Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩.০১.১ ধূর্ত ডিলাইলাহ ও তার জালিয়াৎ কন্যা জাইনাবের কাহিনী

    ধূর্ত ডিলাইলাহ ও তার জালিয়াৎ কন্যা জাইনাবের কাহিনী

    খলিফা হারুণ অল রসিদের সময়ে বাগদাদ শহরে আহমদ এবং হাসান নামে দুই মহা ধড়িবাজ চোর-কুল-শিরোমণি বাস করতো। চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা-সেই বিদ্যায় তারা দু’জনেই মহা ওস্তাদ। তাদের কায়দা কৌশল বড়ই বিচিত্র; অদ্ভুত। চুরি করার নিত্য নতুন অভিনব ফন্দী তাদের মাথায় গজাতো। তাদের লোক ঠকানো, প্রতারণা, জালিয়াতির বহু বিচিত্র কাহিনী লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে—আজও।

    খলিফা ভাবলেন, এই চোর দুটোকে কিছুতেই হাতে-নাতে ধরা যাচ্ছে না। এমনই তাদের কায়দা কৌশল এবং প্রখর বুদ্ধি যে, আইনের ফাঁক দিয়ে ফুডুৎ করে পালিয়ে যায় প্রতিবারই।

    অবশেষে তিনি ঠিক করলেন, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে। তাই, আহমদ আর হাসানকে ডেকে খলিফা তাদের দু’জনকে কোতোয়ালের দুই প্রধান পদে বহাল করলেন। শহর রক্ষার ভার পড়লো দুই চোরের হাতে। খলিফা বললেন, আমার শহরের সব চোর বদমাইশদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি চাই আমার প্রজারা নিশ্চিন্তে ঘুমোক। তাদের বিষয় সম্পত্তি যাতে খোয়া না যায়, তার পুরো দায় তোমাদের দুজনের ওপর।

    খলিফা দুজনকে মূল্যবান সাজ-পোশাক এবং প্রতিমাসে এক সহস্ব স্বর্ণমুদ্রা বেতনের ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রত্যেকের চল্লিশজন করে ঘোড়সওয়ার সিপাই এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামের বরাদ্দ করা হলো! আহমদের ওপর ন্যস্ত হলে স্থলের শান্তি ও সুরক্ষার দায়িত্ব। আর হাসান পেল জলপথের ভার।

    সেইদিনই তারা দুজন কোতোয়াল খালিদাকে সঙ্গে করে শহর পরিক্রমায় বের হলো। তাদের সঙ্গে সঙ্গে চললো চল্লিশ চল্লিশ আশিটি ঘোড়সওয়ার সিপাই। কোতোয়াল পথে পথে ঘুরে ঘোষণা করলো, আজ থেকে মহামান্য খলিফার আদেশে আহমদ আর হাসানকে স্থল ও জল কোতোয়ালের দুই প্রধান পদে বহাল করেছেন। শহরবাসীরা শুনুন, আপনাদের ধন-সম্পদের নিরাপত্তার জন্য আজ থেকে এরা দুজন প্ৰাণপাত করতে প্রস্তুত। যদি কখনও কারো কোন সাহায্য প্রয়োজন হয়। এদের সঙ্গে মোলাকাৎ করবেন। এরা আপনাদের সেবা করতে পারলে কৃতাৰ্থ মনে করবেন।

    এই সময়ে বাগদাদ শহরে এক ধূর্ত বুড়ী ডিলাইলাহ আর তার প্রতারক মেয়ে জাইনাব বাস করতো। ডিলাইলাহর দুটি মেয়ে। বড়টির সে শাদী দিয়েছে। কিন্তু ছোটটি বিয়ে বা শাদী কিছু করেনি। নানা ছলা-কলায় লোক ঠকানোই তার একমাত্র ব্যবসা। এই মা-মেয়ের কুখ্যাতি সারা শহরের প্রতিটি মানুষই জানতো।

    ডিলাইলাহর স্বামী সে সময়ে একজন বেশ নামজাদা মানুষ ছিলো। খলিফার সারা মুলুকে সে চিড়িয়া সরবরাহ করতো, এই কারণে খলিফা তাকে খুব খাতির করতেন। সে সময়ে বাগদাদের সন্ত্রান্ত সমাজে তার বেশ নাম ডাক ছিলো। কিন্তু সে সবই অতীত স্মৃতি। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভাব প্রতিপত্তিও মুছে যেতে দেরি হলো না। কালক্রমে মানুষ একেবারেই বিস্মৃত হলো তাকে। মরার সময় সে তার দুই কন্যা আর বিবিকে রেখে গিয়েছিলো। আজ তার বিধবা বিবি ডিলাইলাহ এবং ছোট মেয়ে জাইনাব লোক ঠকিয়ে, প্রতারণা করে দিন কটায়। জাইনাবের মতো শয়তান মেয়েছেলে খুব কম দেখা যায়। তার শিরায় শিরায় বন্দবুদ্ধি। সাপের মতো সে হিংস্র। ছলে বলে কৌশলে যেন তেন প্রকারণে সে তার অভীষ্ট সিদ্ধ করবেই করবে। যদি কারো পিছনে লাগে, তা সে যদি সাক্ষাৎ শয়তনও হয়, তার কোনও ভাবেই নিস্তার পাওয়ার জো নাই। তাকে সে সমুচিত শিক্ষা দেবেই-এই তার পণ।

    কোতোয়াল যখন আহম্মদ আর হাসানকে নিয়ে তাদের দপ্তরের ফরমান জারি করে বেড়াচ্ছিল, সেই সময় বুড়ি ডিসাইলাহ আর তার মেয়ে জাইনাব জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করলো সব। জাইনাব বলে, জান মা এই আহমদ লোকটা কে? একটা নাম-করা দাগী আসামী। অন্য এক দেশ থেকে পালিয়ে এখানে এসে ঢুকেছে। ওর কীর্তি-কলাপ আমি সবই জানি। ওর স্বদেশ মিশর। সেখানকার কোতোয়াল গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে। এখানে আসার পর সে যে ধরনের চুরি, প্রতারণা জালিয়াতি চালিয়েছিলো তাতে খলিফাও চিন্তায় পড়েছিলেন। হালে পানি না পেয়ে তিনি চোরকেই বহাল করেছেন চুরি রাহাজানি বন্ধ করতে। আর ঐ হাসানটা তার দোসর। ওরা দুজনে আজ খলিফার ডান হাত আর বা হাত। খলিফার প্রাসাদে তাদের জন্যে এখন পাতা পড়ে। তোফা আছে বটে-চল্লিশটা করে সাগরেদ, হাজার দিনার মাসৌহারা, তা ছাড়া কত কী ইনাম উপহার নিত্য জুটছে। আর আমরা কী কষ্টে কাল কাঁটাচ্ছি, দেখ মা। খলিফার প্রাণে এতটুকু দয়া মায়া নাই। অথচ বাবা যখন বেঁচেছিলো, কি খাতির না করতেন। খলিফা। বাবাকে কত ইনাম উপহার দিতেন। বাবা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে গেছেন তিনি। অবাক দুনিয়া। এখন আমাদের কী ভাবে দিন কাটছে, খেতে পরতে পাচ্ছি কি পাচ্ছি না, একটিবার খোঁজ খবরও করেন না।

    বুড়ি ডিলাইলাহ মাথা দুলিয়ে বলে, খোদাতালা মাথার ওপরে আছেন। তিনি সবই দেখছেন। তবে দুনিয়াতে কৃতজ্ঞ লোকের সংখ্যা খুবই কম। এই-ই জগতের নিয়ম। এই রকমই হয়! ও নিয়ে মন খারাপ করিস না।

    জাইনাব ক্ষেপে ওঠে, না মা এ সব মুখ বুজে। আর বরদাস্ত করা সম্ভব (উর্দু না। একবার তুমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াও দেখি। তোমার ছল-চাতুরীর R কাছে ওরা সব নাস্যি। তোমার জালিয়াতির জাল একবার মেলে ধরে তো। খলিফার থেতা মুখ ভোঁতা করে দিতে হবে। এমনভাবে লোক ঠকানোর ফন্দী ফাঁদবে, যা শুনে খলিফার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে! তখন বুঝবেন তিনি, কত ধানে কত চাল। তোমার শয়তানী বুদ্ধির বহর দেখে তিনি তাজ্জব বনে যাবেন। তখন দেখে নিও, খলিফার টনক নড়বে। তোমাকেও তার দরবারে ভালো চাকরীতে বহাল করতে বাধ্য হবেন তিনি।

    রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো তেত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

    ডিলাইলাহ কন্যার কথায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এই আমি আমার মাথার বেণী ধরে কসম খাচ্ছি, জাইনাব, এমন শয়তানীর চাল আমি চালবো-এক চালেই বাজী মাৎ হয়ে যাবে। বাছাধন আহমদ আর হাসান হালে পানি পাবে না।

    আর এক মুহূর্তও দেরি না করে তখুনি সে উঠে পড়ে কাজে লেগে গেলো।

    এক সুফী দরবেশের মতো করে লম্বা গেরুয়ার আলখাল্লা পরলো সে। তার উপরে চাপালো একখানা জবর জং বোরখা। গলায় পরলো নানা রঙের রকমারী পুতির একখানা মালা। রেশমী সুতোয় বেঁধে জলে ভরে একটা বদন ঝুলিয়ে নিলো গলায়। তার মধ্যে তিনটি সোনার দিনার রেখে বদনার মুখে এক গোছা খেজুরের ছোবড়া গুঁজে দিলো। নানারকম আকার এবং ওজনের অনেকগুলো ধাতব চাকতি আর মড়ার খুলী দিয়ে গাথা বিদঘুটে বিচিত্র আজানু এক জগকাম্প মালা গলায় ধারণ করলে সে। তার সাকুল্যে ওজন হবে এক আঁটি জ্বালানী কাঠের সমান। যুবতীরা যে ধরনের নিশান নিয়ে চলে সেই রকম লাল হলদে আর সবুজের ডোরাকাটা একখানা নিশান নিলো এক হাতে।

    এই কিন্তুত কিমাকার এক ছদ্মবেশ ধারণ করে সে পথে নামলো। জোর চিৎকার করে আওয়াজ তুলতে থাকলো, আল্লাহ—আল্লাহ। মাঝে মাঝে সে নানারকম প্রার্থনার বুলি কপচাতে থাকে। এক কথায় প্রথম দর্শনে সবাইকে আঁৎকে উঠতে হবে-এমন তার সাজ-পোশাক, চাল-চলন এবং গলার বিচিত্র আওয়াজ।

    সারাটা শহর। এইভাবে সে চলতে চলতে এক সময় এক গলির শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। বিশাল একখানা শ্বেত পাথরের ইমারত—তার সদর ফটকে সুসজ্জিত এক মুর প্রহরী। বিরাট দরজার চৌকাঠ আর পাল্লা আগাগোড়া সুগন্ধী চন্দন কাঠে তৈরি। সুন্দর সুন্দর নানারকম কাজ করা পিতলের বলয় বসানো। বড় বাহারী দেখতে।

    বাড়িখানা খলিফার দেহরক্ষী মুসতাফার। লোকটা ভীষণ ভয়ঙ্কর। লোকে বলে বাঘ। কথার আগে তার ঘুষি চলে। একটি পরমাসুন্দরী মেয়েকে শাদী করে সুখে দিন কাটাচ্ছে। নিজের ঘরের বিবি ছাড়া পর-নারীর দিকে তার কদাচি নজর নাই। কোনও দিনই সে বাড়ির বাইরে রাত কাটায় না। কিন্তু তার এমনই নসীব, রোজ রাতে বিবির সঙ্গে সহবাস করেও এযাবৎ একটা সন্তান পয়দা করতে পারেনি সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে মাথার সাদা চুলের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। দিনে দিনে বয়স বাড়ছে। বুড়ো হতে আর বেশি দেরি নাই। অথচ আজও তার একটি ছেলে পুলে কিছু হলো না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ কি তাকে এই রকম নিঃ সন্তান করেই রাখবেন? মনটা কেমন যেন বিষিয়ে ওঠে। এই সময় তার বিবি এসে দাঁড়ায় সামনে। এক সময়ে প্রাণের-পিয়ারী এই বাঁজা মেয়েমানুষটাকে দেখে আজকাল তার পিত্ত জ্বলে খায়। তার ধারণা তারই দোষে সে আজ সন্তান-সুখ বঞ্চিত। দীত মুখ খিঁচিয়ে ঝাঝালো গলায় চিৎকার করে ওঠে, এখানে কী? কেন এসেছিস আমার সামনে, হতচ্ছাড়া অপয়া কোথাকার! যেদিন থেকে তুই আমার ঘরে এসেছিস সেইদিন থেকে আমার সব সুখ শান্তি উবে গেছে। যা ভাগ, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।

    মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, সে কি আমার দোষে?

    –আলবৎ তোর দোষে। প্রথম শাদীর রাতে, মনে পড়ে? আমাকে দিয়ে হলফ করিয়ে নিয়েছিলি, জীবনে আমি যেন অন্য মেয়েকে ঘরে না আনি, মনে পড়ে? আমি তো আমার কথা রেখেছি। কিন্তু তাতে লাভটা কী হলো? তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকতে বসেছে, আজি পর্যন্ত একটা বাচ্চা বিয়োতে পারলি না! দরবারের যত দেওয়ান আমির সবাইকেই দেখছি।–কী সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়ের বাপ হয়েছে তারা। আর আমি? দুনিয়ার অযাত্রা একটা অপুত্রক হয়ে হা-হুতাশ করে মরছি। এ সংসারে যে বংশরক্ষা করে যেতে পারে না সে তো সমাজের পতিত ঘূণ্য জীব। আমাকে সেই আখ্যাতি মাথায় বয়ে বাঁচতে হচ্ছে। এর চাইতে জহর খেয়ে মরাও অনেক ভালো। দুঃখ বল আর রাগই বল, সবই আমার শুধু এই একটা কারণে। তুই একটা বাঁজা-বেহদ্দ মেয়েমানুষ; আমার সারা জীবনের বীর্যপোতই বিফলে গেলো।

    স্বামীর এই ধরনের দোষারোপে মুহূর্তে মধ্যে মুখ নীলবৰ্ণ হয়ে গেলো তার।

    —মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। আমার একবিন্দু দোষ নাই। সন্তান ধারণের সব ক্ষমতাই আমার আছে। আসলে তোমারই মরা বীর্য।

    মুসতাফা বলে, ঠিক আছে, প্রমাণ আমি করে দিচ্ছি। আজই আমি আর একটা শাদী করে ঘরে অন্য এক মেয়েছেলে নিয়ে আসছি। তারপর যথাসময়ে প্রমাণ করে দেবো, আমার বীর্য भद्धां, না अठ!

    বৌটা বললো, আমার নসীবে যা লেখা আছে তা তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না। সতীনের সঙ্গে যদি ঘর করা কপালে থাকে, তাই হবে।

    এই বলে কাঁদতে কাঁদতে  সে সে-ঘর ছেড়ে চলে গেলো। কিন্তু মুসতাফা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনুতাপের আগুনের দগ্ধ হতে থাকলে সে। বারবার মনে হতে লাগলো, মানুষটাকে অত শক্ত শক্ত কথা না বললেই বুঝি ভালো হতো।

     

    এতক্ষণ আপনারা বাড়িটার ভিতরের কিছু ঘটনা শুনলেন। এবার শুনুন, ধূর্ত বুড়ি ডিলাইলাহর কথা।

    ডিলাইলাহ জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলে আমীরের বিবি বিষণ্ণ বদনে বসে বসে কী যেন চিন্তা করছে। তার গা ভর্তি গহনা; পরণে মূল্যবান সাজপোশাক। ডিলাইলাহ আড়চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখে নেয়। নিজের মনে মনেই বলে, শোনো ও ডিলাইলাহ, এই তোমার সুবৰ্ণ সুযোগ। এবার তোমার বুলি থেকে বুদ্ধির প্যাঁচ-পায়জার বের করে কাজে লাগাও। মেয়েটাকে ঘরের বাইরে বের করে নিয়ে গিয়ে তার গায়ের গহনাপত্র এবং সাজপোশাক যদি তুমি খুলে নিতে পারো। তবেই বুঝবো তোমার কেরামতি।

    ডিলাইলাহ হঠাৎ উচ্চৈস্বরে আল্লাহ-আল্লাহ করতে থাকে। আশেপাশের বাড়ির জানলার পর্দা সরে যায়। বাড়ির মেয়েরা উৎসুক হয়ে দেখতে থাকে। এক সুফী দরবেশ এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বুড়ির দোয়া মাগে।

    মুসতাফার বিবি ভাবে, আল্লাহ বুঝি মুখ তুলে চেয়েছেন, তাই বোধহয় তিনি আমারই জন্য একে এখানে পাঠিয়েছেন। একটা বাঁদীকে ডেকে বলে, যা তো দরজার পাহারাদার আবু আলীকে একটু তোয়াজ করে বল গিয়ে যে, আমি ঐ বুড়ি মার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই! সে যেন মেহেরবানী করে তাকে ভিতরে আসতে দেয় একবার। আমি তার দেয়া নেবো।

    বাঁদীটি ছুটে আসে পাহারাদার আবু আলীর কাছে। বলে, ও আবু আলী ভাই, মালকিন খাতুন আপনাকে অনুরোধ করছেন, এই বুড়ি মাকে যদি তুমি একটিবারের জন্য ভিতরে ঢুকতে দাও। তিনি তার আশীর্বাদ নিতে চান।

    দ্বাররক্ষী আবু আলী বুড়ির কাছে গিয়ে তার হাতে চুম্বন করতে যায়। কিন্তু বুড়ি নাক সিটিকে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, আমাকে ছুয়ো না। ঠিক মতো রুজু করে নামাজ করো না তুমি। তফাৎ যাও—আল্লাহ যেন তোমাকে এই গোলামী থেকে মুক্তি দেন, এই প্রার্থনা করি। তফাৎ যাও—। তবে শোনো ও আবু আলী, তুমি আল্লাহর সুপুত্র। আজ নসীবের ফেরে তোমাকে এই খারাপ কাজ করতে হচ্ছে। তুমি সদাই তার নামগান কর। দেখবে, সব দুঃখ ঘুচে যাবে। মনে শান্তি পাবে।

    আবু আলী হাত পেতে বললো, মা জননী, আপনার ঐ পানি আমাকে একটুখানি দিন।

    বুড়িটা বদনার মুখ থেকে খেজুরের ছোবড়াগুলো টেনে বের করে। হঠাৎ ঝন ঝন আওয়াজ তুলে সেই দিনার তিনখানা নিচে পড়ে যায়। এমন একটা ভাব দেখালো সে, যেন আল্লাহর আশীর্বাদে—আসমান থেকে পড়লো।

    তাড়াতাড়ি আবু আলী দিনারগুলো কুড়িয়ে তুলে ভাবে, এ তো যে সে পীর নয়। একেবারে সাক্ষাৎ আল্লাহর দূত। কে জানে কী অলৌকিক ক্ষমতাধারিণী সে। আবু আলী দিনার তিনটে ফেরৎ দিতে যায়, এই নিন মা, আপনার হাত থেকে বোধ হয়ে পড়ে গেলো।

    —পয়সা? পয়সা কড়ি নিয়ে কী করবো। আমি? এই সব তুচ্ছ পার্থিব সম্পদে আমার কোনও প্রয়োজন নাই, বাছা! ওতে আমার মন ভরে না। আমি চাই এমন অমূল্য বস্তু, যা পয়সা কড়ি দিয়ে কেনা যায় না। তার নাম খোদাতালার মহকবৎ। ওগুলো তোমার কাছেই রেখে দাও, কাজে লাগবে।

    আবু আলী মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সব যেন কেমন গোল পাকিয়ে যায়।

    খাতুনের বাঁদী ডিলাইলাহকে পথ দেখিয়ে বাড়ির অন্দরে নিয়ে যায়। বুড়ি দেখে অবাক হয়। এমন রূপবতী নারী সে কমই দেখেছে। খাতুন সত্যিই অসামান্যা সুন্দরী।

    রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো চৌত্রিশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে :

    সুন্দরী খাতুন বুড়ির পায়ে লুটিয়ে পড়ে।

    বুড়ি বলে, আহা। ষাট বাছা, উঠে বসে। আল্লাহ আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে, আমাকে তোমার দরকার। কিছু বলবে?

    খাতুন বুড়িকে খুশি করবে কি ভাবে ভেবে পায় না। শরবৎ, ফল এনে সামনে ধরে। কিন্তু বুড়ি বলে, আমি তো কিছু খাবো না বাছা। আমার রোজা চলছে! সারা বছর ধরে চলে আমার রোজা। মাত্র পাঁচটা দিন বাদে। ও সব থাক, এখন বলে মা, কী তোমার দুঃখ। কী তুমি আমাকে বলতে চাও, নিৰ্ভয়ে বলো। আমি তার নির্দেশেই তোমার কাছে এসেছি। তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার দুঃখ মোচন করতে।

    খাতুন বলতে থাকে, শাদীর প্রথম রাতে আমি আমার স্বামীকে শপথ করিয়েছিলাম, জীবনে সে আর দ্বিতীয় বিবি ঘরে আনবে না। আজ পর্যন্ত কথার খেলাপ সে করেনি। আমরাও যথারীতি প্রতি রাত্রে সহবাস করে আসছি। কিন্তু খোদা মুখ তুলে চাইলেন না। আমাদের কোনও বাল-বাচ্চা হলো না। আমার স্বামী দারুণ দুঃখে দিন কাটাচ্ছে। অন্য পাঁচজনের ছেলেপুলে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। আজ আমাকে সাফ সে বলে দিয়েছে, অন্য একটা শাদী করবে। কিন্তু মা, আমার কী দোষ, সতীন নিয়ে ঘর করবো কী করে আমি? আমার স্বামীর ধারণা আমি বাঁজা। কিন্তু জানি আমার শরীরে কোনও খুঁত নাই। তার বীৰ্যেই কোনও তেজ নাই। কিন্তু সে-কথা মানতে চায় না। রাগে সে আমার ওপর গায়ের ঝাল ঝাড়ে। আজ বলে গেছে, ফেরার সময় সে আর একটা মেয়েকে শাদী করে নিয়ে আসবে। তার ধারণা, তার গর্ভে সে বাচ্চা পয়দা করতে পারবে। পয়সা কড়ি ধনদৌলতের কোনও কমতি নাই আমার স্বামীর। দরবার থেকে মোটা মাইনে পায়। অনেক জমি জিরেৎ বাড়ি ঘর আছে। এখন অন্য মেয়ে ঘরে আসলে সে-ই তার মালকিন হয়ে বসবে। আমার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবো আমি। আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন মা। একটা উপায় বাৎলে দিন।

    বুড়ি অভয় দিয়ে বলে, তুমি মনে কোনও ভয় রেখা না, মা। আমি কে, এবং কী আমার ক্ষমতা কিছুই তোমার জানা নাই। তবে এটা জেনে রাখ, আমি স্বয়ং আল্লার দূত। তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার কাছে। তোমার যাতে কোনও দুঃখ কষ্ট না থাকে তারই ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছেন তিনি। তুমি কিছু ভোবে না, মা। আমি সব সমস্যার সুরাহা করে দেব। শুধু যা বলবো, সেই মতো তোমাকে চলতে হবে!

    খাতুন বলে, আপনি যা বলবেন, মা, আমি তাই করবো। বলুন কী করতে হবে?

    –এই শহরে এক পীরের দরগা আছে। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। সেখানে। তোমার মনের যা কামনা বাসনা, সেখানে জানাবে তুমি। মানত করবে। তা হলেই তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হবে, মা। ঐ দরগার এমন মাহাত্ম্য সেখানে যে যা মানত করে তাই সে পায়। কত দীন ভিখারী ঐ পীরের দরগায় সিন্নি দিয়ে বিরাট বড়লোক হয়েছে, কতো বন্ধ্যা নারী সন্তানবতী হয়েছে তার সীমা সংখ্যা নাই। তুমি চলো, তোমার মনের বাঞ্ছা পূরণ হবে।

    খাতুন বলে। কিন্তু মা, সেই যে শাদীর দিন আমি এ বাড়ির অন্দরে ঢুকেছি, আজ পর্যন্ত কোনও কারণেই বাইরে বেরোই নি। এ বাড়ির পর্দা বহুৎ কড়া। মেয়েদের বাইরে যাওয়ার কোনও নিয়ম নাই। তা সে উৎসব আনন্দের আমন্ত্রণই হোক, কিংবা শোক তাপের সঙ্গ দানের কর্তব্যই থাক, কোনও কারণেই বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি মেলে না। আমার।

    বুড়ি ডিলাইলাহ বলে, কিন্তু এ ব্যাপারে তোমাকে একটি বারের জন্য সেখানে যেতেই হবে মা। পীর তো তোমার কাছে আসবে না, দরকার হলে তোমাকেই যেতে হবে সেখানে। তোমার কোনও চিন্তা নাই, বাছা। শুধু একবার সেখানে যাবো। আর ফিরে আসৰাে। কতটুকুই বা সময় লাগবে। তোমার স্বামী ঘরে ফেরার অনেক আগে তুমি ফিরে আসবে। কেউ জানতে পারবে না। আর এ-সব কাজ বাড়ির মরদ মানুষদের জানিয়ে কখনও করতে নাই। তাতে কোনও সুফল হয় না। আমি তোমাকে পীরের সামনে হাজির করবো। তিনি তোমাকে একবার শুধু দেখবেন। তারপর তোমার মনের বাসনা জানাবে তাকে। ব্যস, আর কোনও ব্যাপার নাই। তিনি তোমাকে দোয়া করবেন। তারপর ঘরে ফিরে এসে আজ রাতেই শুদ্ধ মনে স্বামীর সঙ্গে সহবাস করো। দেখবে যথাসময়ে পুত্র সন্তান লাভ করবে। সহবাসের সময় মনে মনে যা কল্পনা করবে, সেই রকম সন্তানই পাবে তুমি। যদি ছেলে চাও, ছেলেই পাবে। যদি মেয়ে কামনা কর, মেয়েই হবে। মোটকথা, মিলনের সময়, তোমার কোলে যে আসবে সেই শিশুর আদলটি মনের মধ্যে ছবির মতো করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করো। দেখবে অবিকল সেই রকম খুবসুরৎ হবে সে। খাতুনের মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে। তাড়াতাড়ি সে বাক্স প্যাটরা খুলে সবচেয়ে সুন্দর সাজপোশাক এবং দামী-দামী রত্নালঙ্কার বের করে নিজেকে পরিপাটি করে সাজায়। বাঁদীিকে ডেকে বলে, আমি একটু পরে আসছি। বাড়িটা খালি রইলো, নজর রাখিস।

    সদর দরজার পাহারাদার আবু আলী প্রশ্ন করলো, আপনি কোথায় যাবেন, মালকিন?

    খাতুন বলে, এক ধন্বন্তরী পীরের দরগায়। এই মা আমাকে মেহেরবানী করে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কাছে গেলে বন্ধ্যা মেয়েরা পুত্রবতী হয়।

    আবু আলী বলে, আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে নিৰ্ভয়ে যান মালকিন। ইনি মানুষের রূপ ধরে নেমে এসেছেন। আসলে ইনি সাক্ষাৎ আল্লাহর দূত। আপনার সব মনোবাঞ্ছা পূরণ করে দিতে পারেন ইনি। এই দেখুন, উনি আমার ওপর খুশি হয়ে এই তিনটে দিনার দিয়েছেন আমাকে। এ আমি মাথায় করে রাখবো। উনি আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছেন আমার সব দুঃখ ঘুচে যাবে।

    দুজনে রাস্তায় নেমে চলতে থাকে, চলতে চলতেই কথা হয়। বুড়ি বলে, পীর-এর এমনই মহিমা সেখানে গেলে যে তুমি শুধু সন্তানবতী হবে তাই নয়, তোমার সঙ্গে তোমার স্বামীর আর কোনও ঝগড়া বিবাদ হবে না। কখনও। তার বদলে সে তোমাকে মাথায় করে রাখবে। ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে।

    খাতুন বলে, তার চরণে মাথা রাখার জন্যে প্ৰাণ আমার আকুল হয়ে উঠেছে, মা। আর কতদূর যেতে হবে, একটু পা চালিয়ে চলুন।

    সচলতে চলতে ধূর্ত বুড়িটা ফন্দী আঁটতে থাকে, পথে তো বের করে এনেছি। এবার ওর গহনাপত্র কী করে হাতানো যাবে! চারপাশে এতো লোকজন; জোর জবরদস্তি করে ছিনতাই করা সম্ভব হবে না। অন্য পথ দেখতে হবে।

    ডিলাইলাহ এবার ফিস ফিস করে খাতুনকে বলে, তুমি আমার অনেকটা পিছনে পিছনে থাক। কারণ লোকে দেখলে নানারকম সন্দেহ করতে পারে।

    খাতুনের মনে তখন একই চিন্তা। কখন সে পীরের দরগায় পৌঁছবে। কখন জানাবে তার বাসনা। সে বললো, ঠিক আছে মা, আমি দূরে দুরেই থাকছি।

    একটু পরে তারা বড়বাজারে এসে পৌঁছয়। বাজারের বিখ্যাত তরুণ সওদাগর সিদি মুসিন-এর দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বুড়ির কানে আসে, সওদাগর সিদি মুসিন খাতুনের রূপে মুগ্ধ হয়ে আপন মনেই তারিফ করছে, ইয়া আল্লাহ, এ যে বেহেস্তের ডানাকাটা হুরী!

    বুড়ী খাতুনকে বলে, বাছা তুমি এখানে একটু দাঁড়াও তো। এই দোকানী আমার এক শিষ্য, ওর সঙ্গে দুএকটা কথা বলে আসি।

    বুড়ি এসে সিদি মুসিনের দোকানে ঢোকে। খাতুন দূরে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। বুড়ি জিজ্ঞেস করে, বাছা, তুমি তো সওদাগর সিদি মুসিন?

    যুবক সসম্রামে বুড়িকে স্বাগত জানায়, জী হাঁ। আপনি আমাকে জানলেন কী করে?

    রাত্রির শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো পয়ত্রিশতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

    এক সদাশয় সওদাগরই তোমার কাছে পাঠিয়েছে আমাকে। ঐ যে মেয়েটিকে দেখছো, ও আমার কন্যা। ওর বাবা এককালে শহরের এক নামজাদ সওদাগর ছিলো। কিন্তু সে আজ নাই। মারার আগে বিষয়-আশয় যথেষ্টই রেখে গিয়েছে। আমি দেখতে পোচ্ছ, সংসারের মায়া কাটিয়ে অনেক ওপরে চলে গেছি। এখন ঐ মেয়েই হয়েছে আমার পথের একমাত্র বাধা। নিশ্চিন্ত মনে প্ৰাণ-ভারে আল্লাহর সাধন ভজন করবো, তাও পারছি না। এখন তার শাদীর বয়স হয়েছে, ভাবছি তোমার মতো কোনও সুপোত্রর হাতে যদি ওকে সঁপে দিতে পারি, তবে আমি নিশ্চিন্ত হই। আল্লাহর দরবারে আমি আমার আর্জি জানিয়েছিলাম। তিনি আমাকে নির্দেশ করলেন, তোমার কাছে আসতে। এখন দেখ, তোমার যদি পছন্দ হয় মেয়েটিকে, আমি এই দায় থেকে রেহাই পাই। অন্য কোনও ব্যাপারে চিন্তা করো না বাবা। টাকা পয়সার আমার কোন অভাব নাই। আমি আল্লাহর পায়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছি। অর্থে আমার কোনও প্রয়োজন নাই। ওকে শাদী করলে, আমার যা সম্পত্তি ধনদৌলত আছে সবই পাবে তুমি। সে টাকায় এই বাজারে আরও দু’খানা দোকান কিনে দিব্যি সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে। সাধারণ মানুষের কী কাম্য বাবা? পয়সা, আরাম এবং নারী। ওকে শাদী করলে সবই পাবে তুমি।

    সিদি মুসিন বলে, মা আপনার প্রথম দু’টো কথা বড় চমৎকার। পয়সা এবং আরাম। এ আমি সত্যিই চাই। এবং পেয়েছিও। কিন্তু নারী সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নাই। আমার মা, এখন তিনি বেঁচে নেই, বলেছিলেন, বাবা বিয়ে করে সংসারী হও। জীবনে সুখ পাবে। আমার তখন পয়সা বানাবার নেশা। মাকে বলেছিলাম, এখন না। মা, আগে পয়সা রোজগার করতে দাও, তারপর ওসব ভাববো। আজ আমার পয়সা যথেষ্টই হয়েছে। কিন্তু মায়ের সাধ আমি পূরণ করতে পারিনি।

    ধূর্ত বুড়ি বলে, তা হলে আর দেরি করে কী লাভ। বাছা। আমাদের সঙ্গে চলো, আমার মেয়েকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দেখে নাও, তার শরীরে কোনও খাদখুত কিছু আছে কিনা। হ্যাঁ বাবা, একটা কথা, পথে চলার সময় একটু দূরে দূরে চলবে। লোকে যাতে বুঝতে না পারে, তুমি আমাদেরই সঙ্গে যাচ্ছে।

    তরুণ সওদাগর সিদি মুসিনের চোখে রঙ লাগে। মনের মধ্যে বহুদিনের সুপ্ত কামনার দীপশিখা দপ করে জ্বলে ওঠে। তাড়াতাড়ি সে একহাজার দিনারের একটা বটুয়া জেবে পুরে উঠে দাঁড়ায়। নিজের মনেই বলে : মানুষের ভাগ্য কখন যে কী ভাবে খুলে যায় কেউ বলতে পারে না।

    সওদাগর রাস্তায় নেমে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে শয়তান বুড়িটার পিছনে পিছনে চলতে থাকে। ডিলাইলাহ ভাবতে থাকে, এখন কী ভাবে জাল গুটিয়ে ওপরে ওঠান যাবে।

    যেতে যেতে সে রঙের কারবারী হজ মহম্মদের দোকানের সামনে এসে পড়ে। এই হজ মহম্মদ লোকটা ভীষণ বদ। মেয়েছেলে দেখলে তার জিভে জল আসে। তা সে স্টুডিই হোক আর বুড়িই হোক।

    খাতুনকে দেখে লোকটার চোখের তারা নেচে ওঠে। খাসা মাল! ধূর্ত বুড়ি ডিলাইলাহর কিছুই চোখ এড়ায় না। ভাবে, এখানেই কাজ হাসিল হবে। ওদের দু’জনকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সোজা সে দোকানের ভিতরে ঢুকে যায়।

    –আপনার নাম হজ, মহম্মদ?

    –জী হাঁ। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।

    বুড়ি বলে, পারবেন না, বাবা। আমরা এ শহরের বাইরে থাকি। বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে আসছি। ওই যে বাইরে ওদের দেখছেন, ওরা আমার ছেলে আর মেয়ে। এই শহরের বাইরে আমার একখানাবাড়ি আছে। বাড়িখানা আদ্যিকালের। আমার ঠাকুর্দার বাবার আমলের। একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থা। সব সময় ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। কখন বুঝি বা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। পাড়া-পড়াশীরা পরামর্শ দেন, এভাবে ও-বাড়িতে থাকা আর ঠিক না। ভালো করে মেরামত না করে ওখানে বাস করতে থাকলে কবে আত্মঘাতী হতে হবে। আমিও ভাবলাম, কথাটা ঠিক। তাই মিস্ত্রী লাগিয়েছি-বাড়িটাকে ঠিকঠাক করার জন্য। কিন্তু মুসকিলে পড়েছি। এই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। এখন উঠি কোথায়? শহরের এতোটা পথ এলাম, কোথাও কোনও খালি ডেরা নাই। তবে লোকে আপনার নাম করে বললো, আপনার কাছে গেলে আপনি একটা ব্যবস্থা করে দেবেনই।

    হজ মহম্মদ হাসে। সে হাসি শয়তানের। বলে, লোকে আমাকে জানে তো, আমার দয়ার শরীর। কারো দুঃখ কষ্ট আমি দেখতে পারি না চোখ মেলে। কেউ কোনও বিপদে পড়ে আমার সামনে এসে একবার হাজির হলে আমি তাকে তাড়িয়ে দিতে পারি না। আমার যত অসুবিধাই হোক একটা কিছু ব্যবস্থা আমাকে করে দিতেই হয়। ঐ যে বললাম, দয়ার শরীর, কারো দুঃখ কষ্ট চোখ মেলে দেখতে পারি না। কিন্তু মা, আমি আপনাদের রাখবো কোথায়? এই আমার দোকান আর ওপরে আমার একটাই শোবার ঘর। তা আমি না হয় দোকানেই শোবো। কিন্তু একটা অসুবিধে দাঁড়াচ্ছে, গ্রাম থেকে চাষীরা আসে আমার কাছে নীল বিক্ৰী করতে। ওদের দিয়েই আমার এই রঙের কারবারটা চলে। সুতরাং তাদের একটু আদর যত্ন করতেই হয়। তাই মাঝে-মধ্যে ওরা যখন এসে আটকে যায় আমার ঐ ঘরেই রাত কাটায়। সে-ঘর, যদি আপনাদের ছেড়ে দিই, তা হলে আমার চাষী-ভাইরা থাকবে কোথায়?

    বুড়ি বলে, মামলা তো মাসখানেকের। তার মধ্যে বাড়ির মেরামতীর কাজ শেষ হয়ে যাবে। এই একটা মাসের জন্য ওপরের ঘরখানা যদি দু’টো ভাগ করে একদিকে আমাদের থাকতে দেন, বড় উপকার হয়।

    হজ মহম্মদ এই তালই ভাঁজছিলো।

    —তা কথাটা মন্দ বলেন নি, মা। ঘরটার মাঝখান দিয়ে যদি একটা দরমার বেড়া দিয়ে আড়াল করে দেওয়া যায়, তা হলে দুদিকই রক্ষণ হয়। ঠিক আছে, আপনি কোনও চিন্তা করবেন। না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

    বুড়ি বললো, আপনার চাষী-ভাইরা আপনার যেমন মেহেমান, আমাদেরও তারা মেহেমান হয়ে যাবেন! কোনও সংকোচ করার কিছু নাই। আমরা সবাই মিলে-মিশে থাকতে পারবো। এক সঙ্গে খানাপিনা করতে পারবো, কোনও অসুবিধা হবে না।

    হজ মহম্মদ দেরাজ থেকে তিনটি চাবির একটা গোছা বুড়ির হাতে দিয়ে বললো, এই সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে যান। এই চাবিটা দিয়ে সামনের দরজা খুলবেন। তারপরে এই চাবিটায় খোলা যাবে বসবার ছোট্ট বৈঠকখানাটা। আর এটা দিয়ে খুলবেন শোবার ঘরখানা।

    বুড়ি চাবিগুলো নিয়ে খাতুন আর সওদাগরকে সঙ্গে করে ওপরে উঠে যায়।

    রাত্রির অন্ধকার হালকা হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো ছত্রিশতম রজনী। আবার সে বলতে শুরু করে :

    সামনের দরজা খুলে খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িটা ভিতরে ঢুকে যায়। সওদাগরকে চোখের ইশারায় বাইরেই অপেক্ষা করতে বলে। শোবার ঘরে ঢুকে বুড়ি বলে, বেটা, এইখানে তুমি বসে। একটু পরে পীরসাহেব। আসবেন। তিনি এই বাড়িরই নিচতলায় এখন নামাজ করছেন। কোনও লজ্জা সংকোচ করার ব্যাপার নাই, মা। খোদ আল্লাহর দরবারে এসে গেছ তুমি। বোরখাটা খুলে আরাম করে বসো এখানে। আমি এখুনি আসছি।

    বুড়িটা আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। বাইরে বেরিয়ে গেলো।

    সওদাগর বাইরে দাঁড়িয়েছিলো। তাকে সঙ্গে করে পাশের ছোট্ট খুপরী মতো বসার ঘরটায় নিয়ে গিয়ে বললো, এইখানে তুমি আরাম করে বসো, বাবা। আমি আমার মেয়েকে একটু বাদেই তোমার কাছে নিয়ে আসছি। নিজের চোখে তাকে বাজিয়ে দেখে নিও।

    এরপর সে খাতুনের কাছে ছুটে আসে।

    —পীরসাহেব এসে গেছেন, মা। এবার আমরা তার দর্শন পাবো।

    খাতুন আনন্দে দিশাহারা হয়ে পড়ে, আমার কী সৌভাগ্য, মা।

    বুড়ি বলে, কিন্তু মা পীর সাহেব এসব জাকজমক আড়ম্বর দুচক্ষে দেখতে পারেন না। সাজগোড়, রত্ন অলঙ্কার, এসবই তার চোখের বিষ। এসব পরে তো তার দর্শন পাওয়া যাবে। না। তার সামনে যেতে গেলে পার্থিব সব সম্পদ ত্যাগ করে যেতে হবে। তোমার কোনও লজ্জা করার কারণ নাই। তিনি কোনও মানুষ নন, তার কাছে লজ্জা কীসের? এক কাজ কর মা, তোমার সাজ-পোশাক গহনাপত্র সব খুলে এখানে রেখে তার কাছে যাও। আমি আছি, আমি তোমার জিনিসপত্র সব দেখবো।

    খাতুন-এর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় জাগলো না। তৎক্ষণাৎ সে একটি মাত্র রেশমী শেমিজ ছাড়া সব সাজ-পোশাক এবং গহনাপত্র পরিত্যাগ করে একেবারে প্রায় নগ্ন হয়ে দাঁড়ালো।

    খাতুনের পরিত্যক্ত সাজ-পোশাক আর গহনাপত্র একটা পুঁটুলি করে বেঁধে। ডিলাইলাহ বলে, আমি এ-গুলো পীরের পায়ে ঠেকিয়ে এনে এখানে রেখে দিচ্ছি। তার ছোঁয়া পেলে পবিত্র হবে।

    ডিলাইলাহ পুঁটুলিটা সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ির এক জায়গায় গুঁজে রেখে সে সওদাগরের কাছে যায়। ছোট্ট একটা থুপরীতে বসে বসে তরুণ। সওদাগর ঘামছিলো। ধৈর্য আর কিছুতেই বাঁধ মানছিলো না। বুড়িকে একা দেখে সে জিজ্ঞেস করে, কী হলো, মা? এতো দেরি হচ্ছে কেন?

    –আর বলো না, বাছা আমার নসীবের দোষ।

    বুড়ি কপাল চাড়পাতে থাকে। সওদাগর বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকায়–কেন, কী হয়েছে?

    আর কী হয়েছে? তোমাকে বলেছিলাম না, একটু তফাৎ রেখে চলতে। কিন্তু তুমি বোধ হয় তা পারনি। কিছু লোকের সন্দেহ হয়েছে। একটু আগে তারা এসে আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেলো। তুমি কে, তোমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক এই সব প্রশ্ন। আমার মেয়ে সোজাসুজিই তাদের বলেছে : ছেলেটির সঙ্গে আমার শাদী হবে। আমার মা তাকে পছন্দ করেছেন। আমার পছন্দ অপছন্দের কোন প্রশ্নই ওঠে না।

    তারা বললো, ঠিক আছে, শাদী হবে উত্তম কথা। কিন্তু সওদাগর ছেলেটার শরীরে যে কুণ্ঠ আছে—সে কথা কী সে কবুল করেছে?

    সত্যি কথা বলতে কি বাছা, এই কথা শুনে মেয়ে আমার কেঁদে আকুল। আমি তাকে ভরসা। দিয়েছি, তোমার কোনও ভয় নাই। তুমি যেমন তার কাছে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে, সেও তেমনি সব সাজপোশাক খুলে তোমার সামনে দাঁড়াবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার সর্বাঙ্গ তুমি পরীক্ষা করে। নেবে। যদি কোনও অসুখের দাগ দেখতে পাও, আমিই রাজি হবো না। কী বলো বাবা, খারাপ বলেছি?

    সওদাগর তাজ্জব বনে যায়। এমন ডাহা মিথ্যে কথা কে বলে গেলো? আল্লা সাক্ষী মা, আমার দেহে কোনও রোগ নাই। আমি সব সাজপোশাক খুলে ন্যাংটা হয়ে দেখাচ্ছি, আপনারা দেখুন।

    সিদি মুসিন উত্তেজিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াল। বুড়ি বলে, ঠিক আছে, আমি তোমাকে মেয়ের ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, সে-ই নিজের চোখে পরীক্ষা করে দেখুক। হ্যাঁ বাবা, তোমার এই সাজপোশাক পয়সা কড়ি এখানে রেখে যাওয়া তো ঠিক হবে না। এগুলো আমি ভালো জায়গায় রেখে আসি। তুমি এখানে বসে। আমি এখুনি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।

    ধূর্ত ডিলাইলাহ সওদাগরের সাজপোশাক এবং টাকার থলেটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সে খাতুনের সাজপোশাক এবং গহনার পুঁটুলিটাও সঙ্গে নিতে ভোলে না। রাস্তায় নেমে সে অদূরে অবস্থিত একটা মশলাপতির দোকানে ঢুকে বলে, দোকানী আমার এই পুঁটুলি দুটো একটু রাখতো ভাই, আমি একটা গাধা ডেকে আনি।

    তারপর বুড়িটা হন হন করে চলে আসে হজ মহম্মদের দোকানে। হজ মহম্মদ বুড়িকে দেখে বলে, কী গো বুড়িমা, ঘর পছন্দ হয়েছে?

    -খুব হয়েছে, বাবা চমৎকার ঘর আপনার। কী বলে যে আশীর্বাদ করবো। আমি যেমনটি আশা করেছিলাম, আপনার ঘরখানা তার চেয়ে ঢের ভালো, বাবা। এখন দেখি যাই একটা কুলিটুলি পাওয়া যায়। কিনা। সামান পত্রগুলো তো আনতে হবে এখানে। আমারবাড়ি থেকে ফিরে আসতে তো খানিকটা সময় লাগবে, বাবা। সেইজন্যে বলছি, এই দিনার কাটা রাখুন, কিছু রুটি গোস্ত এনে ওদেরও খেতে দিন, আপনিও খান। আমি যাবো। আর আসবে।

    হজ মহম্মদ বলে, তা তো বুঝলাম, কিন্তু দোকানে তো অন্য কোনও লোক নাই মা, দোকান ফেলে। আমি যাবো কী করে?

    বুড়ি বলে, এখনকার দোকান-পাট তো আমার চেনা নাই, বাবা। তা হলে আমিই এনে দিয়ে যেতাম। আচ্ছা, আমি আপনার দোকান পাহারা দিচ্ছি, আপনি যান, খাবারটা নিয়ে আসুন। কতক্ষণ লাগবে?

    হজ-মহম্মদ বলে একটু ভালো খাবারের দোকান খানিকটা দূরে। তবে বেশি দেরি হবে না, আপনি এখানে বসুন, আমি তাড়াতাড়িই ফিরবো।

    হজ মহম্মদ আর অপেক্ষা করে না, বুড়িকে বসিয়ে, একখানা রেকবী এবং একটা বাটি সঙ্গে নিয়ে সে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে যায়। বুড়িটাও ছুটে যায়। মশলাপতির দোকানটায়। পুটুলি দু’টো নিয়ে আবার ফিরে আসে। হজের দোকানে। দোকানের যা কিছু দামী দামী জিনিসপত্র দেখতে পেলো, একটা বস্তায় চটপট ভরে নিলো সে।

    এই সময় একটা ছেলে একটা ভাড়াটে গাধা নিয়ে ভাড়ার সন্ধান করতে করতে সেই দোকানের সামনে এসে পড়ে। বুড়ি জিজ্ঞেস করে, ভাড়া যাবে?

    ছেলেটি বলে, যাবো না কেন? ভাড়া যাওয়াই তো আমার কাজ। কী সামান যাবে?

    ছেলেটির কথায় জড়তা। বুড়ি বুঝলো চরস খেয়ে ছোকরাটা বুদ হয়ে আছে। যাক ভালোই হলো।

    –তুমি আমার ছেলেকে জান? এই দোকানের মালিক হজ মহম্মদকে চেন?

    ছেলেটি বলে, কী যে বলেন, বুড়িমা, খুব আচ্ছা তারা জানি। আমার চাইতে তাকে আর ভালো করে কেউ জানে না। কিন্তু ব্যাপার কী? কী হয়েছে। দোকানের সামানপত্র এমন লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছেন কেন?

    রাত্রি শেষ হয়ে যায়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো সাঁইত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    দুঃখের কথা আর বলে না, ছেলে। আমার বেটার কারবার ডাকে উঠেছে। দেনার দায়ে সে আজ দেউলিয়া। পাওনাদাররা শুনবে কেন, কাজীর কাছে মামলা দায়ের করে দিয়েছে। কাজী আমার ছেলেকে কয়েদ করেছে। দোকানের সামানপত্র ক্রোক করার পরোয়ানা আসবে এখুনি। তার আগে যতটা পারি জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলি। কিন্তু এতোসব বড় বড় রঙের জালাগুলো তো আর সাড়ানো যাবে না। আমার বাছার এমন সাধের দোকান কাজীর পেয়াদা এসে লুঠ করে নিয়ে যাবে, তা আমি কিছুতেই হতে দেব না।

    ছেলেটা বোকার মতো তাকায়, তা হলে কী করে এই সব পোল্লাই পোল্লাই রঙের জালাগুলো সরাবে?

    –সরাতে পারবো না। তবে ভেঙ্গে গুড়িয়ে নষ্ট তো করে দেওয়া যায়?

    ছেলেটি বুড়ির বুদ্ধির তারিফ করে ভারিকি চালে ঘাড় নাড়ে। হুঁ, তা অবশ্য যায়।

    বুড়ি বলে, কিন্তু ছেলে, আমার গায়ে তো বেশি জোর নাই। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে?

    –কী করতে হবে বলুন?

    –এই ডাণ্ডা দিয়ে জালাগুলো সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দাও। আমি ততক্ষণে এই বস্তাটা তোমার গাধার পিঠে চাপিয়ে অন্য জায়গায় রেখে আসি। কিছু ভেবো না; তোমার যা ভাড়া—তার অনেক বেশিই দেবো। নাও, এই বস্তাটা তোমার গাধার পিঠে বেঁধে দাও।

    ছেলেটি বুড়িকে বিদায় করে ডাণ্ডা দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে মাটির জালাগুলো গুড়ো করে। দেয়। সারা ঘর নীলের গোলায় কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে। এমন সময় হজ মহম্মদ দূর থেকে দেখতে পেয়ে হস্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে ছেলেটার হাতের ডাণ্ডা চেপে ধরে বলে, এ্যাই, এসব কী হচ্ছে?

    ছেলেটি হজ মহম্মদকে চেনে। দাঁত বের করে খিকখিক করে হাসতে হাসতে সে বলে, এবার আসুক না ব্যাটারা, ঘণ্টা পাবে। আমি সব খতম করে দিয়েছি—

    হজ মহম্মদ কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। তার সারা জীবনের সাধনা এই রঙের দোকান, আজ কয়েক পলকের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো কী করে!

    —এ্যাই ব্যাটা উলুবাঁদর বদমাইশ কাঁহাকা, এ তুই কী করেছিস। আমার যে সব শেষ হয়ে গেলো!

    ছেলেটা অবাক হয়ে তাকায়। হজ মহম্মদকে কখনও চোখের জল ফেলতে দেখেনি সে। আজ সে কাদছে।

    –কিন্তু আমার কী দোষ; শেখসাহেব। আপনার মা-ই তো আমায় সব ভাঙ্গতে বলে গেলেন।

    -আমার মা? আমার মা তো অনেকদিন গত হয়েছে।

    ছেলেটি আরও অবাক হয়, তবে যে এক বুড়িমাকে দেখলাম। এই দোকানের জিনিসপত্র বস্তায় ভরছিলো? সে তবে কে? সেই তো আমাকে বলে গেলো, তার ছেলে—মানে আপনাকে কাজী নাকি কয়েদ করেছে। দেনার দায়ে আপনার দোকান আজ ক্রোক করতে আসবে তার পেয়াদা। তাই তো বুড়িমা আমাকে বললো, যতটা পারি বাঁচাই, বাকীটা তুই ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে রাখ-যাতে কাজীর পেয়াদা এসে কিছু না নিয়ে যেতে পারে। সবুর করুন শেখসাহেব, সামানপত্র সামলে রেখে এখুনি ফিরে আসবে বুড়িমা। এসে আমার গাধা। আর ভাড়া মিটিয়ে দেবে।

    —তোর মুণ্ডু দেবে। যাকে আমি দোকানে বসিয়ে গিয়েছিলাম। সে আমার মা হতে যাবে কেন? তাকে তো আমি আমার ওপরের ঘরখানা ভাড়া দিয়েছি আজি!

    –আপনি তাকে আগে থেকে চিনতেন?

    –না না, চিনবো কি করে। সবে আজ সকালেই তো সে এসেছে আমার কাছে। তার ছেলে আর মেয়েকে সঙ্গে করে। আমি তো তাদেরই জন্য খাবার কিনতে গিয়েছিলাম। হায় আল্লাহ এ কী সর্বনাশ হলো আমার। এখন আমার দিন চলবে কী করে? ও বাবা গো, মা গো, আমি এখন কী করবো?

    হজ মহম্মদের চেঁচামেচি চিৎকারে পথচারী দোকানদার প্রতিবেশী সবই এসে ভীড় করে। সকলের মুখে একই জিজ্ঞাসা—কী ব্যাপার, কী হয়েছে?

    হজ মহম্মদ বলে, আমার নতুন ভাড়াটের ছেলেমেয়েদের জন্য আমি খানা কিনতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি আমার দোকানের এই হাল করেছে এই ছেলেটা। রঙের সব জালাগুলোকে দেখুন, ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আমার এতো সাধের আলমারী। টেবিল তাক সব টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। এখন আমি কী করবো।

    একজন প্রশ্ন করে, দোকানে কাকে বসিয়ে গিয়েছিলেন? সে কোথায়?

    –সে-ই তো আমার নতুন ভাড়াটে-এক বুড়ি।

    –সে কী আপনার চেনা-জানা?

    হজ মহম্মদ বলে, আজ সকালের আগে কখনও দেখিনি আমি।

    একজন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, একবেলার পরিচয়, তার হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে বাইরে গেলেন, আপনি?

    সে যে আমার ভাড়াটে হয়েছে। ওপরে তার ছেলেমেয়ে রয়েছে এখনও। আমি তাদের জন্যই খাবার আনতে গিয়েছিলাম।

    হজ মহম্মদ কপাল বুক চাপড়াতে থাকলো।

    ছেলেটাও এতক্ষণে বুঝতে পারে, গাধাটাও আর ফেরত পাওয়ার আশা নাই। সেও হা-হুতাশ করে কপাল চাপড়াতে থাকে। আমার গাধা-আমার গাধা পাবো কোথায় গো? ছেলেটা হজ মহম্মদকে পাকড়াও করে, আমি ওসব কিছু শুনতে চাই না। আপনার দোকানের লোক আমার গাধা নিয়ে পালিয়েছে। এজন্যে আপনিই একমাত্র দায়ী। আমার গাধাটা ফেরত দিন।

    হজ মহম্মদও রুখে আসে, তবে রে হতচ্ছাড়া, আমার সর্বনাশ করে, আবার বলে। কিনা গাধা ফেরত দাও।

    তৎক্ষণাৎ দুইজনের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারি শুরু হয়ে যায়। হজ বলে কেন আমার দোকানটার সর্বনাশ করলি-তোকে আমি ফাটকে দেবো। আর ছেলেটা বলে, ওসব বুজরুকী ছাড়ো, আমার গাধা ফেরত দাও, না হলে তোমাকে আমি কাজীর কাছে নিয়ে যাবো।

    উপস্থিত জনতা ওদের মারামারি দেখে মজা অনুভব করতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন বলে, হজ মহম্মদ, বুড়িটা যখন তোমার ভাড়াটে, আর সে যখন ছেলেটার গাধাটা নিয়ে পালিয়েছে, আমার মতে গাধাটা অথবা একটা গাধার খেসারত তোমাকেই দিতে হয়।

    কিন্তু কে শোনে কার কথা, তখন হজ মহম্মদ আর ছেলেটার মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়ে গেছে।

    রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }