রিলস সুন্দরী
ম্যাডাম, এদিকে আরেক বিপদ৷ ওই স্কুলের সিকিউরিটি লোকের কাছে বলছে, ওকে নাকি থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করার নাম করে ডেকে এনে মারধর করা হয়েছে৷ কী মুশকিল বলুন তো! এই যে জয়ন্ত প্রামাণিকের ফোনের লক ওপেন করা গেছে৷ ওটা একবার চেক করে নেবেন৷’ টেবিলে ফোনটা রাখতে রাখতে সুশোভন বলল৷
ফোনটা দেখেই অনীতা বলল, ‘এটা জয়ন্তদার আসল ফোন নয়৷ সেটা ব্লু কালারের ছিল৷ এটা পুরোনো ফোন৷ পরিচিতদের এই নম্বরটা দিয়ে রেখেছিল৷ এটাতে তেমন কিছু পাবেন না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘হ্যাঁ, তারপর তুমি যেটা বলছিলে, সেটা কমপ্লিট করো৷ জয়ন্তদার বউ আসলে অসুস্থ নয়?’
অনিতা বলল, ‘না, বউদির ক্যান্সার হয়নি৷ বউদির সঙ্গে জয়ন্তদার ঝগড়া হত টাকার জন্য৷ বউদির দামি দামি পোশাক চাই, হিরের গয়না চাহ— এইসবের জন্যই জয়ন্তদার বাজারে ধার হয়ে গিয়েছিল৷ তারপরে বউদি একদিন রাত্রিবেলা ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল৷ বলে গেল, দিতে তো কিছুই পারো না, অন্তত আমি মরে গেছি বলে লোকের কাছ থেকে ধার নিতে পারবে৷ ওই স্টেশনারি দোকানের আর আয় কত যে বউদির এত চাহিদা মেটাবে? তাই দাদার বাড়িতে রোজই পাওনাদার দাঁড়িয়ে থাকত৷ তখন দাদা বুদ্ধি করে বলতে শুরু করল, বউদির ক্যান্সার ধরা পড়েছে তাই প্রচুর টাকা লাগছে৷ দিয়ে এর কাছে ধার নিয়ে ওর কাছে শোধ করে চালাচ্ছিল৷ আমি জিজ্ঞাসা করতাম, বউদি আর আসবে না? জয়ন্তদা বলত, টাকার জোগাড় করতে পারলে আসবে৷ তারপর একদিন সকালে কাজে এসে দেখলাম, বউদি রয়েছে বাড়িতে৷ দাদা বলছে, স্কুলের সামনে এসব করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি? বউদি রেগে গিয়ে বলেছিল তাহলে মরবে৷ এমনিতেই বা কী বেঁচে আছ? তারপর রাত করে মাসে একদিন বউদি আসত, একটা বড়ো ব্যাগ নিয়ে৷ ভোর ভোর কেউ ওঠার আগেই চলে যেত৷ আমায় এই ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, রিল বানাবি৷ নিজে এনজয় করবি জীবন৷ কী লোকের বাসন মাজিস? এত দামি ফোন দেখে আমি ফেরত দিতে গিয়েছিলাম৷ বউদি বলেছিল, মুখ কোথাও খুললে এমনিও মরবি, অমনিও মরবি৷ তার থেকে বরং যে কদিন মুখ বন্ধ করে থাকতে পারবি, সে কদিন প্রাণেও বাঁচবি, সেলফিও তুলতে পারবি৷ সেই থেকেই আমি ভয়ে চুপ করে থাকি৷
লগ্নজিতা বলল, ‘উহুঁ, তারপর থেকে ভয়ে নয়, লোভে চুপ করে থাকো৷ ভাগ পেলে চুপ থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক৷’
অনীতা বলল, আমায় নাহলে মেরে ফেলত আমি জানি৷ এই তো মরতে হল তো জয়ন্তদাকে৷ বউদির কথা শুনলে তো আর মরতে হত না৷ ম্যাডাম, আপনারা পুলিশের লোক, আপনাদের কিছু হবে না৷ আমাদের মতো মানুষদের পিঁপড়ের মতো শেষ করে দেবে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘তুমি জয়ন্ত প্রামাণিকের বউয়ের অ্যাড্রেস দিতে পারবে? অথবা ফোন নম্বর?’
অনীতা বলল, ‘আমায় যে নম্বর থেকে কল করত, সেটা দিতে পারব৷ তবে কাল থেকে যতবার ফোন করছি, এই নম্বর সুইচড অফ বলছে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘অ্যাড্রেস?’
অনীতা বলল, ‘আমি সঠিক জানি না, ম্যাডাম৷ তবে দাদা একদিন বলেছিল, যাদবপুরের ফ্ল্যাটে তুমি একা থাকছ, নাকি আর কেউ আসছে সেখানে? বউদি বলেছিল, সেটা জেনে তুমি কী করবে? তুমি যে দোকানে বসে পাড়ার বউদিদের বউয়ের অসুস্থতার কথা বলে গল্প জমাচ্ছ আমি কি সে নিয়ে কিছু বলেছি? দাদা বলেছিল, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে গিয়ে ফ্ল্যাটে থাকি৷ বউদি বলেছিল, সময় হলে ঠিক ডাকব৷ এখন মন দিয়ে দোকান করো৷ তবে ম্যাডাম, বউদি ব্যাগে করে প্রচুর লজেন্স নিয়ে আসত৷ দু-রকম চকোলেট আনত৷ আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এগুলো কীসের চকোলেট? বউদি একমুঠো হাতে দিয়ে বলেছিল, পাড়ায় গিয়ে বিলি করে দাও৷ আর যারা কিনতে চাইবে, তাদের বলবে, জয়ন্ত ভ্যারাইটিজে পাওয়া যায়৷ আমায় বেশ কয়েকবার ওই চকোলেট বিলি করার জন্য দিত৷ আমি একবার লোভে পড়ে দুটো খেয়েছিলাম৷ মাথাটা হালকা ঝিমঝিম করেছিল৷ আরও খেতে ইচ্ছে করছিল৷ পাড়ার লোকেরাও এসে জয়ন্ত ভ্যারাইটিজ থেকে ওই চকোলেট কিনে নিয়ে যেত৷ এই বিক্রি করেই তো দাদা রাতারাতি বড়োলোক হয়ে গেল৷’
লগ্নজিতা বলল, শুধু চকোলেট বিক্রি করে তোমার দাদা বড়োলোক হয়নি অনীতা৷ সেটা তুমিও জানো৷ সত্যিটা গোপন করলে তোমার বিপদ৷ বলো, আর কী জানো?’
অনীতা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘বাক্সের মধ্যে সাদা গুঁড়োর প্যাকেট থাকত৷ ওগুলো নাকি কলেজের ছেলেরা নাকে শোঁকে৷ সেগুলো জয়ন্তদার বাড়ি থেকে মাঝরাত্রে এসে কারা নিয়ে যেত, আমি জানি না৷’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, পারিজাতস্যার এসেছেন আপনার সঙ্গে মিট করতে৷ লগ্নজিতা আড়মোড়া ভেঙে রিল্যাক্স মুডে বলল, ‘বিশ্বাসদাকে বলো, আজকের রাতটাও এই ঘরে বসে রেডিয়ো শুনতে হবে৷ আর অনীতাকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ো৷ লাঞ্চে কী খাবে, ডিনারে কী জেনে নিয়ো৷ যেন ভাবে না, আমরা থানায় যত্ন করি না৷’
অনীতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, লগ্নজিতা বলল, ‘ডোন্ট ওয়রি৷ আছ তো আজকের দিনটা৷ কতটা বলবে, মনস্থির করে নাও৷ আমি কাজ সেরে এসে শুনছি৷’
সুশোভন ফিসফিস করে বলল, ‘ম্যাডাম আপনি এই রক্তপাতহীন টর্চারগুলো শিখলেন কোথা থেকে?’
লগ্নজিতা বলল, ‘কী যে বলো সুশোভন? কোথায় ওই রিলস সুন্দরীকে তিনবেলা কী খাবে, তার অপশন জিজ্ঞাসা করতে বললাম, আর তুমি আমায় টর্চার করতে দেখলে৷ আমি যার আন্ডারে প্রথম কাজ শিখেছি, তার একটাই ওষুধ ছিল কথা বের করার৷ বলতেন, এই কে আছিস, একে আজ থেকে লিকুইড খাবার দিবি৷ এ হাতে মেখে খেতে পারবে না কিন্তু৷ কারণ আজকেই এর দু-হাতের নখগুলো উপড়ে নেওয়া হবে৷ তাই বলছি, লিকুইড খাবার দিবি, যেন মাখতে না হয়৷ আমি আবার কারো কষ্ট সহ্য করতে পারি না৷ ব্যাস, গড়গড় করে অপরাধী সব তথ্য দিয়ে দিত৷ ওই মুখার্জিদা বলতেন, খেয়াল রাখবে লগ্নজিতা, আসামি যেন ভয়কে জয় না করে ফেলে৷ যতক্ষণ ভয় পাবে, ততক্ষণ তোমার জয়৷ একবার যদি ভয়কে এরা জয় করে ফেলে তখন এরা হয়ে যায় আত্মঘাতী আসামি৷ কেউ আর এদের নাগাল পায় না৷ তাই ভয়টা জিইয়ে রাখতে হবে, সুশোভন৷ এটাই একমাত্র কৌশল ওর গায়ে হাত না দিয়ে তথ্য বের করার৷ এনিওয়ে, মিস্টার বালকে কোথায় বসিয়েছ?’
সুশোভন বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার রুমে বসিয়েছি৷ কিন্তু ওঁকে প্লিজ পারিজাত বলুন৷ শুধু সারনেম বললে উনি একটু বিরক্ত হন৷’
লগ্নজিতা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘এটা কি আমার দোষ নাকি ওঁর পূর্বপুরুষের দোষ?’
নিজের রুমে ঢুকে দেখল, পারিজাত একটা ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছে৷ অলরেডি সুশোভন কফির ব্যবস্থা করেছে৷ লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারছে, সুশোভন পারিজাতের ফ্যান৷ লগ্নজিতা ঢুকতেই পারিজাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আমায় মিস্টার সান্যাল পাঠালেন৷ সুমনের কেসটার ইনভেস্টিগেশন করছি আমি৷ তাই ভাবলাম, যদি একসঙ্গে কাজটা করি এই চক্রটাকে আমরা ধরতে পারবে৷
লগ্নজিতা বলল, ‘মিস্টার বাল সুমনের চার্জশিট কি রেডি হয়ে গেছে?’
পারিজাত কটমট করে সুশোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আমার নাম পারিজাত৷ আপনি আমায় পারিজাত বলেই ডাকুন৷’
লগ্নজিতা হেসে বলল, এ কী সুশোভন, ওঁর এমন একটা সুন্দর নাম থাকতে তুমি বার বার সারনেম বলে পরিচয় করাচ্ছিলে কেন? অহেতুক একটা স্ল্যাং বলতে হচ্ছে৷ অবশ্য আমরা বাঙালিরা আজকাল এগুলোকে কথার মাত্রা ভাবি, স্ল্যাং নয়৷’ সুশোভন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে গেল৷ ওর মুখের দিকে তাকালে হেসে ফেলবে বলেই লগ্নজিতা সেদিকে না তাকিয়েই বলল, ‘এনিওয়ে পারিজাত, এবারে বলুন, এই আড়াই দিনে আপনার অবজার্ভেশনের ফল কী? এটা যে একটা চক্রের কাজ, সুমনের নয়, এটা বুঝলেন কী করে?
পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, যেখানে যেখানে গাঁজা বা কোকেন বিক্রি হয়, সর্বত্র খোঁজ নিয়েছি আমার লোককে দিয়ে, কোথাও সুমনকে কেউ চেনে না৷ সুমনের বাচ্চাটা ওর স্কুলের পাশের জয়ন্ত ভ্যারাইটিজ থেকে এই জিনিস কিনেছে৷ দোকানদার নাকি ওকে বলেছিল, দশটা বিক্রি করতে পারলে একশো টাকা দেবে৷ ল্যাবে টেস্ট করে দেখা গেছে লজেন্স শেপের বানানো৷ হাতে চাপ দিলেই ডাস্ট মতো হয়ে যাচ্ছে৷ এটা ড্রাগ কিন্তু খুব বেশি পরিমাণে নয়৷ মানে দুটো-তিনটে খেলে কিছু হবে না৷ কিন্তু ম্যাডাম, এই মাদকের প্রতি ক্রমশ মানুষ আকৃষ্ট হবে৷ তখন এরা বেশি পরিমাণে খুঁজবে, আর তখন এই চক্রটা এদের সাপ্লাই দেবে৷ আপাতত বাচ্চাদের ছোটো ছোটো এজেন্ট বানিয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বিজনেসটা পাকাপোক্ত করে তুলছে৷ আমি এসব জানতে পেরে জয়ন্ত প্রামাণিকের দোকানে রেইড করতেও যাই৷ কিন্তু লোকটা অলরেডি খুন হয়ে গেছে, শুনলাম৷ তখনই জানলাম, আপনি নিজে এ কেসটা দেখছেন৷
লগ্নজিতা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘পারিজাত, আপনি যেটুকু বললেন, এটা তো আমার জানা৷ নতুন কিছু তথ্য দিন, যাতে এই মিশনে আমি আপনাকে নিতে উৎসাহিত বোধ করি৷ সুশোভন তো আপনার প্রশংসা করার সময় বলছিল, আপনি নাকি তুখোড় এসব লাইনে৷ মানে কলকাতার কোন অলিগলিতে কে কোকেন বিক্রি করে আর কে হেরোইন, সেটা আপনার নখদর্পণে৷ আর আপনার জিম করা বডি৷ দ্বিতীয়টা মিলে গেল৷ কিন্তু প্রথমটা তো…
পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, জানি তো৷ চলুন আমার সঙ্গে৷ তিন জায়গায় আজ রেইড করিয়ে দিচ্ছি৷ ক্যানিং, ধর্মতলা আর ট্যাংরা৷ এসব জায়গায় জিনিসের মধ্যে দিয়ে পাচার হয়, ম্যাডাম৷ খালি চোখে বুঝতে পারবেন না৷
লগ্নজিতা বলল, ‘আপনি কি জ্যোতিষচর্চা করেন? বা জ্যোতিষ-বিশ্বাসী?’ পারিজাত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, কেন ম্যাডাম?
লগ্নজিতা বলল, না, আমি ভাবছিলাম, গ্রহ-নক্ষত্রের মিলন ঘটলে তবেই হয়তো রেইড করতে বেরোতে পারবেন৷ যা-ই হোক, জয়ন্ত প্রামাণিকের বউয়ের অ্যাড্রেসটা আমার লাগবে, পারিজাত৷ আপনি তো যাদবপুরের ছেলে৷ ওখানেই মহিলার একটা ফ্ল্যাট আছে৷ এখনও অবধি মহিলার একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবিও জোগাড় করতে পারিনি৷
পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, সুমনকে বেল দিয়ে দেব৷ আপনি কী বেল করাতে চান?
সুশোভন বলল, ‘নিশ্চয়ই৷ আমি আজকে তাহলে যাচ্ছি, পারিজাতদা৷’
লগ্নজিতা কয়েকটা নম্বর পারিজাতের হাতে দিয়ে বলল, ‘এগুলো একটু ট্রেস করুন৷ আজ থেকে এ মিশন আমাদের৷’
পারিজাত হেসে বলল, ‘মিস্টার সান্যাল আপনার খুব প্রশংসা করেন৷ বলেন আপনার কাজের পদ্ধতিটা অন্যদের থেকে আলাদা৷ আপনি নিজের পজিশনের তোয়াক্কা না করে গ্রাউন্ডে নেমে এসে কাজ করেন৷ দেখি একসঙ্গে কাজ করে, আলাদা ফ্লেভার নিশ্চয়ই পাব৷’
লগ্নজিতা হ্যান্ডশেক করে বলল, আমায় একটু বেরোতে হবে পারিজাত৷ আমি চলি৷
পারিজাত বলল, ‘ম্যাডাম, কালকে আমি আসছি৷ আশা করি, তথ্যগুলো আপনাকে দিতে পারব৷ ’
পারিজাত বেরিয়ে যেতেই সুশোভন বলল, ম্যাডাম, আপনি তো সাংঘাতিক৷ আমাকে এভাবে পারিজাতদার সামনে বাউন্সার না মারলেই চলছিল না?
লগ্নজিতা হেসে বলল, ‘শুধু জিম করলে হবে? কাজেও তো লাগতে হবে৷ ইগো হার্ট করে দিয়েছি, এবারে দেখো, কাজ হয়ে যাবে৷ চলো, সুমনের পাড়ায় যাব৷ ‘বেরোনোর আগেই একটা ফোন এল লগ্নজিতার ফোনে৷ ফোনটা রিসিভ করেই লগ্নজিতা বলল, ‘সুশোভন চলো, জলধরবাবুর হবু বউমার বাড়িতে একবার ঘুরে আসি৷’