কৌশিকের মানভঞ্জন
রান্না করা খাবারগুলো টেবিলে যত্ন করে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে সীতা৷ যে পাত্রে রেখেছে, সেগুলো মাইক্রোআভেনপ্রুফ৷ মনে মনে হাসল জিতা৷ সীতা ভাবে, দিদি রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে খাবার গরম করে খাবে৷ ঠান্ডা খাবারগুলো নিজের সামনে সাজিয়ে নিয়ে খেতে বসে গেল লগ্নজিতা৷ কৌশিক রেগুলার মেসেজ করে এই সময়৷ জিজ্ঞাসা করে, ডিনার হল কি না৷ আজকে কোনো মেসেজ নেই৷ হসপিটালে গিয়ে সৃজিতের মা বেপাত্তা জানার পরে যে কথাগুলো কৌশিককে বলে ফেলেছে জিতা ওগুলো খুবই অপমানজনক৷ শুধু ওকে ভালোবাসে বলে এ ধরনের কথা কৌশিক ডিজার্ভ করে না৷ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে মেসেজ করল জিতা৷ ঘুমালে? সিন হয়েও কোনো উত্তর এল না৷ লগ্নজিতা বুঝল, অভিমান হয়েছে৷ কৌশিক হলে হয়তো এই অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করত৷ কিন্তু অভিমান ভাঙাতে জিতা জানে না৷ শিখে ওঠাও হয়নি৷ ভালোবাসা নামক বিষয়টাতেই তো বিশ্বাস চলে গিয়েছিল ওর প্রথম প্রেমে আঘাত পেয়ে৷ তমাল ওর জীবনের বেশ কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে৷ তমালের একটা কথা যখন কানে বাজে তখন অদ্ভুত একটা আক্রোশ মনকে ক্ষিপ্ত করে দেয়৷ ‘পুলিশে চাকরি করা মেয়েকে তো আমাদের বাড়ির বউ হিসাবে কেউ মেনে নেবে না, জিতা৷ চাকরিটা তোমায় ছাড়তে হবে৷’ লগ্নজিতা বলেছিল, ‘তোমাদের বাড়ির মানুষদের মেনে নেওয়া আর না-নেওয়ায় আমার কেরিয়ার নির্ভর করবে না, তমাল৷ আমি আমার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি৷ ভালোবাসা আমায় এতটা অন্ধ কোনোদিনই করে দিতে পারবে না যে আমি নিজের স্বপ্নগুলোকে হত্যা করব৷’ ভেঙে গিয়েছিল সম্পর্কটা৷ তারপর দীর্ঘদিন প্রেম নামক শব্দটার প্রতিই বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল৷ নিজের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি এমন কোনো অনুভূতিকে৷ দীর্ঘ বছর পরে কৌশিক এসে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল৷ লগ্নজিতার বীভৎস ব্যস্ততার দিনে, ওর কাছ থেকে এক ফোঁটা সময় না পেয়েও রয়ে গিয়েছিল কৌশিক৷ একতরফা এফোর্ট দিয়েই টিকিয়ে রেখেছিল সম্পর্কটাকে৷ তারপর কবে থেকে যেন জিতাও ব্যস্ততার ভিড়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল৷ একজন আছে, যে ওটি থেকে বেরিয়েও মেসেজ করবেই, লাঞ্চ করে নিয়ো৷ এতগুলো বছরে কৌশিকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই আবার ভালোবাসা শব্দটার প্রতি ওর বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছিল৷ কৌশিকই বারংবার ওর রাগ ভাঙিয়েছে৷ কখনো জিতাকে এফোর্ট দিতে হয়নি এ সম্পর্কে৷ তাই অভিমান ভাঙানোর পদ্ধতিটাই শেখা হয়নি ওর৷ আবার মেসেজ করল, সরি কৌশিক৷ তুমি তো জানো, আমি ডিউটিতে থাকলে সব কথা এত মিন করে বলি না৷ প্লিজ কিছু মনে কোরো না৷
বিশ্বাসদা ফোনে বলল, ‘ম্যাডাম, অনীতা আপনাকে সব বলতে চায়৷ সারারাত থানায় বসে থেকে তেজ কমেছে ফুলনদেবীর৷ ‘সোমেশ্বর বিশ্বাস বেশ খোশমেজাজেই আছেন মনে হচ্ছে৷ এই ভদ্রলোক হচ্ছে ওদের থানার সব থেকে শান্ত মস্তিষ্কের ধৈর্যশীল মানুষ৷ সুশোভন বলে, ‘মস্তিষ্কের সিংহভাগ জুড়ে ফাঁকা ম্যাডাম, তাই কাজ কম করে৷ বিশ্বাসদার একটাই নেশা, রেডিয়োর বিভিন্ন অনুষ্ঠান শোনা৷ আর মাত্র দু-বছর পরেই রিটায়ারমেন্ট— এই অজুহাতে ফাঁকি দেন ভদ্রলোক৷ তবে কেউ যদি কোনো দায়িত্ব দেয় তাহলে সেটা প্রাণ দিয়েও করার চেষ্টা করেন৷’
লগ্নজিতা ফোনটা স্পিকারে দিয়ে ব্রাশ করতে করতেই বলল, ‘আপনাকে ঠিক কী বলল মেয়েটা?’
বিশ্বাসদা বললেন, ‘ম্যাডাম, মেয়েটা মনে করছিল আমি রেডিয়ো শুনছি, মন দিয়ে ওর কথা কিছুই শুনতে পারছি না৷ বার দুয়েক কল করল কাকে যেন৷ সে রিসিভ করল না৷ গজগজ করে বলল, শালা হারামি মেয়েছেলে, ফেঁসে গেলে আর চেনে না৷ দেব পুলিশকে সব বলে, বুঝবে তখন৷ আবার আরেকটা কল করে কাউকে বলছিল, জয়ন্তদাকে কেউ মেরে দিয়েছে রে৷ পুলিশ আমায় তুলে এনেছে থানায়৷ আমি ম্যাডামকে ফোন করলাম দুবার, ধরল না৷ তার মানে আমাদের বাঁচাবে না৷ আমি কেন জেল খাটবো? যেটুকু জানি, বলে দেব৷ জয়ন্তদাকে মনে হচ্ছে, ওই শালিই খুন করিয়ে দিয়েছে৷ ও সব পারে৷ তুই পালা, পুলিশ হয়তো তোকেও তুলে আনবে৷ আমি কিন্তু ওর নাম বলে দিচ্ছি৷ কিন্তু ভয় করছে ও যদি আমায় খুন করিয়ে দেয়! আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল৷ আমি তো ম্যাডাম, শিবনেত্র করে এফ.এম.-এ গান শুনছিলাম৷ আমায় জিজ্ঞাসা করল, এই মহিলা পুলিশ অফিসার আবার কখন আসবে থানায়? আমি বললাম, আসবে যখন কাজ পড়বে৷ তখন ঘাড় গোঁজ করে বলল, আমি ওঁকেই সবটা বলব৷ উনিও মেয়ে, বুঝবেন মেয়েদের জ্বালাটা৷ মনটা নিশ্চয়ই অতটা কঠিন নয়৷ অবশ্য তাইবা কী বলব? ওদিকে আরেকজনও তো মহিলাই ছিল৷ এসব ফিসফিস করার পরে মেয়েটা বলেছে, ম্যাডাম এলেই সবটা বলব৷
লগ্নজিতা বলল, ‘ওকে টিফিন খাওয়ান৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি৷
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসতেই বেল বাজল৷ ‘সীতা দরজা খুলতেই পরিচিত গলা, সীতা, আমার জন্যও ব্রেড আর অমলেট দাও৷ কিছু না খেয়েই বেরিয়ে এসেছি৷ কারণটা হল, তোমার দিদি কালকে মেসেজ করে বলেছিল, সে আমাকে মারাত্মক মিস করছে৷ জিতা মুচকি হেসে বলল, ‘আহা কৌশিক কী হচ্ছে এগুলো৷’
কৌশিক বলল, ‘শুনুন ম্যাডাম, আমার বাড়িতে ব্রেড আর এগ নেই বলে সাতসকালে আমি এখানে আসিনি৷ এসেছি তোমায় দুটো ইনফর্মেশন দিতে৷ সৃজিতকে কালকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কোন দোকান থেকে চকোলেট কেনো? তো সৃজিত বলল, আমি চকোলেট তো কিনি না, অনেক দাম তো, বন্ধুরা কেনে আমাদের দোকান থেকে৷ আমি মায়ের দোকান থেকে নিয়ে খাই৷ আরেকটা কথা, ওই যে মডেল সুন্দরী, যাকে আমার পাশে দেখে তুমি আচমকা রেগে গিয়ে ভুলভাল বকছিলে, যে কারণে কাল রাতে সরি লিখলে…
জিতা রেগে গিয়ে বলল, ‘উফ, ফাজলামি কেন করছ? তোমার কি আমাকে জিরো আইকিউ মনে হয়? সৃজিতের মাসির পরিচয় দিতে গিয়ে এত শিবের গাজন গাইছ কেন? বাই দ্য ওয়ে, আমি কাউকে দেখে জেলাস ফিল করিনি৷ এনিওয়ে বলো বাকিটা৷
কৌশিক কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘সীতা, যদি তোমার ম্যাডাম আমায় বিয়ে করেন তো যৌতুক হিসাবে তোমায় আমি নিয়ে যাব৷ এই কফিটা স্টারবাক্সও করতে পারে না৷ হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, ওটা সৃজিতের মাসি নয়৷ মানে দূর সম্পর্কেরও নয়৷ এই মহিলাকে সৃজিত বার দুয়েক দেখেছে ওদের বাড়িতে৷ ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে৷ সৃজিতের জন্য একবার একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি এনেছিল৷ দ্যাট’স এনাফ৷ কোনো তুতো মাসিও নয়৷ এদিকে সৃজিতের মা দাবি করছেন ওই রক্তিমা নাকি ওঁর বোন৷
লগ্নজিতা বলল, ‘সৃজিত কী বলল? ওর বন্ধুরা ওদের দোকান থেকে চকোলেট কেনে তাই-তো? তার মানে দোকানটা স্কুলের কাছেই৷ আচ্ছা কৌশিক, স্কুলটা সৃজিতের মা সঠিক বলেছে তো? নাকি অ্যাড্রেসের মতো এটাও ফেক? তাহলে আবার কলকাতা শহরে চিরুনিতল্লাশি চালাতে হবে৷
কৌশিক বলল, তোমার সঙ্গে বছর চারেক থেকে এটুকু বুদ্ধি আমার হয়েছে, ম্যাডাম৷ আমি সৃজিতকে বললাম, তুমি তো নেতাজি সুভাষচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে পড়ো৷ সঙ্গে সঙ্গে বলল, না ডাক্তারবাবু, আমি ঋষি অরবিন্দতে পড়ি৷ বাচ্চাটা তো জানেই না সে কী অন্যায় করেছে, তাই ও সব সত্যি বলছিল৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ওই মাসি কী বলল তোমার কানে কানে? সৃজিত বলল, আমি যদি বেশি কথা বলি তাহলে পুলিশ আমায় ধরে নিয়ে যাবে৷ আমি মায়ের কাছে ফিরতে পারব না৷ ডাক্তারবাবু আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলব না৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে কে এই অজ্ঞান হওয়ার চকোলেট খেতে চাইত? বলল, ক্লাস ইলেভেনের অভিষেকদা আর টুয়েলভের সৌম্যদা বেশি চাইত৷ নিয়ে গেলেই অনেক টাকা দিত৷ সেই টাকা আমি মা-কে এনে দিতাম৷ মা আরও চকোলেট দিত৷
লগ্নজিতা বলল, ‘বিগ মিসটেক হল কৌশিক৷ সৃজিতের ওই মা আর ফেক মাসিটাকে আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি৷ কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ৷ ওই মাসি হয়তো লাইভে এসে আমার মা-মাসি এক করে দিল৷ ওয়ারেন্ট ছাড়া ওদের আটকে রেখেছি বলে পুলিশের অধঃপতন নিয়ে পাক্কা দু-ঘণ্টার লেকচার দিয়ে দিল৷ আজকাল সব সম্ভব৷ অপরাধীরাও আজকাল মিডিয়া ডেকে গলাবাজি করছে৷’
কৌশিক পোচটা মুখে ঢুকিয়ে বলল, ‘জিতা, সুন্দরী পুলিশ অফিসারদের মুখে গালিগালাজ যে এত মিষ্টি লাগে—এটা আগে বুঝিনি৷ বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে থাকার সময় ধেড়ে ধেড়ে সিনিয়রদের মুখে এসব প্রবচন শুনে তো বেশ বিরক্ত লাগত৷ প্রেমে পড়লে বুড়ো বয়সেও বসন্ত বাতাস বয়, বলো?’
জিতা বলল, ‘তোমার কত বয়েস হল, কৌশিক? বত্রিশ তো? আমার থেকে বছর দুয়েকের বড়ো তুমি৷ আমার বুড়ো হতে বেশ দেরি আছে৷ তুমি যদি একান্ত বুড়ো হতে চাও তাহলে বিয়েটা সেরে ফেলতে পারো৷
কৌশিক আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, সত্যি? তাহলে তো বাবাকে বলতে হচ্ছে একটা ডেট দেখার জন্য৷ তোমার বাবার সঙ্গেও তো কথা বলতে হচ্ছে৷’
কোমরে বেল্টটা পরতে পরতে জিতা বলল, ‘আমার বাবা কী করবে তোমার বিয়েতে?’
কৌশিক হেসে বলল, ‘সে কী, শ্বশুরমশাই ছাড়া বিয়ে হয় নাকি?’
লগ্নজিতা বলল, ‘বাই এনি চান্স, তুমি কি আমাদের বিয়ের কথা বলছ? সেটা হলে তো এখনও দু-বছর ওয়েট করতে হবে৷ আমি তোমার বুড়ো হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ থেকেই পাত্রী খুঁজতে বলছিলাম৷’
কৌশিক রাগী গলায় বলল, ‘সবসময় ইয়ারকি ভালো লাগে না৷ এনিওয়ে, বি কেয়ারফুল৷ কেসটা কিন্তু বেশ জটিল৷ সাবধানে থেকো৷ আমার ও.টি আছে দশটায়৷ চললাম৷ সীতা যৌতুকে তোমায় নিয়ে যাব৷ বাই৷’
নিজের মনেই হাসছিল লগ্নজিতা৷ চার বছরে একটা মানুষের একটুও পরিবর্তন হল না৷ সেই একই ছেলেমানুষ রয়ে গেল৷ আবার রোগীরা বলে, ডাক্তারবাবু নাকি খুব ম্যাচিয়োর ডক্টর৷ হে ভগবান!