Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাত পাকে বাঁধা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প210 Mins Read0
    ⤷

    ১. মফস্বল শহরের এক পাশ

    সাত পাকে বাঁধা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    প্রথম প্রকাশ, ফাল্গুন ১৩৬৬

    ০১.

    মফস্বল শহরের এক পাশ দিয়ে গঙ্গার ধার-ঘেঁষা রাস্তার এক মাথা এসে থেমেছে মেয়ে-ইস্কুলের সামনে। উঁচু বাঁধানো রাস্তা। নিচে গঙ্গা। অসতর্ক মুহূর্তে গাড়ি ঘোড়া রাস্তা ছেড়ে যাতে নিচের দিকে না গড়ায় সেইজন্য সে-দিকটায় হাঁটু-উঁচু দেড়-হাত চওড়া বাঁধানো কার্নিস। একটু দূরে দূরে এক-একটা অতিবৃদ্ধ বট-অশ্বত্থ ডালপালা ছড়িয়ে মাঝে মাঝে গঙ্গাকে আড়াল করেছে। অন্য দিকটায় বাড়িঘর, দু-চারটে দোকানপাট, চুন-সুরকির আড়ত, আড্ডিদের মস্ত আমবাগান, কোম্পানি আমলের মুসলমান গোরখানা, পাড়ার ক্লাব-ঘর, শর্টহ্যাণ্ড টাইপ শেখার ছোট্ট প্রতিষ্ঠান, কেশ-বাহার আর বাবু-আসুন সেলুন–ইত্যাদি।

    সকাল নটা না বাজতে রাস্তাটার ভোল বদলায়। ইস্কুল-মুখী মেয়েদের পায়ের ছোঁয়া পেয়ে এতক্ষণের ঝিমুনিভাব কাটিয়ে যেন সজাগ হয়ে ওঠে। সাদা লাল নীল হলদে বেগুনী ফ্রক আর শাড়ির শোভাযাত্রা শুরু হয়। কিশোরী মেয়েদের কলমুখরতায় লাল গঙ্গা আর লালচে অশ্বত্থ-বটের শান্ত উদাসীনতায় বেশ একটা ছেদ পড়ে কিছুক্ষণের জন্য।

    দোতলার বারান্দায় অথবা ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে কোন কোন বাড়ির বউয়েরা খানিক দাঁড়িয়ে অলস চোখে এই প্রাণ-তারুণ্য দেখে। দত্ত স্টেশনারির প্রৌঢ় মালিক চকোলেট লজেঞ্জুস বিস্কুট ডালমুট ভরা কাচের বয়ামগুলির ওধারে এসে দাঁড়ায় চুপচাপ। বয়ামগুলি এবারে খানিকটা করে খালি হওয়ার আশা। বুড়ো মুদি মাখন শিকদার চাল ডাল তেল মুন মসলাপাতি ওজনের ফাঁকে অনেকবার অন্যমনস্ক হয়ে সামনের হাফ-জানালার ভিতর দিয়ে মেয়েদের যাওয়া দেখে। তার নাতনী আছে একটি। ছেলে নেই। নাতনী বড় হচ্ছে। আর একটু বড় হলে এই মেয়েদের মত সাজিয়ে-গুজিয়ে ইস্কুলে পাঠানো সম্ভব হবে কিনা তাই ভাবে বোধ হয়।

    চুন-সুড়কির আড়তের কাছে এসে রাস্তা-ঘেঁষা সুরকির স্তূপের মধ্যে জুতোসুদ্ধ পা ঢুকিয়ে দেয় এক-একটা ফ্ৰকপরা মেয়ে। ইস্কুলে পৌঁছে পা ধোয়ার একটা কর্তব্য পালন করতে পারবে। তাদের দেখাদেখি আবার আরো ছোট এক-আধজন হয়তো পা ঢুকিয়ে দেয় চুনের ঢিপির মধ্যেই। অন্যেরা শাসন করে তক্ষুনি, পা খেয়ে যাবে মরবি–গঙ্গার জলে ধুয়ে আয় এক্ষুনি।

    টাইপ-রাইটিং স্কুলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মুখ দিয়ে টকটক টকটক শব্দ বার করবেই কোন না কোন একদল ছোট মেয়ে। আরো-ছোটরা অনুকরণ করে তাদের। ক্লাব-ঘর পেরুনোর সময় উঁচু ক্লাসের মেয়েরা চেষ্টা করে গম্ভীর হয় একটু। নতুবা দাড়ি-গোঁপের আভাস নির্মমভাবে নির্মূল করে, মাথার চুল পাট করে আঁচড়ে, ফর্সা ধুতি আর ফর্সা স্যাণ্ডো-গেঞ্জি পরে এই সময়টায় নিস্পৃহ গাম্ভীর্যে ক্লাব-ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়ায় দু-পাঁচজন নতুন বয়সের ছেলে। কেউ কলেজের ফার্স্ট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, কেউ বা সেটুকুও ছেড়ে সম্প্রতি শুধুই শরীরচর্চা করছে। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা মুখ গম্ভীর করে এদের প্রতীক্ষার মর্যাদা দেয়। কিন্তু একটু এগিয়ে এরাই আবার মুখে কাপড় গুঁজে হাসে সামনের কেশ-বাহার বা বাবু-আসুন সেলুনের দোর দিয়ে কাউকে ঢুকতে-বেরুতে দেখলেই। বিশেষ করে সদ্য চুল হেঁটে কাউকে বেরুতে দেখা গেলে কম করে বিশ-তিরিশ জোড়া চপল চোখ সেই মাথাটা চড়াও করবেই।

    দলে দলে মেয়েরা যায় বই বুকে করে, বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে অথবা বই ভরা ছোট ছোট রঙ-করা টিনের বাক্স দোলাতে দোলাতে। রাস্তা জুড়ে চলে তারা। এরই মধ্যে সাইকেল-রিকশর ভেঁপু কানে এলে দু-পাশে সরে আসে। তার পর ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কে যায়।

    মাস-ভাড়া সাইকেল-রিকশয় ঠাসাঠাসি হয়ে চলেছে মীরাদি আর প্রভাদি। মীরা সান্যাল, প্রভা নন্দী। ওই দুজনের পক্ষে ওটুকু বসার জায়গা যথেষ্ট নয়। বড় মেয়েরা টিপ্পনী কাটে আর হাসে! ছোট মেয়েরা তাদের হাসির কারণ বুঝতে চেষ্টা করে। একটু বাদে আবার শোনা যায় সাইকেল-রিকশর ভেঁপু।

    কে আসে?

    প্রতিভাদি আর শোভাদি। প্রতিভা গাঙ্গুলী, শোভা ধর। তাদের দুজনের মাঝখানে আবার একটা ছোট মেয়েকে অন্ততঃ বেশ বসিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে। সাইকেল-রিকশ অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে দু-পাশ থেকে রাস্তার মাঝখানে জড়ো হয়ে চলতে চলতে বড় মেয়েরা এক-একদিন সেই পুরনো গবেষণায় মেতে ওঠে –উল্টে পাল্টে ঠিক করলেই তো পারে সাইকেল-রিকশ–মীরাদির সঙ্গে প্রতিভাদি, আর প্রভাদির সঙ্গে শোভাদি। নয়তো, মীরাদি আর শোভাদি আর প্রভাদি আর প্রতিভাদি। চিরাচরিত সিদ্ধান্তেই এসে থামতে হয় আবার। অর্থাৎ যার সঙ্গে যার ভাব।

    আবার কে আসে?

    ও বাবা। মালতীদি আর স্মৃতিদি! মালতী রায়, স্মৃতি কর! হেডমিসট্রেস আর সহকারী হেডমিসট্রেস। সর সর!

    রাস্তার দু-পাশ ঘেঁষে চলে মেয়েরা। একটানা ভেঁপু বাজিয়ে সাইকেল রিকশ তরতরিয়ে চলে যায়। সাইকেল-রিকশর চালকও আরোহিণীদ্বয়ের মর্যাদা জানে যেন।

    এদিক থেকেই আসেন মেয়ে-স্কুলের বেশির ভাগ টিচার। শেয়ারের মাস ভাড়া সাইকেল-রিকশ, সকালে নিয়ে আসে বিকেলে পৌঁছে দেয়।

    শুধু একজন ছাড়া। অর্চনা বসু।

    হেঁটে আসে, হেঁটেই ফেরে।

    পৌনে দশটা নাগাদ যে মেয়েরা ইস্কুলের কাছাকাছি এসেছে, নিজেদের অগোচরে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাবে তারা। দেখতে পেলে অস্বস্তি, না পেলে উসখুসুনি। ঠিক সময় ধরে এলে এক জায়গায় না এক জায়গায় হবেই দেখা।

    হেঁটে আসে–তবু সামনের মেয়েরা ঘাড় না ফিরিয়েই বুঝতে পারে অর্চনাদি আসছে। কারণ, যেখান দিয়ে আসে তার আশপাশের প্রাণতারুণ্য হঠাৎ যেন থেমে যায় একটু।

    কান সচকিত করা ভেঁপু নেই সাইকেল-রিকশর, তবু সরবার পালা মেয়েদের। পথের মাঝখান থেকে ধারে সরে আসা নয়, ধারের থেকে মাঝখানে বা ও-ধারে সরে যাওয়া। যে আসছে গঙ্গার দিকের কার্নিস দেওয়া রাস্তার ধারটা যেন তার দখলে।

    ফ্যাকাসে সাদা গায়ের রঙ। ধপধপে সাদা পোশাক। সাদা ফ্রেমের চশমা। সাদা ঘড়ির ব্যাণ্ড। পায়ে সাদা জুতো। সব মিলিয়ে এক ধরনের সাদাটে ব্যবধান। মেয়েদের আভরণে যে-সাদা রিক্ত দেখায়, তেমন নয়। যে সাদা চোখ ধাঁধায়, প্রায় তেমনি।

    বাড়ির বারান্দায় অথবা ঘরের জানালায় বউদের অলস চাউনিতে তখন ঔৎসুক্যের আমেজ লাগে একটু। কিন্তু এ সময়টায় দেওর-ভাসুরদেরও অনেক সময় বারান্দায় বা জানালার দিকে আসতে দেখা যায় বলে তাদের সতর্ক থাকতে হয়। মুদি-দোকানের বুড়ো মাখন শিকদার দোকান ছেড়ে এক-একদিন দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। রিকশয় চেপে যে-টিচাররা ইস্কুলে যান–তাঁরা কখন যান চোখে পড়ে না। শুধু এই একজনের সঙ্গে আগামী দিনে তার পড়ুয়া নাতনীর একটা সহৃদয় সম্পর্ক কল্পনা করে মাখন শিকদার। কল্পনা করে, আর ভয়ে ভয়ে দেখে।

    দত্ত স্টেশনারির প্রৌঢ় দত্ত ঘাবড়েছিল সেই দু-বছর আগে। সে-ও এই শ্বেতবসনা টিচারটিকে দেখে যত না, তার থেকে বেশি তাঁর সন্নিধানে মেয়েদের চকিত ভাব-ভঙ্গী দেখে। এ আবার কোত্থেকে জ্বালাতে এলো কে–তাকে দেখলে মেয়েগুলো দোকানে ঢোকা দূরে থাক, দোকানের পাশ ঘেঁষেও হাঁটে না যে! অনবধানে দোকানে ঢুকে পড়ার পরে কোন মেয়ের সঙ্গে যদি চোখাচোখি হয়েছে তো সেই মেয়ের মুখ যেন চোরের মুখ। কিন্তু ক-টা দিন না যেতেই মনে মনে খুশীতে আটখানা দত্ত, স্টেশনারির দত্ত। এক এক দঙ্গল মেয়ে নিয়ে ফেরার পথে নিজেই দোকানে ঢুকেছে নতুন শিক্ষয়িত্রী। মেয়েদের চকোলেট লজেন্স ডালমুট কিনে দিয়েছে। দত্ত ঠোঙা ভরেছে আর ভেবেছে, টিচার ঠিক এমনিটিই হওয়া উচিত। তা না, নিজেরা নাক উঁচু করে যাবেন সাইকেল রিকশয়, আর মেয়েগুলো হেঁটে মরুক! লজ্জাও করে না!

    কিন্তু দু-বছর বাদে এখন আবার ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে দত্ত। বিরক্ত হয় না। শুধু অবাক হয়। কি হল হঠাৎ? দোকানটাকে যেন আর চেনেও না। মেয়েগুলোকেও না। সকালে ওই গঙ্গার দিকের কার্নিস ঘেঁষে ইস্কুলে যায় আর বিকেলে ওই দিক ঘেঁষেই ফেরে। মেয়েগুলোর হাবভাবই বা এমন বদলে গেল কেন? ভাবে, ফাঁকমত জিজ্ঞাসা করবে কোন মেয়েকে।

    সে আসছে টের পেলে চুন-সুরকির ঢিপিতে পা গলাতে আসে না একটি মেয়েও। টাইপ-স্কুলের সামনে মুখের টকটক শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরা ছেলেরা সুটসাট ঢুকে পড়ে ক্লাবরের মধ্যে।

    দু-বছর হল অর্চনা বসু এসেছে এই মেয়ে-ইস্কুলে।

    তার আসার গোড়ায় কটা দিন যেমন দেখা গিয়েছিল, এখন আবার ঠিক সেই রকমটিই দেখে আসছে মেয়েরা। কোনদিকে না চেয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে সোজা হেঁটে আসে। না, ঠিক কোনদিকে না চেয়েও নয়। মাঝে মাঝে গঙ্গার পাড়ের দিকে চোখ পড়ে। জলের ধারে ছোট কোন ছেলেমেয়ে দেখলে থমকে দাঁড়ায়। ইস্কুলের মেয়ে কিনা দেখে শক্ষ্য করে। চুন-সুরকিতে পা ডুবিয়ে অনেক মেয়ে ঘটা করে পা ধুতে যেত। অনেক চঞ্চল মেয়ে আবার আসার পথে খেলার ছলে রাস্তার ধারের সেই হাঁটু-উঁচু কার্নিস থেকে দৌড়ে গঙ্গার পাড়ে নেমে যেত। জলের ধার ঘেঁষে ছুটোছুটি করতে করতে ইস্কুলের পথে এগোত। বেশি দুরন্ত দুই একটা মেয়ে অনেক সময় জুতো আর বই হাতে করে জলে পা ভিজিয়ে চলতে গিয়ে আছাড় খেয়ে ভিজে ফ্রক আর ভিজে বই-জুতো নিয়ে ইস্কুলে এসে হাজির হত।

    এখন সে-সব বন্ধ হয়েছে।

    হেডমিসট্রেস বা সহকারী হেডমিসট্রেস বা অন্য কোন শিক্ষয়ত্ৰীর তাড়নায় নয়। অর্চনাদির ভয়ে। যাকে একবার নিষেধ করা হয়েছে, তাকে দ্বিতীয়বার নিষেধ করতে হয় না আর। ছোট বড় সব মেয়েই জানে, অর্চনাদির বিষম জলের ভয়। শুধু তার চোখে পড়ার ভয়েই এখন আর জলের দিকে পা বাড়ায় না কেউ।

    চোখে পড়লে কি হবে?

    অর্চনাদি রাগ করবে না বা কটু কথাও বলবেন না কিছু। শুধু বলবে, জলের ধারে গেছলে কেন? খেলার তো এত জায়গা আছে। তোমাদের দেখাদেখি আরো ছোটরাও যাবে। আর যেও না।

    এটুকুর মুখোমুখি হতেই ঘেমে ওঠে মেয়েরা। অথচ অন্য টিচারদের গঞ্জনাও গায়ে মাখে না বড়। অৰ্চনাদির বেলায় কেন এমন হয় বুঝে ওঠে না।

    মেয়েদের চোখে মহিলাটির এই জল-ভীতির পিছনে অবশ্য ঘটনা আছে একটা।

    এখানে আসার পর অর্চনা বসুর প্রথম হৃদ্যত এই ইস্কুলের মালী ভগবান তেওয়ারীর বউ সাবিত্রীর সঙ্গে। ইস্কুল-চত্বরের এক প্রান্তে জোড়া আমগাছের পিছনের আটচালাতে বউ আর দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে ভগবান তেওয়ারী। থাকে সবাই জানে। কিন্তু লক্ষ্য করে না কেউ। লক্ষ্য করার কারণ ঘটেনি কখনো।

    ঘটল অর্চনা আসার পর।

    টিফিনের সময়টুকু সহ-শিক্ষয়িত্রীদের জটলা এড়িয়ে নিরিবিলিতে কাটানোর জন্যে অর্চনা এই জোড়া আমগাছের ছায়াটুকু বেছে নিয়েছিল। বই হাতে সেখানে এসে বসত। ইস্কুল-বাড়ি থেকে অনেকটাই দূর। তাই কারো চোখেই এটা স্বাভাবিক লাগেনি খুব। মেয়েরা প্রথম প্রথম সসম্ভ্রমে দেখত দূর থেকে। টিচাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেন আর মুখ টিপে হাসতেন।

    অর্চনা বই খুলে বসত বটে, কিন্তু পড়া হত না। আমগাছের পিছনের আটচালায় দুটো ছেলেমেয়ের দস্যিপনার আভাস পেত। মাঝে মাঝে ছুটোছুটি করতে দেখত তাদের। ছেলেটার বছর সাতেক হবে বয়স, মেয়েটা বছর তিনেকের। দুটোই সমান দুরস্ত। কিন্তু দুরন্তপনা ভুলে এক-একদিন বেশ কাছে দাঁড়িয়েই হাঁ করে তারা ওকেই চেয়ে চেয়ে দেখত। অর্চনা বই থেকে মুখ তুলতেই আবার ছুটে পালাত। আটচালার ভিতর থেকে ওদের মায়ের মুখখানাও মাঝে মাঝে উঁকি-ঝুঁকি দিতে দেখা যেত। ইস্কুলের অত বড় বাড়ি ছেড়ে এই গাছতলায় বসে বই-পড়াটা দুর্বোধ্য লাগত বোধ হয়।

    একদিন ওই ছোট মেয়েটার আচমকা আর্ত চিৎকারে বই ফেলে অর্চনাকে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল। ছাপরা ঘরের ভিতর থেকেই আসছে শব্দটা। মেয়েটা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এগিয়ে এসে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে যা দেখল, চক্ষুস্থির। গোবর লেপা মাটির মেঝেতে মেয়েটাকে চিত করে ফেলে তার বুকের ওপর চেপে বসে আছে ছেলেটা। মেয়েটা যত চেঁচায় ছেলেটার তত ফুর্তি।

    ঘরের ভিতরে ঢুকে এক হ্যাঁচকায় ছেলেটাকে টেনে তুলল অর্চনা। মেয়েটার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ততক্ষণে ওদের মা-ও এসে ঘরে ঢুকেছে। আধভেজা কাপড়ে অনুমান, কুয়োতলায় ছিল। অর্চনাকে বলতে হল না কিছু, নিজেই দেখেছে ছেলের কাণ্ড। ছেলেটাকে একটু কড়া সুরেই ধমক দিল অর্চনা, ওর বুকের ওপর চেপেছিল কেন, মরে যেত যদি?

    মরে যাওয়া-টাওয়া বোঝে না, কিন্তু বোনের বুকে চেপে বসার এই ফলটা ভয়ানক অপ্রত্যাশিত। হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু। আর একরত্তি মেয়েটাও ব্যথা ভুলে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক-নেত্রে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। অদূরে আধ-হাত ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে ওদের মা।

    অর্চনার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে গাছতলায় বই নিয়ে বসল আবার। কিন্তু বইয়ে চোখ দেবার আগেই ছেলেটার বিকট কান্নায় সচকিত হয়ে উঠল। মায়ের শাসন শুরু হয়েছে বোঝা গেল। কিন্তু এ কি রকম শাসন। মেরে ফেলবে নাকি ছেলেটাকে।

    থাকতে পারল না। আবার উঠতে হল। এগোতে হল। ভগবান তেওয়ারীর বউয়ের মাথার ঘোমটা গেছে। ফর্সা হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। দেড়হাত প্রমাণ একটা সরু ডাল দিয়ে বেশ আয়েস করে ছেলে পিটছে সে। ছেলেটা মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। মায়ের ভ্রূক্ষেপ নেই, ওইটুকু শরীরে জায়গা বেছে বেছে জুতমত ঘা বসাচ্ছে। বোনের বুকে চেপে বসে ছেলে কতটা অন্যায় করেছে সেটা সে নিজেও সঠিক উপলব্ধি করেনি। এমন একটা অন্যায় করেছে যার দরুন গাছতলা থেকে ওই সাদা পোশাকের মাস্টার বিবিকে উঠে আসতে হয়েছে–এটুকুই শুধু বুঝেছে। তাই শাসন তেমনি হওয়া দরকার।

    তীক্ষ কণ্ঠে ধমকে উঠল অর্চনা।–ও কি হচ্ছে! মেরে ফেলবে নাকি ছেলেটাকে?

    চমকে ফিরে তাকালে ভগবান তেওয়ারীর বউ। থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে ছড়ি হাতে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    ওটা ফেলো হাত থেকে।

    ফেলে দিল।

    ধুলোমাটি মাখা শরীরে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। নাকের জলে চোখের জলে একাকার। কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কায় কাঁদতেও পারছে না, হেঁচকি তুলছে শুধু। ছোট মেয়েটা এক কোণে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে কাণ্ডকারখানা দেখছে।

    মায়ের উদ্দেশে এবারে একটু নরম সুরে অর্চনা বলল, এমন করে মারে! বুঝিয়ে বলতে হয়।

    ফিরে আসতে গিয়েও ছেলেটার দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়াল। দুই এক মুহূর্তের সঙ্কোচ কাটিয়ে তার হাত ধরে ডাকল, আয় আমার সঙ্গে।

    গাছতলায় এসে বসল। ওকে বলল, বোস–।

    হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে ছেলেটা বসল। ভড়কেই গেছে একটু। অর্চনা বই হাতে তুলে নিল। পড়ার জন্যে নয়, এমনি। চোখ পড়ল ছেলেটার ধুলোমাখা পিঠের ওপর। দাগড়া দাগড়া দাগ পড়ে গেছে, ফুলে উঠেছে এক-এক জায়গা। অস্ফুট কাতরোক্তি করে উঠল। ওর মায়ের ওপর রাগে লাল হয়ে উঠল প্রথমে। তারপর নিজের ধপধপে সাদা রুমাল বার করে পিঠটা মুছে দিল। রুমালটা ওর হাতে দিয়ে বলল, চোখমুখ মুছে ফেল বেশ করে, দুষ্টুমি করিস কেন?

    ছেলেটা চেয়েই আছে। তার কচি পিঠের মারের দাগগুলোর ফলাফল বুঝলে খুশী হত। ফর্সা রুমালটা ময়লা মুখে লাগাতে সঙ্কোচ। অর্চনা আবার বলল, মুছে ফেল, রুমালটা তোকে দিলুম।

    মুখ মুছে একটা সম্পত্তি হাতে নিয়ে বসে থাকার মতই রুমাল হাতে করে বসে রইল ছেলেটা।

    তোর নাম কি?

    গণেশ।

    তোর বোনের নাম কি?

    লছমী।

    তোর বাবার নাম কি?

    ভগোয়ান।

    তুই পড়িস?

    মাথা নাড়ল। পড়ে না।

    টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ল। অৰ্চনা বই হাতে করে উঠে দাঁড়াল।– আচ্ছা, এবারে ঘরে যা।

    পরদিন সকালে গ্লাস-কেসের ওপারে দাঁড়িয়ে অন্য সব দিনের মতই বিদ্যার্থিনীদের মিছিল দেখছিল দত্ত স্টেশনারির দত্ত। কলরব থামিয়ে মেয়েদের ঘন ঘন পিছন ফিরে তাকানো দেখে বুঝেছিল তিনি আসছেন। রাস্তার ওপাশ থেকে এ-পাশে সরে আসা দেখেও বুঝেছিল, আসছেন তিনি। অর্চনা ইস্কুলে যোগ দিয়েছে তিন সপ্তাহও হয়নি তখনো। কিন্তু তার যাওয়া-আসার স্বাতন্ত্র্যটুকু মফস্বল শহরের এই পথে তিনদিনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিন সপ্তাহ তো অনেক দিন। পসারের দিক থেকে কাল্পনিক বাধা ভেবে দত্তর মনোভাব বিরূপ তখনো।

    কিন্তু দত্ত হকচকিয়ে গিয়েছিল সে-দিন।

    রাস্তার ও-পার দিয়ে দোকানটা ছাড়িয়ে যাবার মুখে অর্চনা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ঘুরে দোকানটাকে দেখেছিল দুই এক বার। দত্ত ভেবেছিল, কোন মেয়ে ঢুকেছে কিনা তাই দেখছে। কিন্তু না। রাস্তা পেরুলো। দোকানে ঢুকলো।

    টফি আর লজেন্স কিনল। ছোট ছোট কলের পুতুল কিনল দুটো। তারপর দোকানের চারদিকে দেখল একবার, আর কি নেওয়া যায়। এক কোণে ঝকঝকে ট্রাই-সাইকেলটার ওপর চোখ পড়ল। দত্তর মনে হল ওটাই চাইবে। কিন্তু কি ভেবে মত পরিবর্তন করল বোধ হয়। একটা রবারের বল নিল শুধু। কাগজের বাক্সয় পুতুল আর বল প্যাক করে দিয়ে হাত কচলাতে লাগল দত্ত।

    আমগাছতলায় বই খুলে বসে অনেকক্ষণ কান পেতে ছিল অর্চনা! কিন্তু পিছনের চালাঘরে জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। মালীর ঘরে কাল ঢুকে পড়েছিল, ঢুকতে হয়েছিল বলে। আজ সঙ্কোচ। মালীর বউটা অবাক হবে…।

    অর্চনা বসুর তাগিদ কোথায় ও জানে না। কেউ জানে না। ওই মালীর ঘরেই আজও না এসে পারবে না। না এসে পারেনি।

    পিছনের গলি-পথ দিয়ে ঠিক সেই সময় ছেলেমেয়ে নিয়ে গঙ্গার ঘাট থেকে চান সেরে ফিরেছে ভগবান তেওয়ারীর বউ সাবিত্রী। সিক্ত ছাপা শাড়ি ভিজে গায়ে লেপটে আছে। টানাটানি সত্ত্বেও মনমত ঘোমটা উঠল না মাথায়। ছেলেটা একটু থতমত খেয়েই এক দৌড়ে ভিতরের উঠোনের দিকে গা-ঢাকা দিল। ভিজে প্যান্ট ছেড়ে ফেলেছিল–সামনেই সেটা আবার টেনে তোলার বিড়ম্বনা ভোগ করতে রাজী নয়।

    ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে ভাব হতে এর পর তিন দিনও লাগেনি। গাছতলায় এসে বসলেই দুটিতে এসে হাজির হয়। কোন কোন দিনে আগেই আসে। গাছতলায় ছুটোছুটি করে আর টিফিনের ঘণ্টার প্রতীক্ষা করে। অর্চনা খালি হাতে এলেও অবিশ্বাসভরে লজেন্সের ঠোঙা বা রুমালে টফির ঠোঙার সন্ধান করে। ভাইবোনের রেষারেষিও কম নয়। ছেলের জন্যে বই-স্লেট আনার ফলে মেয়ের জন্যেও আনতে হয় আর এক দফা। টিফিনের এই এক ঘণ্টার মধ্যে সামনে বসে একটু পড়াশোনাও করতে হয় গণেশচন্দ্রকে।

    সাবিত্রীর লজ্জা কমেছে। দেখলেই আর ঘোমটা টানে না এখন। তবে তার সঙ্গে দেখা বড় হয় না। শালপাতায় করে মাঝে মাঝেই আমের আচার, লেবুর আচার, লঙ্কার আচার পাঠায় আমগাছতলায়। আর অবাক হয়ে এই অদ্ভুত শিক্ষয়িত্রীর কথা ভাবে। আট বছর ধরে সংসার পেতে বসেছে এখানে। এমন তো কখনো দেখেনি।

    আমগাছতলার ব্যাপারটা ইস্কুলের মেয়েরা প্রথম প্রথম দেখেছে, দূর থেকে। তার পর সহ-শিক্ষয়িত্রীরা দেখেছেন। ভগবান মালীর পরিবারের সঙ্গে অর্চনা বসুর হৃদ্যতা বেশ কৌতুকের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের কাছে। তবে, মেয়েদের অর্চনাদির সম্বন্ধে শুধু কৌতূহলই বেড়েছে। অর্চনাদি ছেলেমেয়ে ভালবাসে কত, এ কয় মাসে সেটা তারা নিজেদের দিয়েই বুঝেছে। তার এই ধপধপে সাদা সাজসজ্জা সত্ত্বেও মেয়েদের সঙ্গে এমন সাদাটে ব্যবধান গড়ে ওঠেনি তখনো। বিশেষ করে খুব ছোট মেয়েদের সঙ্গে। ইস্কুলের মধ্যেই খপ করে এক-একটা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েকে কোলে কাঁধে তুলে নেয়। ক্লাসের মধ্যে একটা বাচ্চা মেয়েকে টেনে কোলে বসিয়েই হয়তো ক্লাসের পড়া শুরু করে দেয়। ছোটবড় দু-পাঁচটা মেয়েকে তে রোজই বাড়ি নিয়ে যায়। চকোলেট দেয়, লজেন্স দেয়, বিস্কুট দেয়।

    …কিন্তু তা বলে মালীর ছেলেমেয়ে!

    অর্চনা বসুর রকম-সকম দেখে প্রথম থেকেই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন অন্য টিচাররা। নীরব বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাঁরা। অন্তরঙ্গ হতেও চেষ্টা করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু তাঁদের ভিতরের কৌতূহল বড় হয়ে উঠেছিল বলেই হয়তো বন্ধুত্ব জমেনি। উল্টে বিচ্ছিন্নতাই এসেছে এক ধরনের। নিজেদের মধ্যে অনেক জটলা করেছেন এই নবাগতাকে নিয়ে। চেহারা-পত্র, চালচলন, পুওর ফাণ্ড-এ মোটা চাঁদা দেওয়ার বহর দেখে তো বড়লোকের মেয়ে বলে মনে হয়। বড়লোক না হোক, নামজাদা লোকের মেয়ে যে সেটা এখন সবাই জানে। এম. এ পাস। দেখতে সুশ্রী। শুধু সুশ্রী নয়, বেশ সুন্দর। কিন্তু বয়েস ঠিক বোঝা না গেলেও খুব কম তো হবে না বোধ হয়। বিয়ে হয়নি কেন? আড়ালে কানাকানি করেন তাঁরা, হাসাহাসি করেন। মেয়েদের নিয়ে এসব কী কাণ্ড!

    শেষে এই মালীর ছেলেমেয়ে নিয়ে! বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কি!

    সংস্কৃতর টিচার প্রতিভা গাঙ্গুলীর সঙ্গে বেশি ভাব বিজ্ঞানের টিচার শোভা ধরের। মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর–পড়ান বিজ্ঞান। সাইকেল-রিকশয় ফিরতি পথে সঙ্গোপনে বলেন প্রতিভা গাঙ্গুলিকে।–আসলে এটা একটা রোগ। আমি বইয়ে পড়েছি। মনের রোগ। ওই ছত্রী মালীটাকে লক্ষ্য করে দেখেছ? ছাঁদ-ছিরি আছে–

    বুঝতে সময় লেগেছিল সংস্কৃতর টিচার প্রতিভা গাঙ্গুলির। বুঝে একেবারে হাঁ করে ফেলেছিলেন তার পর। বিস্ময়াতিশয্যে ফিসফিস করে বলেছেন, তা যদি হবে তাহলে কল্যাণীদির ওই ভাইকে আমল দিচ্ছে না কেন? অমন সুন্দর চেহারা, অমন শিক্ষিত ভদ্রলোক, তার ওপর সেক্রেটারির ভাইপো…

    তাহলে আর রোগ বলছি কেন। বান্ধবীর সংশয়ে ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন শোভ ধর–রোগ হলে ওই রকমই হয়। আমি পড়েছি।

    বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া সত্ত্বেও ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি প্রতিভা গাঙ্গুলি। তবে প্রতিবাদ করতেও ভরসা হয়নি আর। মনোবিজ্ঞান-পড়া বান্ধবীকেই রোগে ধরেছে কি না, আড়চোখে চেয়ে চেয়ে সেই খটকাও লেগেছিল সংস্কৃত টিচার প্রতিভা গাঙ্গুলির মনে।

    আরো দেড় বছর কেটেছিল এইভাবে। তার পর সেই অঘটন।

    ইস্কুলের পিছনেই গঙ্গার বাঁধানো ঘাট। বাইরের অনেকেই চান করে সেখানে। বিশেষ করে আশেপাশের খড়ো ঘরের মেয়ে-পুরুষেরা। দুপুরে টিফিনের সময় ইস্কুলের ছোট মেয়েদের খেলার আর বড় মেয়েদের বসার জায়গা ওই ঘাট।

    ঘাটের দু-পাশের উঁচু উঁচু ধাপগুলোর ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা-নামা করে ছোট মেয়েরা। শীতকালে জল অনেকটা নিচে থাকে। কিন্তু বর্ষায় ওই সিঁড়ির অর্ধেকটা তো ডোবেই, উঁচু ধাপগুলোরও দুদিক ছাপিয়ে জল উঠে আসে।

    এই গেল-বর্ষায় এক দুপুরে ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘাটে চান করতে এসেছিল ভগবান তেওয়ারীর বউ সাবিত্রী।

    রোজ দুপুরেই আসে। সেদিনও এসেছিল।

    ছাপা শাড়ির আট হাত ঘোমটা টেনে পাকলে চান করাচ্ছিল লছমীকে। ছেলেটা নতুন সাঁতার শিখেছে, তাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া ভার।

    সেই দুপুরে বর্ষার ভরা গাঙের বিষম স্রোত আট বছরের ছেলেটাকে টেনে নিয়ে গেল।

    তার মায়ের বুক-ফাটা কান্নায় আর চিৎকারে গোটা ইস্কুলটাই ভেঙে পড়ে ছিল এই ঘাটে। কোথা থেকে কত লোক জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক নেই।

    গণেশকে তোলা গিয়েছিল অনেক পরে। অনেক দূরে। নিষ্প্রাণ কচি দেহ আপনি ভেসে উঠেছিল।

    এদিকে ঘাট থেকে নড়ানো যায়নি সাবিত্রীকে। ঘাটের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদছিল।

    তখন অনেকেই লক্ষ্য করেছিল, ওই শোকার্ত মায়ের দিকে চেয়ে দুই গাল বেয়ে নিঃশব্দে ধারা নেমেছে আর একজনেরও।

    সেদিন আর ক্লাস নিতে পারেনি অর্চনা বসু।

    তার পরদিন থেকে টিফিনের সময় তাকে আর সেই আমতলায় গিয়েও বসতে দেখেনি কেউ।

    এর পর গঙ্গার দিকে যতবার চোখ গেছে ততবার যেন শিউরে শিউরে উঠেছে অর্চনা। বর্ষার লাল জলে শিশুদেহগ্রাসী লালসার বিভীষিকা দেখেছে।

    …মেয়েরা দৌড়োদৌড়ি করে, ছুটোছুটি করে ওই ধাপগুলোর ওপর। ফসকে বা টাল সামলাতে না পেরে একবার ও-পাশে পড়লে–

    আতঙ্কে অস্থির হয়ে অর্চনা দৌড়ে গেছে হেডমিসট্রেসের কাছে। টিফিনে মেয়েদের ঘাটে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। বড় মেয়েরা গেলে ছোট মেয়েরাও যাবে –সেটা অত্যন্ত ভয়ের কথা।

    হেডমিসট্রেস অবাক। বলেন, কিন্তু ওই মালীর ছেলেটা তো চান করতে গিয়ে ডুবেছে। মেয়েদের আটকাব কেন?

    ভয়ের কি আছে আর কেন আটকানো দরকার অর্চনা বুঝিয়ে দেয়। তার সেই বোঝানোর আকূতি দেখে মনে হবে, যেন আর একটি ছোট মেয়েকেই বোঝাচ্ছে সে।

    হেডমিসট্রেস চুপচাপ তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন খানিক। পরে বলেন, আচ্ছা, আমি তাদের সাবধান করে দেব।

    কিছু বলার জন্যেই বলা। নইলে কিছুই তিনি করবেন না জানা কথা। উদার মত-পন্থিনী প্রধান শিক্ষয়িত্রী কোন কল্পিত ভয়ে মেয়েদের স্বাধীনতা খর্ব করতে রাজী নন।

    কিন্তু অর্চনা বসুর চোখে এ ভয়টা ভয়ই।

    কাজেই, যা করবার নিজেই করতে বসল। একদিন দুদিনে কাজ হল না, কিন্তু চার পাঁচ দিনের মধ্যে হল। অৰ্চনা বসু তো মাস্টারি করে বাধা দিতে যায়নি কোন মেয়েকে। তার নিষেধের মধ্যে অব্যক্ত অনুনয়টুকুই বাধা হয়ে উঠেছিল বড় মেয়েদের কাছে। অবশ্য একবারেই ঘাটের মায়া ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি তারা। কিন্তু অর্চনাদির চোখে চোখ পড়তে কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেছে। অনুযোগভরা ওই ঠাণ্ডা দু-চোখের অস্বস্তি তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঘাটে আসা ছেড়েছে আর নিচু ক্লাসের ছোট মেয়েদেরও আগলে রেখেছে। ফলে টিফিনের সময় ঘাট খাঁ খাঁ করে এখন।

    মেয়েরা জেনেছে অর্চনাদির জলের ভয় খুব। কিন্তু সহশিক্ষয়িত্রীরা মুখ টিপে হেসেছে। কানে কানে ফিসফিস করেছে মীরাদি আর প্রভাদি, প্রতিভাদি আর শোভাদি। বিজ্ঞানের টিচার আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর তার মত বদলেছেন একটু। রোগ ঠিকই, কিন্তু যে রোগ ভেবেছিলেন সে-রোগ নয়। ভগবান তেওয়ারীর ওই কচি ছেলেটা জলে ডোবায় কয়েকদিনের মধ্যেই মত বদলাবার মত কারণ কিছু ঘটেছিল। অর্চনা বসুর এই বাৎসল্যজনিত আতঙ্কের পিছনে অন্য কিছু আভাস পেয়েছেন সকলেই।

    বিস্ময়কর কিছুর।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরাধার চোখে আগুন – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    Next Article সোনালী রেখা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }