স্বীকারোক্তি
পার্লার থেকে ফেরার পথেই ফোনটা এল৷ লগ্নজিতা বলল, ‘বলো সুমন, দেখা করতে চাও? আমি ওয়েট করছিলাম, কবে তুমি নিজে মুখে অপরাধগুলো স্বীকার করবে৷ আসলে তোমায় খুব বিশ্বাস করতাম৷ মনে হত গরিব হলেও সততাটুকুই তোমার সম্পদ৷ কিন্তু আমার ভুল ভাঙল যখন, তখন সত্যিই কষ্ট পেলাম৷ রুদ্রজ্যোতিস্যার বলেছিলেন, সুমন দোষী, ওকে অ্যারেস্ট করুন৷ কিন্তু আমি অ্যারেস্ট না করে অপেক্ষা করছিলাম তোমার ফোনের৷ ভেবেছিলাম, তুমি ফোন করবে৷ স্বীকার করবে নিজের দোষগুলো৷ কিন্তু তপন মহান্তি খুন হবার পরেও যখন তুমি কল করলে না তখন বুঝলাম আমি ভুল৷ আজকে তুমি কল না করলেও পুলিশ যেত তোমার বাড়িতে৷ এসো, আমি অফিসেই যাচ্ছি৷ না না, থানায় নেই এখন৷ অফিসে আছি৷ তুমি ওখানেই এসো৷ ‘লগ্নজিতা নিজস্ব অফিসের কেবিনে বসে রক্তিমার পার্লারের ভিতরের ভিডিয়োটা চালাল৷ রিওয়াইন্ড করে শুনল, রক্তিমা বলছে, ‘বাই প্রফেশন, তুমি কী করো নীহারিকা? নীহারিকা বলল, ‘সেরকম কিছু নয়, ম্যাডাম৷ অনলাইনে শাড়ি-কুর্তি বিক্রি করছি৷’
রক্তিমা বলল, একটা কথা জানবে, রুপসি মেয়েদের কাজের অভাব হয় না৷ ইনকাম করতে চাও? কয়েকটা ছবি তুলবে আর থোক টাকা পাবে৷ দেখো যদি রাজি থাকো৷’
কপালের দু-পাশের শিরাগুলো রাগে টনটন করে উঠল জিতার৷ কীভাবে দিনের পর দিন রূপচর্চার নাম করে মেয়েগুলোকে এভাবে এক্সপ্লয়েট করছে এরা, ভেবেই মাথাটা গরম হচ্ছে৷ দরজায় নক করল সুমন৷ লগ্নজিতা বলল, ‘এসো৷ এই কদিনেই সুমনের চেহারাটা ভেঙেছে৷ চোখের নীচে কালি৷ মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর অস্থিরতা দেখে৷ লগ্নজিতা বলল, ‘পিকু মা ছাড়াই বড়ো হয়ে উঠবে৷ কারণ পিকুর মা একজন ড্রাগস এজেন্ট৷ নিজের ছেলেকেও এত ছোটো থেকে এই ব্যাবসায় লাগিয়ে দিয়েছে৷ তাই মা ছাড়া কীভাবে পিকুকে সামলাবে ভাবলে ভুল ভাবছ সুমন৷ বরং ওর মায়ের আওতা থেকে ওকে বের করে আনাটা জরুরি৷’
সুমন দুটো হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে বলল, ‘শুধু ড্রাগস এজেন্ট নয় ম্যাডাম, ও একজন ঠান্ডা মাথার খুনি৷ তপনদাকে ও-ই খুন করেছে ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু যে ইঞ্জেকশন দিয়েছে তপনকে, সে লেফটি৷ ইঞ্জেকশনের পজিশন দেখে ডক্টর তা-ই বলেছেন৷’
সুমন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, রিম্পা বাঁহাতি৷ মানে এ এক অদ্ভুত ব্যাপার ওর মধ্যে৷ ও লেখা-লেখি, ইঞ্জেকশন দেওয়া বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাঁ হাতেই করে৷ কিন্তু ওর ডান হাতও খুব সচল৷ ও ডান হাতে খায়৷ ওকে দেখে বোঝা যায় না ম্যাডাম ওর গায়ে খুব জোরও৷ তপনদা যেদিন মারা গেল, সেদিন ও বাড়ি ফিরেছে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ৷ ও বলেছিল, অফিসে কী সব কাজে ফেঁসেছে৷ কিন্তু আমি ওদের হেড শম্পাদিকে ফোন করে জেনেছিলাম, ওদিনও একই সময় ও বেরিয়ে এসেছিল অফিস থেকে৷ দু’দিন আগে দু-ব্যাগ দামি দামি শাড়ি নিয়ে বাড়ি ঢুকেছিল৷ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কে দিল? আমায় বলল, নিজের যখন দেবার মুরোদ নেই তখন এসব প্রশ্ন করবে না৷ আমার সঙ্গে ঝগড়াও হয়েছিল, ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ওইসব জামাকাপড় ওরই কেনা৷ ওগুলো থাকত তপন মহান্তির বাড়িতে৷’
সুমন অবাক হয়ে বলল, মানে?’
‘সুমন, তুমি সকাল আটটায় বেরোতে আর রাত বারোটায় বাড়ি ফিরতে৷ তাই জানতে পারোনি এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে রিম্পা৷ তপন মহান্তির ঘরের এক কপি চাবি থাকত রিম্পার কাছে৷ অত দামি পোশাক বাড়ি থেকে পরে বেরোত না ও৷ পাড়ার লোকজন দেখবে বলে৷ তপনের একটা ফাঁকা গলির মধ্যে ঘর৷ তাই তেমন কোথাও যাওয়ার হলে ও ওখানে গিয়েই ড্রেস চেঞ্জ করত৷ তপনের টেবিলে একটা হাত-আয়না, একটা চিরুণি আর বোরোলিন রাখা ছিল৷ ওটুকুই তপনের সরঞ্জাম৷ কিন্তু রংচটা দেওয়ালে এক-মানুষ সমান ঝকঝকে আয়না লাগানো দেখেই বুঝেছিলাম এখানে মহিলার আগমন ঘটে৷ আয়নার পাশে টিপও লাগানো ছিল৷ ওই স্কোয়্যার টিপ আমি রিম্পার কপালেই দেখেছিলাম৷ ওই পাড়ার দু-একজন বলেছিল, রিম্পা চাবি খুলে ঢোকে, শাড়ি বদলে আবার চাবি দিয়ে বেরিয়ে যায়৷’
সুমন বলল, ‘সত্যি বলছি ম্যাডাম, এটা আমার অজানা ছিল৷ ও যদিও স্বীকার করছে না, এগুলো ও করেছে৷ কিন্তু ম্যাডাম, আমি নিশ্চিত৷ ইঞ্জেকশন দেওয়ার হাতটা ওর তুখোড়৷ আমি পিকুকেও আড়ালে জিজ্ঞাসা করেছি, তুই যে এসব চকোলেট বিক্রি করতিস, মা জানত? পিকু বলেছিল, মা তো নিজেও খায় এই চকোলেট৷ আমায় খেতে বারণ করে৷ বলে, এই চকোলেট খেলে পেটে কৃমি হবে৷ অন্যদের বেচে দিয়ে সেই টাকায় অন্য কিছু খাবি৷ ম্যাডাম, আমার দু-কুঠুরি ঘরের মধ্যে যে এমন অপরাধের সাম্রাজ্য বাসা বেঁধেছে, আমি তো সেটা বুঝতেই পারিনি৷ আমি ওর দামি জিনিসের প্রতি লোভ দেখে ঝগড়া করতাম, বকাবকি করতাম৷ কিন্তু আমার ধারণাও ছিল না, ও এসব শুরু করে দিয়েছে পাকাপাকিভাবে৷ এমনকী পাড়ার অল্পবয়েসি মেয়েরাও দেখতাম, আসছে ওর কাছে৷ ভাবতাম, গল্প করতে আসে৷ একদিন বিজয়ের বউয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া৷ বিজয়ের বউয়ের বক্তব্য, রিম্পা নাকি ওকে খারাপ ছবি তুলে ইনকাম করার পরামর্শ দিতে এসেছিল৷ বিজয় এমনিতেই খুব মাথা গরম ছেলে৷ সে তো দেখি, রিম্পাকে মারতে আসে৷ আমি আপনার কাছেই আসছিলাম অফিসে৷ ওই সময় ঝামেলা দেখে আমিই বিজয়কে বলেছিলাম, তোর বউ কি বাচ্চা? যার পছন্দ হবে না সে ছবি তুলবে না৷ ছবি তোলার কথার মধ্যে অসভ্য কী দেখলি তুই? বিজয় বলেছিল, চোখটা এবারে খোলো সুমনদা, না হলে বড়ো বিপদ হয়ে যাবে তোমার৷ তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই রিম্পাবউদির অন্য রূপ বেরোয়৷ যতক্ষণ তুমি বাড়িতে থাকো, ততক্ষণ খুব সতী৷ রিম্পা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাওয়ায় বিজয় পালিয়েছিল৷ প্রায় একই উঠোন হওয়া সত্ত্বেও ওরা আর কথা বলত না আমাদের সঙ্গে৷ ওই আমি যদি বিজয়কে কিছু জিজ্ঞাসা করতাম তো উত্তর দিত৷ অথচ ওরা কিন্তু আমায় রেসপেক্ট করত, ম্যাডাম৷ কিন্তু পিকুর ব্যাঙ্কে ধরা পড়ার পর থেকেই আমার মনটা কু গাইছিল৷ পিকুর যেকোনো বিষয়ে ওর নজর থাকে, অথচ এই বিষয়ে রিম্পা কিছুই জানে না, এটা হতে পারে না৷ জয়ন্তর বাড়ির কাজের মেয়েটা একদিন ফোন করেছিল রিম্পার ফোনে৷ রিম্পা তখন বাথরুমে ছিল৷ আমি ইচ্ছে করেই ফোনটা রিসিভ করছিলাম৷ হ্যালো বলার আগেই অনীতা বলতে শুরু করল, আমি জানি রিম্পাবউদি, জয়ন্তদাকে দিয়াশাবউদিই মেরে দিয়েছে৷ আমাদের এখন বাঁচাবে কে? পুলিশ তো আমায় থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছিল৷ দিয়াশাবউদি তো ফোনই ধরছে না৷ চলো রিম্পাবউদি, আমরা কদিনের জন্য গা-ঢাকা দিই৷ আমরাও যে ওইসব ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যদি বুঝে যায়? এটুকু শোনার পরেই আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছিল রিম্পা৷ সেদিন অনীতার সঙ্গে ফোনে বেশ হট টক হচ্ছিল ওর৷ পুলিশ ধরলে অনীতাকে ধরবে— রিম্পাকে নয়, এরকম কিছু বলছিল৷ তারপরেই তো অনীতাও খুন হয়ে গেল৷ ম্যাডাম, আমি দুটো ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ পেয়েছি বাথরুমে৷ প্যাকেটে ভরে রেখেছিলাম আমি৷ একটা তপনদা খুনের দিন রাতে ডাস্টবিনে ফেলেছিল রিম্পা, আরেকটা অনীতা খুনের দিন৷ ‘একটা পলিথিন প্যাকেট বের করে সামনে রাখল সুমন৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘তুমি যে এসে সবটুকু স্বীকার করলে, এটাই আমার বড়ো পাওয়া৷ বার বার মনে হচ্ছিল, কেন লুকাচ্ছে সুমন?’
সুমন বলল, ‘ম্যাডাম, পিকুটা যে মা-কে ছাড়া ঘুমাতে পারে না এখনও৷ আমি তো বাইরে বাইরে থাকি, পিকুর মা ওর সব৷ এই একটা ভাবনা মাথায় এলে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম৷ দোটানায় কয়েক রাত চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না৷ আজ অনেক শান্তি৷ আমি জানি, আপনারা রিম্পাকে অ্যারেস্ট করবেন৷ ওর যাবজ্জীবন হবে৷ তবুও আমার আর কিছু করার ছিল না৷ আসছি, ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কাল থেকে কাজে এসো সুমন৷’
সুমন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আসব ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা জানে, ওই সিরিঞ্জ দুটোতে কী পাওয়া যাবে তবুও টেস্ট করতে পাঠিয়ে দিল৷ রাঘবও দুজনের ছবি পাঠিয়েছিল৷ দুই মহিলা দুরকম টাইমে ঢুকেছিল অনীতার বাড়িতে৷ একজন জয়ন্তর স্ত্রী, আরেকজন মহিলার ছবিটা আরেকটু কাল্টিভেট করতে হবে৷ রাঘব লিখেছে, দুজনেই দশ মিনিট করে বাড়ির মধ্যে থেকে পালিয়ে গেছে৷