গল্পের শ্রোতা
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি কোথায়? আমরা সবাই ওয়েট করছি হোটেলের হলে৷ এম.এল.এ. সাহেবও জয়েন করেছেন আমাদের সঙ্গে৷ মিস্টার সান্যাল, পারিজাতস্যার, রুদ্রস্যার, ইন্দ্রনীল সবাই আছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমিও ঢুকছি, গেটে আছি৷’
লগ্নজিতা ঢুকতেই সবাই উষ্ণ অভিনন্দন জানালো৷ রুদ্রজ্যোতিস্যার এগিয়ে এসে বলল, ‘ভীষণ খুশি হয়েছি৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘সবই আপনাদের আশীর্বাদে, স্যার৷ কোটি কোটি টাকার ড্রাগ পেয়েছি যাদবপুরের ফ্ল্যাট আর পার্লার থেকে৷ এইসব খুনের জন্যই হয়তো পাচার করে উঠতে পারেনি দিয়াশার টিম৷’
অভিষেক পান্ডে এগিয়ে এসে বললেন, ‘এবারে বলুন ম্যাডাম, আপনি কী একটা গল্প বলবেন বলছিলেন এই কেস সংক্রান্ত৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘স্ন্যাক্সের কী ব্যবস্থা করেছ সুশোভন?’
সুশোভন তন্দুরি চিকেন এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, শুরু করুন৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘একটা ছোটোছেলের গল্প বলব আজ৷ তার ছোটো থেকে বড়ো হয়ে ওঠার কাহিনি৷
‘ছেলেটার মা মারা যায় বেশ ছোটোতেই৷ চিকিৎসা করানোর মতো টাকা ছিল না ওদের পরিবারের৷ ছেলেটা ছিল পড়াশোনায় মারাত্মক ব্রিলিয়ান্ট৷ ক্লাসে কোনোদিন সে সেকেন্ড হয়নি৷ স্কুল টিচাদের দয়ায় তার পড়াশোনা চলছিল৷ বাবা চাইছিল, কোনো দোকানে হাতের কাজ শিখুক৷ কিন্তু ছেলে তাতে রাজি ছিল না৷ বাবা পরিষ্কার জানিয়েছিল, এ বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করা যাবে না৷ এ ঘটনার পরে আচমকাই ছেলেটির বাবা মারা যায় বিষ খেয়ে৷ না, কোনো পুলিশ কেস হয়নি৷ ছেলেটা তখন মাধ্যমিক স্টুডেন্ট৷ নিজেই পুলিশের কাছে এসে কান্নাকাটি করে বলে, আমি পড়তে চেয়েছিলাম, আর বাবার টাকা ছিল না তাই বাবা আত্মহত্যা করে নিল৷ আমি অপরাধী, আমায় অ্যারেস্ট করুন৷ একজন সহৃদয় পুলিশ অফিসারের চেষ্টায় তখন তারই শিক্ষক শ্রীজগমোহন ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করেন ছেলেটির সব দায়িত্ব নেওয়ার জন্য৷ জগমোহনবাবুর বাড়িতেই অনাথ ছেলেটি বড়ো হতে থাকে৷ পড়াশোনায় তুখোড় ছেলেটি কোনোদিন দ্বিতীয় হয়নি৷ ছেলেটি যখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভরতি হল তখন তার পরিচয় হল একজন সহূদয় প্রফেসরের সঙ্গে৷ তার সাহায্যে ছেলেটির বাকি পড়াশোনা কমপ্লিট হল৷ ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর পদে জয়েন করল৷ সঙ্গে পেল রাজকন্যা ও রাজত্ব৷
অভিষেক পান্ডে বললেন, ‘আচ্ছা ম্যাডাম,এই ঘটনাটার সঙ্গে কি এই ড্রাগের কেসটা কোনোভাবে জড়িত?’
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি গল্প শুনতে ভালোবাসেন না মিস্টার পান্ডে? একজন ব্রাইট প্রফেসরের জীবনের গল্পটা শুনতে কি মন্দ লাগছে?’
মিস্টার সান্যাল বললেন, ‘আরে ম্যাডাম, থামছেন কেন? আমি লিখব বিষয়টা৷ বলুন বলুন প্লিজ৷’
লগ্নজিতা কোল্ড ড্রিঙ্কে গলা ভিজিয়ে বলল, ‘সমস্যা তৈরি করল রাজকন্যা স্বয়ং৷ সে বাবার দেওয়া এমন বিয়ে মেনে নিতে পারল না৷ চালচুলোহীন একটা অনাথ ছেলেকে বিয়ে করাটা তার পক্ষে কষ্টদায়ক৷ তাই সে নিজের বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে একটা ফ্ল্যাট রেন্টে নিয়ে সংসার পাতল৷ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সরকারি চাকুরে৷ দুজনেরই নতুন চাকরি যদিও তবুও অভাব সেভাবে ছিল না৷ তাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হল৷ এরপর ছেলেটির মানসিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করল৷ টাকার অভাবে মায়ের মারা যাওয়া, টাকার অভাবে বাবার মারা যাওয়া, লোকের বাড়িতে ভিক্ষে করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কবে যেন তার মধ্যে একটা রোগ বাসা বেঁধেছিল৷ সেটা হল মানি সিকনেস৷ টাকার প্রতি মারাত্মক দুর্বলতা৷ সরকারি চাকরির বাঁধাধরা মাইনেতে সে কিছুতেই খুশি হতে পারছিল না৷ এদিকে স্ত্রী নিজে যেহেতু হাই প্রোফাইল তাই তার কাছেও বিশেষ সম্মান সে পেল না৷ তখন সে লক্ষ করল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইয়াং ছেলেরা মাদকাসক্ত৷ বড়োলোকের ছেলেরা, যাদের টাকার অভাব নেই৷ প্রফেসরের সঙ্গে যোগাযোগ হল দিল্লির এক বিখ্যাত ড্রাগ ডিলারের৷ সেখানে জয়েন করে প্রফেসরি ছেড়ে দিল ছেলেটি৷ মুঠো মুঠো টাকা দেখে স্ত্রী’ও সন্দেহ করল৷ ছেলেটির তখন কোনো হুঁশ নেই৷ তার বাচ্চা মেয়েকে সে কোকেন শোঁকাতে ব্যস্ত৷ স্ত্রী পুলিশে গেল না একটাই শর্তে — কোনোদিন যেন মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে লোকটি৷ ডিভোর্স হয়ে গেল ওদের৷ ছোটো মেয়েকে নিয়ে চলে এল মেয়েটি বাপের বাড়ি৷ ছবি তোলা, ব্যাঙ্কে চাকরি আর মেয়েকে মানুষ করার মধ্যেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখল মেয়েটি৷ ছেলেটি পার্মানেন্টলি চলে গেল দিল্লি৷ টাকা আর টাকা৷ একটাই নেশা— আরও টাকা ইনকাম করতে হবে৷ মাসুদ আর ছেলেটি একই সঙ্গে এই ব্যাবসায় পার্টনার হিসেবে কাজ করছিল৷ তারপর মাসুদ তার দলটা আলাদা করতে চাইলে ছেলেটি পুলিশে ধরিয়ে দেয় মাসুদকে৷ কিছুদিনের জন্য ছেলেটির বড়ো একঘেয়ে লাগছিল জীবনটা৷ তার যা বুদ্ধিমত্তা, তাতে এই একঘেয়ে কাজ ভালো লাগার কথাও নয়৷ মাসুদের প্রায় কোটি টাকার মাদকদ্রব্য ধরিয়ে দিয়ে সে তখন পুলিশের ঘরের লোক হয়ে গেল৷ নিজের নামটা কোর্টে গিয়ে অ্যাফিডেভিট করিয়ে নিল৷ আগেই বলেছিলাম, তুখোড় বুদ্ধি মানুষটার৷ যেখানে হাত দেয়, সেখানেই সে সফল হয়৷ তার ইচ্ছে হল, জটিল কেস সলভ করবে সে৷ মূর্তি চুরি, গান পাচারচক্র এসব কেস সলভ করে পুলিশের গুড বুকে তখন লোকটি৷ তারপরেই তার মনে হল, বহুদিন কলকাতায় যায়নি৷ সেই মাসুদকে ড্রাগ পাচারের সময় ধরিয়ে দেওয়ার পর আর ওদিকে যাওয়াই হয়নি৷ তারপর আরও দুটো চুনোপুঁটি ড্রাগ ডিলারকে ধরিয়ে দিয়ে মার্কেটে নামল৷ কীভাবে যেন নাইটক্লাবে গিয়ে পরিচয় হল দিয়াশা ওরফে রক্তিমার সঙ্গে৷ রক্তিমার লোভকে কাজে লাগিয়ে কলকাতার স্কুল থেকে পার্লার থেকে জিমে ছড়িয়ে দিল ড্রাগস৷ আবারও পুরোনো টাকার নেশাটা তাড়া করতে শুরু করল৷ সবই ঠিক চলছিল৷ হঠাৎই ধরা পড়ল পিকু৷ তখন কলকাতায় থাকাটা বিশেষ জরুরি৷ নিজের টিমকে পরিচালিত করার জন্য৷ কারণ গত ছয়-সাত মাসের প্রচেষ্টায় এ এলাকায় বেশ কয়েকজন ড্রাগ এজেন্ট তৈরি করা গেল, যাদের নিম্নমধ্যবিত্ত চেহারাটাই তাদের সম্পদ৷ কেউ সন্দেহ করবে না৷ কিন্তু পিকু ওইভাবে ধরা পড়তেই টনক নড়ল৷ সুতো টানলে হয়তো সে ধরা পড়বে না৷ কারণ তার চেহারা আজ অবধি তার কোনো এজেন্টই দেখেনি৷ একমাত্র রক্তিমা জানে তাদের হেড একজন ম্যাডাম, যার হাইটটা বেশ লম্বা৷ রক্তিমার সঙ্গে নাইটক্লাবে পরিচয় হয়েছিল লাবণ্যম্যামের৷ গোল্ডেন কালারের লং গাউন, ঠোঁটে নিখুঁত লিপস্টিক আর চুলে টপনট৷ বেশ মিষ্টি হেসে বলেছিল, শুধু লোকের দিকে তাকিয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললে হবে? নিজের ইচ্ছে করে না ওইরকম স্ট্যান্ডার্ড বিলং করতে? রক্তিমা বলেছিল, করে৷ কিন্তু সে অবস্থা আমাদের নয়৷ আজ নেহাত একটা বন্ধু খাওয়াতে নিয়ে এসেছে তাই এসব জায়গায় ঢুকতে পারলাম৷ তারপর চলল রক্তিমার গ্রুমিং৷ পরের গল্পটা তো গতকালই বললাম, কীভাবে দিয়াশা রক্তিমা হয়ে উঠল৷ রিম্পা, কাবেরী, অনীতার মতো অনেক এজেন্ট তৈরি করল৷ জলধরবাবুকে নিস্পৃহ করে দিল৷ এমনকী জয়ন্তকে খুন অবধি করে দিল প্ল্যান করে৷ তো এই জয়ন্তর দোকান যখন পুলিশের টার্গেটে, রক্তিমা যখন বিপদে পড়বে তখনই তার আগমন ঘটল কলকাতায়৷ রক্তিমার সঙ্গে তার দেখা হত মহিলার বেশেই৷ আর জনসমক্ষে সে পুরুষ৷ মেকআপ আর্টিস্টের থেকেও ভালো মেকআপ করে সে৷ স্কুলের নাটকে প্রথম মেয়ে সেজে তার হাতেখড়ি হয়েছিল৷ ঠিক এইখানেই আমার খটকাটা ছিল৷ রক্তিমা বলছে, তাদের হেড একজন মহিলা৷ অথচ আমার তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী লোকটি একজন পুরুষ৷
‘ওদিকে রাঘবের পাঠানো ছবি অনুযায়ী অনীতা খুনের পরে একজন মহিলা কিছুক্ষণের জন্য গিয়েছিল অনীতার বাড়িতে৷ সম্ভবত প্রমাণ লোপাট করতে৷ ওই মহিলার ছবি দেখাতেই রক্তিমা স্বীকার করল, এটাই ওদের হেড৷ জগমোহনবাবু আমার ভুল ভাঙলেন৷ উনিই বললেন, ছেলেটি নাকি শ্রীনাথ বহুরূপীতে এমন বাঘ সেজেছিল যে লোকজন চমকে উঠেছিল৷ আরেকবার সীতার সাজে বয়েজ স্কুলের সবাই অবাক হয়েছিল৷ আমার অঙ্ক মিলে গেল৷ বুঝলাম ছেলেটি কলকাতার প্রকাশ্য দিবালোকে পুরুষ৷ আর তার টিমের কাছে মহিলা৷
‘ওদিকে আগরওয়াল বংশের অষ্টধাতুর মূর্তি অকশনে বেচে দিয়ে চুরি গেছে বলে মরাকান্না জুড়লেন৷ ডাক পড়ল প্রাইভেট ডিটেকটিভ রুদ্রজ্যোতির৷ রুদ্রজ্যোতি দু-দিনেই বুঝে গিয়েছিলেন, এটা চুরি যায়নি৷ খোঁজখবর নিয়ে বের করে ফেললেন মূর্তিটি অলরেডি বিদেশে বেচে প্রচুর টাকা কামিয়েছে আগরওয়াল৷ বাকিটা আপনাদের আগরওয়াল নিজেই বলুক৷ সুশোভন, ওঁকে নিয়ে এসো৷’
সুশোভন আগরওয়ালকে নিয়ে ঢুকল৷ সঙ্গে ঢুকল সুবর্ণা গোস্বামী৷ সেদিকে তাকিয়ে রুদ্রজ্যোতি বললেন, ‘ভালো আছেন ম্যাডাম? কতদিন পরে দেখা৷’ সুবর্ণা কোনো কথা বলার আগেই রুদ্রজ্যোতি বললেন, ‘ম্যাডাম লগ্নজিতা, আপনাকে আর কাউকে দিয়ে কিছু প্রমাণ করাতে হবে না৷ আমি সব জানি৷ আপনার আমার স্কুলের টিচারের কাছে যাওয়া, আমার নাম পরিবর্তনের রেকর্ড বের করা, সুবর্ণাই সম্ভবত জগমোহন স্যারের নম্বর আপনাকে দিয়েছে৷ যেটা আপনাকে ডাক্তারা বলতে পারবে না, সেটা আমি আপনাকে বলছি, আমার বাবার খাবারে বিষ আমি মিশিয়ে দিয়েছিলাম৷ লোকটা দুটো পান্তা ভাতের থেকেও ভাগ বসাত৷ লোকটা বলেছিল, তোকে পড়াতে পারব না৷ মাথার ওপরে অপদার্থ বাবা থাকলে কেউ আর সহানুভূতি দেখায় না৷ তাই আমি নিজেই নিজেকে অনাথ করেছি৷ আরেকটা কথা শুনুন, হ্যাঁ, টাকার নেশা আমার৷ কিন্তু জানেন কি, সেই টাকা আমি কী করি?’
লগ্নজিতা বলল, জানি, টাকা কুচিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন৷ সেটাও একটা অপরাধ৷ সরকারি প্রপার্টি অপচয় করা আইনত দণ্ডনীয়৷’
মিস্টার সান্যাল অপলক তাকিয়ে আছেন রুদ্রজ্যোতির দিকে৷ ফিসফিস করে বললেন, ‘কিন্তু ও তো ডিটেকটিভ৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘ওটাও একটা মুখোশ৷ চারটে কেস সলভ করে শোরগোল ফেলে দিয়ে পুলিশের বিশ্বাসভাজন হয়ে নিজে ক্রেডিট না নিয়ে পুলিশদের সেটা দিয়ে উদারতা দেখানোটাও একটা চালাকি৷ নিজের ছবি কোথাও পোস্ট না হতে দেওয়া৷’
অভিষেক পান্ডে বললেন, ‘কী ভয়ংকর!’
রুদ্রজ্যোতির মুখে কোনো ভয়ের ছাপ নেই৷ নিস্পৃহ হয়ে বসে আছেন৷ যেন গল্পের আসরে বসে আছেন গল্পের অরিজিনাল ভিলেন৷
মিস্টার সান্যাল বললেন, ‘কিন্তু ম্যাডাম, আপনি কখন বুঝতে পারলেন রুদ্রজ্যোতিই আসল হেড?’
লগ্নজিতা বলল, ‘উনি প্রথম আমায় ইমপ্রেস করার জন্য তপন মহান্তির খুনটা যে ওভারডোজ অফ ড্রাগসে হয়েছে, সেটা ওর গায়ে ছুঁচের দাগ দেখিয়ে বলে দিলেন৷ তারপর যখনই উনি দেখলেন, আমি তদন্তটা নিয়ে ঠিক পথেই এগোচ্ছি তখন উনি আমায় মূর্তি চুরির রহস্য সমাধান করতে লাগিয়ে দিতে চাইলেন৷ আমায় এ কেস থেকে সরাতে পারলে উনি গোছানোর সময় পেয়ে যাবেন৷ তারপর খটকাটা আসল লাগল, যেদিন ডক্টর কৌশিক ওঁর ছবি দেখে বলেছিল, আমি এঁকে একটা অনুষ্ঠানে দেখেছি৷ ছবিটা পাঠিয়ো আমায়, তোমায় ডিটেলস দিয়ে দেব৷ কৌশিকের এঁকে দেখার কথা নয় সেভাবে৷ তারপর কৌশিক বলেছিল, এঁকে আমি বহুদিন আগে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেমিনারে দেখেছিলাম৷ আমিও উপস্থিত ছিলাম সেখানে৷ মাদকদ্রব্য শরীরের কী কী ক্ষতি করে, কীভাবে এটার কারণে মস্তিকের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির বিলুপ্তি ঘটে— এগুলো বলেছিলাম সেমিনারে৷ তখন এই ভদ্রলোক মাদকগ্রহণের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন একজন প্রফেসর হয়ে৷ উনি বলেছিলেন, মাদকদ্রব্য নাকি মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ভুলতে সহায়তা করে৷ আমার প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল লোকটার ওপরে৷ অনুষ্ঠানের পরে আমি কয়েকটা কথাও শুনিয়েছিলাম৷ কিন্তু ইনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর ছিলেন জিতা, ডিটেকটিভ কবে হলেন?
‘তারপর দেখলাম, রুদ্রজ্যোতি যে ওষুধ দুটো খান, সে দুটো ডিপ্রেশনের ওষুধ৷ এটা জেনে অবাক হয়েছিলাম৷ ডিটেকটিভ মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছেন? পরেরটাতে আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম৷ যেদিন সুশোভন জানাল রুদ্রস্যারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, কারা যেন বাইক থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে স্যারের হাতে৷
‘আমি খবরটা পেয়েই রুদ্রজ্যোতির রেন্টের ফ্ল্যাটে গেলাম দেখা করতে৷ সৌজন্য সাক্ষাৎ আর কি৷ গিয়েই দেখলাম, ফ্ল্যাটের গেট হাট করে খোলা৷ আমি ভিতরে ঢুকে এদিক-ওদিক ঘুরেও ওঁকে দেখতে পেলাম না৷ দেখলাম, রান্নাঘরে গ্যাস কমানো অবস্থায় জ্বলছে৷ পাশেই চায়ের ছাঁকনিতে চায়ের ভিজে পাতা ছাঁকা অবস্থায় পড়ে আছে৷ আমি বিপদের ভয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিলাম৷ বাথরুমে ঢুকে আরেকটু হলেই পড়ে যেতাম৷ তেলের শিশিটা ছিটকে মুখ উপুড় করে পড়ে আছে৷ অনেকটা তেল ছিটিয়ে রয়েছে, কারণ শিশিটা বেশ উঁচু তাক থেকে পড়েছে৷ ওখানেই রাখা বডি লোশনের গন্ধটা আমার ভীষণ চেনা লাগছিল৷ কিন্তু এই গন্ধটা সাধারণত আমরা ব্যবহার করি না৷ মনে করার চেষ্টা করছিলাম, কোথায় পেয়েছি গন্ধটা৷ ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটা ছোটো মেয়ের ছবি ফ্রেমে বাঁধানো৷ মেয়েটার বয়েস বড়োজোর পাঁচ হবে৷ এখন মেয়েটার বয়েস আঠারো হলেও আমার চিনতে অসুবিধা হল না, ওই ব্রাউনিজ চোখের মণির মেয়েটা ঋতিকা৷
‘ঘরের এককোণে কুচো কাগজ পড়ে ছিল৷ টুকরোগুলো তুলে চমকে উঠলাম, অরিজিনাল পাঁচশো টাকার নোটের টুকরো৷ আমি যে ওখানে যাচ্ছি— এটা শুনে ফেলেছিলেন রুদ্রজ্যোতি৷
‘কী করে শুনলেন? সুশোভনের ফোনটা ট্যাপ করেছিলেন৷ সুশোভনের ফোনটা উনি সেদিন বহুক্ষণ হাতে নিয়ে বসে ছিলেন৷ তপন মহান্তির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখার নাম করে, যেটা ওঁর কাছে অলরেডি ছিলই৷ তারপরেই আমি যাবার খবরটা পেয়ে তাড়াতাড়ি উনি বেরিয়ে যান ফ্ল্যাট থেকে টাকার ব্যাগ নিয়ে৷ কারণ সব টাকা তখনও কুচোনো হয়নি৷
‘তারপর সুবর্ণা গোস্বামী আমায় হেল্প করেছেন একটু হলেও সত্যজিৎ আর রুদ্রজ্যোতি একই মানুষ সেটা বুঝতে৷ আরেকটা খটকা লেগেছিল৷
‘অনীতার মৃত্যুর মুহূর্তে রুদ্রজ্যোতি সেখানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অনীতাকে উঠিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়নি৷ বমি করতে করতে দম আটকে মরতে দেওয়া হয়েছিল৷ কেন এই মাদক কেলেঙ্কারির অন্যতম সাক্ষীকে এভাবে মরতে দিলেন ডিটেকটিভ? রিম্পার কাজ মিটে গিয়েছিল৷ তাই রুদ্রজ্যোতি বার বার সুমন আর রিম্পা দোষী— এটা বলে বলে রক্তিমাকে আড়াল করতে চাইছিলেন৷ ওদিকে আগরওয়ালকে ব্ল্যাকমেইল করেও টাকা নিচ্ছিলেন৷ ফ্যামিলিতে জানিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে৷ আমি জেরা করতেই আগরওয়াল সব বলে দিলেন৷ আমাকে বার বার কনভিন্স করানোর চেষ্টা করছিলেন, সুমন আর রিম্পা দোষী৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওই বডি লোশনের গন্ধটা আপনি ঋতিকাম্যামের গায়ে পেয়েছিলেন তা-ই না? আপনি সেদিন বলেছিলেন, কী সুন্দর না পারফিউমের গন্ধটা৷ বেশ সতেজ লাগছে৷ ওটা তাহলে লোশনের গন্ধ ছিল৷
লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ৷ ওটা একটা বিদেশি ব্র্যান্ডের বডি লোশন৷ রুদ্রজ্যোতিই ঋতিকাকে গিফট করেছিল৷’
সুবর্ণা বলল, ‘সত্যজিৎ মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছিল? কিন্তু কেন? ও তো কথা দিয়েছিল, কোনোদিন মেয়ের সংস্পর্শে আসবে না৷ সেই কারণেই আমি পুলিশে কমপ্লেইন করিনি৷ ওর অন্যায় দেখেও চুপ করে মুখ বন্ধ করে ছিলাম, কারণ আমার সন্তানকে ওর কবল থেকে বাঁচাতে হবে৷ একদিন ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে দেখি মেয়ের গোটা বিছানায় টাকা ছড়ানো৷ আমার ছোটো মেয়েটাকে ওই আনহাইজিনিক টাকার বিছানায় শুইয়ে রেখেছে ও৷ বুঝতে পারছিলাম ও চূড়ান্ত মানসিক রোগী৷ আমি বকাবকি করায় চুপ করে থাকতো৷ যখন কাউন্সেলিং চলত তখন একটু স্বাভাবিক থাকত৷ না হলে আবার যে কে সেই৷ যেদিন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, সেদিনের ঘটনাটা বলি৷ সুবর্ণার মতো কঠিন মানুষের চোখে জল দেখে খারাপই লাগছিল লগ্নজিতার৷ সেদিন আমার মেয়ে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল পার্কে৷ হাঁটু ছড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল৷ কাঁদছিল বাড়িতে এসে৷ আমি ওর ওই জায়গাটা ওয়াশ করিয়ে দেব বলেই একটু গরম জল করে আনতে গিয়েছিলাম, এসে দেখি, ও একটা সাদা ডাস্ট মতো জিনিস নিয়ে মেয়েকে বলছে, জোরে নাক দিয়ে টান, দেখ, ব্যথা কমে যাবে৷ আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কী? ও ক্যাজুয়ালি বলেছিল, কোকেন৷ দেখো, এখুনি ওর ব্যথা কমে যাবে৷ আমি আর দেরি করিনি, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম৷ ও কথা দিয়েছিল, পুলিশে না গেলে ও মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না আর কখনো৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কিন্তু সে কথা উনি রাখেননি৷ কদিন আগেই ঋতিকার নাচের ক্লাসের সামনের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল ওরা৷ নিজের পরিচয় দিয়ে দেখা করে এসেছিলেন৷ এবং ব্র্যান্ডেড কিছু কসমেটিকস দিয়ে এসেছিলেন৷ ঋতিকা সেগুলো ইউজও করছে, সুবর্ণাম্যাম৷ আপনি ভুল করেছেন ঋতিকার কাছে ওর বাবার পরিচয়টা লুকিয়ে৷ ওর বাবার অপরাধগুলো লুকিয়ে৷’
সুবর্ণা বলল, ‘আর লুকাব না, জানিয়ে দেব সব৷ তারপর ঋতি সিদ্ধান্ত নিক৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, ওইজন্য রক্তিমাকে অ্যারেস্ট করতে যাওয়ার সময়ে আপনি আমায় আমার ফোনটা সুইচ অফ করে থানায় ফেলে রাখতে বলেছিলেন? যাতে উনি ট্র্যাক করতে না পারেন তা-ই না?’
লগ্নজিতা বলল, হ্যাঁ, ওটাই কারণ৷ না-হলে ওইদিন পার্লারে রক্তিমাকে আমরা পেতাম না৷ তা ছাড়াও আমরা ওনাকেই হিতৈষী ভেবে এ কেসের সমস্ত ডিটেলস দিচ্ছিলাম৷ এতে ওনার জানতে বাদ ছিল না, এরপরে আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি৷ সেইমতো উনিও ওঁর রাস্তা সাজাচ্ছিলেন৷ উনি আমায় বলেছিলেন, ওপরের একটা ফ্ল্যাটের এক ফ্যামিলির কাছ থেকে চা করে আনতে গিয়েছিলেন, কারণ ওঁর গ্যাস শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ এটা আরেকটা মিথ্যে৷ ওঁর গ্যাস জ্বলছিল৷ চা উনি নিজের ফ্ল্যাটেই করেছিলেন৷ আমি ওপরের ওই ফ্যামিলির কাছে গিয়েছিলাম৷ ওখানে একজন প্রায়ান্ধ বয়স্ক মানুষ থাকেন৷ উনি রুদ্রজ্যোতি নামের কাউকে চেনেনই না৷ উনি তখন টাকার ব্যাগ লুকাতে গিয়েছিলেন ওঁরই পাশের ফ্ল্যাটে৷ ওই ফ্লোরে দুটো ফ্ল্যাট আছে ওঁর৷ বাথরুমে তেল পড়ে স্লিপারি হয়েছিল, ওতেই পড়েছিলেন উনি৷ অল্প লেগেছিল কনুইয়ে৷ বাইক থেকে কেউ আক্রমণ করলে তারা সবার প্রথমে মাথায় মারবে৷ নিজের থেকে সন্দেহ দূর করার জন্যই এই অকারণ মিথ্যের অবতারণা করেছিলেন পারিজাত বা সুশোভনের সামনে৷’
পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, জগুদাদু বলছিলেন, আমি জানি, ও অপরাধ করবেই, কেন বলছিলেন?’
লগ্নজিতা বলল, কারণ জগমোহনবাবু সত্যজিৎকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত৷ সত্যজিৎ জগমোহনবাবুর স্ত্রী-র একটা হিরের আংটি চুরি করে বেচে দিয়েছিল৷ যাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করতে চেয়েছিলেন, সে এমন করবে— এটা ওঁরা মেনে নিতে পারেননি৷ সাইকিয়াট্রিস্ট তো দেখিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার৷ কিন্তু সেভাবে কাজ হয়নি৷ সেই কারণেই জগমোহনবাবু বলেছিলেন, অত ব্রাইট একটা স্টুডেন্ট যে শেষ হয়ে যাবে, উনি বুঝতে পেরেছিলেন৷’
মিস্টার সান্যাল বললেন, ‘কিন্তু ম্যাডাম, উনি যে অন্য ড্রাগ ডিলারদের ধরিয়ে দিলেন…’
কথা শেষ না করতে দিয়েই লগ্নজিতা বলল, ‘উনি শুধু নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করছিলেন৷ কলকাতা ওঁর কন্ট্রোলে থাকবে৷ গোটা কলকাতায় একমাত্র ড্রাগ ডিলার থাকবেন উনি৷ তাই অন্য দলের এজেন্টদের ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের গুড বুকে নাম লেখাচ্ছিলেন৷ কারণ এসব চুনোপুঁটির খবর উনি ভালো জানতেন৷ একই পথের পথিক বলে৷ পুলিশও খবরের কাগজে নিজের ছবি দেখবে বলে উতলা হয়ে থাকে৷ সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রুদ্রজ্যোতি আরও ফেমাস হয়ে গিয়েছিলেন পুলিশের৷’
মিস্টার সান্যাল মুখের সামনে তন্দুরি চিকেনের ঠ্যাংটা ধরে কামড় দিতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু কাগজে ছবি বেরোনোর লোভের কথা বলতেই ঠ্যাংটা ঠং করে প্লেটে নামিয়ে রেখে আপাতত লোভ সংবরণ করলেন৷ রুদ্রজ্যোতির মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই৷ সেই একই নিস্পৃহভাবে বসে আছেন যেন কোনো গল্পের আসরে৷ মুখে সেই মধ্যবিত্ত বাঙালির ছাপ৷ জিনসের ওপরে একটা ঢলা খদ্দরের পাঞ্জাবি, গালে না-কামানো দাড়ি৷ শরীরের কোথাও কোনো দামি জিনিসের আধিপত্য নেই৷ শুধু অনামিকাতে একটা বড়ো হিরে জ্যোতি বিচ্ছুরণে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে৷ আর আছে বাঁ হাতের রিস্টে একটা বিদেশি ব্র্যান্ডের ঘড়ি৷ এ ছাড়া জুতোটা পর্যন্ত সস্তার৷ সকলের চোখ যখন ওঁর দিকে, তখন ওঁর চোখ বিয়ারের গ্লাসের তরল পানীয়ের দিকে স্থির৷ গলা ভিজিয়ে বললেন, ‘ধুর মশাই, আজকাল সবেতে ভেজাল৷ বিয়ারেও সেই কড়া ভাবটা নেই৷’ পারিজাত আর সুশোভনের চোখের পলক পড়ছে না রুদ্রজ্যোতির দিক থেকে৷ রুদ্রজ্যোতি হেসে বললেন, ‘এই হচ্ছে আজকালকার ফাঁকিবাজ গোয়েন্দা পুলিশ৷ অর্ধেক সত্য আর অর্ধেক মিথ্যে দিয়ে গল্পের এন্ডিং টেনে দিলো৷ আরে মিস ভট্টাচার্য, আপনি বললেন, তপনকে রিম্পা ইঞ্জেকশন দিয়েছিল৷ হ্যাঁ, সেটা ঠিক৷ কিন্তু রিম্পা শক্তিমান নয় যে ও তপনকে টাঙিয়ে দিয়ে আসবে৷ রিম্পার ওপরে নির্দেশ ছিল তপনকে মেরে দরজা খুলে চলে আসার৷ তারপর আমি মহিলার বেশে গিয়ে তপনকে টাঙিয়ে দিয়ে আসি৷ এটা আপনার গল্প থেকে মিসিং ছিল৷ আর হ্যাঁ, লাল শিফনটা রিম্পারই৷ আলমারিতে ছিল৷ পরে অবশ্য ওটা আমার কাছে নিয়েছিলাম মিস্টার সান্যালের পারমিশন নিয়েই৷ আমার কাছে সব খবর ছিল৷ আপনি জগমোহনস্যারের বাড়িতে গেছেন, আমার আরেকটা ফ্ল্যাটের তালা ভেঙেছেন, আমার স্কুল, কলেজ, ডক্টরের কাছে গেছেন— সব আমি জানি৷ বলুন তো, তারপরেও কেন আজকে আপনাদের সাকসেস পার্টিতে এলাম? এই, গোঁজামিলগুলো যাতে না দিতে হয়৷ এই যে সুবর্ণা গোস্বামী আমায় ঘৃণা করে, কেন জানেন? কারণ আমার ব্রাইট রেজাল্ট ছিল, সরকারি চাকরি ছিল কিন্তু বংশমর্যাদা ছিল না৷ হাই প্রোফাইল ছিল না৷ বিশাল বাগানওয়ালা বাড়ি ছিল না৷ তাই আমার স্ত্রী-র কাছে আমি চিরকাল তাদেরই বাড়িতে তার বাবার কাছে পড়তে-যাওয়া এক ভিখারি স্টুডেন্ট রয়ে গিয়েছিলাম৷ এই গল্পগুলো আপনারা বলবেন না বলেই আজকের এই আসরে আমার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি ছিল৷ এই যে অনীতাকে ইনজেক্ট করেই রিম্পা আমায় কল করেছিল৷ আমি লগ্নজিতাম্যাডামকে বললাম, আমায় বেরোতে হবে৷ তড়িঘড়ি পৌঁছালাম৷ কেন জানেন? মৃত্যু আমায় আকর্ষণ করে৷ অনীতাকে মরতে দেখব বলেই আমি ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে অনীতা মরার আগেই পৌঁছেছিলাম৷ তপনের মৃতদেহ আমায় আকর্ষণ করেনি৷ বললাম না, মৃত্যু মুহূর্তটা আমায় আকর্ষণ করে, মৃতদেহ নয়৷ তাই তপনের বেলায় কোনো উত্তেজনা ছিল না৷’
অভিষেক পান্ডে বললেন, ‘তারপরে আবার আপনি অন্য কাউকে দিয়ে আমায় ফোন করিয়ে বলালেন, একটার পর একটা খুন হচ্ছে আপনার এলাকায় আর আপনি ওই মহিলা পুলিশ, শখের গোয়েন্দার ওপরে ভরসা করে বসে আছেন? আরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিয়োগ করুন৷ সামনে ইলেকশন, এবারে টিকিট পেলে হয়! রুদ্রজ্যোতিকে দায়িত্ব দিন৷ কে রুদ্রজ্যোতি যদি বুঝতে না পারেন তাহলে মিস্টার সান্যালের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিন৷ আমিও মিস্টার সান্যালকে কল করে রুদ্রজ্যোতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম৷ উনি বিশেষ প্রশংসা করলেন নির্লোভ মানুষটার৷ তখনই আমি ওঁর দেওয়া নম্বরে কল করে যোগাযোগ করলাম রুদ্রজ্যোতির সঙ্গে৷’
লগ্নজিতা বলল, এই কারণেই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি নিজে রুদ্রজ্যোতিকে ডাকলেন নাকি উনি নিজেই এ তদন্তের ভার নিতে চাইলেন উপযাচক হয়ে? আশা,করি সকলের কাছে সবটা ক্লিয়ার৷ অন্তত চার বস্তা টাকা উদ্ধার করতে পেরেছি আমরা রুদ্রজ্যোতির পাশের ফাঁকা ফ্ল্যাট থেকে৷ জানি না, ওই টাকা উনি ছিঁড়ে ফেলতেন না উড়িয়ে দিতেন!’
মিস্টার সান্যাল বললেন, ‘আচ্ছা রুদ্রজ্যোতি-আপনি প্রফেসরি ছেড়ে, এমন স্ত্রী সংসার ছেড়ে এসব পথে পা বাড়িয়ে জীবনে ঠিক কী পেলেন বলুন দেখি?’
রুদ্রজ্যোতি দু হাত ওপরে তুলে বললেন, উত্তেজনা৷ ‘উত্তেজনা পেলাম৷ বুদ্ধিতে শান দিলাম এত বছর ধরে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে’ ছিলাম এতদিন ধরে, আর পেলাম অনেক টাকা৷ একমাত্র একটা জিনিসের কোনো অভাব নেই আমার কাছে, সেটা হল টাকার৷ রুদ্রজ্যোতি পকেটে হাত ঢোকাতে যেতেই লগ্নজিতা বলল, ‘উহুঁ কোনো চালাকি নয়৷’
রুদ্রজ্যোতি বলল, ‘ওসব খেলনা বন্দুক নিয়ে আমি আপনাদের মতো রাতে ঘুমাই না, ম্যাডাম৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, রিভলভার নেই ওভার কাছে৷ গেটে সিকিউরিটি চেকিং হয়েছে৷’
রুদ্রজ্যোতি পাঞ্জাবির পকেট থেকে করকরে পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল বের করল একটা৷ হাতের মধ্যে দুবার ঘষে, নাকে শুঁকল বার দুয়েক৷ তারপরেই পরনের পাঞ্জাবিটা দিয়ে মুখটা মুছতে লাগল৷ সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে৷ অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখছে লোকটার৷ করতে কী চাইছে, বুঝতে পারছিল না কেউ৷
লগ্নজিতা বলল, ‘পারিজাত কুইক, অ্যারেস্ট হিম৷ ও সুইসাইড করার চেষ্টা করছে৷ ‘হাত দুটো আগে ধরো ওর৷’ লগ্নজিতার কথা শেষ হবার আগেই চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেল রুদ্রজ্যোতি৷ হাতে তখনও শক্ত করে ধরা আছে পাঁচশোর নোটগুলো৷ লগ্নজিতা বলল, ‘কল অ্যাম্বুলেন্স৷’
পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, ওই টাকায় সম্ভবত কোনো বিষ লাগিয়ে এনেছিল লোকটা৷’
‘লগ্নজিতা বলল, দেখো, পাঞ্জাবির বোতামটা ঠোঁটে চেপে ধরা রয়েছে৷ ওতেই বোধহয় সায়ানাইড অথবা আর্সেনিক ছিল৷ বেশ বড়ো সাইজের বোতাম৷ সাধারণত পাঞ্জাবির বোতাম এত বড়ো বড়েü হয় না৷ রুদ্রজ্যোতিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই ডক্টররা জানালেন, মারা গেছে৷
‘পোস্টমর্টেম না করলে বোঝা যাবে না, লোকটা কী খেয়ে মরল৷ উফ কী তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লোকটার৷ জানত, ধরা পড়বেই, তাই সব প্রিপারেশন নিয়ে এসেছিল৷’
সুবর্ণা বলল, ‘ম্যাডাম, একটা রিকোয়েস্ট করবো? ওর যা যা সম্পত্তি আছে, যেগুলো ও নমিনি করেছে ঋতিকে বা করেনি, সেগুলো প্লিজ কোনো অনাথ আশ্রম বা সরকারি কোনো কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে দেবেন? আমরা ওসব টাকা বা সম্পত্তি নেব না প্লিজ৷’
‘লগ্নজিতা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ওঁর ক্যাশ টাকা তো সরকারি হেপাজতে যাবেই, বাকিটা দেখছি৷’
বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল লগ্নজিতার৷ শুনতে পেল, রান্নাঘরে একটা দক্ষযজ্ঞ চলছে৷ কৌশিকের গলাও শুনতে পেল৷ সীতাকে জিজ্ঞাসা করতে বাবা এসে বলল, ‘কৌশিক ফ্রেঞ্চ টোস্ট শিখছে তোর মায়ের কাছে৷ আরও তোর পছন্দের সব রান্না শিখে নেবে বলেছে৷’
‘জিতা আড়মোড়া ভেঙে বলল, কেন বাবা, আবার আমাকেই কেন গিনিপিগ বানানো হচ্ছে?’
বাবা মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তোর এই এত কেস-কাবারির মাঝে ওই একটিই লাভ হয়েছে তোর৷ একটা ভালো মানুষকে খুঁজে পেয়েছিস৷’
লগ্নজিতা মুচকি হেসে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল৷ চোখের সামনে এখনও ভাসছে রুদ্রজ্যোতির মুখটা৷ মৃত্যুর সময়েও হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে রেখেছিল টাকাগুলো৷ কী অদ্ভুত নেশা!
কৌশিক হইহট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে ডাইনিংয়ে৷ ‘ফ্রেঞ্চ’ টোস্ট রেডি৷ মিস ভট্টাচার্য কোথায় বেপাত্তা হলেন… আসুন আসুন৷
‘মা আর বাবার প্রাণখোলা হাসির আওয়াজে অনেকদিন পরে খুব ভালো লাগছে আজকের সকালটা৷ লগ্নজিতা মনে মনে বলল, মৃত্যু যেমন সত্যি, জীবন আজও ভীষণ রঙিন৷ কৌশিক বলল, ‘আজ সবাই মিলে একটা লং ড্রাইভে গেলে হয়৷ আমার বাবাকে রেডি হতে বলছি৷’
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে লগ্নজিতা দেখল, ওর ফোনে দুটো মেসেজ এসেছে৷ কোনো এক এস. আচার্য খুন হয়েছে ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়ে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক সবাই মিলে ডুয়ার্স ঘুরে এলে হয় না?’
কৌশিক একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল, উঁহু এককথায় সব কাজ ফেলে ম্যাডাম বেড়াতে যেতে চাইছে যখন, তখন আজকের নিউজপেপারটা দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নেব, ডুয়ার্স যাব নাকি ডুগডুগি বাজাব৷
লগ্নজিতা বুঝল, কৌশিক ওকে হাড়ে হাড়ে চিনে গেছে, আর বোকা বানানো সম্ভব নয় ওকে৷ আপাতত ফ্রেঞ্চ টোস্টে কামড় দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বুজল জিতা৷
সমাপ্ত