Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ২.৩৮ গুলাবী এবং রোশন এর কাহিনী

    কোনও এক সময়ে এক প্রবল পরাক্রান্ত শাহেনশাহর ইবরাহিম নামে এক উজির ছিলো। এই উজিরের ছিলো এক রূপবতী কন্যা। তার নাম গুলাবী। তাকে নিয়েই আমাদের আজকের কাহিনী।

    মেয়েটির যেমন রূপ তেমনি গুণ। তার মিষ্টি কথাবার্তায় সুন্দর আদব-কায়দায় সকলেই মুগ্ধ হতো। লেখাপড়াও সে যথেষ্টই করেছিলো। বহু নামকরা কবির শায়ের-বয়েৎ অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারতো সে।

    শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো। বাদশাহ শাহরিয়ার দেখলো, রাত্রি অতিক্রান্ত হতে চলেছে।

     

    চারশোতম রজনীতে আবার শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :

    প্রত্যেক উৎসব অনুষ্ঠানে সুলতান গুলাবীকে ডাকতো। আনন্দের মুহূর্তগুলো সুন্দরতর হয়ে উঠতো তার উপস্থিতিতে। সুলতানের সে পাশে পাশেই অবস্থান করতো। তার রূপ এবং রসবোধ দুই-ই সুলতানকে মুগ্ধ করতে পারতো।

    একদা সুলতানের অভ্যাগতরা প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বল খেলছিলো। গুলাবী জানালার পাশে বসে বসে সেই খেলা দেখছিলো। হঠাৎ তার নজর পড়লো সুঠাম দেহী সুন্দর সুপুরুষ এক যুবকের দিকে। ওলাবীর চিত্তে চাঞ্চল্য জেগে ওঠে। নিজেকে আর শান্ত করতে পারে-পর্ব

    না। ছেলেটির যেমন বাহুভুজ তেমনি বিশাল বিস্তুত বক্ষপট, ক্ষীণকটি, বলিষ্ঠ গর্দান। আর কী সুন্দর হাসে সে-দীতগুলো যেন মত্তেজ্ঞার মতো ঝিকমিক করে ওঠে।

    গুলাবী মুগ্ধ নয়নে তার দিকে আপলকভাবে তাকিয়ে থাকে। দেখে দেখে তার আর আশা মেটে না। ছেলেটিকে আরও কাছে পাওয়ার জন্য, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য প্ৰাণ আকুলি বিকুলি করতে থাকে। একটু পরে গুলাবী তার ধাইকে ডেকে বলে, ধাইমা ঐ যে খুবসুরৎ ছেলেটিকে দেখছো, ওকে চেন? নাম ধাম জান কিছু?

    —কার কথা বলছে বেটা, কিছুই তো ঠাওর করতে পারছি না। সব ছেলেগুলোই তো দেখতে চাঁদের মতোন?

    গুলাবী বলে, সে কি! তুমি বুঝতে পারছে না, ধাইমা। ঐ তো—ঐ যে দেখছে না? আচ্ছা! দাঁড়াও আমি তোমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

    একটা আপেল হাতে নিয়ে সে ছুঁড়ে মারে। ছেলেটির গায়ে লাগতেই সে জানালার দিকে তাকায়। গুলাবীর চোখে চোখ পড়ে। পলকে দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। ছেলেটির মুখে মৃদু। হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সেই মুহূর্তে, দুটি হৃদয়েরও বিনিময় ঘটে যায়। ছেলেটি আপনমনেই একটি কবিতার কয়েকটি কলি আওড়ায়—

    তীর বিদ্ধ আমি–
    আমি এক আহত সৈনিক।
    কে তুমি ধনুর্ধর,
    এমন অব্যৰ্থ তোমার শর?
    দুষমন, অথবা দুরন্ত প্ৰেমিক!

    গুলাবী তার ধাইমাকে আবার জিজ্ঞেস করে, এবার তো বুঝতে পেরেছে, কার কথা আমি বলছি। ওর নাম কী?

    ধাইমা বলে, রোশন।

    গুলাবী বলে, রোশনই বটে। সার্থক নাম রেখেছেন ওঁর মা-বাবা!

    তারপর গুলাবী বিড় বিড় করে নিজের খেয়ালে কী সব আওড়াতে থাকে। একটু পরে সে বলে, ধাইমা কাগজ কলম নিয়ে এসো তো। আমি একটা কবিতা বানিয়েছি।–লিখবো।

    ধাইমা তাকে কাগজ কলম এনে দেয়। গুলাবী লিখতে থাকে :

    প্রজ্ঞ পিতার প্রিয়-পাত্র পুত্র,
    তোমার নাম রেখেছেন তিনি রোশন-জগতের আলো।
    তা জগতেরই আলো বটে—
    তোমার রূপের রোশনাই-এ তামাম দুনিয়া আলোকিত হয়ে আছে।
    পূর্ণিমার পূর্ণচাঁদের মতো তোমার স্নিগ্ধ কোমল দ্যুতি
    আমার মনের সব অন্ধকার কেড়ে নিয়ে গেছে।
    তোমাকে দেখার পর থেকে আমি নিশ্বাসে আঘ্রাণ করছি
    তোমার দেহের সুরভিত সুবাস। তুমি এসো—

    কবিতাটা লিখে কাগজখানা ভাঁজ করে সে একটা সুন্দর কাজকরা বটুয়ার মধ্যে পুরে বালিশের তলায় রেখে দেয়। ধাইমা দূর থেকে সবই লক্ষ্য করছিলো। গুলাবী ঘুমিয়ে পড়লে, সে অতি সন্তৰ্পণে বালিশের তলা থেকে বাটুয়াটা বের করে। কবিতাটা পড়ে বুঝতে পারে, তার নবযৌবনাউদ্ভিন্ন মালকিনের মনে এই প্রথম বসন্তের বর্ষণ শুরু হয়েছে। মহব্বতের ঢল নামতে আর বেশি দেরি নাই; চিঠিখানা আবার ভাঁজ করে বটুয়ার ভরে যথাস্থানে রেখে দেয় সে।

    যখন ঘুম ভাঙ্গলো, বৃদ্ধা তার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর সোহাগ করতে করতে বলে, বেটী, জন্মের পর থেকে তোমাকে আমি বুকে পিঠে করে মানুষ করেছি। এই অবস্থায় যা স্বাভাবিক তাই তোমার মধ্যে ফুটে ওঠার জন্যে আকুল হয়ে উঠেছে। এ খুবই শুভ লক্ষণ। জীবনে যখন প্রথম প্ৰেম আসে, তার উদাম উচ্ছলতা সহ্য করার শক্তি সকলের থাকে না। কেউ বা ভেসে যায়। কেউ বা তলিয়ে যায়। মহব্বতের আগুনে পুড়ে কত হৃদয় খাটি সোনা হয়। আবার কেউ অঙ্গার হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রেমের চিন্তা বড় মারাত্মক, সে নিয়ত দহন করে। কিন্তু এই দহন জ্বালার কিছুটা উপশম হয় যদি তার প্রণয়-চিন্তার ভাগ দেয় সে অন্য কাউকে।

    গুলাবী বলে, ধাইমা, তুমি কী জন এই মহব্বতের জ্বালার কী দাওয়াই?

    ধাইমা বলে, জানি বাছা, জানি।

    গুলাবী আকুল হয়ে বলে, বলো না, ধাইমা, কেমন করে জুড়াবো। আমার এ জ্বালা?

    ধাইমা বলে, তুমি এক কাজ কর বেটী, তাকে খৎ লেখো। খুব সুন্দর করে খুব মোলায়েম করে তাকে জানাও তোমার প্রেমের আকুলতা। দেখবে, সে তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে। তোমার মন প্ৰাণ খুলে মেলে ধরে তার কাছে। কোনও কিছু গোপন রাখবে না। দেখবে—সেও উন্মুক্ত করে দেবে তার হৃদয়।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো একতম। রজনীতে আবার সে শুরু করে :

    বৃদ্ধার কথা শুনে গুলাবী পুলকিত হয়। ভাবে, যথার্থই বলেছে সে। তবু নিজেকে খুলে মেলে ধরতে পারে না তার কাছে। সে যে ছেলেটির প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে। সে-কথা বিলকুল চেপে যায়। প্রথমে ছেলেটির কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, তার মনের কথা। যদি সে বুঝতে পারে, ছেলেটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবেই সে নিজেকে খুলে ধরবে তার কাছে। তার আগে নয়। সুতরাং এখনই এই বৃদ্ধাকে সে-কথা সে বলবে না।

    বৃদ্ধ গুলাবীর মনের কথা আঁচ করে বলে, বেটী, গতকাল রাতে আমি এক খোয়াব দেখেছি। একটি সুন্দর ছেলে আমার সামনে এসে বলছে ‘তোমার মালকিন গুলাবী এবং রোশন প্রেমাসক্ত হয়েছে। তুমি ওদের গাঁটছড়া বাঁধার একমাত্র উপায়। আর দেরি করো না, গুলাবীর খৎ নিয়ে গিয়ে রোশনের হাতে পৌঁছে দাও তুমি। রোশন তার জবাব দেবে এবং তা গুলাবীর কাছে পৌঁছে দেবার ভার তোমাকেই নিতে হবে। এই মহান কর্তব্য থেকে তুমি যদি বিচ্যুত হও তবে দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে।’ স্বপ্নে যা দেখেছি তোমাকে বললাম, এবার ভালো-মন্দ বিচারের ভার তোমার, বেটী।

    গুলাবী আনন্দে নোচে ওঠে, ধাইমা, একটা কথা বলবো, কাউকে বলবে না, বলো?

    —তোমার কী কোনও সন্দেহ হয়। বেটী? আমি তোমাকে জানি দিয়ে ভালোবাসি। তোমার কোন ক্ষতি হয় তেমন কোনও কাজ কী আমার দ্বারা সম্ভব?

    গুলাবীর আর ধৈর্য মানে না। বালিশের তলা থেকে কাগজখানা বের করে সে বৃদ্ধার হাতে দেয়, পড়, আমি তাকে কবিতায় জানিয়েছি আমার মনের ভাষা। আমার’এই মনের কথা তুমি তার হাতে পৌঁছে দাও, ধাইমা। সে যা জবাব দেয়। আমাকে নিয়ে এসে দাও। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।

    তখুনি ধাইমা রোশন-এর বাড়িতে ছুটে যায়। তার হাতে তুলে দেয় গুলাবীর কাগজখানা। রোশন খুলে পড়ে। আনন্দে ভরে ওঠে তার মন। সেও কবিতা করেই জবাব লেখে —

    আমার প্রাণ আজ পাখী হয়ে
    দূর নীল নভে ডানা মেলে
    উধাও হতে চায়।
    আমি তো তাকে বাধা দিতে পারি না
    সে যে আজ পিঞ্জীর ছাড়া—
    শুধু মুক্তির গান গায়।
    এসো, ওগো আমার প্রিয়া
    পরেছি। দেখো নতুন সাজ
    সঁপোছি তোমায় সকল হিয়া।

    কাগজখানা ভাঁজ করে রোশন ধাইমার হাতে দিয়ে বলে, আপনিই আমার একমাত্র ভরসা, মা। সে যদি আমাকে একটু অনুগ্রহ করে সে আপনারই জন্যে করবে।

    ধাই বলে, আমার যথাসাধ্য আমি করবো, বাবা।

    বৃদ্ধা আর সেখানে দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে ফিরে আসে গুলাবীর কাছে।

    চিঠিখানা হাতে পেয়ে গুলাবী প্রথমে অধরে স্পর্শ করে। তারপর খুলে পড়ে।

    সে আবার জবাব লিখতে বসে :

    ধৈর্য ধর,
    একই জালে বন্দী হয়েছি। আমরা,
    তবু কি করে বুঝবো বলো
    তোমার দিল-ও টুকরো টুকরো
    হয়ে যাচ্ছে আমারই মতো!
    রাত্রির কালোছায়া তোমাকে আড়াল করে রেখেছে
    আমার দৃষ্টিপথ থেকে,
    কিন্তু আমি তো জানি
    আমাদের দুজনেরই বুকে জ্বলছে তুষের আগুন।
    নীরবে মুখ বুজে থাকাই শ্রেয়;
    আমার নাকাবি নাই বা খোলা হলো
    তোমার ইয়ার বন্ধুদের সামনে!
    আমি তো তোমারই-একান্তভাবে।

    রাত্রির অন্ধকার সরে যেতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    চারশো দুইতিম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয় :

    গুলাবীর লেখা শেষ হলে কাগজখানা ভাঁজ করে আবার সে ধাইমার হাতে দিয়ে বলে, যাও ধাইমা, তাড়াতাড়ি জবাব নিয়ে এসো। আমি আর দেরি সইতে পারছি না।

    ধাইমা দ্রুতপায়ে চলে যায়। কিন্তু সেবার বিধি বাম হলো, রোশনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে উজিরের প্রধান সচিবের মুখোমুখি হয়ে পড়ে সে।

    –শোনো, কোথায় যাচ্ছো এত রাতে?

    –হারামে।

    বৃদ্ধ থতমত খেয়ে পালাতে গিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে চিঠিখানাও আঁচল থেকে খুলে যায়। দরজার সামনে বারান্দায় গিয়ে পড়ে। একটা খোজা ছুটে এসে কুড়িয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে। তারপর সোজা গিয়ে তুলে দেয় উজিরের হাতে। বলে, কাগজখানা দরজার সামনে পড়ে ছিলো, হুজুর। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম।

    উজিরের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। হাতের লেখা দেখে চিনতে অসুবিধে হয় না-এ তার কন্যারই লেখা!

    রাগে দুঃখে অপমানে উজিরের কান্না পায়। সে চীৎকার করতে করতে বেগমের কাছে ছুটে আসে। স্বামীর ঐ মূর্তি দেখে বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার চোখে জল কেন, মালিক?

    উজির কাগজখানা বাড়িয়ে দেয়-দোখ, পড়।

    বেগম কাগজখানা নিয়ে পড়ে। তারও বুঝতে কষ্ট হয় না-এ তারই কন্যার হাতে লেখা। তারও দু’চোখ জলে ভরে যায়। কিন্তু নিজেকে সে সংযত করে নিতে পারে তখুনি। উজিরকে বলে, এ নিয়ে চোখের জল ফেলা বৃথা, মালিক। তার চাইতে এখন ভাবতে হবে কী ভাবে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, কলঙ্ক থেকে রেহাই পাওয়া যায় কী ভাবে?

    তারপর নানা কথায় উজিরকে সান্ত্বনা দিতে থাকে বেগম।

    —মেয়ের কথা ভেবে আমি ভয় পাচ্ছি। তুমি তো জানো, সুলতান স্বয়ং তাকে কতো ভালোবাসেন। এখন আমার দুদিকে ভয়। প্রথমতঃ সে আমাদের সন্তান। দ্বিতীয়তঃ সে সুলতানের ভীষণ পেয়ারের। এ ব্যাপারে তোমার কী মত?

    বেগম বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আগে আমাকে একটু আল্লাহর কাছে মোনাজাত করতে দিন।

    বেগম যথাবিহিত রুজু আদি সেরে শুদ্ধাচারে নামাজ সারে।

    প্রার্থনা শেষে সে বলে, বাহার অল কুনুজ সাগরেরর মাঝখানে একটা পাহাড় আছে। তার নাম ‘নির্বাসিত মাতা’। দারুণ বিপদকাল ছাড়া কেউই সেখানে যেতে পারে না। ওখানে একখানা ইমারত বানিয়ে মেয়েকে রেখে আসুন আপনি। এতে সুলতানের রোষ এবং মেয়ের ইজ্জত দুই-ই বাঁচবে।

    বেগমের কথা উজিরের মনে ধরে। পাহাড়ের দুৰ্গম চূড়ায় একখানা প্রাসাদ বানাবে ভাবলো সে। প্রাসাদে এক বছরের মতো খানা-পিনার ব্যবস্থা রাখা হবে। গুলাবীকে সেখানে নির্বাসিত বন্দিনী করে রাখবে সে। অবশ্য দাসী বাঁদী চাকর নফর সবই থাকবে তার সঙ্গে-তার দেখা-শোনার জন্য।

    বড় বড় রাজমিস্ত্রী, ছুতোর মিস্ত্রী এবং ভাস্করদের ডেকে সেখানে কাজে পাঠিয়ে দিলো উজির। কিছুদিনের মধ্যেই তারা এক দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো এক সুরম্য প্রাসাদ বানিয়ে ফেললো সেখানে।

    উজির যখন শুনলো, তার কথামতো সব তৈরি হয়ে গেছে, একদিন গভীর রাতে গুলাবীকে জাগিয়ে তুলে লোক লস্কর লটবহার সহ তাকে নিয়ে সেই পাহাড়-প্রাসাদে রওনা হয়ে গেলো।

    এতদিন সবকিছু গোপনে গোপনে সমাধা করেছে সে। গুলাবী এসবের কিছুই বুঝতে পারেনি। আজ তার বাবা হঠাৎ তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেবার তোড়জোড় করছে দেখে সে বিরহ-ব্যথায় ভেঙ্গে পড়লো। কান্নায় ভেসে যেতে লাগলো তার বুক। যাবার আগে দরজার পাল্লায় লিখে রেখে গেলো।

    তোমার জন্য আমার প্রাণামাতানে
    চুম্বন রইলো, হে প্রিয়
    জানি না, কোথায় চলেছি আমি
    এই রাতে পাখীরা তরুশাখায় বসে
    চোখের জল ফেলছে,
    কিন্তু আমার নিয়তি
    আমাকে ছাড়বে কেন?

    ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো চারতম রজনীতে আবার বলতে শুরু করে :

    চোখের জলে সুৰ্মা গুলে হৃদয় নিঙড়ে এই ব্যথার বাণী সে দরজার ওপর লিখে রেখে ডুলিতে গিয়ে বসলো। মনে মনে বিদায় জানালো তার ভালোবাসাকে।

    ঊষর মরুভূমি, বন্ধুর পাহাড় পর্বত, অনেক শহর গ্রাম অতিক্রম করে চলতে থাকে তারা। অবশেষে আল কুনুজ সমুদ্রতীরে এসে থামালো। সেখানে তাঁবু ফেলা হলো। দুমদাম কাজে লেগে পড়লো লোকজন, মিস্ত্রী। খুব চটপট একখানা বিশাল নৌকা বানিয়ে ফেললো তারা।

    প্রহরী-পরিবেষ্টিত করে দাসী বাঁদী নফর চাকর সঙ্গে দিয়ে গুলাবীকে নৌকায় চাপিয়ে

    দিলো| উজির। প্রহরীদের বলে দিলো, মেয়েকে প্রাসাদে পৌঁছে দিয়েই তারা যেন আবার সকলে এপারে ফিরে আসে। আসার পর নৌকাখানা পুড়িয়ে ফেলার হুকুম দিলো সে।

    এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজাদি সেরে বেগম ঘোড়ায় চেপে সুলতানের দরবারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। পথে উজিরের প্রাসাদ, রোশন দেখলো। প্রাসাদে কোনও জনমানবের সাড়া নাই। অবাক লাগলো তার। ঘোড়া থেকে নেমে সে প্রাসাদের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, দরজায় লেখা গুলাবীর সেই কবিতার কয়েকটি ছত্র। বুঝতে আর বাকী থাকে না, নয়নতারা, তার বুকের কলিজা গুলাবী আর সেখানে নাই। মাথাটা তার ঘুরে গেলো। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না, সেইখানেই লুটিয়ে পড়লো রোশন।

    অনেকক্ষণ পর কিছুটা ধাতস্থ হয়েবাড়ি ফিরে আসে। বুকের মধ্যে হু হু করে যায়। এখন সে কী করবে, কোথায় যাবে, কোথায় তার প্রিয়তমার সন্ধান পাবে-কিছুই বুঝতে পারে না। এইভাবে ভাবতে ভাবতে প্ৰায় পাগলের মতো সে পথে বেরিয়ে পড়ে। এক বিস্ত্ৰে। উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে মরুপ্রান্তর পার হয়ে চলতে থাকে।

    একটানা কত পথ যে অতিক্রম করে, কে তার হিসাব রাখে। এক নদীর ধরে এসে সে থামে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। অঞ্জলি ভরে জল পান করে। নদীর স্বচ্ছ জলে তার নিজের মুখের চেহারা দেখে আঁৎকে ওঠে। একি ছিরি হয়েছে তার চেহারার!

    তা সে ক্ষণকালের জন্যই। রোশন ভাবে হোক গে, কী হবে এই রূপ আর যৌবন দিয়ে? যদি সে তার প্ৰিয়তমা গুলাবীকেই না পেলো, এ রূপ-যৌবনের কী বা প্রয়োজন?

    আবার সে বিরাম বিহীন ভাবে চলতে থাকলো। কত পাহাড় পর্বত নদী নালা গ্রাম শহর পিছনে ফেলে সে শুধু একটানা পথ চলে। কোথায় চলেছে কিছুই জানে না। শুধু চলার নেশাতেই চলেছে।

    এইভাবে চলতে চলতে একদিন সে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে এক সমুদ্র-সৈকতের বালুক-বেলায় এসে বসে পড়ে। দেহে আর কোনও শক্তি নাই। আর সে চলতে পারে না। কয়দিন পেটে একটাও দানাপানি পড়েনি। খিদ্দেটা শুকিয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। এখন আর অনুভবই করতে পারে না–সত্যিই তার খিদে বলে কিছু আছে কিনা।

    বালির ওপরে পড়ে পড়ে সে ধুকছিলো, এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ায় এক দরবেশ ফকির। রোশনের অবস্থা নিরীক্ষণ করে সে বুঝতে পারে, এভাবে এখানে পড়ে থাকলে নিৰ্ঘাৎ মারা যাবে ছেলেটা।

    কোনরকমে তাকে উঠে দাঁড় করায় সে। বলে, বেটা, এখানে তুমি কেন এসেছে, চলো, আমার ডেরায় চলো।

    অদূরেই দরবেশ-সাহেবের আস্তানা। সমুদ্রের এক পাশে ছোট পর্বতমালা। তার নিচে একটি গুহায় সে বাস করে। রোশনকে কোন রকমে গুহার ভিতরে নিয়ে আসে। কিছু ফলমূল এবং একটু সরবৎ খেতে দেয় সে। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

    সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গলে রোশন দরবেশকে জিজ্ঞেস করে, আমি কোথায়?

    —তুমি আমার দরগায় এসেছে, বেটা। তোমার কোনও ভয় নাই!

    –আপনি কে?

    রোশনের প্রশ্ন শুনে দরবেশ-এর মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে, আমি এক ফকির, বাবা। আল্লাহর নফর।

    —আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন। আপনি?

    —তা না হলে তুমি যে মারা যেতে বাবা। জানি না কি কারণে, তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিলো, পথশ্রমে তুমি বড় ক্লান্ত, অনেকদিন তোমার নাওয়া খাওয়া কিছু হয় নি। ঐ

    আমার ডেরায় নিয়ে এসেছি। এখন বলতো, কোথায় তুমি চলেছে, আর কেনই বা এত কষ্টের পথ অতিক্রম করে এসেছে।

    রাত্রির অন্ধকার কেটে যায়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো পাঁচতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    পীর সাহেব জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী, বেটা?

    –আমার নাম রোশন।

    এরপর রোশন তার বিরহের উপাখ্যান আদ্যোপান্ত সব শোনায় তাকে। কথা বলতে বলতে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে।

    পীর সাহেব বলে, শোক করো না, বেটা। সবই তীর ইচ্ছ। আমি প্ৰি-তই আজ বিশটা বছর এই গুহায় আস্তানা গেড়ে বসে আছি। এদিকে কোনও ৈ জনবসতি নাই। মানুষের মুখ কচিৎ কখনও দেখতে পাই। তবে এই কয়েকদিন আগে মানুষের একটা দলবল এখানে এসেছিলো। দেখে মনে। হলো, অনেক বড় ঘরের ব্যাপার। অনেক লোক লস্কর, লটবহর সঙ্গে ছিলো তাদের। এই সমুদ্রের তীরে বসে অনেক লোকজন মিলে ওরা একখানা নৌকা তৈরি করলো। তারপর সেই নৌকায় চেপে সমুদ্রের মাঝখানে ঐ যে দেখছে একটা পাহাড়-সেই পাহাড়ের দিকে চলে গেলো। আমি আমার গুহার সামনে বসে বসে সব প্রত্যক্ষ করলাম। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হলো না। তবে একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো, নৌকাটা যখন সমুদ্রের জলে ভেসে চলতে থাকলো তখন, নারী-কষ্ঠের এক আর্তনাদ। আমি শুনতে পেয়েছিলাম। যাইহোক, নৌকাটা চলতে চলতে এক সময় গিয়ে ঐ পাহাড়ের পাদদেশে ভিড়লো। তারপর কিছু লোকজন নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এলো এখানে। কিন্তু আশচর্য হলাম, ওরা নৌকা থেকে নেমে, অত মেহনত করে বানানো বজরাটাকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিলো।

    সেই থেকে এই হেঁয়ালীর কোনও অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি। এখন তোমার এই কাহিনী শুনে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো, বেটা। তোমার প্ৰিয়তমাকে ওরা ঐ পাহাড়ে বন্দিনী করে রেখে গেছে।

    রোশন জিজ্ঞেস করে, নৌকাটাকে পুড়িয়ে দিয়ে লোকগুলো কোথায় গেলো?

    পীর সাহেব বললো, যে পথ দিয়ে এসেছিলো আবার সেই পথ—এই মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ঐ দিকে চলে গেছে তারা।

    রোশন কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকে পীর সাহেবও। বলে, দুঃখ করো না, বাবা, আল্লাহ মেহেরবান। আজ রাতে আমি তার কাছে তোমার জন্য মোনাজাত করবো। তারপর যা আদেশ পাই, সেইভাবে তুমি কাজ করবে।

    এখন রোশনের কথা থোক। গুলাবীর কাহিনী শুনুন :

    পাহাড়ের সেই সুরম্য প্রাসাদে প্রবেশ করে গুলাবী অবাক হয়। এত সুন্দর মনোহর ইমারত সে কখনও দেখেনি। সারা প্রাসাদটা বিলাস উপচারে ভরা-বেশ সাজানো গোছানো ঝকঝকে তকতকে। কিন্তু সবই তার কাছে বিষাদময় হয়ে ওঠে। প্রিয়তম ছাড়া কোনও কিছুই তার কাছে ভালো লাগে না। প্রাসাদের ছাদে গিয়ে দাঁড়ায় সে। সেখান থেকে দূর দিগন্তে যতদূর চোখ যায়—শুধু জল আর জল। অনন্ত জলরাশি। মাথার ওপরে নীল আকাশ। আর সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় নাম না জানা কত রকমের পাখী।

    গুলাবী একখানা জাল পাতে। যদি ঐ পাখীরা এসে ধরা দেয়। যদি তাদের কেউ বন্দী হয়ে তার সঙ্গী হয়। কিন্তু কেউ ধরা দিতে আসে না। কেউ তার বিরহ-ব্যথার ভাগ নিতে চায় না। সে এই নিঃসঙ্গ পুরীতে একা। বড় অসহায়। অথচ তার কোনও দীনতা নাই। খানাপিনা সাজ-পোশাক বিলাস-বৈভবের কোনও অভাব নাই। কিন্তু কী হবে এত ভোগের সামগ্ৰী দিয়ে। যেখানে তার প্রিয়তম নাই সেখানে সবই নিরর্থক। উষর মরুভূমির মতো সবই রিক্ত শূন্য মনে হয় তার কাছে।

    গুলাবী তার বিরহ-ব্যথা নিয়ে দিন কাটাক, এবার আমরা আবার রোশনের দিকে চোখ ফেরাই :

    পীর সাহেব বললো, আমি কাল রাতে তোমার কথা ভেবেছি। আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছি। তুমি এক কাজ কর, একটু এগোলেই সামনে একটা খেজুর-বন দেখতে পাবে। ওখানে অনেক মরা গাছের গুডি পড়ে আছে। তার কয়েকটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে এসো এখানে।

    ফকিরের কথা মতো রোশন খেজুর কাঠের গুডি এনে জড়ো করে সেখানে। একটার সঙ্গে আর একটা বেঁধে সে ভেলা তৈরি করে। কিছু খড় বিচালি এনে পাটাতন বানায়।

    পীর সাহেব বলে, এবার আল্লাহর নাম করে উঠে বসে। খেয়াল রাখবে, সমুদ্রের মাঝখানের ঐ পাহাড়ে তোমাকে পৌঁছতে হবে।

    ভেলা ভেসে ভেসে চলে।

    সমুদ্র শান্ত ছিলো। হঠাৎ সে উত্তল হয়ে ওঠে। রোশন দিশহারা হয়ে পড়ে। উন্মত্ত চৈত্রের তাণ্ডবে কোথায় যে সে চলে যায়, কিছুই বুঝতে পারে না।

    এক সময় ঝড় থামে। রোশন চৈতন্য ফিরে পেয়ে দেখে ভেলা কোথায় ভেসে গেছে, সে এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছেছে। সমুদ্র ঝঞায় তার সারা দেহ ব্যথায় টনটন করছে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি নাই। দেখতে পেল, একটা খোজা তার দিকে এগিয়ে আসছে।

    —আপনি কে, মালিক? এখানে এইভাবে এলেন কী করে?

    —আমি এক সওদাগর। সমুদ্র-ঝড়ে আমার জাহাজ ডুবে গেছে। আমি ভাসতে ভাসতে এসে ভিড়েছি। এখানে। দেশ আমার ইস্পাহান।

    রোশনের দুর্দশার কাহিনী শুনতে শুনতে খোজাটা কেঁদে ফেলে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে।

    একমাত্র আল্লাহই আপনাকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহই আপনাকে রক্ষা করবেন। ইস্পাহান আমারও স্বদেশ! আমার ভালোবাসা, আমার চাচার মেয়ে আজও আমার পথ চেয়ে বসে আছে সেখানে। একদিন আমাদের জাতভাইরাই আমাকে চুরি করে নিয়ে যায়। তখন আমার বয়স খুবই কম। ওরা আমার বীচি দুটো কেটে খোজা বানিয়ে বাজারে বেচে দেয়। এমনি বান্দা হিসেবে বেচলে যা দাম পেত, তার অনেক বেশি দাম তারা পেয়েছিলো আমাকে খোজা বানিয়ে। সে থাক, আমার দুঃখের কিসসা পরে শোনাবো আপনাকে। এখন আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।

    পাহাড়ের চুড়ায় একখানা বিশাল প্রাসাদ। তার বাইরের মহলে রোশনকে নিয়ে যায় সে।

    –এইখানে আমি থাকি। খাইদাই ঘুমাই। বলতে গেলে প্রাসাদের সদর পাহারা দেওয়া ছাড়া আমার কোনও কাজ নাই। তা পাহারা দেবারই বা কী দরকার। সদর দরজা সারা বছর। বন্ধ থাকবে। খুলবে শুধু একদিন।

    রোশন বুঝতে পারে না। প্রশ্ন করে, মানে?

    খোজাটা বলে, প্রাসাদের অন্দর থেকে বাইরে বেরুবার কোনও নিয়ম নাই। ভেতরে ঢোকারও তাই। পুরো একটা বছরের যাবতীয় খানাপিনা সামানপত্র একেবারে ভিতরে পুরে দেওয়া হয়েছে। এক বছর বাদে আবার আসবে নৌক বোঝাই মালপত্র। সেইদিন আবার এ দরজা খোলা হবে, তার আগে নয়।

    রোশন দেখলো, চারপাশে গাছ-গাছালিতে ঘেরা সুন্দর সাজানো গোছানো প্রাসাদ। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে ফুলের বাগিচা। তার মাঝখানে একটা ফোয়ারা অবিরত ধারায় বর্ষণ করে চলেছে। কিন্তু এমন নয়নাভিরাম সৌন্দৰ্যও তার কাছে স্নান মনে হয়-করুণ কান্নার আওয়াজ শুনে।

    -কে কাঁদে? এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    চারশো সাততম রজনী। আবার সে বলতে থাকে :

    খোজা বলে, এক বাদশাহর উজির তার কন্যার নির্বাসনের জন্য বানিয়েছেন এই প্রাসাদ। দিন কয়েক আগে তিনি রেখে গেছেন তাকে। এই প্রাসাদের হারেমে তিনি বসে বসে তার দয়িতের জন্য চোখের জল ফেলছেন। এ কান্নার আওয়াজ তারই।

    রোশনের মুখে আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। স্বগতভাবে উচ্চারণ করে, যাক, এতদিনে আমি ঠিক জায়গাতে এসে পৌঁছেছি। নিমেষে তার দেহ-মনের সব ক্লান্তি সব অবসাদ দূর হয়ে যায়।

    কিন্তু এখানে এইভাবে কতকাল তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে—কিছুই আন্দাজ করতে পারে না।

    এই নির্বাসন-প্রাসাদে আসার পর থেকে গুলাবীর চোখে ঘুম নাই। মুখে আহার রোচে না। প্রায় এক রকম অনাহার অনিদ্রাতে কেঁদো-কেঁদে দিন কাটতে থাকে তার। প্রাসাদের কারাপ্রাচীরে মাথা কুটে সে, খোদা, আমাকে মুক্তি দাও এই কয়েদখানা থেকে।

    কিন্তু কোনই ফল হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় গুলাবীর, ছাদের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে শেষ করে দেবে সে। ভালোবাসার এই বিরহযস্ত্বণা আর কতকাল সইতে পারে। মানুষ? দূরে নীল আকাশের দিকে তাকায়। ওখানে মুক্ত বিহঙ্গরা ডানা মেলে ভেসে বেড়ায়। গুলাবী ভাবে, বনের পাখী, তারাও কত স্বাধীন, মুক্ত।

    ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব নানা চিন্তায় সে বিভোর হয়েছিলো। হঠাৎ একপাশে নজর পড়লো। একটা পাহাড়ী গাছের লম্বা ডাল ছাদের কানিশ ষ্টুয়েছে প্রায়। গুলাবী আশার আলো দেখতে পায়। ডালটাকে ধরতে পারলে নিচে নামা যেতে পারে। কিন্তু কানিশের ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু তাতে প্ৰাণ হারাবার ভয় আছে। তা থাক। গুলাবী আর প্রাণের মায়া করে না। এমন পোড়া ব্যর্থজীবন রেখেই বা কী হবে? সে মরিয়া হয়ে কাৰ্নিশের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডালটাকে আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ে। অনেক কায়দা কসরত করার পর নিজেকে সে আয়ত্তে আনতে পারে। কোনও রকমে একটা মোটা ডালে উঠে বসে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে আসে নীচে।

    দুৰ্গম পাহাড়ের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে একসময় সে সমুদ্রের সমতটেও নামতে সক্ষম হয়।

    তার সারা অঙ্গে দামী দামী রত্নাভরণ, বাদশাহী জমকালো সাজপোশাক।

    ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো নয়তম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

    গুলাবী দেখতে পায় এক ধীবর নৌকায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের জলে জাল ফেলছে। জেলেরও নজর পড়ে গুলাবীর ওপর। কপালের ভুরু কুঁচকে ওঠে তার। এখানে নির্জন সমুদ্র অঞ্চলে এমন রূপবতী সুন্দরী আমির সুলতানতনয়া সদৃশ এই নারী এলো কী করে? হয় সে বেহেস্তের হুরী পরী, নয় সে নিৰ্ঘাৎ অন্য কোথাও থেকে এসেছে এখানে। নৌকাটাকে লাগি দিয়ে ঠেলে সে কুলের কাছে নিয়ে আসে।

    গুলাবী তাকে ইশারা করে ডাকে। লোকটা আরও কাছে এলে সে বলে, ভয় নাই, আমি কোনও দৈত্য-দানবী বা জীন-পরী নই। কিংবা ভেবো না। সমুদ্রের নিচে আমার বাস। আমি এক রক্ত-মাংসে গড়া নারী। একান্তই মানুষের সন্তান। আমারও দেহে কামনা বাসনা ছিলো। আমিও ভালোবেসেছিলাম আমার দায়িতকে। কিন্তু কি করবো বলো, কপালে আমার সুখ লেখা নাই। বিধি বাম হলো, আমি আজ নির্বাসিত নারী! তোমার নৌকায় আমায় একটু জায়গা করে দেবে জেলের পো? আমি তোমায় সোনাদানা দেবো। দেবো। এই মুক্তোর মালা। জানি তো, এ মুক্তো পাওয়া যায়। এই সমুদ্রেরই ঝিনুক খোলে? আর দেরি করো না জেলের পো। তাড়াতাড়ি কাছে এসো। আমাকে উঠিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যাও। নইলে ওরা-যারা আমাকে এখানে বন্দী করে রেখেছিলো, তারা যদি জানতে পারে, আবার আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুরবে ঐ পিঁজরাপোলে। দোহাই, তুমি আর দেরি করো না।

    গুলাবীর রোদনভরা আকুলতায় বিচলিত হয় জেলে। তার চোখও জলে ভরে ওঠে। সেও ইয়াদ করতে পারে, তার প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেমের বিরহ যন্ত্রণ। বহুকাল পরে প্রায় বিস্মৃত সেই সব স্মৃতি আবার জেগে ওঠে। মনে।

    জেলে নৌকাখানা কূলে ভেড়ায়।

    -এসো, আমার নায়ে এসো। যেখানে তুমি যেতে চাও বলো, নিয়ে যাবো আমি।

    গুলাবী নৌকায় চেপে বসে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেলে দাঁড় টেনে সমুদ্রের কিনারা ছেড়ে অনেক ভেতরে চলে যায়। এমন সময় সমুদ্রে তুফান ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে জেলে নিশানা হারিয়ে ফেলে। শক্ত হাতে হাল ধরেও সে আর নৌকাটাকে বাঁচাতে পারে না। প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় কোথা দিয়ে কী ভাবে ওলোট পালোট খেয়ে কোথায় যে তলিয়ে যায় নৌকাখানা কিছুই ঠাওর করতে পারে না কেউ।

    এক সময় সমুদ্র শান্ত হয়। এক শহর সমীপে সমুদ্রতটের বালির চড়ায় নৌকাখানাকে আটকে থাকতে দেখা যায়। সেইদিন বিকালে সেই শহরের সুলতান দিরবাস বৈকালিক ভ্বমণে বেরিয়েছিলো। একখানা নৌকা বালির চড়ায় আটকে থাকতে দেখে সে তার পরিষদদের সঙ্গে নিয়ে নৌকাটার কাছে আসে। দেখে অবাক হয়, পাটাতনের ওপর শুয়ে আছে এক পরমাসুন্দরী কন্যা। সুলতান ভাবে, এ নিশ্চয়ই কোনও সমুদ্র-কন্যা হবে। না হলে এত রূপ। কখনও কোনও

    -কে তুমি?

    সুলতানের ডাকে গুলাবীর আচ্ছন্নভোব কেটে যায়। চোখ মেলে সে তাকায়। সুলতান আবার প্রশ্ন করে, কোন দেশের কন্যা তুমি, এখানেই বা এলে কী করে?

    এবার গুলাবীর সব মনে পড়ে। উঠে বসে সে। বলে, আমার বাবার নাম ইবরাহিম। তিনি শাহেনশাহ সামিখের উজির। আমার এই সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্য বড় বিচিত্র। তা হলে আগাগোড়া সবটাই শুনুন, তবে বুঝতে পারবেন।

    গুলাবী কোনও কথাই গোপন করলো না। তার প্ৰেম বিরহ বিচ্ছেদ, নির্বাসনের সব কাহিনীই তাকে বিস্তারিতভাবে বললো।

    —আমার নসীব খারাপ, চোখের পানি ফেলে। আর কী করবো। তবু তো পোড়া চোখে পানি বাধা মানে না। আমার ভালোবাসার এই যে অদ্ভুত কাহিনী এ কি তুচ্ছ অশ্রুধারায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে?

    এই সময় রজনী অতিক্রান্ত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো দিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    গুলাবীর মুখে তার জীবনের ব্যর্থপ্রেমের কাহিনী শুনে সুলতান ব্যথিত হয়ে বলে, ভয় নাই। তোমার দুঃখের দিন শেষ হয়ে এসেছে। এবার আর কাঁদতে হবে না। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো এবং আমার বিশ্বাস, তোমার ‘ভালোবাসাকে’ আমি পৌঁছে দিতে পারবো তোমার কাছে। এখন চলো, আমার প্রাসাদে চলো। সেখানে তুমি অবস্থান কর। আমি তোমার ‘ভোলাবাসা’র সন্ধানে লোকজন পাঠাচ্ছি।

    সুলতান তার উজিরকে বললো, নানারকম মূল্যবান সাজ-পোশাক উপহার উপটৌকন এবং আমার একদল সৈন্য সঙ্গে নিয়ে বাদশাহ সাখিমের দরবারে যাও তুমি। সেখান থেকে রোশন নামে এক নওজোয়ান যুবক প্রার্থনা করে নিয়ে আসবে। বাদশাহকে বলবে গুলাবীর জান-বাঁচাবার জন্য রোশনকে অতি অবশ্য দরকার। তাকে যেন শাহেনশাহ সাখিম। এখানে পাঠিয়ে দেন।

    সুলতান দিরবাস বাদশাহ সাখিমকে একখানা চিঠিতেও সে কথা খুলে লিখে দিলো। যাওয়ার সময় উজিরকে সে বললো, তোমার কাজে যদি আমি খুশি হই, তবে তোমাকে আমি আরও দায়িত্ব ছেড়ে দেবো। কিন্তু যদি শূন্য হাতে ফিরে আস, তবে তোমার পদাবনতি ঘটবে, উজির। মনে থাকে যেন।

    উজির যথাবিহিত কুর্নিশ করে বলে, যে হুকুম, জাঁহাপনা।

    বাদশাহ সাখিমের দরবারে পৌঁছে উজির সুলতান দিরবাস-এর ভেট সওগাত এবং নিচিঠিখান পেশ করে। বাদশাহ সাখিম চিঠিখানা পড়ে কাঁদতে থাকে, ইয়া আল্লাহ, রোশনকে কোথায় পাবো। সে যে কোথায় চলে গেছে, আমরা তো তার কোন হদিস জানি না। তাকে যদি তুমি ফিরিয়ে আনতে পারো উজির, তোমার সুলতান আমাকে যে ডালি পাঠিয়েছেন আমি তোমাকে তার দ্বিগুণ সওগাত দেবো। এখন তুমি এসব জিনিস ফেরত নিয়ে যাও তোমার সুলতানের কাছে। তাকে গিয়ে বলো, আজ অনেক দিন হলো রোশন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কেউ তার সন্ধান করতে পারছে না। বুঝতেই পারছি না, সে আজ কত দূরে—কেমন আছে, অথবা আদৌ সে বেঁচে আছে কি না।

    উজির বলে, কিন্তু জাঁহাপনা, রোশনকে সঙ্গে না নিয়ে আমি আমার সুলতানের সামনে যেতে পারবো না। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, যদি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে না পারি তবে আমাকে তিনি আর এই উজিরের পদে রাখবেন না। এখন আমি শূন্য হাতে কি করে দেশে ফিরে যাবো, জাঁহাপনা।

    বাদশাহ তার নিজের উজির ইবরাহিমকে বললো, এই উজিরের দলের সঙ্গে তোমরা ঘুরে ঘুরে তাকে খুঁজে বেড়াও। খুঁজে তাকে বের করতেই হবে।

    ইবরাহিম বললো, জাঁহাপনার যা মর্জি।

    ওরা অনেক দিন ধরে নানা দেশের নানা শহর প্রান্তর গ্রামগঞ্জ তল্লাস করে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু রোশনের কোনও সন্ধান পেলো না।

    ভোর হয়ে আসছে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ কর বসে রইলো।

     

    চারশো এগারোতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

    আবার তারা নগরে প্রান্তরে ঘুরতে লাগলো। পথের মধ্যে যাদের সঙ্গেই দেখা হয় সকলকেই জিজ্ঞেস করে রোশনের কথা। কিন্তু কেউই কোনও আলোর নিশানা দেখাতে পারে না।

    এইভাবে চলতে চলতে একদিন তারা সেই সমুদ্র-সৈকত্বে এসে হাজির হয়। এই সমুদ্রের মাঝখানে সেই নির্বাসিতা মাতা পাহাড়। সুলতান দিরবাসের উজির ইবরাহিমকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ঐ পাহাড়টার ওরকম নাম রাখা হয়েছে কেন?

    ইবরাহিম বলে, এর পিছনে একটা মজার কাহিনী আছে। অনেক কাল আগে চীন দেশে এক জিনিয়াহ ছিলো। সে ঘটনাক্রমে একটি মনুষ্য সন্তান যুবকের প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। জীনের রোষ থেকে তাকে রক্ষা করার জন্যে সে তার দায়িতকে এই নির্জন দ্বীপ-পাহাড়ে এনে লুকিয়ে রাখে। জীনের চোখ ফাকি দিয়ে মাঝে মাঝে সে আকাশ-পথে উঠে এসে এই পাহাড়ে সেই যুবক প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতো। তার ঔরসে বার-কয়েক সেই জিনিয়াহ গর্ভবতী হয় এবং কয়েকটি ছেলেমেয়ের জন্ম দেয় এই পাহাড়েই। নাবিকরা জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দেবার সময় সেই ছেলেমেয়েদের কান্নাকাটির আওয়াজ শুনতে পেতো তখন।

    সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম ‘নির্বাসিতের মা’ হয়ে গেছে।

    নৌকায় চেপে পাহাড়ের পথে যেতে যেতে ইবরাহিম। এই কাহিনী শোনাচ্ছিল তার সঙ্গী সুলতান দিরবাসের উজিরকে। একটু পরে পাহাড়ের পাদদেশে এসে নৌকা ভিড়ালো। দ্বাররক্ষী খোজা এসে সালাম জানালো তাদের। ইবরাহিম যে তার মনিব, তা সে দেখেই চিনতে পেরেছে। দুজন উজিরকে সঙ্গে নিয়ে সে প্রাসাদে উঠে এলো। প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে নফর। চাকরদের মধ্যে এক ভবঘুরে যুবককে দেখে ইবরাহিম চিনতে পারে—এই সেই রোশন!

    ইবরাহিম খোজাকে জিজ্ঞেস করলো, এই মুসাফির যুবকটি কে? কী তার পরিচয়? কেনই বা এখানে সে এসেছে?

    খোজা বলে, বেচারি এক সওদাগর। সমুদ্রে জাহাজ ডুবে গেছে। সহায়সম্বলহীন হয়ে সে কেনমতে-প্ৰাণে রক্ষা পেয়েছে। আমাদের এই ঘাটেই একদিন এসে ভিড়েছিলো। তারপর থেকে এখানেই আছে। মানুষটি বড় ভালো। একেবারে ফকির দরবেশের মতো। কারো সাতে-পাঁচে নাই। নিজের মনেই সে ঘুরে বেড়ায়। খুব কম কথা বলে। নাওয়া খাওয়া করে না বললেই চলে।

    ইবরাহিম তখন আর কিছু না বলে প্রাসাদের অন্দরে ঢোকে। কিন্তু হারেমের কোথাও তার কন্যা গুলাবী দেখতে না পেয়ে সে দাসী-বাদীদের প্রশ্ন করে, আমার মেয়ে কোথায়?

    তারা ভীত-চকিত হয়ে বলে, আমরা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এই দুর্গের মতো প্রাসাদ থেকে কী করে সে অন্তর্ধান হয়ে গেলো! শুধু এইটুকু জানি, সে আর এ প্রাসাদে নাই। আমরা তার কোনও হদিশ করতে পারিনি।

    দাসী-বাদীদের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে উজির ইবরাহিম। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আক্ষেপ করতে থাকে, ইয়া আল্লাহ, তোমার লীলা বোঝা ভার। যার কপালে যা লিখে রেখেছে, তা থেকে একচুল এদিক ওদিক হবার জো নাই।

    ইবরাহিম ছাদের ওপরে উঠে আসে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে একটা গাছের ডালের দিকে নজর পড়ে। ডালখানা এসে ছুয়েছে প্রাসাদের কার্নিশ। ইবরাহিমের আর বুঝতে কষ্ট হয় না, তার কন্যা গুলাবী এই ডাল বেয়ে নিচে নেমে কোথাও চলে গেছে।

    রক্ষী-বাহিনীকে বলা হলো সারা পাহাড়ের প্রতিটি কন্দর তন্নতন্ন করে খুঁজে পেতে দেখতে।

    কিন্তু রক্ষীরা অনেক খুঁজেও গুলাবীর কোনও সন্ধান আনতে পারলো না। ইবরাহিম ভাবলো; পাহাড়ের জন্তু-জানোয়ারদের মুখে পড়ে। তার কন্যা গুলাবীর ইন্তেকাল হয়ে গেছে।

    এদিকে এই সংবাদ রোশনের কানে যেতেই সে আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার এই অনড় অসাড় অবস্থা দেখে প্রাসাদের নফর চাকররা ভাবে, যুবক ধ্যানস্থ হয়েছে। এখন সে খোদ খোদাতালার সঙ্গে কথা বলছে।

    এ অবস্থায় তার পক্ষে রোশনের সন্ধান করে বেড়ানো আর সম্ভব হবে না। তাই সে ভাবলো এক এক উদ্দেশ্য-বিহীনভাবে এদিক ওদিক ফালতু ঘোরাঘুরি করে কোনও ফয়দা নাই। সুতরাং শূন্যহাতে স্বদেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। সুলতানের রোষে তার অশোক্ষ ক্ষতি হবে জেনেও সে দেশের পথেই রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমে সে গুলাবীর পিতা ইবরাহিমের কাছে গেলো বিদায় নিতে। বললো, আপনার যা মনের অবস্থা তাতে আর আপনাকে বিরক্ত করবো না। আমি দেশে ফিরে চললাম। শুধু যাওয়ার সময় আপনার প্রাসাদের ঐ অসহায় যুবকটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। ওর মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, জীবনে সে কোনও পাপ করতে পারে না। অথচ কী কপাল দোষে আজ তার এই দুরাবস্থা। আমি রোশনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলাম না, সে কারণে সুলতান আমার ওপর কুপিত হবেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু একমাত্র এই ভরসা নিয়ে যাচ্ছি, এই যুবকের সুন্দর অপাপবিদ্ধ চেহারায় মুগ্ধ হয়ে যদি-বা তিনি প্রসন্ন হয়ে আমাকে কিছু কম সাজা দেন। পরে আমি তাকে তার স্বদেশ ইস্পাহানে পাঠিয়ে দেব। আমাদের শহর থেকে ইস্পাহান তো বেশি দূরে নয়।

    ইবরাহিম বলে, আপনার যা অভিরুচি। আমার কোনও আপত্তি নাই।

    দুই উজির দুই পথ ধরলো। নিজের নিজের দেশের পথ।

    দিরবাসের উজির রোশনকে একটা খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে তার পাশে পাশে নিয়ে চললো। তখনও রোশনের আচ্ছন্ন ভাবি কাটেনি।

    তিন দিন তিন রাত্ৰি কেটে গেলো। ধীরে ধীরে রোশন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পায়। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে উজিরের দিকে তাকায়, আমি কোথায়?

    একজন নফর ওকে বোঝাবার চেষ্টা করে, আপনি সুলতান দিরবাসের উজিরের সঙ্গে তীর শহরের পথে চলেছেন।

    উজির বললো, এবার ওকে গুলাব জল দিয়ে মুখ ধুইয়ে, খানাপিনা খেতে দাও! সময় সময় খেয়াল রাখবে, ওর কোন কিছু অসুবিধা হচ্ছে কি না।

    শহরের কাছে আসতে দূত দ্রুতগতিতে ছুটে গেলো সুলতান দিরবাসের কাছে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সে ফিরে এসে উজিরকে জানালো, সুলতান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি হুকুম পাঠিয়েছেন, যেহেতু তুমি ওয়াদা মতো রোশনকে খুঁজে-পেতে সঙ্গে আনতে পারেনি, সেই কারণে আমি তোমার মুখ দর্শন করতে চাইনি। প্রাসাদে আসতে হবে না। তোমাকে। তুমি শহরের ভিতরে ঢুকবে না।

    দিশাহারা উজির বুঝতে পারে না, এখন কী করণীয়। বেচারী জানে না, যে-গুলাবীর জন্য উজির ইবরাহিম আজ শোকাকুল সেই গুলাবী এখন সুলতানের হেফাজতে। আর যে-রোশনকে খুঁজে আনতে পারেনি বলে আজ তার নিজের এই নির্মম দশা সেই রোশন তারই দলবলের সঙ্গে চলেছে। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস!

    সুলতান দিরবাসের হুকুম শুনে উজিরের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। অনেক চিন্তা ভাবনা করেও নিজের বুদ্ধি দিয়ে কোনও উপায় উদ্ভাবন করতে পারে না! ভাবে, ঐ যুবক খোদাতালার এক নিষ্ঠাবান ভক্ত। এ ব্যাপারে সে হয়তো তাকে কোনও নিশানা বাৎলে দিতে পারে।

    রোশনের কাছে গিয়ে সে বলতে থাকে, এক কঠিন সমস্যায় পড়েছি আমি। নিজে নিজে ভেবে ভেবে কোন কুল-কিনারা করতে পারছি না। তুমি আল্লাহর সেবক, আমার বিশ্বাস তুমিই আমাকে পথ বলে দিতে পারবে। আমার সুলতান একটি কাজে আমাকে দূরদেশে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমার খারাপ নসীব, আমি কাজটা সমাধা করতে পারিনি। এখন তার দূত এসে আমাকে খবর দিয়ে গেলো, যেহেতু আমি কাজটা করে আসতে পারিনি। সেই কারণে তিনি আমার মুখ দর্শন করবেন না। তার হুকুম, আমি যেন তার শহরে প্রবেশ না করি।

    -কী কাজে তিনি পাঠিয়েছিলেন। আপনাকে?

    তখন উজির তাকে আদ্যোপোন্ত সব কথা খুলে বললো। সব অবগত হলো রোশন। ভিতরে ভিতরে দারুণ বিচলিত বোধ করলেও বাইরে কিছু প্রকাশ করলো না সে। সহজ ভাবেই বললো, কিছু ভয় করবেন না, আমাকে সুলতানের সামনে নিয়ে চলুন। আমি তাকে বলবো, রোশনের সন্ধান আমি জানি।

    উজিরের চোখ আনন্দে নোচে ওঠে, তুমি কী সত্যিই জানি, বাবা?

    রোশন বললো, আমি মিথ্যে বলবো কেন? সত্যিই জানি।

    উজির আর তিলমাত্র বিলম্ব করতে পারে না। রোশনকে সঙ্গে নিয়ে সে সুলতানের দরবারে গিয়ে হাজির হয়।

    উজিরকে দেখামাত্র সুলতান গর্জে ওঠে, রোশন কোথায়? পেয়েছে। কোনও সন্ধান?

    উজিরের বদলে রোশ্ন জবাব দেয়, সুলতান মহানুভব, আমি জানি, রোশন কোথায় লুকিয়ে আছে।

    সুলতান ইশারায় তাকে কাছে আসতে বললো। রোশন তার সামনে এগিয়ে যেতে সে প্রশ্ন করে, সে-জায়গাটা কোথায়? কতদূর?

    -খু-উ-ব কাছে। একেবারে আপনার নাকের ডগায় বলতে পারেন, জাঁহাপনা। আমি তার সন্ধান আপনাকে সূত্র নিশ্চয়ই জানাবো। কিন্তু তার আগে মেহেরবাণী করে বলুন, কেন, কী কারণে তাকে আপনার প্রয়োজন? অবশ্য আপনার যদি জানাতে কোনও আপত্তি না থাকে।

    আপত্তির কিছু নাই। সবই তোমাকে বলতে পারি। তবে শুধু তোমাকেই। কারণ, এ আমার নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার। দরবারের সবাইকে তা জানাতে চাই না। আমি তোমাকে নিভৃতে। সব খুলে বলবো।

    সুলতান রোশনকে সঙ্গে নিয়ে দরবার ছেড়ে এক গুপ্তকক্ষে প্রবেশ করে। সমস্ত কথা সে খুলে বলে তাকে।

    রোশন বলে, আপনি এক কাজ করুন, আমাকে জমকালো একটা সাজ পোশাক এনে দিন। আমি ওটা পরে যখন দাঁড়াবো, তখনই রোশন এসে হাজির হবে আপনার সামনে।

    সুলতান তাকে এক মহামূল্যবান সূক্ষ্ম কারুকার্যকরা সাজ-পোশাক এনে দিলো। রোশন তার ছিন্ন বেশ-বাস পরিত্যাগ করে শাহী-সাজে সেজে সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, আমি, আমিই সেই রোশন, জাঁহাপনা।

    এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো তেরোতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়। শাহরাজাদ বলতে থাকে :

    রোশন তার সমূহ বিরহ উপাখ্যান সবিস্তারে বর্ণনা করলো সুলতানের কাছে। সুলতান বলে, খোদা হাফেজ, সত্যিকারের মহব্বতের কখনও মৃত্যু হয় না। তোমাদের দু’জনের মধ্যেই যে তীব্র আকুলতা আমি দেখলাম, ভালোবাসার ইতিহাসে তা সোনার জলে লেখা থাকবে। যতদিন চন্দ্র সূৰ্য গ্রহ তারা থাকবে, তোমাদের এই অমর প্রেমের জ্যোতির্ময় শিখা দূর আসমানের ধ্রুবতারার মতো জুলতেই থাকবে।

    রোশন জিজ্ঞেস করে, এখন গুলাবী কোথায় আছে, জাঁহাপনা?

    –সে আমার প্রাসাদেই আছে।

    সুলতান কাজী আর সাক্ষী-সাবুদিদের ডেকে পাঠালো। কাজী এসে শাদীনামা তৈরি করে দিলো। রোশনকে নানা মূল্যবান দান-সামগ্ৰী দিলো সুলতান। এবং বাদশাহ সামিখের কাছে এক দৌত্যদল পাঠানো।

    বাদশাহ সামিখ সংবাদ পেয়ে সবিশেষ আনন্দিত হয়ে সুলতান’ দিরবাসকে এক পত্রে জানালো, আমি খুব আনন্দিত। আমার ইচ্ছা, শাদী উপলক্ষে খানাপিনার উৎসব আমার প্রাসাদেই হোক।

    বহু উট, গাধা, খচ্চর এবং ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করা হলো বিরাট দানসামগ্ৰী। অনেক দাস-দাসী লোকজনের এক বিশাল বাহিনী পাঠালেন তিনি সুলতান দিরবাসের প্রাসাদে।

    সেই স্মরণীয় দিন প্রায় এসে গেলো। ওরা সকলে ইস্পাহানে এসে। উপস্থিত হলো। সে-দিনের সেই আলোকসজ্জা, সেই সমারোহ ভুলবোর নয়। সারা দেশের যত গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়ে-সবাই এসে জড়ো হলো ‘বাদশাহের প্রাসাদে। তিনদিনব্যাপী চলতে থাকলো সেই আনন্দ উৎসব। লোকে পেটপুরে খেয়ে সাজপোশাক উপহার নিয়ে খুশি মনে ঘরে ফিরে গেলো। উৎসবের শেষে রোশন গুলাবীর ঘরে গিয়ে তাকে বুকে টেনে নেয়।

    এতকালের এত বিরহবেদনার এইখানেই ইতি হয়ে যায়। দুজনের গাল বেয়ে ঝরে পড়ে আনন্দের অশ্রুধারা। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলতে পারে না। শুধু বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে তারা।

    শাহরাজাদ বলে, এর পর আপনাকে অন্য ধরনের এক আশ্চর্য কাহিনী শোনাবো, জাঁহাপনা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.