Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২.০৯ নানা রঙের ছয় কন্যার কাহিনী

    নানা রঙের ছয় কন্যার কাহিনী

    জাঁহাপনা এবার আপনাকে যে গল্পটা শোনাব সেটা এর চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। গল্পটি গড়ে উঠেছে ছ’টি মেয়েকে ঘিরে, নানান রঙের ছ’টি মেয়ে। গল্পের চেয়ে এর কবিতা গুলি দারুন চমৎকার! এতদিন তো আপনাকে অনেক কবিতাই শুনিয়েছি; কিন্তু এর কবিতার কাছে ওগুলি যে কিছু নয়। সেকথা আপনাকে আমি হলফ করেই বলতে পারি। এর পরেও যদি আপনার ভালো না লাগে আপনি আমার গর্দান নিয়ে নেবেন যখন খুশী।

     

    শুরু হলো শাহরাজাদের গল্প :

    জাঁহাপনা, আপনি নিশ্চয় বাদশাহ আল-মামুনের নাম শুনেছেন। আমি যাঁর কথা বলছি তিনি সেই ধাৰ্মিক মামুন। একদিন তিনি পাত্রমিত্রদের নিয়ে রাজপ্রাসাদের সিংহাসনে বসেছিলেন। পাত্রমিত্রদের মধ্যে ছিলেন না কে? ছিলেন উজির, আমীর, ছিলেন নামী-নামী পণ্ডিতেরা, আর সভাকবি। এদের মধ্যে তীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন বসোরার মহম্মদ। খুব সুন্দর সুন্দর গল্প বলতে পারতেন। তিনি। বাদশাহ তাঁকে কাছে ডেকে বললেন-মহম্মদ, সুন্দর একটা গল্প বলত। যা কোনদিন এখানে বলো নি। সেই রকম একটা গল্প বলো।

    মহম্মদ বললেন-সে। আর এমন কী কথা। শোনা গল্প বলব, না, নিজের চোখে দেখেছি। এমন কোন কাহিনী শুনবেন?

    বাদশাহ বললেন—সে তুমি বুঝবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে গল্পটা ভালো হওয়া চাই। সবাই যেন শুনে তোমার তারিফ করতে পারে।

    মহম্মদ শুরু করলো গল্প :

    আমি একটি ধনী লোককে চিনতাম, তার নাম আলী। তিনি থাকতেন অল-ইয়ামনে। নিজের দেশ ছেড়ে তিনি বাগদাদে এসে বাস করছিলেন। বাগদাদের শান্ত জীবনযাত্রা তার খুব ভালো লাগত। জীবনটাকে ভোগ করার কোন আয়োজনেরই অভাব সেখানে ছিলো না। সেইটাও টেনে রেখেছিলো তাকে। বাগদাদে তিনি বেশ মানিয়ে নিতে পারবেন। এই ভেবে অল-ইয়ামনে তার যে সব সম্পত্তি ছিলো সেই সব সম্পত্তি নিয়ে এলেন বাগদাদে; মায় তার হারেমটি পর্যন্ত। সেই হারেমে ছিলো ছটি বাঁদী। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে ওই ছটি মেয়েই রূপে-রঙে-ঢঙে একেবারে স্বতন্ত্র প্রকৃতির-কারুর সঙ্গেই কারুর মিল ছিলো না এতটুকু। ছ’জনেই যেন ছ’টি হুরি। যেমন গায়ের রঙ, তেমনি তাদের স্বাস্থ্য। তাদের মধ্যে কে যে বেশী সুন্দরী তা বাছাই করা একেবারেই অসম্ভব ছিলো।

    প্রথম মেয়েটি ফর্সা, দ্বিতীয়টি বাদামী; তৃতীয় মেয়েটি স্বাস্থ্যবতী—একটু মোটাই বলা যায়; চতুর্থ জনের চেহারা একাহারা। পঞ্চম জনের গায়ের রঙ পীতাভ বা সোনালি। ষষ্ঠজনের গায়ের রঙ আবলুস কাঠের মত কালো। বিদ্যা-বুদ্ধি, সাহিত্য-কলা, সঙ্গীত-নৃত্য—কোন বিষয়েই কম। যায় না কেউ।

    ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

     

    তিনশো বত্রিশতম রজনী :

    পরের দিন রাত্রে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ : আদর করে আলী সাহেব ছ’টি মেয়েকে ছ’টি নামে ডাকতেন। ফার্স মেয়েটির নাম ছিলো। বদরুন্নেসা (চন্দ্রমুখী), বাদামী রঙের মেয়েটির নাম ছিলো শোলা (বহ্নিশিখা), স্বাস্থ্যবতী। মেয়েটির নাম হচ্ছে বদর-এ-কামিল (পূর্ণিমা) পাতলা মেয়েটির নাম বেহেস্তের হুরী, পীতাভটির নাম মেহেরুন্নিসা (সূর্যমুখী), আর কৃষ্ণাঙ্গিনীটির নাম কাজল।

    কিছুদিনের মধ্যেই বাগদাদের সব কিছুই আলীর ভালো লাগতে শুরু করলো। অবশ্য ভালো লাগার কথাই। তখন দুনিয়াজোড়া বাগদাদের নাম। আকাশই বলুন, বাতাস-ই বলুন, আর খানাপিনাই বলুন-বাগদাদের সব কিছুই সুন্দর, চিত্তাকর্ষক। একদিন সকালে আলী সাহেবের মেজাজটা খুব ভালো ছিলো। গল্প করার জন্যে তীর মেয়েদের ডেকে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে মেয়েরা পান ভোজন করবে, করবে নানান রঙ্গতামাসা নাচে-গানে তারা মাতিয়ে রাখবে সাহেবকে।

    যথারীতি হাজির হলো মেয়েরা। শুরু হলো হাসিঠাট্টা, রঙ তামাসা, গল্পগুজব। দুনিয়ায় হেন জিনিস নেই যা বাদ পড়লো। অনেকক্ষণ। এইভাবে চলার পরে আলী সুাহেবের মেজাজ আরও সরিফ হয়ে গেলো। খুশীতে ভরে উঠলো মেয়েদের মনও। রঙ-তামাসার ফোয়ারা উঠলো। চারপাশে। ঢল-ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবনি ছড়িয়ে পড়লো ঘরের মধ্যে। হাসতে-হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়লো।

    এমন সময় আলী সাহেব এক পেয়ালা সরাব নিয়ে বদরুন্নেসার কাছে গিয়ে বললেনঃ সুন্দরী, তোমার গানে তো মধু ঝরে। তোমার সেই সুরেলা কণ্ঠে মজাদার একটা গান শোনাও না আমাদের।

    জাঁহাপনার মর্জি। —এই বলে বীণা হাতে তুলে নেয় মেয়েটি। ধীরে-ধীরে ঝঙ্কার ওঠে বীণার তারে; মিঠে সুরেলা ঝঙ্কার। —সুরের সেই আবেশে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ; নিম্প্রাণ পাথরের বুকেও বুঝি বা জীবনের স্পন্দন জেগে ওঠে। ঝঙ্কারের সঙ্গে তাল দিয়ে গাছপালারাও বুঝিবা নেচে-নেচে ওঠে। বীণার সুরের সঙ্গে তাল মিশিয়ে গান ধরলো বদরুন্নেসা :

    আগুনের প্রলেপ দিয়ে আমার চোখে
    প্রিয়তমের রূপটি আছে আঁকা।
    আমার জাফরানী এই বুকের মাঝে
    র ছবি আছে গাঁথা।
    আমার চোখের সুমুখ থেকে
    যায় যদি সে চলে,
    আমি তখন থাকিব চেয়ে
    আমার হৃদয় তলে।
    আবার যদি সামনে থাকে মোর
    (আমি) থাকব তখন আঁখির নেশায় ভোর।

    গান শেষ হলো; কিন্তু রেশ আর কাটে না তার। আলী সাহেব তো খুব খুশী। সরাবের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে আদর করে এগিয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে। পেয়ালা নিঃশেষ করে মেয়েটি তার হাতে সেটি ফিরিয়ে দিলো কুর্নিশ করে। পেয়ালাটি দ্বিতীয়বার পূর্ণ করে বাদামী রঙের মেয়েটির কাছে গিয়ে তিনি বললেন-শোলা সুন্দরি গানের গলা তো তোমার খাসা। উচ্চারণও বড় সুন্দর। তোমার গান শুনলে মানুষের সব দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যায়। তোমার মনের মতে করে শোনাও না। আমাদের একখানা গান।

    যথা আজ্ঞা, জাঁহাপনা। —এই বলে বীণা তুলে নিলো মেয়েটি। করুণ সুরে বাজালো প্রথমে। সুরের আর্তিতে ভরে গেলো চারপাশ। সেই সুর হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করে ঘুমন্ত বেদনার ঢেউকে জাগিয়ে তুললো। তার উদ্বেল তরঙ্গগুলি কল্পনার তটপ্রান্তে আছাড় খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। তারপর ধীরে ধীরে গান করতে লাগলো। সুরের মৃদু আলাপের সঙ্গে সঙ্গে তার দেহটিও কাঁপতে লাগলো তালে-তালে :

    আমার প্রিয়তমের মুখটি রাঙা
    গোলাপ ফুলের মত।
    তার কাছোতে শিখছে বসে
    রূপবিলাসী যত।
    যে সব হতভাগ্য নারী
    জুড়িয়ে দিলেন মনের ক্ষত
    তাদের হাতে তুলে দিলেন
    মানুষ ধরার ফাঁদ।
    বিশ্বে তো এর নেইক জোড়া
    তাইতো পরমাদ।

    কী সুন্দর গান! হৃদয়টাকে একেবারে তরল করে দেয়। আলী সাহেবও খুশীতে ডগমগ। হাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সোহাগ করে মেয়েটির হাতে সেটি তুলে দিলেন। মেয়েটি কুর্নিশ করে পেয়ালাটা নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে ফেললো। আলী আবার পেয়ালা ভরে নিয়ে স্থূলাঙ্গিনীর কাছে গিয়ে বললেন—ও বদর-এ কামিল, তোমার বপুটি কিঞ্চিৎ স্কুল। তাতে হয়েছে কী? সোজা সরল, মিষ্টি ব্যবহারে তোমার জুড়িদার নেই। তুমি যেমন সোজা, সেই রকম একখানা গান আমাদের শোনাও দেখি।

    এই শুনে মেয়েটি বীণা তুলে নিলো হাতে। ধীরে-ধীরে বাজাতে লাগলো বীণা। এমন বাজনা যার সুরে পাষাণ হৃদয়ও গলে যায়। প্রথমে গুনগুন করে শুরু করে তারপরে আসল গানটি ধরলো :

    একটি হাসির তরে আমি বিশ্ব দিতে পারি,
    যদি আমি ভাঙতে পারি তোমার জুরিজারি।
    তোমার মুখে একটি কথা শুনতে যদি পাই,
    মাটির পরে হাঁটবে রাজা অন্যাথা তার নাই।
    রাজাদের সবটুটবে মুখের বাঁধ,
    তোমার যদি হাঁটার জাগে সাধ।
    খুশ করতে পারলে তোমায়
    থাকিব তোমার পায়ের তলায়;
    তোমায় যদি হারাতে হয়। ভাসব আঁখি লোরে।
    বিশ্বটাকে ছাড়তে পারি একটি চুমুর তরে।

    এবারেও আলী সাহেব খুব খুশী হলেন। ঠোঁট দিয়ে সরাবের পেয়ালা ভিজিয়ে এগিয়ে দিলেন মেয়েটির কাছে। সরাবের পেয়ালা গ্রহণ করলো মেয়েটি। পেয়ালাটা আবার পূর্ণ করে নিলেন তিনি। পাতলা মেয়েটির কাছে গিয়ে বললেন—ওগো বেহেস্তের হুরি, তোমার পরিচয় তো তোমার নামেই। বীণার তারে সুর তুলে আমাদের একটা গান শোনাও দেখি।

    জাঁহাপনার যা আদেশ—এই বলে বীণাটি হাতে তুলে নিলো সে।

    তারপরে গান ধরলো—

    আমার প্রেম সে তুচ্ছ করে
    এর যে আমি বিচার চাই।
    প্রেম করে যে ভুল করেছি, তার
    জরিমানা লক্ষ হাজার
    দেওয়ার মত জাজটি কোথায় পাই।
    সওয়াল শেষ হওয়ার পরে
    উদাসীনতার তরে
    এমন জজ যে চাই।

    গান তো নয়—একেবারে সুরের ঝর্ণা। সেই ঝর্ণার তালে-তালে পায়ের নূপুর বেজে চলেছে ঠুন-ঠুন করে। আলী সাহেব বেজায় খুশী—একেবারে বেহেড হয়ে গেলেন। আমেজটা একটু থিতিয়ে এলে হাতের পেয়ালাটায় একটু ঠোঁট দিয়ে মেয়েটির হাতে সেটি তুলে দিলেন। মেয়েটিও কুর্নিশ করে সেটি নিঃশেষ করে ফেললো শূন্য পেয়ালাটি আবার ভরিয়ে নিয়ে সোনালি রঙের মেয়েটির সামনে এগিয়ে গেলেন আলী সাহেব।

    ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প থামিয়ে দিলো শাহরাজাদ।

     

    তিনশ তেত্রিশতম রজনী :

    সরাবের পেয়ালাখানি হাতে নিয়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে আলী সাহেব বললেন— মেহেরুন্নেসা, কী সুন্দর রঙ তোমার। গলানো সোনার রঙ-ও তোমার ওই রঙের কাছে কিছু নয়। তুমি একখানা প্রেমের গান শোনাও দেখি। যে প্রেমের কাছে মানুষ নিজের জীবনকেও তুচ্ছ বলে মনে করে। যার কাছে জগত-সংসার-ও অসার। এই রকম একটা গান গাও।

    আলী সাহেবের আদেশে কুর্নিশ করে বীণাটা তুলে নেয় মেহেরুন্নেসা। বেহাগের সুর ধরে, সঙ্গে তার কণ্ঠ মেলায়। ছন্দের তালে-তালে নেচে ওঠে তার কটি দেশ, হিল্লোল জেগে ওঠে তার শিরায় শিরায়, অঙ্গের লাবনিতে। ধীরে-ধীরে জেগে ওঠে। গানের কলি :

    তার চোখ থেকে যে ছিটকে এলো, ভ্রমর কালো
    হুল বেঁধানো বিষম বঁকা শর।
    নিবিয়ে দিলো আমার চোখের রঙিন যত আলো
    তখন বলি হৃদয়টারে আহত জর্জর
    ‘হায় অভাগা হৃদয় আমার শোনো,
    বিষের ক্ষতে ভুগছি তুমি জেনো।
    কোথায় তুমি দাওয়াই পাবে বল?
    বৃথাই তোমার ঝরবে আঁখিজল।’
    তবু যদি হৃদয় কিছু বলে
    তারে আমি শুনতে নাহি পাই;
    কেমন করে শুনব বল
    হৃদয় সেথায় নাই।
    সে যে আজ হারিয়ে গেছে
    পথের ধূলির মাঝে–
    কামনার ফাঁস পরেছে
    লাগবে কী আর কাজে।

    হৃদয়ের নিভৃত কন্দরের রুদ্ধ দরজায় আঘাত করলো মেয়েটি, জাগিয়ে তুললো সুপ্ত বেদনার আর্তিকে। কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো আলী সাহেবের মনটিও সরাবের পেয়ালায় ঠোঁট দিয়ে তিনি সেটি এগিয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে। কৃতজ্ঞচিত্তে মেয়েটি তা গ্রহণ করলো। সুরাপত্ব আবার পূর্ণ করে এগিয়ে গেলেন তিনি কৃষ্ণাঙ্গীর কাছে, বললেন-চোখের নীল অঞ্জন তুমি। চেহারাটা কৃষ্ণ ভ্রমর হলে কি হবে? মনটা তোমার বরফের মত সাদা। তোমাকে দেখলে আল্লাহর পরম করুণার কথা মনে পড়ে যায়। এ-দুনিয়ার ব্যথা বেদনার যেন প্রতীক তুমি! তোমার মুখের দিকে তাকালে জীবনের সব দুঃখ, ব্যথা আর বেদনার কথা আমি তুলে যাই। মনটা যে তোমার গোলাপের মত সুগন্ধী। তোমার মনের মত একটা গান শোনাও না আমাদের।

    মাথা নিচু করে প্রভুর নির্দেশে মেয়েটি বীণা তুলে নিলো হাতে।

    বীণার তারে সুরের ফুলঝুরি ছড়িয়ে পড়লো। দুঃখের সুরে কতখানি মাদকতা রয়েছে আলী সাহেব তা যেন বুঝতে পারলেন। বিভিন্ন সুরের আমেজে মুগ্ধ হয়ে উঠলো সবাই। তারপরে মেয়েটি তার সেই প্রিয় গানখানি গাইলো :

    আমাদের প্রেমের যে স্বর্ণশিখা জ্বলছে তার জন্য
    শোক কর; কারণ আমার প্রেমিক অন্য
    নারীদের প্রীতির চোখে দেখে। কিন্তু গোলাপকে
    ভালোবাসতে তোমরা বাধা দিয়ে না আমাকে।
    যে হৃদয় গোলাপের স্বপ্নে মাতোয়ারা হায়,
    আমার সামনে কুড়িটি পেয়ালা সাজানো
    সেগুলি সব সরাব দিয়ে ভরানো
    আর রয়েছে কেবল চুমু খাওয়ার জন্য
    একটি পুরানো গিটার, আমার প্রিয়তম সে-ই;
    কিন্তু আমার কাছে কোন সুগন্ধী নির্যাস নেই।
    আমার গোলাপগুলি সোনালি আগুন হয়ে উঠেছে
    কিন্তু আরো অনেক অনেক ফুল ফুটেছে
    তারা হয়নিক হতমান,
    এবং স্বগে চিরবসন্ত বিরাজমান।
    ভগবান, যাকে সবাই ভালোবাসে, তাকে
    ভালোবাসা কি অপরাধ বলে গণ্য হয়ে থাকে!

    এমন সুন্দর গান অনেকদিন শোনেননি আলী সাহেব। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো র্তার। সরাবের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে এগিয়ে দেন মেয়েটির দিকে। মেয়েটি এক চুমুকে পেয়ালাটি উজাড় করে দিলো।

    এবার ছ’জনেই উঠে এসে আলী সাহেবকে কুর্নিশ করে মাটিতে চুম্বন করলো। মেয়েরা জানতে চাইলো কার গান তীর সব চেয়ে ভালো লেগেছে। গানের সুরই বা কার ভালো, বীণার ঝংকারই বা কার সব চাইতে ভালো?

    আলী সাহেব তো মহা ফাঁপরে পড়লেন!। এ-সমস্যার সমাধান তিনি কেমন করে করবেন? রাখবেন কাকে, কাকে ফেলবেন? প্রত্যেকেরই গান, সুর, ঝংকার এত সুন্দর হয়েছে, প্রত্যেকেরই দেহ-হিল্লোল এত অনবদ্য হয়েছে যে তাদের আলাদা করে বিচার করাটা কেবল কষ্টকরই নয়, একেবারে অসম্ভব।

    তবু যখন সমস্যা একটা উঠেছে তার সমাধানের একটা চেষ্টা করা উচিৎ। সেই সৎচেষ্টাতেই তিনি চোখ দুটি বুজিয়ে প্রতিটি গান আলাদা আলাদা করে ভাবার চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকার পরে অপ্রত্যয়ের ঘাড় নাড়লেন তিনি। এ অসম্ভব, এ অসম্ভব। কারোও কোন খুৎ নেই; কেউ কিছু কম যায় না।

    আলী সাহেব বললেন—আল্লাহকে ধন্যবাদ, তোমাদের মত গুণবতী মেয়েদের আমি পেয়েছি। এটাই আমার পরম সৌভাগ্য। তোমরা আমার গর্ব। আমি সাচ্চা কথাই বলছি, তোমাদের আমি সমানভাবে ভালোবাসি। আমি তোমাদের কাউকেই আলাদা করে দেখতে পারব না। তার চেয়ে তোমরা আমার কাছে এসো। সবাই মিলে আমাকে আদর করা।

    যে কথা সেই কাজ। ছটি মেয়েই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো আলী সাহেবের বুকে। নানানভাবে সোহাগে-আদরে ভরিয়ে তুললো তাকে।

    বেশ কিছুক্ষণ। এইভাবে চলার পর আলী সবাইকে গোল করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। নিজে মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন—সোহাগীরা তোমাদের মধ্যে থেকে একজনকে শ্রেষ্ঠ বলে বেছে নেওয়ার সাধ্য আমার নেই। আর সে-চেষ্টা করাও আমার পক্ষে উচিৎ হবে না। তাতে সুবিচার হবে না, তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে সেটা বিচার করার ভার আমি তোমাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। তোমরা সকলে নিশ্চয় কোরান পড়েছি। ভালোভাবেই পড়েছ; সেই সঙ্গে অন্য পড়াশুনাও তোমাদের কম নেই। পুরানো ইতিহাস বা পিতৃপুরুষদের নানান কাহিনীও তোমাদের জানা রয়েছে ভালো করেই। আমি দুজন-দুজন ঠিক করে দেব। একজন নিজের গুণাপনা আর রূপের কথা বলবে। যত সুন্দর করে পার বলবে। তোমার বিরোধী যে থাকবে সে সঙ্গে সঙ্গে তোমার বক্তব্য খন্ডন করবে। অর্থাৎ, তুমি যাকে উত্তম বলবে সে সেটাকে নিকৃষ্ট বলে প্রতিপন্ন করবে। এইভাবে তিনটি জোড় হবে তোমাদের। বিতর্ক চলবে দুজনের মধ্যে, প্রথমে ফরসা আর কালো বাঁদী, তারপরে পাতলা আর মোটা; শেষকালে সোনালী আর বাদামী। হ্যাঁ; এই সঙ্গে একটা কথা বলে দিই। তর্ক চলার সময় আজেবাজে কথা বলবে না; ব্যবহার করবে না অশ্লীল কোন শব্দ। ভালো-ভালো কথা বলবে। প্রয়োজন মনে করলে জ্ঞানী লোকের বা নামকরা কবির উদ্ধৃতি দিতে পোর।

    ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামাল।

     

    তিনশো চৌত্রিশতম রজনী :

    পরের দিন দুপুর রাতে যথারীতি গল্প শুরু করলো শাহরাজাদ। বাঁদীরা সকলেই এক সঙ্গে রাজি হয়ে গেলো। বিতর্কের শর্ত অনুযায়ী প্রথম জুড়িটি বলতে উঠলো—ফরসা আর কালো বাঁদী। বদরুন্নেসা সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কাজলের। চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বদরুন্নেসাই শুরু করলো প্রথম :

    আরে কালো মেয়েটা, সাদা বা ফরসা রঙ নিয়ে জ্ঞানীরা কী বলছেন শোনো তাহলে, বলছেন-আলো সাদা, চাঁদের আলো সাদা, আর সাদা হচ্ছে বীর্যবান পুরুষ। ভাগ্য ভালো হলে ফরসা মানুষের কপাল চকচক করে। তাই বোধ হয়। সেই বিখ্যাত কবি আমার জন্যেই বলেছেন—

    সৃষ্টি করার সময় মেয়েটিকে
    ভগবান মুক্তার ফেনা দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন।
    তারপরে শিশিরে মেদিগাছ ভিজিয়ে
    তৈরি করেছিলেন তার অপরূপ তনু।
    সেই সঙ্গে সাদা গোলাপও নিয়েছিলেন কিছু;
    কিন্তু শেষ কালে আরও কিছু তিনি যোগ করেছিলেন–
    সেগুলি হলো তার উজজুল বাগান, আর
    তার সঙ্গে দোদুল্যমান পন্থপাদপ।

    কবিতাটি শেষ করে বদরুন্নেসা বললো-এই শেষ নয়। আরও, আরও আছে শোনো। দিনের আলো সাদা, কমলা ফুল সাদা, আর সাদা ভোরের শুকতারা।

    এবারে শোনো এই সাদা নিয়ে কোরাণে কী বলেছে। একবার মুসার হাতে কুণ্ঠরোগ হলো। আল্লাহ মুশাকে বললেন—তোমার হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে দাও; সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সাদা হয়ে যাবে। পবিত্র হবে হাত। যা ক্ষয়ে গিয়েছিলো তা উঠবে ভরে।

    আমাদের ধর্মগ্রন্থে বলেছে—যাদের মুখ ফরসা, যাদের মুখ পোড় খায়নি, আল্লাহ কেবল তাদেরই করুণা করেন।

    সব রঙের রানী হলো আমার গায়ের রঙ। সেই রঙেই আমার রূপের জলুস, আর সেই রূপেই আমার রঙ খোলতাই।

    দামি-দামি পোশাক আর দামি-দামি অলঙ্কারকদের গায়ে মানায় জানিস? আমার মত গায়ের রঙ যাদের তাদের। এসব কথা কে না জানে?

    ওই যে বেহেস্তের বরফ যা এই দুনিয়ার বুকে নেমে এসেছে তার রঙও সাদা। ধাৰ্মিকরা যে ফেজ পারেন। তার রঙও সাদা। এ-রঙ রঙ-তামাসা করার বস্তু নয়।

    আমার রঙ নিয়ে আর কত বলব? এ-দুনিয়ায় যত ভালো-ভালো কথা রয়েছে আমাকে বাদ দিলে তাদের একটা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমার ফর্স রঙ সূর্যের আলোর মত সত্য। তাই আমাকে নিয়ে আর কিছু বলছি নে। এবার তোর ওই পোড়া রঙ নিয়ে কিছু বলব। ওরে কালো, শ্মশানের কাক। দোয়াতের কালি, ঘরে যে কুল পড়ে তার রঙও তো কালো! কালো কাকের রঙ। কিন্তু কাক কি ভালো গান গাইতে পারে?

    একজন কবি এই সাদা-কালো নিয়ে কী সুন্দর কবিতাই না একটা লিখেছেন। মন দিয়ে শোনো :

    বন্দী রাজার অর্থ দিয়ে একটি তারা মুক্তা কিনে।
    কিন্তু এক বস্তা কয়লা বেচে একটি শিলিঙ দামে;
    সাদা মুখ আর সাদা পাখায় স্বৰ্গটাকে নাও চিনে,
    নইলে স্বৰ্গ থাকত নাক-শুধু নামে।
    তোমরা যদি রাজি থাক—বলতে পারি সত্যি কথাটাই
    নরক আমরা যাকে বলি সেত শুধু কালোতে বোঝাই।

    ধাৰ্মিক নেওয়ার একটা গল্প বলি শোনো। তার দুই ছেলে—সাম ও হাম। ছেলে দুটিকে পাশে বসিয়ে একদিন তিনি ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় নেওয়ার কাপড় গেলো উঠে। পুরুষাঙ্গ বেরিয়ে পড়েছে দেখে খুব হাসতে লাগলো হাম। মানুষের ইতিহাসে নেওয়া হলেন দ্বিতীয় পুরুষ। তার সেই বিচিত্র জীবনের গৌরব কাহিনী কে না জানে? সাম কিন্তু হাসেনি। বাবার ধর্ম, বাবার গৌরব যে কত বড় তার কিছু কিছু সে জানত। কোন কথা না বলে চুপচাপ উঠে সে। তাঁর কাপড়টা ঠিক করে গুছিয়ে দিলো।ইতিমধ্যে ঘুম ভেঙে গেলো তার। জেগে উঠে হামকে হাসতে দেখে তিনি তাকে অভিশাপ দিলেন। সামের গভীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি তাকে আশীর্বাদ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হামের মুখ কালো হয়ে গেলো; সাদা হয়ে গেলো সামের মুখের রঙ। সামের বংশধররা হলেন ঋষি, ধর্মপ্রচারক, পুরোহিত, আর রাজারা। আর অভিশপ্ত হাম কী করলো জান? ওই কালো মুখ পাছে কেউ দেখতে পায় এই ভয়ে সে সংসার ছেড়ে পালিয়ে গেলো। তার বংশে জন্ম নিলো সুদানের কালো কুচ্ছিৎ নিগ্রোরা। এদের বংশে আজ পর্যন্ত কোন সাধু-সন্ত, পয়মন্ত, অথবা দেবদূত জন্মাননি। এ-কথা কেবল জ্ঞানীগুণীরাই নয়, সাধারণ মানুষও জানে।

    আলী সাহেব বদরুন্নেসাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন—তুমি এবার চুপ কর। এবারে কাজল বলবে।

    কাজল এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিলো। এবারে সে বদরুন্নেসার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো।–তুই কিছুই জানিস নে কিছু বুঝিসই না তা বলবি কী করে? কোরাণে কী বলেছে শোনো : পরমেশ্বর আল্লাহ শপথ নিতেন গভীর রাতে। দুপুর বেলাতেও যে নিতেন না সে কথা ঠিক নয়। তবে মাঝ রাতটাকেই তিনি পছন্দ করতেন বেশী। তা বাপু হে, মাঝরাতটা কি সাদা, না কালো? ভালো করে মাথাটা খাটিয়ে ভেবে দেখ।

    এবার বলি কলো চুলের কথা। কালো চুল কীসের প্রতীক বলো দেখি? বলতে পারলি নে? শোনো তবে। কালো চুল হলো যৌবনর প্রতীক। বার্ধক্যের প্রতীক সাদা চুল। বার্ধক্যেই ভোগ-বাসনা–কামনার শেষ। এক কথায় পূর্ণচ্ছেদও বলতে পারিস।

    ভোর হয়ে আসছে দেখে চুপ করে গেলো শাহরাজাদ।

     

    তিনশো পয়ত্রিশতম রজনী :

    পরের দিন রাত্ৰিতে গল্প বলতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ।

    কাজল বললো—কালো যদি রঙের রাজাই না হবে, তো আল্লাহ কেন চোখের মণি আর কলিজার রঙ কালো করেছেন বলো? কোন এক কবি কী সুন্দর কথাই না বলেছেন :

    কৃষ্ণবৰ্ণ দেহের মাঝে আগুন ভরা আছে।
    কৃষ্ণ কালো শিরায়-শিরায় ভোগ-বাসনা নাচে।
    কালো দেহে উপছে ওঠে যৌবন চঞ্চল।
    হে বিধাতা, রক্ষা কর, ফেলছি আঁখি জল
    ডিমের খোলা নিয়ে আমার বাঁচার ইচ্ছা নাই।
    খোলটাকে ভালোবাসা সেইত বিপর্যায়। তাই
    সেই খোলস নিয়ে বাচার কথা ভাবতে গেলে হায়
    আমার বাঁচাই হবে দায়।
    সত্যি আমি দেখতে নারি মৃতের সাদা ঢাকনা;
    পক্ককেশীর ভালোবাসা, সে তো কবরখানার কান্না।

    এই প্রসঙ্গে আরও একজন কবি কী বলেছেন শোনো :

    আমন করে চাইছ কেন? ভাবিছ বুঝি কী জঞ্জাল!
    কালো মেয়ের অন্বেষণে বুদ্ধি আমার উধাও হলো নারে!
    ডাক্তারেরা, বলছি শোনো, বলছে চিরকাল
    কালো চিন্তা বুদ্ধিমানে, পাগল করে ছাড়ে।

    আরও রয়েছে। শুনবো? শোনো তাহলে :

    দুপুর রোদে কোনদিনই কাউকে আমি ভালোবাসিনি
    শ্বেতীর মত সাদা মেয়েদের আমি ঘৃণা করি
    ওরাসব বস্তাপচা ময়দার মত।
    ওদের ভালোবেসে কোন ফয়দা নেই।
    এক ঘণ্টার বেশী ওদের সঙ্গে প্রেম করা যায় না।
    কালো মেয়েদেরই আমি ভালোবাসি বেশী
    সেখানে কোন রাত্রির বালাই নেই
    চাঁদ থাকবে কেমন করে?

    খুব অন্তরঙ্গ বন্ধুরা এক জায়গায় কখন জড় হয়? রাত্রিতে। প্রেমিক-প্রেমিকরা কাকে খুঁজে বেড়ায়? ছায়াকে কেন বলতো? কারণ, ছায়ার রঙ কালো। রাত্রির অন্ধকার ডানা মেলে। ওদের ঢাকা দিয়ে রাখে যাতে দিনের আলো তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে না পারে। দিনের আলোতে ওসব হলে তো তুই-ই ঢাক নিয়ে বেরিয়ে পড়বি। ফুলশয্যা শেষ হয়ে গেলে দম্পতীরা কী বলে আক্ষেপ করে বলো দেখি। বলে, হায়রে, এত তাড়াতাড়ি রাত পুইয়ে গেলো? কেন বলে? বলে এই জন্যে যে রাতকে তারা পছন্দ করে, ভালোবাসে। কালো যে কত ভালো তার প্রমাণ কি আরও চাও? একটা বয়েৎ শোনো :

    সাদায়-কালোয় মেশা ছেলে যত
    চর্বি খেয়ে বেঁচে থাকে যারা
    তাদের আমি ভালোবাসি নাত।
    একটা কালো ছেলে যার অঙ্গ দোহারা
    সত্যি কথা বলছি–সেত
    ওদের বিশজনদের মত।
    অর্থাৎ? মনের কথা বলছি আমি বলে
    তুমি অবাক হলে?
    কালো ঘোড়া জোরসে ছুটে চড়তে ভালোবাসি।
    সাদা খোঁড়া হাতি যত বুড়োর জন্যে রাখি।

    আরও একটা শুনবে? বহুৎ আচ্ছা, শোনো :

    কালো রোতই চুমু খাওয়ার শয্যা।
    সাদা সকল সেত দারুণ লজ্জা।
    আমার যদি চেয়ে নেওয়ার থাকত অধিকার,
    আমি কালো রাতেই চেয়ে নিতাম সন্দেহ নেই তার।
    বিধির কাছে আজি দিতাম-এ জীবনে যত আছে আলো
    সবই যেন ভরিয়ে দেযায় নিতল ঘন কালো।

    ওরে, সাদা, কালোর প্রশংসা আর বেশী করব? রঙের জগতে কালেই একমাত্র সাচ্চা; বাকি স-ব কাঁচা। ব্যস—এইখানেই শেষ। যা বলেছি। এই যথেষ্ট। কথায় বলে না, অল্প কথায় যুক্তি বেশী। কালোর প্রশংসা শেষ করে এবারে শুরু করছি তোর কথা। পুরুষকে আমি যতখানি টানতে পারি তুই ততটা পারিস নে। তোর অঙ্গটা একেবারে খেলো—এলোমেলো-ও বলতে পারিস। তোর সাদা রঙটাত কুষ্ঠর মত একটা দুষ্ট রোগ। কী বিশ্ৰী গন্ধ বলত—একথা সবাই জানে। একটু আগে নিজেকে তুই বরফের সঙ্গে তুলনা করেছিলি না? তাহলে শোন। দোজখের নাম শুনেছিস তো? সেখানে পাপীদের ঠাণ্ডায় জমিয়ে ফেলার জন্যে বরফ জমিয়ে রাখা হয়। ঠাণ্ডা বলে ঠাণ্ডা! আগুনের চেয়েও সাংঘাতিক। আর তার রঙটা হচ্ছে বরফের মত সাদা। প্রেমিক-প্রেমিক তাই বরফটাকে বরবাদ করে দিয়েছে। তার চায় উম। তুই আমাকে লেখার কালির সঙ্গে তুলনা করেছিলি তাই না? আল্লাহর কিতাব কীসে লেখা হয়েছে রে? এই কালো কালিতেই। মৃগানভির গুণ কী জানিস তো? তার রঙটা কী? কালো। তাইত কবি বলেন :

    সবার সেরা মৃগনাভী রঙটা তার কালো
    পচা নাসপতি হলো সাদা
    আমার চোখে কালো মেয়ে সবার চেয়ে ভালো
    অন্য সবাই জীবন-পথে বাধা।
    কালো চোখের মণি দিয়ে দেখতে তুমি পাও।
    অন্ধ জনের সাদা চোখে সমস্ত উধাও।

    ব্যস…ব্যস! দারুণ বলেছ তোমরা। তোমাদের তারিফ না করে পারছিনে-বললেন আলী সাহেব-তোমাদের বিতর্ক খুব ভালো হয়েছে। এবারে দ্বিতীয় দল এগিয়ে এসো।

    এই কথা শুনে কালো আর ফরসা মেয়ে নিজেদের জায়গায় ফিরে গেলো। এগিয়ে এলো মোটা আর পাতলা মেয়ে।

    আলী সাহেবের নির্দেশে প্রথমে শুরু করলো মোটা মেয়ে বদর-এ-কামিল। শুরু করার আগেই সে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলো। জামা খুললো, বসন খুললো। একটা একটা করে সব খুলে ফেলে একেবারে উলঙ্গ হয়ে গেলো। ঘুরে-ঘুরে দেখালো তার প্রতিটি অঙ্গ। দেখোল কবজি, পায়ের গোড়ালি। দেখাল উরু আর পায়ের গোছা; উদ্ধত কুচযুগের নিচে সুন্দর রেখায় তার উদরটি অঙ্কিত রয়েছে সেটি দেখালো। দেখোল পরিপুষ্ট পরিসরমর্দন কুচযুগল; গুরুভার নিতম্ব দেখাল। অবশ্য সেমিজে ঢাকা ছিলো সব; কিন্তু সে নামকে ওয়াস্তে। ফিনফিনে পাতলা সেমিজ ভেদ করে তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেই ঠুনকে আবরণ তার উদ্ধত যৌবনকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলো না। বলোল কটাক্ষে নগ্ন দেহে মৃদুকম্পন তুলে সে আলী সাহেবের কামনার আগুনে ধূনা ছিটিয়ে দিলো যেন; তারপরে পাতলা মেয়েটির সামনে গিয়ে বললো–

    শেষ হয়ে এলো রাত। শাহরাজাদ থামালো তার গল্প।

     

    তিনশো ছত্রিশতম রজনী :

    পরদিন রাত্ৰিতে আবার শুরু করলো শাহরাজাদ :

    বদর-এ-কামিল বেহেস্তের হুরীর সামনে কোমরে হাত দিয়ে চোখ নামিয়ে বললো—আল্লাহর মেহেরবানীতে গুহা-পাহাড়-পর্বত এ-দুনিয়ার সর্বত্র নরম গালিচা পাতা। নরম তুলতুলে জিনিস বড়ই পছন্দ করেন তিনি। আমার গায়ে এই যে চর্বি দেখছো এই নরম তুলতুলে জিনিসটিও সে-ই আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর দয়ায় আমার শরীরে তাই পদ্মগন্ধ, মধুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। আমার গায়ে প্রচুর মাংসও দিয়েছেন তিনিই, দিয়েছেন প্রচুর শক্তি। এক ঘুষিতে শক্রকে আমি মাটিতে পাট করে ফেলে একেবারে লোপাট করে দিতে পারি। সে তাগাদ আমার রয়েছে।

    ওরে রোগা-প্যাটকা মেয়ে, তালপাতার সেপাই—বিজ্ঞ মানুষেরা এ বিষয়ে কী বলেন তা আমার কাছ থেকে শোনো : আনন্দ বলতে জীবনে তিনটি জিনিসে রয়েছে। সেই তিনটি জিনিস হলো— মাংস খাও, মাংসের ওপরে চড়, আর মাংস নিয়ে খেলা কর।

    কথাটা ঠিক। স্বাস্থ্যুবতী মেযেদের দেখলে কার না ভালো লাগে! চড়াই-উৎরাই দেখে কেউ কি মুখ ফেরায়? আমাদের আল্লাহ নরম চর্বিকত ভালোবাসেন জানিস? সেই জন্যেই তো তিনি হৃষ্টপুষ্ট মেদহবহুল মেষশাবক। আর বাছুরকে কোরবানি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

    জামাকাপড় খুলে প্রকৃতির পোশাকে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার দিকে একবার নয়ন মেলে তাকা। এ যেন প্রকৃতির সাজানো একটা বাগান। বুকে ধরেছে ডালিম, গালে ধরেছে লাল পিচফল, আর আমার কোমরের নিচে ধরেছে তরমুজ।

    ইজরাইল ছেড়ে মিশরে উড়ে গিয়েছে তিতির পাখি। সেই থেকে ইজরাইলের ছেলেমেয়েরা আর তিতিরের মাংস খেতে পায় না। কী দুঃখ তাদের? তা খুকুমনি, এই তিতিরের মাংস কতটা হয়। তা জান? আর খেতে কত সুস্বাদু। সে সম্বন্ধেও কি জ্ঞান রয়েছে তোমার? অত মাংস ওর গায়ে রয়েছে বলেই না। ওর এত কদর?

    মাংসের দোকানে গিয়ে মাংস বাদ দিয়ে হাড় কিনতে কাউকে দেখেছ কোনদিন? না, কোনদিন সেই তাজ্জব ব্যাপার তুমি শুনেছ? মাংসের দোকানদার তার ভালো-ভালো খদেরদের জন্যে লুকিয়ে রাখে রান আর গর্দানের মাংস। সে কি এমনি এমনি?

    আমার মত কোন স্বাস্থ্যুবতী মেয়েকে দেখেই কবি বলেছেন :

    দেখ দেখা ধনি তার হাঁটার লাবনী।
    গুরু নিতম্বভারে তার কাঁপছে মেদিনী।
    পরনে বিন্দরে মোর চকিত-নয়নী।
    দেখ ওই বিশ্রামিছে চতুরা ভামিনী।
    মূর্তিমতী কামনার রানী।
    দেখ দেখা নাচত ও বররঙ্গিনী
    বঙ্কিম নয়নে তার ক্ষণে-ক্ষণে ছুটত দামিনী,
    জঙ্ঘা কাঁপছে তার
    কাঁপে হৃদি বসুধার
    হৃদয় ভরলো আজ জীবন সফল বলে মানি।

    আর তোর চেহারাটা দেখ একবার! একেবারে বসানো দাঁড়কাক। কাকের মত সরু সরু পা, লোহার শিকের মত উরু তোর! তোর বুক দেখে কার সুখ হয় বলতে পারিস? কী শক্ত তোর দেহের হাড়! ভুল করে কোন পুরুষ তোকে জড়িয়ে ধরলে, খোদার কসম সে জখম হতে বাধ্য। তোর মত মেয়েকে দেখেই কবি বলেছেন :

    আল্লা করুন, কভু যেন রোগার ঘাড়ে চাপতে না হয়,
    রোগা নারী বেশ আনাডি তাইত তারে বিষম ভয়।
    তাদের বুকে কোথাও যদি এক চিলতে আরাম পাই
    ভোর বেলাতে দেখব উঠে শিরায় আমার রক্ত নাই।

    আলী হাত তুলে বলেন-ব্যস, ব্যস। আর না বেহেস্তের হুরী এবার তোমার পালা। এবার তুমি জবাব দাও। বেহেস্তের হুরী হচ্ছে ছটি মেয়ের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট। মোটা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে বলতে শুরু করলো :

    আমাকে এই দেহ কে দিয়েছেন জানিস? দিয়েছেন পরম করুণাময় আল্লাহ। তাকে আমি শতকোটি সেলাম জানাই। লম্বা ইয়েলো গাছ যখন বাতাসে দোলা খায় সেই অপরূপ দৃশ্য তুই দেখেছিস? তার ডালগুলি কী সুন্দর নাচে বলো দেখি! প্রচণ্ড ঝড়ে বাঁশ যখন মাথা নাচায় তখন কী ভালোই না লাগে! পদ্ম ডাটার ওপরে যে ফুল ফোটে তার চেয়ে সুন্দর জিনিস দুনিয়ায় আর কিছু রয়েছে? ইয়েলো গাছের ডাল, মাতাল বাঁশ, আর পদ্মফুলের ডাটা এরা সবাই তো হালকা, পাতলা, আর সরু। নেহাৎ গরু ছাড়া এদের কেউ খারাপ বলতে সাহস করবে? কক্ষনো না।

    আমার শরীর হালকা। তাই তাড়াতাড়ি আমি যেমন বলতে পারি তেমনি তাড়াতাড়ি চলতে পারি। হালকা শরীর নিয়ে চলাফেরা করা কত আরামের বলত? আমি হাঁটি সোজা মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে। কচ্ছপের মত থপথপ করে মাডিয়ে-মাডিয়ে হাঁটার অভ্যাস আমার নেই। মোটা লোকদের দেখলেই তাই আমার গা-টা ঘিনীঘিন করে।

    তাছাড়া, প্রেম নিবেদন করার সময় কোন পুরুষ কি তার প্রেমিককে বলে—প্রিয়তমে, তোমার হাতির মত মোটা দেহটা কী সুন্দর! দেখে আর ভালোবেসে আমার জীবন সার্থক হলো! অথবা, তোমার দেহে পর্বতপ্রমাণ এই মেদের স্তুপ দেখে আমি একেবারে বিমোহিত হয়ে গিয়েছি। আমি তোমাকে কত ভালোবাসি! এরকম কথা কোন পুরুষকে বলতে শুনেছিস কখনও?

    বরং তারা বলে—তোমার কোমরটি কত সরু, সিংহীর কটিদেশের মত এক বিঘৎ। মুঠোর মধ্যে ধরা যায় তোমাকে। আর কী নরম তুলতুলে তোমার দেহ—মোওয়া ছানার মত। কী সুন্দর হালকা পায়ে ঘুরে বেড়াও তুমি, মনে হচ্ছে যেন পাখির ডানার ওপরে ভর দিয়ে তুমি উড়ে বেড়ােচ্ছ। এক টুকরো ধুলো পর্যন্ত পড়ে না তোমার গায়। কত অল্প খাওয়ায় তোমার পেট ভরে। তোমার গালে চুমু খেতে পেলে বেহস্তেও ঘুমোতে আমি রাজি নয়। হে প্রিয়তমে, যখন তুমি আমাকে তোমার ওই দুটি হালকা বাহুলতা দিয়ে জড়িয়ে ধর তখন কী একটি অপূর্ব আবেশে আমার মন ভরে যায়। তুমি চড়াই পাখির চেয়েও চঞ্চল, হরিণীর চেয়েও তুমি প্রাণবন্ত। বাঁশের মত যেমন করে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা তোমাকে বাঁকানো যায়, ভাঙার ভয় থাকে না এতটুকু। আর তোমার হাসি? সে তো তোমার মতই হালকা। আর তোমার শরীরটা হালকা বলেই তো ইচ্ছামত তোমাকে আমার বুকের ওপরে টেনে নিতে পারি। আমার উলঙ্গ হাঁটুর ওপরে, হে আমার প্রিয়তমে, তুমি পশমী চাদর।

    ওরে ও ধ্যাবড়া মেয়ে, তোর ওই থ্যাবড়া দেহ কি কোনদিন পুরুষদের মনে আগুন জ্বালাতে পেরেছে? পারেনি, কোনদিন পারেনি। পেরেছে আমাদের মত পাতলা মেয়েরই। আমাদের মত পাতলা মেয়েরাই পুরুষদের পাগল-ছাগল বানিয়ে দেয়, তাদের নামিয়ে আনে আমাদের পায়ের কাছে। আঙুরলতা যে কঞ্চি জড়িয়ে ওপরে ওঠে। পুরুষরাও তেমনি আমাকে জড়িয়ে ফুটতে চায়, আমি। মালিক কি আমাকে বেহস্তের হুরী বলে ফালতুই আদর করেন?

    ভোরের পাখি ডেকে উঠলো দেখে থেমে গেলো শাহরাজাদ।

     

    তিনশো সাঁইত্রিশতম রজনী :

    পরের দিন রাত্রিতে আবার গল্পের জের টানলো শাহরাজাদ :

    বেহেস্তের হুরী বললো—আমার কথা আর তোকে কিছু বলব না। এবার তোর ওই মোটা দেহ নিয়ে গোটা কত কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। ওরে ও থলমলে চর্বিওয়ালি, তোর ওই চাতুরালি ছেড়ে সত্যি কথাটা বলো দেখি। তুই যখন হাঁটিস তখন নিজের চেহারাটা কি তুই দেখতে পাস? পাস না। কিন্তু আমরা পাই। তখন তোকে দেখে শোকে আমরা একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়ি। মরি, মারি কী শোভা! হাঁসের মত বিশ্ৰী ঢঙে পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটিস। দেমাকে একেবারে ফেটে পড়িস। আমরা তো হেসে বাঁচি নে আর; খোরাকটা তোর হাতির মত। যতই মাতামতি করিসি সঙ্গমের সময় কোন পুরুষকে তুই তৃপ্তি দিতে পারিস নে। তোর ওই পাহাড়ের মত উরু আর ভুডি। ওই তিন পাহাড়ের ফাঁকে গুহার খোঁজ করতে করতে কতগুলি পুরুষাঙ্গ যে দিশেহারা হয়ে পড়ে তা কে বলবে! কোন রকমে খুঁজে পেলেই কি কোন সুরাহা হবে? তোর ওই ভুডির ঠেলায় তুডি দিয়েই সে ছিটকে আসবে বেরিয়ে! তোর কাছে পুরুষ মানুষ আসবে কোন সুখে?

    কোন গুণেই বাজারে বিকেবি না। তুই। কোন মাংসওয়ালা তোর ওই ওজন দেখে হয়ত তোকে কিনতে পারে; কিন্তু কোন ভদরলোক তোর ধারে ঘোিষবে না। তোর আত্মাও তোর চেহারার মত। থ্যাবড়া। তোর রঙ-তামাশাও তোর ওই শরীরের মতই খাসা। ও বাপুকারুর মাথায় ঢোকার কথা নয়। তোর ওই ফুলো-ফুলো গালে কোন পুরুষই ঠোঁট ছোঁয়াবে না। তোর হাসির চোটে কানের পর্দা যাবে ছিড়ে।

    তোর হাত তো নয় যেন বাড়ির থাম। ওর ভেতরে কোন প্রেমিকই ধরা দেবে না। তোর নিঃশ্বাসে তো ঝড় বইতে শুরু করে। ওর ধাক্কা কে সহ্য করবে বল? তোর শরীর থেকে সবসময়েই ঘাম ঝরছে। ঘাম তো নয়, একেবারে ফোয়ারা। ধর, কোন লোক তোকে একটু আদর করলো। তুই করবি কী তাকে জড়িয়ে ধরবি। ব্যস! ব্যাচারার জামা-কাপড় সব সপাসপো হয়ে যাবে। শুধু কি তাই? তোর তেল-চিটচিটে ঘামের দুর্গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে রে, উঠে আসবে।

    ঘুমেলে তোর নাক ডাকে ঘড়র.ঘড়র.ঘো-ঙ! নিঃশ্বাস ফেলিস মোষের মতভোঁয়োস…ভাস। নড়ে বসতেই তুই হাপরের মত হাস-পাস করিস। শুয়ে থাকতেও তোর কষ্ট। শরীরের ওজন যেন তোর ওপরে চেপে বসে। দিন-রাত তোর খিদে লেগেই রয়েছে। কাকের মত মুখ নাড়ছিস হরদম। তুই এত মোটা যে প্রকৃতির ডাকে তুই বেসামাল হয়ে পড়িস। চলার সময় পায়ের তলায় পাপোশ পড়লেই তার দফা একেবারে রফা হয়ে যাবে। স্নান করার সময় শরীরের সব জায়গায় হাত পৌঁছয় না তোর। ফলে, বেটকা গন্ধ ছাড়ে তোর গা থেকে।

    সামনে থেকে তোকে দেখতে লাগে হাতির মত; পাশ থেকে তুই উট; আর ভিস্তির মত তোকে দেখতে লাগে পেছন থেকে। এ আমার কথা নয়-কবির কথা :

    ওরে ও ধ্যাবড়া মুখী, গ্যাবড়া মুখী এক বস্তা ময়দা হেন,
    হাঁটলে পরে তোর পায়ের ভারে ভূমিকম্প হয়রে যেন।
    পশ্চিমে তুই নেচে বেড়াস। সদ্য যেন ঘূর্ণী বায়ু
    প্রাচ্যে হেলা যায় রে বাপু শাস্তশিষ্ট মোদের আয়ু।

    হা-হা করে হেসে উঠলেন আলী সাহেব; বললেন-বাপস! কী সব সাংঘাতিক কথা? তা, তোমরা দুজনে বলেছ ভালোই। তোমরা যে যার জায়গায় বসে পড়। এবারে তোমরা এসো। প্রথমে বলে মেহেরুন্নেসা।

    সোনালি মেয়েটি বলতে শুরু করলো—দিনের আলো আমার গায়ে। আমার রঙ নিয়ে কোরানে অনেক কথাই লেখা রয়েছে। আমাকেই প্রশংসা করে আল্লাহ বলেছেন-সোনালি বা হলুদ রঙ চোখে আমার খুব ভালো লাগে। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমার রঙটা খুবই সুন্দর। আমার রঙে আছে যাদু! রুপের শেষ কথাটা হচ্ছে আমার রূপ; আনন্দের শেষও আমারই ভেতরে। সোনার দাম যে এত বেশী তার কারণ হচ্ছি আমি। সূর্য-চন্দ্র-তারকা আমার রঙ নিয়েই সুন্দর। সোনালি আপেল বা পীচ দেখতে কত ভালো লাগে। বিশ্বে যত দামী-দামী পাথর রয়েছে তাদের রঙ আমারই গায়ের রঙ। ফসল পাকলে আমার রঙ ধরে। শরৎকালে ফসল পাকে। ফসলের রঙ সোনা হয়ে যায়। সেইজন্যেই তো শরৎ এত আদরের। সূর্যের তাপে গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে যায়। তাইত সবুজ এত ভালো লাগে দেখতে।

    এবার বাদামী রঙ, অর্থাৎ, তোর কথাই বলি। বাদামী রঙ যার তারই দাম কম। কেন কম বলো দেখি! শুধু ওই রঙের জন্যে। তোর রঙটা খুবই সাধারণ; আর সাধারণ বলেই তো এত বিশ্ৰী। কেউ তা পছন্দ করে না।

    এমন কোন ভালো মাংস দেখেছিস যার রঙ বাদামী? কোন ফুল বা পাথরই বাদামী নয়। অবশ্য অনেকদিন পরিষ্কার না করলে তামার রঙ বাদামী হয়ে যায়।

    সবচেয়ে বড় কথাটা কী জানিস? তুই ফরাসাও নস, কালোও নস। এ দুটো রঙের জন্যে যত প্রশংসা মানুষে করে তার এক কণাও তোর কপালে নেই।

    আলী সাহেব বললেন-হয়েছে। তুমি এবার থাম। বলতে দাও শোলাকে।

    বাদামী মেয়ে শোলা, একগাল হাসলো। মেয়েটি হাসলে মুক্তো ঝরে যেন, কী সুন্দর তার দাঁতের পংক্তি যেন মুক্তোর সারি। মধুর মত ঘন গাঢ় বাদামী ওর গায়ের রঙ। গড়নটিও কত চমৎকার। হাত-পা-চোখ-কান-মুখ-বুক সবই একেবারে মাপা, যাকে বলে নিখুঁৎ। ঢেউ-খেলান কোমর সব সময়েই নাচের তালে তালে দুলতে থাকে। দোহরা দু’খানা হাত দুপাশে ঝুলছে। মাথায় এক রািশ কালো মেঘের মত চুল। সেই চুল নেমে এসেছে তার ভারি নিতম্বের ওপরে। সেই চুল দুলিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সে দেখোল আলী সাহেব, আর সেই সোনালি মেয়েটিকে। তারপরে সে মেহেরুন্নেসার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো—আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে ধূমসো করে পাঠাননি, পাঠাননি রোগা ডিগডিগে বা বিকলাঙ্গ করে। শ্বেতীর মত সাদা, কামলা রোগীর মত হলদে, কিংবা কাঠ কয়লার মত ময়লা করেও এ-দুনিয়ায় তিনি আমাকে পাঠাননি। আমার গায়ের রঙ সব রঙকেই টেক্কা দিয়েছে। নানান রঙের মশলা দিয়ে আল্লাহ আমার গায়ের রঙ তৈরি করেছেন। আর তাঁর তুলির টানে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি কী সুন্দরই না ফুটে উঠেছে। আল্লাহ যে কত বড় শিল্পী আমাকে দেখলেই তা বোঝা যায়।

    এ-দুনিয়ার সব কবিই আমার মত মেয়ের দিকে মশগুল হয়ে তাকিয়ে থাকে। হাজার-হাজার বন্দনাগীতি তারা আমার জন্যেই রচনা করেছে। সেসব কথা বলতে গেলে এক জীবনে কুলোবে না। তাই সে চেষ্টা না করে আমি কেবল দু-চারটে কবিতা বলছি।

    ভোর হয়ে এলো দেখে থেমে গেলো শাহরাজাদ।

     

    তিনশো আটত্রিশতম রজনী :

    পরের দিন আবার শুরু করলো শাহরাজাদ :

    সবাই কি আর হতে পারে আমার প্রিয়তমার মত
    রঙিলা সে, চটুল গতি, নয়কো মোটা, নয়কো রোগা,
    ছোট একটি নারী সে যে রবির আলোয় পল্লবিত
    রঙিন স্বপন সম আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিতা।

    তোর গায়ের রঙ তো রঙই নয়। সবুজ সতেজ প্রকৃতিতে ও-রকম কোন রঙই নেই। গাছের পাতা হলদে হলে ঝরে যায়; সবুজ জীবন হলদে হয়ে মরে যায়। তোর রঙটা তাই জীবনের প্রতীক নয়, ইঙ্গিত হলো মৃত্যুর।

    গিরিমাটির রঙ হলদে। হরিতলের রঙও তাই। এ দুটো জিনিস দিয়ে যে ওষুধ তৈরি হয় তা গায়ে লাগলে রোম যায় উঠে। সবুজ ঘাস কী নরম বলো তো? শুকিয়ে গলে গেলে সেই ঘাস এমন শক্ত হয়ে যায় যে গরু ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।

    দোজখেতে জাকুম নামে এক ধরনের গাছ জন্মায়। তাতে খুনী, বদমাস, আর শয়তানদের মাথা ঝুলিয়ে রাখা হয়। সেই গাছে তোর মুখের মত এক রকম তামাটে ফলও ধরে। তোর মত মেয়েদের দেখেই কবি বলেছেন-খোদা আমাকে একটি স্ত্রী দিয়েছিলেন। তার রঙটা ছিলো হলদে। সেই থেকে আমি সারাটা জীবন মাথার যন্ত্রণায় ভুগেছি। একবার আমি বলেছিলাম, দোহাই তোমার। এবার আমরা যে যার পথ দেখি এসো। শুরু হলো আমাদের মধ্যে বিরোধ; আর তারই ফলে, দাঁতগুলি হারাতে হয়েছে আমাকে।

    আলী সাহেব তো হেসেই অস্থির। হাসির দাপটে মাথাটা তীর নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। মেয়ে দুটিকে তিনি দু’হাতে জড়িয়ে ধরেন। বাকি চারজনকে কাছে ডেকে নেন তিনি। সকলেই সমমূল্যের দামি-দামি পোশাক আর গহনা উপহার দেন।

    গল্প শেষ করে বাসোরার মহম্মদ বললো-এই হলো ছটি মেয়ের গল্প। এর পরে তারা আলীর সঙ্গে বাগদাদেই সুখেস্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে লাগলো।

    আল মামুনের বাদশার গল্পটা শুনতে বেশ ভালোই লাগলো। তিনি মহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলেন-ওই মেয়েদের মালিকেরবাড়ি তুমি চেন? মেয়ে কটিকে আমাকে বেচাবে কিনা তুমি মালিককে জিজ্ঞাসা করে এসো।

    মহম্মদ বললো-আজ্ঞে জাঁহাপনা, যতদূর জানি, মেয়েগুলিকে আলী সাহেব খুব ভালোবাসেন। তাদের ছেড়ে দিতে তিনি রাজি হবেন না।

    বাদশাহ বললেন—ষাট হাজার দিনার নিয়ে তারবাড়ি যাও। মেয়ে পিছু দশ হাজার দর দেবে। আলী সাহেবকে বলো আমি মেয়েদের কিনতে চেয়েছি।

    বাসোরার মহম্মদ তথাস্তু, জো হুকুম বলে ষাট হাজার দিনার নিয়ে আলী সাহেবের বাড়ি হাজির। সব কথা খুলে বলে আলী সাহেবের হাতে মহম্মদ টাকাটা তুলে দিলো। একে বাদশার অনুরোধ। তার ওপরে ষাট হাজার দিনার! লোভে আলী সাহেবের চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। অথচ, মেয়েগুলিকেও তিনি বড় ভালোবাসতেন। কী করবেন। ভাবতে লাগলেন। ভাবতে-ভাবতে শেষ পর্যন্ত লোভের কাছে হেরে গেলেন তিনি। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছটি মেয়েকেই তিনি তুলে দিলেন বাদশাহর হাতে। মেয়েদের নিয়ে মহম্মদ সোজা চলে গেলো। বাদশাহর কাছে।

    মেয়েদের গায়ের রঙ দেখে বাদশাহর চোখ ট্যারা হয়ে গেলো। এমন রঙের ফুলঝুরি তিনি আর কোথাও দেখেননি। ওদের দেহের গঠন আলাদা, ওদের রঙ-তামাসা, হাসি। সবই মনোরম। কেব বাদশাহ খুব খুশি হলেন ওদের পেয়ে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি ঢঙ রয়েছে, আকর্ষণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে একটা। হারেমে ওদের জন্যে ভালো ব্যবস্থা করে দিলেন। তিনি। অনেকদিন ধরে নাচে, গানে, রঙ-তামাসায় বাদশাহকে তার করে রাখলো।

    বেচারা আলী সাহেব! মেয়েদের বেচে দিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন তার আর কাটে না। ষাট হাজার দিনারের লোভ তিনি ছাড়তে পারলেন না? ছিঃ-ছিঃ! অনুতাপে মরে গেলেন তিনি। মেয়েরা তাঁকে যে আনন্দ দিয়েছিলো তার তুলনায় ষাট হাজার দিনারের দাম কতটুকু! নিজের ওপরে ধিক্কার জন্মে গেলো তার। এভাবে জীবন কাটানো তার কাছে অসম্ভব হয়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো আলী সাহেবের। বাদশার কাছে নিজের মনোবেদন জানিয়ে তিনি একটা চিঠি লিখলেন।

    আমার বিষণ্ণ হৃদয় প্রজাপতি
    ওই ছটি পুষ্পলাবী মধুকন্যাকে চুম্বন করার জন্যে
    পাখা মেলে উড়ে যায়।
    ওরাই আমার চোখের দৃষ্টি
    আমার বাঁচার রসদ
    আমার তৃষ্ণার পানি
    আমার জীবন
    সেই উপহার পেলে
    আমি আমার চোখ দুটি বুজিয়ে ফেলতে পারি
    ওই ছটি কন্যাকে আমি দুচোখ দিয়ে দেখতে চাই…
    আমার জীবন প্রদীপের তৈল, আমার কামনা
    আমার বেঁচে থাকার উষ্ণতা ওরা,
    কিন্তু তৈজসে যার বাতি নেই, সেখানে কোন আলো জ্বলে না।

    যথা সময়ে আল মামুন পত্রটি পেলেন। বাদশার উদার হৃদয়ের কথা দুনিয়ায় কে না জানে? আলী সাহেবের বেদনার ঝঙ্কার বাদশার হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করলো। তাড়াতাড়ি ছটি মেয়েকে ডেকে পাঠালেন তিনি। প্রত্যেককে দিলেন প্রচুর উপহার। এছাড়া প্রত্যেককে দিলেন দশ হাজার করে দিনার। দিলেন বহুমূল্য অলঙ্কার। তারপরে তাদের ফিরিয়ে দিলেন আলী সাহেবকে।

    দূর থেকে মেয়েদের আসতে দেখে আলী সাহেব ছুটে গিয়ে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। বাদশার হারেমে থেকে ওদের রঙ আরও ফুটেছে। স্বাস্থ্যও হয়েছে বেশ সুন্দর। বাদশার একটা পত্ব তারা আলী সাহেবের হাতে দিলো। মেয়েদের মূল্য বাবদ আলী সাহেবকে যে ষাট হাজার দিনার দিয়েছিলেন বাদশা সেটা মুকুব করে দিয়েছেন। আলীর আনন্দ আর ধরে না।

    জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলী সাহেব তাদের নিয়ে সুখে দিন কাটালেন।

    —জাঁহাপনা, নানান রঙের ছ’টি গল্প এইখানেই শেষ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }