সক্রেটিসের শিষ্য
জয়ন্তর দোকানের সামনে গিয়ে দেখল দোকানের শাটার নামানো৷ কিন্তু তাড়াহুড়োতে দুটো তালা দেওয়া নেই৷ একদিকে তালা দিয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়েছে জয়ন্ত প্রামাণিক৷ এ সময় দোকান বন্ধ থাকার কথা নয়৷ রিম্পা বলল, ‘আমি তো আধ ঘণ্টা আগে যখন এলাম দোকানের পাশ দিয়ে তখনও দোকান খোলা ছিল, ম্যাডাম৷ তা ছাড়া স্কুল চলাকালীন দোকান বন্ধ থাকে না৷ রবিবার বন্ধ রাখেন উনি৷ পিকুকে নিয়ে আজ ব্যাঙ্কে যেতে হবে বলেই স্কুলে পাঠাইনি আমি৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘চলুন, স্কুলে হেডস্যারের সঙ্গে একটু কথা বলে যাই৷’
রিম্পা ইতস্তত করে বলল, ‘ম্যাডাম, পিকুকে যদি আর স্কুলে না নেয়৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘খবরটা পুলিশই স্কুলে পাঠাবে৷ তাই আমাদের যেতে কোনো সমস্যা নেই৷’
রিম্পা ঘাড় নিচু করে লগ্নজিতাকে ফলো করল৷
প্রধানশিক্ষক মানুষটা বেশ প্রাণখোলা৷ লগ্নজিতাকে আপ্যায়ন করে নিজের রুমে বসিয়ে বললেন, ‘বলুন ম্যাডাম, আপনার জন্য কী করতে পারি? আমরা কিন্তু ডেঙ্গি সচেতনতা থেকে ম্যালেরিয়ার জন্যও মিছিল বের করেছি৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি কত বছর আছেন এই স্কুলে?’
প্রধানশিক্ষক জলধর বন্দ্যোপাধ্যায় একটু চমকে উঠেই উত্তর দিলেন, ‘তা প্রায় বছর চব্বিশ হল৷ কেন বলুন তো?’
লগ্নজিতা গোটা ঘরটায় চোখ বুলিয়ে বলল, আপনি সক্রেটিসের ফ্যান মনে হচ্ছে৷ সাধারণত প্রধানশিক্ষকদের অফিস রুমে বিবেকানন্দ, নেতাজিদের ছবি দেখতে পাই৷ আপনার দেখছি সক্রেটিস৷
জলধরবাবু যে একটু থমকালেন, সেটা চোখ এড়াল না লগ্নজিতার৷ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, আমি দর্শনের ছাত্র ছিলাম৷ ওঁকে গুরু মনে করতাম৷ সেই থেকেই আর কি৷
লগ্নজিতা বলল, এনিওয়ে, আসল কথাতে আসি৷ আপনার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র পিনাক মণ্ডলকে আজ বিধাননগর থানার পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে, আপনি জানেন?
জলধরবাবুর যতটা চমকানোর কথা ছিল, ততটা যেন চমকালেন না৷ কিছুটা যেন মেকি চমকের অভিনয় করে বললেন, সে কী, কখন? কেন? পিনাক স্কুলে এসেছিল আজ?
রিম্পা ঘাড় নেড়ে বলল, স্যার, ব্যাঙ্কে গিয়েছিল অ্যাকাউন্ট খুলতে৷ স্কুলে আসেনি৷
জলধরবাবু একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ম্যাডাম, ক্লাস সেভেনেই আমার স্টুডেন্ট আছে প্রায় দেড়শোজন৷ তার মধ্যে কেউ একজন স্কুলে অ্যাবসেন্ট অবস্থায় কোথায় ড্রাগ বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, তার দায়িত্ব তো স্কুলের বা আমার হতে পারে না৷ এটা তো অভিভাবকদের দেখতে হবে, ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘আপনি কিন্তু যথেষ্ট খেয়াল রাখেন স্টুডেন্টদের৷ যে স্টুডেন্ট আজ স্কুলে আসেনি, সে-ও কী বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, সেটাও আপনার নখদর্পণে৷ আমায় স্বীকার করতেই হচ্ছে, আপনি ছাত্র অন্ত প্রাণ৷’
জলধরবাবু বুঝতে পারলেন বেফাঁস বলে ফেলেছেন৷ কারণ লগ্নজিতা পিনাক অ্যারেস্ট হবার কারণটা এখনও বলেইনি৷ সামাল দিতে গিয়ে বললেন, ‘দেখুন, ম্যাডাম আমিও একটু আগেই খবরটা পেয়েছি৷ স্কুলকে এ ব্যাপারে জড়াবেন না৷ এটা একটা নামকরা প্রতিষ্ঠান৷ এ বছর আমরা হীরকজয়ন্তী পালন করব৷ এর মধ্যে এসব ঘটনা আমার প্রতিষ্ঠানকে বদনাম করে দেবে৷ প্লিজ ম্যাডাম মিডিয়া ছিনেজোঁকের মতো পড়ে যাবে৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তা-ই বলে আপনি বহালতবিয়তে স্কুলে বসে ড্রাগসের বিজনেস চালাবেন আর বাচ্চাগুলো ফাঁদে পড়বে—এটা তো চলতে পারে না, মিস্টার প্লেটো৷ থুরি জলধরবাবু৷
দেখুন ‘অন্যায় করে লজ্জিত না-হওয়াটা আরেক অন্যায়৷’ আমি নয়, আপনার গুরুবচন৷ তাই স্বীকার করুন, আপনি এ ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ লজ্জা করে না, আপনার জন্য একটা অবোধ শিশু হয়তো সারাজীবন হোমে কাটাবে!’ লগ্নজিতার গলার আওয়াজেই স্যারের রুমের সামনে অলরেডি উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে গেছে অন্য টিচারদের৷ সকলের চোখেই কৌতূহল৷
জলধরবাবু ভেঙে-পড়া গলায় বললেন, ভুল করছেন ম্যাডাম৷ আমি কোনোভাবেই এর সঙ্গে জড়িত নই৷ আমি শুধু আমার স্কুলকে গার্ড দিতে চাই৷ মিথ্যাটা এজন্যই বলেছিলাম৷ আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য করব ম্যাডাম৷ প্লিজ বিশ্বাস করুন, আমি আজকের আগে ঘুণাক্ষরেও জানতাম না, আমার স্কুলের ছাত্ররা এসবে জড়িয়েছে৷ আপনি চলুন আমার সঙ্গে ক্লাস সেভেনের ক্লাসরুমে৷ পিনাকের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করুন৷
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি খবরটা পেলেন কোথা থেকে?’
জলধরবাবু বেশ ভেঙে পড়েছেন, সেটা ওঁর উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ ভাঙা গলায় বললেন, ‘ওই ব্যাঙ্কে তখন আমার একজন এক্স-স্টুডেন্ট ছিল৷ ওই ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টে আছে৷ সে-ই ফোন করে বলল, স্যার, আমাদের স্কুলের স্টুডেন্ট ধরা পড়েছে ড্রাগ বিক্রি করতে গিয়ে৷ স্কুলে পুলিশ যাবে দেখবেন৷ এছাড়া আমি আর কিছুই জানি না, ম্যাডাম৷ আমি দীর্ঘদিন সম্মানের সঙ্গে এই পেশায় আছি৷ আপনি এ চত্বরে খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমার সম্পর্কে সকলে কী বলে৷ এ বিদ্যালয় আমার শুধু কাজের জায়গা নয় ম্যাডাম, আমার স্বপ্ন৷ তাই আমি চাই না, সে স্বপ্নের গায়ে কোনো দাগ লাগুক৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনার স্কুলের ছাত্র এসবের সঙ্গে যুক্ত অথচ স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না, এটা আমাদের মতো জটিলমনস্ক মানুষের বিশ্বাস করা একটু মুশকিল, স্যার৷ এনিওয়ে, চলুন, পিনাকের বন্ধুদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই৷ আর আপনার স্কুলের শিক্ষকদের বলে দেবেন, তারা যেন আপাতত কলকাতার বাইরে না যায়৷
লগ্নজিতা রিম্পাকে নিয়েই গেল ক্লাস সেভেনের বি সেকশনে৷ অঙ্কের স্যার তখন মনোযোগ দিয়ে শেষ অঙ্কটা কষছিলেন বোর্ডে৷ পুলিশের পোশাক দেখে একটু বোধহয় ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘স্যার এনি প্রবলেম?’
হেডস্যার ইশারায় বললেন, ‘পরে বলছি৷ আপাতত ওঁকে কাজ করতে দিন৷’
লগ্নজিতা হেডস্যারকে বলল, এদের সকলের ব্যাগ চেক করার ব্যবস্থা করুন এখুনি৷ আর পিনাকের বন্ধু কে কে এই ক্লাসে, তারা এগিয়ে এসো৷ আমি কাউকে বকব না৷ সকলকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব মাত্র৷’
বেদান্ত নামের একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল, ‘পিনাক আমার বেস্টফ্রেন্ড, ম্যাম৷’ সকলের ব্যাগ সার্চ করেও তেমন কিছুই পাওয়া গেল না৷ শুধু শুভময় বলে একটি ছেলের ব্যাগে ওই একই চকোলেটের কয়েকটা খালি প্যাকেট পাওয়া গেল মাত্র৷ লগ্নজিতা ওগুলোর ল্যাব টেস্ট করাবে বলে সরিয়ে রাখল৷ বেদান্তর কথা অনুযায়ী পিনাক রেগুলার স্কুল ছুটির পরে জয়ন্তর দোকানে যেত৷ এটা প্রায় মাসখানেকের ঘটনা৷ বেদান্ত জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল, ‘চকোলেট দেয় জয়ন্তকাকা৷ ওগুলো বিক্রি করলেই পয়সা পাব৷’ বেদান্তকেও একদিন সেই চকোলেট বিক্রি করতে দিয়েছিল৷ কিন্তু বেদান্ত চকোলেট বিক্রি করছে শুনলে ওর বাবা মারবে বলেই সে পিনাকের কথাতে রাজি হয়নি৷ পিনাক ওই চকোলেট বিক্রির টাকায় মোগলাই, রোল এসব খেত ক্যান্টিন থেকে৷ তবে ওই চকোলেট বেদান্ত কখনো খেয়ে দেখেনি৷
লগ্নজিতার ফোনে বার দুয়েক সুশোভনের ফোন এসেছে৷ সেটা দেখেই জলধরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, কোঅপারেট করবেন, আশা করি৷ তাহলে আমি এই চক্রটার সন্ধান পাব৷
জলধরবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, সব রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত৷ শুধু দেখবেন, আমার স্কুলের নাম যেন খারাপ না হয়৷