Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশন সমগ্র – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প1195 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০১. ইয়াসিন সাহেব বারান্দায় অজু করতে এসে দেখেন

    ইয়াসিন সাহেব বারান্দায় অজু করতে এসে দেখেন শশা-মাচার নিচে লাল শাড়ি পরা বউ মত কে যেন ঘুরঘুর করছে। শশা-মাচা তো বেড়ানোর জায়গা না। কে ওখানে? শশা তুলছে নাকি? তাই তো, শশাই তো তুলছে। কোঁচড়ভর্তি শশা। সূর্য ডোবার পর ফলবতী গাছের ফল হেঁড়া যায় না—এই সত্যটা কি লাল শাড়ি পরা মেয়েটা জানে না। ইয়াসিন সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। একবার ভাবলেন অজু বন্ধ রেখে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসেন ব্যাপারটা কী? কিন্তু এটা ঠিক না। গুরুতর কোন ঘটনা না ঘটলে নামাজ ছেড়ে যেমন ওঠা যায় না, তেমনি অজু ছেড়েও ওঠা যায় না। লাল শাড়ি পরা মেয়ের শশা তোলা কোন গুরুতর ঘটনা না।

    তিনি অজু শেষ করে তাঁর ঘরে ঢুকলেন। তাঁর ঘরে পালংকের মাথায় ভাঁজ করা জায়নামাজ থাকে, সেই জায়নামাজ নিয়ে মসজিদে যাবেন। যদিও আজ আলসি লাগছে। মসজিদে না গিয়ে ঘরে নামাজ পড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সমস্যা হয়েছে মসজিদটা তিনি নিজে দিয়েছেন। পাকা মসজিদ। মুসুল্লিদের অজুর জন্যে চাপকল, একটা সেনিটারি লেট্রিন সবই করা হয়েছে। আজানের মিনার ছাড়া মসজিদের যাবতীয় কাজ শেষ। এই মাসের আট তারিখ থেকে উলা পাস একজন মাওলানাও রাখা হয়েছে। রোজা আসছে খতমে তারাবি পড়ানোর মানুষ দরকার। মাওলানার থাকা-খাওয়া এবং মাসিক পাঁচশ সত্তুর টাকা বেতনও তিনিই দিচ্ছেন। সেই মানুষ যদি নিজের মসজিদে নামাজ না পড়ে তাহলে অন্যরা কেন নামাজ পড়বে?

    ইয়াসিন সাহেব জায়নামাজ হাতে নিলেন। বিরক্ত গলায় ডাকলেন, শেফার মা কই? এদিকে শুনে যাও।

    আমেনা বেগম স্বামীর গলা শুনে ছুটে এলেন। এ বাড়ির সবাই ইয়াসিন সাহেবকে যমের মত ভয় করে। আমেনা বেগম তার ব্যতিক্ৰম না।

    ইয়াসিন সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন শশা-মাচার নিচে কাকে যেন দেখলাম, লাল শাড়ি পরা। মেয়েটা কে?

    আমেনা বেগম ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, নিজের মেয়েরে চিনেন না? শেফা।

    লাল শাড়ি পরেছে কেন? শখ করে পরেছে। এই শাড়ি তো ঢাকা থেকে আপনিই এনে দিয়েছেন।

    সন্ধ্যাবেলা শশা তুলতেছে। এটা কেমন কথা? সন্ধ্যাকালে নামাজ আদায় করবে তারপর বই নিয়ে বসবে। মেট্রিক পরীক্ষার দুইমাসও বাকি নাই। আমি মসজিদ থেকে এসে যেন দেখি সে বই নিয়ে বসেছে।

    জ্বি আচ্ছা।

    তার মাস্টার কই, রফিক? তাকে তো দেখি না। জুম্মাবার ছাড়া কোনদিন তাকে মসজিদেও দেখলাম না। তাকে বলে দিবে আমার বাড়িতে যারা যারা জায়গির থাকে তাদের প্রত্যেকের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হবে। এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হবে না। তুমি দেখ রফিক ঘরে আছে কিনা। আমি নিজেই আজ তারে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যাব।

    আমেনা বেগম বললেন, রফিক ঘরে নাই।

    গেছে কোথায়?

    ময়মনসিংহ গিয়েছে। সন্ধ্যার ট্রেনে চলে আসবে।

    ময়মনসিংহ গেল কখন?

    আজ সকালে গিয়েছে।

    আমি কিছু জানলাম না কেন? শেফার মা শোন আমার এই বাড়িতে যারা থাকে তাদের সবার সব বিষয় আমাকে জানাবে। কোন কিছু গোপন রাখবে না।

    নামাজের সময় পার হইয়া যাইতেছে। আপনে মসজিদে যান।

    ইয়াসিন সাহেব বিরক্ত মুখে মসজিদের দিকে রওনা হলেন। মসজিদের জন্যে যে মাওলানা রাখা হয়েছে তাকে তার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হওয়ার প্রধান কারণ মাওলানা নামাজের সময় বেছে বেছে সবচে লম্বা সুরাগুলি বের করে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে যায় তারপরেও সুরা শেষ হয় না। দোয়ার সময় হাত যে তোলে সেই হাত আর নামায় না দোয়া কিছুক্ষণ চলে উর্দুতে, কিছুক্ষণ আরবিতে তারপর শুরু হয় বাংলায়। বাংলা দোয়ার একপর্যায়ে আমরা বড়ই গুনাহগার আমরা বড়ই গুনাহগার বলতে বলতে হাউমাউ করে কান্নাকাটিও শুরু হয়।

    ইয়াসিন সাহেবের ধারণা মাওলানা মিথ্যা কথাও বলেন। চাকরি পাওয়ার চার দিনের দিন মাওলানা তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কাদো কাদো গলায় বললেন, আজ শেষরাতে ফজরের নামাজের আজানের ঠিক আগে আপনাকে নিয়ে একটা খোয়াব দেখেছি। খোয়াবে দেখলাম আরব দেশের লেবাস পরা একজনকে সফেদ দাড়ি, একটা শাদা চাদর এক পঁাচ দিয়ে পরা। চোখে সুৰ্মা। আমি উনাকে চিনতাম না। উনি আমাকে বললেন—তুমি অতি ভাগ্যবান। তুমি যার আশ্রয়ে আছ সে নেকবান, তাঁর অন্তরে আছে আসল নুরানি। এই নুরানির কারণে সে নিজ খরচায় মসজিদ দিয়েছে। এখন তোমার দায়িত্ব এই মানুষটার পাশে পাশে থাকা। তার দেখভাল করা। মসজিদের দায়িত্ব পালনের চেয়ে এই মানুষটার দেখভাল তোমার জন্যে অতি জরুরি। এই বলে তিনি আমার ডান হাতের বুড়া আঙুলে আতর লাগায়ে দিলেন। তারপরেই আজানের শৰে ঘুম ভেঙে গেল।

    ইয়াসিন সাহেব শুকনো গলায় বললেন, ও।

    মাওলানা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আল্লাহপাকের কি কুদরতি সেই আতরের গন্ধ এখনো আঙুলে আছে। একটু শুঁকে দেখেন।

    ইয়াসিন সাহেব বললেন, এঁকে লাভ নেই। আমার সর্দি গন্ধ পাই না।

    খোয়াবটা দেখার পরে বড়ই অবাক হয়েছি।

    ইয়াসিন সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন অবাক হওয়ারই কথা। আরব দেশের মানুষকে স্বপ্নে দেখলেন—সে কথা বলতেছে বাংলায়। যাই হোক স্বপ্ন বেশি না দেখা ভাল। স্বপ্ন কম দেখবেন।

    আপনে বোধহয় আমার খোয়াবের ব্যাপারটা বিশ্বাস করলেন না।

    ইয়াসিন সাহেব বললেন—করেছি। বিশ্বাস করব না কেন? আপনি এত বড় মাওলানা, আপনে তো আর মিথ্যা কথা বলবেন না। আজানের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙেছে, এটা শুনে অবাক হয়েছি। কারণ আজান তো দেন আপনি।

    আজানের শব্দটাও খোয়াবে শুনেছি।

    ও।

    যাকে স্বপ্ন দেখেছি তার পরিচয় দিলে আপনে চমকে উঠবেন।

    তাহলে পরিচয় না দেওয়াই ভাল। এই বয়সে ঘনঘন চমকানো ভাল না। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।

    ইয়াসিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। টাকাপয়সা খরচ করে মসজিদের জন্যে ইমাম রাখা হল। সে চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে। তিনি ধর্মকর্মের জন্যে মসজিদ দেন নাই। মসজিদ দিয়েছেন আগামী ইলেকশনের কথা চিন্তা করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই পার্টিতে দেন। দরবার শুরু করেছেন। একজন কেউ নমিনেশন দিলেই হল। না দিলে স্বতন্ত্র পাড়াবেন। তার মত ফালতু যে মানুষ তার বিষয়ে স্বপ্নে কথা বলল সফেদ পোশাকের লোক? স্বপ্নে আবার আরও মাখিয়ে দিল? আতরের গন্ধ স্বপ্ন শেষ হবার পরেও যায় নাই। এখনো বুড়ো আঙুলে লেগে আছে। মিথ্যা কথারও তো সীমা থাকা দরকার। একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করতে হবে। যার পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া হয় তার প্রতি যদি শ্ৰদ্ধা না থাকে তাহলে নামাজ হবার কথা না।

    ইয়াসিন সাহেব মাগরেবের নামাজে দাঁড়া হয়েছেন। তিন রাকাত নামাজ দেখতে দেখতে শেষ হবার কথা। অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে—এই মাওলানা কতক্ষণ লাগাবে কে জানে? ইয়াসিন সাহেবের মন এখন বিক্ষিপ্ত। নামাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন সব কথাবার্তা মনে আসতে শুরু করেছে। যেমনরফিক ময়মনসিংহ গিয়েছে, সে ময়মনসিংহ যাবে জানলে তিনি দুটা ইলিশ মাছ আনার টাকা দিয়ে দিতেন। গ্রাম-গঞ্জের বাজারে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। ময়মনসিংহ ছাড়া গতি নেই। এই বছর ইলিশ মাছ খাওয়াই হয় নাই। নতুন সরিষা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোলের কাছে জগতের কোন খাদ্যই খাদ্য না। বেহেশতের খানা-খাদ্যের মধ্যে পক্ষীর মাংসের কথা উল্লেখ আছে, ইলিশ মাছের ঝোলের কথার উল্লেখ আছে কিনা মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মাওলানা যে রকম মিথ্যাবাদী লোক না থাকলেও হয়ত বলবে আছে। তাকে খুশি করার জন্যে বলবে।

    ইয়াসিন সাহেবের মনে হল নামাজে দাঁড়িয়ে তিনি সোয়াবের পরিবর্তে পাপ করে যাচ্ছেন। যতই সময় যাচ্ছে ততই পাপ বাড়ছে। তিনি আল্লাহপাক বা বেহেশত-দোজখের কথা চিন্তা না করে চিন্তা করছেন অতি তুচ্ছ ইলিশ মাছের কথা। ইয়াসিন সাহেব মাথা থেকে দুষ্ট চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলেন–চিন্তাটা আরো খারাপ দিকে চলে গেল। মাথায় ঘুরতে লাগল যাত্রাপার্টির কথা। গ্রামের মানুষজন যাত্রা দেখলে খুশি হয়। এই শীতে যাত্রার আয়োজন করলে দল বেঁধে সবাই যাত্ৰা দেখতে আসবে। তিনিও সবার সঙ্গে যাত্রা দেখবেন। অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে। মাঝরাতে চায়ের ব্যবস্থা থাকল। সবাই এককাপ করে চা খেল। কত আর খরচ হবে। লাভ হবে তিন ডাবল। হিন্দু-ভোট হয়ত কিছু পাওয়া যাবে। গতবার ইলেকশনে হেরেছেন হিন্দু-ভোট না পাওয়ার কারণে। মসজিদ দেবার কারণে হিন্দু-ভোট আরো কমে যাবে কিনা কে জানে।

     

    রাতে খেতে বসে ইয়াসিন সাহেব চমৎকৃত হলেন। ইলিশ মাছের ভাজা এবং ঝোল। সাধারণ কোন ঝোল না, সরিষার ঝোল। বাটি থেকেই সরিষার ঝাঁঝ নাকে এসে লাগছে। ইয়াসিন সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন—শেফার মা, ইলিশ মাছ, ব্যাপার কি?

    রফিক এনেছে।

    নিজ থেকে এনেছে নাকি তুমি আনতে বলেছিলে?

    নিজ থেকে এনেছে। একজোড়া মাছ নিয়ে এসেছে।

    মাছের দাম দিয়া দিবা।

    জ্বি আচ্ছা।

    তারে ডাক দাও। কথা বলব। আচ্ছা থাক, এখন না। মাছটা ভাল হয়েছে। ঝাল কিঞ্চিৎ বেশি হয়েছে তার জন্যে স্বাদের কোন কমতি হয় নাই।

    আরেক টুকরা মাছ নেন।

    ইয়াসিন সাহেব আরেকটা মাছ নিলেন। আলাদা করে পিরিচে ইলিশ মাছের দুটা মাথা রাখা হয়েছে। ইয়াসিন সাহেবের হিসাবে এই জগতে যত সুখাদ্য আছে ইলিশ মাছের মাথা তার মধ্যে একটি। বেশিরভাগ মানুষ এই তথ্য জানে না।

    শেফা খেয়েছে?

    না।

    একটা মাথা শেফার জন্যে রেখে দাও।

    আপনে খান। শেফা মাছের মাথা খেতে পারে না।

    খাওয়া শিখতে হবে না। সব কিছু শিখতে হয়। খাওয়া শিখতে হয়। না খেলে খাওয়া শিখবে কিভাবে?

    আমেনা বেগম বললেন, মেয়েমানুষের অত খাওয়া শিখার দরকার নাই। মেয়েমানুষ যত কম খাওয়া শিখে তত ভাল। কার না কার ঘরে যেতে হয়।

    ইয়াসিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন-বা-মায়ের সঙ্গে যতদিন আছে ততদিন খাওয়া-খাদ্য যেন ঠিক মত খায় এটা দেখা বাবা-মায়ের কর্তব্য। মেয়েকে ডাক, ইলিশ মাছের মাথাটা আমার সামনে খেতে বল।

    সে খাবে না। খাবে না আবার কি? অবশ্যই খাবে। ডাক দাও দেখি।

    আমেনা বেগম মেয়েকে রক্ষা করার জন্যে বললেন-পড়তে বসেছে। পড়া থেকে উঠানো ঠিক না। এমিতেই পড়তে চায় না। আর আপনে আমার একটা কথা রাখেন, এই মাথাটাও খান। আমি শেফারে ইলিশ মাছের মাথা এনে খাওয়াব।

    ইয়াসিন সাহেব দ্বিতীয় মাথাটাও পাতে উঠিয়ে নিলেন।

    খাওয়াদাওয়ার পর পান খাওয়া এবং পান খেতে খেতে হুক্কায় টান দেয়া ইয়াসিন সাহেবের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এই সময় তার পায়ের কাছে ফজলু বসে থাকে। সে পায়ে ইলিবিলি কেটে দেয়। ইয়াসিন সাহেবের তখন তন্দ্ৰা-তন্দ্রা ভাব হয়। তিনি এই ঘোর ঘোর অবস্থায় তাঁর কাছে দেন-দরবার নিয়ে আসা লোকজনের কথাবার্তা শোনেন। এর একটা ভাল দিক হচ্ছে কারো কোন কথাই মন দিয়ে শুনতে হয় না। মন দিয়ে মানুষের কথা শুনার মত কষ্টকর কিছু এই দুনিয়াতে নেই।

    আজ রাতে তিনি শুনছেন রফিকের কথা। তবে রফিক নিজ থেকে কথা বলতে আসে নি। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন। দুদিন পর পর সে হুট করে ময়মনসিংহ যায়, ঢাকা যায়, এটা ঠিক না। শেফার মেট্রিক পরীক্ষার বেশি বাকি নাই। এই সময় তার সার্বক্ষণিক থাকা দরকার। মেয়ে যদি মনোযোগী ছাত্রী হত তাহলে কোন কথা ছিল না। মেয়ের পড়াশোনার প্রতি কোন মনোযোগই নাই।

    রফিক শুনলাম ময়মনসিংহ গিয়েছিলে ব্যাপার কি?

    চশমার দোকানে গিয়েছিলাম।

    চোখ খারাপ হয়েছে?

    জ্বি না। দুটা লেন্স কিনলাম, আগে একবার গিয়ে অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম, এরা ঢাকা থেকে আনায়ে দিয়েছে।

    জিনিসটা কি বললে?

    লেন্স। চশমার কাচ।

    করবা কি?

    একটা টেলিস্কোপ বানাব। দুরবিন। দূরের জিনিস কাছে দেখার যন্ত্র।

    দূরের জিনিস কি দেখবা?

    তারা দেখা যাবে, চাঁদ দেখা যাবে। খুব কাছে দেখা যাবে।

    কাছে দেখা যাবার প্রয়োজনটা কি?

    রফিক চুপ করে গেল। ইয়াসিন সাহেব ঘুম-ঘুম গলায় বললেন, বাজে কাজে সময় নষ্ট করবা না। আমি লক্ষ করেছি তুমি বাজে কাজে বেশি সময় নষ্ট কর। সময়ের দাম আছে বুঝলে?

    জ্বি চাচা।

    টেলিস্কোপ জিনিসটা কিভাবে বানায়?

    বুঝয়ে বলব?

    যে ভাবেই বল, আমি বুঝব না। তারপরেও বলতে চাইলে বল শুনি।

    দুটা লেন্স দিয়ে টেলিস্কোপ বানাতে হয়। একটা হল অবজেকটিভ। চাঁদের আলো এই লেন্সের উপর পড়বে। তার ইমেজ তৈরি হবে লেন্সের ফোকাল লেংথে। সেই ইমেজটা যে জায়গায় পড়বে সেটা হবে দ্বিতীয় লেন্সটার ফোকাল প্লেন। প্রথম লেন্সটার ফোকাল লেংথ হতে হবে বেশি। দ্বিতীয় লেন্সের ফোকাল লেংথ হতে হবে অনেক কম। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল টেলিস্কোপ। অবজেকটিভের ফোকাল লেংথ কত বেশি তার উপর নির্ভর করবে জিনিসটা কত কাছে দেখা যাবে। আমি যে টেলিস্কোপটা তৈরি করব সেটা দিয়ে ইনশাল্লাহ। শনিগ্ৰহ দেখা যাবে।

    কি দেখা যাবে?

    শনিগ্ৰহ। শনির বলয়।

    শনিগ্ৰহ দেখা ঠিক না। শনি থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভাল। বুঝলে তো?

    জ্বি।

    তোমার যন্ত্রটা তৈরি হবে কখন?

    যন্ত্র প্রায় তৈরি। কাঠের চোঙের মধ্যে দুটা লেন্স শুধু ফিট করা। আর ঘণ্টা থানিক লাগবে। ধরেন আজ রাত দুটা নাগাদ চাঁদ দেখতে পারব।

    আজ পূর্ণিমা না?

    জ্বি পূর্ণিমা। টেলিস্কোপটা তৈরি হলে কি চাচা আপনাকে ডাক দিব?

    আমাকে ডাকাডাকি করার কোন দরকার নাই। আমার সমস্যা আছে। রাতে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম হয় না। ঠিক আছে এখন যাও। আর শোন বাজে কাজে সময় নষ্ট করবা না। চশমার কাচ দুটা যে কিনলা কত দাম পড়ল?

    এগারোশ টাকা নিয়েছে।

    এগারোশ টাকা একেবারে যে পানির মধ্যে পড়েছে এটা বুঝতে পেরেছ? চাঁদ কাছে এনে দেখার কোন দরকার নাই। কাছে আনলেই যে জিনিস ভাল দেখা যায় তা না। আল্লাহপাক যে জিনিসরে যেখানে রেখেছেন সেখানেই তারে ভাল লাগে। আল্লাহপাক যদি ভাবতেন চাঁদকে কাছে আনলে ভাল দেখা যাবে তাহলে তিনি হাতের কাছে চাঁদ এনে দিতেন। হাত দিয়া চাদরে দেখার ব্যবস্থা করে দিতেন। তিনি কি সেটা দিয়েছেন?

    জ্বি না।

    আচ্চা যাও। টাকাপয়সা বাজে খরচ করবা না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। এইটা মনে রাখবা।

    জ্বি আচ্ছা।

    তোমার ছাত্রী পড়াশোনা কেমন করতেছে?

    জ্বি ভাল।

    মোটই ভাল না। পড়াশোনার দিকে তার মন নাই। তার মন সাজনে। গতমাসে ঢাকায় যাব সে আমার হাতে কি কি আনতে হবে তার লিস্ট ধরায়ে দিয়েছে। লিস্টে আছে লিপস্টিক, পাউডার এইসব হাবিজাবি। তোমাকে বাড়িতে কি কারণে রেখেছি সেটা মনে রাখবা। মেয়েমানুষ একবার মেট্রিক ফেল করলে আর পাস করতে পারে না। সে যেন এক চাগে পাস করে এটা দেখতে হবে। শুধু চাঁদ দেখলে হবে না। আচ্ছা এখন যাও।

    ফজলু পায়ে ইলিবিলি কাটছে। বাইরের আবহাওয়া মনোরম। কার্তিক মাসের শুরু। অতি আরামদায়ক বাতাস বইছে। চারদিকে প্রবল জোছনা। ইয়াসিন সাহেব হাতে হুক্কার নল নিয়ে গভীর তন্দ্ৰায় ডুবে গেলেন। মাঝে মাঝে ঘুম কাটলে তিনি দেখতে পান উঠানে রফিক কাঠের টুকরা, হাতুড়ি, করাত নিয়ে কি যেন করছে। সে পাটি পেতে বসেছে। তার পাশে কাঠের চেয়ার। চেয়ারে ছোট্ট বাক্স। ইয়াসিন সাহেব তার মধ্যে ভাবেন করছে কি? তারপরেই মনে হয় রফিক চাঁদ দেখার যন্ত্র বানাচ্ছে। তিনি খানিকটা বিরক্ত হন। বিরক্তি নিয়েই হুক্কার নলে দুতিনটা টান দেন। তারপর আবারো গভীর তন্দ্ৰায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর হাতুড়ির টুকটাক শব্দে তন্দ্ৰা কাটে, তিনি ভাবেন–চাঁদের আলোতে বসে রফিক করছেটা কি? হাতুড়ি, পেরেক, করাতের ঘষাঘষি। হচ্ছেটা কি?

     

    আমেনা বেগম রাতে শেফার সঙ্গে ঘুমুতে যান। মেয়ে বড় হলে তাকে কখনো একা শুতে দিতে নেই। হয় সে ছোট ভাই-বোনের সঙ্গে ঘুমুবে নয়তো দাদি নানির সঙ্গে ঘুমুবে। এটাই সাধারণ নিয়ম। শেফার কোন ভাইবোেন নেই। দাদি মারা গেছেন। নানি এখানে থাকেন না। কাজেই বাধ্য হয়েই আমেনা বেগমকে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে হয়। তিনি জানেন কাজটা ঠিক হচ্ছে না। স্ত্রীর কাছে স্বামী প্রথম, স্বামী দ্বিতীয় এবং স্বামী তৃতীয়…তারপর অন্যরা। সেই স্বামীকে একা ফেলে রেখে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে আসা খুবই অন্যায়। মানুষটার রাতের বেলা কতকিছুর দরকার হতে পারে হয়ত একগ্লাস পানি খাবে, ঘুম আসছে না, মাথার যন্ত্রণা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া দরকার, মশারির ভেতর মশা ঢুকেছে। কানের কাছে পিনপিন করে বিরক্ত করছে। সেই মশা মারা দরকার। তিনি তার কিছুই করতে পারছে না। এটা ভেবে তার খুবই খারাপ লাগে। আবার ঘুমুতে যাবার আগে আগে মেয়ের সঙ্গে গুটুর-গুটুর করে যে অনেক কথা বলেন সেটা তার খুবই ভাল লাগে। তবে ইদানিং মেয়ের কথাবার্তা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সে ঘুরেফিরে তার স্যারের কথা বলছে। যে মেয়ে বড় হয়েছে তার মুখে ঘনঘন একজন মানুষের কথা আসা খুবই ভয়ের কথা। তিনি এখনো এই বিষয়ে মেয়েকে কিছু বলছেন না। তবে যে-কোন এক রাতে বলবেন। সেটা আজ রাতেও হতে পারে। না আজ রাতে কিছু বলবেন না। আজ মেয়েটার শরীর ভাল না। জ্বর এসেছে। গা গরম। এটা একটা দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে গেল। মেয়েটার অসুখবিসুখ লেগেই আছে। ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কোন ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার।

    আমেনা বেগম ঘুমন্ত শেফার গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। শেফা সঙ্গে সঙ্গে সেই চাদর ফেলে দিল। আমেনা বেগম বললেন, তুই জেগে আছিস।

    শেফা বলল, হ্যাঁ।

    শরীর বেশি খারাপ লাগছে?

    না শরীর অল্প খারাপ, মন বেশি খারাপ।

    মন খারাপ কি জন্যে?

    রফিক স্যারকে একটা জিনিস ময়মনসিংহ থেকে আনতে বলেছিলাম। আনে নাই।

    কি জিনিস?

    রবারের চুড়ি।

    রবারের আবার চুড়ি হয় নাকি?

    হয়, রবারের চুড়ি হয়। নতুন বের হয়েছে।

    তারে তুই চুড়ি আনতে বলছিলি কি জন্যে? সে মাস্টার মানুষ।

    মাস্টার মানুষ চুড়ি আনতে পারবে না? নাকি আনলে সেটা বিরাট দোষ। জেল-জরিমানা হবে।

    আমেনা বেগম মেয়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন মাথার যন্ত্রণা আছে? টিপে দেই?

    শেফা বিছানায় উঠে বসল। আমেনা বেগম বললেন, কি হয়েছে?

    শেফা বলল, দেখে আসি।

    কি দেখে আসবি?

    দুরবিন কতদূর হয়েছে দেখে আসি।

    আমেনা বেগমের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মেয়েটা বলে কি। গভীর রাতে সে কার কাছে যেতে চায়।

    শেফা বলল, স্যার বলেছেন দুরবিন তৈরি হয়ে গেলে সেই দুরবিনে প্রথম চাঁদ দেখব আমি।

    তুই প্ৰথম কেন দেখবি? তোর প্রথম দেখার দরকার কি?

    সেটা তো মা আমি জানি না। কে প্রথম দেখবে কে দুই নম্বরে দেখবে সেটা আমি ঠিক করি নাই। স্যার ঠিক করেছেন। তুমি উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।

    আমেনা বেগম অবাক হয়ে দেখলেন শেফা তড়তড় করে বিছানা থেকে নামহে। এই মেয়েকে এখন আটকানো যাবে না। কাজেই এখন যা করতে হবে তা হল—তাকে সঙ্গে যেতে হবে। মেয়ের সঙ্গে মা থাকলে আর কোন দোষ থাকে না। কোন কারণে যদি ইয়াসিন সাহেবের ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি জানালা দিয়ে দেখেন গভীর রাতে মা-মেয়ে রফিকের সঙ্গে কথা বলেছে তিনি কিছু মনে করবেন না। কিন্তু তিনি যদি দেখেন মেয়ে একা কথা বলছে—তাহলে বাড়িতে গজব হয়ে যাবে। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে গর্ত করে মেয়েকে জীবন্ত পুঁতেও ফেলতে পারেন।

    স্যার দুরবিন তৈরি হয়েছে?

    প্রায়।

    প্রায় কেন, বাকি আছে কি?

    চোঙটা আরো বড় করতে হবে। বেশি না সামান্য করলেই হবে।

    কতক্ষণ লাগবে?

    ধর ঘণ্টা খানিক।

    আমেনা বেগম বললেন, এখন রেখে দাও। ঘুমুতে যাও। যা করার সকালে করবে।

    রফিক নিচু গলায় বলল, এখন ঘুমাতে গেলে ঘুম আসবে না। মনটা এখানে পড়ে আছে।

    শেফা বলল, স্যার আপনার কিছু লাগবে? রফিক বলল, না কিছু লাগবে। না।

    এবাপ চা বানায় এনে দিব?

    না লাগবে না।

    কোন সাহায্য লাগবে। করাত দিয়ে কাঠ কাটা, কিংবা শিরিষ কাগজ ঘষা। আমি করাত দিয়ে খুব ভাল কাঠ কাটতে পারি। কোন্ কাঠটা কাটতে হবে আপনি দেখায় দেন, আমি চোখের নিমিষে কেটে দেব।

    কাঠ কাঠতে হবে না। কাটাকাটির কাজ শেষ। এখন শুধু জোড়া দেয়া।

    আমেনা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। মেয়ে এভাবে কথা বলছে কেন? তার গলার স্বর কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়েও আছে। রফিকের দিকে। একবারও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। তিনি মেয়ের হাত ধরে তাকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন। ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব সূক্ষ্ম ব্যবস্থা। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে এমন ব্যবস্থা। রফিককে এ বাড়িতে রাখা যাবে না।

    অসম্ভব।

    শেফা বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আমেনা বেগমের ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। সেই ঘুমও ভাল হল না। একটু পর পর ঘুম ভেঙে যায়। যতবার ঘুম ভাঙে তিনি জানালার কাছে যান এবং দেখতে পান রফিক চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। এই ছেলের কি ক্লান্তি বলে কিছু নাই?

    শেষবার জানালা থেকে ফিরে বিছানায় উঠতে যাবেন, শেফা বলল, মা স্যার কি এখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন?

    আমেনা বেগম চাপা গলায় বললেন, তুই জানলি কিভাবে?

    তুমি যেমন একটু পরপর দেখে আসছ আমিও দেখে আসছি। আমি যখন দেখতে যাই তুমি তখন গভীর ঘুমে থাক বলে কিছু বুঝতে পার না।

    আমেনা বেগম লক্ষ করলেন মেয়ে কাঁদছে। কান্নার কোন শব্দ হচ্ছে না, তবে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেয়ের এই কান্নার ভঙ্গি তার চেনা।

    তুই কাঁদতেছিস কি জন্যে?

    স্যার বলেছিল আমি প্রথম দেখব। এখন সে নিজে দেখতেছে। আমার কথা তার মনেই নাই। মা স্যারকে তুমি বলবা সে যেন আমাদের বাড়িতে আর না থাকে, অন্য কোথাও চলে যায়। আমি এই স্যারের কাছে পড়ব না। এই স্যার কেন, আমি কোন স্যারের কাছেই পড়ব না।

    শেফা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমেনা বেগম মনে মনে বলছেন কি সর্বনাশ! কি সৰ্বনাশ।

    সর্বনাশ তো বটেই। নাম-পরিচয় নেই এক ছেলে। বড় হয়েছে এতিমখানায়। সেই ছেলের কথা ভেবে তার মেয়ে চোখের পানি ফেলছে। এমন ভয়ংকর কথা তো কাউকে বলা যাবে না। কেউ জানতে পারলেও সর্বনাশ হয়ে যাবে।

    ছেলেকে এই বাড়িতে থাকতে দেয়াই ভুল হয়েছে। সাধারণ ভুল না, বড় ভুল। মানুষ যখন ছোটখাটো ভুল করে তখন বুঝতে পারে। বড় ভুল করার সময় কিছু বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলে মানুষ বড় ভুল করতে পারত না।

    শেফার বাবা যখন বললেন, শেফার জন্যে একটা ভাল ছেলের সন্ধান পেয়েছি। তখন আমেনা বেগম আনন্দিত গলায় বলেছিলেন, পাত্র কি করে? এতে শেফার বাবা খুবই রেগে গিয়ে বললেন-পাত্র কি করে মানে? পাত্রের কথা আসছে কেন? শেফাকে পড়াবে এমন একজনের কথা বলতেছি। শেফাকে তো মেট্রিক পাস করা লাগবে।

    আমেনা বেগম খুবই লজ্জা পেয়েছিলেন। রফিক প্রথম যেদিন এ বাড়িতে থাকতে এল তখনও লজ্জা পেলেন। ভিন্ন কারণে লজ্জা পেলেন। রফিকের জন্যে দুপুরে ভাত পাঠিয়েছেন। প্রথমদিন সেই হিসেবে খোঁজ নিতে গিয়েছেন।

    রফিক মাথা নিচু করে খাচ্ছিল; আমেনা বেগমকে দেখে মাখা আরো নিচু করে ফেলল। আমেনা বেগম ছেলেটাকে দেখে মুগ্ধ হলেন—সুন্দর চেহারা। বড় বড় চোখ। চোখ দেখেই মনে হয় খুব বুদ্ধি। আমেনা বেগম বললেন, নিজের বাড়ি মনে করে থাকবা। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে খবর পাঠাবা।

    রফিক মাথা আরো নিচু করে বলল, জ্বি আচ্ছা।

    জুম্মাবারে অবশ্যই নামাজে যেতে হবে। এই বাড়িতে যারা থাকে তারা যদি জুম্মাবারে নামাজে না যায় তাহলে শেফার বাবা খুব রাগ করে।

    রফিক আবারো বলল, জ্বি আচ্ছা।

    আমেনা বেগম বললেন, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?

    রফিক বলল, আমি ঠিক জানি না।

    আমেনা বেগম বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি জান না মানে কি? তোমার পিতা-মাতা কোথায় থাকেন?

    এটাও আমি জানি না। ছোটবেলার কোন স্মৃতি আমার নাই। আমি বড় হয়েছি এতিমখানায়।

    আমেনা বেগম খুবই লজ্জা পেলেন। শেফার বাবা যদি ছেলে প্রসঙ্গে এই কথাগুলি আগে বলে রাখতেন তাহলে তিনি রফিককে এ ধরনের কথা বলে লজ্জা পেতেন না।

    ছেলেটার জন্যে সেদিন তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। এই বাড়িতে তুমি আশ্রয় পেয়েছ এখন তোমার আর চিন্তা নাই। শেফার বাবা অতি বদমেজাজি মানুষ, তবে অতি ভাল মানুষ। সে তোমার একটা না একটা গতি করে দিবে।

    আমেনা বেগম প্রথমদিন ছেলেটির প্রতি যে মমতা বোধ করেছিলেন আজও সেই মমতা বোধ করছেন, তবে একই সঙ্গে তাঁর বুক কঁপছে। তার মন বলছে ভয়ংকর এক সময় তাঁর সামনে। তিনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছেন। আল্লাহপাক সাহায্য না করলে তিনি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন না।

    শেফা আরাম করে ঘুমুচ্ছে। মায়ের মানসিক যন্ত্রণার কথা মেয়ে কিছুই জানে না। আমেনা বেগম শেফার গায়ে হাত রাখলেন।

    শেফা বলল, ছটফট করছ কেন মা। তোমার কি হয়েছে।

    ছটফট করতেছি তোরে কে বলেছে?

    কেউ বলে নাই। বুঝতে পারি। মা, রফিক স্যার কি এখনো উঠানে বসা?

    হুঁ।

    চোখে দুরবিন?

    না দুরবিন নাই।

    কাঠের মূর্তির মত চুপচাপ বসে আছে, ঠিক-না মা?

    হুঁ।

    স্যারের একটা ব্যাপার কি জান মা? স্যার ঘন্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে কি যেন চিন্তা করে।

    কি চিন্তা করে?

    জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না, হাসে। একবার শুধু বলেছিল—হিসাব করে। হিসাব নাকি মিলে না।

    কি হিসাব করে?

    জিজ্ঞেস করেছিলাম মা। কিছু বলে না। স্যারের একটা মস্ত বড় গুণ কি জান মা? স্যার যে কোন অংক মুখে মুখে করতে পারে। কাগজ-কলম লাগে না।

    ও।

    যে-কোন অংক স্যারকে দিয়ে শুধু বলবে, উত্তর কত? স্যার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর বলবে।

    অংক ভাল জানে বলেই তো তোর বাবা তাকে রেখেছে তোকে পড়াবার জন্যে।

    অংক ভাল জানা এক কথা আর মুখে মুখে অংক করা আরেক কথা।

    ঘুমাতো, স্যারকে নিয়ে এত কথা বলার দরকার নাই।

    সান্দিকোনা স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব আগামী বুধবার রফিক স্যারকে নিয়ে একটা অংক খেলার আয়োজন করেছেন। খুবই মজার খেলা। খেলাটা কি রকম বলব?

    বল।

    ব্ল্যাকববার্ডে দশটা অংক লেখা থাকবে। রফিক স্যার অংকগুলি করবেন মুখে মুখে আর বাকি যারা আছে তারা করবে ক্যালকুলেটর দিয়ে।

    আচ্ছা ঠিক আছে শুনলাম।

    মা, তুমি একটা কাজ করতে পারবে?

    কি কাজ?

    পাকঘরে গিয়ে এককাপ চা বানায়ে দিবে। স্যার সারারাত জেগে আছে তো, সকালবেলা এককাপ চা পেলে খুব খুশি হবে। চা-টা আমি হাতে করে নিয়ে যাব মা।

    আমেনা বেগম আবারো চমকালেন। কি ভয়ংকর কথা। কি মহাবিপদ তাঁর সামনে। তিনি এই বিপদ কি করে সামলাবেন। এত বুদ্ধি কি তাঁর আছে? বুদ্ধি আছে শেফার বাবার। যে-কোন বিপদ, যে-কোন সমস্যা এই মানুষটা সামাল দিতে পারে। কিন্তু এই বিপদের কথা তাঁকে কিছুতেই বলা যাবে না।

    কই মা, শুয়ে আছ কেনচা বানাতে যাও। আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে চা বানাতে হবে না। আমি নিজেই বানাব।

    শেফা খাট থেকে নামছে। আমেনা বেগমের হাত-পা জমে যাচ্ছে। কি হতে যাচ্ছে।

    মসজিদে আজান হচ্ছে। শেফার বাবা এখনি ঘুম থেকে উঠবেন। তিনি যদি দেখেন তার মেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে…না তিনি আর ভাবতে পারছেন না। তার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীল অপরাজিতা – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article মিসির আলির অমিমাংসিত রহস্য – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }