ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ
গোঁজ হয়ে বসে আছে সুমন৷ বেল পেয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু কেস থেকে নিস্তার পায়নি৷ রিম্পা রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল৷ সুমন গম্ভীর স্বরে বলল, ‘নিজের লোভে আমাদের শেষ করে দিলে তুমি৷ ওইটুকু ছেলেটাকেও ছাড়লে না তুমি৷’
রিম্পা বিরক্তির গলায় বলল, তোমার ছেলে যে ঐ কারণেই এমন হাঁদা হয়েছে৷ না হলে ব্যাঙ্কের ঢোকার সময় সিকিউরিটিকে ওই পুরিয়া দিতে যায়? আর শোনো, আমি এসবের কিছুই জানি না৷ ও কোথা থেকে এসব পেল, সেটাও জানি না৷
সুমন বলল, ‘রিম্পা, চুপ করে থাকি অশান্তির ভয়ে৷ তোমার মুখের ভয়ে৷ পাড়ায় বদনামের ভয়ে, তার মানে এই নয় আমি তোমার নোংরামি কিছুই জানি না৷ কীসের এত লোভ গো তোমার?’
রিম্পা বলল, ‘ভালো থাকতে চাওয়াকে লোভ বলে না৷ তা ছাড়া আমি কারো কোনো ক্ষতি করিনি৷’
সুমন বলল, ‘তপন মহান্তিকে কে খুন করল? তুমি সেদিন রাত করে বাড়ি ফিরলে কেন? কোথায় গিয়েছিলে? তুমি মনে করলে, আমি ঘুমিয়ে গেছি তা-ই তো? চাবি ঘুরিয়ে টুক টুক করে ঘরে ঢুকলে৷ শুনলাম তপনদাকে কেউ ইঞ্জেকশন দিয়েছিল৷ ইঞ্জেকশনের হাত তো তোমার মন্দ নয় রিম্পা৷’
রিম্পা বলল, ‘তপনদাকে আবার কেউ টাঙিয়েও রেখেছিল, শুনেছ নিশ্চয়ই৷ সেটাও কি আমি করেছি?’
সুমন বলল, ‘করতেই পারো৷ গায়ে জোর তোমার তো কিছু কম নেই৷’
রিম্পা বলল, ‘তবে আর কী, তোমার পুলিশম্যাডামকে ডেকে ধরিয়ে দাও৷’
সুমন বলল, হ্যাঁ তাই দিতাম৷ যদি পিকু না থাকত৷
রিম্পা হেসে বলল, ‘ছেলেকে যদি এতটাই ভালোবাসতে তাহলে তার ভবিষ্যতের কথা ভেবেও বেশি টাকা রোজগারের চেষ্টা করতে৷’ সুমন বলল, ‘সেটা অসৎ পথে?’
রিম্পা তরকারির বাটিটা গ্যাস আভেন থেকে নামিয়ে বলল, ‘ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের দায়িত্ব ভগবান তোমায় দিল কবে থেকে? আর শোনো, ‘আমি কিছুই করিনি৷’
* * *
সুমন বলল, ‘মিথ্যে বলতে বলতে তুমি অভ্যস্ত হয়ে গেছ রিম্পা৷ জয়ন্তকে কে মারল? তোমাদের দলের কেউ?
রিম্পা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘পাড়ার স্টেশনারি দোকানে যেমন সবাই যায় আমিও যেতাম৷ তাকে কে মেরেছে সেটা আমি জানি না৷’
সুমন বলল, ‘অদ্ভুতভাবে জয়ন্তর স্ত্রী পিকুর মাসি সেজে গিয়ে আমায় বেল করিয়ে আনল৷’
রিম্পা বলল, ‘ভুলভাল বোকো না তো৷ জয়ন্তর স্ত্রী হাসপাতালে ভরতি আছে৷’
সুমন ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল, ‘কেউ নিজের ভোল পাল্টে ফেললেই যে তাকে চেনা যাবে না এটা নয়৷ হতে পারে, ওই রক্তিমা নিজের নাম বদলে, সাজপোশাক এমনকী চুলের রং অবধি বদলে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে আমি চিনতে পারব না এমন নয়৷ ওটাই জয়ন্তর স্ত্রী৷ বার তিন-চার তাকে পাড়ায় দেখেছিলাম আমি৷ তখন অবশ্য এমন দেখতে ছিল না৷ কিন্তু মুখের আদল পালটাতে তো আর পারবে না৷ তাই দেখেই চিনেছি৷’
রিম্পা বলল, ‘ভুল চিনেছ৷ উনি আমার পরিচিত৷ বিপদে পড়েছি শুনে আমায় সাহায্য করতে এসেছিলেন৷ কী বেইমান গো তুমি৷ উনিই উকিল দিয়ে তোমায় বেল করিয়ে নিয়ে এলেন, আর তুমি এভাবে খুঁত ধরছ?’
সুমন বলল, ‘রিম্পা, এখনও সত্যিটা বলে এসো থানায়৷ আমি চেষ্টা করব ম্যাডামকে বলে তোমায় বাঁচানোর৷’
রিম্পা হেসে বলল, ‘তোমার ম্যাডাম তো তোমাকেই বাঁচালেন না, আমাকেই যেতে হল ছাড়াতে৷ আর অন্তত দশবার বললাম, আমি এসবের কিছু জানি না৷ বার বার এক কথা বলবে না৷’
সুমন বলল, ‘লজ্জা করে না তোমার? পাড়ার অল্পবয়েসি মেয়েদের ব্লু ফিল্মের ফোটোশ্যুটের লোভ ধরিয়ে কোথায় যেন পাঠাও৷’
রিম্পা বলল, ‘সবাই তো বাচ্চা গো, আমি বললেই সবাই শোনে৷ শোনো, তোমার মতো সবাই ভিখিরি হয়ে থাকতে চায় না, বুঝেছ? সবাই ভালো থাকতে চায় তাই তারা রোজগার করতে যায়৷ আমি কাউকে কোথাও পাঠাই না৷’
সুমন বলল, ‘পিকুর মা না হলে আমি নিজে তোমায় ধরিয়ে দিতাম৷ তপনদা যেদিন মারা গেল, সেদিনের চটিটা এখনও বাইরে পড়েই আছে, বেল্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল বোধহয় তাড়াহুড়োয়৷
রিম্পা বলল, ‘এগুলো তোমার প্রমাণ? এই তুমি পুলিশদের সঙ্গে ওঠা বসা করো? রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে চটি ছিঁড়ে গেছে, সেটা তোমার খুনের প্রমাণ?’ সুমন গুম হয়ে বসে রইল৷ রিম্পা সেজেগুজে দামি ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে গেল৷
সুমন মনে মনে ভাবছিল, এ অন্যায়-অপরাধগুলো মুখ বুজে মেনে নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? ভাবনার মধ্যেই পিকু এসে বলল, ‘বাবা, মা বলে গেল, রান্নাঘরে খাবার আছে, খেয়ে নিতে৷ ‘সুমন ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল৷ হিসেবগুলো মেলানোর চেষ্টা করছে সুমন৷ তপন যেদিন মারা গেল, সেদিন রিম্পা বিকেলে ফোন করে বলেছিল ফিরতে রাত হবে৷ একটা কাজে ফেঁসে গেছি অফিসে৷’ সেদিনই সকাল আটটা নাগাদ একটা ফোন এসেছিল ওর ফোনে৷ রিম্পা বাইরে বেরিয়ে গিয়ে কথা বলেছিল, সুমন যাতে শুনতে না পায়, সে কারণেই হয়তো৷ কিন্তু সুমন একটা কথা শুনেছিল, রিম্পা উত্তেজিত হয়ে বলছে, হ্যাঁ, এটাকেও শেষ করে দিতে হবে৷ না হলে ফাঁসিয়ে দেবে৷’ তারপরেই রিম্পা বেরিয়েছিল৷ আশা কর্মী হিসাবে জয়েন করার পরেই ওদের ইঞ্জেকশন দেওয়া শেখানো হয়েছিল৷ সুমন জানে, কাজের জায়গায় রিম্পার সুনাম আছে৷ তপন মাঝরাত পর্যন্ত জেগে ঘুরে বেড়াত স্কুলের মধ্যে৷ জয়ন্তর কার্যকলাপ ওর না জানার কিছু নেই৷ অনেক কিছুই চোখের সামনে দেখেছে ও৷ তাই কি ওকে সরিয়ে দেওয়াটা জরুরি ছিল? রিম্পার সঙ্গে তপনদার খুব ভালো পরিচয় ছিল৷ তাই ও গেলে কিছুই সন্দেহ করবে না৷ আর ভাবতে পারছে না সুমন৷ তবে কি রিম্পা টাকার লোভে মানুষ খুন করে দিল৷ পুলিশের গাড়ি চালানোর সুবাদে রাত করেই বাড়ি ফিরত সুমন৷ তখনও দেখত, তপনদা বাঁশি বাজাচ্ছে৷ সেই লোকটা জয়ন্ত খুনের দিন সন্ধেবেলা ঘুমিয়ে গিয়েছিল— এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন কাজ৷ সুমন শিয়োর, ও জানত জয়ন্ত খুনের বিষয়টা, তাই সরানো হল তপনকে৷ রিম্পার কথা আর কাজে এত অসংগতি যে মেলাতে কষ্ট হচ্ছে সুমনের৷ রিম্পা ওইদিন মাঝরাত পর্যন্ত কী করছিল? যখন ফিরল তখনই বা অমন বিধ্বস্ত লাগছিল কেন? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সুমন৷ ম্যাডামও আর হয়তো ওকে বিশ্বাস করছে না৷ সেটাই স্বাভাবিক৷ ও কিছুই জানত না— এটা কে বিশ্বাস করবে?