Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩.০১.২ সওদাগর সিদি মুসিন আর খাতুনের কথা

    সওদাগর সিদি মুসিন আর খাতুনের কথা

    চারশো আটত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে : এবার শুনুন, সওদাগর সিদি মুসিন আর খাতুনের কথা : সিদি মুসিন সাজ-পোশাক খুলে দিয়ে একেবারে দিগম্বর হয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকে সেই ছোট্ট খুপরীটাতে। বুড়ি তাকে বলে যায়, এখুনি সে এসে তার মেয়ের ঘরে নিয়ে যাবে তাকে। কিন্তু তিলে তিলে অনেক সময় কেটে যায়। বুড়ি ফিরে না। সিদি মুসিন অধৈর্য হয়ে বৈঠকখানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।

    এদিকে খাতুনের অবস্থাও তাই। বুড়িটা তাকেও ধোঁকা দিয়ে, সাজ-পোশাক গহনাপত্র নিয়ে, প্রায় বিবস্ত্ৰা করে, বসিয়ে রেখে সেই যে বেরিয়ে গেলো আর ফিরলো না। খাতুন ভাবে নিচে থেকে ফিরে আসতে এতো দেরি হওয়ার কারণ কী? অধৈর্য হয়ে সেও ঘর থেকে উইিকেত বাইরে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা কৰ্কশ আওয়াজ শুনে সে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়। কিন্তু চোখ আর খুলে রাখতে পারে না। সেই নওজোয়ান সওদাগর একেবারে বিবস্ত্র —উলঙ্গ।

    সিদি বেশ তেজের সঙ্গেই কৈফিয়ৎ চায়, তোমার মা কোথায়? এক্ষুণি, ডাকো তাকে। আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করবো না। এখুনি শাদীর ব্যবস্থা করতে হবে।

    খাতুন অবাক হয়ে বলে, আমার মা? সে তো কতকাল আগে মারা গেছে। তুমি কী সেই পীরের সাগরেদ নাকি?

    সিদি আবার ভেঙ্গে পড়ে, এ তুমি কী বলছো, মণি, তোমার জন্যে আমি পাগল হয়ে উঠেছি। তোমার মা আমাকে কথা দিয়েছে, আজই এক্ষুনি তোমার সঙ্গে শাদী করিয়ে দেবে আমার।

    খাতুন-এর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। মাথাটা বোঁ বৌ করে ঘুরে ওঠে। তবে কি বুড়িমা-আর সে ভাবতে পারে না কিছু।

    সিদি মুসিনও বুঝতে পারে, ব্যাপারটা বড় সুবিধের না। এখন এই অবস্থায় সে কী করবে, কী করা উচিত কিছুই ঠাওর করতে পারে না।

    খাতুনও আতঙ্কিত হয়ে নির্বোধের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটে যায়। ভাবখানা এই-যেন সিঁড়ি দিয়ে নামলেই বুড়িটার সঙ্গে দেখা হবে। সিদিও তার পিছনে পিছনে নামতে থাকে।

    এই সময় হজ মহম্মদ আর ছেলেটার কাজিয়া তুঙ্গে উঠেছে। ওপরে উঠে আসার জন্যে তারা সিঁড়ির কাছে ছুটে আসে। পিছনে বিরাট জনতা। সিঁড়িতে পা দিয়েই মহম্মদ দেখে, মেয়েটি আর ছেলেটি দুজনেই উলঙ্গ। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। হজ মহম্মদ আর তার পিছনে একরাশ জনতাকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ে, খাতুন। শেমিজটাকে প্রাণপণে টেনে হাঁটুর কাছে নামাতে চায়। আর সিদি মুসিন— সে বেচারা দু’হাত দিয়ে ঢেকে কোনও রকমে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ প্রয়াস করতে থাকে।

    হজ মহম্মদ গর্জে ওঠে, এই খানকির বেটি খানকি, তোর মা মাগী কোথায় আগে বলে?

    খাতুন হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠে, আমার মা তো বহুদিন আগে মারা গেছে! আমাকে যিনি সঙ্গে করে এনেছেন তিনি তো এখানকার পীরের শিষ্যা।

    তার এই কথা শুনে হজ মহম্মদ তার দোকানের শোক ভুলে গেলো, ছেলেটা তার হারানো গাধার দুঃখও ভুলে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো পিছনের জনতাও। কারুরই আর বুঝতে বাকী রইলো না তারা সবাই ঐ ধূর্ত ঠগ বুড়িটার শিকার হয়েছে।

    হজ মহম্মদ, ছেলেটা আর সওদাগর সিদি মুসিন তিনজনে ঠিক করলো, শয়তান বুড়িটাকে শায়েস্তা করতেই হবে। কিন্তু তার আগে এই অসহায় মেয়েটার লজ্জা নিবারণের একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

    কিছুক্ষণের মধ্যে একটা পোশাক এনে পরতে দেওয়া হলো খাতুনকে। খাতুন তখন লজ্জা ভয় শঙ্কায় দিশাহারা। কোনও রকমে পোশাকটা পরে দ্রুত পায়ে সে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

    বলো। তার চাইতে কোতোয়ালের কাছে চলো, নালিশ করে আসি।

    সওদাগরের দিকে তাকিয়ে সে বললো, আপনি চলুন আমাদে সঙ্গে কোতোয়াল খালিদের কাছে। এজাহার দিয়ে আসবেন।

    সব শুনে আমির খালিদ বললো, এতো বড় তাজ্জব কাণ্ড, আল্লার নাম নিয়ে বলছি, তোমরা যে কাহিনী শোনালে সবই আমি বিশ্বাস করছি। কিন্তু একটা কথা, এই বিরাট বাগদাদ শহরে সেই শয়তান বুড়িটাকে কী করে আমি ধরবো? হারেমে হারেমে ঢুকে সব মেয়ের বোরখা খুলে পরীক্ষা করে দেখা কী আমার পক্ষে সম্ভব? আমার পক্ষে কেন, কারো পক্ষেই তা সম্ভব নয়।

    –তা হলে কী উপায় হবে?

    ওরা তিনজন হা-হুতাশ করতে থাকে। হজ মহম্মদ কপাল চাপড়ায়, আমার দোকান—

    ছেলেটা কেঁদে ফেলে, আমার গাধা—

    আর সওদাগর সিদি মুসিন মাথা ঠুকতে থাকে, আমার এক হাজার দিনারের বটুয়া—

    কোতোয়াল খালিদ বলে, তোমরা, যদি বুড়িটাকে ধরে এনে দিতে পোর, আমি তার যোগ্য সাজা দেবার ব্যবস্থা করতে পারি। এমন দাওয়াই তাকে দেবো, বাছাধন সব কবুল করতে পথ পাবে না। কিন্তু তাকে যদি হাতের মুঠোয় না পাই, আমার কিছু করার নাই।

    খালিদের কথায় তারা আপাততঃ শান্ত হয়ে যুক্তি করে, যেভাবেই হোক তাকে তাকে থাকতে হবে, বুড়িটার হদিশ করতেই হবে।

     

    এবারে ধূর্ত বুড়ি ডিলাইলাহর কথা বলি :

    মালপত্র চাপিয়ে সে গান্ধটাকে তাড়িয়ে নিয়ে নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। একেবারে সোজা বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছায়। আল্লাহর কৃপায় পথে কোনও ঝঞ্ঝাট হলো না, নিজের বাড়ির দৌড়গোড়ায় পৌঁছে বুড়িটা হাঁফ ছেড়ে বঁচে। যাক বাবা, ভ্যালয় ভালয় পৌঁছে গেছি! জাইনাব জানলার ধারে মা-এর প্রত্যাশায় বসেছিলো। আনন্দে সে লাফাতে লাফাতে এসে দরজা খুলে দেয়।

    –মা, মাগো, তুমি দেখি বাজী মাৎ করে এসেছো?

    –তবে কী ভেবেছিলি কোতোয়ালের হাতকড়া পরে ফাটকে যাবো?

    ডিলাইলাহর চোখে শয়তানীর হাসি নাচতে থাকে। দেমাক করে বলতে থাকে, আমার নাম ডিলাইলাহ। তোর কোতোয়াল খালিদ বল, আর আহমদ হাসান বল, সাতঘাটের পানি খাইয়ে দিতে পারি আমি। আমার সঙ্গে খলিফা যে ব্যাভার’-খানা করলে তাতে কি আমি চুপ করে বসে থাকবো ভেবেছিস? ওর সুলতানী করার সাধ আমি ঘুচিয়ে দেব। আমার সঙ্গে চালাকী! জাইনাবের আনন্দ আর ধরে না। মা, মা গো, তোমার কেরামতির কাহিনীটা একবার শোনাও না, মা।

    ডিলাইলাহর মুখে দুৰ্গ জয়ের অহঙ্কার ফুটে ওঠে, এক ঢ়িলে চার পাখী মেরেছি। এক আমিরের বিবি আর এক ছোকরা সওদাগরের সাজ-পোশাক গহনাপত্র টাকাকডি লোপাট করে একেবারে উদাম করে রেখে এসেছি। আর এক দোকানদারের দোকানের সব ভালো ভালো দামী দামী জিনিসপত্র ফাঁক করে দিয়েছি। আর এই গাধাটা দেখছিস, এটাও বাগিয়ে নিয়ে এসেছি একটা ছেলের কাছ থেকে।

    জাইনাবা শিউরে ওঠে, বলো কী মা, এতোগুলো কাজ একবেলার মধ্যে সেরে ফেললে?

    –তবেই বোঝ, আমার কারসাজী?

    –কিন্তু মা, তোমার কী ধারণা, ওরা তোমাকে পথে-ঘাটে দেখে চিনতে পারবে না? তখন? তখন কী করে বাঁচবে তুমি? একবার ধরা পড়লে, জন্মের সাধ তো তোমার ঘুচিয়ে দেবে কোতায়াল।

    –তুই থাম তো জাইনাব। তোর ঐ আমির খালিদকে আমি ট্যাঁকে গুঁজে রাখতে পারি। খালি ভয় আমার ঐ ছোঁড়াটাকে। বেটাচ্ছেলে, আমাকে চেনে। সে যাক গে, ও-নিয়ে আমি চিন্তা করি না।

    ডিলাইলাহ একটু দম নেয়। তারপর আবার বলতে থাকে : এ আর কী দেখলি আমার কেরামতী। আসল কাজে তো এখনও হাতই দিইনি।

    জাইনাব আতঙ্কিত হয়ে বলে, কিন্তু মা, আমার বড় ভয় করছে। যদি তুমি ধরা পড়ে যাও–

    -আমাকে যে ধরবে সে এখনও মায়ের গবভে। ওসব ভয় আমাকে দেখাস নে। জানিস আমি হচ্ছি। পাকাল মাছ, হাতে মুঠো করে ধরেও ধরে রাখা যায় না। পালিয়ে আমি যাবোই।

    রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    চারশো উনচল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

    সুফী দরবেশের আলখাল্লা ছেড়ে সে আমির উজিরের বাড়ির হারেমের আয়ার সাজ পরে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আবার কাকে ঘায়েল করা যায়, তারই ফন্দী আঁটতে আঁটতে বাগদাদের শহর পথ পরিক্রমা করে চলে সে।

    বাজার। রাস্তার দুধারে বাহারী রঙদার বিলাসদ্রব্যের দোকান। নানারকম কায়দায় সুন্দর সুন্দর জিনিস সব এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে, দেখে চোখ ঝলসে যায়। ডিলাইলাহ এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চলছিলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো, একটা বড় লোকের চাকরানীর কাঁধে ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে। এক নজরেই বোঝা যায়, কোনও আমির বাদশার খানদানী ঘরের দুলাল। সারা অঙ্গে তার সজের কী বাহার। জমকালো জরির কাজ করা কুর্ত কামিজ। মাথায় শিরোপা। হীরা চুনী পান্না মুক্ত বসানো-মহামূল্যবান টুপী। তার গলায় ইয়া বড় একটা মুক্তোর মালা। মাঝে মাঝে হীরা বসানো। একটাবাড়ি থেকে চাকরানীটা ছেলেটিকে কাঁধে করে রাস্তায় নামলো। এই বাড়িটা বাগদাদ শহরে বিখ্যাত। শহরের সওদাগর-সমিতির সভাপতির বাড়ি। সুতরাং প্রায় সব লোকেই চেনে। এই বাচ্চা যে সওদার সভাপতির সে-কথা হয়তো না বললেও বোঝা যায়।

    ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে চাকরানীটা তার সঙ্গে গপ্লো করতে করতে বাড়ির সামনেই পায়চারী করতে থাকলো। তাদের কথাবার্তা থেকে একটা কথা পরিষ্কার সে জানতে পারে, সওদাগরের বাড়িতে আজ উৎসব আছে। তার কন্যার বাগদানের উৎসব। ছেলেটা বড় দামাল। বাইরের অভ্যাগতদের সামনে ওর মাকে নাজেহাল করবে, এই আশঙ্কায় চাকরানীর কাছে দিয়ে বলেছে, বাইরে নিয়ে যা। মেহেমানরা চলে গেলে, নিয়ে আসবি।

    ডিলাইলাহ ভাবে, যেভাবেই হোক ছেলেটাকে গায়েব করতে হবে। সচ্ছন্দভাবেই সে চাকরানীটার সামনে এগিয়ে যায়। আর বোলো না বাছা, আমার বড় দেরি হয়ে গেলো।

    চাকরানীটা কিছুই বুঝতে পারে না। ডিলাইলাহর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। এই ফাঁকে ডিলাইলাহ তার হাতে একটা আচল দিনার গুঁজে দিয়ে বলে, এটা রাখো, তোমার মালকিনকে গিয়ে একবার খবর দাও, বাছা, তার পুরোনো আয়াউম অল খায়ের এসেছে দেখা করতে। আজ এই শুভ দিনে আমার দেয়া জানাতে এসেছি আমার বেটিকে। আমার নিজ হাতে মানুষ করা লেড়কী। আজ তার শাদীর পাকা দেখা। এ আনন্দ আমি কি চেপে রাখতে পারি। তাই না ডাকলেও ছুটে এসেছি, যাও তুমি মালকিনকে একবার গিয়ে বলো, তাহলেই তিনি সব বুঝতে পারবেন।

    চাকরানীটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে; এ তো ভারি। আল্লাদের কথা মা, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুণি মালকিনকে আপনার কথা বলছি।

    কিন্তু মুহূর্ত মধ্যেই চুপসে যায় চাকরানীটা! বলে, কিন্তু কী করে ভিতরে এখন যাবো, মা?

    –কেন?

    —এই বাচ্চাটা বড়ই দুরন্ত দামাল। মালকিন আজ বাদশাহী সাজপোশাকে সেজে আছেন, ওকে ভিতরে নিয়ে গেলে এক পলকে তার মা-এর সাজ-পোশাক একেবারে মাটি করে দেবে। সেই ভয়েই তিনি আমাকে বাইরে পাঠিয়েছেন। এখন তো একে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারবো না মা।

    —ওঃ, এই কথা! তা দাও ওকে আমার কোলে, আমি ততক্ষণ ওর সঙ্গে আলাপ জমাই। তুমি চটপট খবর দিয়ে চলে এসো, কেমন?

    সহজ সরল নির্বোধি চাকরানীটা আতশত প্যাঁচ-পয়জার ভাবতে পারে না। বলে, তা হলে তো খুব ভালো হয় মা। আপনি একটু ধরুন। আমি যাবো। আর আসবো।

    সরল বিশ্বাসে চাকরানীটা তার কোলে শিশুটিকে তুলে দিয়ে দোতলায় উঠে যায়।

    এদিকে তক্ষুণি ধূর্ত শয়তান বুড়িটা শিশুটিকে কোলে নিয়ে হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূরে বা পাশের একটা সরু অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে সদর রাস্তার গোচর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঝটপট সে শিশুটির গা থেকে মূল্যবান হীরে জহরতগুলো খুলে নিয়ে বটুয়ায় ভরে ফেলে। তারপর ভাবে, একে দিয়ে আরও অনেক রোজগার করা যাবে।

    দ্রুতপায়ে সে বাজারের স্যাকরা-পট্টিতে চলে আসে। এখানকার নামজাদা জহুরী এক ইহুদী। লোকটা পয়সার কুমির। কিন্তু বাগদাদের ব্যবসায়ী মহলে তার কোনও প্রতিষ্ঠা নাই।

    দোকানের গদীতে বসে খন্দেরের আশায় পথের দিকে তাকিয়েছিলো। ডিলাইলাহর কোলে সওদাগর-সভাপতির পুত্রকে দেখে তার চোখ দুটো জুলজুল করে ওঠে। এই সওদাগর-সভাপতির ওপর তার মনে মনে দারুণ হিংসা। পয়সায় ইহুদী অনেক বড়, কিন্তু তার মতো ইজৎ সে পায় না। লোকে তাকেই সন্মান করে সমিতির সভাপতি বানিয়েছে। কিন্তু ইহুদীকে ডাকেনি।

    ডিলাইলাহ দোকানের ভিতরে ঢোকে। ইহুদী স্বাগত জানিয়ে বসতে বলে। ভাবে, সওদাগর-সভাপতির বাড়ির বায়না—মোটা মাল বিক্রি হবে। কণ্ঠে মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করে, কী চান মা?

    —আপনিই তো আমাদের মহাজন, ইহুদী আজারিয়াহ?

    –আপনি ঠিকই চিনে এসেছেন।

    ডিলাইলাহ বলতে থাকে, এই বাচ্চাটার বড় বোনের আজ শাদীর পাকা কথার উৎসব হচ্ছে বাড়িতে। ওহো, আমি কোনবাড়ি থেকে এসেছি, দেখুন, তাই-ই বলতে ভুলে গেছি।

    ইহুদী আজারিয়াহ বলে, আমি জানি, আপনি আমাদের সওদাগর শাহবানদার-প্রাসাদ থেকে আসছেন। এই বাচ্চা দেখেই বুঝতে পেরেছি। তা বলুন, কী কাজে লাগতে পারি। আমি?

    ডিলাইলাহ বলে, অনেক আত্মীয় ইয়ার দোস্ত আমির ওমরাহ সওদাগর আসবেন আজ। খুব জাঁকজমক করছে আমাদের মালিক।

    -জানি। আমারও নেমন্তন্ন আছে সেখানে। দোকানপাট বন্ধ করেই যাবো।

    ডিলাইলাহ মুহূর্তের জন্য মিইয়ে যায়। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার নিজেকে সহজ করে নিয়ে বললে, মালকিনের ইচ্ছা তার এই বাচ্চাটাকে একেবারে শাহজাদার মতো করে সাজাতে হবে। তিনিই আমাকে পাঠালেন। আপনার কাছে। আপনার দোকানের সেরা জহরৎ দিয়ে সাজিয়ে দিন-মালকিনের তাই ইচ্ছে।

    ইহুদী শুনে গদগদ হয়, এ আর বেশি কথা কী। এমন সব দামী-দামী জড়োয়া-জহরৎ দিচ্ছি, আপনার মালকিনের পছন্দ হবেই হবে।

    জহুরী বেছে বেছে দু’খানা বাহুর তাগা, দু’খানা বালা, এক জোড়া মুক্তোর কানবালা, একখানা কোমরের দোয়াল, দুই রকম জামার বোতাম এবং হাতের কয়েকটি আংটি ডিলাইলাহর হাতে তুলে দিয়ে বললো, দেখান আপনার মালকিনকে। আমার মনে হয় অপছন্দ হবে না।

    ডিলাইলাহর চোখ নেচে ওঠে। সবগুলো গহনায় হীরে চুনী পান্না প্রভৃতি নানারকম রত্ন বসানো। অনেক দাম হবে বোধ হয়। জহুরীকে বলে, বহুৎ বাহারী চমৎকার জিনিস সব। আমি মালকিনকে দেখিয়ে দামটা দিয়ে যাচ্ছি। কত লাগবে, আপনি ক’ষে বলে দিন।

    জহুরী বলে, দামের জন্য চিন্তা কী। সে পরে হবে ’খন। আগে তো তার পছন্দ হোক। তারপর দামের জন্য কী আটকাবে?

    মুখে এই বললেও কাগজ কলম নিয়ে হিসেব কষে সে বলে, এই আপনার গিয়ে সব সুদ্ধ দোম পড়ছে একহাজার দিনার মতো। ও-জন্যে কিছু ভাববেন না। দাম না হয়। আমি পরে নিয়ে আসবো। আপনি নিয়ে যান; তিনি পছন্দ করুন-সেইটেই আমার কাছে বড় কথা।

    ডিলাইলাহ বলে, বাচ্চাটা এখানে ততক্ষণ থাক, আমি দৌড়ে যাবো। আর ছুটে আসবো।

    ইহুদী হাসে, বুঝেছি আপনার কোথায় আটকাচ্ছে। ওসব কিছুর দরকার নাই। ছেলেকে জমা রেখে আপনি নিয়ে যাবেন, আর আমি তাই হতে দেবো? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এসব আপনি ভাবলেন কী করে। যান, চলে যান। আপনাকে এ নিয়ে আর কিছু চিন্তা করতে হবে না। ছেলেকে যদি এমনিই রেখে যেতে চান, থাকুক। এখানে খেলা করুক। কিন্তু আমার কোনও প্রয়োজন নাই।

    ছেলেটিকে ইহুদীর দোকানে বসিয়ে রেখে ডিলাইলাহ সোজা বাড়ির পথে হন হন করে হেঁটে চললো।

    জাইনাব ঠগের সেরা মাকে ফিরতে দেখে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে, আবার কাকে ফাঁসিয়ে এলে, মা?

    মা নির্বিকারভাবে বলে, এমন বড় কিছু না, ছোট্ট একটা কারবার করে এসেছি। শাহবানন্দরের ছোট ছেলেটার গায়ের কিছু জহরৎ খুলে নিয়ে ওকে স্যাকরা-বাজারে জহুরী আজারিয়াহ ইহুদীটার হেপাজতে রেখে তার বদলে ওর কাছ থেকে এই সামান্য হাজার খানেক দিনারের মতো জরোয়া গহনা নিয়ে এসেছি।

    কিন্তু মা, জাইনাব শঙ্কিত হয়ে বলে, এই রকম বেপরোয়া হয়ে এমন সব কাজ তুমি করে আসছ, এরপর ভেবে দেখেছো বাগদাদের হাটে বাজারে আর তুমি বেরুতে পারবে?

    –তুই থাম তো ষ্টুডি! আমাকে আর জ্ঞান দিস নি। বলি, তুই আমার পেটে হয়েছিস, না। আমি তোর পেটে হয়েছিলাম। আমার কাজে বাধা দিবি না। যা আমি করবো ভেবেছি, তার এক কণাও এখনও করা হয়নি। আমার।

    এদিকে সেই নির্বোধ চাকরানীটা দোতলায় উঠে যায়। বিরাট বিশাল ভোজসভার আয়োজন হয়েছে মাঝের বড় ঘরে। সওদাগর বিবির কানে ফিস ফিস করে সে বলে, মালকিন, আপনার পুরোনো আয়া উম আল খাইর এসেছে। নিচে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। শাদীর পাকা-দেখা শুনে সে মেয়েকে দোয়া জানাতে এসেছে।

    এই কথা শুনে সওদাগর-বিবি প্ৰায় চিৎকার করে ওঠে, তোর ছোট মালিককে কোথায় রেখে এলি?

    মেয়েটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলো, ঐ আয়ার কাছে তাকে রেখে এসেছি, মা। ভাবলাম, ওকে ওপরে আনলে আপনি রাগ করবেন। ও আপনার সাজ-পোশাক নষ্ট করে দেবে, তাই। এই দেখুন আপনার আয়াটা আমাকে একটা দিনার বকশিশ দিয়েছে।

    সওদাগর-বিবি দিনারটা হাতে নিয়ে দেখে, জাল। পিতলের তৈরি। সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। সে, শিগ্‌গির ছুটে যা, খানকি মাগী, নিয়ে আয় আমার বাছাকে।

    চাকরানীটা দিগভ্ৰান্ত হয়ে পড়ে। হুড়পাড় করে সে নিচে নেমে এসে দেখে পাখী পালিয়েছে। কোথায় আয়া? কোথায় তার ছোট মালিক? হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। তার চিৎকার শুনে অন্যান্য মেয়েরা ছুটে নেমে আসে নিচে। নিমেষের মধ্যে দারুন চেঁচামেটি-চিৎকার মহা-সোরগোল পড়ে যায়। সওদাগর সভাপতি নিজেও ছুটে আসে, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? এতো গোল কীসের? যখন তার বিবির মুখ থেকে শুনলো, ছেলেকে নিয়ে ভেগেছে একটা শয়তানী ছেলে-চোর, সওদাগর পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটিছুটি করে খুঁজতে থাকলো। তার সহগামী হলো উপস্থিত অভ্যাগত আমন্ত্রিত সকলেই। নানা দিকে ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়লো তারা শিশুর সন্ধানে। শত সহস্ব পথচারীদের জিজ্ঞেস করলো, কেউ একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলেকে কোনও বুড়ির কোলে দেখেছে কি না। কিন্তু কেউ কোনও হদিস দিতে পারলো না। দোকানদার, ফিরিওলা, ভিস্তিওলা কাউকেই জিজ্ঞেস করতে বাদ রাখলো না তারা। কিন্তু কেউই আশার কথা শোনাতে পারে না। অবশেষে অনেকক্ষণ পরে তারা স্যাকরা বাজারে এসে ছেলের সন্ধান পেলো। ইহুদী আজারিয়াহর দোকানের দরজার পাশে বসে সে একমনে খেলা করছিলো। তার সাজ-পোশাক এলোমেলো, গায়ের হীরে জহরৎ কিছু নাই। শাহবানদার ক্ৰোধে আনন্দে অধীর হয়ে ইহুদীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

    এ্যাই শয়তান পাজী বুড়ো, আমার ছেলে তোর কাছে কেন, বল? কী করে এলো এখানে? নিশ্চয়ই গহনার লোভে চুরি করিয়ে এনেছিস। তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো, বদমাইশ। বল, ওর গায়ের হীরে জহরৎ কোথায় রেখেছিস?

    বুড়ো ইহুদী ভয়ে কাঁপতে থাকে। শাহবানদারের দাপট সে জানে। তার ওপর এখন তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল জনতা। তার একটা ইশারাতে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে পারে তারা।

    –দোহাই, মালিক, আমার অপরাধ নেবেন না। আমি কোনও দোষ করিনি, কোন চুরি ছেনতাই আমার ব্যবসা নয়।

    সওদাগর রাগে ফেটে পড়ে, ওরে আমার পীর রে। তুমি চুরি করনি তো আমার ঘরের ছেলে তোমার দোকানে এলো কী করে? ঐটুকু দুধের বাছা, হেঁটে হেঁটে একাই চলে এলো 으T55 에?

    –জী না, একা আসবে কী করে? আপনার বাড়ির এক বুড়ি আয়া তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো। আজ। আপনার মেয়ের বাকদান। অনেক অতিথি মেহেমান আসবেন। তাই মালকিনের কথামতো সে আমার দোকানে এসে হাজারখানেক দিনারের গহনাপত্র নিয়ে গেছে তাকে দেখাতে। আপনি বিশ্বাস করুন শাহবানন্দার সাহেব, আপনার ছেলেকে জামানত রাখতে চাইনি আমি। আমার কী দরকার, আপনি পাঠিয়েছেন, আমি বিশ্বাস করে গহনা ছেড়ে দেবো না।

    শাহবানদার এবার জ্বলে ওঠে, ওহে কালাবাঁদর, আমার মেয়ের গহনাপত্রের কী কিছু অভাব আছে? তোমার দোকানে লোক পাঠিয়ে গহনা না নিয়ে গেলে আমার মেয়ে সেজেগুঁজে দাঁড়াতে পারবে না। ও সব বুজরুকী রাখ, ছেলের গায়ের হীরে-জহরৎ কোথায় রেখেছ, বের করা?

    এমন সময় সেখানে সেই হজ মহম্মদ, গাধার মালিকটা আর সওদাগর সিদ্দি মুসিন এসে হাজির হয়। ঘটনার বিবরণ শুনে তারা সকলে কীভাবে সেই শয়তান বুড়িটার কাছে প্রতারিত হয়েছে তার বিস্তারিত কাহিনী বলে। সব শুনে শাহবানদারের প্রত্যয় হয়, ইহুদীটির কোনও দোষ নাই। সে তাকে বলে, ঠিক আছে, হীরে-জহরৎ যা গেছে তার জন্য আমি তোয়াক্কা করি না। আমার ছেলেকে ফিরে পেলাম। এই যথেষ্ট। তবে এও বলে রাখলাম আপনাদের, সে বুড়ি শয়তান মাগী আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে না। আজ আমার বাড়িতে কাজ-এখন এ নিয়ে আর হৈ-হুজুৎ করতে চাই না।

    শাহবানদার ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। ইহুদী জহুরী সেই তিন প্রতারিতকে প্রশ্ন করে, আপনারা এর কোনও বিহিত করবেন না?

    তারা জানায়, সকালে তারা কোতোয়াল খালিদের কাছে এজাহার দিয়ে এসেছে। কিন্তু সে

    হাতে তুলে দিলে সে তাকে উপযুক্ত সাজা দেবে, এই কথা দিয়েছে।

    ইহুদী বলে, তা হলে আসুন আমরা সবাই একজোট হয়ে তাকে ধরে ফেলার ব্যবস্থা করি। আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কেউ কী আগে ঐ বুড়িটাকে চিনতেন?

    গাধার মালিকটা এগিয়ে এসে বলে, আমি চিনতাম।

    ইহুদী বলতে থাকে, সবাই মিলে একসঙ্গে দল বেঁধে তাকে খুঁজে বেড়াতে থাকলে কোনও কাজ হবে না। চারজন চারদিকে নজর রাখুন। পথে-ঘাটে যত বুড়ি মেয়েছেলে চোখে পড়বে তাদের সবাইকে ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। কিন্তু সাবধান, কেউ যেন না বুঝতে পারে আমরা কিছু লক্ষ্য করছি।

    রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    চারশো একচল্লিশতম রজনীর মধ্যযামে আবার সে বলতে আরম্ভ করলো :

    গাধার মালিকটাই প্রথমে দেখা পেলে ডিলাইলাহর। যদিও সে-দিন আর এক অভিনব ছদ্মবেশে সেজে পথ চলছিলো, তবুও কিন্তু তার নজর এড়াতে পারলো না। বুড়িটার অদ্ভুত ধরনের চলার ভঙ্গী তার অনেক দিনের চেনা। দৌড়ে এসে সে বুড়িটার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, ই ই আমার চোখকে ফাকি, এবার কোথায় পালাবে গাধা-চোর? তোমার লোক-ঠিকানোর ব্যবসা আমি বের করে দিচ্ছি।

    ডিলাইলাহ ফিস ফিস করে বলে, আঃ অত চেঁচাচ্ছে কেন? মামলাটা কী বাবা?

    –মামলা আবার কী? আমার গাধা কই-গাধা?

    ডিলাইলাহ আরও নরম সুরে বলে, আস্তে কথা বলো, বাবা। আচ্ছা, শুধু তোমার গাধাটা ফেরত পেলেই তুমি খুশি হবে, না অন্য সকলের সামান-পত্রও চাও?

    ছেলেটি বলে, অন্য লোকের জিনিসে আমার কী কাম? আমার গাধা, আমি ফেরত পেলেই খুশি হবো।

    ডিলাইলাহ কষ্ঠে মধু ঢেলে বলে, আমি জানি তুমি গরীব লোক। তোমার জিনিসে আমার কোনও লোভ নাই, বাবা। আমি ছিনতাই করতে চাই আমির বাদশাহদের ধন-দৌলত। তোমার গাধাটা আমি তোমাকে ফেরত দেবো বলেই ঐ মুর-নাপিতের দোকানের সামনে বেঁধে দিয়েছি। তুমি যাও, পাবে। দোকানের মালিকের নাম হিজ মাসুদ। ওকে বলা আছে, গিয়ে চাইলেই তোমাকে দিয়ে দেবে। আচ্ছা, তোমাকে যেতে হবে না, তুমি এখানে দাঁড়াও। আমিই গিয়ে নিয়ে আসছি। এই রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেই বাঁক ঘুরলেই তার দোকান। একটুক্ষণ তুমি অপেক্ষা কর, আমি তোমার গান্ধটাকে নিয়ে আসছি।

    চোখে ততক্ষণে অশ্রুধারা নামিয়ে ফেলেছে সে। নাপিতের হাত ধরে কাঁদতে বলে, হায় হায় আমার সব শেষ হয়ে গেলো।

    —কেন? কেন, কী হয়েছে বুড়ি মা?

    নাপিত হজ মাসুদ উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করে। বুড়ি বলে, আমার ছেলে তোমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, বাবা। এই গাধাটাকে ভাড়া খাটাতো সে। কিন্তু একদিন দারুন খরাতে ঘুরে ঘুরে হঠাৎ ওর মাথাটা বিগড়ে যায়। তারপর থেকে অনেক চেষ্টা করেও ওর মাথার দোষ সারাতে পারিনি। বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। উপসর্গ বলতে অন্য কিছু নয়, সারাদিন তার মুখে একই বুলি, আমার গাধা, আমার গাধা কোথায় গেলো? আমার গাধা আমাকে ফেরত দিয়ে দাও-এই সব আর কি। শয়নে স্বপনে নিদ্ৰা জাগরণে তার ঐ এক কথা, আমার গাধা আমাকে দিয়ে দাও-। আমি ওকে অনেক হেকিম-বদ্যি দেখিয়েছি। কিন্তু কেউই সারাতে পারেনি। তারপর এই শহরের সবচেয়ে নামজাদা হেকিমের কাছে আমি গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে এক মোক্ষম দাওয়াই রাৎলে দিয়েছে। কিন্তু সে দাওয়াই ওকে দেবার সাধ্য আমার নাই। তোমার সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব হবে না, বেটা।

    হজ মাসুদ বলে, কী এমন কাজ মা, যা আপনি পারবেন না-অথচ আমি পারবো? যাক, বলুন, আমি জান দিয়েও করে দেবো আপনার কাজ।

    ডিলাইলাহ হজ মাসুদের হাতে একটা দিনার গুঁজে দিয়ে বললো : হেকিম জী বলেছেন : ছেলের এই পাগলামীর আসল কারণ ওর দু’টো শ্বদন্ত। এই দু’খানা উপড়ে ফেলে সেখানে গরম দু’খানা লোহার গজাল গেঁথে দিলেই ওর পাগলামী ভালো হয়ে যাবে।

    ডিলাইলার কথা শুনে মাসুদ বলে, আপনি কিছু ভাববেন না। আপনার ছেলের পাগলামী আমি এক্ষুণি সারিয়ে দিচ্ছি।

    মাসুদ তার দুই সহচরকে হুকুম করলো। দু’খানা পেরেক উনুনে পোড়াতে দাও। আমি ওকে ডেকে আনি।

    মাসুদ দোকানের বাইরে এসে গাধার মালিককে দেখতে পেয়ে বলে, ও ছেলে, দোকানে চলো। তোমার গাধা ফেরত নিয়ে এসো।

    ছেলেটা হস্তদন্ত হয়ে মাসুদের পিছনে পিছনে দোকানে ঢোকে। মাসুদ তাকে পাশের কামরায় নিয়ে গিয়ে আচমকা পেটের ওপর এক ঘুষি মারে। ছেলেটা চিৎপাৎ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অনুচর দু’টো এসে তাকে চেপে ধরে। এর ফলে আর সে নড়া-চড়া করতে পারে না। মাসুদ ওর বুকের ওপর চেপে বসে, গলাটা টিপে ধরে। ছেলেটার দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনা থেকেই মুখটা হাঁ হয়ে যায়। তখন একখানা সাঁড়াশী দিয়ে পটাপট দু:খানা স্বদন্ত তুলে ফেলে সে। গজাল দু’খানা ততক্ষণে তেন্তে.লাল হয়ে গিয়েছিলো। মাসুদ নির্মম হাতে সেই দাঁতের গর্তে দু’খানা গজাল ঠুকে বসিয়ে দিয়ে বলে, এই তো হয়ে গেলো। এবার তুমি তোমার গান্ধাকে নিয়ে নাচতে নাচতেবাড়ি চলে যাও, কেমন! দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকি, যা যা বলেছিলেন, ঠিক ঠিক মতো করতে পেরেছি কি না তাকে দেখাই।

    নাপিতের সাগরেদ। দু’টো তখনও ছেলেটাকে চিৎপাৎ করে ধরে রাখলো। আর ছেলেটা দারুণ যন্ত্রণায় হাঁপাতে থাকলো। নাপিত তার মাকে ডাকতে চলে গেলো পাশের ঘরে।

    কিন্তু একি! ঘরতো ফাকা। কেউ নাই। বুড়ি মা কোথায় গেলো? এই তো সে এখানেই বসেছিলো!

    নাপিত মাসুদ অবাক হয়। দোকানের বাইরে এদিক-ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু না, কোথাও সে নাই। হঠাৎ তার খেয়াল হয় দোকানের ছুরি, কঁচি, ক্ষুর, সাবান, আয়না চিরুনী বদনা গামলা—কিছুই নাই। সব সাফ করে নিয়ে গেছে। বুঝতে আর বাকী থাকে না—এতক্ষণ সে এক শয়তান বুড়ির পাল্লায় পড়ে সর্বস্বাস্ত হয়েছে।

    সে এক জাঁদরেল সিদেল চোর। আর আজ এই দিন-দুপুরে তারই নাকের ডগা দিয়ে তার দোকানের সর্বস্ব লোপাট করে নিয়ে গেছে একটা মেয়ে-ছেলে? এতো বড় ক্ষমতা-রাগে গরগর করতে থাকে সে। পিছনের ঘরে ছুটে গিয়ে রেগে ছেলেটার দুই গালে প্রচণ্ড মুষ্ঠাঘাত করে কৈফিয়ৎ তলব করে, বল, তোর মা মাগী কোথায় গেছে? বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। আমার ভয়ে গৃহস্থের চোখে ঘুম আসে না, আর আমার দোকানেই বাটপাড়িা! এখনও বাঁচিতে চাস তো তোর মা কোথায় থাকে আস্তানার পাত্তা বল।

    ছেলেটির তখন মৃতকল্প দশা! বলে, আল্লাহ কসম, আমার মা অনেক কাল আগে দেহ রেখেছে। আমি অনাথ। গাধা খাটিয়ে খাই।

    মাসুদ বলে, ওসব কসম আমি বিশ্বাস করি না। ঐ বুড়ো খানকিটা আলবাৎ তোর মা। বলো সে কোথায়? সে আমার সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে গেছে।

    যখন তারা এই রকম তর্ক-বিতর্ক করে চলেছে, এমন সময় দোকানের সামনে দিয়ে সেই তিন প্রতারিত হজ মহম্মদ, সওদাগর সিদি আর জহুরী ইহুদী ধূর্ত বুড়ির অনুসন্ধান করে ফিরছিলো। গাধার মালিকের আর্তনাদ শুনে তারা নাপিতের দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়লো। ছেলেটার তখন দুগাল বেয়ে রক্ত-নদীর ধারা বয়ে চলেছে! যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছিল। ওর তিন সতীর্থকে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সে; আমাকে মেরে ফেললো, এই বিধমী বদমাইশটা। আপনারা আমাকে বাঁচান।

    ওরা দেখলো ছেলেটার মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়। দু’খানা তাজা দাঁত উপড়ে তুলে ফেলেছে। তার। উত্তপ্ত লীেহশালাকার ছেকায় তার মুখের প্রায় আধখানাই পুড়ে আংরা হয়ে গেছে। নাপিতের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তারা মারমুখী হয়ে উঠতে হজ মাসুদ আদ্যোপোন্ত সব ঘটনা তাদের সামনে খুলে বলে। তখন ওরা বুঝতে পারলো, আসল দোষী সেই ধূর্ত শয়তান বুড়িটা। তাকে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত তাদের গায়ের ঝাল যাবে না। সবাই মিলে আবার হলফ করলো, যেভাবেই হোক, যতদিনেই হোক এর বিহিত তারা করবেই।

    শাহরাজাদ দেখলো, রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে রইলো।

     

    চারশো বিয়াল্লিশতম রজনী। আবার সে বলতে থাকে :

    অনেকদিন ধরে অনেক পথ ঘুরে, অবশেষে একদিন তারা বুড়ি ডিলাইলাহকে পাকড়াও করতে পারলো। গাধার মালিকই চিনতে পেরেছিলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচামেচি চিৎকার করে সে লোকজন জড়ো করে ফেললো। হজ মহম্মদ সওদাগর সিদি মুসিন এবং ইহুদী জহুরী আজারিয়াহ। আর মুর নাপিত হজ মাসুদও এসে পড়লো ঘটনাস্থলে। ওরা পাঁচজনে মিলে

    খালিদ তখন খানা-পিনা করে নাক ডাকিয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছিল। পাহারাদার বললো, কী ব্যাপার? এখন সাহেবের সঙ্গে মুলাকাত হবে না। তিনি এখন শুয়েছেন। আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন, আর এই জেনেনা লোককে আমি অন্দরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর কোতোয়াল সাহেব ঘুম থেকে উঠলে তাকে আপনাদের মামলা জানাবেন।

    ওরা পাঁচজন বৈঠকখানায় বসে রইলো, আর একটি খোজা এসে বুড়ি ডিলাইলাহকে প্রাসাদের অন্দরমহলে নিয়ে গেলো।

    এক সদাশয় শুভ্বকেশ বৃদ্ধাকে এই সময়ে কোতোয়ালের কাছে আসতে দেখে কোতোয়াল-বিবি কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, আপনার কী মামলা, মা? কেন এসেছেন তার কাছে?

    বুড়ি হেসে বলে, না, আমার কোনও মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপার নাই। খালিদ সাহেবের সঙ্গে আমার কথাবার্তা সব হয়ে গেছে। আমার স্বামীর বান্দা কেনা-বেচার ব্যবসা। তিনি কাজের তাগিদে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। এবার যাওয়ার আগে আমার কাছে পাঁচটা মামলুক রেখে বলে গেলেন ঘরে পয়সা কড়ি যা রেখে গেলাম, আমার দেশে ফেরার আগে যদি তা ফুরিয়ে যায়। তবে এই পাঁচটা বান্দা কোনও আমির বাদশাহর কাছে বিক্রি করে সংসার চালিও। খালিদ সাহেবকে বলতেই তিনি বললেন, পাঁচটাই তার দরকার। তাই ওদের আজ নিয়ে এসেছি। ওই দেখ মা, বৈঠকখানার বারান্দায় ওরা বসে আছে–ওই পাঁচটি আমার সেরা বান্দা। দারুন কাজের লোক। আর বুদ্ধি সুদ্ধিও ঢের!

    খালিদ-বিবি জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো, সত্যিই পাঁচটিই বেশ ভালোজাতের মানুষ। বললো, তা কত দাম কিছু ঠিক হয়েছে মা?

    বৃদ্ধ বেমালুম বলে ফেললো, এক হাজার দুশো দিনার-একেবারে জলের দাম। নেহাত বিপদে পড়েছি, পয়সাকডির দরকার তাই। না হলে বাজারে নিলামে তুললে অনেক বেশি ইনাম পাওয়া যেত।

    আমির-বিবিরও তাই ধারণা। মাত্র বারোশো দিনারে এই রকম পাঁচ পাঁচটা ম্যামলুক মেলানো ভার। বাজারে গেলে, চাই কি, এক একটার দাম হাজার দিনার হাঁকবে।

    খালিদ গৃহিণী আব্দর যত্নর মাত্ৰাটা একটু বাড়িয়ে দেয়। ইশারা করতেই একটি চাকরানী এসে এক গেলাস পেস্তার শরবৎ এনে রাখে। খালিদ বৌ বলে, মেহেরবানী করে চুমুক দিন। আচ্ছা মা, দাম নেওয়া ছাড়া কী আর কোনও দরকার আছে তার সঙ্গে? তিনি এইমাত্র খানা-পিনা সেরে শুয়েছেন। ঘুম থেকে উঠতে তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে। এতক্ষণ কী আপনি অপেক্ষা করবেন? না, আমি দামটা দিয়ে দেব, নিয়ে যাবেন? পরে সময় মতো একবার এসে ভোট করে যাবেন?

    বৃদ্ধার তীর অব্যৰ্থ। এইভাবেই সে তাকে গেঁথে ফেলতে চেয়েছিলো। বললো, পয়সা ছাড়া তো তার সঙ্গে আমার অন্য কোনও দরকার নাই, মা!

    —তা হলে আমি দেখি আমার কাছে আছে কিনা, থাকে। যদি আপনাকে দিয়ে দিই দামাটা। না হলে স্রেফ এই টাকাটার জন্যে আপনি এতোটা সময় বসে বসে হয়রান হবেন?

    অন্য ঘরে চলে গেলো সে। কয়েক মুহূর্ত পরে একটা বটুয়া এনে বললো। কিন্তু পুরো বারোশো তো এখন হচ্ছে না, মা। এতে এক হাজার আছে!

    প্রায় ছোঁ মেরেই থলেটা হাতে নিয়ে বুড়ি ডিলাইলাহ বলে, ঠিক আছে। এতেই আমার একটা দিন দিব্যি চলে যাবে। আমার ফেরার সময় হয়ে এসেছে।

    —কিন্তু আপনার আরও দুশো দিনার বাকী রয়ে গেলো যে মা?

    — তা থাক। ধরে একশো দিনার দিলাম তোমার শরবতের দাম। আর একশো না হয়। পরে কখনও নিযে যাবো।

    খালিদ-গৃহিণী ভাবে, যাক, মুফতে দুশো দিনার বাণিজ্য হয়ে গেলো! ভাগ্যে খালিদ-সাহেব গতকাল তাকে টাকাটা দিয়েছিলো অন্য একটা সামান কেনার জন্য!

    ধূর্ত বুড়ি এবার পলায়নের পথ খোঁজে।–তা হলে মা, আমি আর অপেক্ষা করবো না। কিন্তু ঐ সদর দরজার সামনে আমার এতোদিনের চেনা-জানা-বান্দাগুলো বসে আছে। দিনে দিনে মায়া-মমতা জড়িয়ে গেছে, এখন এখানে ফেলে রেখে ওদের মুখের সামনে দিয়ে চলে যেতে আমার কলিজা ফেটে যাবে। তুমি বরং আমাকে খিড়কীর দরজা দিয়ে বের করে দাও মা।

    খালিদ-গৃহিনী নিজে তাকে সঙ্গে করে খিড়কীর দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বাইরে বের করে দেয়।

    ডিলাইলাহ হন হন করে হেঁটে বাড়িতে ফিরে আসে। জাইনাব এসে হেসে জিজ্ঞেস করে, আজ আবার কাকে জগ দিয়ে এলে মা?

    ডিলাইলাহ বলে আজ বড় মজার কাণ্ড করে এসেছি রে। সেই গাধার মালিক, রঙের আজ কোতোয়াল খালিদের বিবির কাছে এক হাজার দিনারে বেঁচে দিয়ে এসেছি। ওই কুৰ্ত্তার বাচ্চা গাধার মালিকটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। বার বার ঐ ছোঁড়াটাই আমাকে চিনে ফেলছে। এবারও ওরই জন্যে আমি ধরা পড়েছিলাম। আমাকে ধরতে পেরে ওদের কী আনন্দ! কোতোয়ালীতে নিয়ে গিয়ে তুললো। তা আমিও পাকাল মাছ। ওদের গায়ে কাদা লেপে দিয়ে পিছলে বেরিয়ে এসেছি। নে, এখন ঠ্যালা বোঝ। শয়তানের বেহদ্দ যখন শুনবে, ওদের জন্যেই তার হাজার দিনার খোয়া গেছে, তখন ও কী আর ওদের আস্ত রাখবে, ভেবেছিস!

    জাইনাব এবার সত্যিই ভয়ে কেঁপে ওঠে, মা, ঢের হয়েছে, এবার ক্ষান্ত দাও, একেবারে সাক্ষাৎ কোতায়ালকে চোট করে এসেছে তুমি। ভেবেছো, সে তোমাকে ছেড়ে দেবে? কথায় আছে না স্যাকরার ঠিকঠাক কামারের এক ঘা।’ তুমি লোকের চোখে ধুলো দিয়ে দিনে দিনে যা সংগ্রহ করছে, খালিদ তোমাকে একবার কত্তজায় পেলে তার দশগুণ বের করে নেবে তোমার কাছ থেকে।

    এইভাবে অনেক উপমা উদাহরণ দিয়ে মাকে নিরস্ত করার প্রয়াস করতে থাকলো জাইনাবি, অনেক হয়েছে। এই পয়সাই সারা জীবনে আমরা খেতে পারবো না। আর বেশি ঝুকি নিয়ে কাজ নাই। অতিলোভে তাতী নষ্ট!

    এদিকে কোতোয়াল খালিদ নিদ্রা পরিহার করে যখন বাইরে এলেন, তার বিবি এসে তাকে সুখবরটি পরিবেশন করে বললো। খোদা মেহেরবান, আশা করি তোমার সুখ-নিদ্রা হয়েছে। তা, তুমি বেশ ভালো সওদা করেছে তো! কিন্তু আমাকে জানাও নি কেন গো?

    খালিদ বোকার মতো বিবির মুখের দিকে তাকায়, ভালো সওদা? কীসের সওদা?

    —আহা, কী তোমার ভুলো মন, তুমি যে পাঁচ পাঁচটা ম্যামলুক বান্দা কিনেছো, সে কথা কী বেমালুম ভুলে বসে আছো?

    –বান্দা! আমি কোনও বান্দা ফান্দা কিনিনি কারো কাছ থেকে। কে তোমাকে এই সব আজগুবি খবর দিলো?

    —বা বা, বলিহারী তোমার স্মরণ শক্তি! একটা বৃদ্ধার কাছ থেকে তুমি বারোশো দিনারে পাঁচটা বান্দা কেননি? আজ তো, তুমি ঘুমিয়ে পড়লে সেই বুড়ি এসেছিলো, ঐ দেখ বাইরের বৈঠকখানায় বান্দাগুলো বসে আছে। তা জন্যে বসে থাকবে? কিন্তু যাই বলো, এতো সস্তা—যেন একেবারে…

    –থামো, গর্জে ওঠে খালিদ, বারশো দিনার দিয়ে দিয়েছে তাকে?

    বৌটা বুঝতে পারে না, অন্যায়টা সে কী করেছে। বলে, হ্যাঁ।

    কোতোয়াল আর এক তিল বসে না। প্রায় ছুটেই বাইরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে সেই পাঁচটি প্রতারিত সন্তান ছাড়া অন্য কোনও নাফর বান্দাকে দেখতে পায় না সে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ গোল করে খালিদ পাহারাদারকে প্রশ্ন করে, বান্দাগুলো কোথায়?

    —পাহারাদার বোকার মতো এদিক ওদিক তাকায়, জী বান্দা?

    –হ্যাঁ পাঁচটি বান্দা, তোমার মালকিন, আজ দুপুরে এক বৃদ্ধার কাছ থেকে কিনেছে। সেই পাঁচটা বান্দা কোথায়?

    হুজুর, আমি তো তেমন কোনও খবর জানি না।

    খালিদ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করে তাড়ফায়, আমি তো কোনও খবর জানি না-ত কিছুই যখন খবর রাখ না, তো এখানে সুরৎ-এর বাহার দেখাবার জন্যে থাকার কী দরকার? বিদেয় হও-যত্তোসব বোদর কা। বাচ্চা

    পাহারাদার কাচুমাচু মুখে বলে, আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন, সেই সময় এই পাঁচজনের সঙ্গে এক বুড়ি এসেছিলো। সে-বুড়িকে আমি অন্দরে পাঠিয়ে দিয়েছি, হুজুর।

    খালিদ বলে, ওঃ তোমরা? তা এখানে নবাবের মতো বসে আছো কেন? গতর তোলো? যাও কাজে হাত লাগাও। তোমাদের মালকিন আমার কাছে বিক্রি করে গেছে তোমাদের।

    খালিদের কথা শুনে ওরা পাঁচজনে সোরগোল তুলে কেঁদে ওঠে।–এ আপনার কেমন তরো বিচার হলো আমির সাহেব? আপনার নামে খলিফার কাছে নালিশ করবো আমরা। আমরা খলিফার অনুরক্ত প্রজা। নিয়ম মাফিক কর দিই—আমরা স্বাধীন-মুক্ত মানুষ। আমরা কি নফর বান্দা যে, আমাদের নিয়ে কেনাবেচার বেসাতি করবেন? ঠিক আছে, আগে খলিফার কাছে চলুন, তারপর যা বিধি-ব্যবস্থা তিনিই করবেন।

    গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো। শারিয়ার দেখলো, রাত শেষ হয়ে আসছে।

     

    চারশো তেতাল্লিশতম রজনীতে আবার শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :

    খালিদ গর্জে ওঠে, যদি তোমরা নফর বান্দা না হবে, তাহলে তোমরা কী? নিশ্চয়ই চোর ছ্যাচোর বদমাইশ গুণ্ডা? ঐ শয়তান বুড়িটার সঙ্গে সাঁট করে আমার বিবিকে ধোঁকা দিয়ে পয়সা বের করে নিয়েছ। আমি কী তোমাদের অত সহজে ছাড়বো, ভেবেছো? বিদেশী মুসাফীরদের কাছে প্রত্যেককে একশো দিনারে বেচে দেবো।

    খালিদ আর ঐ পাঁচজন প্রতারিতের মধ্যে যখন এইরুপ বাকবিতণ্ডা বাচসা চলছে, এমন সময় খালিফার দেহরক্ষী শেরকা বাচ্চ মুস্তাফা সেখানে এসে হাজির হয়।

    ইতিপূর্বে মুস্তাফা এসে তার বিবির প্রতারিত হওয়ার সমস্ত বিবরণ দিয়ে খালিদের কাছে এজাহার দিয়ে গিয়েছিলো। সে সম্পর্কে খালিদ কী হদিশ করতে পারলো কী পারলো না, তারই খোঁজ নিতে এসেছে সে।

    সেইদিনের সেই ঘটনার পর থেকে প্রতিনিয়ত খাতুন তাকে খোঁচাচ্ছে, শুধু তোমার জন্যে আজ আমার এই দশা হলো। তুমি যদি আমাকে ভয় না দেখাতে—অন্য মেয়ে ঘরে আনবে বলে, তাহলে তো আমি সেই পীরের দরগায় যাওয়ার জন্যে ঐ বদমাইশ বুড়িটার সঙ্গে পথে বের হতাম না। তুমি যদি সে-দিন আমাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত না করতে তা হলে এই সর্বনাশ আমার হতো না।

    খালিদকে দেখামাত্র সে জ্বলে ওঠে, কী খালিদ, সেই শয়তান বুড়িটার খোঁজ পেলে?

    খালিদ মাথা হোঁট করে থাকে। মুস্তাফা এবার গর্জে ওঠে, তুমি একটা অপদার্থ তোয়াল। সারা শহরটা চোর বদমাইশ-এর আস্তানা হয়ে গেলো, সে দিকে তোমার কোনও হুঁশ নাই। শুধু নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে! যেমন তোমার অপদার্থ পাহারা পেয়াদা তেমনি তোমার গোবর-ঠাসা মগজ। একেবারে অকস্মার টেকি। তা না হলে, সাত সকালে দিনের আলোয় খলিফার আমিরের বাড়িতে ঢুকে তার বিবিকে রাস্তায় বের করে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নেবার সাহস হয় কী করে ঠগ চোরদের? আমার যা লোকসান হয়েছে, তার জন্যে আমি একমাত্র তোমাকেই দায়ী করবো।–আর কাউকে জানি না আমি।

    তখন বুকে সাহস পেয়ে ঐ পাঁচ প্রতারিতও চিৎকার করে ওঠে, আমির সাহেব, আমাদের সকলের অবস্থাও ঠিক একই রকম। আমরাও সেই ধূর্ত বুড়ির ধাপ্লায় ভুলে যথাসর্বস্ব খুইয়েছি। তারই নালিশ করতে এসেছিলাম। আমরা এই কোতোয়ালের কাছে-আর্জি ছিলো ন্যায্য বিচার।

    -কীসের বিচার?

    তখন পাঁচজনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতারিত হওয়ার করুণ কাহিনী শোনালো তাকে। আমির মুস্তাফা গম্ভীর হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, হুম, তোমাদের দশাও দেখছি একই রকম। সবই এই কোতোয়ালের অকৰ্মণ্যতা—কোনও গুরুত্বই সে বুঝতে পারেনি।

    খালিদ বিনীত হয়ে বলে, আমির সাহেব, আপনার বিবির কাছে আপনি খাটো হয়ে যাচ্ছেন, এটা আমি বুঝি। আপনি খলিফার দরবারে এখন একজন জাঁদরেল আমির। এই সামান্য একটা ঠগ জোচ্চোরকে শায়েস্তা না করতে পারলে ইজৎ থাকে কী করে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমির সাহেব, আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, যেনি-তেন প্রকারে সেই শয়তান বুড়িকেই আমি ধরবোই।

    আমির তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বলে, তোমার কেরামতী আর দেখতে চাই না। আমি নিজেই এর ব্যবস্থা করছি। আচ্ছা শোনো, মুস্তাফা প্রতারিত পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমাদের মধ্যে কেউ আছ যে, ঐ বুড়িটাকে দেখলে চিনতে পারবে?

    সবাই সমস্বরে বলে, আমরা সকলেই তাকে চিনতে পারবো, হুজুর।

    গাধার মালিক বিশেষভাবে বলে, হাজারটা শয়তানীর মধ্যেও যদি সে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে, আমি তাকে এক নজরেই টেনে বার করতে পারবো। আমি বলি কি, হুজুর, আমার সঙ্গে আপনি মেহেরবানী করে জানা-দশোক সিপাই দিন। তারপর দেখুন, আমি তাকে আপনার কাছে হাজির করতে পারি কি না।

    সঙ্গে সঙ্গে দশজন সিপাই সঙ্গে দিয়ে ওদের পাঁচজনকে, শয়তান বুড়িটাকে পাকড়াও করে আনার উদ্দেশ্যে, পাঠানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুড়ির সন্ধানও তারা পেয়ে গেলো। ওদের দেখামাত্র উর্ধশ্বাসে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সিপাইরা তাকে ধরে ফেলে। পিঠামোড়া করে বেঁধে কোতোয়ালের কাছে নিয়ে আসে।

    কোতোয়াল খালিদ গর্জে ওঠে, চুরির মাল-পত্র সব কোথায় রেখেছে?

    ডিলাইলাহ অবাক হওয়ার ভান করে বলে, জীবনে আমি কারো একটা কুটো চুরি করিনি। বুঝতেই পারছি না, কেন আমাকে ধরে এনেছেন। আপনি?

    খালিদ ক্ৰোধে কাঁপতে থাকে, বুঝিয়ে আমি দিচ্ছি। এ্যাই, এই মেয়েছেলেটাই আজকের রাতের মতো কয়েদখানার আঁধার ঘরে বন্ধ করে রাখি।

    কিন্তু কয়েদখানার সর্দার বললো, আমাকে মাফ করবেন, হুজুর, আমি পারবো না?

    খালিদ চিৎকার করে ওঠে, কেন, কেন পারবে না?

    সর্দার বলে, এই বুড়ির ছলচাতুরী বড় মারাত্মক। সে যে কী ভাবে আমার লোকজনদের চোখে ধুলো দিয়ে হাওয়া হবে, তা কেউ জানে না। তাই আমি এতো বড় ঝুঁকি কাঁধে নিতে পারবো না, হুজুর।

    খালিদ গুম মেরে গেলো কিছুক্ষণ। তারপর পঞ্চ প্রতারিতদের প্রতি নির্দেশ করে বললো, ঠিক আছে, আজ সারারাত একে তোমরা সকলে মিলে পাহাড়া দেবে। তারপর কাল সকালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। চলো, বুড়িটাকে আমরা বাগদাদ শহরের সীমানার বাইরে গিয়ে একটা খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখি।

    খালিদ ঘোড়ায় চাপলো। সিপাইরা বুড়ি ডিলাইলাহকে টানতে টানতে নিয়ে চললো। শহরের প্রাচীর সীমা পার হয়ে একটা ফাঁকা জাযগায় একটা খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে ডিলাইলাহর চুল জড়িয়ে বাঁধা হলো। তারপরই পাঁচজন প্রতারিতকে পাহারায় মোতায়েন করে বাকী লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়াল ফিরে এলো তার বাড়িতে।

    সবাই মিলে, বিশেষ করে গাধার মালিক বুড়ির আদ্যশ্ৰাদ্ধ করতে লাগলো। যত রকম মুখ খারাপ করে গালাগাল, খিস্তি খেউর। সম্ভব—কিছুই বাদ করলো না।

    কিন্তু কতক্ষণ আর এইভাবে এক ঘেয়ে গালিগালাজ করে কাটানো যায়। গত কয়েকটা দিন বুড়ির সন্ধানে ঘুরে ঘুরে সকলেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। এদিকে রাত বাড়তে থাকে। ওদেরও চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। খানাপিনা শেষ করে নেয় সকলে। তারপর আর একদণ্ড তারা চোখ মেলে থাকতে পারে না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

    নিশুতি নিঃঝুম রাত। ডিলাইলাহকে বৃত্তাকারে ঘিরে পড়ে পড়ে নাক ডাকতে থাকে সেই পঞ্চ-প্রহরী। তখনও কিন্তু ধূর্ত বুড়ি জেগে। রাত আরও গম্ভীর হতে থাকে। হঠাৎ ডিলাইলাহ দেখলো, দুটি দস্যু ঘোড়ায় চেপে এইদিকে আসছে। রাতের নিস্তব্ধতায় ওদের অনুচ্চ আলোপও বেশ পরিষ্কার শুনতে পায় সে।

    একজন বলছেঃ আচ্ছা ভাইসোব এই সুন্দর বাগদাদ শহরে সব চাইতে মজার কাজ তুমি কী করেছে?

    রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    চারশো চুয়াল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

    -আল্লাহর দোয়ায় আমি আমার সব চাইতে পেয়ারের খানা বেশ পেট ভরে খেয়েছি। খুব খাটি মধু-মাখানো পিঠে আর মাখন আমার খুব প্রিয় খাদ্য। এখনও তার সুবাস নাকে লেগে রয়েছে।

    এই সময় তারা ডিলাইলাহর আরও কাছে এসে পড়ে।

    –কে তুমি? এখানে এসেছে কেন?

    ডিলাইলাহ গলায় মধু ঢেলে প্রার্থনার ভঙ্গীতে বলে, শেখ সাহেব, আপনারা আমাকে বাচন।

    আরব দস্যদের একজন বলে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান তাকে ডাকো। তিনিই একমাত্র রক্ষাকর্তা। কিন্তু এই খুঁটির সঙ্গে কে তোমাকে বেঁধে রেখেছে?

    –তা হলে আমার দুঃখের কাহিনী শুনুন মুসাফির, আমার একটি দুশমন আছে। সে মধু দিয়ে পিঠে আর মাখনের মিঠাই বানাতে ওস্তাদ। সারা বাগদাদ শহরে এইজন্যে তার খুব নাম-ডাক। তার মতো জিভে জল আনা মধু আর সরের মিঠাই আর কেউই বানাতে পারে না। এই লোকটা আমাকে একদিন খুব মারধোর করেছিলো। তারই প্রতিহিংসায় জ্বলছিলাম আমি। ওর দোকানে গিয়ে মিঠাই মণ্ডার বারকোষে থুথু ছিটিয়ে দিলাম। কোতোয়ালের কাছে সে আমার নামে নালিশ করেছিলো। তারই সাজা হিসেবে সে আমাকে এই খুঁটিতে বেঁধে রেখে গেছে। একমাত্র একটা শর্তেই সে আমাকে খালাস দিতে পারে। সে হলো কোতোয়ালের সামনে দশখানা থালা-ভর্তি মধু-পিঠা খেতে হবে। যতদিন আমি তা খেতে না পারবো, ততদিন আমাকে এইভাবে সাজা পেতেই হবে। সকাল হতে না হতেই কাল আমার সামনে দশথালা মধু-পিঠা এনে ধরা হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন শেখ সাহেব, কোনও মিঠাই-এর গন্ধ আমি বরদাস্ত করতে পারি না। বমি এসে যায়। বিশেষ করে ঐ মধুর পিঠা দেখা মাত্র আমার কাঁপুনী দিয়ে জ্বর আসে। অথচ ভাবুন, ঐ অখাদ্য খাবার একটা দুটো নয়, দশ-দশ থালা আমাকে উদারস্থ করতে হবে। তবে আমি ছাড়া পাবো! ইয়া আল্লাহ, আমার কপালে আরও কদিন এই সাজা লেখা আছে একমাত্র তুমিই জান। না খেয়ে খেয়ে একদিন এখানেই আমাকে শুকিয়ে মরতে হবে।

    বাদাবী-দস্যু টোপ গিললো, আমরা আরব, তুমিও আরব। তোমার দুঃখে আমাদের বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমরা বাগদাদ শহরের নামজাদা মধু-পিঠের লোভেই এখানে এসেছি। আর সেই পিঠের গন্ধ তুমি সহ্য করতে পার না? যাই হোক, তোমার কষ্ট দেখে আমাদেরও খুব খারাপ লাগছে। যদি চাও, তবে তোমার হয়ে আমরা তোমার পিঠেগুলো উদারস্থ করতে পারি।

    কিন্তু ওরা তো আপনাদের তা খেতে দেবে না। কোতোয়ালের হুকুম আছে, শহরের বাইরে একটা খুঁটিতে বাধা আছে যে, তাকে খাওয়াতে হবে দশথালা মধুর পিঠা। মধু-পিঠা যদি খেতে চান তবে এই খুঁটিতে বাঁধা থাকতে হবে।

    বাদাবীদের একজন অপরজনকে বললো, আমি তো অনেক মধুর পিঠে খেয়ে পেট ডাই করে এসেছি। আমি চলি, তুমি বরং খাও।

    সে চলে গেলো। অন্য বাদাবীটা তখন বললো, কিন্তু আমি যদি তোমার জায়গায় বাধা হয়ে থাকি, তবে তো, কাল সকালে কোতোয়ালদের লোক এসে আমাকে দেখে চিনে ফেলবে। তারা ভাববে, মেয়েছেলেটা গেলো কোথায়?

    ডিলাইলাহ বললো, আমিও সে-কথা ভেবেছি। শুনুন, আপনি আপনার সাজপোশাক আমাকে দিন, আর আমি আমার এই সাজপোশাক আর বোরখা আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। বোরখায় তো আপনার সর্বাঙ্গ ঢাকাই থাকবে। ওরা চিনবে কী করে—আপনি পুরুষ না মেয়ে?

    বাদাবী বললো, হুঁ, ঠিক বলেছো।

    তারপর দুজনে পরস্পরের সাজপোশাক বদলে নিলো। বাদাবীর পোশাক পরে ডিলাইলাহ ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে বসে। আর বাদাবী ডাকাতটা বোরখা পরে সেই খুঁটিটার সঙ্গে নিজেকে, শক্ত করে বাঁধে।

    সকাল হতে পঞ্চ-প্রহরীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। গাধার মালিক এগিয়ে গিয়ে বন্দীকে প্রশ্ন করে, কী গো বুড়ি, তোমার ঘুমটুম কেমন হলো?

    বাদাবীটা তার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে হেঁড়ে গলায় প্রশ্ন করে, মেরা পিঠা কঁহা, পিঠা লে আও।

    —এ্যাঁ! এ যে পুরুষ মানুষের গলা! একি হলো?

    গাধার মালিক প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, এখানে তুমি কী করছো? আর ঐ বুড়িটাকেই বা ছেড়ে দিলে কেন?

    কিন্তু বাদাবী দস্যু সে কথার জবাব দেয় না। তার সেই এক কথা। আমার পিঠে কোথায়, জলদি নিয়ে এসো। আমার বডড খিদে পেয়ে গেছে। সারাটা রাত আমার কিছুই খাওয়া হয়নি। সুতরাং ঝটপট নিয়ে এসো।

    গাধার মালিক তবু প্রশ্ন করে, বুড়িটা গেলো কোথায়?

    —তাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। সে তো মধু-পিঠে খেতে পারবে না। খামোকা তাকে আটকে রেখে কী লাভ? তাই আমি তাকে খালাস করে দিয়েছি।

    পঞ্চ-প্রতারিত বুঝতে পারে, এই দুর্ধর্ষবাদাবী ডাকাতকেও বুড়িটা প্রতারণার ফাঁদে আটকে রেখে হাওয়া হয়ে গেছে। ওদের চোখে মুখে হতাশার করুণ ছবি ফুটে ওঠে। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, আল্লাহ যাকে ছেড়ে দেবে, মানুষ তাকে কী বেঁধে রাখতে পারে?

    এরপর কী করা যায়, কী তারা বলবে কোতোয়ালের কাছে, তাই ভেবে সবাই তখন আকুল। এমন সময় ঘোড়ায় চেপে কোতোয়াল এসে হাজির হলো সেখানে। তার সঙ্গে একদল সশস্ত্ব সিপাই।

    বাদাবী তখন কোতোয়ালকে উদ্দেশ্য করে হুঙ্কার ছাড়ে, কই, আমার মধুর পিঠে কোথায়?

    খালিদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার, এ সব কী? বুড়িটা কোথায় গেলো? এ তো একটা দামড়া।

    পঞ্চ-প্রহরী মাথা চুলকায়, বলে, এই হচ্ছে নসীব। ঐ ধূর্ত বুড়িটা এই বাদাবীকে বোকা বানিয়ে এখানে বেঁধে রেখে সে তার ঘোড়া নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। আপনার দোষেই সে আজ পালিয়ে গেলো। চলুন, আপনাকে আমরা খলিফার দরবারে নিয়ে যাবো। আপনি যদি জনকয়েক সিপাই আমাদের সঙ্গে দিতেন, সে তো এইভাবে পালাতে পারতো না। সুতরাং এর জন্যে একমাত্র আপনিই দায়ী। আপনি কী ভেবেছিলেন, আমরা আপনার কেনা গোলাম? সারারাত জেগে আপনার হুকুম তামিল করবো?

    তখন খালিদ বাদাবীকে জিজ্ঞেস করে, ব্যাপার কী বলে তো? তুমি এখানে এলে কী করে?

    বাদাবী-দস্যু সমস্ত কাহিনী খুলে বললো তাকে।

    —আমাকে সে বলেছে, এখানে এই খুঁটিতেই বাঁধা থাকলে সকাল বেলায় থালা-থালা ভর্তি মধু-পিঠে আর মাখন পিঠে খেতে পাওয়া যাবে। তা সকাল তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। কোথায়, আমার পিঠে কোথায়, নিয়ে এসো।

    বাদাবীর কথা শুনে খালিদ আর তার সিপাইরা হেসে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু পঞ্চ প্রতারিতরা রাগে গরগর করতে থাকে।

    —ওসব হাসি-টাসি রাখুন। এখন খলিফার কাছে যেতে হয়ে আপনাকে। আমরা এর একটা বিহিত চাই।

    বাদাবীটা তখন তড়পাতে থাকে, এখনও বলছি, ওসব ধোঁকাবাজী ছাড়ো, মধু-পিঠা নিয়ে g[तीं।

    কিন্তু তার কথায় কেউ-ই কৰ্ণপাত করলো না। সবাই শুধু হাসতে থাকে। অবেশষে বাদাবী বুঝতে পারে, ঐ বুড়িটা তাকে ধোঁকা দিয়ে তার সাজ-পোশাক আর ঘোড়াটা নিয়ে কেটে পড়েছে। মধু-পিঠা আর মাখন-পিঠার গল্প—সব বানানো।

    খালিদ দেখলো, মামলা বড় জটিল আকার ধারণ করছে। এ অবস্থায় কানে তুলো দিয়ে বসে থাকলে ভবিরা ভুলবে না। তাই সে বাধ্য হয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে খলিফার দরবারে এসে হাজির হয়।

    রাত্রি শেষ হতে চলেছে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশে পায়তাল্লিশতম রজনী। শাহরাজাদ। আবার কাহিনী শুরু করে :

    খলিফার সাক্ষাৎ মঞ্জুর হলো। খালিদ তার দলবল নিয়ে দরবার-কক্ষে প্রবেশ করে। খলিফা হারুন অল রসিদ তখতে আসীন। তার একপাশে দেহরক্ষী মুস্তাফা দণ্ডায়মান। উজির আমিরে ঠাসা পরিপূর্ণ দরবার মহল।

    খলিফা নিজেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি সেই গাধার মালিককে জেরা করতে শুরু করলেন। এবং শেষ করলেন কোতোয়াল খালিদকে দিয়ে। প্রত্যেকে যে-যার কাহিনী বলে গেলো। খলিফা হারুন অল রসিদ বিষম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

    —তাজ্জব কাণ্ডকারখানা! যাইহোক, আবার পূর্ব-পুরুষদের সুনাম যাতে রক্ষা হয়, সে-জন্য যার যা খোয়া গেছে সবই পূরণ করে দেওয়া হবে আমার ধনাগার থেকে। গাধার মালিক তার গাধা পাবে। সওদাগর পাবে হাজার দিনারের বটুয়া, রঙের কারবারীর দোকানের যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করে দেবো আমি। ইহুদী জহুরীর সোনাদানা যা গেছে, তাও সে পাবে। নাপিতের জন্য একটা দোকান তৈরি করে দেওয়া হবে, আর এই বাদাবী—সেও ফেরত পাবে তার সাজ-পোশাক এবং একটি আরবী ঘোড়া। এ ছাড়াও তাকে দিতে হবে দশখানা থালা-ভর্তি বাগদাদের বিখ্যাত মধু-পিঠা। খেয়ে যাতে তার প্রাণ ভরে যায়। কিন্তু সবার আগে আমার হুকুম—সেই বুড়িটাকে আমার সামনে হাজির করতে হবে। শোনো খালিদ এবং মুস্তাফা, তোমরা এখন বেরিয়ে পড়। আজ সন্ধ্যার আগে সেই বুড়িকে এখানে ধরে নিয়ে এসো। তারপর আজ রাতে আমার এইখানেই খানা-পিনা করবো। কিন্তু খালি হাতে ফিরবে না। মনে রেখে রাতের খানা তোমাদের এখানেই খেতে হবে। যাও, এই আমার হুকুম।

    আমির খালিদ প্রমাদ গুনলো। খলিফার এই কথার অর্থ সে ভালোভাবেই জানে। নিজের ক্ষমতা জানিয়ে সে নিস্কৃতি চায়, আমাকে রেহাই দিন, জাঁহাপনা। এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। ঐ ধূর্ত শয়তানীকে কাজায় আনা আমার কম্মো নয়। ও যে কী-ভাবে কখন চোখে ধুলো দিয়ে বুড়বাক বানিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে তা কল্পনারও অতীত। মেহেরবানী করে এ ভার আপনি অন্য কাউকে দিন। আমি পারবো না।

    খলিফা হো হো করে হেসে উঠলেন। —তাহলে আর কোতোয়াল হয়ে বসে থেকে কী করবে। অন্য কোনও কাজ দিতে হবে তোমাকে, কী বলো?

    খালিদ বলে, ধর্মাবতার! আপনার সুযোগ্য দক্ষিণ হস্ত শহরের সেরা সিপাই-প্রধান আহমদকেই এই দায়িত্ব দিন। আমার মনে হয় তার চোখে ফাঁকি দিয়ে সে বুড়ি নিস্তার পাবে না। তার বিচক্ষণতা এবং বেতন আমার চেয়ে অনেক বেশি। এ কাজ তারই উপযুক্ত। এতোদিনে সে শুধু আপনার কাছ থেকে দামী দামী উপহার মোটা অঙ্কের ইনাম নিয়ে আসছে। কাজের নমুনা কিছুই দেখায়নি। এবার তাকে এই ভারটা দিন, জাঁহাপনা। তারপর বোঝা যাবে তার এলেম।

    খলিফা মাথা নাড়লেন, ঠিক, ঠিক বলেছে খালিদ। কই, আহমদ, এদিকে সামনে এসে দাঁড়াও।

    তৎক্ষণাৎ আহমদ খলিফার সামনে এসে আভূমি আনত হয়ে কুর্ণিশ করে দাঁড়ালো।—মহামান্য ধর্মাবতার, আপনার আজ্ঞা আমার শিরোধাৰ্য, আদেশ করুন, জাঁহাপনা!

    —শোনো আহমদ, খলিফা বলতে থাকেন, ধূর্ত ঠগ বুড়ি মেয়েছেলে এই বাগদাদ শহরের নিরীহ মানুষকে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে। সে-সব কাহিনী তুমিও নিশ্চয়ই এখানে শুনেছো। এখন আমার কথা হচ্ছে, এ ধরনের ব্যাপার আমার শহরে চলতে দিতে পারি না। আমি তোমাকে ভার দিচ্ছি, যে ভাবে পারো আজই ঐ মেয়েছেলেটাকে আমার সামনে হাজির কর।

    আহমদ আর বিলম্ব করলো না। চল্লিশজন সিপাই ঘোড়-সওয়ার নিয়ে সে শহরের পথে বেরিয়ে পড়লো। বাদাবী দাসু এবং সেই পঞ্চ প্রতারিতরা দরবারেই রয়ে গেলো।

    আহমদের প্রধান সাগরেদ চল্লিশ সিপাই-এর সর্দার আলী। এইসব তল্লাসী এবং গ্রেপ্তারে মহা-ওস্তাদ। তার প্রধান কারণ এক সময়ে সে-ও চোর ডাকাত দলের পাণ্ডা ছিলো। আটঘাট তার সবই নখদর্পণে। সে বললো, আহমদ সাহেব ঐ বুড়িকে পাকড়াও করা খুব একটা সহজ কাজ হবে মনে করবেন না। সারা বাগদাদে অমন হাজার-হাজার বুড়ি মেয়েছেলের দেখা পাবেন আপনি। তার মধ্যে কে যে শয়তানী কী করে ধরবেন? আহমদ পাল্টা প্রশ্ন করে, তাহলে কী করবে, ভাবছো?–আমার মনে হয় কী জানেন, এ বিষয়ে হাসান সাহেবের যুক্তি-পরামর্শ নিলে ভালো হতো। তাঁর মাথায় অনেক ভালো বুদ্ধি খেলে। এই ধরনের ধূর্ত শয়তান ঠগদের সেই কাবু করতে পারবে। কারণ আমরা বরাবরই ডাকাতি রাহাজানি ছিনতাই লুঠপাঠ করে কামিয়েছি, আর হাসান সাহেব তো পয়সা কামিয়েছেন লোককে ধোঁকা দিয়ে, ঠকিয়ে, চালাকী করে, বুদ্ধি খাটিয়ে। সুতরাং এ ব্যাপারটা তিনিই ভালো রপ্ত করতে পারবেন।

    –না না না, আহমদ প্ৰায় চিৎকার করে ওঠে, এতোবড় নাম কেনার সুযোগ যখন আমার কপালে জুটেই গেছে সে সৌভাগ্যের বখরা আমি অন্য কাউকে দিতে চাই না।

    এই সময় তারা চলতে চলতে হাসানের বাড়ির সামনে এসে পড়েছিলো। কিন্তু আহমদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। সে গলা ফাটিয়ে তখনও বলে চলেছে, একটা বুড়িকে পাকড়াও করা এমন কী শক্ত কাজ! অথচ তার জন্যে দরবারে আমার কী ইজ্জত বাড়বে একবার ভাবে তো! আর এই জিনিসের ভাগ দেবো। আমি হাসানকে? সে কখনো হতে পারে না।

    আহমদের অশ্বারোহী বাহিনীর খুরধ্বনি শুনে সে জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। সেখান থেকেই সে আহমদের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো। মনে মনে ভাবলো, ঠিক আছে আহমদ, তুমি আজ খলিফার বড় পেয়ারের লোক হয়েছে। কিন্তু আমারও নাম হাসান, দেখি তোমার দৌড় কতদূর।

    শহরের মাঝখানে এসে আহমদ তার সেপাইদের চারভাগে বিভক্ত করে শহরের চারদিকে অনুসন্ধান করতে পাঠিয়ে দিলো। বললো, তোমরা তল্লাসী চালিয়ে সবাই মুস্তাফার বাড়ির গলির মুখে চলে আসবে সবাই। আমি সেখানে অপেক্ষা করবো।

    নিমেষের মধ্যে সারা শহরময় রটে গেলো; আহমদের সিপাইরা শহরেরবাড়ি বাড়ি খানাতল্লাসী করে সেই ধূর্ত বুড়িকে গ্রেপ্তার করতে বেরিয়েছে। কথাটা ডিলাইলাহ জাইনাবের কানে পৌঁছতেও দেরি হয় না। জাইনাব বলে মা, এখন কী উপায় হবে?

    ডিলাইলাহ বলে, ঘাবড়াসনে বেটা, কিছু ভয় নাই। আমি খবর পেয়েছি, আহমদের সঙ্গে হাসান নাই। সে একা তার দলবল নিয়ে বেরিয়েছে। এই আহমদটা একটা মাথা-মোটা। ঘটে এক ফোটা বুদ্ধি নাই, ওকে আমি আদৌ ডরাই না। হ্যাভয়ের কথা হতো, যদি হাসান ওর সঙ্গে থাকতো। লোকটা মহা ঠগবাজ। আর লোক ঠকাতে গেলে মগজে বুদ্ধি ধরতে হয়। তা তার আছে। সেইজন্যেই ওকে আমার ভয় ছিলো। খলিফা। যদি আমাকে পাকড়াও করার জন্য হাসানকে ভার দিত, আমি বলতে পারি। আমাকে সে গ্রেপ্তার করতে পারতো। কিন্তু আহমদের চৌদ্দ পুরুষেরও সাধ্যি হবে না, আমাকে কাজ করতে। তবে আজকে আমার শরীরটা ভালো নাই বাছা, আমি আর পথে বেরুবো না। এক কাজ কর, আজ তুই একটু খেল দেখিয়ে দে ওদের। প্রমাণ করে দে দেখি, মা-এর চেয়ে মেয়ে কিছু কমতি যায় না! ঐ চল্লিশটা সিপাইকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যা তারা জীবনে ভুলতে পারবে না। কী, পারবি না?

    জাইনাব হাসে, তোমার দেয়া থাকলে কোন কাজ আটকায়, মা? রাত্রি শেষ হয়। অন্ধকার কেটে আসে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো ছেচল্লিশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে :

    জাইনাবের শরীর খানা সাপিনীর মতো লকলকে। গভীর আয়ত টানাটানা চোখ, সুন্দর মুখের গড়ন, উদ্যত বুক, সরু কোমর, ভারী নিতম্ব। এক কথায় কামনার বহ্নিশিখা। খুব জমকালো সাজ-পোশাকে সাজগোজ করলে সে। আর খুব পাতলা রেশমী বোরখায় ঢাকিলো তার অঙ্গ। বলা যায়, আরও বেশী করে দেখাবার জন্য, প্রলুব্ধ করার জন্যই এই ঢাকনা পরলো সে। এই রকম মোহিনী মূর্তি ধরে মায়ের কপালে চুমু খেয়ে সে বললো, মা আমার এই কুমারী যৌবনের কসম খেয়ে তোমাকে বলছি, ঐ চল্লিশটা সিপাইকে আজ আমি বাঁদর নাচ নাচাবো, তবে ছাড়বো।

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে সোজা মুস্তাফার বাড়ির দিকে রওনা হলো। মুস্তাফার বাড়ির কাছাকাছি মসুলের হজ করিমের শরাবখানা। দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলো সে। জাইনাব মিষ্টি করে হাসির বান ছুঁড়লো তার দিকে।

    হজ করিম ধন্য হয়ে গেলো। সে বারবার মাথা হেলিয়ে তাকে স্বাগত জানাতে থাকলো। জাইনাবি কাছে এগিয়ে গিয়ে হজ করিমের হাতে পাঁচটা দিনার গুঁজে দেয়।

    —এই পাঁচটা দিনার রাখুন করিম সাহেব। আমি আপনার বড় ঘরটা এক দিনের জন্য ভাড়া নিচ্ছি। আমার কিছু ইয়ারদোস্তারা ফুর্তি করতে আসবে।সেইজন্যে আপনার কাছে আমার আর্জি, এই একটা দিনের জন্য আপনি আপনার উটকো খদেরদের ঢোকাবেন না। আপনার কোনও লোকসান হবে না, সে ভরসা আপনাকে দিচ্ছি।

    হজ করিম বললো, শুধু আপনার জন্য, আপনার ঐ সুন্দর চোখের জন্য আমি আপনাকে মাঙনায় ঘরখানা ছেড়ে দিচ্ছি। শুধু আমার একটা অনুরোধ, আপনার মেহেমানদের আপ্যায়ন করার জন্য শরাব খাওয়াতে কাপণ্য করবেন না।

    জাইনাব হেসে বলে আমার দোস্তারা এক একটা মদের পিপে। শরাবে তাদের অরুচি নাই।

    আপনার দোকানে যত মন্দ আছে সবই সাবাড় করে দেবে তারা।

    এই বলে জাইনাব আবার নিজেরবাড়ি ফিরে যায়। সেখানে বাধা ছিলো সেই ছেলেটার গাধা আর বাদাবীর ঘোড়া। সে ভাড়া নিয়ে তাদের পিঠে বোঝাই করে গালিচা, আসন, তাকিয়া, পেয়ালা, পিরিচ এবং অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম। তার পর আবার ফিরে আসে হজ করিমের শরাবখানায়।

    সে খুব কায়দা করে সরাইখানার সদর দরজা থেকে আরম্ভ করে ভিতরের ঘর পর্যন্ত চমৎকারভাবে সাজায়। ঘরের মেজেয় দামী গালিচাখানা বিছিয়ে দেয়। আর বড় বড় মদের বাহারী ঝারি বসিয়ে দেয় সদর দরজায় দুইপাশে। তার সঙ্গে নানারকম লোভনীয় বাদশাহীখানার রেকবীও থরে থরে সাজিয়ে রাখে। সেখানে। নিজেও দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই আহমদের দশজন অশ্বারোহী সিপাই এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে আহমদের প্রধান সাগরেদ আলীও ছিলো। তার সাজগোজ একেবারে জাঁদরেল সেনাপতির মতো। নজন অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে সে শরাবখানার ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে, ক্ষিপ্র হাতে জাইনাব তার মুখের নাকাব সরিয়ে দেয়। আলী অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়, তুমি এখানে কী করছে খুকি?

    আলীর শরীরে রক্ত চনমান করে ওঠে। মেয়েটার দেহে যাদু আছে। জাইনাব বলে, আপনিই কী কাপ্তান আহমদ?

    —খোদা হাফেজ, না। আমি নই। কিন্তু আমি ওই সিপাইদলের সেনাপতি। আমার নাম আলী। তাঁ, আহমদকে খুঁজছো কেন? শোনো সুন্দরী, তোমার জন্য আমি যা করতে পারি, স্বয়ং আহমদ তা করতে পারবে না। বলো তোমার কী চাই?

    জাইনাব ফিসফিস করে বলে, আপনিই তো জাঁদরেল, কেন পারবেন না। আপনি? নিশ্চয়ই পারবেন। তা এখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? চলুন ভিতরে চলুন। একটু আরাম করবেন।

    জাইনাব দশজনকেই সঙ্গে করে বড় ঘরের ফরাশে নিয়ে গিয়ে বসায়। গোল হয়ে বসে সকলে। তাদের ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট বড় মদের ঝারি বসিয়ে দেয় সে। এই ঝারির শরাবে সে মিশিয়ে রেখেছিলো এক ঢেলা আফিং। পর পর দু পোয়ালা পেটে যেতেই বাছাধনীরা এ ওর গায়ে ঢলে পড়লো। তারপর পালকের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো তারা। জাইনাব তাদের পা ধরে হিডি হিডি করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো খিডিকীর দরজায়। দরজা খুলে ওদের গড়িয়ে দিলো কদমাক্ত নোঙরা আস্তাবলে। এইভাবে এক এক করে সবাইকে টেনে নিয়ে এসে সে গাদা করে রাখলে সেখানে।

    এরপর আবার সে ফরাশ-টরাশ ঠিকঠাক করে ঝেড়ে-পুছে আবার এসে দাঁড়ালো সদর দরজার পাশে। কিছুক্ষণ বাদে আরও দশজন আহমদের সিপাই এসে দাঁড়ায় সেখানে। ঠিক একই কায়দায় তাদেরও কুপোকাৎ করে একইভাবে শরাবখানার পিছনে গাদা দিয়ে রেখে দেয় সে। এইভাবে তৃতীয় এবং চতুর্থ বাহিনীর কুড়িজনকেও সে চোখের বাণ মেরে, আফিং-মেশানো মদ খাইয়ে অচৈতন্য করে শরাবখানার পিছনে গাদা করে রেখে আসে।

    জাইনাব আবার ঘরটা সাজিয়ে গুছিয়ে সদরে এসে দাঁড়ায়। আসল মক্কেল এখনও আসেনি। কিন্তু জাইনাব জানে, ফাঁদ যখন সে পেতে বসে আছে, আসতে তাকে হবেই।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকট হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে দাঁড়ালো সে। তার চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলছিলো। চোয়াল পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠেছিলো। ইয়া বড় হাতের চাবুকখানা বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে ঘোরাতে সে গর্জে ওঠে, কোথায় সেই সব কুত্তার বাচ্চাগুলো।

    ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো আহমদ। শরাবখানার দেয়ালের একটা গজালে লটকে দিলো লাগামটা। —আমি তাদের তো এই রাস্তার মুখটায় জড়ো হয়ে থাকতে বলেছিলাম। তা শরাব-এর লোভ আর ছাড়তে পারেনি বেল্লিকরা। একেবারে নেশায় বুদ হয়ে গেছে।

    জাইনাব দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে এমন মায়াবিনীর হাসি হাসে, তার টাল আর সামলাতে পারে না বেচারা আহমদ। ওর চোখ দুটো চেটে চেটে খেতে থাকে জাইনাবের কামলোভাতুর শরীরখানা। তাক বুঝে জাইনাবের সরু কোমরখানা দুলে ওঠে। তার ভারী নিতম্ব আর কচি কদু-সদৃশ স্তনদুটি আহমদের বুকের রক্তে তুফান তুলে। চোখের বিদ্যুৎ হেনে জাইনাব এক অপূর্ব লাস্যময়ী ঢং করে জিজ্ঞেস করে, কার কথা বলছেন, মালিক?

    আহমদের অবস্থা তখন সপ্তমে। বুকের রক্তে নাচন ধরেছে। মাথা বিমঝিম করছে, সারা শরীর কেমন শিরশির করছে।

    জাইনাব তখন দুই পা ফাঁক করে এমন একটা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী করে দাঁড়িয়েছে যা দেখে আহমদের সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। কোনও রকমে বলতে পারে, আমার চল্লিশজন সিপাই এখানে আসার কথা ছিলো, কিন্তু সুন্দরী, আমি বুঝতে পারছি না, তারা এখনও এলো না কেন? কিম্বা এসে তোমার দোকানে ঢুকে মদ গিলতে শুরু করেছে কিনা?

    জাইনাব একদম সামনে নেমে এসে আহমদের হাত ধরে ওপরে তুলতে তুলতে বলে, আপনি ভিতরে বিশ্রাম করুন। আপনার চল্লিশজন সিপাই-ই এসেছিলো। আপনার জন্যে অপেক্ষাও করছিলো। হঠাৎ ওরা দেখতে পেলো, রাস্তার ওপাশ দিয়ে ডিলাইলাহ বুড়ি হন।হন। করে পালাচ্ছে। তাই সবাই তার পিছনে ধাওয়া করেছে। আপনার প্রধান সাগরেদ। আলীসাহেব আমায় বলে গেছেন, আপনি আসবেন। আপনি এলে যেন আপনাকে খুব আদর-আপ্যায়ন করি, তাও আমাকে হুকুম করে গেছেন। আর এও বলে গেছেন, ডিলাইলাহর জন্য আপনি যেন বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেন। একবার যখন তার হদিশ করতে পেরেছে, ধরে তাকে নিয়ে আসবেই আপনার কাছে। শুনলেন তো সব, এবার তা হলে চলুন, ভিতরে গিয়ে আরাম করে বসবেন। তারপর একটু পরেই বামাল সুদ্ধ এসে হাজির হবে আপনার লোকজন।

    মন্ত্রমুগ্ধ মানুষের মতো আহমদ জাইনাবের কাঁধে ভর দিয়ে শরাবখানার ভিতরে ঢুকে পড়ে। জাইনাবা ওকে বড় ঘরের ফরাশে নিয়ে গিয়ে বসায়। আহমদের রক্তে তখন আগুন ধরে গেছে।

    –শরাব লে আও।

    জাইনাব পেয়ালা ভরে সেই আফিং মেশানো মদ এনে আহমদের মুখে ধরে। এক চুমুকেই সাবাড়া করে দেয় সে। আর এক পেয়ালাও খেয়ে ফেলে। তারপরই ক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায়। জোর করে চোখ খুলে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে দু-একবার। হাত দু’খানা বাড়িয়ে দিয়ে জাইনাবকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। প্রায় অস্পষ্ট জড়ানো কণ্ঠে মিনতি করে ডাকে, আমার বুকে এসো গো সুন্দরী, তোমাকে গড়িয়ে দেবো-সাতনরী হার—

    ওর কথা আর শেষ হয় না। জাইনাব নিজেকে সরিয়ে নেয়। আহমদের বিপুল বিশাল দেহখানা এলিয়ে পড়ে যায় ফরাশে। আহমদ-এর গায়ে অনেক রত্নাভরণ ছিলো। এক এক করে সব সে খুলে নেয়—এমন কি তার দামী সাজ-পোশাকটা পর্যন্ত। শুধু একটা ইজার রেখে দেয় তার কোমরে। তারপর একই কায়দায় টানতে টানতে নিয়ে যায় খিডিকীর ওপারে। তার অনুচর চল্লিশজনের গাদার উপর চাপিয়ে দেয় তার দেহটাও।

    এরপর যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে বেঁধে নিয়ে খিড়কীর ওপাশে বেঁধে রাখা সেই গাধা আর ঘোড়াটার পিঠে চাপিয়ে সোজা বাড়ির পথে পাড়ি দেয়। জাইনাব।

    মেয়ের কীর্তি শুনে মা ডিলাইলাহর আর আনন্দ ধরে না।

    –এই না হলে আমার মেয়ে। ধন্যি আমি, তোকে গভূভে ধরেছিলাম বেটি!

    এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো সাতচল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :

    আহমদ আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা পুরো দুটো দিন পড়ে পড়ে ঘুমালো। তৃতীয় দিনের সকালে যখন তারা জাগলো, প্রথমে বুঝতেই পারলো না, কোথায় তারা পড়ে আছে। কিছুক্ষণ বাদে ঘুমের জড়তা কেটে গেলে একে একে সবই মনে পড়তে থাকলো। লজ্জায় ক্ষোভে দুঃখে কারো মুখে আর কোনও কথা নাই। সবাই মাথা নিচু করে বসে থাকে। কারো পরণেই পোশাক-আশাকের কোনও বালাই নাই। একটি মাত্র ইজার ছাড়া সবই, লোপাট হয়ে গেছে। এখন এই প্রায় ন্যাংটো অবস্থায় তারা পথেই বা বের হবে কী করে। সেই চিন্তাতেই সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে হাসানকে তাদের দলে নেওয়া হয় নি। এ দশা দেখলে এখন সে টিটকারি দিতে কসুর করবে?

    কিন্তু উপায়ই বা কী? অগত্যা আহমদ ঐ অবস্থাতেই দলবল নিয়ে রাস্তায় নামলো। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। তা পড়বি তো পড়-একেবারে সেই হাসানেরই সামনে পড়ে গেলো তারা। পলকেই বুঝে নিলো সে ব্যাপারখানা। আনন্দে সে আত্মহারা হয়ে গান গেয়ে ওঠলো। কিন্তু ভাবখানা এই—যেন সে কিছুই লক্ষ্য করেনি।

    ডবকা ছুঁড়ি ভাবে মনে, সব পুরুষই এক
    কারণ পাগড়ী পরে মাথায়, সবাই সাজে শেখ
    কিন্তু সে কি জানে, কেউ বা তাদের গেয়ো ভূত কেউ বা কেতায় চোস্ত;
    কেউ বা তাদের সফেদ গোরা জ্ঞান গরিমায় শ্রেষ্ঠ,
    আবার কেউ বা তাদের হাঁদা বোকা উজবুক ভোঁদড়
    গড়ুরের মতো সুন্দর কেউ; আবার কেউ শকুনের দোসর।

    গান শেষ করার পর সে চমকে ওঠার ভান করে। যেন এতক্ষণ আহমদকে আর তার ধনুর্ধরদের নজরই করেনি। সে।

    খোদা মেহেরবান, একি জাঁদরেল আহমদ ভাই; আজ এই সাত সকলে একি দৃশ্য দেখতে হলো আমাকে।

    আহমদ বলে, হাসান তুমি বড় রসিক। তবে জেনে রাখো কেউই নিয়তি এড়াতে পারে না। নসীবে যা লেখা আছে তা খণ্ডন করবে। কী করে? একটা সামান্য মেয়ের পাল্লায় পড়ে। আজ আমাদের এই হাল, ভাবতে পারো? একেবারে বুড়বাক বানিয়ে দিয়েছে আমাদের। চেন তুমি তাকে?

    হাসান বলে, আমি তাকে চিনি, তার মাকেও চিনি। ওদের দু’জনকে ধরে এনে দিতেও পারি। দেখতে চাও?

    আহমদ অবাক হয়, সে কী করে সম্ভব?

    –সম্ভব। সবই সম্ভব। কী করে যে সম্ভব হতে পারে তা তোমাকে আমি দেখিয়ে দিতে পারি মাত্র একটি শর্তে।

    –কী শর্ত?

    —তুমি শুধু খলিফার কাছে অক্ষমতা জানিয়ে বলবে তোমার হিম্মতে কুললো না। ওদের তুমি পাকড়াও করতে পারবে না এবং তুমি আমার হয়ে ওকালতী করে খলিফাকে বলবে, হুজুর হাসানের ওপর দায়িত্ব দিন, সে এর বিধি ব্যবস্থা করতে পারবে।

    হাসানের পরামর্শ মতো আহমদ তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদে আসে। সাজ-পোশাক পরে মাথা হোঁট করে সে খলিফার সামনে দাঁড়ায়।

    খলিফা প্রশ্ন করেন, সেই বুড়িটা কোথায়? তাকে ধরে এনেছো?

    আহমদ মাথা চুলকায়, দোহাই ধর্মাবতার, আমার অপরাধ নেবেন না, এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। আপনি হাসানকে এ কাজে বহাল করুন, ও আপনার সামনে হাজির করে দেবে। তাকে। এসব কাজ ও-ই আমার চেয়ে ভালো বোঝে। ও শুধু ঐ ধূর্ত বুড়িকেই ধরে আনতে পারবে না, সারা শহরের যত ঠগ জোচ্চোর-সবাইকে সে শায়েস্তা করে দিতে পারবে।

    খলিফা প্রশংসার দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকান, তাই নাকি হাসান? ওই বুড়িকে তুমি চেন? তোমার কী ধারণা, ঐ বুড়িটা শুধু মাত্র আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে এতো সব

    বিচিত্র কাণ্ডকারখানা করে চলেছে?র

    —আপনি যথার্থই বলেছেন, ধর্মাবতার। তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই।

    খলিফা অবাক হয়ে বলেন, তোমার কথা যদি সত্যি হয়। হাসান, তবে জেনে রাখ, আমি আমার পূর্বপুরুষদের নামে কসম খেয়ে বলছি, যে সব টাকা পয়সা গহনা-পত্র এবং অন্যান্য সামগ্ৰী সে লোক ঠকিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে, সেগুলো যদি সব আবার ফেরত দিয়ে দেয়, তা হলে, তার সব গুনাহ। আমি মাফ করে দেবো।

    হাসান বললো, আপনার জবান যে সাচ্চা—তার প্রমাণ আমার হাতে দিন, জাঁহাপনা।

    খলিফা তার একখানা রুমাল হাসানের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। হাসান সেখানা কুড়িয়ে নিয়ে দরবার মহল ত্যাগ করে বেরিয়ে সোজা চলে গেলো ডিলাইলাহর বাড়ি।

    জাইনাব দরজা খুলে দিলো। হাসান জিজ্ঞেস করে, মা কোথায়?

    জাইনাব বলে, ওপরের ঘরে।

    হাসান বললো, তাকে গিয়ে বলো, সিপাহশালা হাসান এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। এই দ্যাখো, স্বয়ং খলিফার রুমাল, তিনি ভরসা দিয়েছেন তোমার মা লোক ঠকিয়ে যে সব টাকা-কডি সোনা-দানা এবং অন্যান্য সামানপত্র হাতিয়ে নিয়েছে, সেগুলো যদি আবার তাদের ফেরত দিয়ে দিতে রাজি থাকে। তবে তার সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। এরকম সুযোগ আর পাবে না সে। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করাও, তা না হলে আমাকে বল-প্রয়োগ করতেই হবে।

    জাইনাবের মুখে সব কথা শুনে ডিলাইলাহ নিচে নেমে এসে হাসানকে বলে, রুমালখানা আমাকে দিন। আমি সব সামানপত্র সঙ্গে নিয়ে খলিফার কাছে যাচ্ছি।

    হাসান খলিফার রুমালখানা ডিলাইলাহর দিকে ছুঁড়ে দেয়। ডিলাইলাহ সেখানা কুড়িয়ে নিয়ে গলায় বঁধে। গাধা আর ঘোড়াটার পিঠে বোঝাই করে সেই সব সামানপত্র আর কন্যা জাইনাবিকে সঙ্গে করে খলিফার দরবারের পথে রওনা হয়।

    হাসান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব সামানপত্র পরীক্ষা করে বলে, সবই ঠিক আছে দেখছি কিন্তু আহমদ আর তার চল্লিশটি ধনুর্ধরের সাজ-পোশাকগুলো তো দেখছি না।

    ডিলাইলাহ হাসে, ওগুলো আমি হাতাই নি হাসান সাহেব।

    হাসান হো হো করে হেসে ওঠে, –বিলকুল ঠিক। কিন্তু আমার মনে হয় তার পিছনে জাইনাবের হাত আছে–কী? ঠিক না? ঠিক আছে। ওগুলো এখন থাক।

    হাসান তাদের সঙ্গে নিয়ে খলিফার দরবারে এসে হাজির হয়।

    এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    চারশো আটচল্লিশতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

    সেই ধূর্ত বুড়িকে দেখামাত্র খলিফা হারুন অল রসিদ গর্জে ওঠেন, তুমিই সেই ঠগ! এতো বড় স্পর্ধা তোমার, আমার মুলুকে বাস করে আমারই নাকের ডগা দিয়ে এই সব প্রতারণা ধান্দাবাজী চালিয়ে যাচ্ছে? এখুনি তোমার আমি গর্দান নেবো।

    ডিলাইলাহ অবাক হয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি না। আমাকে বলেছিলেন হাসান সাহেব, ধর্মাবতার এই রুমাল দিয়ে অঙ্গীকার করেছেন!

    হাসান তখন এগিয়ে এসে খলিফাকে কুর্নিশ করে বলে; ধর্মাবতার, বোধ হয় আপনার অঙ্গীকার বিস্মৃত হয়েছেন। আপনার দেওয়া ঐ রুমালখানা ডিলাইলাহর গলায় বাঁধা আছে, জাঁহাপনা। আপনি কিছুতেই অন্য রকম হুকুম দিতে পারেন না।

    খলিফা আত্মস্থ হন। —ওঃ, হাঁ, তাই তো! আমি তো তোমাকে জবান দিয়েছিলাম—। ঠিক আছে, জবানের তো নড়াচড় হতে পারে না, হাসানকে যখন কথা দিয়েছি, সেইজন্যে তোমাকে মাফ করে দিলাম। কী নাম তোমার?

    -আমার নাম ডিলাইলাহ। আপনার আগেকার চিড়িয়া সর্দারের বিধবা বিবি আমি।

    খলিফা বললেন, তোমার নামের সঙ্গে একটা যোগ্য খেতাব থাকা দরকার। আমি তোমার নাম দিতাম। ধূর্ত ডিলাইলাহ। সে যাক, এখন সাফ সাফ বলতো এই কদিন ধরে সারা শহরের নিরীহ মানুষের মনে এমন একটা আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। কেন তুমি? তোমার ভয়ে লোকে এক মুহূর্ত নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না। আমার বাগদাদ শহর-সুখের শান্তির জায়গা। এখানে মানুষ নিৰ্ভয়ে নিশ্চিন্তে দিন কাটায়। কিন্তু তোমার দাপটে তো সব তছনছ হয়ে যাবার দাখিল হয়ে পড়েছিলো। কী ব্যাপার, কেন এরকম আরম্ভ করেছিলো? আসলে কারণটা কী?

    ডিলাইলাহ বলে, তবে শুনুন ধর্মাবতার, আমার কোনও লোভ-লালচ নাই! বাঁচতে গেলে পয়সার প্রয়োজন আছে ঠিকই, তাই বলে ধনদৌলতে ঘরবাড়ি ভরে ফেলবো—আমির বাদশাহ হবে, এমন লালসা আমার কোনও দিনই ছিলো না, আজও নাই। আমি যা চাই, তা হলো যশ, মান খ্যাতি। খলিফার দরবারে স্বীকৃতি। আমার মৃত স্বামী একদিন আপনার দরবারে এক উঁচু পদে বহাল ছিলেন, দেশের মানুষের কাছ থেকে অনেক সুনাম আদায় করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা আমাদের একেবারেই ভুলে গেছেন। আমাদের আজ আর কোনও বাদশাহী স্বীকৃতি নাই। আমি তারই প্রত্যাশী, জাঁহাপনা। টাকা পয়সার আমার তেমন প্রয়োজন নাই। আমি ধর্মাবতারের দরবারে সামান্য একটু জায়গা পেলেই নিজেকে ধন্য মনে করবো।

    এই সময় সেই গাধার ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে চাপা আক্ৰোশে বলতে থাকে, আল্লাহ এর বিচার করবেন, এই বুড়ি আমার একমাত্র সম্বল গাধাটাকে লোপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি। আমাকে এই মুর নাপিতের দোকানে ঢুকিয়ে আমার দু’। দু’খানা দাঁত উপড়ে নিয়ে তার জায়গায় দু’খানা তপ্ত লোহার গজাল বসিয়ে দিয়েছিলো। আল্লাহ এর বিচার করবেন।

    এরপর সেই বাদাবী দাসুদৃঢ় উঠে বলতে থাকে, এতো বড় সে ধাপ্লাবাজ, আমাকে পেটপুরে মধু-পিঠা খাওয়ার মিথ্যা লোভ দেখিয়ে আমার সাজ-পোশাক আর ঘোড়াটা নিয়ে সে চম্পট দিয়েছিলো।

    এরপর সেই রঙের কারবারী, সওদাগর, সিদি মুসিন, জহুরী ইহুদী, কাপ্তান মুস্তাফা এবং কোতোয়াল খালিদ সবাই এক এক করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়ে অভিসম্পাত দিতে থাকলো!

    সকলের বক্তব্য শোনার পর উদার মহৎ-প্ৰাণ খলিফা। যারা-যা খোয়া গিয়েছিলো সব তিনি ফেরত দিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়। সেই সঙ্গে নিজের ধনাগার থেকে প্রত্যেককে তার যোগ্যতা মতো ইনামও দিলেন তিনি। গাধার মালিককে গাধার সঙ্গে আরও এক হাজার দিনার নগদ অর্থ দিয়ে বলা হলো, এই টাকায় সে তার নতুন দাঁত বাঁধিয়ে নেবে। এছাড়াও তাকে একটা চাকরী দিলেন তিনি। সারা দেশের যত গাধার রাখাল আছে সে হবে তাদের সর্দার।

    সকলেই তাদের মনের দুঃখ ব্যথা ভুলে গিয়ে খুশি মনে দরবার থেকে বিদায় নিলো। খলিফার ন্যায় বিচার এবং বদান্যতার প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলো সকলে।

    তখন খলিফা ডিলাইলাহকে প্রশ্ন করলেন, এবার ডিলাইলাহ, তোমার কী চাই বলো? ডিলাইলাহ যথাবিহিত কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, ধর্মাবতার, আপনি আমার মৃত স্বামীপদে আমাকে বহাল করুন। এই আমার এক মাত্র বাসনা। পাখীদের কী ভাবে বশ করতে হয়, আমার স্বামীর কাছ থেকে আমি তা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছি। পাখিদের খাওয়ানো ধোয়ানো-পরিচর্যার সব কায়দা-কানুন আমার নখদর্পণে। তা ছাড়া ওদের শেখানো পড়ানোর ব্যাপারেও আমি দারুণ ওস্তাদ। ওদের মুখে চিঠি ধরিয়ে, ইশারা করে তালিম দিয়ে উড়িয়ে দিলে ঠিক জায়গাতে চিঠি বিলি করে আসবে তারা। আমার স্বামী বেঁচে থাকতে আপনি যে বিরাট চিড়িয়াখানাটা বানিয়ে দিয়েছিলেন, আপনি জানতেন। আমার স্বামীই সেটা দেখাশোনা করতেন, কিন্তু আসলে আমিই তার সব কিছু তদারক করতাম। সেই চিড়িয়াখানাটা পাহারা দিত চল্লিশজন নিগ্রো আর চল্লিশটা আফগান কুকুর। এই কুকুরগুলো যুদ্ধবিদ্যায় ওস্তাদ।

    খলিফা চিৎকার করে ওঠেন, সাবাস! তুমি তো সবই জান দেখছি! আর দেরি নয়, আজই, এক্ষুণি তোমাকে আমি আমার প্রধান চিড়িয়া-রক্ষকের পদে বহাল করলাম। চিড়িয়াখানার সব ভার তোমার ওপরেই রইলো। এখনও সেই চল্লিশটা নিগ্রো আর চল্লিশটা আফগান যোদ্ধা কুকুর সেখানে আছে। আজ থেকে তারা সবই তোমার হেপাজতে গেলো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, ডিলাইলাহ, আমার ঐ শেখানো পড়ানো পায়রাগুলো আমার প্রাণ। ওদের একটা খোয়া গেলে তোমাকে তার জবাবদিহি করতে হবে। অবশ্য তোমার এলেম সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। তুমিই এর যোগ্য।

    নিতে চাই, জাঁহাপনা। সে আমার সঙ্গে চিড়িয়াখানাতে থেকে কাজকাম দেখাশুনা করতে পারবে।

    খলিফা বললেন, ঠিক আছে, আমি অনুমতি দিলাম।

    ডিলাইলাহ খলিফাকে কুর্নিশ জানিয়ে বিদায় নেয়।বাড়ি ফিরে এসে সে তার ঘরের সমস্ত সামানপত্র বেঁধে-ছেঁদে নিয়ে চিড়িয়াখানার পথে রওনা হয়।

    আজ ডিলাইলাহর শাহী সাজ-পোশাক। মাথায় সোনার তাজ পরে সে সদৰ্পে পথ চলে। সবাই তাকে দেখুক, সে আজ বাদশার কত বড় সরকারী কর্মচারী! গোটা চিড়িয়াখানার সে সর্বময় কর্তা। তার কথায় চল্লিশজন ইয়া তাগড়াই নিগ্রো নিয়ত উঠু বোস করছে। চল্লিশটা লড়াকু কুকুর আজ তার দখলে। বলতে গেলে, তার হাতে অসীম ক্ষমতা। খলিফার বিশাল মুলুকের নানা সুবাদারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার সে-ই একমাত্র চাবিকাঠি। তার ইশারাতেই পায়রা আকাশে উড়বে। যথানির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে নেমে চিঠি বিলি করে আবার ফিরে আসবে।

    রাত্রিবেলায় ডিসাইলাহ চল্লিশটা কুকুর চিড়িয়াখানার চারপাশে ছেড়ে দিয়ে রাখে। কার সাধ্য, কোনও চোর বদমাশ ভেতরে ঢোকে। একেবারে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেবে না তারা?

    প্রতিদিন সকালে বিকালে সে দরবারে গিয়ে খলিফার সঙ্গে দেখা করে। কোথায় কোন সুবাদারকে কী খৎ পাঠাতে হবে বলে দেন। তিনি। ডিলাইলাহ যথানিয়মে কাজ করে যেতে থাকে।

    চিড়িয়াখানার ভেতরে তার সুরম্য আবাসগৃহে বসে দেওয়ালে ঝুলানো আহমদ আর তার চল্লিশ ধনুর্ধরের সেই সাজ-পোশাকগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে কী এক অপূর্ব আত্মপ্রসাদ অনুভব করে ডিলাইলাহ।

    এইভাবে এককালের ঠগ প্রবঞ্চক ডিলাইলাহ এবং ছলনাময়ী জাইনাব বাদশাহী মর্যাদার শিখরে বসে দেশজোড়া নাম যশ খ্যাতি আর প্রচুর ইনামের অধিকারিণী হয়ে ওঠে।

    কিন্তু এভাবেও সব দিন চলে না। বিধাতার ইচ্ছা বোধহয় অন্যরূপ ছিলো। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যের চাকাও ঘুরে যায়।

    এরপর জাঁহাপনা, শাহরাজাদ গল্পের প্রথম অধ্যায় শেষ করে বলে, আলী চাঁদ আর তার অভিযানের কাহিনী বলার সময় এসে গেছে। ডিলাইলাহ এবং জাইনাবের সঙ্গে এই

    এবং সেই ইহুদি জহুরী ও যাদুকর আজারিয়াহর কাহিনীও শুনুন। সব মিলে এমন মজাদার কিসসা-এর আগে কখনও শোনেননি আপনি।

    শারিয়ার ভাবে, মেয়েটাকে তো মারা যাবে না কিছুতেই। এমন কিসসার শেষটুকু না শুনলে তো চলছে না। দেখাই যাক, আলীচাঁদকে নিয়ে সে কি—কিসসা বানায়।

    এই সময়ে শাহরাজাদ দেখে প্রভাত সমাগত, গল্প থামিয়ে সে চুপ করে বসে থাকে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }