Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ২.০৭ সিন্দাবাদের সপ্তম ও শেষ সমুদ্রযাত্রা

    সিন্দাবাদের সপ্তম ও শেষ সমুদ্রযাত্রা

    পরদিন সকালে কুলি সিন্দবাদ রুজু নামাজ সেরে যথা সময়ে বৃদ্ধ সিন্দাবাদেরবাড়ি এসে হাজির হয়।

    এক এক করে অন্য সব অভ্যাগতরা এসে পড়লে বৃদ্ধ সবাইকে নিয়ে খানাপিনা করে। অনেক রসালাপ হয়। তারপর কাহিনী বলতে শুরু করে সিন্দবাদ নাবিক :

    আমার ছয় ছয় বার অভিযানের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর সমুদ্র অভিযানের সঙ্কল্প একেবারে মন থেকে মুছে ফেলে দিলাম। একবার দুবার নয়, এই ন্যাড়া পর পর অনেকবার বেলতলায় গেছে, আর নয়। যে-সব কথা স্মরণ করলে শিউরে উঠতে হয়। সুতরাং এই বয়সে আর সেই সব বিপদের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাই না। তাছাড়া বয়সও বেড়েছে, এখন আর এত ধকল শরীরে সইবে না। আর কেনইবা যাবো? আমার তো অর্থের প্রয়োজন নাই। আমি এখন, আল্লাহর কৃপায়, বাগদাদের সেরা ধনী। সাতপুরুষ বসে খেলেও ফুরাবে না। শুধু কি অর্থ, সারা শহরে আজ আমার কত নাম যশ খ্যাতি। স্বয়ং খলিফা আমাকে সাদরে ডেকে পাঠান। আমার অভিযানের কাহিনী শুনে তিনি চমৎকৃত হন।

    কিন্তু মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছাই বড় কথা নয়। একদিন খলিফা হারুণ অল রসিদের দরবারে বসে আমার দুঃসাহসিক অভিযানের বিচিত্র কাহিনী শোনালাম তাকে। তারপর খলিফা আমাকে একটি প্রস্তাব দিলেন।

    -সিন্দবাদ, আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছি, সারণ দ্বীপ সম্রাটের কাছে আমার শুভেচ্ছা। আর উপহার পাঠাবো। কিন্তু জুতসই কোনও দূত পাচ্ছি না। তুমিই একমাত্র যোগ্য লোক, আমার ইচ্ছে, তুমি আমার দূত হয়ে তাঁর কাছে যাও। তোমাকে আবার পেয়ে তিনি খুব খুশিও হবেন, আমারও কাজ হবে।

    বুঝলাম, খলিফার ইচ্ছাই আদেশ। আমি বিনয়াবনত হয়ে বললাম, আপনার হুকুম শিরোধার্য, জাঁহাপনা। কবে যেতে হবে, বলুন।

    দু-এক দিনের মধ্যেই তিনি সব গোছগাছ করে দিলেন। তোমরা বিশ্বাস কর, ঘর ছেড়ে বেরুবার এক বিন্দুইচ্ছে ছিলো না আমার, শুধু খলিফাকে তুষ্ট করার জন্যই পথে বেরুতে হলো।

    তিনি আমাকে দশ হাজার দিনার রাহা খরচ দিলেন। সারন দ্বীপ সম্রাটকে এক শুভেচ্ছাপত্র লিখলেন। সেই চিঠির সঙ্গে তাঁর স্বনির্বাচিত উপহার উপটৌকনাদি বেঁধে ছেদে দিলেন আমার হাতে। তার মধ্যে ছিলো : একটি চমৎকার রক্তাভ মখমল শয্যা! কি যে দাম হতে পারে, আমি কল্পনা করতে পারলাম না। অর্থ আমার প্রচুর আছে, কিন্তু আমন বিলাসশয্যা আমি জীবনে চোখে দেখিনি। এই ধরনের আরও দু’খানা দুরঙের শয্যা তিনি সঙ্গে দিলেন। কুফার তৈরি একশো প্রস্ত বাহারী সাজ-পোশাক। আলেকজান্দ্ৰিয়ার তৈরি লোভণীয় রেশমী কাপড়। বাগদাদের বিখ্যাত কারু শিল্পীদের তৈরি কিছু সূক্ষ্মসূচীকর্ম করা সাজপোশাক। কারুকার্যকরা সোনার তৈরি অতি প্রাচীন এবং দুষ্প্রাপ্য ফুলদানী। সেই ফুলদানীর গায়ে বিখ্যাত শিল্পীর হাতে খোদাই করা ছিলো একটি ছবি—এক শিকারী এক সিংহকে তীরবিদ্ধ করতে উদ্যত। এ ছাড়া একজোড়া সেরা আরবী ঘোড়া এবং হাজারো রকমের অন্যান্য জিনিসপত্র।

    রাত্রি শেষ হয়ে আসতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    তিনশো বারোতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

    খলিফার এই সব লটবহর নিয়ে একদিন, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই, রওনা হয়ে পড়লাম।

    একটানা দুই মাস সমুদ্র যাত্রার পর একদিন নিরাপদে এসে পৌঁছলাম। সারণদ্বীপে। সম্রাটের হাতে তুলে দিলাম খলিফার সেই চিঠি আর উপহার। অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে আবার কাছে পেয়ে সম্রাট দারুণ খুশি হলেন। খলিফার দূত হয়ে এসেছি আমি। সুতরাং রাজসিক আদর অভ্যর্থনার কোনও ত্রুটি রাখলেন না। তিনি। আমাকে তিনি যথেষ্ট ভালোবাসেন, সুতরাং আদর যত্নের কোনও অভাব হওয়ার কথা ছিলো না, কিন্তু এই অভ্যর্থনা, এই সম্মান খলিফা হারুন অল রসিদের জন্য। আমাকে সম্মান দেখানো মানেই সুলতানকে সম্মান জানানো।

    সম্রাট বললেন, সিন্দবাদ এতদিন বাদে তোমাকে আবার কাছে পেয়েছি, এবার বেশ কিছুদিন থেকে যাও।

    আমি বললাম, কিন্তু সম্রাট আমি তো এবার সুলতানের আজ্ঞাবহ দাস হয়ে এসেছি। এখানে, আমার ইচ্ছামতো, থেকে যাবো।–সে তো হয় না। তাকে যথাসময়ে আমার কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনি মাফ করবেন, এবার আমাকে ছেড়ে দিন, পরে যদি কখনও আসতে পারি, আপনার ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রাখবো না।

    কয়েক দিন পরে সম্রাটের কাছে বিদায় নিয়ে আমার জাহাজে চেপে বসলাম। আর কোনও দিকে নয়, সোজা যাবো বসরাহ। সেখান থেকে বাগদাদ।

    পালের হাওয়াও আমাদের অনুকূলে হলো। খুব সুন্দর আরামের সমুদ্রযাত্রা করছি আমরা। সমুদ্রের জলে ভেসে এত নির্বিয়ু নিৰ্বাঞ্ছােট যাত্রা আমার নসীবে আগে কখনও জোটেনি।

    এইভাবে সপ্তাহখানেক চলার পরে আমরা সিন দ্বীপে এসে নোঙর করলাম। এখানে সওদাগররা কেনা বেচা করার জন্য নামে। দ্বীপটা মোটামুটি জন-বসতি-বহুল। লোকের আর্থিক অবস্থাও মন্দ না। তাই, চলার পথে সওদাগরদের চোখ এড়ায় না। এই বন্দরটা।

    সিন ছাড়িয়ে সবে সমুদ্রের মাঝ বরাবর এসে পথের নিশানা ঠিক করা হচ্ছে, এমন সময় কাপ্তেন এসে আতঙ্কিত ভাবে বললো, ঠিক বুঝতে পারছি না, কোথায় এসে পড়লাম। যাইহোক, আমি মাস্তুলের উপরে যাচ্ছি, দেখি, নিশানা বুঝতে পারি কি না।

    কাপ্তেন ক্ষিপ্র হাতে গায়ের কুর্তা খুলে ফেলে দিয়ে মাস্তুলের মাথায় উঠে যায়। আমরা অজ্ঞ অসহায় কতকগুলো সওদাগর। আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে রইলাম। ভয়ে বুক ঢ়িব ঢ়িব করছে। কাপ্তেন কি বার্তা শোনাবে, কে জানে!

    জানা গেলো, বার্তা শুভ নয়। আমরা এসে পড়েছি। এক মরণ ফাঁদ দ্বীপের মুখোমুখি। এখানে এলে কেউ প্ৰাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারে না। অন্তত নাবিকরা তাই বলে। এতকাল ধরে যারা পথ ভুলে, অথবা নসীবের দোষে এই সমুদ্রে এসে পড়েছে তাদের সকলেরই ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এখানে।

    কাপ্তেন নেমে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, আর কেন, এবার তার নাম জপ কর। আর কোনও আশা নাই। একটা প্রচণ্ড ঘুণী ঝড় তেড়ে আসছে এই দিকে। আমাদের মতো শখানেক জাহাজ তার একটা পাকে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। খুব কাছেই একটা দ্বীপ আছে—চেষ্টা করলে এই তুফানের তাণ্ডব এডিয়ে আমরা সেই দ্বীপে গিয়ে নোঙর করতে পারি। কিন্তু তাতেও কোনও ফয়দা হবে না। সিংহের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে হায়নার মুখে পড়া হবে।

    আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কেন-কেন?

    কাপ্তেন বললো, ঐ দ্বীপের কিনারে বাস করে অসংখ্য ময়াল সাপ। তারা আকারে এক-একটা ছোটোখাটো পাহাড়ের মতো। আমাদের এই জাহাজখানা আস্ত একেবারে পেটে পুরে ফেলতে তাদের একটুও মেহনত করতে হবে না।

    আমরা আঁৎকে উঠলাম, ওরে-বাবা! দরকার নাই—

    তার চেয়ে ঝড় তুফানে মরবো, সে-ও ভালো।

    কাপ্তেন তার তোরঙ্গ থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করলো। বাক্সের তালা খুলে তার মধ্যে থেকে একখণ্ড ন্যাকড়া আর কিছু সাদা গুড়ো মতো একটা বস্তু বের করলো। খানিকটা জল দিয়ে ঐ অত্যাশ্চর্য গুড়ো বস্তুটি ভিজিয়ে আটা মাখার মতো ডেলা করে নাকের ফুটায় পুরে দিলো। এরপর সে একখানা ছোট্ট কিতাব বের করে বললো-আমার যাদুমন্ত্রের বই!

    আমরা বললাম, এ দিয়ে কি হবে?

    –তোমরা জান না, ঐ যে ঝড় আসছে দেখছো, ও হচ্ছে পয়গম্বর সুলেমানের সৈন্যবাহিনী। আর ঐ যে দ্বীপ দেখছো, ঐ দ্বীপে আছে সুলেমানের সমাধি। আজ পর্যন্ত কেউ ঐ সমাধিক্ষেত্র দেখতে পায়নি। এখানে এলেই, প্রথমে তেড়ে আসতে থাকে ঐ তুফান। তাকে পাশ কাটিয়ে যদি দ্বীপের তীরে পৌঁছেও যাও, তবু রক্ষণ নাই। ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ আর বিকটাকৃতির দানব আস্ত গিলে ফেলবে।

    এরপর কাপ্তেন আর একটি কথা বললো না। নিবিষ্ট মনে বই-এর কয়েকটা পাতা উল্টে উল্টে বিড় বিড় করে কি সব পড়তে থাকলো।

    –নাঃ, হলো না।

    –কী হলো না?

    আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করি, কি হলো না কপ্তেন?

    –সে বললো, না, এ দুর্যোগ কাটবার কোনও সম্ভাবনা নাই। বরং আরও বাড়বে। সুতরাং আমার ওপর ভরসা না রেখে নিজের নিজের পথ দ্যাখো, ৩ইসব। আল্লাহ মেহেরবান–

    তখনও ঝড় এসে পৌঁছয়নি, কিন্তু বৃষ্টির বন্যায় জাহাজের পাটতন ভেসে যেতে থাকে। আমরা প্ৰাণপণে চেষ্টা করি।–কাপড়ের গাঁটগুলো বাঁচানো যায়। কিনা। কাপ্তেন বললে, ওসব থোক, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, আগে নিজের বাঁচার পথ দেখ। জানে বাঁচতে পারলে অনেক কাপড়ের গোট চোখে দেখতে পাবে। এখুনি ঘুণী ঝড় এসে আছড়ে পড়বে। যদি পারো সাবধান হও। আমি চললাম, বিদায় বন্ধু, বিদায়। বেঁচে যদি থাকি, আবার হয়তো কোনদিন দেখা হতে পারবে

    কাপ্তেনের করুণ চোখের সেই ভয়ার্ত দৃষ্টি আমি আজও ভুলতে পারিনি। জানিনা সেই দিনই তার সলিল সমাধি হয়েছে কিনা। জানিনা, বেঁচে থাকলেও, জীবনে আর কোনও দিন তার সঙ্গে দেখা হবে কিনা।

    একটু বাদেই প্রচণ্ড একটা ঝড়ের ধাক্কা এসে লাগলো। আমাদের জাহাজে। প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে পারলেও পরের দাপট আর সহ্য করতে পারলাম না। এলো পাথাড়ী ঝড়ের তাণ্ডব চলতে থাকলো। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আমাদের গোটা জাহাজটা গ্রাস করে ফেলে। কখনও বা মনে হয়, জলের একটা পাহাড় এসে পড়লো। আবার দেখি, না, জলটা সরে গেলো। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ কাটিলো না। একটা ঘুণী এসে আমাদের জাহাজখানাকে প্রায় একশো হাত ওপরে তুলে আছাড় মারলো। তারপর কে কোথায় আমরা ছিটকে পড়লাম, তলিয়ে গেলাম, হারিয়ে গেলাম তার কোনই হদিশ করতে পারলাম না। তখন সবাই নিজের চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত। কে কোথায় বাঁচিলো কি মরলো, সে-কথা মনে আসবে কি করে?

    আমি জাহাজের একখানা ভাঙ্গা পাটাতন আঁকড়ে ধরতে পারলাম। এই তক্তাখানায় ভর করে ভেসে চললাম। কোথায় এবং কতদূরে জানি না, এক সময় দেখলাম, একটা দ্বীপের কিনারে এসে ভিড়েছি। দ্বীপটা শান্ত শ্যামল, ফলে ফুলে ভরা। ছোট্ট একটা স্রোতস্বিনী নদী দ্বীপের মাঝ দিয়ে বহমান।

    আগের অভিযানের সেই রত্নগৰ্ভ খরস্রোতার কথা মনে পড়ে গেলো। সেবার সেই নদীর দৌলতেই আমার প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো। ঠিক করলাম, এই নদীর জলেই ভেলা ভাসিয়ে চলবো—যা থাকে কপালে। যদি বাঁচি ভালো, না বাঁচলেও দুঃখ থাকবে না। এছাড়া উপায়ই বা কি!

    গাছের সুমিষ্ট ফল। আর নদীর জল খেয়ে নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নিলাম। কাঠের পাটাতনখানা টেনে এনে ফেললাম নদীর জলে। তার উপর চেপে বসে ভেসে চলতে থাকলাম স্রোতের টানে। ভেলা ছাড়ার আগে যতটা পারলাম ফলমূল বোঝাই করে নিলাম। আর নিলাম কতকগুলো সুগন্ধী গাছের ডাল। নাম জানি না, কিন্তু সেই কাঠের সুবাস আত্মাণ করে বেশ বুঝতে পারলাম, নিশ্চয়ই কোনও দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান বস্তু।

    গাছের ডাল গুলো ভেলার ওপরে না চাপিয়ে শক্ত লতা দিয়ে ভেলার পাশে বেঁধে দিলাম। এর ফলে ভেলার ওপরে ভার পড়লো না, অথচ ভেলাটাও আকারে অনেক বড় হয়ে গেলো।

    ভেলার ওপরে চেপে একটা গাছের ডাল দিয়ে ঠেলা দিতেই নদীর মাঝখানে চলে যায়। তারপর প্রবল স্রোতের টানে দুর্বাের গতিতে ছুটে চলে। আমি আর তাল সামলাতে পারি না। ভেলার ওপরে পাক খেয়ে পড়ে গেলাম। আমার দেহের ওপরে গাদা হয়ে গড়িয়ে পড়লো। ফলের ডাই। আমি চাপা পড়ে গেলাম।

    যখন আমার জ্ঞান ফিরলো, দেখি, ভেলাটা তখনও তীর বেগে ছুটে চলেছে। প্রাণপণে উঠে বসবার চেষ্টা করি। কিন্তু কে যেন আমার হাত-পা বেঁধে রেখেছে, কিছুতেই উঠতে পারলাম না। ভয়ে আঁৎকে উঠলাম, এই দুর্বর গতি রোধ করার সাধ্য তো কারো হবে না। তাহলে, তাহলে কি এই আমার অনন্ত যাত্ৰা? চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপ করতে থাকলাম।

    হঠাৎ কানে এলো, কিছু লোকের চিৎকার। তাকিয়ে দেখলাম, একদল ধীবর জাল ফেলেছিলো, সেই জালে আটকে গেছে আমার ভেলা। লোকগুলো ছুটে এসে আমাকে তীরে তুললো। তখন আমার অৰ্দ্ধমৃত অবস্থা। জালের জন্ট থেকে ভেলাটাকেও ছাড়িয়ে ওপরে তোলা হলো।

    শীতে আমি তখন ঠিকঠক করে কাঁপছি। ওরা আমাকে গরম কাপড় চোপড় দিয়ে ঢেকে দিলো।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    তিনশো তেরতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?

    একজন বৃদ্ধ আমার সারা শরীরে তেল মালিশ করে আমাকে খানিকটা চাঙ্গা করে তোলে। এবার আমি উঠে বসতে পারি। কিন্তু তখনও কথা বলতে পারছি না। আমাকে ওরা ধরাধরি করে একটা হামামে নিয়ে গেলো। গরম জলে গোসল করার পর মোটামুটি একুট সুস্থ হলাম।

    বৃদ্ধ তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলো আমাকে। পাড়া-পড়াশীরা ভিড় করে এলো। চমৎকার সব খানাপিনা এনে দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো সে। চোখে আমার তন্দ্ৰা আসছিলো! শোয়া মাত্রা ঘুমে ডুবে গেলাম।

    এইভাবে তিন দিন তিন রাত্রি দারুণ তোয়াজের মধ্যে কাটালাম আমি। ওরা আমাকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করলো না।

    চার দিনের দিন সকালবেলা বৃদ্ধ এসে আমার পাশে বসলো।—আল্লাহর দোয়ায় এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলে, বাবা। আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সবই তাঁর ইচ্ছে—

    একটু থেমে বৃদ্ধ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বাবা, কে তুমি? কোত্থেকেই বা আসছিলে?

    আমি বললাম, আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন, আল্লাহ। আপনাদের মঙ্গল করবেন। আমার নাম সিন্দবাদ নাবিক। অনেক সমুদ্র যাত্রার ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে আমার জীবনে।

    এরপর আমার সমুদ্র-অভিযান অভিজ্ঞতার বিচিত্র কাহিনী বললাম তাকে।

    বৃদ্ধ মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনলো সব। তারপর বললো, বেটা আর দেরি না করে এবার তোমার মূল্যবান সামানপত্র সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়ে যাও। কারণ এ জিনিস শুধু সুন্দরই না-একেবারে দুষ্প্রাপ্য। অন্য লোকের লোভ হতে পারে।

    আমি অবাক হই। —আপনি কিসের কথা বলছেন? কি এমন অমূল্য বস্তু আমার সঙ্গে আছে?

    —তুমি যে গাছের ডালগুলো সঙ্গে এনেছো সেগুলো মূল্যবান চন্দন কাঠ। যদি বেচিতে চাও, আমার সঙ্গে বাজারে চলো। আমি তোমাকে নায্য দাম পাইয়ে দেব।

    আমি বললাম, আপনি সদাশয় ধর্মপ্ৰাণ, সঙ্গে যাওয়ার কী আছে, আপনি নিজেই যান। যা ভালো বিবেচনা করবেন, সেই দামে বেচে আসুন।

    বৃদ্ধ বললে; ঠিক আছে, চলো না, এখানকার বাজারটাও তোমার দেখা হবে।

    আমি আর ‘না’ করলাম না।

    বাজারে এসে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এক দাঙ্গল দালাল ঘিরে ধরেছে।–আমার চন্দন কাঠের ডালগুলো নানাভাবে তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছে।

    এরপর বৃদ্ধ ডালগুলো নীলামে তুললো। একজন দাম দিলো এক হাজার দিনার। আর একজন বললো, দুই হাজার। আর একজন—তিন। এইভাবে দাম বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে দশ হাজার দিনার পর্যন্ত উঠলো। বৃদ্ধ আমার দিকে তাকায়, কী, ছেড়ে দেবে?

    কি করবো ভাবছি, বৃদ্ধ বললো, এখন বাজার ভীষণ মন্দা। সব জিনিসের দরই পড়তির দিকে। আমার মনে হয়, বেচে দেওয়াই ভালো। আচ্ছা যাক-আরও একশো দিনার বেশি দেবো আমি। আমাকেই দিয়ে দাও তুমি।

    –ইয়া আল্লাহ, আপনি নিজে কিনবেন? তার জন্যে বাজারে আসতে হলো। এত যাচাই করতে হলো। আপনি চান জানলে, আমি এমনিতেই দিয়ে দিতাম। আপনাকে। যা উপকার করেছেন আমার, তা কি কোন মূল্য দিয়ে শোধ করা যাবে?

    বৃদ্ধ তার এক অনুচরকে বললো, কাঠগুলো আমাদের গুদামে নিয়ে যাও।

    তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, চলো বাবা, ঘরে ফেরা যাক।

    বাড়ি ফিরে এসে বৃদ্ধ আমাকে গুণে দশ হাজার একশো সোনার মোহর দিয়ে বললো, আমি একটা বাক্স দিচ্ছি, এগুলো বাক্সে বন্ধ করে সঙ্গে নাও।

    এরপর আমরা দুজনে একসঙ্গে বসে খানাপিনা করলাম। বৃদ্ধ আমাকে বললে, বেটা তোমার কাছে একটি জিনিস আমার চাইবার আছে—

    আমি কৃতাৰ্থ হয়ে গেলাম, আপনি কোনও সংকোচ করবেন না। বলুন কী চান? আপনাকে আমার আদেয় কিছুই নাই।

    বৃদ্ধের চোখ নেচে উঠলো, বাবা, আমি বুড়ো হয়েছি। আর বোধহয় বেশিদিন বাঁচবো না। আমার আপনি বলতে সংসারে একটি মাত্র মেয়ে। দেখতে শুনতে বেশ সুন্দরী। আদব কায়দাও বড় ভালো। আমার মরার পর এই বিশাল সম্পত্তির একমাত্র মালিক হবে সে-হুঁ। এই কারণে, আমার সম্পত্তির লোভে, আমার মেয়েকে শাদী করার জন্যে হাজারো ছেলে পাগল। কিন্তু আমি জানি, আমার মেয়ে তাদের লক্ষ্য নয়, তারা কাজায় পেতে চায় আমার এই বিপুল বৈভব। তাই ভয় হয়, মেয়েটার একটা হিল্লে করে না যেতে পারলে, একটা সুপোত্র দেখে শাদী দিয়ে যেতে না পারলে সে বোধহয় সুখ শান্তি পাবে না। কিন্তু বাবা, অনেক চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত এমন একটা ছেলের সন্ধান পেলাম না, যে সত্যিই আমার সম্পদের লোভে নয়, মেয়েটির রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে শাদী করতে পারে। তোমাকে দেখা ইস্তক আমার মনে বড় আশা হয়েছে। তোমার মতো সৎ, নিষ্ঠাবান, উদার-হৃদয় ছেলেই আমি খুঁজছিলাম। আমার একান্ত অনুরোধ, বাবা, তুমি আমার মেয়েটি গ্রহণ কর। আমি জানি, টাকা পয়সা, ধন দৌলতের উপর তোমার কোনও মোহ নাই। তুমিই পারবে আমার মেয়েকে সুখী করতে। আর আমিও শান্তিতে মরতে পারবো।

    কোনও কথা না বলে আমি মাথা নত করে বসে থাকি। বৃদ্ধ বলে, আমার খুব বেশি আব্দার নাই, বাবা। শুধু যে কটা দিন বাঁচি, মেয়েটাকে নিয়ে তুমি আমার কাছে থাক, এই আমার ইচ্ছা। তারপর, তোমার ইচ্ছা হয়, আমার সব বিষয় সম্পত্তি বেচে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে যেও।

    আমি বলতে পারলাম, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে আর আলাদা কিছু নাই। আপনি যা বলবেন, আমি তাই করবো। কারণ এইটুকু জানি, আজ যে এই হেসে গেয়ে চলে ফিরে বেড়াতে পারছি সে তো শুধু আপনারই কল্যাণে। বলতে গেলে, এ আমার দ্বিতীয় জীবন লাভ। আপনি যা বলবেন, তাই আমি করবো।

    বৃদ্ধের চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। —যাক, বাবা, এতদিনে আমি নিশ্চিত হলাম। কি বলে যে তোমাকে দোয়া জানাবো, ভাবতে পারছি না।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    তিনশো চৌদ্দতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

    কাজী, ও সাক্ষী ডেকে সেইদিন শাদীপৰ্ব্ব সমাধা করা হলো বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। মহাধুমধাম করে অনেক লোকজন খাওয়ানো হলো। গরীব দীন ভিখারীরা খানাপিনা ছাড়াও নগদ বিদায় নিয়ে পাত্র-পাত্রীর শতায়ু কামনা করে চলে গেলো।

    এতদিন এখানে আছি, কিন্তু সেই শাদীর রাতেই প্রথম দেখলাম বৃদ্ধের মেয়েকে। সে তখন আমার বিবি, সে আমার এখনও বিবি। নানা রত্নাভারণে সেজোগুঁজে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। তার রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হলাম! অনেকদিন বাদে একটি সুন্দরী নারীর কবোষ্ণ দেহ বুকের মধ্যে টেনে নিজেকে হারিয়ে

    দিলাম।

    এইভাবে সুখের সায়রে গা ভাসিয়ে দিয়ে অনেকদিন কাটালাম সেখানে। তারপর একদিন আমার শ্বশুর দেহ রাখলো। যথাযোগ্য মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হলো। তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সারা দেশের লোক ভেঙ্গে পড়েছিলো সেদিন। আজকালকার দিনে আমন ধর্মপ্ৰাণ সদাশয় মানুষ বড় একটা দেখা যায় না। বিরাট লম্বা। শোকমিছিলের পুরোভাগে ছিলাম আমি। এমন একজন মানুষের জামাই হয়ে গর্বে বুক ফুলে উঠেছিলো আমার।

    এদেশের মানুষ ফি বছর বসন্তকালে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। সারা বছর ধরে প্রতীক্ষা করে তারা বছরের একটি দিনের জন্য। বসন্তকালের এই নির্দিষ্ট দিনে তারা এক অদ্ভুত খেলার ভাগীদার হয়। এখানকার মানুষ পিঠে ডানা বেঁধে পাখীর মতো আকাশে ওঠার এক বিচিত্র কৌশল জানে। বসন্তকালের সেই নির্ধারিত দিনে সবাই দল বেঁধে এরা আকাশে ওড়ে। উড়তে উড়তে নিঃসীম নীল আকাশের পারাবারে হারিয়ে যেতে চায় এরা। কেউ কেউ যে একেবারে হারিয়ে যায় না, তাও নয়। সবাই মিলে সকলে আকাশে ওঠে। সন্ধ্যার আগে আবার নিচে নেমে আসে। কিন্তু যারা ফেরে না তারা আর কোনও দিনই ফেরে না। তাই এই আকাশ অভিযান এক দিকে যেমন সুখদায়ক আর এক দিকে তেমনি দুশ্চিন্তারও বাহক। তাই সমুদ্রযাত্রার মতো এই আকাশ অভিযানের সময় স্ত্রী পুত্র পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা করার রীতি আছে।

    সেবার আমার বড় সাধ হলো, আমিও আকাশে উড়বো। কিন্তু কেউই আমার কথায় আমল দিলো না। এবং কিভাবে ডানা মেলে। আকাশে ওড়া যায়, তার কৌশলও কেউ শিখিয়ে দিলো না।

    কিন্তু আমার বিবাগী মন কিছুতেই বাগ মানে না। শেষে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে একজনকে রাজি করলাম। সে আমাকে শিখিয়ে দিলো ডানা বেঁধে ওড়ার কায়দা। সে বললো, চলো, আমি উড়বো তোমার সঙ্গে।

    নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে চলেছি আমরা। মনের আনন্দে গান গাইছি। হঠাৎ বিপর্যয় ঘটলো, একটা দমকা হাওয়া এসে ওলোট পালট করে দিলো আমাদের। আমার সঙ্গীটি ডিগবাজি খেয়ে প্রচণ্ড বেগে নিচে পড়ে গেলো। আমি নিচেই পড়তাম, আল্লাহর অপার করুণা, পড়তে পড়তে একটা পাহাড়ের চুড়ায় আটকে গেলাম। আমার পাখা দু’খানা তার আগেই ভেঙ্গে নিচে পড়ে গেছে।

    এখন এই অবস্থায় কীভাবে আমার বিবির কাছে ফিরে যাবো সেই ভেবে আমি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকি। এখন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। একটা পাথরের টিলার ওপর বসে বসে কাঁদতে থাকলাম। এই সময় দুটি প্রিয়দর্শন বালকের দেখা পেলাম। এত রূপ আমি কোন মানুষের দেখিনি।

    আমি ধীর পায়ে উঠে গেলাম তাদের সামনে। মাথা নেড়ে শুভেচ্ছা জানালাম। আমাকে দেখে তারাও বেশ খুশি-স্বাগত জানালো। এবার মনে কিছুটা ভরসা পেলাম। বললাম, আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন, আপনারা কে? এখানেই বা কি করছেন?

    আমরা আল্লাহর বরপুত্র।

    ওদের দু’জনের হাতে দু’খানা ছোট্ট সোনার লাঠি ছিলো। একজন একখানা আমার হাতে দিয়ে বললো, এই পথে চলে যাও।

    লাঠিখানা হাতে নিয়ে আমি ওদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। চলতে চলতে শুধুই ভাবছি, কি সুন্দর ছেলে দুটি। কি করেই বা এলো এখানে।

    কিছু দূর এগোতেই রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে এক জায়গায়। সেই পথে পা বাড়াতে যাবো হঠাৎ নজরে পড়লো সামনে এক বিশালাকায় বিষধর সাপ। তার মুখে একটা মানুষ। প্রায় তিনভাগই মুখের মধ্যে পুরে ফেলেছে।

    আমি আর এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারলাম না। এই বীভৎস দৃশ্য। প্রাণপণ শক্তিতে লাঠিটা ছুঁড়ে মারলাম সাপটার দিকে। কিন্তু কি আশ্চর্য, এই ছোট্ট সোনার লাঠিটার কি যাদু, ঐ লাঠিটার আঘাতে সাপটা লুটিয়ে পড়ে গেলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে খতম।

    লোকটাকে টেনে বের করলাম তার মুখ থেকে। আর একটু হলেই পুরো দেহটাই সে পেটে পুরে ফেলতো।

    এই লোকটি আসলে কোনও মানুষ নয়। সে বললো, আমি জীন। উড়তে উড়তে তোমার মুখে তোমাদের ঈশ্বরের নাম শুনে আমি কক্ষচ্যুত হয়ে ঐ সাপের মুখে গিয়ে পড়ি।

    আমি বললাম, আমার একটা উপকার করবে?

    —স্বচ্ছন্দে। তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করলে, আর তোমার উপকার করবো না? বলো কি করতে হবে।

    —আমার পাখা দু’খানা ভেঙ্গে গেছে। যদি তুমি আমাকে আমার বিবির কাছে পৌঁছে দাও—

    –এ আর এমন বেশি কি? আমার পিঠে উঠে বসে। এক্ষুণি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার বাড়ি।

    কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে আমাকে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে গেলো।

    আমার বিবি তো ততক্ষণে কেঁদে কেঁদে সারা। তার ধারণা, আমি আর বেঁচে নাই! যাই হোক, সে বললো, এই হতচ্ছাড়া দেশে আর এক দন্ড থাকবে না আমি। বিষয়সম্পত্তি যা আছে সব বেচেটেচে দাও। বাকী জীবনটা বাগদাদে গিয়েই বাস করবো। বাবার তাই ইচ্ছা ছিলো, তার মৃত্যুর পর আমি যেন তোমার দেশেই চলে যাই। আমার বাবা অনেক রেখে গেছেন। এ সবই এখন তোমার। টাকা পয়সার তো অভাব নাই, তবে আর কী, একখানা ভালো দেখে সওদাগরী জাহাজ কিনে ফেলো। সামানপত্র সব বোঝাই করে, আল্লাহর নাম নিয়ে পাডি দেওয়া যাক।

    আমি বললাম, সেই ভালো।

    যে-সব জিনিসপত্র সঙ্গে নেওয়ার অসুবিধা সবই এক এক করে নীলামে চড়িয়ে বেচে দিলাম। দাম নেহাত কম পাওয়া গেলো না। বেশ ভালো দেখে আনকোরা একখানা জাহাজ কিনলাম। সামানপত্র বোঝাই করে, দিনক্ষণ দেখে, একদিন বসরাহর দিকে রওনা হয়ে পড়লাম।

    কিছুদিনের মধ্যে প্রথমে আমরা বসরাহ, পরে বাগদাদে এসে পৌঁছলাম। আমার বিবিকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে আমিবাড়ি গেলাম। সেখানে আমার আত্মীয় পরিজন সবাই দেখে খুশির আনন্দে নেচে উঠলো। আমার নতুন বিবিকে বরণ করে ঘরে তুললো তারা। দীর্ঘ সাতাশ বছরে পরে আমি দেশে ফিরে আসছি। আমার বন্ধুবান্ধবরা উপদেশ দিলো, সিন্দবাদ, এইভাবে জীবনের প্রায় সব কটা দিনই তো বাইরে বাইরে কাটিয়ে দিলে। এবার একটু ঘরে সুস্থির হয়ে বসে।

    আমি বললাম, আর নয় যথেষ্ট হয়েছে। জীবনের দেখার আর কিছুই বাকী রাখিনি। এবার আর আমার জন্মভূমি বাগদাদ ছেড়ে বাইরে একপাও যাবো না। এত ঝড়ঝনঝা বিপদ আপদ কাটিয়ে আজও যে আমি বেঁচে-বর্তে আছি, সে তো সেই একমাত্র করুণাময় আল্লাহর দয়ায়।

    এই হলো আমার সপ্তম এবং শেষ সমুদ্রযাত্রার কাহিনী।

    এবার বৃদ্ধ সিন্দবাদ কুলি সিন্দাবাদের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কাহিনী শুনলে তো মিতা। তাহলে এখন ভেবে দেখ, তুমি যত হাড়ভাঙা পরিশ্রমই করে থাক— আমার তুলনায় তা কত নগণ্য। একটা দিকে তোমার নিশ্চিন্ত ভরসা আছে, সারাদিন খাটাখাটুনির পর ঘরে ফিরে যেতে পারবে তুমি। কিন্তু আমার কথা ভাবো, ঘর ছাড়ার পর আবার যে কখনও ঘরে ফিরতে পারবো সে ভরসা ছিলো কী? ফিরে আসতে পেরেছি—সে একমাত্র তারই কল্যাণে।

    একথা সত্যি, আজ আমি বাগদাদের সেরা ধনী। আর তুমি দীন হতে দীনতম এক কুলি। কিন্তু এটা তো মানো, আমার যে উদ্যম আমার যে জীবনমরণ পণ তার পুরস্কার কি আমি পাবো না?

    কুলি সিন্দবাদ বৃদ্ধের হাত দু’খানা জড়িয়ে ধরে বলে, আমার দুঃখের, ব্যথার গানগুলো শুনে আপনি আমার ওপর রাগ করবেন না, মালিক। আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল। এ সংসারে যে যেমন কর্মকরে, সে তেমনই তার মূল্য পায়।

    এই কাহিনী শেষ হলেও দুই সিন্দাবাদের দোন্তী খতম হয় না। বরং আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন সে নিয়ম করে বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে আসে-বৃদ্ধেরই অনুরোধে। খুব জোর খাওয়াদাওয়া গান বাজনা চলে। কুলি সিন্দবাদ, সারাদিন খাটুনির পর, সন্ধ্যাবেলা আবার নতুন জীবনের স্বাদ ফিরে পায়।

    উজিরকন্যা শাহরাজাদ সিন্দবাদ নাবিকের এই অপূর্বকাহিনী শেষ করে চুপ করে বসে থাকে। এই সময় অবশ্য রাত্ৰিও শেষ হয়ে আসে।

    দুনিয়াজাদ ছুটে এসে দিদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, কি সুন্দর গল্প তোমার দিদি। আর কি মিষ্টি করেই না বলতে পারো। শুনতে শুনতে চোখের ঘুম উবে যায়। আচ্ছা, দিদি, সত্যি কি সিন্দাবাদের মতো ঐরকম দুঃসাহসিক নাবিক কেউ ছিলো? এইভাবে সে বার বার সাত বার নিজের জীবন তুচ্ছ করে বিপদের সঙ্গে লড়াই করেছিলো?

    —মিথ্যে হবে কেন, বোন? এতো ইতিহাস। যাই হোক, আজকের মতো ঘুমিয়ে পড়ো। কাল রাতে নতুন কাহিনী শুরু করবো। দেখবে কি মজার।

    সুলতান শারিয়ার শাহরাজাদকে আদর করতে করতে বললো, সিন্দাবাদের মতো এমন দুঃসাহসিক হয়তো না, কিন্তু আমি আর আমার ছোট ভাই শাহজামান একবার এক অভিযানে বেরিয়েছিলাম, সে কাহিনীও বড় চমৎকার। পরে একদিন শোনাবো তোমাদের। সে যাক, কাল রাতে কী কিসসা শোনাবে শাহরাজাদ।

    শাহরাজাদ সুলতানের কোলে মাথা রেখে বলে, কাল শোনাবো, সুন্দরী জুমুরুদ আর আলী শার-এর কাহিনী।

    শাহরাজাদের চিবুকে হাত বুলিয়ে ঠোঁটে সোহাগ করতে করতে শারিয়ার ভাবে, এই সব মজাদার কিসসাগুলো না শুনে তো মেয়েটাকে মারা যাচ্ছে না। জানি না কত গল্প সে জানে। আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সে।

    যথাকার্য সমাধার পর ওরা দুজনে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন সুলতান শারিয়ারের দরবারে পৌঁছতে কিছুটা দেরিই হয়ে থাকবে। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি তার ওপর আদর সোহাগের অবসাদ-সব মিলে প্রিয় বাহুডোর খুলে আসতে হয়ত বা কিছুটা দেরিই হয়েছিলো।

    দরবারে সবই উদ্বিগ্ন। চিন্তিত। সুলতানের তবিয়ৎ কি আচ্ছা নাই। এমন দেরি তো বড় একটা হয় না তার।

    যাই হোক, সুলতান দরবার কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে জল্পনা কল্পনার গুঞ্জন একেবারে থেমে গেলো। শাহরাজাদ পিতা উজির সুলতানের বাহুতে কন্যার মাথার ওড়নাখানা দেখে আঁৎকে ওঠে। মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে তার। তাহলে বুঝি শাহরাজাদ। আর বেঁচে নাই। এতদিন সে কোনও রকমে গল্প বলে ভুলিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু আজ হয়তো সে পারেনি। সুলতান তার মুগুচ্ছেদ করে এসেছে। দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে। এই বুঝি সুলতান তার কন্যার দণ্ডবিধানের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু না, সে সব কিছুই বললো না শারিয়ার। প্রতিদিন সে যেমন বলে। ‘কই কি কাজকাম আছে বলে’, সেই কথাই আজও জিজ্ঞেস করলো।

    সারাটা দিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়ে সন্ধ্যা হতেই আবার সে ফিরে আসে শাহরাজাদের ঘরে। তারপর প্রাত্যহিক সুরতরঙ্গ সমাধা করে আবার উন্মুখ হয়ে বসে গল্প শোনার জন্যে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.