অষ্টধাতুর কৃষ্ণমূর্তি
লগ্নজিতা দেখল, ওর ফোনটা বেজে চলেছে৷ কৌশিক ফোন করছে৷ ফোনটা রিসিভ করতেই কৌশিক বলল, ‘জাস্ট জ্ঞান ফিরেছে সোনাইয়ের৷ কিন্তু এখনও নর্ম্যাল কন্ডিশনে আসেনি৷ কাঁদছে, হাসছে— কেমন একটা পাগলের মতো বিহেভ করছে৷ ডক্টর জানালেন, স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগছে৷ তখন ডক্টরের চেম্বারে ছিলাম তাই ফোন সাইলেন্ট করা ছিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘তুমি এখন কোথায়?’
কৌশিক বলল, ‘বাবাকে বাড়িতে দিয়ে হসপিটালে যাব একবার৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক, তোমার এক পরিচিত ছিল না যে অকশন করায়৷ ওই যে একবার তুমি আমায় একটা অ্যান্টিক নেপালি ছুরি গিফট করেছিলে৷’
কৌশিক বলল, হ্যাঁ, ওর নাম সীমান্ত৷ আমার স্কুলের বন্ধু৷ লেখাপড়াটা মন দিয়ে না করেও যে বড়োলোক হওয়া যায় ইধার কা জিনিস উধার করে, সেটা ও প্রমাণ করে দিল, বুঝলে৷ কিন্তু কেন বলত? হঠাৎ ওকে কেন চাইছ?
লগ্নজিতা বলল, ‘আমায় এখন নিয়ে যেতে পারবে ওর কাছে?’
কৌশিক একটু থমকে বলল, ‘জিতা, তুমি কি আজীবন এরকমই থাকবে? মানুষ হিরের আংটি চায়, দামি গাড়িও চায় তার উড বির কাছে তা নয়, অকশন করা এজেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চাই৷ তোমার মাথায় এমন উদ্ভট ভাবনার উদয় কেন হয় জিতা?’
লগ্নজিতা বলল, যদি না নিয়ে যেতে পারো, বলে দাও, আমি ঠিক খুঁজে নেব৷’
কৌশিক একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তোমার এই অভিমানী গলাটা শোনার পরে আমি যে সব কাজ ফেলে চলে যাব— এটুকু রিড করেই নিয়েছ আমায়৷ তাই শেষ অস্ত্রটা যথাসময়ে নিক্ষেপ করেই দাও তুমি৷ কোথায় আছো বল?’
লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার বাড়ির একদম কাছে৷ তুমি ফোন ধরছিলে না বলে টেনশনে নার্সিং হোমে যাচ্ছিলাম৷ আপাতত ডক্টর’স ভিলা থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে আছি৷’
কৌশিক বলল, ‘জিতা, আমার আজ লাঞ্চ করা হয়নি৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘সে তো কোনোদিনই হয় না, ডিয়ার৷ রোজই তো বিকেল চারটে তোমার লাঞ্চ টাইম৷ ’
কৌশিক বলল, ‘এগিয়েই যখন এসেছ আরেকটু এগিয়ে আমিনিয়াতে চলে এসো৷ খেয়ে নিয়ে সীমান্তর সঙ্গে মিট করব৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘শোনো, খাওয়ার সময় আমি পাশে পাখা নিয়ে বসে থাকতে পারব না, কারণ আমিও খাব৷ বিরিয়ানির গন্ধে আমার মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়, জানো কৌশিক৷ মনে হয়, ওই রুদ্রজ্যোতিস্যারই এ কেসটার ফয়সালা করুক৷ কী দরকার এত জটিলতায় জড়ানোর?’
কৌশিক বলল, ‘এই শোনো, তুমি বরং বেড়াল মাছ ফেলে চলে গেছে টাইপ ঢপ আমায় দিয়ো৷ আমি ভাবব সেই বেড়ালটা বৈষ্ণবধর্ম পালন করছে৷ কিন্তু প্লিজ তুমি জটিল কেস থেকে নিজের নাকটা সরিয়ে নেবে— এটা বিশ্বাস করতে বোলো না প্লিজ, হজমেরও তো একটা ব্যাপার আছে৷ কোথায় তুমি? আমি আমিনিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে, জিতা৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমি ঠিক তোমার পিছনে৷’
রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার অর্ডার দিয়েই কৌশিক বলল, ‘আমি চাই, তুমি এই কেসটা সলভ করো৷ সোনাঝুরির অবস্থা আজ দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে, এইভাবে নিঃশব্দে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোকে মরতে দেওয়া যায় না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘মাদকের নেশাকে সাইলেন্ট কিলার বলাই যায়, কৌশিক৷ কোনো রক্তপাত নেই, বন্দুকের আওয়াজ নেই, গলায় ফাঁস লাগানো নেই অথচ এগুলো কিন্তু একেকটি প্ল্যানড মার্ডার৷ প্রথমে একটা ক্যাপসুল, তারপর দুটো, তারপর অনেকগুলো৷ ডিপ্রেশন কাটানোর নামে ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছে এরা৷ ওভারডোজ নিতে যাচ্ছে, তারপর নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে৷ কী ভয়ংকর ভাবো তো৷ ইদানীং কলকাতায় এত ছড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা, জাস্ট ভাবতে পারছি না৷ বলিউডে বহুদিন ধরেই এর রমরমা, কিন্তু এখন সাধারণের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বিষয়টা৷’
কৌশিক বলল, ‘এই রে, ভুল হয়ে গেছে একটা৷ সোনাইয়ের ফোনটা মনে হয়, ওর পকেটে ছিল, ওকে কেবিনে ঢোকানের সময়ে নিজের কাছে রেখেছিলাম, আর ফেরত দেওয়া হয়নি৷ মাথার কি ঠিক ছিল এতক্ষণ? এখন ফোনটাতে রিং হচ্ছে৷ দেখি, হসপিটাল থেকে ঘুরে সেই রাতে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে ফোনটা৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ফোনটা রিসিভ করো প্লিজ৷’
কৌশিক ইতস্তত করে বলল, ‘অন্যের ফোন রিসিভ করব? অনুরূপা ওর বন্ধু, সে ফোন করছে তো৷’
জিতা বিরক্তির গলায় বলল, ‘যুধিষ্ঠির কি তোমাকেই দায়িত্ব দিয়ে গেছে কৌশিক, কলিযুগে তার রোলটা প্লে করার জন্য? ফোনটা রিসিভ করো৷ আমার দরকার আছে৷ কৌশিক, মুখটা এমন করে আছ কেন? তোমায় কি আমি ফুল প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে পাঁচশো মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছি?’
ফোনটা রিসিভ করতেই অনুরূপা বলল, ‘এই সোনাঝুরি, তুই যে বলেছিলিস, আজকে আমাকে একবার এলিগেন্ট স্পা-তে নিয়ে যাবি, এদিকে ফোনটাই তো ধরছিস না৷ শোন-না, অ্যাট্রাকটিভটা দুরন্ত কাজ হয়৷ বিলিভ মি, আমি জাস্ট টেনশন ফ্রি হয়ে গেছি৷ এবারের ফেসিয়ালটা আমি এলিগেন্ট থেকেই করব৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমি ওর রিলেটিভ কথা বলছি৷ ও একটু অসুস্থ রয়েছে৷ তাই ফোনটা আমার কাছে৷ আচ্ছা অনুরূপা, এই এলিগেন্ট স্পা-টার অ্যাড্রেস আমায় একটু দিতে পারবে? সোনাঝুরিও বলেছিল এর নাম৷ আমিও একবার ফেসিয়াল করাতে যাব ভাবছি৷’
অনুরূপা বলল, ‘কী হয়েছে সোনাঝুরির? সিরিয়াস কিছু?’
লগ্নজিতা বলল, ‘ডায়েট করে করে উইক হয়ে পড়েছিল৷ তাই চেকআপে ঢুকেছে৷’
অনুরূপা বলল, ওহ৷ আমি বলছি, অ্যাড্রেসটা আপনি লিখুন৷’ ফোনটা কেটে দিল জিতা৷ কৌশিক মুখ চুন করে বসে ছিল এতক্ষণ৷ মনে হচ্ছিল, পার্টনার ব্যাঙ্কের ভল্ট ভাঙছে আর ওকে পাহারা দিতে দেওয়া হয়েছে৷
কৌশিক জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘জিতা, তোমরা যখন পুলিশের ট্রেনিং নাও তখন কি এটারও ট্রেনিং দেওয়া হয়?’
লগ্নজিতা মাটনের টুকরোটা আলতো করে ভাঙতে ভাঙতে বলল, ‘কীসের ট্রেনিংয়ের কথা বলছ বলোতো?’
কৌশিক বলল, ‘এই অবলীলায় মিথ্যে বলার৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘সে তো তোমরাও ট্রেনিং নাও, বস৷ গ্যাস হয়েছে পেটে জেনেও ইউ.এস.জি. করতে পাঠিয়ে দাও ল্যাবে৷ কেন? কারণ ওই ল্যাব বছরের শেষে তোমাদের বাড়িতে বিদেশ ভ্রমণের দুটো টিকিট পাঠিয়ে দেবে৷ মাথাব্যথা হচ্ছে বলে ডক্টরের চেম্বারে ঢোকার পর ডক্টর এমন ভয় দেখিয়ে দেবে যেন মনে হয় ব্রেন টিউমারটা এখুনি ফেটে যাবে বুঝি৷’
কৌশিক মুখ ভারী করে বলল, ‘আমি তেমন ডাক্তার নই৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘এই কোয়ালিটি কমেছে বলো এদের বিরিয়ানির? না না, আমি তো সব ডাক্তার কথা বলিনি৷ বললাম, এসব ট্রেনিংও বোধহয় দেওয়া হয়৷ আমাদের পুলিশেও দেশের আইন রক্ষার শিক্ষা দেওয়া হয়, তারপর কী করে যেন এই প্রফেশনে ঢুকেই লোকের বাঁ হাতটা বড়ো বেশি সচল হয়ে যায়৷ বাঁ হাত পেতেই থাকে কাগজের নোটের লোভে৷ আর বাকি রইল মিথ্যে বলা, সত্যের সন্ধান করার জন্য যতক্ষণ মিথ্যে বলতে হবে, আমি বলব৷ আপাতত সোনাঝুরির ফোনটা আমি একবার চেক করব৷’
কৌশিক বলল, ‘অন্যের ফোন চেক করাটা অন্যায়৷ লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক, তোমার বোন আজ মারা যেতে পারত, যে চক্রটাতে পড়েছে, সেটাকে খুঁজে বের করতে হবে না?’
কৌশিক চুপচাপ ফোনটা দিয়ে বলল, ‘চলো, সীমান্তকে মেসেজ করেছিলাম, ওর অফিসেই আছে, যেতে বলল৷ কিন্তু তোমার এই পুলিশের ইউনিফর্ম দেখলে একটা কথাও বলবে না৷ কারণ ওরা প্রচুর চোরাই জিনিস বিক্রি করে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আরে, ও নিয়ে চিন্তা কোরো না বস৷ আমার গাড়িতে সব সময় দুটো সেট জামা-প্যান্ট থাকেই৷ কখন কার সঙ্গে চায়ের আড্ডায় বসতে হয়, সেই ভেবেই৷’
কৌশিক বলল, ‘কিন্তু চেঞ্জ করবে কোথায়?’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তোমার সামনে নিশ্চয়ই করব না, সে আশাও কোরো না৷’
কৌশিক মুচকি হেসে বলল, ‘আহা, আশায় বাঁচে চাষা৷ লগ্নজিতা বলল, ‘ওয়েট, এদের ওয়াশরুমেই কাজ সারব৷ ‘কৌশিক কিছু বলার আগেই বাইরের পার্কিংয়ের দিকে ছুট দিল জিতা৷
ড্রেস চেঞ্জ করে একটা ব্লু ফেডেড বেল বটম জিনস আর লাইট অলিভ কালারের টি-শার্ট পরে রেডি হয়ে বলল, কী ডক্টর, এখন তোমার উড বি বলে পরিচয় দিতে পারবে তো?’
কৌশিক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘সানন্দে ৷’
লগ্নজিতা মুচকি হেসে বলল, ‘প্রেম বড়োই অন্ধ৷ এই একটা কথা আমি মেনে নিলাম৷’
কৌশিক কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলল, ‘মানে? হঠাৎ এ কথাটা কেন বলছ?’
জিতা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, ‘না হলে আমার মতো সানট্যান-পড়া চেহারা দেখে তুমি মুগ্ধ হও৷’
কৌশিক অভিমানী গলায় বলল, ‘মোটেই না, প্রেমের অন্তত চারটে চোখ আছে৷ একটা চোখ দিয়ে সে প্রেমিকার ডেডিকেশন দেখে৷ আরেকটা চোখ দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা পরখ করে৷ আরেকটা চোখ দিয়ে সততাটা চেখে নেয়৷ শেষ চোখ দিয়ে দেখে নেয়, তাকে কতটা ভালোবাসছে৷ এগুলো সব আমি দেখেশুনে তারপর ধপাস হয়েছি৷ সোজা গিয়ে লেফট টার্ন নিয়ে একটা ক্যাফেটরিয়া আছে, ওটার ওপরে ওর অফিস৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘লেট’স গো৷ আমি তোমার গাড়িকে ফলো করছি৷’
সীমান্ত বসুর অফিসটা বেশ ছিমছাম৷ প্রচুর অ্যান্টিক জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো৷ ভদ্রলোক ব্যাবসাটা মারাত্মক বোঝেন৷ সব জিনিসের গলায় একটা করে গোল্ডেন ট্যাগ লাগানো, তাতে জিনিসটির বিক্রয়মূল্য আর জিনিসটির প্রাপ্তিস্থান লেখা আছে৷ কৌশিককে দেখেই সীমান্ত উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বল বস, তোর জন্য কী করতে পারি৷ তুই আমাদের স্কুলের গর্ব, আমাদের ক্লাসের গর্ব ছিলিস৷ তখন মাইরি তোর দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, ছেলেটা এমন টকাটক অঙ্ক কষে কী করে? তারপর বুঝলাম, তোর মাথায় ভগবান বুদ্ধিটাই বেশি দিয়ে দিয়েছে৷’
কৌশিক বলল, ‘হ্যাঁ ভগবান আমার মাথায় বুদ্ধি দিয়েছে আর তোর কপালে টাকা৷’
সীমান্ত বিশাল খুশি হয়ে গর্বিত ভঙ্গিমায় হেসে বলল, ‘ধুর কী যে বলিস!’
সীমান্ত বলল, ‘বল, কী জন্য গরিবকে মনে করলি? সেই স্কুলের রিইউনিয়নের পর আবার দেখা৷ কী খাবি বল?’ এতক্ষণে লগ্নজিতাকে খেয়াল করে সীমান্ত বলল, ‘ওহ সরি ম্যাডাম৷ পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে খেয়ালই করিনি আপনাকে৷’
কৌশিক বলল, ‘আমার উড বি৷’
সীমান্ত নমস্কারের ভঙ্গিমা করে বলল, ‘কী সৌভাগ্য৷ স্ন্যাক্স আর কফি আনাই কথা বলতে বলতে শুনব৷’
কৌশিক বলল, আমরা খেয়েই এলাম৷ তুই শুধু কোল্ড ড্রিঙ্ক আনা৷’ সীমান্ত ফোনে কাউকে কোল্ডড্রিঙ্কের অর্ডার দিতেই কৌশিক বলল, ‘জিতার খুব শখ, আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটা কিছু অ্যান্টিক জিনিস দিয়ে সাজাই৷ তখনই তোর কথা মনে পড়ল৷ একটু গাইড করবি তুই৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমার একটা জিনিস চাই, আপনাকে ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷’
সীমান্ত ডাক্তার বন্ধুর কাছ থেকে এতটা গুরুত্ব পেয়ে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই বলুন, না ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা অষ্টধাতুর কৃষ্ণমূর্তিটার ছবি দেখিয়ে বলল, ‘এটা৷’
সীমান্ত একটু অবাক হয়েই বলল, ‘এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন, ম্যাডাম?’
লগ্নজিতা বলল, আমার এক পরিচিত ফোটোগ্রাফারের অ্যালবাম থেকে৷ উনি এই ছবিটার জন্য ক্যালকাটা বেস্ট ফোটোগ্রাফির অ্যাওয়ার্ডও জিতেছেন৷’
সীমান্ত বলল, বুঝেছি৷ ‘আপনি বোধহয় সুবর্ণাম্যামের কথা বলছেন৷ উনি অকশনের ছবি তুলতে আসেন মাঝে মাঝে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ, সুবর্ণাদির বাড়িতেই দেখেছিলাম ছবিটা৷ এই কৃষ্ণমূর্তিটা আমায় পাইয়ে দিন৷ টাকা যা লাগে, আমি দেব৷’
কৌশিককে কনুই দিয়ে এক গুঁতো দিল জিতা৷ কৌশিক মুখটা এমন করে আছে যেন কয়েতবেলের আচার চুরি করতে গিয়ে দিদার হাতে ধরা পড়েছে৷ জিতার গোঁত্তা খেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ সীমান্ত, টাকা নিয়ে ভাবিস না৷ আমার শ্বশুরের প্রচুর টাকা৷’
সীমান্ত কোল্ড ড্রিঙ্ক দুটো সামনে রেখে বলল, ‘ওরে টাকা নয়, প্রবলেম অন্য জায়গায়৷ এটা আর ভারতে নেই৷ একজন এন.আর.আই. কিনে নিয়ে ইয়োরোপে চলে গেছে৷ আমার অকশনেই সেল হয়েছিল মাস চারেক আগে৷ পাঁচ কোটিতে বিক্রি হয়েছিল, বুঝলি৷ এই যে বাঁশিটা দেখছিস, তাতে যে পাথরগুলো দেখছিস, সব ক’টা দামি হিরে, বুঝলি৷ আর মুকুটে দেখ পান্না আর চুনির কাজ৷
লগ্নজিতা বলল, ‘বেচল কে এটাকে? এমন জিনিস কেউ বেচে?’
সীমান্ত বলল, এস. আগরওয়াল৷ আরে ভদ্রলোক এটা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন৷ আরও দুই ভাই এর ভাগীদার৷ লোকটা এতটা চালাক যে অকশন করে বিক্রি করে দিয়ে সে টাকা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বাকি ভাইদের গল্প দিয়েছে, ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে চুরি গেছে৷ লোকটা মহা ধুরন্ধর লোক৷’
লগ্নজিতা মনখারাপ করে বলল, ‘এই আগরওয়ালের বাড়ি কোথায়, কলকাতায়?’
সীমান্ত বলল, ‘আরে এই তো বউবাজারে গোটা তিনেক সোনার দোকান আছে এর৷ আর কী কী আছে জানি না, তবে টাকা আছে প্রচুর, আর টাকার লোভও প্রচুর৷ না হলে বংশানুক্রমে পাওয়া এমন কৃষ্ণমূর্তি কেউ বেচে দেয়?
লগ্নজিতা বলল, ‘আচ্ছা, ওই প্রবাসী বাঙালির ছবি আছে আপনার কাছে? সীমান্ত বলল, ‘সে হয়তো আছে৷ কিন্তু উনি বেচবেন না, ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা বলল, পাঁচ কোটি দিয়ে এটা কেনার ক্ষমতা আপনার বন্ধুর নেই৷ এটা শুধু কৌতূহলমাত্র৷ আশাভঙ্গের পরের স্টেপ এগুলো৷’
সীমান্ত আর কৌশিক হেসে উঠল৷ সীমান্ত বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম, অ্যান্টিক জিনিসের কোনো অভাব নেই আমার কাছে৷ বলতে পারেন এ শহরের সব থেকে বড়ো অকশন ডিলার আমি৷ প্রতিসপ্তাহে একটা করে বড়ো অকশন করেই থাকি৷ এরকম ধরনের কৃষ্ণমূর্তি পেলেই আমি আগে কৌশিককে কল করব৷’ হোয়াটসঅ্যাপে সম্ভবত ইয়োরোপের ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ আছে সীমান্তর৷ ধনী খদ্দের, তাই নিজের তাগিদেই যোগাযোগ রেখেছে সীমান্ত৷ ওখান থেকে ছবিটা নিয়ে কৌশিকের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, ‘তারপর বল বিয়েটা কবে করছিস৷ নিমন্ত্রণ যদি না পাই, হামলা করব কিন্তু৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ করবো সীমান্তদা৷ আজ আসি৷’
বাইরে বেরিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক, এ তো পুরো গোলকধাঁধা৷’ মূর্তি চুরিই যায়নি, বেচে দিয়ে চুরি হয়েছে বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিয়োগ করে ফেলল আগরওয়াল, যাতে ফ্যামিলির লোকজন ওকে সন্দেহ না করে৷ এদিকে রুদ্রজ্যোতিস্যার দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে গত তিন মাস ধরে গোরু খোঁজা খুঁজে চলেছেন এই মূর্তিটাকে৷ কলকাতার যত পুরোনো অ্যান্টিকের দোকান খুঁজে ফেলেছেন নাকি ভদ্রলোক৷ আচ্ছা উনি সীমান্তর কাছে এলেন না কেন বলোতো?’
কৌশিক বলল, এলেও সীমান্ত বলবে না৷ আরে, অপরিচিত লোকের কাছে ওরা এমন ভাব করে থাকে যেন এসব অকশনের বিষয়ে ও কিছুই যানে না৷ কারণ অনেক চোরাই জিনিসও জেনে-বুঝে বিক্রি করে দেয় ওরা৷ হ্যাঁ জিনিসটা হয়তো ওরা চুরি করে না, কেউ একজন এসে সস্তায় বেচে দেয় ওদের৷ কিন্তু এটা কেনাও তো অন্যায় তা-ই না?’
লগ্নজিতা বলল, ‘আইনের নাকের ডগায় বসে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এরা এসব করে বেড়াচ্ছে, বলো৷ আমরা নিরুপায়৷’
কৌশিক বলল, ‘জিতা, সীমান্ত আমায় বিশ্বাস করে সব বলল, প্লিজ ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ো না৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘দেব না৷ সোনাঝুরির ফোনটা একবার দাও৷’
কৌশিক আবার মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে গর্হিত কাজটা করল৷ লগ্নজিতা মনে মনে বলল, কলিযুগে এই ধর্মপুত্রকে নিয়ে আমার হয়েছে বিপদ৷ লোকটা কেন যে এতটা সৎ, কে জানে! ফোনটা ঘেঁটে কয়েকটা নম্বর নিজের ফোনে নিয়ে ফোনটা কৌশিকের হাতে দিয়ে বলল, ‘ভাবছি একটা ঝোলা আর একটা একতারা কিনে তোমায় বাউল বানিয়ে দেব৷ উফ কৌশিক অমন অপরাধী-অপরাধী মুখ করে থেকো না৷’
কৌশিক গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘আমি হসপিটালে চললাম৷ তুমি সাবধানে ফিরো৷ রাতে কল করব৷’