে আমার মাথাটা চেপে ধরে ক্ষুর চালাতে লাগলো। মাত্র কয়েকগাছি চুল কামানো হয়েছে। ক্ষুরটা তুলে ধরে বলতে লাগলো, শয়তান ভর না করলে অধৈৰ্য আসে না।’

    কিন্তু এসব দর্শনের কথা আপনাকে শুনিয়ে কী লাভ? আমার ওপর আপনার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নাই। তাই আমি যা বলবো, আমি যা করবো সবই আপনার কাছে বিষবৎ মনে হবে। হতে বাধ্য। কারণ এও গভীর দর্শনেরই কথা।

    আমি বলি, মাথাটা কামবে তো কামাও। না হলে ছাড়ো। তোমার বকবকানীতে কান আমার ঝালাপালা হয়ে গেলো। এরকম যদি আর কিছুক্ষণ চালাও, আমি অক্কা পাবো। আর আমার যদি মৃত্যু ঘটে, তার জন্যে একমাত্র তুমিই দায়ী হবে, এই বলে রাখলাম।

    নাপিত বললো, এবার বুঝলাম আপনার খুবই তাড়া আছে।

    —হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যা—ভীষণ ভীষণ ভীষণ তাড়া আছে! তোমাকে তো সেই তখন থেকে হাজার বার বলছি—তাড়া আছে। তাড়াতাডি কমিয়ে দাও।

    নাপিত বলতে থাকে, কিন্তু কে আপনাকে বলেছে, আপনার তাড়া আছে? তাড়াতাডি করার পরামর্শ কে দিয়েছে। আপনাকে? সে কথা তো আমি বলবো! আমি বলে দেবো, তাড়াতাডি যেতে হবে কি হবে না? অহেতুক তাড়াহুড়া করে কোন কাজ করা উচিৎ না, তাতে ক্ষতিই বেশী হয়। করলে পরিণামে অনুতাপ করতে হয়। আমাদের পীর মহম্মদ বলেছেন, ‘তামাম দুনিয়াতে যা কিছু সুন্দর দেখবে, তার সবই সমাধা হয়েছে খুব ধীর-মস্থর গতিতে’, কিন্তু আপনি বলছেন, আপনার খুব তাড়া আছে। কি এমন আপনার কাজ—যার জন্যে তাড়াহুড়া করতে চাইছেন? আমি শুনলে আপনাকে সৎ উপদেশ দিতে পারবো। বলতে পারবো প্রকৃতপক্ষে তাড়াহুড়া করে সে-কাজ। আপনার করার প্রয়োজন আছে কি নাই। আপনার মাথা কামানো বন্ধ রেখে আপনাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করছি বলে গোসা করবেন না, মালিক। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি, আর কয়েকঘণ্টা বাদে আপনার ভালো সময় আসছে।

    এই বলে সে তার হাতের ক্ষুরটা নিচে নামিয়ে রাখলো। এবং সেই জ্যোতিষ-দৰ্পণখানা তুলে নিলো। আবার উঠানে গিয়ে সূর্যের দিকে মেলে ধরলো। এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে কি ছাইপোশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকলো। আমার আর সহ্য হয় না। এ কি আপদ জুটেছে আমার ঘাড়ে! ওই বস্তুটার মধ্যে একটা চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো তো তাকিয়েই রইলো। কিন্তু আর একটা চোখ তার আমার দিকেই ছিলো। সূর্যের উচ্চতা মেপেটেপে আমার কাছে ফিরে এসে বললো, নাঃ, এখন তো আপনার কোন তাড়াহুড়ার কাম নাই। দুপুর বেলা নামাজের সময় আপনার কামের পক্ষে প্রশস্ত সময়। তার আগে তাড়াহুড়া করে কোন লাভ নাই, কত্তা। মাথাটা ঠাণ্ডা করে বসুন। এখনও পাক্কা তিন ঘণ্টা দেরি আছে! আমার গণনা অভ্রান্ত।

    আমি বললাম, দোহাই তোমার, আর বক বক করো না। আমার গা গুলিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এখুনি বমি করে দেবো।

    নাপিত এবার তার ক্ষুর তুলে নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। খুব আস্তে আস্তে অল্প একটু মাথা কামালো। বুঝলাম, ইচ্ছে করেই সোমন্থরগতিতে ক্ষুর চালাচ্ছে। একটুক্ষণ পরে আবার তার পাঁচালী শুরু হলো, আপনার অধৈর্য দেখে সত্যিই আমি দুঃখিত, সাহেব। আপনি যদি আমাকে সব খুলে বলতেন, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম। আমার কাছে কোন কিছু গোপন রাখা আপনার উচিৎ নয়, মালিক। আপনি তো জানেন, আপনার বাবা আমার পরামর্শের কতো মূল্য দিতেন?

    লোকটার হাত থেকে নিস্তার পাবার আশা না দেখে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হলো, আজি নামাজের সময় আমাকে পৌঁছতে হবে আমার মানসীর বাড়ি। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে কেটে আসতে হবে। না হলে। ওর বাবাবাড়ি এসে আমাকে দেখলে আর রক্ষা থাকবে না। তাই তোমার কাছে আমার মিনতি, একটু তাড়াতাডি কামিয়ে দাও। আর কথার ফুলঝুরিটা একটু থামাও। অহেতুক কৌতূহল একটু চেপে রাখো। আরও যদি জানতে চাও তো বলি, আমার এক বন্ধু আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে। তারবাড়ি গিয়ে খানাপিনা সারতে হবে। তারপর সেখানে যাবো। সে-জন্যেও খানিক আগে বেরুতে হবে আমাকে।

    —নি-ম-ন্ত্র-ণ! নাপিত যেন কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ করলো। —ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, মালিক। আমি তো এক্কেবারে ভুলে বসে আছি। আজ রাত্রে আমার বাসায় কাজন বন্ধুকে খেতে বলেছি। কিন্তু এতোটা বেলা হলো, একেবারে ভুলে গেছি, বাজারহাট কিছু করা হয়নি। কি বে-ইজতের ব্যাপার হবে বলুন তো?

    আমি বললাম, কিছু ভাবনার নাই। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আজ তো আমার নিমন্ত্রণ-আমি বাড়িতে খাবো না। কিন্তু রোজ যেমন খানাপিনা হয় আজও তেমনি সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। মাংস মদ প্রচুর আছে। তোমার যা দরকার এখান থেকে নিয়ে যেও। কিন্তু একটা কথা, আর একটুও দেরি করো না, নাপিত ভায়া। আমাকে তাড়াতাডি কামিয়ে ছেড়ে দাও।

    —খোদা আপনার মনস্কামনা পূর্ণ করবেন, আপনি শতায় হবেন, মালিক। তা কি কি খানাপিনা তৈরি হচ্ছে, সাহেব? একটু চাখাবেন?

    —পাঁচ রকমের খানা পাকানো হয়েছে। ডিমের আপেল, পায়রার দৌপিয়াজী—তাঁর মধ্যে দেওয়া হয়েছে আঙ্গুরের পাতা আর লেবুর রস; মাংসের চাপ, সরু দাউদখানি চালের বিরিয়ানী—তার মধ্যে সরু সরু করে কাটা বিলাতী বেগুন, আর মাংসের বটি, ছোট ছোট পেয়াজের ঝোল। এছাড়া আছে দশটা তন্দুরী মুরগী—আর একটা ভেড়ার মাংসের কোর্মা। আর আছে দুই থালা ভর্তি হালুয়া, লাড়ডু, পেড়া। আরও আছে। মাখন, মধু, পনির। আপেল, আঙ্গুর, কলা, শশা, তরমুজ, ক্ষীরা।

    টসটস করে জল গড়িয়ে পড়লো নাপিতের জিভ দিয়ে।-একটু চাখাবেন, মালিক?

    বাবুর্চিকে ডেকে বললাম, আজকের খানা যা তৈরি আছে, নিয়ে এসো এখানে।

    একটু একটু করে সব খাবারগুলো চেখে দেখলো নাপিত।–বাঃ, চমৎকার, এমন খানা অনেককাল খাইনি। তা সরাব কি রেখেছেন, মালিক?

    —ছটা বড় বড় ঝুডি ভর্তি আছে নানাজাতের সরোব। আমি এখনও খেয়ে দেখিনি, তেমন। ওগুলোও তুমি সব নিয়ে যাও। আমি আবার পরে আনিয়ে নেবো।

    নাপিত এবার গদ গদ হয়ে উঠলো, আপনার মতো এতো মহৎ এমন দিলাদরিয়া মানুষ এক আপনার বাবাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। তা সাহেব, কিছু গোলাপজল, আন্তর, ধূপ, খানিকটা ফুল পেলে আরও ভালো ভাবে মেহেমানদের আপ্যায়ন করতে পারতাম।

    আমি বললাম, ঠিক আছে, তাও দেবো, সব বাড়িতেই আছে। কিন্তু এখন আগে এসে তো, আমাকে কামিয়ে দাও। চাকরকে ডেকে বললাম, যে বাক্সটায় আন্তর, ধূপটুপ আছে। ওটা এনে দে নাপিতাকে।

    চাকর নিয়ে এলো। নাপিত আনন্দে লাফিয়ে উঠলো, ওরে বাস, কি বাহারী বাক্স। তা নফরভায়া, বাক্সের ডালাটা একটু খোল তো, দেখি কি কি আছে?

    আমার চাকরটা বাক্সের ডালা তুলে ধরলো। হাতের জ্যোতিষদর্পণ খানা পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে একটা একটা করে বাক্সের যাবতীয় জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। আর আমি তখন আধিকমানো মাথা নিয়ে অসহায় আহম্মকের মতো বসে রইলাম। উপায় নাই-পড়েছি। ধূর্ত নাপিতের হাতে…আমি তখন নিজের বোকামীর জন্যে নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছি। আর নাপিত ব্যাটা কোন দিকে ভ্বক্ষেপ না করে একটা করে জিনিস তুলছে আর নাকের কাছে ধরে আত্মাণ নিচ্ছে। এমন জোরে নিশ্বাস টেনে গন্ধ শুকতে লাগলো, মনে হলো, নাক দিয়েই খেয়ে ফেলবে সব! আমার মাথার মধ্যে বোঁ বেঁা করে ঘুরতে লাগলো। এমন মানসিক অত্যাচারের চেয়ে কেউ যদি দু’ঘা ডাণ্ডারবাড়ি দিতো আমার মাথায়, তাও বুঝি এতোটা মারাত্মক হতো না।

    অবশেষে, অনেকক্ষণ পরে ক্ষুর হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো নাপিত প্রবর। এক যোজন লম্বা প্রশস্তি গাইলো আমার। তারপর মাথা কামাতে আরম্ভ করলো। একটুক্ষণ পরেই আবার তার কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠলো, খোদা হাফেজ, আজকের এই বদন্যতার জন্যে খালি আপনাকে সুক্ৰিয়া জানালে তো আমার কর্তব্য শেষ হয় না, মালিক। আসল ধন্যবাদ পাওয়া উচিত আপনার পিতার। তারই দৌলতে আজ। আপনার এই বিপুল বৈভব। তাই তো আপনি দরাজ হাতে দান করতে পারলেন। তা হলে, আপনিই ভেবে দেখুন কত্তা, প্রকৃতপক্ষে ধন্যবাদটা কার পাওনা? সে যাই হোক, আজকের দিনে আপনি যে অনুগ্রহ করলেন তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। আমার নিমন্ত্রিত মেহেমানরা আজ চোব্য চোষ্য করে খেয়ে তৃপ্তি পাবে। তারা সবাই আমার মতো গরীব-সরীব মানুষ। এতো ভালো ভালো খানা-পিনা তাদের না খাওয়ালেও কেউ অখুশি হতো না। তা বলে মনে করবেন না, আমি তাদের খাটো করে দেখছি। তাদের প্রত্যেককে আমি দারুণ ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। গরীব হলে কি হবে, মানুষ হিসাবে কেউ তারা ছোট না। তাদের নাম ধাম বললে হয়তো আপনি চিনতেও পারবেন। একজনের নাম জানতুত—ঝাড়ুদার মেথর। আরেকজন সিলাত—বাজারে মুরগীর মাংস বেচে। অন্য একজন সালিয়াহ গম-আটার দোকানদার। আরও একজন-তার নাম আকরা শাহ-সক্তজী বিক্রি করে। হামিদ-ভিস্তিওলা আর গোয়ালা আবুমাকারিস।

    স্বভাবতই সবাই আমার মতো মেকদারের মানুষ। এরা এতো ভালো খানা কল্পনা করবে কি করে মালিক? তবে লোক হিসাবে সবাই খাসা। আর আপনি জানেন, বাজে লোকের সঙ্গে আমি আলাপ রাখি না। এরা সবাই আমারই মতো-বড় সজ্জন। খুব কম কথা বলে। অহেতুক কোন কৌতূহল নাই। পর নিন্দ পর্যচর্চার ধার ধারে না। তবে হ্যাঁ, সন্ধ্যা হলে মৌজ করে সরাব খেতে ভালোবাসে সবাই। মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গান গায়, নাচে। ওদের নাচ গানের খ্যাতি সারা বাগদাদে ছড়িয়ে পড়েছে। যদি কিছু মনে না করেন তবে ওদের দু-একটা নামকরা গান আপনাকে গেয়ে শোনাতে পারি। আর নাচও আমি মন্দ জানি না। গানের সঙ্গে নাচটাও তা হলে দেখুন একবার।

    ঝাড়ুদার জানতুত যে গানটা গায় আর তার সঙ্গে যে নীচটা নাচে সেটা আগে দেখাইঃ

    ও আমার দরদিয়া বন্ধুরে
    তোমার ঠ্যাং কেন খোড়া?
    তোমার তরে বসে আছি
    এসে বসে, মদ খাও থোড়া।

    কোমরটা হেলিয়ে দুলিয়ে এক অদ্ভুত বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করে নাচের নামে কায়দা কসরৎ করতে লাগলো নাপিত। রাগও হয়। হাসিও পায়। কিন্তু এখন তো ওকে চটালে চলবে না। যে কোন ভাবে আধা কামানো মাথাটা আমার শেষ করাতেই হবে।

    কিন্তু সে তখন জানতুত ছেড়ে হামিদ-কে ধরেছে। হামিদের নাম করে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিলো। গায়ে বিচুটি ঘসে দিলে যে ভাবে দাপতে থাকে মানুষ, সেইভাবে দাপাতে লাগলো সে। আর মাঝে মাঝে আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তারিফ চাইতে লাগলো।-হামিদের নাচের এই আড়-খেমটা তাল আমি হুবহু রপ্ত করে ফেলেছি কত্তা। দেখুন, একেবারে নিখাদ নিখুঁত।

    আমি বললাম, হ্যাঁ খুঁত ধরতে পারবে তেমন সমঝদার আদমী সারা বাগদাদে খুঁজ পাওয়া যাবে না। খুব ভালো-চমৎকার। কিন্তু আরো ভালো আরও চমৎকার হবে, এবার যদি দয়া করে তুমি থামো।

    নাচ না থামিয়ে নাপিত বলে, হামিদের গানটা শুনুন সাহেব। বড় মজাদার :

    আমার বিবি—কালো কুচ্ছিত কুত্তা,
    খান চাইলে মারে আমায় গোত্তা।
    তবু তারে আদর করি, পায়ে ধরি,
    বিবি বলে, পান খাবো, আনো আগে দোক্তা।

    আমার কোন প্রতিবাদই কানে তুললো না সে। একের পর এক নাচ আর গানের তাণ্ডব চলতে লাগলো।

    অনেক বাদে নাচ গান থামিয়ে সে এক প্রস্তাব পেশ করলো, আজ রাতে আপনি আমার বাসায় আসুন কত্তা। নাচ গান দেখবেন, খানা করবেন। দেখবেন, আপনার এতো দিনের জুরের দুর্বলতা কেটে যাবে। আপনি চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।

    মেজাজ শেরিফ হয়ে যাবে।

    আমি বললাম, তোমার আমন্ত্রণের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু আজ তো হবে না, নাপিতভায়া। আজ আমার অনেক কাজ। এর পরে একদিন তোমারবাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবো।

    নাপিত বললো, কাজ কাম সেরে না হয় একটু রাত করেই যাবেন। আমার বন্ধুদের নাচ গান দেখে আপনি ভীষণ আমোদ পাবেন। অতোগুলো গুণী লোক আজ এক জায়গায় হবে

    আমার তখন রাগে সারা শরীর জুলছে। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ওর এই সব নচ্ছার-পনা। বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ অতোগুলো গুণী জ্ঞানী লোকের সমাগম হবে। সেখানে না গেলে তো জিন্দগীই বরবাদ হয়ে যাবে। ওসব ন্যাকাপনা রাখো তো। এবার তোমার কাম সারো, তারপর কেটে পড়ে। আর একটাও কথা তোমার শুনতে চাই না আমি।

    নাপিত একটু দমে যায়। ভয়ে ভয়ে বলে, কিন্তু আপনি নারাজ হচ্ছেন কেন সাহেব? শুধু একটুক্ষণের জন্যে আমার বাসায় আপনার পায়ের ধুলো দিতে অনুরোধ করছি। এইটুক অনুরোধ রাখতে পারেন না, মালিক! আপনি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কখনও মেশেননি। তাই বুঝতে পারছেন। না কী মজাদার মানুষ তারা। একবার যদি আলাপ করেন তো জীবনে আর ছাড়তে চাইবেন না। বার বার যেতে হবে তাদের কাছে।

    আমি বলি, ঠিক আছে, একদিন তোমার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করবো। আমার বাড়ি। সেদিন খুব মৌজ করে খানাপিনা হবে। সে-দিনই আলাপ সালাপ করবো। আজ নয়, আজ আমার সময় হবে না।

    নাপিত মাথা নেড়ে আমার কথার তারিফ করলো।–ভালো, খুব ভালো হবে মালিক। সেই ভালো হবে। তাহলে আপনি বসুন। একটু। আমি আপনার দেওয়া এই খানিপিনাগুলো বাড়িতে রেখে এক্ষুণি আসছি। আর আসার পথে আমার বন্ধুদের সুখবরটা দিয়ে আসি। আপনার বাড়িতে আপনি তাদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবেন। এতো বড় সুখবরটা তাদের না শুনিয়ে আর থাকতে পারছি না। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আমি যাবো। আর আসবো।

    আমি চিৎকার করে উঠি, আগে আমাকে কামিয়ে দাও। তারপর যেখানে খুশি যাও। কিন্তু আমাকে না কমিয়ে এক পা নড়তে পারবে না। আমাকে কামিয়ে দিয়ে খানাপিনা নিয়েবাড়ি যাও। তোমার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মৌজ-কর। আর আমি আমার কাজে যাই।

    –কিন্তু মালিক আপনি একা একা যাবেন, সে তো হতে পারে না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেবো।

    আমি বিরক্ত হয়ে বলি, আমি যেখানে যাবো সেখানে আমাকে একই যেতে হবে। অভিসারে কেউ সঙ্গী নিয়ে যায় না। আমার মানসীর কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো কি করে?

    নাপিত বললো, কিন্তু আমার ভয় হয়, আপনার বিপদ আপদ হতে পারে। নতুন জায়গা, কিছু বলা তো যায় না। আমাকে সঙ্গে নিলে আপনার কোনও চিন্তার কিছু থাকবে না।

    –না সে হয় না।

    নাপিত বলে, আপনি বুঝতে পারছেন না, কত্তা। এই বাগদাদ শহরে এমন সব ফাদ আছে তার মধ্যে একবার ঢুকলে আর বেরুতে পারবেন না। নির্ঘাৎ মৃত্যু। আর বড় বড় ফাঁদগুলো মেয়েদের দিয়েই পেতে রাখে ওরা। আমাদের সুলতানের আবসাররা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়। কারুর কোন খেয়াল নাই, কোথায় কি ঘটছে। সব অপদার্থ নপুংশক।

    আমি এবারে ক্ষেপে গেলাম।-ওসব বুজরুকি থামাও। আমার মাথাটা কামাবে। কিনা বলে? না হলে ক্ষুর দিয়ে তোমার নাকটা কেটে দেবো এবং এক্ষুণি।

    এই বলে হাতটা বাড়িয়ে ক্ষুরটা নিতে যাই। এই প্রথম দেখলাম সে চুপ করলো, কাছে এগিযে এসে মাথায় ক্ষুর চালাতে লাগলো। মাথাটা যখন কামানো শেষ হলো, দেখলাম নামাজের সময় পার হয়ে গেছে। সুতরাং আমার মনের অবস্থা তখন বুঝতেই পারছেন। কিন্তু কী আর করা যাবে। চলে যাওয়া সময় তো আর ফেরানো যায় না।

    আমি বললাম, খুব করেছে। এখন খাবার দাবার নিয়ে রওনা হও। আমার সব মাটি হয়ে গেলো। তাড়াতাডি ওগুলো রেখে ফিরে এসো। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবো।

    নাপিত বললো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে মালিক, আমাকে বিদায় করার জন্যেই একথা বলছেন আপনি! আমি বেরিয়ে গেলেই আপনি টুক করে কেটে পড়বেন। কিন্তু তা করবেন না, সাহেব। আমি যতক্ষণ না ফিরি আপনি বাড়ি থেকে বেরুবেন না। তাতে অনেক বিপদ আপদ ঘটতে পারে। এক যদি চলে যান, আর যদি কোন বিপদ ঘটে আমাকে কিন্তু দোষ দিতে পারবেন না।

    —ঠিক আছে, যাবো না, শুধু একটু তাড়াতাডি ফিরে এসো।

    আমি তার কাঁধে মাথায় তুলে দিলাম খাবারদাবার। কিন্তু বেচারী তার ভারে নুয়ে পড়লো। শেষে দুজন কুলি ডেকে তাদের মাথায় চাপিয়ে আমারবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো নাপিত।

    নাপিত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামামে ঢুকে গোসল সেরে সেজেগুজে একই বেরিয়ে পড়লাম আমি। একটু এগোতেই নামাজের আজান ভেসে এলো কানে। আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়তে লাগলাম। একটানা দ্রুত দৌড়ে এসে পৌঁছলাম সেই কাজীর বাড়ির দরজায়। দরজা খোলাই ছিলো। আমি একবার উকি দিয়ে দেখে নিলাম ভেতরটা। তার পর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সেই বৃদ্ধ ভিতরে অপেক্ষা করছিলো। আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে গেলো।

    কিন্তু কিসের যেন সোরগোল কানে এলো। আমি যখন দৌড়তে দৌড়াতে আসি সেই সময় রাস্তার আশে পাশের অনেক লোক হাঁ করে আমাকে লক্ষ্য করছিলো। তাদের অনেকেরই ধারণা হতে পারে আমি কোন ছিনতাই চোর। মনে হলো কয়েকজন আমার পিছু ধাওয়া করে আসছিলো। এখন কাজী সাহেবের বাড়িতে ঢুকে পড়ায় তাঁরা বোধ হয় নিশ্চিত হয়ে গেছে—আমি চোর ছাড়া আর কেউ নই!

    ক্রমশই গোলমাল বাড়তে থাকলো। বেশ বুঝতে পারলাম, কাজীসাহেবের বাড়ির অন্ধ গলিটার মুখে অনেক লোকের জটলা হচ্ছে। কেউ বলছে, চোরটা কাজীসাহেবের বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েছে। কেউ বলছে, না, পালিয়েছে। এমন সময় কাজীসাহেব স্বয়ং এসে হাজির হলেন। এই সময়ে এতো লোকের ভীড় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে।

    আমি আর আমার মানসী জানলার ফুটোয় চোখ রেখে দেখলাম কাজীসাহেব খচ্চরের পিঠ থেকে নামলেন। তার সঙ্গে জনাদশেক নিগ্রো প্রহরী। আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেই ব্যাটা নাপিত।

    কাজী সাহেবের কথার কেউ জবাব দেয় না। ক্রমশ ভীড় বাড়তে থাকে। আমি দেখলাম, কাজী সাহেব এসেবাড়ি ঢুকলেন। আর আমার বুক কাঁপতে লাগলো। কাজী সাহেবের মেয়ে বললেন, তোমার কোন ভয় নাই, আব্ববাজান আমার ঘরে কদাচিৎ আসেন। আর যদি আসেনও, তোমাকে লুকিয়ে রাখার এখানে অনেক জায়গা আছে।

    নাপিতটা যখন বুঝতে পারলো কাজীর বাড়ির অন্দরে আমি ঢুকে পড়েছি সে তখন চোঁচামেচি শুরু করে দিলো। নিজের জামা কাপড় ছিঁড়ে খুঁড়ে চিৎকার করতে লাগলো।

    —ওগো, কে আছো, তোমরা, আমার মালিককে বাঁচাও। কাজীসাহেব তাকে মেরে ফেললো।

    ক্রমশই রাস্তার লোক আরও বেশী ভিড় জমাতে থাকে। একজন প্রশ্ন করে, কী, কী হয়েছে?

    নাপিত তখন হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।–আমার মালিক কাজীরবাড়ি ঢুকেছে। কাজী তাকে বেদম মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছে। আমার মনে হচ্ছে এতক্ষণে সে আর বেঁচে নাই। তোমরা সবাই এসো ভাই, আমার মালিককে উদ্ধার করে দাও।

    –কিন্তু তোমার মালিককে কাজী সাহেব মারবেন কেন? কী করেছেন তিনি?

    কিন্তু সে কথার জবাব দিলো না নাপিত। ইনিয়ে বিনিয়ে সেই একই কথা, তোমরা সবাই মিলে চলো, কাজীর কাছে যাই। জবাব দিতে হবে তাকে, কেন সে মেরে ফেলেছে আমার মালিককে?

    তখন জনতা বিক্ষুব্ধ। তাই তো, একটা মানুষকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছে একেবারে। কী অন্যায় কথা। কাজী হয়েছে বলে কি হাতে মাথা কাটবে নাকি? এসো, সবাই মিলে কাজীর কাছে। যাই। এর জবাব চাই আমরা।

    হুড়পাড় করে জনতা কাজীর দরজার সামনে এসে চিৎকার করতে লাগলো।–কই, কে আছে দরজা খোল। দরজা খোল, খোল বলছি, না হলে তুড়ে দেবো।

    দমাদম ইট পাটকেল লাঠি ডাণ্ডা পড়তে লাগলো দরজার ওপর। কাজী সাহেব হতবাক। একি অদ্ভুত সব কাণ্ড। নামাজের আগেও তিনি দেখে গেছেন, সব ঠিক ছিলো। হঠাৎ এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসব কি ব্যাপার? দরজার দিকে এগিয়ে যান। তিনি। নিগ্রো পাহারাদাররা বাধা দেয়, সাহেব দরজা খুলবেন না। ওরা হয়তো আপনার ওপরেই চড়াও হবে।

    —আমার ওপর চড়াও হবে? কেন, আমার অপরাধ?

    —সে বিচার তো জনতার মানুষ করে না। আগে তারা হাতের সুখ মেটায়। আফশোষ করতে হয়। পরে করে।

    কাজী সাহেব বললেন, সে যাই হোক, দরজা খুলে দাও। ওরা কি বলতে চায়, আমি শুনবো।

    একটা নিগ্রোনফর দরজা খুলে দেয়। কাজী সাহেব দেখলেন সারা গলিটা লোকে লোকারণ্য। এমন হৈ হল্লা-কে যে কি বলতে চায় কিছুই বোঝা যায় না। কাজী সাহেব বললেন, তোমরা শান্ত হও। একজন এসে বলো, কী তোমাদের বক্তব্য?

    নাপিত এগিয়ে গেলো। বললো, আপনি আমার মালিককে মেরে ফেলেছেন কেন তার জবাব bे!

    –কে তোমার মালিক। আমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? আর কেনই বা তাকে আমি মেরে ফেলবো। কিছুই বুঝতে পারছি না তোমার কথা।

    —তা বুঝতে পারবেন কেন? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন, এদিকে যে সব ফাঁক হয়ে গেলো সে দিকে তো আর হুস ছিলো না কাজী সাহেবের।

    এক নিচুতলার মানুষের মুখে এ ধরনের অশালীন উক্তি শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন কাজী সাহেব।

    —ওসব বুজরুকী রাখে। সভ্য ভব্য ভাবে কথা বলো। ভুলে যেও না। কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো।

    নাপিত তখন বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করে বললো, না না, তা আর ভুলবো কি করে? আমরা যে মহামান্য কাজীসাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি সে কথা কি ভুলতে পারি?

    কাজী সাহেব দেখলেন, জনতা ফুসছে। তিনি একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে অপেক্ষাকৃত নিম্ন গলায় প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মালিকাটি কে? আমার বাড়িতে তার কী প্রয়োজন?

    নাপিত এবার বিদ্রাপের টং-এ জবাব দেয়, আহা ন্যাকা, দেশসুদ্ধ লোক জানে, আপনার মেয়ের সঙ্গে সে মহকবৎ করছে, আর আপনি জানেন না? আপনার বাড়িতে সে ফি দিন আসে। আপনার মেয়ের সঙ্গে রাত কটায়। তারপর আপনাকে কলা দেখিয়ে আপনারই নাকের ডগা দিয়ে পার হয়ে যায়। আপনি বলতে চান, এ সবের আপনি কিছুই জানতেন না? আর যদি জানতেনই, তবে গোড়া থেকে তা বন্ধ করেন নি কেন? কেন আগে নিজের মেয়েকে শাসন করেন নি? পরের ছেলের গায়ে হাত তোলা খুবই সোজা, না? কাজী হয়েছেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? আমাদের মালিককে মারার মজা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। বেরিয়ে আসুন, চলুন আপনাকে যেতে হবে খলিফার কাছে। আপনার বিচার তিনিই করবেন।

    কাজী সাহেব লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারেন না। ছিছি মান-ইজত সব গেলো। মেয়ের চরিত্র নিয়ে কি জঘন্য সব কথা শুনতে হলো তাকে। কিন্তু সব মিথ্যা-মিথ্যা। তার মেয়েকে সে খুব ভালো করেই জানে, এরকম সে কিছুতেই হতে পারে না। আর তাছাড়া তার বাড়িতে ঢোকার, একটাই দরজা। সে দরজায় কড়া পাহারা থাকে।

    নাপিতকে বললেন, খলিফার কাছে যাওয়ার আগে একবার আমার বাড়িটা ভালো করে খুঁজে পেতে দেখে নাও তোমরা। কোথাও তোমাদের মালিকের লাশটাস পাও কিনা।

    এবার আমি প্রমাদ গুণলাম। এখুনি উঠে আসবে তারা। তারপর আমার যে কি দশা হবে-আর ভাবতে পারলাম না। কাজীসাহেবের মেয়ে আমাকে অভয় দিতে লাগলো। কিছু ভয় নাই। তোমাকে আমি ঐ বাক্সটার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখছি। ওর মধ্যে চুপটি করে বসে থাকে। ওরা এলেও খুঁজে পাবে না তোমাকে।

    উপায়ন্তর না দেখে ঘরের এক পাশে রাখা সেই কাঠের বাক্সটার মধ্যেই ঢুকে বসে পড়লাম। ডালাটা সে বন্ধ করে দিলো।

    হুড়মুড় করে জনতার পঙ্গপাল ঢুকে পড়লো বাড়ির অন্দরে। এঘর ওঘর আতিপাতি করে খুঁজতে লাগলো সকলে। বুঝতে পারলাম, উপরে আমাদের ঘরেও ঢুকেছে। কিছু লোক। নাপিতের গলা শোনা গেলো। কাজীসাহেবের মেয়েকে প্রশ্ন করছে, এঘরে আর কে আছে?

    –আর আবার কে থাকবে? আমি একাই থাকি, একই আছি।

    –কেন তোমার পেয়ারের নগর? সে আসেনি?

    –না। কেউ আসেনি। আমার ঘরে।

    মেয়েটির কথা শুনে অন্য সবাই বেরিয়ে গেলো। কিন্তু ধূর্ত নাপিত ঘরের এদিক ওদিক উকিঝুকি দিয়ে খুঁজতে থাকলো। এক সময় আমার বাক্সের পাশে দাঁড়ালো। আমার তখন ধড়ে আর প্রাণ নাই। ডালাটা একটু তুলে ধরলে সে। আমার চোখে চোখ পড়তেই আবার বন্ধ করে দিলো। বুঝতে পারলাম, বাক্সটা কাঁধে তুলে নিলো সে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে একেবারে বড় রাস্তায় এসে ধপাস করে ফেলে দিলো। আমার তখন প্ৰাণ যায় যায়। বাক্সের ডালাটা মাথায় ঠেলে উঠে দাঁড়িয়েই টপকে বেরিয়ে পড়ি। আর এই বাক্সটা থেকে বেরুতে গিয়ে উল্টে পড়ে যাই, রাস্তায়। সেই সময় আমার এই পায়ে ভীষণ চোট লাগে। তার ফলেই আজ আমি ল্যাংড়া।

    সে-যাই হোক, রাস্তায় পড়ে গিয়েই উঠে দাঁড়িয়েই জেবে যা ছিলো মুঠো করে বের করে রাস্তায় ছুঁড়ে দিলাম। কিছু লোক হুমডি খেয়ে পড়লো সেই পয়সাকডির লোভে। আর কিছু মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো তখন। আমি পড়ে যাওয়ায় অনেকেই করুণা পরবশ হয়ে আমাকে ধরে তুলতে এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই উঠে চো দৌড় দিতেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তারা।

    এই সময় শাহরাজাদ দেখলো, রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

     

    ত্রিশতম রজনী।

    শাহরাজাদ। আবার তার কাহিনী শুরু করে :

    তারপর শাহজাদা শুনুন, সেই দর্জিতার গল্প বলে চলেছে।

    তখন সেই তরুণ ল্যাংড়া আমাদের উৎসবের আসরে তার জীবনের সবচেয়ে করুণ কাহিনী বলছে, আর আমরা উপস্থিত অভ্যাগতরা রুদ্ধশ্বাসে শুনছি :

    আমি বাক্স থেকে বেরুতে গিয়ে উল্টে পড়ে গেলাম। সেই পড়াতেই এমন চোট লাগলো-যার ফলে আজ আমার এই দশা। পা-টাই জন্মের মতো খোঁড়া হয়ে গেলো।

    যাই হোক, জনতার হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্যেই আমি আমার জেবের টাকা পয়সা রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকলাম। পিছনে শুনতে পেলাম সেই নাপিতের কণ্ঠস্বর। শুনুন ভাই সাব, আর কোন ভয় নাই, আমার মালিককে পেয়ে গেছি। যাক, আল্লার মজিতে তিনি বেঁচে গেছেন।

    —কিন্তু বাক্সের মধ্যে ঢুকেছিলো কেন সে?

    জনতার প্রশ্ন। নাপিত বললো, আমরা চোঁচামেচি চিৎকার করাতে কাজীর লোকজন আর তাকে সাবাড় করতে পারেনি। এই বাক্সটার মধ্যে পুরে রেখেছিলো। আমরা না ঢুকলে, বাক্সটা না আনতে পারলে, পরে নির্ঘাৎ কোতল করতো তাকে। যাক বাবা, জানে বেঁচে গেছে। আমি ভাবছি, আমার এই উপস্থিত বুদ্ধি না থাকলে আজ কি সর্বনাশই না হতো।

    আমি তখন একটানা দৌড়ে চলেছি। প্ৰাণ ভয়ে। কিন্তু নাপিত আমার পিছু ছাড়ে না। সে-ও দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে থাকে। তারঃস্বরে চিৎকার শুনতে পাই।-ও সাহেব, শুনুন, থামুন। আজ আমি না থাকলে ওরা আপনাকে আস্ত কবর দিয়ে দিতো। আপনাকে তখনই উপদেশ দিয়েছিলাম, আমাকে না নিয়ে কোথাও বেরুবেন না, তা আমার কথা শুনলেন না বলেই আপনার এই দশা হলো। তাও আপনার ভাগ্য ভালো সময় মতো আমি এসে পড়েছিলাম। তাই প্ৰাণটা বাঁচাতে পেরেছি। না হলে আজ। আপনার বাঁচার কোন পথ ছিলো না। সেই জন্যেই বলি আমার কথা মেনে চলবেন আপনার কোন ক্ষতি হবে না। আপনার বাবা কখনও আমার উপদেশ ছাড়া কোন কাজে পা বাড়াতেন না। কিন্তু আপনি এইভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন? এখন আর কেউ কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। আপনি দাঁড়ান, আমার কথা শুনুন।

    আমি একটুক্ষণের জন্য দাঁড়ালাম। নাপিত আরো নিকটতর হলে বললাম, আল্লাহর দোহাই, তুমি আমাকে রেহাই দাও। তোমার জন্যেই আমার পাটা গেছে। এবার কি আমাকে জানেও মারতে চাও।

    আবার দৌড়াতে লাগিলাম। এগলি ও গলি দিয়ে একে বেঁকে শেষে বাজারের কাছে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম। এই দোকানের মালিক আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু লোক। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন। যখন বাবা বেঁচেছিলো। আমাকে খুব স্নেহ করেন।

    সারা শরীর ঘামে নেয়ে গেছে। শুধু হাঁপাচ্ছি আমি। দোকানের মালিক আমার এই অবস্থা দেখে অবাক হলেন। উৎকণ্ঠ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হয়েছে, বাপজান, এমন করে হাঁপাচ্ছে

    কেন?

    আমি বললাম, বলবো, সব বলবো আপনাকে। আগে আমাকে দোকানের ভিতরে একটুক্ষণ লুকিয়ে রাখুন। না হলে ও ব্যাটা এখুনি এসে ধরে ফেলবে আমাকে।

    দোকানী বললো, কী বলছে সব? কে তোমাকে ধরে ফেলবে? কী করেছে তার? এসো, ভেতরে এসো।

    আমি তখন আগাগোড়া সব ঘটনা খুলে বললাম তাকে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তোমার কোন ভয় নাই, আমার দোকানের ভেতর ঢুকতে পারবে না সে। আর তোমার পা যতদিন না ঠিক হচ্ছে তুমি এখানেই থেকে। আমি দাওয়াইপত্র ব্যবস্থা করে দিচ্ছি সব। তোমার বাবা আমার প্রাণের বন্ধু ছিলেন। তোমার কোনও অনাদর অযত্ন হবে না, বাবা।

    আমি ওখানেই রয়ে গেলাম কয়েক দিন। পা-টা ফুলে ঢোল হয়ে গেলো। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলাম। হেকিম এলো। দাওয়াই দিলো। ফোলা ব্যথাও কমলো একদিন। কিন্তু পা-টা একেবারে ঠিক হলো না। এখনও মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। খুঁডিয়ে খুঁডিয়ে চলাফেরা করি।

    এই ঘটনার পর এই নাপিত সম্পর্কে দারুণ এক আতঙ্ক আর ঘৃণা হলো মনে। লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান। শয়তানের অসাধ্য কিছুই নাই। তাই ঠিক করলাম, দেশান্তরী হবো। যে-দেশে এই দুষ্ট নাপিত বাস করছে সে-দেশের ধারে কাছেও থাকবো না। ব্যবসা বাণিজ্য ছোট করে বেচে দিলাম অনেকখানি। বাকী যা রইলো, আমার এক বন্ধুকে দেখাশোনার ভার দিয়ে একদিন বিদেশ যাত্রা করলাম। ঠিক করলাম, এই বাগদাদ ছাড়িয়ে এমন এক দূর দেশে চলে যাবো, যেখানে অন্তত এই নাপিতের মুখদর্শন করতে হবে না। আল্লাহর কাছে ওর সর্বনাশ প্রার্থনা করেছি। নাপিত আমার যে সর্বনাশ করেছে তার প্রতিফল যেনো সে পায়। সবংশে নির্বাংশ হয় যেনো।

    কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, দুৰ্গম গিরি, কান্তার মরু আর দুস্তর পারাবার পেরিয়ে চলে এলাম। আপনাদের মুলুকে—এই চীন দেশে, ভাবলাম চিরদিনের মতো অব্যাহতি পেলাম সেই অপয়া ধূর্ত শয়তান নাপিতের হাত থেকে; কিন্তু হায় আল্লাহ, এখানে এসেও তার মুখই আমাকে দেখতে হলো আজা! আর এক মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করবো না। এখানে, আপনাদের এই দেশে। একদিন যেমন আমার নিজের দেশ পরিত্যাগ করে আপনাদের দেশের পথে পা বাড়িয়েছিলাম। তেমনি আজ আবার আপনাদের দেশ ত্যাগ করে অন্য কোনও অজানা দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো।

    এই কথা বলে আর ক্ষণ-মাত্র অপেক্ষা না করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে।

    আমরা সবাই তখন সেই নাপিতের দিকে ফিরে চাইলাম। মুখ নামিয়ে চুপ করে বসেছিলো সে। আমাদের একজন প্রশ্ন করলো, ছেলেটি যা বলে গেলো তা কি সত্যি? আর যদি সতি্যু হয়। তাহলে জিজ্ঞেস করি, এমন সর্বনাশ তার কেন করেছিলে, বাপু? এইভাবে তার জিন্দেগীটা বরবাদ করে দিয়ে তোমার লাভ কি হয়েছে?

    নাপিত এবার সোচ্চার হয়ে উঠলো।—আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি তার ভালো বই মন্দ ভাবিনি কখনও। আমার কথা যদি সে শুনতো, তার এই দশা হতো না কখনও। আর এ-ও ঠিক, একটা পা-এর ওপর দিয়ে রক্ষা পেয়ে গেছে। আমি সেদিন না থাকলে, আমার উপস্থিত বুদ্ধি খরচ না করলে জানে মারা যেতো সে। এ জন্যে তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ! তা না, সে আমাকে শাপ-শাপান্ত করে গেলো। আল্লাহ ওপরে আছেন, তার চোখ ফাকী দেওয়া যায় না। তিনি সবই দেখেছেন।

    আপনারা এখানে সবাই গুণীজন উপস্থিত আছেন। আপনারাই বলুন, আমি কি বাজে বকবক করি? না, এতক্ষণ বসে আছি, শুনেছেন তেমন কোনও কথা? আমি আজে বাজে অবাস্তর কথাও বলি না, অবিবেচকের কাজও করি না কিছু। হ্যাঁ, তা যদি বলেন, সে ব্যাপারে ওস্তাদ আমার ছয় ভাই। আমি আমার নিজের কথা প্রথমে বলছি, তারপরে বলবো। আমরা ছয় ভাই-এর কাহিনী। আপনারাই বিচার করে দেখবেন, আমি কতো জ্ঞানী, উদার বিচক্ষণ এবং সাবধানী। সবচেয়ে বড় কথা, আমি যে কতো মিতবাক, সেটা আপনারা এক্ষুণি প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.