হসপিটালে হট টপিক
রিম্পাকে সান্ত্বনা দিয়ে যখন কৌশিকের হসপিটালে পৌঁছাল তখন দেখল সুশোভন আরও দুজন কনস্টেবলের সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে৷
ডক্টর কৌশিক ওকে দেখেই এগিয়ে এল৷ ওরা যখন কাজের জায়গায় থাকে তখন ওদের দেখে বোঝাই যায় না, ওরা একটা স্টেডি রিলেশনশিপে আছে গত তিন-চার বছর ধরে৷ কৌশিক বরাবরই একটু দুর্বল চিত্তের মানুষ৷ আর লগ্নজিতা এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট৷ নেশায় ডিটেকটিভ৷ দুজনের যে প্রেম হতে পারে— এটা বোধহয় স্বয়ং মদনদেবও বোঝেননি৷ কৌশিকও মাঝে মাঝে অক্ষেপ করে বলে, ‘মানুষের জীবনে যখন রাহু কেতুর পূর্ণ সহাবস্থান ঘটে তখনই মানুষ এমন নির্মম পুলিশ অফিসারের প্রেমে পড়ে৷ ওদের মতের মিল হয় না বেশির ভাগ সময়েই৷ দেখা করব বলেও একজন ও.টি. আর আরেকজন থানায় আটকে যায় তবুও দিনের শেষে একটা অদ্ভুত ফিলিং আসে, কেউ তো আছে— যে সবটুকু বুঝে নিয়েও একসঙ্গে পথ চলতে চায়৷’
ডক্টর কৌশিক একটু আপসেট গলায় বলল, ‘জিতা, হয়তো বাঁচবে না, ড্রাগসের ওভারডোজ৷ বাচ্চাটির বাবা মারা গেছে৷ মা একটা ছোটো মুদির দোকান চালায়৷ ওর মা তো বুঝতেই পারেনি ছেলের হয়েছেটা কী! এসেই বলল, মনে হচ্ছে, ইঁদুর- মারা বিষ খেয়ে নিয়েছে৷ ওয়াশ করতে গিয়ে বুঝলাম অন্য বিষয়৷ তখনই তোমায় কল করলাম৷ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একটা স্কুলের বাচ্চা ড্রাগস পেল কোথায়?’
লগ্নজিতা বলল, সুশোভন ছেলেটা কোন স্কুলে পড়ত, কিছু খোঁজ পেলে?
‘সুশোভন বলল, ঋষি অরবিন্দ স্কুলে, ম্যাডাম৷ পিকুর স্কুল থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘তার মানে ওই এলাকাটা টার্গেট করেছে৷ গোটা তিনেক সরকারি স্কুল আছে ওই চত্বরে৷ কৌশিক, ছেলেটাকে তো এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না, ওর মায়ের সঙ্গে একবার কথা বলি৷ আরেকটা কথা, খুব সাবধান কিন্তু, বাচ্চাটা যেন হসপিটালে খুন না হয়ে যায়৷ কারণ বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে উঠলে অনেকের বিপদ৷ অনেক ইনফর্মেশন লিক হয়ে যাবে৷ তাই এদের চক্র চেষ্টা করবে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে৷ বি কেয়ারফুল৷ আমি দুজন কনস্টেবল রেখে যাচ্ছি আই. সি. ইউ.-এর সামনে৷ বাচ্চাটাকে সুস্থ করে তুলতেই হবে, কৌশিক৷ এটা একটা বিশাল গ্যাং-এর কাজ৷ স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে চকোলেটের আকারে ড্রাগ পাচার করতে চাইছে৷ বাচ্চাদের মধ্যে যদি একবার এই নেশা ধরিয়ে দিতে পারে তাহলে আর কলেজ অবধি অপেক্ষা করতে হবে না, স্কুল থেকেই এদের ব্যবসা ফুলে উঠবে৷
কৌশিক বলল, ‘কিন্তু সুশোভন জানালেন, এই কেসে বিধাননগর থানা ইনভলভ হয়েছে অলরেডি৷ তাহলে তুমি কেন আবার মাথা ঘামাচ্ছ? আসলে এরা খুব ফেরোশাস হয় তো৷’
কৌশিকের মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক চলো, ‘আজ ইভিনিং শো তে একটা মুভি দেখে আসি৷’
কৌশিক একটু চমকে উঠে বলল, ‘সেটা কী করে সম্ভব, জিতা? আমার দুটো ওটি আছে৷ রাতে রাউন্ডেও যেতে হবে তো৷ অনেকগুলো ক্রিটিক্যাল পেসেন্ট অ্যাডমিট রয়েছে৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘এই হসপিটালে এত ডক্টর আছে, ওঁরা করে দেবেন অপারেশন৷ তুমি চলো প্লিজ৷’
কৌশিকের একটু অবাক লাগছে৷ জিতা কখনো এভাবে মুভি দেখতে যেতে তো বলে না৷ তবে কি অন্য কোনো বিষয়? কৌশিক ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘আজ হবে না জিতা, এগুলো আমার ও.টি., আমার পেশেন্ট৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘ঠিক তা-ই৷ বিধাননগর থানা থাকলেও এটা আমারও কাজ৷ অন্যকাউকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব না৷ তা ছাড়া আমার আন্ডারে যে থানাগুলো রয়েছে, সেখানের স্কুলের স্টুডেন্ট এরা৷ এনিওয়ে, আমি এখন আসছি৷’
কৌশিক মুচকি হেসে বলল, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, আসলে মুভি দেখার আবদার করছে মিস লগ্নজিতা ভট্টাচার্য— এটা ভাবতেই চারবার হোঁচট খেলাম৷ চোর-ডাকাত ফেলে আমার জন্যই ওঁর সময় হয় না, তারপর আবার সিনেমা! বাচ্চাটার জ্ঞান ফিরলে খবর দেব৷ রাতে কল করছি৷
লগ্নজিতা হাত নেড়ে বেরিয়ে এল৷ গাড়িতে উঠেই বলল, ‘লাঞ্চ সেরে বিধাননগর থানায় যাব৷ সুশোভন বলল, ম্যাডাম আজকেই? ওদের আপনি ডাকলেই তো চলে আসবে ম্যাম৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘তোমাদের এই এক সমস্যা বুঝলে, শুধু নিজের ক্ষমতা আর পোস্ট দেখান৷ এই কেসটা যতদিন সলভ করব ততদিন আমি একজন সাধারণ পুলিশ অফিসার হিসেবে কাজ করব৷ সামনে-পিছনে গাড়ি নিয়ে ঘুরব না৷ তোমার থানার কাছে বিষয়টা ঘটেছে, তাই আমার অফিস আপাতত ওখানেই৷ ওই থানারই একটা রুমে আজ থেকে আমি বসব৷’
সুশোভন বলল, আমি জানি গোয়েন্দাগিরিটা আপনার নেশা৷
লগ্নজিতা বলল, সঙ্গে এটা আমার কাজও৷’ অন্যমনস্ক হয়ে গেল লগ্নজিতা৷ ভাবনাগুলো একসঙ্গে মাথায় আসে তখন মন খারাপ করে ওর৷
আজ হঠাৎই লগ্নজিতার মনে হল কৌশিক ওকে একটু বেশিই সহ্য করে৷ ওর সঙ্গে চার বছরের সম্পর্কে ওরা একদিন মাত্র মুভি দেখতে গিয়েছিল৷ সত্যি বলতে কী, কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করাই হয় না৷ নেহাত কৌশিক ডাক্তার তাই নিজেও সময় কমই পায় বলে সম্পর্কটা রয়ে গেছে৷ একটু হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল৷ সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, বাচ্চাটার মা কেমন একটা আপসেট হয়ে রয়েছে৷ প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে চাইছে না৷ আমিও চেষ্টা করেছিলাম৷ ওই স্কুলের নাম আর কী খেয়েছিলর বাইরে সেভাবে কিছুই জানতে পারিনি৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আসলে বাচ্চাটা বাঁচবে কি না ঠিক নেই৷ সেই অবস্থায় তার মায়ের কি আর আমাদের কথায় উত্তর দিতে ভালো লাগে, সুশোভন? তাই আমি বেশি প্রশ্ন করলাম না৷ বাচ্চাটা সুস্থ হলে জেরা করব৷
সুশোভন বলল, ‘ম্যাম, আপনার ফোন বাজছে৷’
ফোনটা রিসিভ করতেই লগ্নজিতার বিশ্বস্ত ইনফর্মার ইউসুফ বলল, ম্যাডাম খোঁজ নিলাম৷ ওই স্টেশনারি দোকানের মালিক জয়ন্তর ওয়াইফ ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছে৷ জলের মতো টাকা বেরোচ্ছে৷ সেটা ওর ওই ছোটো দোকান থেকে সম্ভব নয়৷ বাজারে প্রচুর ধার ছিল বছরখানেক ধরেই৷ এইমাত্র মাস চারেক হল আচমকাই সবার ধার শোধ করেছে শুনলাম৷’
লগ্নজিতা বলল, জয়ন্তর বাড়ির সামনে তোমার লোক রেখেছো তো? এলেই আমায় কল করবে৷ লোকটার ছবি পেয়েছ?
ইউসুফ বলল, ‘ছবি পাইনি, তবে লোকজনের বর্ণনা শুনে বুঝে গেছি কেমন দেখতে৷ এককথায় আমাদের বাংলার সৌমিত্রর মতো৷ না ম্যাডাম, ফেলুদার সৌমিত্র নয়, ‘‘মেয়েটাকে তোল’’ বলা সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দেখতে৷ ও আপনি চিন্তা করবেন না, আমি রাজুকে গ্যারেজ করে দিয়েছি, ও পাহারায় আছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার ওই পেনসিলের মতো রোগা রাজু? দেখো, জোরে হাওয়া এলে না উড়ে যায়৷’
কথা শেষ হবার আগেই ফোনের স্ক্রিনে আরেকটা নম্বর ফুটে উঠল৷ রিসিভ করতেই বেশ ভয়ার্ত গলায় রিম্পা বলল, ‘ম্যাডাম, আমি রিম্পা বলছি, সুমনের স্ত্রী৷ এই দশ মিনিট আগে হঠাৎই দুজন মুখোশ-পরা লোক আমায় ঠেলে পিকুর ঘরে ঢুকে ওর ঘরটা তছনছ করে দিয়ে গেছে৷ মুখগুলো দেখতে পাইনি, ম্যাডাম৷ আমার খুব ভয় করছে কারা এরা? আমরা তো কারো ক্ষতি করিনি, ম্যাডাম৷’
লগ্নজিতা শান্ত গলায় বলল, ‘চিন্তা কোরো না রিম্পা৷ একটা কথা বলো, ওরা কি পিকুর ঘর থেকে কোনো জিনিস নিয়ে গেছে?’
রিম্পা একটু ভেবে বলল, ‘সব তছনছ করছিল, কী নিয়ে গেছে তো বুঝতে পারছি না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘তোমার কি পুলিশ প্রোটেশন লাগবে?’
রিম্পা বলল, ‘না ম্যাডাম, ওসব কিছু লাগবে না৷ শুধু পিকুকে আর ওর বাবাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন৷’
ইউসুফকে ফোনে রিম্পার বাড়ির অ্যাড্রেস দিয়ে বলল, দূর থেকে খেয়াল রাখবে৷ পাড়ার কারো যেন সন্দেহ না হয়৷’