এ ঘরে মৃত্যুর গন্ধ
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম এগুলো কী দেখছেন?’
লগ্নজিতা ইশারায় চুপ করতে বলল৷ দু-তিন দিন দরজা বন্ধ থাকায় ঘরের মধ্যে কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছাড়ছে৷ ঘরের মধ্যে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা৷ কদিন আগেই এই ঘরে একটা জলজ্যান্ত লোক চলাফেরা করত, আর আজ ওদের দুজনের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না৷ লগ্নজিতা জানলাগুলো খুলে দিল, নিজে কাঠের চৌকিটার ওপরে উঠে দাঁড়াল৷ সুশোভনকে বলল, ‘বাইরের গলি দিয়ে হেঁটে যাও এদিকে তাকাতে তাকাতে৷ দেখো তো দেখতে পাও কি না আমায়৷’
সুশোভন বাইরে গিয়ে তপনের ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে বার দুয়েক হেঁটে গেল, ঘরে ঢুকে বলল, ‘ম্যাডাম, ভিতরের ওই আলনা আর ওই কাঠের চেয়ারটা ছাড়া ঘরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না বাইরে থেকে এই জানালা দিয়ে৷ কোনোভাবেই খাটে কে শুয়ে আছে বা দাঁড়িয়ে আছে দেখা সম্ভব নয়৷’
লগ্নজিতা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘এগজ্যাক্টলি৷ তাই বাইরের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছে, বডি ঝুলছে, এটা মিথ্যে কথা৷ এবারে দরজা-জানালা খুলে দিলাম৷ আমি ওই সেম পজিশনে দাঁড়াচ্ছি৷ তুমি আবার ওই পদ্ধতিতেই দেখো, দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কি না৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, কোনোভাবেই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে খাটের ওপরে দেখা সম্ভব নয়৷ কারণ খাটটা যে কোণে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে বাইরে দেখা যায় না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ৷ তার মানে কাউকে ভিতরে ঢুকতে হয়েছিল তপনের বডি ঝুলন্ত অবস্থায় দেখার জন্য? সেই লোকটা কে?’
‘তার মানে জানালা-দরজা খোলা অবস্থায় ঘরের খাটে বসে ঠিক কী হচ্ছে, সেটা দেখা সম্ভব নয়৷ খেয়াল করে দেখো, এত বড়ো ঘরে জানালা মাত্র ওই একটা৷ আর দরজাটাও যথেষ্ট ছোটো৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওই যে তপন বলেছিল না, জয়ন্ত মারা যাবার দিনে, জানালা-দরজা বন্ধ থাকলে আমার ঘরে বসে বাইরে আগুন লাগার আওয়াজও শোনা যাবে না৷ এত মোটা দেওয়াল আমার ঘরের৷ আসলে পুরোনো আমলের স্কুলবাড়ির অংশ বলেই হয়তো এমন ডিজাইন৷’
সুশোভন বলল, ম্যাডাম কাঠের আলমারি ঘেঁটে এই যে এটা পেলাম৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ডায়েরি লিখতেন নাকি? নিয়ে নাও সঙ্গে৷ ও হ্যাঁ খুঁজছ যখন দেখো তো কোনো ব্যাঙ্কের বই পাও কি না৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, এর পাঞ্জাবি পরার শখ ছিল দেখছি৷ আলমারিতে পাঞ্জাবি রয়েছে বেশ কিছু৷ সিনেমার টিকিট রয়েছে ম্যাডাম অনেকগুলো৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ফোনটা পাও কি না দেখো তো আর একবার খুঁজে৷’
সুশোভন বলল, ‘না ম্যাডাম, ওটা তখনো পাওয়া যায়নি৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, চিঠি রয়েছে কতগুলো৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘বলো কী? এই স্মার্টফোনের যুগে চিঠি কীসের? এনিওয়ে, যা পেয়েছ তুলে নিয়ে চলো৷ ওই প্রত্যক্ষদর্শী যে জানালা দিয়ে ঝুলন্ত বডি দেখেছিলেন, তাঁকে একবার ধরতে হবে৷ সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওই লোকটি ডাঁহা মিথ্যে বলল৷’
তপনের ঘরের তিনটে ঘর পরেই সাক্ষী অরুণের বাড়ি৷ আচমকা লগ্নজিতা আর সুশোভনকে দেখে একটু বেশিই বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এই কারণেই আজকাল আর মানুষ কারো কোনো উপকার করে না৷ একটা মিসহ্যাপ দেখেছিলাম তাই থানায় ফোন করে জানিয়েছিলাম৷ আমাদের চেয়ারম্যানকেও জানিয়েছিলাম৷ এখন আপনারা যদি রোজই জিজ্ঞাসাবাদের নামে টর্চার করেন তাহলে আর কেউ কোনো হেল্প করবে আপনাদের? আরে আমার বাড়ির একটা প্রাইভেসি নেই নাকি? ছুটির দিন মানেই আমি পুলিশ অ্যাটেন্ড করব?’
লগ্নজিতা বলল, ‘কবার পুলিশ অ্যাটেন্ড করলেন আপনি?’
অরুণ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘এই তো পরশু দিন রুদ্রজ্যোতি বলে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন সল্টলেক থানার পুলিশদের সঙ্গে নিয়ে৷ জিজ্ঞাসাবাদ করে গেলেন৷’
লগ্নজিতা কঠিন গলায় বলল, ‘আমি ওই একই উত্তর শুনতে চাইছি না৷ আপনি কখন কীভাবে দেখলেন, তপন মহান্তি সুইসাইড করেছে?’
অরুণ একটু থমকে বলল, ‘দেখুন ম্যাডাম, আমার ভোরে উঠে ওয়াকে যাওয়াটা একটা স্বভাব৷ তো সেদিনও ওই চারটের সময় ওয়াকে বেরোচ্ছিলাম৷ তখনই দেখলাম, তপনদার ঘরে লাইট জ্বলছে৷ জানালা খোলা৷ স্বাভাবিকভাবে তাকাতেই দেখি, সিলিং ফ্যান থেকে বডি ঝুলছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনার ঠিক মনে আছে, জানালা দিয়েই দেখেছিলেন? ঘরের ভিতরে ঢোকেননি?’
অরুণ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এতে মনে রাখার কী আছে? এই তো পরশুর ঘটনা৷ একদিনে ভুলে যাব?’
লগ্নজিতা বলল, ‘আসুন অরুণবাবু৷ তপন মহান্তিকে ঠিক কোন জানালা দিয়ে দেখেছিলেন, একবার দেখাবেন৷’
অরুণ থতমত খেয়ে বলল, ‘কী মুশকিল, ওই ঘরে জানালা তো একটাই৷ কী এমন রাজমহল ওটা৷’
লগ্নজিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন দেখাবেন৷’
অরুণবাবু পায়ে চটিটা গলিয়ে বলল, ধুর মশাই, চলুন৷’ তপন মহান্তির জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, এ মা, এখান থেকে আজকে তো সিলিং ফ্যানটা দেখাই যাচ্ছে না৷’
লগ্নজিতা বলল, সুশোভন ওঁকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে চলো৷ পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়ে আইনকে প্রতারিত করেছেন উনি৷
অরুণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, আমি কোনো দোষ করিনি৷ আমি সত্যিটা বলতে ভয় পেয়েছিলাম৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘নো প্রবলেম, থানায় বসে বা কোর্টে গিয়ে বলবেন৷’
অরুণ হাত জোড় করে বলল, ‘ম্যাডাম, ক্ষমা করুন৷ আমি বলছি আপনাকে সত্যিটা৷ আমার স্ত্রী বলেছিল, এসব বলতে গেলেই পুলিশ উলটে তোমাকেই ফাঁসিয়ে দেবে৷ তাই আমি রাতে চেপে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু সারারাত ছটফট করে শেষ পর্যন্ত ভোরবেলা ফোন করতে বাধ্য হই৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘সবটা বলুন৷’
অরুণ বলল, ‘আমি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি৷ আমাদের এখন একটা প্রোজেক্টে প্রবলেম চলছে৷ তাই রোজই ফিরতে দেরি হচ্ছে৷ ফেরার পথে দেখতাম, তপনদা স্কুলে টহল দিয়ে ঘরে ঢুকছে৷ রোজই কথা হত৷ তপনদার সবেতে খুব আগ্রহ ছিল৷ একটা ফোন নিয়ে এদিক-ওদিক ভিডিয়ো করে বেড়াত৷ আমি ফেরার সময় রোজই বলত, আজও বারোটা বাজল নাকি? বউ এবারে মারবে তোমায় অরুণ৷ আজ প্রায় ছয় বছর দেখছি লোকটাকে৷ পরিচয় ভালোই হয়ে গিয়েছিল৷ তাই গল্প হত টুকিটাকি৷ আগে আমি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতেও ছিলাম৷ বছর তিনেক হল, সেই পদ থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছি৷ তো তার আগের দিনও জয়ন্তকে কে খুন করতে পারে নিয়ে কথা হচ্ছিল৷ তপনদা বলেছিল, সব ভিডিয়ো করা আছে৷ রাতের অন্ধকারে ওর দোকানে কী হত, সব আমি জানি৷ আমায় চাকরি নিয়ে হুমকি দিলেই তাস ফেলে দেব৷ আমি বলতাম, এই স্কুলটা শুধু পলিটিক্স করে শেষ হয়ে গেল৷ পরশু দেখলাম, দরজা হাট করে খোলা৷ ঘরে লাইট জ্বলছে৷ তপনদা দরজার সামনে চেয়ারে বসে নেই৷ স্কুলের গেটেও নেই৷ তাই ঘরে ঢুকে ডাকলাম, তপনদা? দেখি, সিলিংয়ে ঝুলছে৷ ঘাড় ঝুলে রয়েছে৷ বুঝতে পারলাম, মারা গেছে৷ ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল৷ ছুটে বাড়ি ঢুকে যাই৷ তখন ঘড়িতে একটা বাজে৷ বউ ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ চাবি খুলে বাড়িতে ঢুকি রোজই৷ বউকে ঘুম থেকে তুলে পুরো ঘটনাটা বললাম৷ আমার স্ত্রী বলল, এসব থানায় বলতে যেয়ো না, শেষে তোমায় ফাঁসিয়ে দেবে৷ আমার স্ত্রী-র কোনো আত্মীয়কে এভাবেই পুলিশ নাকি ফাঁসিয়ে দিয়েছে৷ সারারাত ছটফট করে, শেষে ভোরবেলা হাঁটতে বেরোলাম৷ তখনই দেখেছি বলে সবাইকে ডাকলাম৷ পুলিশেও খবর দিয়েছিলাম৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ম্যাডাম, বিছানার ওপরে বা পাশে কোনো টুল কাত অবস্থায় পড়ে ছিল না৷ তপনদার যা হাইট, তাতে করে চৌকি থেকে সিলিংয়ে নাগাল পাওয়া অসম্ভব৷ তাই আমার ধারণা কেউ মেরে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে৷ বিশ্বাস করুন, তপনদার মতো শত্রুহীন মানুষ যদি খুন হয়ে যায় তাহলে আমাদের জীবনেরও কোনো গ্যারেন্টি নেই৷’
লগ্নজিতা বলল, ওঁর কোনো আত্মীয় ছিল নাকি?’
অরুণ বলল, ‘না ম্যাডাম তেমন, আত্মীয়ের কথা তো কখনো বলতে শুনিনি৷ একদিন বলেছিল, মহিলার চক্করে পোড়ো না অরুণভায়া৷ এরা দিনের বেলাতেও স্বপ্নে আসে৷ আমি বলেছিলাম, যে স্বপ্নে আসছে, তাকে বিয়ে করে ঘরেই নিয়ে এসো৷ হেসে বলেছিল, চালচুলোহীন লোককে কি ওসব সুন্দরী বিয়ে করে? আমি বলছিলাম, তো সে সুন্দরীটি কে? উনি বলেছিলেন, পরস্ত্রী৷ বলেই হেসেছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘তেমন কোনো মহিলার সঙ্গে ওঁর হূদ্যতা দেখেছিলেন নাকি?’ অরুণ একটু ভেবে বলল, ‘না ম্যাডাম৷ তবে একটা জিনিস আপনারা খেয়াল করে দেখেছিলেন কি না জানি না, তপনদার বডিটা একটা রেড কালারের শিফন শাড়িতে ঝুলছিল৷ ওই শাড়ি কিন্তু তপনদার ঘরে বেমানান৷ ঘরটাও বেশ অগোছালো ছিল৷ কিছু যেন খোঁজা হয়েছিল ঘরে৷
একজন অবশ্য প্রায় আসত৷ কিন্তু সে থাক৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘অরুণবাবু, ভয় পাবেন না প্লিজ৷ আপনারা হেল্প না করলে আমরা খুনের কিনারা করব কী করে? আচ্ছা, ঘরের কোণে ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ দেখেছিলেন?’
অরুণ বলল, ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ? কী বলছেন আপনি? তপনদার ইঞ্জেকশন ফোবিয়া আছে, মশাই৷ অত বড়ো দামড়া লোক টেডভ্যাক নিতে গিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল৷ স্কুলে একবার পুরোনো জং-পড়া শিকে হাত কেটে গিয়েছিল ওর৷ আমিও সেদিন স্কুলে ছিলাম একটা মিটিংয়ে৷ আমরাই বলেছিলাম, একটা ইঞ্জেকশন নিয়ে নিতে৷ একজনকে ডাকা হয়েছিল ইঞ্জেকশন দিতে, তপনদার সে কী কান্না৷ আমরা হেসে বাঁচি না৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, তাহলে উনি ড্রাগসের জন্য সিরিঞ্জ ইউজ করতেন না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘নো সুইসাইড, ‘এটা সাজানো মার্ডার৷’
অরুণ বলল, ‘এটাই আমার প্রশ্ন খুনটা করবে কে? এবং কেন?’
লগ্নজিতা বলল, ‘জয়ন্ত খুনের সাক্ষী এই অপরাধে৷’
অরুণ বলল, তাই বলে এমন নিরপরাধ মানুষকেও খুন হতে হয়, ম্যাডাম? তপনদা প্রায় বলত, বুঝলে অরুণ, আর বছর দশেক চাকরি করব, তারপর যা জমবে, সেটা নিয়ে ব্যাঙ্কে রাখব৷ খাওয়াটা চলে যাবে৷ আমি বলতাম, তারপর করবেটা কী? তপনদা বলত, বাউল হব৷ বাউল গান গাইব কোপাই নদীর ধারে বসে৷ এটা তপনদার স্বপ্ন ছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু হিসেব তো মিলছে না, অরুণবাবু৷ ওনার অ্যাকাউন্টে গত ছয় দিনে প্রায় লাখখানেক টাকা ঢুকেছে৷’
অরুণ বলল, ‘কিন্তু ওঁকে টাকাটা দেবে কে? তিনকুলে তো কেউ ছিল না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘চলো সুশোভন৷ অরুণবাবু কোনো অ্যাবনর্ম্যাল জিনিস দেখলে প্লিজ জানাবেন৷’
তপন মহান্তির ঘরে তালা দিয়ে চাবিটা পকেটে রেখে গাড়িতে গিয়ে উঠল লগ্নজিতা৷ সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম ইউরেকা৷ এই যে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ডিটেলস দেখুন৷ মাইনের দশ হাজার টাকা ছাড়া ফার্স্ট কুড়ি হাজার ঢুকেছে জয়ন্ত প্রামাণিকের মৃত্যুর পরের দিন৷ ম্যাডাম, আমি বলছি, লোকটা জয়ন্ত প্রামাণিকের খুনের একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘হিসেব খুব পরিষ্কার, সুশোভন৷ অরুণবাবু বললেন, তপনের ভিডিয়ো করার নেশা৷ সকালে যখন আমরা স্কুলে গেলাম তখনই তপন জানতে পারল, পিনাক ধরা পড়েছে ড্রাগস বিক্রি করতে গিয়ে৷ তখনই সবাই জানত, এই ড্রাগ কোথায় পেল, খুঁজতে গিয়ে আমি জয়ন্তর দোকানটা সিল করব৷ ওকেই ধরব ওই চকোলেট বিক্রির জন্য৷ তপন মহান্তি তখনই অঙ্ক কষে ফেললেন৷ তারপর সারাদিন নজর রাখলেন, ভিডিয়ো করলেন জয়ন্তর যাওয়া-আসা সব৷ এমনকী জয়ন্ত খুনের ভিডিয়ো যদি তপনের কাছে থাকে, আমি আশ্চর্য হব না৷ তারপর শুরু হল খুনিকে ব্ল্যাকমেইল৷ খুনি টাকা দিতে শুরু করল৷ চাহিদা বাড়ছিল তপনের৷ দেখো লাস্ট বার টাকার পরিমাণ বেশি৷ তারপরেই খুনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, একে মেরে দিতে হবে৷’
কিন্তু ম্যাডাম, খুনি এমনভাবে কেন খুন করছে, যাতে কখনো মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্ট, কখনো মনে হচ্ছে সুইসাইড৷ মানে পদ্ধতিগুলো এত জটিল কেন?’
লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার বউ যদি রোজ মাছের ঝোল আর ভাত দেয়, ভালো লাগবে? মাছের কালিয়া, দই-মাছ খেতে ইচ্ছে করবে না? খুনিরও তেমনি নিত্যনতুন পদ্ধতিতে খুন করতে ভালো লাগে৷ তাতে একেঘেয়ে লাগে না৷ পুলিশও কনফিউশনে পড়ে যাবে, বিভিন্ন খুনের পদ্ধতি দেখে খুনিকে শনাক্ত করা মুশকিল হয়৷ এই আর কি! তপনের ডায়েরিতে তো দেখছি কাউকে একটা উদ্দেশ্য করে প্রেম নিবেদনের কবিতা লেখা৷’
সুশোভন বলল, ‘এই যে বলল, একা মানুষ, বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কী মুশকিল, বৈষ্ণবধর্মে প্রেম বিতরণ করতে শেখানো হয়েছে, তোমার মতো নতুন বউকে ফেলে খুনি ধরে বেড়াতে শেখানো হয়নি৷ আর চিঠিগুলো কার?’
সুশোভন বলল, ‘পারুলিয়ার দিকের কোনো আশ্রম থেকে চিঠি আসত গুরুপূর্ণিমায়৷ আমন্ত্রণ জানানো হত শিষ্যদের৷ নাথিং সিরিয়াস৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তপনের বডি নামানোর পরে বেশ কিছু জিনিস বেপাত্তা হয়েছে৷ যেমন রেড শিফনের শাড়িটা ছিল না৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, আমার ধারণা, ওগুলো রুদ্রস্যার বা মিস্টার সান্যাল নিয়ে গেছেন তদন্তের খাতিরে৷ রুদ্রস্যারের কাছে ডুপ্লিকেট চাবিও তো আছে এই ঘরের৷ আপনিই দিতে বলেছিলেন তদন্তের সুবিধার্থে৷ আসলে ম্যাডাম, একই কেসে এতজন না ঢুকলেই হতো৷ অবশ্য এম.এল.এ সাহেব তো আবার ওঁকেই চাইছেন৷’
লগ্নজিতা বলল, হ্যাঁ, এটা হতেই পারে৷ কারণ আমরা আসার আগেই ওরা এসেছিল৷ আর তোমাদের মেজবাবু তো নিজের কাজ অন্যের কাঁধে দিয়ে দিতে পারলে আর কিছুই চায় না৷ বডি নামানোর সময় বেসিক কাজগুলোও করেনি৷ যখনই দেখেছে আর দুজন উপস্থিত তখন উনি সিগারেট খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন হয়তো৷ কিন্তু এগুলো কি নিছক কবিতা? নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো এক বনলতা সেন? বনলতা সেন কি আদৌ ছিলেন? নাকি কবির কল্পনা? লাল শিফনের শাড়ি, ভাঙা ক্লিপের টুকরো প্রমাণ করে, এ বনলতা আছে৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, বনলতা সেন আবার কে?’
লগ্নজিতা বলল, ‘সুশোভন যদি কখনো ডুবে মরবে সিদ্ধান্ত নাও তাহলে যেন নদী বা সমুদ্রে যাবে না, বুঝলে? অবশ্যই ছোট্ট ডোবায় ডুববে৷ সেটাই হবে বনলতা সেনকে না-চেনার শাস্তি৷ হায় রে বাঙালি! আরে তুমি কবি জীবনানন্দ দাশকে চেনো না? ওঁর লেখা বিখ্যাত কবিতার নাম শোনোনি?’
সুশোভন বলল, কেন চিনব না ম্যাডাম? আমি তো ছোটোবেলায় ভাবতাম, ট্রাম যে ধীর গতিতে চলে, তার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একজন মারা গেলেন কী করে? না ম্যাডাম, ওটাও অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না, সুইসাইড ছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, এই হচ্ছে পুলিশের রোগ৷ কবিতা থেকে সোজা সুইসাইড স্পটে গিয়ে থামবে৷’