মাসি না মডেল?
কৌশিকের নামটা ফুটে উঠল লগ্নজিতার ফোনের স্ক্রিনে৷
রিসিভ করতেই কৌশিক বলল, জিতা, বাচ্চাটার জ্ঞান ফিরেছে৷ কিন্তু ওর মা-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আরেকজন অল্পবয়েসি মেয়ে এসে বলছে সে নাকি এর মাসি৷ আমি বলেছি, মা-কে ছাড়া কাউকে অ্যালাও করা যাবে না কেবিনে৷ জেনারেল বেডে দেওয়া হয়েছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘বি কেয়ারফুল, কৌশিক৷ ওই মাসি, দিদি কাউকে ঢুকতে দেবে না৷ আমি আসছি৷ ওকে ইন্টারোগেট করতে হবে৷’
কৌশিক বলল, বাচ্চাটার মাকে দেখে মনে হচ্ছিল, নিম্নমধ্যবিত্ত ফ্যামিলি৷ কিন্তু মাসিকে তো হলিউডের মডেল মনে হচ্ছে৷
লগ্নজিতা আবার বলল, ‘যাও, তোমায় পারমিশন দিলাম ওই মডেলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার৷ শুধু দেখো যেন মডেল না পালায়৷ আমি আসছি৷’
কৌশিক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নয়, নয় করে বছর চারেক তো হল আমাদের সম্পর্কের৷ এখনও অবধি এতটুকু পজেসিভনেস তো দেখলাম না আমার প্রতি৷ এই জিতা, তুমি আদৌ আমায় ভালোবাসো তো?’
লগ্নজিতা বলল, ‘সুশোভন, তুমি মেয়েটিকে জেরা করো৷ রেকর্ড করবে৷ আমি হসপিটাল থেকে ঘুরে আসছি৷’
‘হ্যাঁ, কৌশিক, কী যেন বলছিলে? মডেলটা বাচ্চাকে ভালোবাসে কি না, সেটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে, না বুঝলে?’
কৌশিক হেসে বলল, ‘বুঝলাম, ম্যাডাম৷ নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে তো আর লাভ নেই, নিজেকে দোষারোপ করা উচিত৷ শীতকালে শীত পড়বে এটাই স্বাভাবিক৷ পুলিশ চোর-ডাকাত ধরবে এটাই স্বাভাবিক৷ আর লগ্নজিতা ভট্টাচার্য জটিল কেস সমাধান করবে এটাই সরল সত্যি৷ এগুলো জেনেও যখন তোমার প্রেমে পড়েছিলাম তখন আর ভাগ্যের দোষ দিয়ে হবেটা কী? এনিওয়ে, তুমি এসো হসপিটালে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘উফ, কাজের সময় তুমি যে কেন কবি হয়ে ওঠো, কে জানে!’
ফোনটা রাখতেই বিধাননগর থেকে মিস্টার সান্যাল কল করে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনি শুনলাম, আজ পিনাক মণ্ডলের স্কুলে গিয়েছিলেন? কেন ম্যাডাম এ চত্বরের সব কেস কি আপনাকেই দেখতে হবে? বুঝলাম আপনি নেশায় গোয়েন্দা, কিন্তু আমাদেরও ছিটেফোঁটা সৌভাগ্যের ভাগীদার হতে দিন৷ আপনি শুনলাম, নিজের অফিসে তালা লাগিয়ে এখন থানায় ঘাঁটি গেড়েছেন?’
লগ্নজিতা একটু গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এ কী বলছেন মিস্টার সান্যাল? দিনকয়েক আগেও তো আপনারা ড্রাগ পাচারের কেস ধরেছিলেন৷ দশ মিনিটের মধ্যেই লালবাজার নারকোটিক সেলে কেসটা চালান করে নিশ্চিন্তে রসগোল্লা খাচ্ছেন৷ আমি আর কোথায় সব কেস পেলাম? নেহাত স্কুলটা আমার থানাগুলোর আন্ডারে, সুমনও আমারই ড্রাইভার তাই আমি পার্সোনালি এটা দেখছি৷ আগের ড্রাগের কেসগুলো তো নারকোটিক সেলে ফাইলের নীচে চাপা পড়ে গেছে, মিস্টার সান্যাল৷
এত কথা শোনার পরে মিস্টার সান্যাল বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনি কী করে জানলেন, আমি রসগোল্লা খাচ্ছি?’
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘সেন মশাইয়ের দোকান থেকে আনলেন নাকি? যেভাবে রস টেনে খাচ্ছেন৷ মিস্টার সান্যাল, আমি আপাতত একটা কাজে যাচ্ছি, আপনি বরং আরেকটা বই লিখে ফেলুন, ‘‘রসগোল্লায় রস নেই’’ নাম দিয়ে৷’
ফোনটা রেখেই মনে মনে হাসল লগ্নজিতা৷ থানায় কেউ একজন পাশ থেকে বলছিল, ‘স্যার, আরেকটা রসগোল্লা দিই?’ সেটা শুনেই লগ্নজিতা গোয়েন্দাগিরি ফলিয়ে দিল মিস্টার সান্যালের ওপরে৷ ভদ্রলোক হয়তো ভাবছেন ওঁর শরীরে সি.সি.টি.ভি. ক্যামেরা সেট করে দিয়েছে ও৷
হসপিটালে পৌঁছেই দেখল একজন বছর চব্বিশের মারাত্মক সুন্দরী মেয়ে সৃজিতের কেবিনের বাইরে বসে আছে৷ কৌশিক ওকে দেখেই বলল, ‘ওই যে উনি৷ নাম বলছেন রক্তিমা৷ দেখো, ওর মা বা বাচ্চাটার থেকে এঁর স্ট্যান্ডার্ডটা কিন্তু বেশ আলাদা৷ না মানে চোখে পড়ছে৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমি এসে গেছি এবারে তুমি রক্তিমার থেকে চোখ সরাতে পারো, কৌশিক৷ আমি বুঝে নিচ্ছি৷’
কৌশিক মুচকি হেসে বলল, ‘সিরিয়াসলি? আর ইউ জেলাস?’
লগ্নজিতা বলল, একেবারেই নয়৷ আমি সুন্দরী নই, তাই তাদের সঙ্গে আমার কোনো প্রতিযোগিতা নেই৷ আর শুধু রূপ দেখে যারা প্রেমে পড়ে, তাদের প্রতি আমি আরও বেশি আগ্রহ হারাই৷
কৌশিক ঢোঁক গিলে বলল, ‘বাচ্চাটার মা-কে সারা হসপিটালে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, জিতা৷’
লগ্নজিতা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘আরে, তোমরা এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হও কী করে বলত? তোমাদের হসপিটালে ডাক্তার সেজে এসে কেউ একটা মানুষকে খুন করে বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ টের পাচ্ছে না৷ আজ এতবার বললাম, বিষয়টা সাংঘাতিক৷ তারপরেও তোমরা এত কেয়ারলেস কী করে হও, বলবে? এখন বাচ্চাটার জ্ঞান ফিরেছে, সে তো মা-কে খুঁজবে৷
কৌশিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আরে, মায়ের তো নিজেরই খেয়াল রাখা উচিত বাচ্চাটার কখন সেন্স আসছে, সে ব্যাপারে৷ আমরা চিকিৎসা করব না পেশেন্টের বাড়ির লোকের দিকে নজর রাখব বলত? এই হয়েছে এদের সমস্যা৷ এতক্ষণ লবিতে বসে ছিল, ঘণ্টাখানেক আগে মাসি এন্ট্রি নিল মা বেপাত্তা৷
লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক, মা বেপাত্তা ইচ্ছে করে হয়েছে নাকি কেউ ভয় দেখিয়ে বের করে নিয়ে গেল, সেটাই তো জানার৷ ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল, মহিলা কিছু একটা গোপন করছে৷ এনিওয়ে, চল, বাচ্চাটাকে আগে দেখি৷’
বাচ্চাটা বেশ দুর্বল৷ চোখ খুলে শুয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু প্রাণশক্তি কমে গেছে যেন৷ লগ্নজিতা আলতো করে মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তোমার নাম কী?’
ছেলেটা ওষুধের ঘোরের মধ্যেই বলল, ‘সৃজিত রায়৷’
‘কোন ক্লাসে পড়ো?’
প্রশ্নটা শুনেই ছেলেটা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা কোথায়?’
কৌশিক শান্ত গলায় বলল, ‘তোমার জন্য বিস্কিট আনতে গেছে৷ তুমি কোন ক্লাসে পড়ো? স্কুলে তোমার বন্ধু আছে?’
সৃজিত বলল, ‘আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি৷ হ্যাঁ, আমার অনেক বন্ধু আছে৷ আমি কি ডাক্তারখানায় এসেছি? ইঞ্জেকশন দিয়ো না আমায়৷’
কৌশিক বলল, ‘দেব না৷ তুমি কি চকোলেট খেয়েছিলে অনেকগুলো? তোমার পেটে লাগছিল তো৷’
সৃজিত বলল, আমি ছটা চকোলেট খেয়েছিলাম৷
লগ্নজিতা বলল, ‘কোথা থেকে কিনলে চকোলেট তুমি?’
সৃজিত বলল, কিনিনি তো৷ দোকান থেকে নিয়েছিলাম৷ ‘ঠিক সেই সময়েই ঝড়ের গতিতে ঢুকল সৃজিতের মা আর মাসি৷ দুই মহিলাকে কোনো অ্যাঙ্গল থেকেই বোন মনে হয় না৷ সহোদরা দূরে থাকুক, মাসতুতো, পিসতুতো বোন বলেও মনে হচ্ছে না৷ কারণ দুজনের মধ্যে সামান্যতম মিল নেই৷ সৃজিতের মা এসে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, ছেলেটা যদি এখন সুস্থ থাকে তাহলে আমি কি বাড়ি নিয়ে যেতে পারি?’
কৌশিক বললো, দেখুন এটা আর আমাদের হাতে নেই৷ যেহেতু ওর স্টমাকে নারকোটিকস পাওয়া গেছে, সেহেতু এটা পুলিশ কেস৷ পুলিশ বললে আমরা ডিসচার্জ করে দেব৷ একটু রেস্টে থাকতে হবে৷ প্রোটিনযুক্ত খাবার খেতে হবে৷ আমি দুটো মেডিসিন লিখে দিয়েছি৷ এরপর বাকি পুলিশ বুঝে নেবে৷’
সৃজিতের মা কাবেরী বেশ ঝাঁজালো গলায় বলল, ‘দেখুন, ড্রাগস ও পাবে কোথায়? ঘরে ছিল ইঁদুর-মারা বিষ, ওটাই ভুল করে খেয়েছে হয়তো৷ আমার ছেলেকে নিয়ে যাবে বলে ওর মাসি এসেছে৷ নিজের কাজকর্ম ফেলে৷ এখন ওকে আটকে রাখা তো চলবে না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কাবেরীদেবী, ঘণ্টাখানেকের জন্য আপনি কোথায় হাপিশ হয়ে গিয়েছিলেন বলুন তো? আপনি ইঁদুর-মারা বিষ সরানোর জন্য বাড়িতে যখন গিয়েছিলেন তখনই তো সৃজিত আমাদের জানাল ও ছ-টা চকোলেট খেয়েছে একসঙ্গে৷
সৃজিতের মাসির পরিচয়ে যে মহিলাটি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল, সে এগিয়ে এসে বলল, ‘দিদি, ওঁদের ডিউটি করতে দে৷ যদি সত্যিই ড্রাগস পেয়ে থাকেন ডাক্তারবাবু তাহলে সেটা তো বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য খুবই ভয়ংকর৷ ওদের বিষয়টা তলিয়ে দেখতে দে৷ সানুকে না হয় আমরা কাল বাড়ি নিয়ে যাব৷ লগ্নজিতা কিছু বলার আগেই মেয়েটি উঠে এসে হাত জোড় করে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি রক্তিমা ঘোষ৷ প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবের রিসেপশনিস্ট, ম্যাডাম৷ সৃজিত আমার বোনপো৷ সৃজিতের বাবা মারা যাবার পরে ও আমার কাছেই মানুষ৷ দিদি তো দিনরাত দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকত, আমি তখনও চাকরি পাইনি৷ তাই সৃজিতকে নিয়েই কাটত আমার দিনরাত৷ লগ্নজিতা বলল, ম্যাডাম বুঝতেই তো পারছেন কেসটা কতটা জটিল৷ ড্রাগসের ওভার ডোজ হয়ে প্রায় মরেই যাচ্ছিল ছেলেটা৷’
রক্তিমা বলল, ‘একটা জিনিসই মাথায় ঢুকছে না, এসব ও পেল কোথায়? ম্যাডাম, আমরা যদি ঘণ্টাখানেক ওয়েট করি তাহলে কি আপনাদের জেরাটা শেষ হবে? আসলে সানু অসুস্থ তো৷ তাহলে আজ রাতেও দিদিকে হসপিটালে স্টে করতে হবে৷ বাড়ি ফাঁকা তো৷ আমি বেরিয়ে যাব কাজে৷’ সৃজিতের মা বেশ তাড়ায় রয়েছে৷ রক্তিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমায় বাড়ি ফিরতেই হবে৷ তুই তাহলে সানুর কাছে থেকে যা একটু৷
রক্তিমা বলল, ‘আমি কী করে থাকব দিদি? আমি মলিকে ঘণ্টাখানেকের জন্য বসিয়ে এসেছি৷ আমায় ফিরতে হবে৷’
লগ্নজিতা ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনারা আধ ঘণ্টা বাইরে ওয়েট করুন৷’
কথার মাঝেই রক্তিমা এগিয়ে এসে সৃজিতের গালে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল৷ কৌশিক আর লগ্নজিতা চোখাচোখি করল৷ বেশ বুঝতে পারছে, ওরা কেউই চাইছে না সৃজিতকে কোনোরকম প্রশ্ন করা হোক৷ লগ্নজিতা বলল, বলো সৃজিত, তারপর চকোলেট খাওয়ার পরে কী হল?’
সৃজিত চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আমার আর কিছু মনে পড়ছে না, ম্যাডাম৷ আমি বাড়ি যাব৷’
লগ্নজিতা ফিসফিস করে বলল, এর বাড়ির প্রপার অ্যাড্রেসটা নিয়ে রিলিজ করে দাও৷ না হলে মিডিয়া ডেকে পিছনে লেলিয়ে দেবে৷ হসপিটালে অসুস্থ বাচ্চার জেরা চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ আর আমাদের বাঙালিদের তো শুধু একটা বাহানা চাই হুজুকের৷ সেটা যদি পুলিশের বিরুদ্ধে হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা৷ তুমি একটু নার্সকে বলে রাখো৷ ওষুধ বোঝানোর সময় যেন কায়দা করে সৃজিতের অ্যাড্রেসটা নিয়ে নেয়৷ অবশ্য স্কুলে গেলেও পেয়ে যাব৷ তবুও দেখি, মহিলা কতটা সত্যি বলছে৷ আরেকটা কথা, ওই রক্তিমা কোন ল্যাবে আছে, সেটাও জেনে নিয়ো৷ জেরাতে যখন এত আপত্তি তখন শুধু গল্প নয়, পাঁচশো পাতার উপন্যাস আছে, কৌশিক৷ এই দেড় দিনের মধ্যে ঝড়ের গতিতে ঘটনার ঘনঘটা ঘটে যাচ্ছে৷ সব গুলিয়ে যাচ্ছে৷ অলরেডি একটা খুন হয়ে গেছে৷ কলকাতার প্রকাশ্য দিবালোকে আমার এলাকায় স্কুলের সামনে চকোলেটের মধ্যে নারকোটিক ব্যবহার করে সেটা বাচ্চাদের দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বত্র৷ যাকে ধরলে এর একটা মাথার ঠিকানা পাওয়া যেত, সে-ই খুন হয়ে গেল, কৌশিক৷ এনিওয়ে, আপাতত আমি চললাম৷ সানডে হয়তো বেরোতে হবে৷ রেডি থেকো৷ ও.টি. থাকলে আগের দিন সেরে রেখো প্লিজ৷
কৌশিক বলল, ‘চেষ্টা করছি৷ কোথায় যেতে হবেটা নিশ্চয়ই গাড়িতে উঠে অন্তত এক কিলোমিটার গাড়ি চলার পরে জানতে পারব তা-ই তো? যাক গে, তোমার সঙ্গে আমি জাহান্নামে যেতেও রাজি৷
লগ্নজিতা বেরিয়ে এল৷ আসার সময় আবারও বলে এল, ‘অ্যাড্রেসটা নোট করে রেখো৷’ লগ্নজিতা থানায় ফিরে এসে দেখল, সুশোভন তখনও ধমকাচ্ছে জয়ন্তর পরিচারিকাকে৷ লগ্নজিতা ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এখনও চলছে?’
সুশোভন বিরক্তির সুরে বলল, ‘ম্যাডাম, মহা বিছুটি মেয়ে৷ একটা কথাও বলছে না৷ বলছে, আমি কিছু জানি না৷ কাজ করতাম, বাড়ি যেতাম৷ ম্যাডাম দেখুন, হাতে আই ফোন প্রো৷ কত মাইনে পায় ম্যাডাম এরা?
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘তোমার কী ফোন সুশোভন? স্যামসাং? রিলস বানাও? অনীতা ভালো রিলস বানায় তা-ই না?
অনীতা ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে৷ সৃজিতের সঙ্গে ভালো করে কথা হয়নি বলেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে৷ ওই মাসি আর মা দুজনের জন্য আসল তথ্যটা জানা গেল না৷ গণ্ডগোল আছে বুঝেও চলে আসতে হল ওকে৷ মাথার শিরাগুলো দপদপ করছিল৷ তার মধ্যে অনীতার অনমনীয় মনোভাব দেখেই মাথায় আগুন জ্বলে গেল৷ বেশ চিৎকার করেই বলল, কেন সময় নষ্ট করছ সুশোভন? লকআপটা তো ফাঁকাই আছে৷ অতিথি যখন নিজে যেচে চাইছে লকআপে ঢুকতে তখন দেরি না করে ভরে দাও৷ দেখে রাতে যেন ওকে মশা না কামড়ায়৷ আজকাল যা ডেঙ্গি হচ্ছে৷
লগ্নজিতা বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ নিতেই অনীতা বলল, ‘ম্যাডাম, আমায় ওরা মেরে দেবে৷ জয়ন্তদাকে তো ওরা মেরে দিল৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘বেশ, বোলো না৷ জেলে থাকো৷ কেউ তোমায় মারতে পারবে না৷
সুশোভন, ওর বাড়িতে একটা খবর পাঠিয়ে দিয়ো৷ বাচ্চা, স্বামী এরা আবার অপেক্ষা করে বসে থাকবে৷’ অনীতা তখনও ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে দেখেও লগ্নজিতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল৷ সুশোভনকেও ইশারায় বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিল৷ লগ্নজিতার নিজস্ব অফিসের রুমের সামনে দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে থাকে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে৷ মাঝে মাঝেই খেয়াল করে দেখে, শ্যামলবাবু ঘুমাচ্ছেন৷ এই থানায় বসবে কদিন ঠিক করার পরেই ওর দুজন পার্সোনাল সিকিয়োরিটিও পিছন পিছন এসে হাজির হয়েছে৷ আজও শ্যামলবাবু ঝিমুচ্ছেন৷ ওদের আর দোষ কী? লগ্নজিতা ছুটে বেড়ালে ওরা আর কার ঘরের সিকিউরিটি হবে? নিজের ঘরে ঢোকার সময় লগ্নজিতা সিকিয়োরিটিকে বলে ঢুকল, আমরা একটা মিটিং-এ আছি৷ কেউ এলে বাইরে ওয়েট করতে বলবেন৷
ঘরে ঢুকেই সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, এই অনীতা পুরো ঘোরালো জিনিস৷ ১৪ প্রো ব্যবহার করার টাকা ও পেল কোথায়? এর হাজবেন্ড রঙের মিস্ত্রি৷ বাড়িতে থাকেই কম৷ অনীতা আরও তিনটে বাড়িতে কাজ করে৷ খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সেই বাড়িগুলোতে ও মাত্র আধ ঘণ্টা করে থাকত৷ কোনোটাতে বাসন মাজা, কোনোটাতে ঘর মোছা৷ রান্না থেকে সব কাজ করত জয়ন্তর বাড়িতেই৷
‘ম্যাডাম, ওর বাচ্চাটা বছর তিনেকের৷ তাকেও নিয়ে এসে জয়ন্তর বাড়িতেই রাখত৷ বাড়িটা দোকানের পিছনে তিনটে-চারটে বাড়ি পিছনেই৷ কাল সকালে একবার বাড়িটা রেইড করতে পারলে হত৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘অনীতার কাছে কাকে বসিয়ে এসেছ বলত?
সুশোভন হেসে বলল, বিশ্বাসদাকে, ম্যাডাম৷ রেডিয়োটা দিয়ে এসেছি, ম্যাডাম৷ আর চিন্তা নেই৷ সারারাত বসিয়ে রাখবে অনীতাকে৷ ম্যাডাম, আজ তাহলে বাড়ি চললাম৷ কাল এসে অনীতাকে দেখা যাবে৷
লগ্নজিতাও বেরিয়ে এল থানা থেকে৷ নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকেই ওর প্রথম একটা কথা মাথায় খেলে গেল৷ কেউ একজন ওর দৃষ্টি ঘোরানোর জন্যই জয়ন্তকে খুন করে দিল৷ জয়ন্তকে হয়তো কোনো এজেন্ট মাল দিত৷ আসল মাথার হদিশ জয়ন্ত বেঁচে থাকলেও লগ্নজিতা পেত না৷ এরা এত চুনোপুঁটির হাতের নাগালে থাকেও না৷ জয়ন্তর ফোনটা অবধি নিয়ে যায়নি তারা৷ তার মানে প্রমাণ লোপাট করার উদ্দেশ্য ছিল না৷ সময় দরকার ছিল৷ জয়ন্ত খুনে সেই সময়টা ওরা পেয়ে গেল৷ অদ্ভুতভাবে এক-দু-দিনে ঝড়ের গতিতে এত কিছু ঘটে যাওয়ায় একটু কি বেশি চঞ্চল হয়ে পড়েছে লগ্নজিতা? আরেকটু ভেবে প্ল্যান করতে হবে৷ জয়ন্ত খুনের আড়ালে হয়তো আসল অপরাধীরা মুখ লুকিয়ে নেওয়ার সময় পাচ্ছে৷ সব থেকে বড়ো কথা, ইউসুফ বলল, জয়ন্তর দোকানের সামনে পাহারা বসিয়েছে৷ কিন্তু তপনের কথামতো জয়ন্ত সন্ধেতে দোকানে ঢুকেছিল৷ তাহলে ইউসুফের লোক তাকে দেখতে পেল না কেন? তবে কি কেউ বুঝতে পেরে গিয়েছিল, জয়ন্ত পুলিশের নজরবন্দিতে রয়েছে?