এক মাসে সুন্দরী
কৌশিক ফোন করেছিল, ‘লগ্নজিতা শুনতেও পায়নি৷ ফোনটা রিসিভ করতেই কৌশিক বলল, ‘একটা অ্যাড্রেস দিচ্ছি, চলে এসো৷ এখন কোনো প্রশ্ন করো না প্লিজ৷’
লগ্নজিতা জানে, কৌশিক যখন বলছে তখন বিষয়টা খুবই সিরিয়াস কিছু৷ কৌশিক খুব ভালো করেই জানে লগ্নজিতার ব্যস্ততা৷ সেখানে যখন ফোন করে ইমিডিয়েট আসতে বলল কৌশিক, তখন বিষয়টা গুরুতর তো অবশ্যই৷
কৌশিককে বেশ বিভ্রান্ত লাগছে৷ কৌশিকের বাবা কৃষ্ণেন্দু আঙ্কলও রয়েছে নার্সিং হোমের সামনে৷ যেহেতু কৌশিক নিজে সরকারি হসপিটালের ডক্টর তাই আত্মীয়স্বজনকেও সরকারি হসপিটালেই ভরতি করতে চায়৷ তাই নামী নার্সিং হোমের অ্যাড্রেস শুনে একটু অবাকই হয়েছিল লগ্নজিতা৷ ও ঢুকতেই কৌশিক প্রায় হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘সোনাই মানে সোনাঝুরি ভরতি আছে আশঙ্কাজনকভাবে৷ বাবার এক ছাত্রই দেখছেন এখানে৷ মনে পড়ছে না? আমার মামাতো বোন সোনাঝুরি৷ আমার মায়ের কাছেই বড়ো হয়েছে, বলতে পারো৷ মা মারা যেতে তাই আমার থেকে বেশি ও কেঁদেছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কী হয়েছে?’
ডক্টর সুধীর মিশ্র বললেন, ‘ড্রাগসের ওভারডোজ৷ আপাতত জ্ঞান নেই৷ প্রায় দু-ঘণ্টা হয়ে গেল অজ্ঞান অবস্থায়৷ মামিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলো৷’
লগ্নজিতা বলল, আঙ্কলের বার্থডে পার্টিতে যে মেয়েটা দুর্দান্ত ডান্স করল, সেই মেয়েটা তো?’
কৌশিক বলল, ‘হ্যাঁ জিতা৷ ওর গল্প আমি তোমায় করেছি অনেক৷ ও ফোনেও কথা বলেছিল তোমার সঙ্গে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘সেগুলো মনে আছে আমার৷ আসলে তোমার আরও দুই মামার মেয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল আমার৷ তাই আইডেন্টিফাই করে নিলাম৷ খুব মিশুকে সোনাঝুরি৷’
কৌশিক বলল, ‘চলো, মামিয়া আর মামাইয়ের সঙ্গে একবার কথা বলবে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক ওঁদের মনের অবস্থার কথাটা একবার ভেবে দেখো৷ এখন প্রশ্ন করাটা কী ঠিক হবে? তুমি বরং একটা কথা বলো, এটা সুইসাইড হতে পারে? কৌশিক যে বেশ ভেঙে পড়েছে, সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ ওর নিজের কোনো বোন নেই৷ সোনাঝুরিই ভাইফোঁটা থেকে রাখি সবকিছুতে এসে হাজির হয় কৌশিকের কাছে৷ তাই ওর প্রতি খুবই টান আঙ্কলের আর কৌশিকের৷ লগ্নজিতা জানে, আঙ্কলের সঙ্গে সোনাঝুরির ভালো বন্ধুত্ব আছে৷ বহু কথা শেয়ার করে ওরা৷ সোনাঝুরিই ফোনে বলেছিল একবার৷ যদিও জিতার সঙ্গে সামনে দেখা হয়েছে ওই একবারই৷ আঙ্কল ওকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দেখো জিতা, সোনাইয়ের কোনো প্রবলেম ছিল না৷ ইন ফ্যাক্ট, ওর কোনো রিলেশনশিপও ছিল না৷ পড়াশোনা থেকে নাচ-গান সবেতে তুখোড় মেয়ে সোনাই৷ তাই আমি এটা মেনে নিতেই পারব না, ও সুইসাইড করতে গিয়েছিল৷ অথচ সুধীর জানাল ড্রাগসের ওভারডোজ৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আঙ্কল, ডক্টরের সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে?’
আঙ্কল বলল, নিশ্চয়ই৷ তুই আয় আমার সঙ্গে৷ লগ্নজিতাকে নিয়ে আঙ্কল সোজা ঢুকল ডক্টর সুধীর মিশ্রর চেম্বারে৷’
সুধীর মিশ্র বললেন, ‘ব্লাড টেস্টে পাঠানো হয়েছে৷ রিপোর্ট চলে আসবে সন্ধের মধ্যে৷ তবে প্রাথমিকভাবে রোগীকে টেস্ট করে যা বুঝেছি, তাতে ড্রাগস অ্যাডিক্টেড ছিল৷ মানে আজকাল তো এমন অনেক রোগী আসে তাই তাদের সিমটমগুলো খুব পরিচিত৷ ব্লাড টেস্ট রিপোর্টটা আসুক তাহলে প্রপার বলতে পারব, ঠিক কোন ড্রাগস ও নিত৷ আপনিও একটু খেয়াল করলে বুঝবেন, স্কিনে একটা ব্ল্যাক স্পট আসছে৷ ওর মা বলল, মেয়ে ডায়েট কন্ট্রোল নাকি বরাবরই করত৷ কিন্তু ইদানীং বলছে খিদে নেই৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ডক্টর, আমি কদিন আগেই একটা খবরে পড়ছিলাম, সম্প্রতি নার্কোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরোর হাতে ধরা পড়েছে বলিউডের ড্রাগ সাপ্লায়ার উসমান শেখ৷ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সামনে এসেছে বেশ কিছু তথ্য৷ বলিউডে একটা ধারণা আছে, মাদক নিলে যৌনতার ইচ্ছে বাড়ে, তাতে নাকি নায়িকারা আরও লাস্যময়ী হয়ে ওঠেন৷ অনেক নায়িকা আবার মনে করেন, মাদক নিলেই সুন্দর চেহারা ধরে রাখা যায়৷ আর তাই এক্সপেরিমেন্টাল মাদকসেবনই ক্রমে হয়ে ওঠে নেশা৷’
ডক্টর বললেন, ‘আর ম্যাডাম, এই সুন্দরী হবার চেষ্টায় কত মেয়ে অল্প বয়সেই নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে, ভাবতেই পারবেন না৷ এক্সারসাইজ বা পুষ্টিযুক্ত সুস্থ খাবার খেয়ে ফিট হবার ইচ্ছে এদের নেই৷ এরা রাতারাতি সুন্দরী হতে চায়৷ এভাবেই এসবের চক্করে পড়ে যায়৷ তারপর নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ শুনলাম পেশেন্টের নাকি চেহারাটাই অবসেশন৷ হিরোইন হতে গিয়ে প্রাণটাই হয়তো যাবে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমায় প্লিজ রিপোর্টটা একটু পাঠাবেন৷ আমি কলকাতায় এদের চক্রটা নিয়েই ছুটে বেড়াচ্ছি৷’
সুধীর মিশ্র বললেন, ‘ম্যাডাম, এ তো ছড়িয়ে পড়েছে৷ কদিন আগে দুজন জিম ইনস্ট্রাক্টর ধরা পড়েছে, জানেন? ভালো বডি বানিয়ে দেব বলে ক্যাপসুল দিত স্টুডেন্টদের৷ ধরা পড়েছে, ওটা কোকেন ছিল৷ তাই একজনকে ধরে লাভ নেই, ম্যাডাম৷ কারা কলকাতায় মাদক নিয়ে আসছে, তাদেরকে ধরতে হবে৷ না হলে এ জিনিস চলতেই থাকবে৷’
লগ্নজিতাকে কিছুটা জোর করেই কৌশিক নিয়ে গেল ওর মামির কাছে৷ ভদ্রমহিলা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন৷ মেয়ের জ্ঞান আদৌ ফিরবে কি না, সেই অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনছেন৷ লগ্নজিতা নরম গলায় বলল, ‘ও ইদানীং নতুন কোনো মেডিসিন নিত? জানেন কিছু?’
ভদ্রমহিলা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ নিচ্ছিল৷ খুব কস্টলি একটা হার্বাল ক্যাপসুল খাচ্ছিল স্কিন আর হেয়ারের প্রোগ্রেসের জন্য৷ আগে খেত কি না জানি না৷ তবে এবারে আমার কাছে পনেরো হাজার চাইল৷ বলল, মা, প্রতিমাসে এটা দেবে আমায়? আমি একটা স্কিন ট্রিটমেন্টে আছি৷ আমি বিশেষ কিছু বলিনি৷ মেয়ের যা জেদ, টাকা না দিয়ে উপায় নেই৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ওষুধটা কোন দোকান থেকে কিনেছে, কিছু বলেছে?’
মহিলা একটু ভেবে বললেন, ‘না, সেটা তো বলেনি৷ তবে বলল, আমি, ঋতিকা আর অনুরূপা তিনজনেই খাচ্ছি৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘এদের ফোন নম্বর আছে? দিতে পারবেন?’
কৌশিক নম্বরগুলো কালেক্ট করে বলল, ‘আমি তোমায় সেন্ড করলাম৷ জিতা, এদের ধরতেই হবে৷ এভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করা উচিত৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘টেনশন কোরো না৷ সোনাঝুরি সুস্থ হয়ে উঠবে৷ প্রয়োজনে কল করো৷’
বাইরে বেরিয়ে হালছাড়া গলায় সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, এরা বট গাছের মতো শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে৷ কাকে ছেড়ে কাকে ধরবেন বলুন তো?’
লগ্নজিতা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘সুশোভন, রুদ্রজ্যোতি বা পারিজাত কেউ কোনো আপডেট দিল? ওদের তদন্তের রেজাল্ট কিছু বলল?’
সুশোভন বলল, ‘রুদ্রস্যার নাকি নিজের তদন্তের প্রোগ্রেস কাউকে বলেন না৷ তবে পারিজাতস্যার যেটুকু বললেন, তাতে বুঝলাম, সুমনকে জেরা করেছেন রুদ্রস্যার৷ ওঁর ধারণা, সুমনই ছেলের হাত দিয়ে এসব পাচার করত৷ আর জয়ন্তর দোকান ওর বাড়ির কাছে, তাই দোকান থেকে নিতে সমস্যা হচ্ছিল না৷ সুমন ধরা পড়ার দিনেই জয়ন্ত খুন হয়েছিল৷ আবার যেদিন সুমন ছাড়া পেল তার পরের দিনই তপন খুন হল৷ ওটাও সুমনেরই প্ল্যান ছিল৷’
লগ্নজিতা একটু ভেবে বলল, ভুল তো কিছু বলছেন না৷ সকালে সুমনের ছেলে ধরা পড়ল আর সন্ধেতে জয়ন্ত খুন হল৷ ছাড়া পাওয়ার পরেই তপন খুন৷ বুঝতে পারছি না৷ রুদ্রস্যার তো সুমনের শত্রু নয়৷ উনি যখন বলছেন, কিছু ভেবেই বলছেন হয়তো৷ চলো, মূর্তি চুরির বিষয়টা নিয়ে একটু দেখতে হবে৷ আমি পেনড্রাইভটা দেখলাম৷ কেসটা জলের মতো পরিষ্কার, বুঝলে৷ রুদ্রস্যার কেন এটাকে এত কমপ্লিকেটেড বলছেন, সেটা বোঝার জন্য একবার আগরওয়ালের বাড়ি যাই আজ সন্ধেতে, চলো৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম চলুন, তার আগে ঋতিকাদের বাড়িটা ঘুরে আসি৷ জলধরবাবুর ক্রাশকেও দেখে আসি৷ এদিকে উৎপলের বেল রিজেক্ট হওয়ায় ভদ্রলোক হেভি খেপে আছে আমাদের ওপরে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ভাইপোর সঙ্গে একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে মনে হচ্ছে৷ এদিকে ইউসুফ বলল, রাঘবকে নাকি দু-দিন জলধরবাবুর বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছে এরা৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, এই ছেলেটা ভীষণ ফিশি৷ পুরো দু’দিকে খেলে৷’
এমনভাব করছিল, যেন এরা ওর শত্রু৷ এখন দেখা যাচ্ছে, দু‘দিকেই খেলে যাচ্ছে৷ লগ্নজিতা বলল, আরে ওর গার্লফ্রেন্ডকে ভাগিয়ে নিয়েছে উৎপল৷ সেই থেকেই রাগ৷ আর এই উৎপল তো বিশ্বপ্রেমিক দেখছি৷ ওদিকে ঋতিকার মতো হাই প্রোফাইল একটা মেয়ে৷ এদিকে পাড়ার দত্ত বাড়ির মধ্যবিত্ত মেয়ে৷ দুটো ফ্লেভারে পোষাচ্ছিল না, আবার কোকেন, হেরোইনের ফ্লেভারও চাই তার৷ উফ জিনিস বটে একটা৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম ডান দিকে ঘুরেই বড় বাগানওয়ালা বাড়ি৷ গেটটা দেখলে তাক লেগে যাবে ম্যাম৷’
লগ্নজিতা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সুশোভন, পরের জন্মে প্রফেসর হব বুঝলে৷ এমন একখানা বাড়ি বানাব৷’
সুশোভন বলল, ‘কেন ম্যাডাম, আপনার হলদিয়ার বাড়িটা তো দারুণ৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘সে তো বাবার কীর্তি৷ আমার তো নয়৷ এটা কি সুবর্ণা গোস্বামীর বাবার বানানো? সুশোভন বলল, হ্যাঁ ম্যাডাম,৷ আহা রে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার উৎপল এবাড়ির জামাই হতে হতে হল না৷ গেটের সামনেই সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে৷’
লগ্নজিতা বলল, সুবর্ণা গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চাই৷’
লগ্নজিতা নিজের পরিচয় দিতেই সিকিউরিটি একটু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল ওদের দুজনের দিকে৷ তারপর প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরে লোকটা এসে বলল, ‘আসুন৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, পুলিশদের জীবনের এই এক বিড়ম্বনা৷ সবাই এড়িয়ে যেতে চায়৷’
বিশাল ড্রয়িং রুমে বসে আছে লগ্নজিতা আর সুশোভন৷ চারদিকে অ্যান্টিক জিনিসপত্র৷ আর দেওয়ালে অসংখ্য ছবি৷ ছবিগুলো এতটাই সুন্দর যে শিল্পকলা না— বোঝা মানুষকেও আকর্ষণ করবে৷ লগ্নজিতা ঘুরে ঘুরে দেখছিল ছবিগুলো৷ সবই খুব দামি ক্যামেরায় তোলা বেশ বোঝা যাচ্ছিল৷ হঠাৎই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল লগ্নজিতার৷ কোথায় যেন দেখেছে ছবিটা৷ সময় নষ্ট না করেই নিজের মোবাইল দিয়ে ছবিটা তুলে নিল ও৷ সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেল৷ যে আসছে, সে যে খুব ব্যস্ততায় আছে, সেটা তার হাঁটার শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে৷ ঋতিকা কেন এত সুন্দরী, সেটা বোঝার জন্য ওর মা সুবর্ণাকে একবার অন্তত দেখা উচিত৷ ব্যক্তিত্ব শব্দটা হয় শুধুই ওর জন্য প্রয়োগ করা উচিত অথবা এই শব্দটা ও নিজেই আবিষ্কার করেছে৷ একে কোনো প্রশ্ন করতেও বাধবে লগ্নজিতার৷ সুবর্ণা গোস্বামী নমস্কারের ভঙ্গিমা করে বলল, ‘বসুন৷ আসলে আমার আজ একটা ইন্টারভিউ আছে ম্যাগাজিনে৷ ওই কারণেই শুটিং ফ্লোরে যেতে হবে৷ যা জিজ্ঞাসা করার, একটু যদি তাড়াতাড়ি করেন, খুব উপকার হয়৷
লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি হয়তো জানেন না, আপনার মেয়ের বয়ফ্রেন্ড উৎপল বলে ছেলেটিকে আমরা অ্যারেস্ট করেছি একটা মার্ডারের কারণে৷’
সুবর্ণা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘বয়ফ্রেন্ড কি না বলতে পারব না, তবে বন্ধু হতেই পারে৷ সে অন্যায় করলে অ্যারেস্ট করবেন— এতে আমার কী বলার আছে?’
লগ্নজিতা বলল, ‘না ম্যাডাম, এটা জাস্ট জানালাম৷ এখন যেটা বলতে এসেছি, সেটা হল, ঋতিকার বন্ধু সোনাঝুরি এখন নার্সিং হোমে ভরতি আছে৷ অতিমাত্রায় ড্রাগস নেওয়ার ফলেই সেন্সলেস অবস্থায় ভরতি করতে হয়েছে৷’
সুবর্ণা যে বেশ চমকেছে, সেটা তার পা দুটোর পজিশন চেঞ্জ করা দেখেই বোঝা গেল৷ তবুও গাম্ভীর্য ধরে রেখেই বলল, ‘হ্যাঁ, সোনাঝুরি ওর ডান্স স্কুলের বন্ধু৷ ঠিক কী হয়েছিল? সুইসাইড নাকি?’
লগ্নজিতা বলল, ‘না, ঠিক সেটা নয়৷ শুনলাম, আরও সুন্দরী হবার বাসনাতেই স্কিন আর হেয়ারের কী একটা প্রোডাক্ট খেতে শুরু করেছিল রিসেন্ট৷ সেটার কারণেই নাকি এমন হয়েছে৷ সোনাঝুরি বলেছে, আমি, ঋতিকা আর অনুরূপা খাচ্ছি৷ ম্যাডাম, একটু মনে করে দেখুন তো, এর মধ্যে ঋতিকা কি আপনার কাছে হাজার পনেরো টাকা চেয়েছিল?’
সুবর্ণা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল উত্তেজনায়৷ ধপ করে বসে বলল, ‘আমার কাছে নয়, দাদুর কাছ থেকে নিয়েছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম, ওই ওষুধ কোনো হার্বাল ওষুধই নয়৷ ওটা ড্রাগস৷ এইভাবেই একদিন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে৷’
সুবর্ণা বলল, ‘অফিসার আপনি কি ওর ঘরটা সার্চ করতে এসেছেন? তাহলে করতেই পারেন৷ ও এখন অ্যারোবিক্সের ক্লাসে গেছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম, একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
সুবর্ণা বলল, ‘নিশ্চয়ই৷’
লগ্নজিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, অপূর্ব ফোটোগ্রাফি আপনার৷’ এরকম প্রশংসা সুবর্ণা প্রথম শুনল না, তাই সেভাবে উচ্ছ´সিত নয় হয়তো৷ অথবা ঋতিকার বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত৷ লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি স্কুলশিক্ষক জলধর ব্যানার্জিকে চেনেন?’
সুবর্ণা একটু অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, ‘এই নামের একজন আমার এগজিবিশনে আসেন মাঝে মাঝেই৷ কিন্তু উনি স্কুলশিক্ষক নন৷ কলেজের প্রফেসর৷
লগ্নজিতা নিজের মোবাইলের ফোটো গ্যালারি খুলে জলধরবাবুর ছবিটা খুলে বলল, ইনি কি?’
সুবর্ণা বললেন, ‘হ্যাঁ ইনিই৷ ভদ্রলোক আমার বেশ কিছু ছবিও কিনেছেন৷ সেই সূত্রেই আলাপ৷ কেন বলুন তো?’
লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম উৎপল এঁরই ভাইপো৷ ইনি বসু ইনস্টিটিউশনের প্রধানশিক্ষক৷ প্রফেসর নন৷’
সুবর্ণা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘মানুষ যে কেন এত অকারণ মিথ্যে বলে, কে জানে! এনিওয়ে, আমায় বেরোতে হবে৷ আপনারা যদি একবার ওর ঘরটা সার্চ করে নিতেন৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম, আমরা সার্চ ওয়ারেন্ট আনিনি৷ তাই অফিসিয়ালি তো সার্চ করতে পারি না৷’
সুবর্ণা হেসে বলল, ‘এসেছেন তো মানবিকতার খাতিরে৷ তাহলে সেই সূত্রেই না হয় কাজটা করুন৷ দেখুন, ঋতি আমার একমাত্র সন্তান৷ ব্যাঙ্কের কাজ সামলে ফোটোগ্রাফি করি আমি৷ হয়তো খুব বেশি সময় দিতে পারি না ওকে তবুও চেষ্টা করি খেয়াল রাখার৷ কিন্তু এরকম সাইলেন্ট কিলার মাদকের পাল্লায় পড়লে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরা৷ প্লিজ অফিসার, ডু সামথিং৷’
লগ্নজিতা সুশোভনকে ইশারা করল৷ সুবর্ণা ঋতির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল৷ লগ্নজিতা আর সুশোভন তছনছ না করে খুবই শান্তভাবে ওর ঘরটা সার্চ করছিল নিজস্ব পদ্ধতিতে৷ একটা অ্যাপল শেপের খুবই আকর্ষণীয় কন্টেনার দেখতে পেল ওর বেডসাইডের ড্রয়ারে৷ সঙ্গে একটা বিল৷ কন্টেনারের ওপরে লেখা— অ্যাট্রাকটিভ৷ সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, এটাই৷ লগ্নজিতারা ওটা নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘ম্যাডাম, একটা কথা জানার ছিল, এই ছবিটা আপনি কোথায় তুলেছেন?’
সুবর্ণা বলল, ‘এটা আমার পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি৷ একটা অ্যান্টিক জিনিসের অকশনে গিয়েছিলাম৷ ওখানেই এই অষ্টধাতুর কৃষ্ণমূর্তিটা দেখেছিলাম৷ মূর্তিটা একটু ব্যতিক্রমী মূর্তি৷ দেখুন, কৃষ্ণর হাতের বাঁশি ধরার পজিশনটা একটু আলাদা৷ আর মাথায় মুকুটের রংটা দেখছেন— এটা প্ল্যাটিনামের৷ বাঁশির ওপরে সাতটা হিরে সেট করা আছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘এটা কবেকার কথা, ম্যাডাম৷’
সুবর্ণা বলল, ‘বছরখানেক আগের কথা৷ এটা নিয়ে টেলিগ্রাফ একটা নিউজও করেছিল৷ আমার এই ছবিটা পুরস্কার পাচ্ছে, সেই অনুষ্ঠানটা কভার করেছিল ওরা৷’
ম্যাডাম, আমি জানি, আপনি তাড়ায় আছেন, ‘তবুও একটা কথা জানার আছে, অকশনটা কার ছিল? মানে মূর্তিটা কে বিক্রি করছিল?’
সুবর্ণা বলল, ‘আমি ফিরে এসে আপনাকে জানাচ্ছি, ম্যাডাম৷ একটা ফাইলে সব নোট করা আছে৷ যা ছবি তুলেছি, সেগুলো কোথায় তুলেছি, তার বড়ো ফাইল আছে আমার৷ রাতে কল করছি আপনাকে৷’
লগ্নজিতা ভদ্রমহিলার পার্সোনালিটি দেখে ভেবেছিল, হয়তো কোনোরকম কোঅপারেশন করবেন না৷ কিন্তু সুবর্ণা সত্যের ভক্ত৷ ওঁর কথায় মিথ্যের গন্ধ নেই বলেই উনি চান, অপরাধী ধরা পড়াক৷
গাড়িতে উঠে সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, মূর্তির কেসটা কী হল?’
লগ্নজিতা বলল, ‘ওটা নেহাতই কাকতালীয়৷ এই মূর্তিটাই চুরি গেছে, সুশোভন৷ রুদ্রস্যার এটাকেই খুঁজছেন৷ ফাউ দুটো তথ্য পেয়ে গেলে ক্ষতি আছে কি তোমার?’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওই সোনাঝুরির খবর তো কিছুই পাওয়া গেল না৷ কৌশিকস্যার তো কিছুই জানালেন না৷’
লগ্নজিতা কৌশিককে ফোন করল বার দুয়েক৷ ফোনটা রিসিভ করল না কৌশিক৷ কোনো মেসেজও পাঠাল না৷ তবে কি সোনাঝুরির কিছু ঘটে গেল? লগ্নজিতা বলল, ‘বুঝতে পারছি না, জানো৷ মেয়েটা বেঁচে আছে তো? দু-ঘণ্টায় সেন্স আসেনি৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওই অ্যাট্রাকটিভের কন্টেইনারটা ল্যাবে দিয়ে আসি, দিন৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘গোটা পাঁচেক ক্যাপসুল দিয়ে এসো৷ বলবে, রিপোর্টটা ইমিডিয়েট চাই৷ আমি একবার নার্সিং হোম ঘুরে থানায় আসছি৷ শোনো, ওই অনীতাকে আজকে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করবে তো৷ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসবে৷
সুশোভন বলল, ‘গোটা দেড় দিন আটকে রেখেও তো পেট থেকে কিছু বের করতে পারলাম না, ম্যাডাম৷ জয়ন্তর স্ত্রী-র অ্যাড্রেসটা দরকার৷’
লগ্নজিতা নার্সিং হোমের দিকে চলল৷ মাথার মধ্যে অজস্র ভাবনার আনাগোনা চলছে৷ গ্যারেজের বিজয়ের কথামতো রিম্পা থেকে তপন, জয়ন্ত থেকে তার স্ত্রী, জলধরবাবু থেকে উৎপল, রাঘব থেকে আরও দুজন স্কুল টিচার— সকলে জড়িত এ কাজে৷ রুদ্রস্যারের ধারণা অনুযায়ী সুমনও জড়িত এতে, কিন্তু খুনি কে? জয়ন্ত আর তপনের খুনি কি একই ব্যক্তি নাকি আলাদা? তপন মহান্তি হাতে ফোন নিয়ে ভিডিয়ো করে বেড়াত৷ জয়ন্ত খুনের দিন থেকে তার অ্যাকাউন্টে অকারণ টাকা ঢুকেছে৷ যে টাকা দিয়েছে, সে অনলাইনের যুগেও অনলাইন পেমেন্ট করেনি৷ তপন নিজে গিয়ে ক্যাশ জমা দিয়ে এসেছে৷ জলধরবাবু সব জেনেও জয়ন্তর দোকান নিয়ে কোনো অবজেকশন দেননি৷ তপন, জয়ন্ত, জলধর, রিম্পা এদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চেক করলেই বোঝা যায়, এরা নিজের স্যালারি ছাড়াও অন্য সোর্স থেকে টাকা ইনকাম করত৷ তাই এদের মধ্যেই বখরা নিয়ে ঝামেলা হত৷ খুনি এর মধ্যে থেকেই কেউ৷ মাথার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা জট পাকাচ্ছিল৷