Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশন সমগ্র – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প1195 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০১. অস্বাভাবিক শব্দ

    কোত্থেকে জানি খুব অস্বাভাবিক শব্দ আসছে। ক্লান্তিকর বুদবুদ ফাটার শব্দ, পুট পুট পুট। সারাক্ষণ না, মাঝে মাঝে। কিছু বুদবুদ আবার ফাটার সময় তীব্র চিনচিনে শব্দ করছে। শব্দটা এমন যে সাই করে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আর মাথা থেকে বের হচ্ছে না। শব্দটা সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথায় অস্পষ্ট যন্ত্রণার মতো হচ্ছে।

    আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এটা হয়ত খুব স্বাভাবিক শব্দ। মহাকাশযানে এরকম শব্দ হওয়াই হয়ত রীতি। আমি নতুন মানুষ বলে আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কাউকে কি জিজ্ঞেস করব? বিনীতভাবে বলব, স্যার মাঝে মাঝে আমি একটা শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা অনেকটা বুদবুদ ফাটার মতো। আসলে আমি একেবারেই নতুন মানুষ। একটু ভয়-ভয় লাগছে। মহাকাশযানে চড়া দূরের কথা আমি ইন্টার-গ্যালাকটিক মহাকাশযানের ছবিও দেখি নি। সত্যিকথা বলতে কি মহাকাশযানগুলি যে এত বড় হয় তাও জানতাম না। তাছাড়া আমার আকাশভীতি আছে। প্লেনে কখনো চড়ি নি। আর দেখুন-না আমার ভাগ্য, মহাকাশযানে চড়ে বসে আছি। মহাকাশযান হুহু করে যাচ্ছে। আবার ভুল বললাম। মহাকাশযান যাচ্ছে নাকি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা জানি। না। আসলে কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না। তারচেয়েও বড় কথা কি জানেন স্যার? আমি কেন এখানে সেটা জানি না। বলতে গেলে এরা আমাকে জোর করে তুলে দিয়েছে। কেউ আমাকে কিছু বলে নি। স্যার আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন? প্লিজ। আমি নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছি। আমি কুকুর হলে পা চেটে আপনার মমতা পাবার চেষ্টা করতাম। আমি কুকুর না। মানুষ। খুবই সামান্য একজন, তারপরেও মানুষ।

    কথাগুলি কাকে বলব?

    আমি বসে আছি একটা চেয়ারের মতো জায়গায়। চেয়ারে গদিটদি কিছু নেই। প্লাস্টিকের মতো একটা জিনিস। তবে বসতে খুবই আরাম। আমি যেভাবে কাত হই, চেয়ারটা সেইভাবে কাত হয়। একবার পা তুলে বসলাম অদ্ভুত কাণ্ড চেয়ারের বসার জায়গাটা বড় হয়ে গেল। ঠিক আমার পায়ের মাপে মাপে। যেন জিনিসটা পা রাখার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। পা নামিয়ে নিলাম, বসার জায়গাটা আবার ছোট হয়ে গেল।

    আমি যে ঘরে বসে আছি সে ঘরটা সম্ভবত আমার, কারণ আর কেউ এ ঘরে আসে নি। ঘর না বলে বলা উচিত গোলক। ভুল বললাম, ঘরটা পুরোপুরি গোলাকার না, মেঝেটা সমতল। মাথার উপরের ছাদটা যেন একটা বাটি, যে বাটির গায়ে অসংখ্য সুইচ। কয়েকটা মনিটর। টিভি স্ক্রিনের মতো কিছু মনিটর। সবকটা মনিটরে কিছু না কিছু লেখা উঠছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিমান মানুষরা এইসব মনিটর থেকে অনেক কিছু বুঝে ফেলবেন। আমি বুদ্ধিমান না। একটা মনিটরে ক্রমাগত কিছু নাম্বার উঠছে। মাঝেমধ্যে নাম্বারগুলি পড়তে চেষ্টা করি–

    ৫৪৬৬৮২

    ৫৪৬৬৮০

    ৫৪৬৬৮৩

    ৫৪৬৬৮৮

    অর্থহীন ব্যাপার। কিংবা কে জানে অৰ্থ নিশ্চয়ই আছে, আমি জানি না। ঐ যে বললাম আমি খুবই সাধারণ একজন। বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু বের করে ফেলব সেই আশা করি না। এই বুদ্ধিটুকু আমার আছে।

    আমার গোলকঘরে খেলনা-খেলনা ভাব আছে। সবই ছোট ঘোট। খেলনা সাইজ, তবে সেই খেলনাঘরেও আমার শোবার জায়গা, হাতমুখ ধোবার জায়গা, গোসল করার জায়গা, বাথরুমের জায়গা সবই আছে। এমনকি খাবারঘরও আছে। খাবারঘরে একটা মাত্র চেয়ার। চেয়ারে বসামাত্র প্রথম কিছুক্ষণ শোশো শব্দ হয়। তারপর শব্দ থেমে যায় এবং পর্দা ফাঁক করে খাটো এক রোবট বের হয়ে আসে। রোবটটা দেখতে কুৎসিত। কপালের উপর সাইক্লপের চোখের মতো একটা চোখ। চোখ থেকে নীল আলো বের হয়। মাঝে মাঝে ধ্বক করে লাল আলো জ্বলে ওঠে। রোবটটার হাঁটাচলার ভঙ্গিও খারাপ। মনে হয় অতি কষ্টে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে এবং এক্ষুণি বুঝি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে। পতনের ফলে তার হাত-পা কিছু ভাঙবে। রোবটটা লজ্জিত ভঙ্গিতে সেই ভাঙা পা কিংবা ভাঙা হাত নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। রোবটটার গলা অবশ্যি খুব মিষ্টি। ষোলো সতেরো বছরের তরুণীর মতো ঝলমলে গলা। রোবটের ভয়েসসিনথেসাইজার নিশ্চয়ই কোন চমকার গলার মেয়ের স্বর কপি করে তৈরি করা। রোবটটার গলার স্বর শুনতে আমার ভাল লাগে যদিও আমি তাকে ব্যাপারটা জানতে দেই নি।

    প্রথম দিনে রোবটটা জিজ্ঞেস করল, আপনি কী খেতে চান? টেবিলে মেনু দেয়া আছে। মেনু দেখে অর্ডার দিতে পারেন। মেনুর বাইরে যদি কিছু খেতে ইচ্ছে। করে দয়া করে বলুন। আপনার পছন্দের খাবার জোগাড় করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা হবে। আর আপনি যদি খাবারের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন তাহলে আপনার রুচিমতো খাবার আমি দেবার চেষ্টা করব। মনে হয় আপনার তা পছন্দ হবে।

    আমি বললাম, তোমার নাম কী?

    রোবট মিষ্টি করে বলল, আমি খুব সাধারণ কর্মী রোবট। আমার কোন নাম নেই। তবে আপনি আপনার সুবিধার জন্যে আমাকে যে কোন নামে ডাকতে পারেন।

    তোমার জন্যে নাম খুঁজে বের করার কোন ইচ্ছা আমার নেই।

    আমি কি আপনার খাবার আমার পছন্দমতো দেব?

    আমি কী খেতে চাই তা তুমি জানবে কী করে?

    আপনার ডিএনএ প্ৰফাইল আমাকে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে বের করা। আছে।

    আমার পছন্দের খাবার কি তুমি জান?

    অবশ্যই জানি।

    বল তো আমার সবচে পছন্দের খাবার কোন্‌টা?

    ফ্লেটিশ মাছের ডিম।

    মাছের ডিম আমি জীবনে খাই নি। ডিমের আঁশটে গন্ধে আমার বমি আসে। ফ্লেটিশ মাছের তো নামও শুনিনি।

    ফ্লেটিশ একধরনের সামুদ্রিক মাছ। পানির অনেক নিচে থাকে। তাদের ডিম হয় সবুজ রঙের।

    শুনেই তো আমার গা গুলাচ্ছে।

    আপনি খেয়ে দেখুন আপনার কাছে অসম্ভব সুস্বাদু মনে হবে। আপনার ডিএনএ প্রফাইল তাই বলে।

    রোবট মেয়ের কথা শুনে খেলাম ফ্লেটিশ মাছের ডিম। আসলেই এত সুস্বাদু খাবার আমি আমার এই জন্মে খাই নি।

    মহাকাশযানের ফুড ডিপার্টমেন্ট যে অসাধারণ এটা আমি বলতে পারি। খাওয়াদাওয়া নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগের প্রশ্ন তো আসেই না। আমি আসলে খুশি। খুবই খুশি। খিদে লাগলেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। খেতে খেতে রোবট-মেয়ের সঙ্গে গল্প করি। রোবটটাকে মেয়ে বলার কোন কারণ নেই। ওর গলার স্বরটাই শুধু মেয়ের। সমস্যা হচ্ছে খাওয়াদাওয়ার বাইরে এই রোবট-মেয়ে কিছু জানে না। আমাদের সমস্ত আলাপ খাওয়াদাওয়া নিয়ে।

    তারপর বল আজ কী খাওয়াবে?

    আপনি যা খেতে চাইবেন তাই খাওয়াবো।

    আচ্ছা শোন যা খাচ্ছি সবই কি আসল খাবার না নকল খাবার?

    অবশ্যই আসল খাবার। তবে প্রকৃতি থেকে পাওয়া নয়, ল্যাবোরেটরিতে তৈরি।

    অর্ডার দিলেই মেশিন থেকে খাবার বের হয়ে আসে?

    অনেকটা তাই। পৃথিবীর যাবতীয় খাবারের মাত্র ছটা গুণ থাকে। টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা, তিতা এবং গন্ধ। এই ছটা জিনিসের হেরফের করে আপনার জন্যে খাবার তৈরি করে দেয়া হয়।

    আমি যে ফ্লেটিশ মাছের ডিম খাই সেই ডিম আসলে ফ্লেটিশ মাছের পেট থেকে আসে না?

    অবশ্যই না।

    আচ্ছা ধর আমাদের খাবার-তৈরি যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে গেল। তখন কী হবে। আমরা না খেয়ে বসে থাকব?

    আপনি খুবই অস্বাভাবিক সম্ভাবনার কথা বলছেন। খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া মূল কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে। কম্পিউটার সিডিসি।

    কম্পিউটার সিডিসি নিয়ন্ত্রণ করলে কোন ভুল হতে পারে না?

    অবশ্যই না।

    কেন কম্পিউটার কি ভুল করে না?

    কম্পিউটার সিডিসি ভুল করে না। সে সব জানে। সব কিছু বোঝে।

    তোমার ধারণা সে ঈশ্বরের কাছাকাছি? ঈশ্বর কে?

    বাদ দাও। ঈশ্বর কে তুমি বুঝবে না। আমি নিজেও বুঝি না। তোমাদের এই কম্পিউটার সিডিসি কি বলতে পারবে কেন আমাকে এই মহাকাশযানে আনা হল। আমাকে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

    অবশ্যই বলতে পারবে।

    তাকে জিজ্ঞেস করলে আমি জানতে পারব?

    সে যদি ইচ্ছা করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে তাহলে আপনি জানতে পারবেন। যদি উত্তর না দেয় তাহলে জানতে পারবেন না।

    আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালায় তো আছে। মানুষের যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে কম্পিউটার বাধ্য। মানুষের কাছ থেকে সে কিছু লুকাতে পারবে না। আমি আইনকানুন ভাল জানি না। তবে এই আইনটি জানি। এই আইনের নাম বিশেষ অধিকার আইন।

    কম্পিউটার সিডিসি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না। বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালা উড়ন্ত মহাকাশযানগুলির জন্যে প্রযোজ্য নয়।

    আচ্ছা শোন এই যে আমি তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছি কম্পিউটার সিডিসি কি তা শুনছে?

    অবশ্যই শুনছে। মহাকাশযানে যেখানে যা ঘটছে তার প্রতিটি সংবাদ সিডিসির মেমোরি সেলে চলে যাচ্ছে।

    তাহলে আমি যদি সিডিসিকে এখন গালাগালি করি তা সে শুনবে?

    অবশ্যই শুনবে।

    আমার ধারণা তোমাদের সিডিসি মোটামুটি গাধা-টাইপ একটা কম্পিউটার। সে নিজেকে খুব বুদ্ধিমান। আমি বর্তমানে যে মানসিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা সে বুঝতে পারত, এবং কষ্ট কমাবার চেষ্টা করত। আমি যদি জানতে পারতাম কেন আমাকে মহাকাশযানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাহলেই হত। আমি কিছুই জানি না।

    স্যার আপনাকে কি একটা মিক্সড ড্রিংক দেব, ড্রিংকটা এমন যে আপনার মানসিক উত্তেজনা দূর করতে সাহায্য করবে।

    আচ্ছা দাও।

    একটা ড্রিংকের জায়গায় আমি পর-পর চারটা ড্রিংক খেয়ে ফেললাম। ড্রিংকটা ঝাঁঝালো টক-টক স্বাদ। টকের ভেতর সামান্য মিষ্টি ভাবও আছে। খাবার পর-পর মাথা এলোমেলো লাগছে। কে জানে নেশা হয়েছে কি না। কারণ রোবট-মেয়েটাকেও দেখতে এখন খারাপ লাগছে না। তার নীল আলোর চোখেও মনে হয় একটু মায়া-মায়া ভাব চলে এসেছে। এমনকি মহাকাশযানটাকেও আমার খারাপ লাগছে না। নিজেকে হালকা ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে ভালই তো নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। ভবিষ্যতে কিছু একটা হবে। সেটা আনন্দময় হতে পারে আবার নিরানন্দময়ও হতে পারে। আনন্দময় হলে তো ভালই। নিরানন্দময় হলেও-বা ক্ষতি কি? আনন্দ ও নিরানন্দ নিয়েই তো জগৎ।

    আমার হঠাৎ করেই গান গাইতে ইচ্ছা করছে। সমস্যা একটাই আমার, গানের গলা নেই। তাতে কি? সব মানুষকে তো আর গানের গলা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয় না। আমি আমার হেড়েগলাতেই গান গাইব। কম্পিউটার সিডিসিকে বিরক্ত করে মারব। আমি আরেকটা ড্রিংকের কথা বললাম।

    রোবট বলল, আমার মনে হয় আপনার এই ড্রিংকটা আর খাওয়া ঠিক হবে না।

    আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমার কী মনে হয় তা দিয়ে আমার জগৎ চলবে না। আমার জগৎ চলবে আমার নিয়মে। আমি আরেকটা ড্রিংক খাব। এবং খেতে খেতে গান করব। তুমি শুনবে। ভাল না লাগলেও শুনবে।

    জি আচ্ছা।

    পঞ্চম গ্লাসে চুমুক দিয়ে গান ধরলাম। এমিতে আমার সুর ভাল না, আজ দেখি সুন্দর সুর বের হচ্ছে। নোটগুলি গলায় বসে যাচ্ছে। আমি বেশ গলা খেলিয়ে গাইতে পারছি। আমি বিষাদময় একটা চন্দ্ৰগীতির অনেকখানি গেয়ে ফেললাম। মঙ্গলগ্রহে যে-সব মানুষ বসতি স্থাপন করেছে—এই চন্দ্রগীতি তাদের অত্যন্ত প্রিয়। মঙ্গলগ্রহের দুটি চাঁদ ডিমোস এবং ফিববাসে যখন একসঙ্গে জোছনা লাগে তখন তারা এই চন্দ্রগীতি গায়,

    আমার মতো অভাজনের জন্যে
    একটি চাদই তো যথেষ্ট ছিল,
    তাহলে দুটি চাঁদ কেন?

    মাঝপথে গান থামিয়ে রোবটকে জিজ্ঞেস করলাম, গান কেমন লাগছে?

    স্যার আমি বলতে পারছি না। সংগীত বোঝার ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয় নি। আমি সাধারণমানের কর্মী রোবট। তবে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি গান গেয়ে আনন্দ পাচ্ছেন। আপনার আনন্দটাই প্রধান।

    গাধা সিডিসিও তো নিশ্চয়ই আমার গান শুনতে পাচ্ছে।

    তা পাচ্ছে।

    গাধাটার কান যে ঝালাপালা করতে পারছি সেটাই আমার আনন্দ।

    স্যার আপনি কি আরো ড্রিংক্স নেবেন?

    না আমার মাথা ঘুরছে।

    তাহলে ঘুমুতে যান।

    আমি কী করব না করব তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি ঘুমাব না কি হাত পা ছুড়ে চন্দ্রনৃত্য করব তা আমার ব্যাপার।

    অবশ্যই আপনার ব্যাপার।

    খুবই ক্লান্ত লাগছে। চন্দ্রনৃত্য করতে ইচ্ছা করছে না। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মহাকাশযানের বিছানাগুলিতে কোন রহস্য আছে, শোবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। চোখ খুলে রাখা যায় না এমন অবস্থা। একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি কম্পন দ্রুত মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এবং এই বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি একেক মানুষের জন্যে একেকরকম। এরা নিশ্চয়ই আমার ফ্রিকোয়েন্সি বের করে রেখেছে। আমি বিছানায় শোয়ামাত্র সেই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ আমাকে শোনায়। ভাল কথা শোনাক। তাদের যা ইচ্ছা করুক।

    আমার ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগেও মনে একটা ফুর্তি-ফুর্তি ভাব ছিল। এখন তা নেই। মন খারাপ লাগছে। মহাকাশযানের কোন জানালা থাকলে জানালা খুলে লাফিয়ে বাইরে চলে যেতাম। ঘরের ভেতর দমবন্ধ লাগছে। দমবন্ধ লাগা একবার শুরু হলে খুব সমস্যা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দমবন্ধ ভাব বাড়তেই থাকে।

    দমবন্ধের এই ব্যাপারটা আমি ভাল জানি। সাইকোলজির পরিভাষায় একে বলে কেবিন-ফিভার। প্রতি দুমাসে একবার আমাকে কেবিন-ফিভারের পরীক্ষা দিতে হত। শুধু আমাকে না আমার মতো যারা টানেলে কাজ করে তাদের সবাইকে। দিনের পর দিন টানেলে কাজ করলে একসময় না এক-সময় কেবিন-ফিভার হয়। হঠাৎ করে একজন ভাল মানুষ পাগলের মতো হয়ে যায়, চিকার করতে থাকে। আকাশ ফাটিয়ে চিকার করতে করতে বলে, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে বাইরে নিয়ে চল। এক্ষুণি বাইরে নিয়ে চল।

    বাইরে নিয়ে চল বললেই তো আর বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না। খুব দ্রুত ব্যবস্থা করলেও টানেল থেকে বের হতে দুঘণ্টার মতো সময় লাগে। এই দুঘণ্টা সময় কেবিন-ফিভারের রোগীর জন্যে অনন্তকাল। ভয়ংকর সব কাণ্ড এই দুঘণ্টার মধ্যে তারা করে ফেলে। একজনকে দেখেছি টানেলের দেয়ালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মাথা ঠুকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে ছিটকে ঘিলু বের হয়ে এল। টানেল-কর্মীদের সুপারভাইজারদের সঙ্গে সবসময় কড়া সিটেটিভ থাকে। একবার সিটেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। তবে বেশিরভাগ সময়ই সুপারভাইজাররা এই সময় পায় না। দেখা যায় একজন নিতান্ত ভাল মানুষের মতো টানেলে কাজ করছে। শিস বাজাচ্ছে। চন্দ্বগীতি গাইছে, হঠাৎ সে ঘুরে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ হয়ে গেল রক্তবর্ণ। সুপারভাইজার তার কাছে ছুটে আসার আগেই সে একটা কাণ্ড করে বসল।

    আমরা টানেল-কর্মীরা দুমাসে একবার সাত দিনের ছুটি পাই। সেই সাত দিন আমরা নানান ফুর্তি করি। সে এক কাণ্ড। নাচানাচি। মদ খাওয়াখাওয়ি। নেংটো হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়া—হি হি হি। এখন তো ভাবতেই মজা লাগছে। ছুটি কাটাবার পর সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে হয়। তিনি নানান ধরনের পরীক্ষাটরীক্ষা করেন। উদ্ভট-উদ্ভট প্রশ্ন করেন, যেমন একবার তিনি বললেন, তিনজন মানুষ নদী পার হবে। তুমি, তোমার এক বাল্যবন্ধু এবং বন্ধুপত্নী। বন্ধুপত্নীর বয়স বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। নৌকায় একসঙ্গে দুজন পার হতে হবে। তুমি আগে পার হতে চাইবে না কি বন্ধু-বন্ধুপত্নীকে পার হতে দেবে?

    আমি বললাম, আমি আগে পার হব।

    ঠিক আছে তুমি আগে পার হতে চাচ্ছ, তুমি সঙ্গে কাকে নিতে চাও বন্ধু। না বন্ধুপত্নীকে?

    আমি বিড়বিড় করে বললাম, বন্ধুপত্নীকে। বলতে খুব লজ্জা লাগল। তারপরেও বললাম।

    তুমি নিশ্চয়ই বন্ধুপত্নীর একটা ছবি মনেমনে দাঁড় করিয়েছ। সেই ছবিতে তিনি যে কাপড় পরে আছেন সেই কাপড়ের রং কী?

    নীল।

    তোমার বন্ধুর গায়ের কাপড়ের রং কী?

    খয়েরি।

    তুমি বললে তোমার বন্ধুপত্নী নীল রঙের কাপড় পরেছেন। আচ্ছা তিনি যে অন্তর্বাস পরেছেন তার রঙ কী বলে তোমার ধারণা?

    আমার কোন ধারণা নেই স্যার।

    তোমার মাথায় কোন রঙটা আসছে?

    লাল।

    গাঢ় লাল?

    না খুব গাঢ় না।

    ঠিক করে বল তো লাল না গোলাপি।

    স্যার গোলাপি।

    সাইকোলজিস্টের প্রশ্নের উল্টোপাল্টা জবাব দিয়ে লাভ নেই। কারণ প্রশ্নোত্তরের সময় সারা শরীরে নানান সেনসর লাগানো থাকে। প্রশ্নের ঠিক জবাব দেয়া হচ্ছে, না বানানো জবাব দেয়া হচ্ছে সেনসর তা বলে দেয়। বানানো জবাব দিলে মহা-সমস্যা।

    সাইকোলজিস্ট তার দীর্ঘ পরীক্ষার পর যদি বলেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। তাহলেই আমরা আমাদের পুরনো কাজে ফিরে যেতে পারি। আর তিনি যদি ফাইলের উপর সবুজ কালি দিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন লিখে দেন তাহলে সব শেষ। টানেলে ফিরে যাওয়া হবে না।

    আমরা টানেল-কর্মীরা টানেলে ফিরে যেতে চাই। আমরা যখন টানেলে নামি তখন শান্তি-শান্তি লাগে, মনে হয় মায়ের পেটে ঢুকে যাচ্ছি। অতি নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছি। আর আমাদের কোন সমস্যা নেই।

    টানেলে কাজ করার অনেক মজাও আছে। আমরা সূর্য-ভাতা পাই। যে। কদিন সূর্য দেখতে পাচ্ছি না সে কদিনের সূর্য-ভাতা। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ২ ইউনিট। অনেক বড় ব্যাপার। পাঁচ বছর কাজ করতে পারলে আমরা থাকার কোয়ার্টারের জন্যে আবেদন করতে পারি। কোয়ার্টার পাবার সম্ভাবনা প্রায় আশি ভাগ। তবে সমস্যা হচ্ছে টানেল-কর্মীরা বেশিদিন তাদের কোয়ার্টারে থাকতে পারে না। সূর্যের আলো তাদের অসহ্য বোধ হয়। খোলা বাতাসে তারা নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না। তাদের জীবন কাটে টানেলে টানেলে। অনেকের কাছে সেই জীবনটা হয়ত আনন্দময় নয় তবে আমাদের জন্যে ঠিকই আছে। টানেলেই আমাদের ঘর। আমাদের জীবন।

    মহাকাশযানে আমি বর্তমানে যে ঘরে বাস করছি তার সঙ্গে টানেলের কিছু মিল আছে। আমি ঘর থেকে বের হতে পারি না। টানেল থেকেও বের হওয়া সম্ভব না। টানেলে কথা বলার কেউ থাকে না আশেপাশে কিছু কর্মী রোবট থাকে তারা কথা বলতে পারে না। শুধু কাজ করতে পারে। এখানেও তাই, কথা বলার জন্যে রোবট ছাড়া আর কেউ নেই। তবে এখানে খাবারদাবারের ব্যবস্থা ভাল, অবশ্যই ভাল। এই যে আমি এখানে শুয়ে আছি, আমার ঘুম আসছে না। এখন আমি যদি খাবারঘরে যাই সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-রোবটটা চলে আসবে। আমি তাকে যদি বলি, কফি খাওয়াতে পার? সে কফি বানিয়ে আনবে। সেই কফি সিনথেটিক কফি, কিন্তু কারোর বোঝার সাধ্য নেই। কফির যেমন গন্ধ তেমন স্বাদ। খাবার বানানোর এরকম একটা যন্ত্ৰ কিনতে কত ইউনিট লাগে? আমার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এরকম একটা যন্ত্ৰ কিনে ফেলতে পারলে কাজের কাজ হত। ফ্লেটিশ মাছের ডিম-ফিম খেয়ে জীবন পার করে দিতে পারতাম।

    আমার মাথার কাছে সবুজ একটা বাতি কিছুক্ষণ ধরেই জ্বলছে-নিভছে। বাতিটা এতক্ষণ নেভা ছিল। হঠাৎ বাতিটা পাগল হয়ে গেল কেন? এই সব বাতির মানে কী আমি জানি না। শুধু জানি খিদে পেলে কী করতে হয়।

    টানেলে আমি সুখে ছিলাম। না না সুখে ছিলাম বলা ঠিক হবে না মহাসুখে ছিলাম। সারাদিন কাজ করি, সন্ধেবেলা ঘুমুতে আসি। দিনে প্রচুর পরিশ্রম হয় বলে রাতে ঘুম ভাল হয়। শোয়ামাত্র চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। তারমধ্যেও মনে মনে হিসেব করি ঠিক কত ইউনিট জমল। পাঁচ হাজার ইউনিট জমলে বিয়ের লাইসেন্স করতে পারি। টানেল কর্পোরেশনকে সেই লাইসেন্স দেখালে কোন একজন মহিলা টানেল-কর্মীকে তারা খুঁজে বের করবে। আমার নামে বরাদ্দ দিয়ে দেবে। ডিএনএ ম্যাচিং করে মেয়ে খোঁজা হবে, কাজেই ধরে নেয়া যায় যে আমাদের জীবনটা সুখেরই হবে। দুজন দুজনকে পছন্দ করব। সন্ধ্যার পর যখন কাজ থাকবে না তখন দুজন নানান গল্প করব। তেমন ইউনিট যদি জমাতে পারি তাহলে কয়েকদিনের জন্যে কোন একটা রিসোর্টে বেড়াতেও যেতে পারি। কোথায় যাব সেটা ঐ মেয়েটাকেই ঠিক করতে দেব। তার যদি সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছা করে তাহলে যাব সমুদ্রের কাছে। যদিও সমুদ্র আমার ভাল লাগে না। সারাক্ষণ একঘেয়ে শব্দ। সমুদ্রের কাছে আলোও বেশি, খুব চোখে লাগে। তারপরেও মেয়েটির আনন্দকে আমি গুরুত্ব দেব। আমি যদি তার আনন্দকে গুরুত্ব না দেই সে আমার আনন্দকে গুরুত্ব দেবে না।

    আমি ঠিক করে রেখেছি বিয়ের পরে আমি একটা নিষিদ্ধ কাজও করব। মেয়েটার একটা নাম দেব। টানেল-কর্মীদের কোন নাম থাকে না। তাদের থাকে নাম্বার। নাম্বারটা খুব প্রয়োজনীয় ব্যাপার। নাম্বার থেকে সঙ্গে সঙ্গে বলা যায় টানেল-কর্মী কোথায় কাজ করছে, কী ধরনের কাজ করছে, কত দিন হল কাজ করছে, সে থাকে কোথায়। নাম্বারই টানেল কর্মীর নাম ঠিকানা, পরিচয়। যেমন আমার নাম হল T5023G00/LOR420/S000129, এটা হল আমার পুরো নাম। ঘোট নাম হল T5LASO.

    নাম ব্যবহার আমাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরেও কাউকে না জানিয়ে মেয়েটার আমি যদি সুন্দর একটা নাম দেই তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই। যখন আমাদের কোন কাজকর্ম থাকবে না। দুজন একাকী বসে থাকব তখন এই নামে তাকে ডাকব।

    আমি প্রতিরাতেই একটা না একটা নাম নিয়ে ভাবি। এখন আমাদের সবচে পছন্দের নাম হল ইমা। ইমা নামের মেয়েটার কথা ভাবতে-ভাবতেই আমি প্রতিরাতে ঘুমুতে যাই। ঘুমের মধ্যে ইমাকে মাঝে-মধ্যে আমি স্বপ্নে দেখি লাজুক-টাইপ রোগামতো একটা মেয়ে, লম্বা চুল, বড়-বড় চোখ। চোখের পল্লব এত দীর্ঘ এবং ঘন যে মেয়েটির দিকে তাকালে মনে হবে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমি মেয়েটির চোখ দেখছি। মেয়েটা কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না, শুধু হাসে।

    আমার মতো সাধারণ এবং নিরীহ একটা মানুষ কী করে মহাকাশযান সংক্রান্ত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে তা আমার মাথায় আসে না। মাঝে মাঝে চেয়ারে বসে-বসে ভাবি, পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হয়, মনে হয় আসলেই হয়ত স্বপ্ন। একসময় স্বপ্ন ভেঙে যাবে এবং মোটামুটি অবাক হয়েই দেখব আমি ঠিক আগের জায়গাতেই আছি, টানেল-হোস্টেলের ৩২৩ নাম্বার বিছানায়। আমি বিছানা থেকে নামব, পানি খাব, বাথরুমে যাব তারপর আবার আগের জায়গায় এসে ঘুমুতে শুরু করব। ঘুম না এলে মাথার কাছের রিডিং-লাইট জ্বালিয়ে বইটই পড়ার চেষ্টা করব। ও হ্যাঁ আমার বই পড়ার বদঅভ্যাস আছে। রাজ্যের বই পড়ি।

    সে রকম কিছু ঘটে না। তখন আমি মনে করতে চেষ্টা করি মহাকাশযানে ঢোকার আগে আমার কার কার সঙ্গে কথা হয়েছে এবং কী কথা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু আঁচ করা যায় কি না।

    প্রথম কথা হল টানেল-ম্যানেজারের সঙ্গে। ধবধবে শাদা চুলের একজন রোগা মানুষ। মুখে হাসি-হাসি কিন্তু কথায় কোনরকম আন্তরিকতা নেই। পাথরের মতো আবেগশূন্য চোখ। শুকনো মুখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, নাম্বার কত?

    আমি অত্যন্ত বিনীত ভাবে বললাম, TSLASO.

    পুরো নাম্বার বল।

    আমি আগের চেয়েও বিনীতভাবে বললাম, T5023G001/ LOR420/ s000127.

    তিনি রাগী গলায় বললেন, সেভেন না নাইন?

    আমি বললাম, স্যার ভুল হয়েছে, নাইন। অনেকগুলি নাম্বার তো, বলার সময় এলোমেলো হয়ে যায়। দয়া করে আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।

    এরা যখন নাম্বার জিজ্ঞেস করে তখন আমি একটা সংখ্যা ইচ্ছা করে ভুল বলি। দেখার জন্যে যে এরা ভুলটা ধরতে পারে কি না। সবসময়ই ধরতে পারে। অর্থাৎ এরা নাম্বার জানে। জেনেও জিজ্ঞেস করে। কেন?

    তুমি স্টেশন ফাইভে চলে যাও।

    জ্বি আচ্ছা স্যার। কবে যাব?

    কবে যাবে মানে? এক্ষুণি যাবে। তোমার জন্যে পাস দেয়া আছে। পাস নিয়ে চলে যাবে।

    জ্বি আচ্ছা।

    জ্বি আচ্ছা বলে দাঁড়িয়ে আছ কেন, চলে যাও।

    স্টেশন ফাইভে কার কাছে যাব?

    ইনফরমেশনে পাসটা জমা দেবার পর যা করার ওরা করবে।

    জ্বি আচ্ছা।

    এখনো দাঁড়ায়ে আছ কেন?

    স্টেশন ফাইভটা কোথায় আমি জানি না স্যার।

    মনোরেলে করে চলে যাও সাবওয়ে সেন্ট্রালে। সেখান থেকে সুপার ট্রেনে করে স্টেশন ফাইভ। আঠারো ঘণ্টার মতো লাগবে।

    অল্পকিছু ইউনিট নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। সঙ্গে কাপড়চোপড়ও আনি নি।

    কিছুই লাগবে না।

    স্টেশন ফাইভে কী জন্যে যাচ্ছি সেটা কি স্যার আমি জানতে পারি?

    তুমি কী জন্যে স্টেশন ফাইভে যাচ্ছ আমি জানি না। স্টেশন ফাইভের লোজন হয়ত জানতে পারে। আমাকে বলা হয়েছে তোমার জন্যে একটা রেডপাস ইস্যু করতে, আমি তা করেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। এখন দয়া করে পাস নিয়ে বিদেয় হও। এমিতেই তুমি আমার যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছ।

    আমি ঘর থেকে বের হলাম। আমাকে একটা রেড-পাস দেয়া হল। এরকম পাস আমি আমার জন্মে দেখি নি। নাম রেড-কার্ড কিন্তু রং নীল। কার্ডে আমার নাম্বার লেখা। নাম্বারের নিচে কোড ল্যাংগুয়েজে কিছু লেখা। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু লেখা। যাকে এই কার্ড দেখাই সে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। যেন আমি অদ্ভুত কোন প্রাণী। ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবী দেখতে এসেছি। তারপর কার্ডটাকে সে ডিকোডারে ঢুকায়। এবং আগের চেয়েও আরো বেশিক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কোন রহস্যই ভেদ করতে পারি না। কোড ল্যাংগুয়েজে কি লেখা? আমি একজন ভয়ংকর ব্যক্তি। সিরিয়েগ কিলার। আমার কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকতে হবে এই জাতীয় কিছু?

    স্টেশন ফাইভের এক লোক আমার রেড-কাৰ্ড রেখে একটা রূপালি কার্ড দিয়ে দিল। (এবারের রূপালি কার্ডের রং আসলেই রূপালি) এবং খুবই দ্রভাবে বলল, দয়া করে সামনে এগিয়ে যান। তিনটা লিফট আছে, মাঝখানেরটা রূপালি। কার্ড পাঞ্চ করলেই লিফটের দরজা খুলে যাবে। লিফট আপনাকে নিয়ে যাবে দশ নাম্বার ঘরে।

    সেখানে আমি কার সঙ্গে কথা বলব?

    কার সঙ্গে কথা বলবেন তা তো আমরা বলতে পারছি না। আমাদের দায়িত্ব আপনাকে রূপালি কার্ড দেয়া, আমরা তা দিলাম। আমাদের দায়িত্ব শেষ।

    দশ নাম্বার ঘরে যার সঙ্গে আমার কথা হল সে সুন্দর একটা মেয়ে। তার গায়ে রূপালি পোশাক। গায়ে রূপালি পোক মানে এই মহিলা বিজ্ঞান কাউন্সিলের। তাঁর অবস্থান সাধারণের চেয়ে অনেক উপরে। অপ্রয়োজনে এদের সঙ্গে কথা বলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

    এই প্রথম আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলের কাউকে মুখোমুখি দেখলাম। এদের কথা বলার ভঙ্গি তাকানোর ভঙ্গি সবই আলাদা। যেন এরা ঠিক মানুষ না, এরা দেবদেবীর কাছাকাছি।

    আমি খুব ভয়ে-ভয়ে বললাম, ম্যাডাম আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে কেন এখানে আসতে বলা হয়েছে আমি কিছুই জানি না। মেয়েটি শীতল গলায় বলল, এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। যা জানার যথাসময়ে জানতে পারবে।

    আমি তাঁর জবাব শুনে আনন্দিত হয়েছি এমন ভঙ্গিতে বললাম, জ্বি আচ্ছা।

    তোমার শরীর জীবাণু ও ভাইরাস-মুক্ত করা হবে। তুমি সরাসরি ল্যাবোরেটরিতে চলে যাও।

    একবার ভাবলাম বলি, ম্যাডাম আমার শরীর জীবাণু এবং ভাইরাসমুক্ত করার প্রয়োজনটা কেন হল? জীবাণু এবং ভাইরাস নিয়ে আমি তো ভালই আছি। তা না বলে আগের চেয়েও আনন্দিত গলায় বললাম, জি আচ্ছা।

    আমাদের মহাকাশযান এমিডা এফ এলের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে, তারপরেও তোমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে। ল্যাবোরেটরিতে ঢোকার আগে তুমি যদি তোমার কোন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে চাও কথা বলতে পার।

    ম্যাডাম আমার কোন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন নেই। জন্মের পর-পর আমার বাবা-মা আমাকে কোন অজ্ঞাত কারণে পরিত্যাগ করেন। আমি বড় হই বিজ্ঞান কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত হোমে। হোমের নিয়ম-অনুযায়ী আমি আমার বাবা বা মার কোন পরিচয় জানি না।

    আমাকে এত কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই।

    জ্বি আচ্ছা ম্যাডাম। আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে দুঃখিত।

    সময় নষ্ট না করে ল্যাবোরেটরিতে ঢুকে পড়।

    ম্যাডাম ল্যাবোরেটরিটা কোন্ দিকে?

    তুমি এখানেই অপেক্ষা কর তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে।

    ম্যাডাম আমি কোথায় যাচ্ছি?

    আপাতত মহাকাশযান এড্রোমিডায় উঠছ। মহাকাশযানে করে কোথায় যাবে তা তারা তোমাকে বলে দেবে। যাত্রা শুভ হোক।

    ম্যাডাম আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    সায়েন্স কাউন্সিলের এই মহিলা আমার ধন্যবাদের উত্তরে কিছু বললেন না। পাশের ঘরে চলে গেলেন। পরের বারো ঘণ্টা কিছু রোবট আমাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করল। শরীরে ইনজেকশন দিল। আমাকে কয়েক গ্যালন লবণাক্ত কিছু তরল খাওয়ানো হল। রেডিয়েশন চেম্বারে চেয়ারে বসিয়ে রাখল। তারপর মনে হল অনন্তকাল একটা অন্ধকার ঘরে শুইয়ে রাখল, সেই ঘরের বাতাস অসম্ভব ভারি। যখন নিশ্বাস নেই তখন মনে হয় বাতাস না, আমার নাকের ফুটোর ভেতর দিয়ে তরল কোন বস্তু ঢুকে যাচ্ছে। আমি অপেক্ষা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি আমি মহাকাশযান এড্রোমিডা এফ এল এতে বসে আছি। একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ বুদবুদ ফাটার শব্দ হচ্ছে। মহাকাশযান অকল্পনীয় বেগে ছুটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে। জানি না। একসময় হয়ত জানব। সেই একসময়টা কবে আসবে?

    আমার খুব অস্থির লাগছে। অন্যসময় বিছানায় মাথা ছোয়ানো মাত্র ঘুমিয়ে পড়ি—আজ একি অবস্থা! ঐ পানীয়টা এত খাওয়া ঠিক হয় নি। আমি বিছানা থেকে নামলাম। আমার ঘরের দরজা ধরে কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্তি করলাম। দরজা খুলছে না। খুলবে না জানি। তারপরেও চেষ্টা করা। চিড়িয়াখানার জন্তুরা জানে তাদের খাচার দরজা খুলবে না, তারপরেও তারা প্রতিদিন বেশ কয়েকবার খাচার দরজায় ধাক্কা দেয়।

    আমি তো এখন একজন জন্তুই। জন্তুকে যথাসময়ে খাবার দেয়া হয়, আমাকেও দেয়া হচ্ছে। চিড়িয়াখানার জন্তুর সঙ্গে আমার একটাই তফাত। তাদেরকে অনেকে দেখতে আসে। আমাকে কেউ দেখতে আসে না।

    এমন যদি হত রাতে ঘুমুচ্ছি হঠাৎ দরজায় নক হল। ঘুম ভেঙে আমি দরজা খুললাম এবং ঘরে হাসিমুখে ঢুকল ইমা।

    সে বলবে, একি তুমি এখানে কেন?

    আমি বলব, জানি না কেন?

    মহাকাশযানে করে তুমি কোথায় যাচ্ছ?

    তাও জানি না। ইমা, কি হচ্ছে বল তো?

    কিছুই হচ্ছে না। তুমি আসলে দুঃস্বপ্ন দেখছ।

    না, তা হবে না। আমার জন্যে ইমা আসবে না। আমার জন্যে আসবে ভয়ংকর কেউ।

    কারোর জন্যে অপেক্ষা না করে আমার উচিত ঘুমিয়ে পড়া। আমি আবার বিছানায় গেলাম এবং মনে মনে বার-বার বলতে লাগলাম, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। আমি চাই শান্তি ও আনন্দময় ঘুম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীল অপরাজিতা – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article মিসির আলির অমিমাংসিত রহস্য – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }