অ্যাট্রাকটিভ
কী রে ঋতিকা এত অন্যমনস্ক কেন হয়ে আছিস, বলবি? শোন, না, একটা নতুন মেডিসিন এনেছি ফর স্কিন৷
ঋতিকা সোনাঝুরির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন, তোর স্কিন খারাপ? আর এই মেডিসিন পেলি কোথায়?’ সোনাঝুরি উজ্জ্বল হেসে বলল, ‘স্পা থেকে এনেছি৷ ভীষণ এক্সপেনসিভ, বুঝলি? যিনি এটা খান, তাঁর গ্ল্যামারটা জাস্ট দেখার মতো৷ ওই পার্লার অ্যান্ড স্পা-এর মালকিন রক্তিমাম্যাম৷ আমি শুধু হাঁ করে তাকিয়ে পার্সোনালিটি দেখছিলাম ওঁর৷ কী ফিগার, জাস্ট ভাবতে পারবি না৷ আমি ওকে মাত্র তিন দিন দেখেছি, বুঝলি৷ জাস্ট ফিদা৷ গালগুলো পুরো মাখন, বস৷
এই মেডিসিনের নাম যেমন ‘অ্যাট্রাকটিভ’ তেমনি উনিও অ্যাট্রাকটিভ৷ তো একদিন একটু ভয়ে ভয়েই ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ উনি নিজের রুমে বসে কী সব হিসেব করছিলেন৷ স্ট্রেইট বললাম, আপনার এমন স্কিনের রহস্য কী? কোনো কথা না বলে আমায় একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন৷ দাম শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল৷ বললেন ফাইলটার দাম পনেরো হাজার৷ দেখ বস, বাবার হোটেলে খাই, প্রতিমাসে পনেরো হাজার কি দেবে? তারপরেই ভাবলাম, আমার বাবা-মায়ের তো কিছু কম নেই৷ মেয়ের সৌন্দর্যের জন্য এটুকু না দিলে তো চলে না৷’
ঋতিকা জানে, সোনাঝুরি ডান্স শিখতে আসে অভিনেত্রী হবে বলেই৷ পড়াশোনায় বেশ ভালো সোনাঝুরি৷ কিন্তু অভিনয়ের প্রতি ওর এমনিই নেশা যে পারলে এখুনি লেখাপড়া বন্ধ করে ও অভিনয়ের জগতে চলে যায়৷ মডেলিংয়ের ইচ্ছে ঋতিকারও আছে৷ কিন্তু সোনাঝুরির মতো এতটা অবসেশনে ভোগে না ও৷ সোনাঝুরি নিজকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকে৷ কোনো কারণে ওর দু-গাছা চুল বেশি পড়লেও টেনশনে পড়ে যায় ও৷ যত দামি দামি ব্র্যান্ডের কসমেটিকস ব্যবহার করে ও৷
ঋতিকা বলল, তো ইউজ করছিস মেডিসিনটা?
সোনাঝুরি হেসে বলল, ‘ইয়েস৷ মাত্র দু’দিন৷ অসম্ভব স্ট্রেস রিলিফ লাগে, বুঝলি৷ দুর্দান্ত ঘুম হয়৷ দেখ, স্কিনটা চমকাচ্ছে না আমার?
ঋতিকা হেসে বলল, ‘সে তো রোজই চমকায়৷’
ওদের কথা শুনেই এগিয়ে এল অনুরূপা৷ ইদানীং মেয়েটা ঞ্ঝঙ্খঞ্জ( প্রবলেমে ভুগছে৷ ডক্টর দেখাচ্ছে৷ হরমোনাল ট্রিটমেন্টও চলছে ওর৷ কিন্তু দুটো গাল ভরে গেছে পিম্পলে৷
অনুরূপা বলল, এই সোনাঝুরি কী মেডিসিন রে? এমনি মেডিক্যাল শপে পাওয়া যাবে?
সোনাঝুরি হেসে বলল, ‘না সোনা৷ এটা ওরা বানায়৷ হার্বাল মেডিসিন৷’
অনুরূপা বলল, ‘আমায় এনে দিবি? আমি তোকে অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করছি টাকাটা৷’
সোনাঝুরি নিমরাজি হয়ে বলল, ‘বেশ দেব৷ তবে কাজ না হলে যেন বলিস না৷’
অনুরূপা বলল, বলব আর কী? তুই তো আর তৈরি করছিস না৷ দেখি একটা ফাইল খেয়ে৷ দিন দিন মুখটা পি.ডব্লিউ.ডি.-র রিপেয়ার না-করা রোড হয়ে যাচ্ছে রে৷ সেদিন অর্ণব তো বলেই ফেলল, মুখটা ঠিক কর অনু৷ আমার রিলেটিভসরা দেখলে বলবে কী? বিশ্বাস কর, ওই কথাটার পর থেকে না নিজের ওপরেই কেমন একটা রাগ হচ্ছে৷
সোনাঝুরি হেসে বলল, না ভাই, আমি এটা খাচ্ছি আমার নিজের ভালো লাগার জন্য৷ কোনো অর্ণব বা উৎপলের জন্য নয়৷ আমি সেলফ লাভে বিশ্বাসী৷’
ঋতিকা বলল, ছাড় সোনাঝুরি তুই নিজেও পার্থিবর জন্য পাগল হয়েছিলিস একটা সময়৷ তারপর দেখলি পার্থিব ভীষণ সিরিয়াস টাইপ ছেলে, নট ইয়োর কাপ অফ টি, তারপর আচমকাই সেলফ লাভে বিশ্বাসী হয়ে গেলি৷ তার থেকে বল-না, ব্যথা আছে কিন্তু প্রকাশ করিস না৷ সোনাঝুরি হেসে বলল, ‘আরে ধুর, পার্থিবর মতো অঙ্কের মাস্টারমশাই মার্কা লুকের ছেলের প্রেমে আমি এমনিও পড়তাম না৷ হয়েছিল কী, সেদিন বাড়িতে মা বলছিল, লেখাপড়া মন দিয়ে কর তাহলেই পার্থিবর মতো হতে পারবি৷ পার্থিব কে জানতে চাইলে মা একটা বিশাল থিসিস নামিয়ে দিয়ে বলছিল, পার্থিব আসলে একটা ডেডিকেশনের নাম৷ ছেলেটা মেডিক্যাল পড়ছে৷ আর এটা তো জানিসই আমার পিসেমশাই ডাক্তার, পিসতুতো দাদা ডাক্তার, এমনকী আমার এক মাসির মেয়েও ডাক্তার৷ তাই ভেবেছিলাম, ডেডিকেশনটা একটু ঝুলিয়ে দিই৷ কিন্তু তারপরে দেখলাম, পার্থিবর পার্থিব-অপার্থিব কোনো জিনিসের প্রতিই কোনো মোহ নেই৷ তখন মানে মানে কেটে উঠলাম৷ ব্যথা নয়, মায়ের ওপরে বিরক্ত হয়েই ট্রাই নিয়েছিলাম৷ পার্থিব মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ডের ছেলে৷ তাই আমার বাড়িতে কান পাতলে তুই দিনে অন্তত দশবার পার্থিবর নাম শুনতে পাবি৷ কিন্তু অর্ণব আর উৎপল আলাদা বিষয়, বস৷ তোরা পটিতেও বসিস ওদের পারমিশন নিয়ে৷
ঋতিকা হেসে বলল, ‘তুই থামবি? অনুরূপা গম্ভীর গলায় বলল, আমি সত্যিই অর্ণবকে ভালোবাসি রে৷ কিন্তু ইদানীং আমার এই এক মুখ পিম্পল আর রুক্ষ হয়ে-যাওয়া স্কিন দেখে নিজেরই বিরক্ত লাগছে, চুলও উঠছে খুব৷ আমার তো আয়নার সামনে আজকাল দাঁড়াতেই ইচ্ছে করে না, তাহলে অর্ণবের কেন ইচ্ছে করবে বল তো আমায় নিয়ে রেস্টুরেন্ট বা সিনেমায় যেতে?’
ঋতিকা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোর এই টিপিক্যাল ভাবনাগুলো বাদ দিবি অনু? ভালোবাসলে সে এত রূপ নিয়ে ভাবে না৷ তোকে হয়তো সচেতন করার জন্যই বলেছে স্কিন কেয়ার করতে, তার মানে তোকে ছেড়ে চলে যাবে এমন তো নয়!’
অনুরূপা অবসন্ন গলায় বলল, ‘জানি না রে৷ সব বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজনের মুখে এক কথা-চেহারাটা কী হয়ে গেল অনুরূপার৷ ডিপ্রেশনে চলে যাব আমি এবারে৷ এত হরমোনাল ট্রিটমেন্ট করেও তো লাভ হচ্ছে না রে৷’
সোনাঝুরি বলল, ‘তুই এই মেডিসিনটা নিয়ে দেখ, নিশ্চিন্তে ঘুমাবি আর স্কিন গ্লো করবে৷’
ঋতিকা বলল, ‘অনুরূপা যখন নিচ্ছে, আমাকেও একটা এনে দে বস৷ এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন করি৷’
সোনাঝুরি জানে না এটা আদৌ স্কিন বা হেয়ারের কী ওষুধ? শুধু কদিন খেয়ে দেখেছে, লাইফ ঝিঙ্গালালা টাইপ ফিলিং হয়৷ সব টেনশন উধাও৷
নাচের ক্লাস থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে উৎপলের নম্বর ডায়াল করল ঋতিকা৷ ফোনটা সুইচড অফ বলছে৷ কী যে হল, এমন তো কোনোদিন করে না উৎপল৷ বাধ্য হয়ে রাঘবকে কল করতে হল ঋতিকাকে৷ এই ছেলেটাকে একেবারেই পছন্দ হয় না ওর৷ বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে যেন ঋতিকা উৎপলের নয় রাঘবের প্রেমিকা৷ বড্ড গায়ে পড়ে ফ্লার্ট করে ছেলেটা৷ যদিও মাত্র তিন দিন কথা হয়েছে ছেলেটার সঙ্গে৷ তবুও সিক্সথ সেন্সে টের পেয়েছে, ছেলেটা শুধু বন্ধুর প্রেমিকার চোখে ওকে দেখে না৷ ফোনটা ধরেই রাঘব আজ সেই পরিচিত ভঙ্গিমায় বলল না, যাক, মাঝে মাঝে তো আমাকেও মনে করতে পারো ঋতিকা৷ আজ সম্পূর্ণ অপরিচিত গলায় বলল, ‘ঋতিকা খবর খুব খারাপ৷ উৎপলকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে৷’
ঋতিকা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আরে, অ্যারেস্ট কেন করবে? ওর জেঠু মিসিং ডায়েরি করেছিল ফোনে না পেয়ে তাই পুলিশ খুঁজে বের করেছে৷ আমিই তো পুলিশকে ওর বড়োমামার নাম বললাম৷ যেখানে উৎপল ছিল৷’
রাঘব বিস্মিত গলায় বলল, ‘পুলিশ তোমার কাছ অবধি পৌঁছে গেল কী করে? তুমি ভুল জানো ঋতিকা, আমাদের এখানে একটা মার্ডার হয়েছে৷ লরি চাপা দেওয়া হয়েছে৷ লরিটা উৎপলের ছিল৷ এই কারণেই ওকে অ্যারেস্ট করেছে৷’
চমকে উঠল ঋতিকা৷ মাথাটা দুলে উঠল ওর৷ এসব কী বলছে রাঘব? মিথ্যে বলছে নিশ্চয়ই৷ উৎপল বলেছিল, রাঘব ওর বন্ধু হলেও ওকে খুব হিংসে করে৷ ওই হিংসার থেকেই মিথ্যে বলছে৷ ঋতিকা বলল, ‘রাঘবদা, উৎপল এখন কোথায়?
রাঘব ফিসফিস করে বলল, ‘লকআপে৷ এখন রাখছি৷’
ফোনটা কেটে দিল রাঘব৷ ধপ করে বসে পড়ল ঋতিকা৷ এটা কী করে সম্ভব? উৎপলের লরি কাউকে কী করে চাপা দিয়ে দিতে পারে? আর তাতে উৎপলের দোষ কোথায়? রোড অ্যাক্সিডেন্ট আর মার্ডার কি এককথা? সব ঘেঁটে যাচ্ছে ওর৷ মাথার মধ্যে শিরাগুলো দপদপ করছে৷
ব্যাগ থেকে সোনাঝুরির দেওয়া দু-পিস স্যাম্পল মেডিসিনের একটা খেয়ে ফেলল ঋতিকা৷ ঝিমঝিম করছে মাথাটা৷ চোখটা ঝাপসা হচ্ছে, অদ্ভুত হালকা লাগছে মাথাটা৷ বিছানায় শুয়ে পড়ল ও৷ মাথার মধ্যে একটা সুর যেন অনবরত দ্রিম দ্রিম করে একনাগাড়ে বেজেই চলছে৷ ভাবনাহীন ঘুম নেমে এল ওর চোখে৷