Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশন সমগ্র ৫ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প1035 Mins Read0
    ⤷

    ০১. পৃথিবীতে এখন খুব দুঃসময়

    বৃদ্ধ কুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে এখন খুব দুঃসময়।

    ছোট শিশু অর্থহীন কথা বললে বড় মানুষেরা যেভাবে সকৌতুকে তার দিকে তাকায় অনেকে সেভাবে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলল না। পৃথিবীর মানুষ আজকাল বেশি কথা বলে না, কী নিয়ে কথা বলবে। কেউ জানে না। বৃদ্ধ কুরুর মতো দুই-একজন ছাড়া সবাই জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে পৃথিবীতে খুব বড় দুঃসময়। সবাই সেটা মেনে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে, সেই বেঁচে থাকাটাও খুব অর্থপূর্ণ বেঁচে থাকা নয়। তাই কেউ সেগুলো নিয়ে কথা বলতে চায় না। সেটা নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগও করে না। শস্যক্ষেত্রের পাশে উঁচু ঢিবিতে দাঁড়িয়ে থেকে সবাই উত্তর দিকে তাকিয়ে রইল। বহুদূরে কোথাও আগুন লেগেছে, সেই আগুন থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে উঠছে। এটি কোনো নতুন দৃশ্য নয়, অনেকদিন থেকেই তারা দেখছে দূরে কোথা থেকে জানি মাঝে মাঝে কুণ্ডুলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে ওঠে। যতই দিন যাচ্ছে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলি আরো ঘন ঘন এবং আরো কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। কে জানে কোনো একদিন হয়তো এই গ্রামটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। এই গ্রামের বাড়িঘর, শস্যক্ষেত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর কুচকুচে কালো ধোঁয়া আকাশে পাক খেয়ে উঠতে থাকবে।

    রুহান নিঃশব্দে দূরে তাকিয়ে রইল, কালো ধোয়ার রেখাঁটি একটি অশুভ সংকেতের মতো ঝুলছে, সেটি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। সেটা কত দূরে কেউ জানে না। পৃথিবীতে এখন কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই, তাই ঠিক কোথায় কী ঘটছে তা কেউ অনুমান করতে পারে না। মাঝে মাঝে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অপরিচিত কোনো মানুষ যখন এই গ্রামের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যায়, সবাই তখন তাকে ঘিরে ধরে তার কাছ থেকে জানতে চায়–সে কোথা থেকে এসেছে, কী দেখেছে। এছাড়া সেই মানুষগুলোর কেউ কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতে চায় না, তাড়া খাওয়া পশুর মতো তারা ভীত আতঙ্কিত মুখে তাকিয়ে থাকে। মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে অস্পষ্ট দুই একটি কথা বলে আরো দক্ষিণের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। কেউ কেউ উদাসী মুখে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ঘটনার বর্ণনা দেয়, সেই সব ঘটনার সবকিছু বিশ্বাস করা যায় কী না সেটাও কেউ জানে না।

    বৃদ্ধ কুর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে। যাও সবাই নিজের কাজে যাও।

    আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের দুই-একজন আবার মাথা নাড়ল কিন্তু কেউ চলে গেল না। দিনের আলো থাকতে থাকতে তারা মাঠে, শস্যক্ষেতে কাজ করে কিন্তু বেলা পড়ে এলে তাদের কারো বেশি কিছু করার থাকে না। বৃদ্ধ কুরু শেষবারের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলিটা একবার দেখে উঁচু ঢিবি থেকে নিচে নামতে শুরু করে।

    এতক্ষণ রুহান চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে বৃদ্ধ কুরুকে বলল, কুরু আমি তোমার সাথে আসি?

    আসবে? এসো।

    রুহান হাত ধরে বৃদ্ধ কুরুকে উঁচু ঢিবি থেকে নামতে সাহায্য করল, ব্যাপারটি আজকাল একটু অস্বাভাবিক। মানুষ যখন দুঃসময়ে থাকে তখন ছোটখাটো দ্রতা বা ভালোবাসাটুকুও নিজের ভেতর আড়াল করে রাখে, অন্যদের সামনে প্রকাশ করতে চায় না। বৃদ্ধ কুরু একটু হেসে বলল, রুহান, তুমি জোয়ান ছেলে, আমার মতো বুড়ো মানুষের সাথে কী করবে? যাও নিজের বয়সী ছেলে-মেয়ের সাথে হৈ হুঁল্লোড় করো।

    রুহান হাসল। বলল, সেটা তো সবসময়েই করি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায় তখন হৈ হুঁল্লোড় করতে ভালো লাগে না।

    বৃদ্ধ কুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত, রুহান যে তোমার বয়সী একটা ছেলেকে এরকম কথা বলতে হচ্ছে। মন খারাপ তো তোমাদের হবার কথা নয়-মন খারাপ হবে আমাদের মতো বুড়ো মানুষদের।

    রুহান কোনো কথা বলল না। বৃদ্ধ কুরুর পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। গ্রামের পাথর ছড়ানো পথের দুপাশে ঝোপঝাড়। বাসাগুলো লতাগুল্ম। দিয়ে ঢেকে আছে। বাসার ছাদে সোলার প্যানেলগুলোতে শেষ বিকেলের সোনালি আলো। বাতাসে শরতের হিমেল স্পর্শ।

    বৃদ্ধ কুরু তার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। ভারী দরজার সামনে লাগানো ছোট মডিউলে চোখের রেটিনা স্ক্যান করানোর সাথে নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল। বৃদ্ধ কুরু ঘরের ভেতরে ঢুকে রুহানকে ডাকল, এসো রুহান।

    রুহান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তুমি এখন রেটিনা স্ক্যান করে ঘরে কে?

    বৃদ্ধ কুরু দুর্বল ভঙ্গিতে হেসে বলল, ক্রিস্টালগুলোর জন্যে তা না হলে আমার ঘরে মূল্যবান কী আছে, বল?

    রুহান মাথা ঘুরিয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার অনেকগুলো এস্টাল?

    বলতে পারো। এত ক্রিস্টাল দিয়ে তুমি কী করবে?

    বৃদ্ধ কুরু হাসার চেষ্টা করে বলল, জানি না কী করব। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন পুরো পৃথিবীতে নেটওয়ার্ক ছিল। পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যে কোনো জায়গা থেকে তথ্য আনতে পারত। এখন তো আর পারে না। তাই ক্রিস্টালগুলো জোগাড় করেছিলাম—যতটুকু সম্ভব তথ্য জমা করে রাখার জন্যে এত তথ্য তো আমি সারাজীবনে দেখতে পারব না, তবু এক ধরনের সখ।

    তোমার কাছে কীসের কীসের ক্রিস্টাল আছে কুরু?

    বৃদ্ধ কুরু একটু হেসে বলল, কীসের নেই! ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস থেকে শুরু করে নীল তিমি, পরমাণু থেকে গ্যালাক্সী, প্রেতচর্চা থেকে বিজ্ঞান সবকিছু আছে।

    পৃথিবীর সব ক্রিস্টাল কী কারো কাছে আছে?

    উঁহু। সেটি সম্ভব না। জ্ঞান তো থেমে থাকে না। নতুন জ্ঞানের জন্ম হলেই নতুন ক্রিস্টালে সেটা রাখা হয়। তাই একজনের কাছে কখনোই সব ক্রিস্টাল থাকতে পারে না।

    রুহান বৃদ্ধ কুরুর ঘরের একটা পুরানো চেয়ার টেনে সেখানে বসে বলল, কুরু, তোমার কী মনে হয় এখনো পৃথিবীতে নতুন জ্ঞানের জন্ম হচ্ছে? নতুন ক্রিস্টালে সেটা লেখা হচ্ছে?

    বৃদ্ধ কুরু কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি জানি না রুহান। যদি সত্যি সত্যি সেটা বন্ধ হয়ে থাকে, তাহলে বুঝবে পৃথিবীতে সভ্যতা বলে আর কিছু নেই।

    রুহান আর বৃদ্ধ কুরু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, বাইরে পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যেতে থাকে, সন্ধ্যেবেলা মানুষের মতো সব পশুপাখিও মনে হয় ঘরে ফিরে আসে। রুহান উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, কুরু, আমার মাঝে মাঝে মাথার মধ্যে খুব ভয়ানক একটা চিন্তা আসে।

    বৃদ্ধ কুরু জিজ্ঞেস করল, কী চিন্তা?

    আমাদের যে ক্রিস্টাল রিডারগুলো আছে, সেগুলো যদি এক সময় নষ্ট হয়ে যায় তখন কী হবে?

    নষ্ট হয়ে যায়?

    হ্যাঁ।

    কিন্তু  বৃদ্ধ কুরু ঠিক বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, নষ্ট হয়ে যায় মানে কী?

    এখন যদি আমি আমার কথা জমা করতে চাই, ক্রিস্টাল রিডারে সেটা জমা থাকে। শুনতে চাই ক্রিস্টাল রিডারে শুনতে পাই। কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে ক্রিস্টাল রিডারে খোঁজ করি। সবকিছু আমরা করি ক্রিস্টাল রিডার দিয়ে—

    হ্যাঁ। বৃদ্ধ কুরু এখনো ঠিক বুঝতে পারছে না, ভুরু কুঁচকে বলল, ক্রিস্টাল রিডার দিয়েই তো করব।

    রুহান বলল, কিন্তু ক্রিস্টাল রিডার তো একটা যন্ত্র। একটা যন্ত্র তো নষ্ট হতেই পারে। পারে না?

    কিন্তু এটা তো সেরকম যন্ত্র না। এর মাঝে কিছু নড়ছে না, কিছু ঘুরছে না। ক্রিস্টালের অণুগুলোর মাঝে তথ্য সাজানো হয় সেখান থেকে তথ্য বের হয়ে আসে।

    রুহান একটু উত্তেজিত গলায় বলল, কিন্তু তারপরেও সেটা তো নষ্ট হতে পারে। আমাদের গুরুনের ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হয়ে গেছে না?

    বৃদ্ধ কুরু হেসে বলল, গুরুনের কথা ছেড়ে দাও। সে নিদানি পাতার নির্যাস খেয়ে নেশা করে তার ক্রিস্টাল রিডারটা ফায়ার প্লেসের আগুনে ফেলে দিয়েছে। সেটা নষ্ট হবে না তো কী হবে?

    তা যাই হোক, কিন্তু তার ক্রিস্টাল রিডার তো নষ্ট হয়েছে। এখন সে পাগলের মতো একটা খুঁজছে-খুঁজে পাচ্ছে না। আমি শুনেছি পৃথিবীতে আর ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয় না।

    বৃদ্ধ করু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি পৃথিবীর নেটওয়ার্ক ধ্বংস হবার পর আর ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয় না। শেষ ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগে।

    রুহান বৃদ্ধ কুরুর সামনে একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, তাহলে? তাহলে হলে তুমি বল, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে? যখন কারো কাছে ক্রিস্টাল রিডার থাকবে না, তখন কী হবে? ছোট বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে নতুন কিছু কেমন করে শিখবে?

    বৃদ্ধ কুরু বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি এভাবে চিন্তা করি নি। আমরা আমাদের সব তথ্য, সব জ্ঞানের বিনিময়, সব কিছু করি ক্রিস্টাল রিডার দিয়ে যদি আমাদের ক্রিস্টাল রিডার না থাকে তখন কী হবে আমি জানি না–

    রুহান উত্তেজিত গলায় বলল, কিন্তু সবসময় তো ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন মানুষ কী করত?

    একসময় কম্পিউটার নামে একটা যন্ত্রে কথা বলত। তার আগে হাত দিয়ে কিছু সুইচে করে তথ্য পাঠাত, তার আগে ছিল কাগজ আর কলম। পাতলা এক ধরনের সেলুলয়েড আর কালি বের হবার এক ধরনের টিউব। তার আগে ছিল গাছের পাতা–তার আগে মাটির আস্তরণ–

    রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। গাছের পাতা, মাটির আস্তরণ আর কাগজে কেমন করে তথ্য সংরক্ষণ করত। এগুলো তো যন্ত্র নয়, এর পরমাণু তো সংঘবদ্ধভাবে সাজানো থাকে না!

    না না না। বৃদ্ধ কুরু মাথা নেড়ে বলল, তখন অন্য একটা ব্যাপার ছিল। সব ভাষার তখন লিখিত রূপ ছিল। অক্ষর ছিল, বর্ণ ছিল সেগুলো দিয়ে মানুষ তাদের কথাকে লিখে রাখত।

    লিখে রাখত?

    হ্যাঁ! এখন আমরা কিছু বললেই সেটা যেরকম সংরক্ষিত হয়ে যায় আগে সেটা ছিল না। আগে কিছু সংরক্ষণ করতে হলে সেটা বিশেষ বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে লিখতে হতো। সেই চিহ্নগুলো মানুষ মনে রাখত, সেটা দেখে তারা বলতে পারত কী লেখা আছে। সব শিশুকেই তার জীবনের শুরুতে লেখা আর পড়া ব্যাপারটা শিখতে হতো। সেটা শেখার পর তারা জ্ঞান অর্জন শুরু করতে পারত।

    কী আশ্চর্য! রুহান অবাক হয়ে বলল, কী জটিল একটা প্রক্রিয়া।

    হ্যাঁ। এখন ক্রিস্টাল রিডারে চাপ দিলেই কথা! ছবি ও ভিডিও বের হয়ে আসে। আগে সেটা ছিল না। আগে যে চিহ্নগুলো দেখে মানুষ পড়তো, সেই চিহ্নগুলোর নাম ছিল বর্ণমালা বা এলফাবেট।

    কী আশ্চর্য! রুহান মাথা নেড়ে বলল, তুমি এত কিছু কেমন করে জান?

    বৃদ্ধ কুরু হেসে বলল, আমি বুড়ো মানুষ। আমার তো কোনো কাজকর্ম নেই, আমি তাই বসে বসে আমার ক্রিস্টালগুলো দেখি! প্রাচীন কালে মানুষ কী করত তা আমার জানতে বড় ভালো লাগে।

    রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও এগুলো খুব জানার ইচ্ছে করে। এক সময় এসে তোমার ক্রিস্টালগুলো দেখে যাব

    এসব জানার অনেক সময় পাবে রুহান। এখন গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এসব শেখ। চিকিৎসা বিজ্ঞান শেখ-যখন আমার মতো বুড়ো হবে তখন অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে।

    রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি বুড়ো হতে হতে যদি সব ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হয়ে যায়, তখন?

    বৃদ্ধ কুরু হাত দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে বলল, দোহাই তোমার! এন্ড্রোমিডার দোহাই, এরকম ভয়ঙ্কর কথা বলো না। আমার ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হবার আগে যেন আমার মৃত্যু ঘটে।

    তোমার মৃত্যু হলে তুমি বেঁচে যাবে। কিন্তু আমাদের কী হবে?

    বৃদ্ধ কুরু মাথা নেড়ে বলল, এই মন খারাপ আলোচনা থাকুক রুহান। তার চাইতে বলো তুমি কী খাবে? আমার কাছে খুব ভালো স্নায়ু উত্তেজক একটা পানীয় আছে।

    রুহান হেসে বলল, আমার স্নায়ু এমনিতেই অনেক উত্তেজিত। স্নায়ু শীতল করার কোনো পানীয় থাকলে আমাকে দাও।

    বৃদ্ধ কুরু রান্নাঘরের শীতল কক্ষ থেকে একটা পানীয়ের বোতল বের করে দুটি স্বচ্ছ গ্লাসে সেটা ঢালতে ঢালতে বলল, স্নায়ুকে শীতল করে লাভ নেই। জোয়ান বয়সের ছেলে-মেয়ের স্নায়ু বুড়োদের মতো শীতল হবে কেন? তোমাদের স্নায়ুতে সবসময়েই থাকবে উত্তেজনা। একেবারে টান টান উত্তেজনা!

    রুহান তার গ্লাসটি হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিতেই সারা শরীরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বুকের ভেতর চেপে থাকা দুর্ভাবনাগুলো কেটে মাথার ভেতরে ফুরফুরে এক ধরনের আনন্দ এসে ভর করে। সে জিব দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, চমক্কার পানীয় কুরু।

    হ্যাঁ। খুব চমৎকার! এই পানীয় এমনি এমনি খেতে হয় না। চমক্কার একটা সঙ্গীত শুনতে শুনতে এটি খেতে হয়। প্রাচীন একটা সঙ্গীত।

    রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, শোনাবে কুরু?

    কেন শোনাব না? তুমি হাট্টা কাট্টা জোয়ান একটা মানুষ, এই বুড়ো মানুষের ঘরে এসেছ, বুড়ো মানুষের প্রাচীন একটা সঙ্গীত তোমাকে তো শুনতেই হবে।

    বৃদ্ধ কুরু উঠে গিয়ে শেলফে রাখা ক্রিস্টাল রিডারের কাছে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় একটা নির্দেশ দিতেই ঘরের ভেতরে হালকা নীল আলোর একটা বিচ্ছুরণ হলো এবং পর মুহূর্তে ঘরের কোণায় ত্রিমাত্রিক একটা কিশোরী মেয়েকে দেখা গেল। হলোগ্রাফিতে মেয়েটিকে একটি জীবন্ত রূপ দেয়া হয়েছে, সেই রূপটি এত নিখুঁত যে দেখে মনে হয় মেয়েটিকে বুঝি স্পর্শ করা যাবে। কিশোরী মেয়েটি এদিক সেদিক তাকিয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলে, শরতের এই সন্ধ্যেবেলায় তুমি কেমন আছ কুরু?

    মেয়েটি সত্যি নয়, এটি শুধুমাত্র একটি হলোগ্রাফিক ছবি, কিন্তু সেটি এত জীবন্ত যে তার সাথে সত্যিকারের মানুষের মতো কথা না বলে উপায় নেই। বৃদ্ধ কুরু তাই নরম গলায় বলল, আমি ভালোই আছি মেয়ে। আমাকে একটা প্রাচীন গান শোনাতে পারবে?

    প্রাচীন? কত প্রাচীন?

    এবারে রুহান উত্তর দিল। বলল, প্রাচীন। অনেক প্রাচীন। মানুষ যখন যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে নি, একে অন্যকে মারা শুরু করে নি সেই সময়কার গান।

    মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, সেরকম গান তো একটি দুটি নয়, অসংখ্য। তোমাকে আরো নির্দিষ্ট করে বলতে হবে।

    রুহান বলল, ঠিক আছে, বলছি। সেই গানে নদী আর নদীর ঢেউয়ের কথা থাকতে হবে। আকাশ ভরা কালো মেঘের কথা থাকতে হবে। একটা মেয়ে আর একটা ছেলের ভালোবাসার কথা থাকতে হবে। বিরহের কথা থাকতে হবে-

    আরো কিছু?

    হ্যাঁ। যে গান শুনে বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকবে সেরকম একটা গান।

    মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলল, চমৎকার! প্রাচীন সঙ্গীত-কলার সবুজ ক্রিস্টালটা ঢোকাতে হবে।

    কুরু শেলফের ডালা খুলে প্রাচীন সঙ্গীত-কলার সবুজ ক্রিস্টালটা ক্রিস্টাল রিডারে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরে হলোগ্রাফের কিশোরী মেয়েটি আবছা হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে আর প্রায় সাথে সাথে সারা ঘরে বিষণ্ণ একটা সুর বেজে ওঠে। বহুদূর থেকে কোনো একজন একাকী নারীর করুণ কণ্ঠ শোনা যায়। সেই কণ্ঠে একই সাথে ভালোবাসা এবং বেদনা। আনন্দ এবং যন্ত্রণা। রুহান তার হাতের পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।

     

    রুহান যখন বৃদ্ধ কুরুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো তখন বেশ রাত। আকাশে একটা ভাঙ্গা চাঁদ, চারিদিকে তার নরম জ্যোৎস্নার আলো। ঝিঁঝিপোকা ডাকছে এবং মাঝে মাঝে দূর বনাঞ্চল থেকে রাত জাগা পশুর ডাক শোনা যাচ্ছে। রুহান হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করে শরতের শুরুতেই বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। জ্যাকেটের কলার একটু উপরে তুলে সে হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। একটু আগে শুনে আসা প্রাচীন সঙ্গীতের রেশটুকু এখনো তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। কী অপূর্ব আর মায়াময় সেই কণ্ঠস্বর, এখনো সেটি যেন তার বুকের ভেতর হাহাকারের মতো শূন্যতা তৈরি করে যাচ্ছে।

    আনমনে হাঁটতে হাঁটতে রুহান হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, কাছাকাছি কোনো একটি বাসা থেকে একজন মানুষের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর আর একটি মেয়ের কান্নার শব্দ। ভেসে আসছে। রুহান শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যায়, ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর আর কান্নার শব্দটি আসছে কিসিমার বাসা থেকে। তাদের এলাকার সবচেয়ে সাদাসিধে। সবচেয়ে শান্তশিষ্ঠ আর সবচেয়ে নিরীহ পরিরার হচ্ছে কিসিমাদের পরিরার। গাছপালায় ঢাকা তার ছোট বাসার সামনে কিছু মানুষের জটলা, রুহান-গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গ্রাউসকে দেখতে পায়। গ্রাউসের সামনে কিসিমা এবং তাকে। শক্ত করে ধরে রেখেছে কিসিমার মেয়ে ত্রায়িনা। ত্রায়িনার চোখে মুখে আতঙ্ক, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

    গ্রাউসের বয়স রুহান থেকে খুব বেশি নয় কিন্তু তাকে অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। সে লম্বা এবং চওড়া, তার পেশীবহুল শক্ত দেহ, সোনালি চুল এবং নীল চোখ। গাউস সুদর্শন কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তাকে দেখলে তার সুদর্শন চেহারাটুকু চোখে না পড়ে নিষ্ঠুর ভঙ্গিটুকু প্রথমে চোখে পড়ে।

    রুহানকে ঢুকতে দেখে গ্রাউস ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে কী করতে এসেছ?

    আমি এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তোমাদের কথা শুনে এসেছি।

    আমাদের কথা শুনে তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রাউস চোখ লাল করে বলল, তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে যাও।

    গ্রাউসের কথা শুনে রুহান একই সাথে এক ধরনের ক্রোধ এবং অপমান অনুভব করে। সে শীতল গলায় বলল, এটি কিসিমাদের বাসা। আমি এখানে থাকব না চলে যাব সেটি বলবে কিসিমা–তুমি নয়।

    গ্রাউস হিংস্র পশুর মতো একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার বেশি সাহস হয়েছে, তাই না?

    রুহান মাথা নেড়ে বলল, না। আমার মোটেও সাহস বেশি হয় নি। তারপর মাথা ঘুরিয়ে কিসিমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে কিসিমা? এয়িনা কাঁদছে কেন?

    কিসিমার মুখে এক ধরনের হতচকিত ভাব, দেখে মনে হয় একটা কিছু বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রাউস বলছে তার ত্রায়িনাকে দরকার।

    রুহান চমকে উঠে গ্রাউসের মুখের দিকে তাকাল। গ্রাউসের মুখটি হঠাৎ আরো কঠোর হয়ে যায়। গলা উঁচিয়ে বলল, বলেছিই তো। বলেছি তো কী হয়েছে?

    রুহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তুমি কী বলছ। গ্রাউস?

    গ্রাউস হঠাৎ হাত দিয়ে রুহানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুমি কোথাকার মাস্তান, আমাকে উপদেশ দিতে এসেছ?।

    রুহান পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে গ্রাউসের দিকে তাকাল। গ্রাউস হিংস্র মুখে বলল, রুহান, তুমি আমার সাথে লাগতে এসো না। তোমাকে আমি শেষ করে দেব।

    রুহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, কাউকে শেষ করে দেয়া এত সহজ নয় গ্রাউস।

    গ্রাউস হিংস্র মুখে বলল, তুমি দেখতে চাও?

    না, আমি দেখতে চাই না। কিন্তু আমাদের গ্রামটি এখনো জঙ্গল হয়ে ওঠে নি যে যার যেটা ইচ্ছা সে সেটা করতে পারবে।

    গ্রাউস এবারে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, রুহান, তাহলে নতুন জীবনের জন্যে প্রস্তুত হও। তোমার প্রিয় গ্রামটাতে এখন নতুন পৃথিবীর নিয়ম আসতে যাচ্ছে।

    তুমি কী বলতে চাইছ?

    আমি বলতে চাইছি আমার যেটা ইচ্ছা আমি সেটা করব।

    রুহান মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা সবাই মিলে কিছু নিয়ম ঠিক করেছি

    রুহানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে গ্রাউস বলল, ঐ সব মান্ধাতা আমলের নিয়মের দিন শেষ। নতুন পৃথিবীতে এখন নতুন নিয়ম।

    সেই নিয়মটা কী?

    যার ক্ষমতা আছে তার ইচ্ছাটাই হচ্ছে নিয়ম।

    রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে গ্রাউসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যি কেউ এরকম একটি কথা বলতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না। খানিকক্ষণ নিঃশব্দে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার ক্ষমতা আছে?

    আছে।

    তোমার ইচ্ছাটি তাহলে নিয়ম?

    হ্যাঁ।

    রুহান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এখন তোমার ইচ্ছে কিসিমার ছোট মেয়ে ত্রায়িনাকে তুলে নিয়ে যাবে?

    গ্রাউস মুখে একটা অশালীন ভঙ্গি করে বলল, সে মোটেই ছোট মেয়ে নয়। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে।

    বেশ। রুহান হঠাৎ করে নিজের ভেতরে এক ধরনের অদম্য ক্রোধ অনুভব করে। সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, দেখি তাহলে তুমি কেমন করে ত্রায়িনাকে তুলে নিয়ে যাও। রুহান দুই পা এগিয়ে কিসিমা আর ত্রায়িনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, এসো।

    গ্রাউস কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, কাজটা ভালো করলে না রুহান।

    রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রাউস হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে চলে যেতে শুরু করে, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্য তোমাকে মূল্য দিতে হবে রুহান।

    রুহান নিচু গলায় বলল, দেব।

    অনেক মূল্য।

    দেব।

    গ্রাউস চলে যাবার পর রুহান মাথা ঘুরিয়ে কিসিমা আর তার মেয়ে ত্রায়িনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা ভেতরে যাও, অনেক রাত হয়েছে।

    কিসিমা ভাঙ্গা গলায় বলল, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব রুহান-

    এখানে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই।

    ত্রায়িনা ফেঁপাতে ফোঁপাতে বলল, যদি আবার আসে?

    আসবে না। তোমরা ভালো করে দরজা বন্ধ করে রেখ। আমি ভোরবেলা সবার সাথে কথা বলব। ভয় পাবার কিছু নেই।

    ত্রায়িনা বড় বড় চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?

    হ্যাঁ। সত্যি–কথা বলবে গিয়ে রুহানের গলা কেঁপে উঠল, কারণ সে জানে কথাটি আসলে সত্যি নয়। নতুন পৃথিবীতে সবকিছু পাল্টে গেছে, এখন কোথাও কোনো নিয়ম নেই। এখানে যার শক্তি বেশি, যার ক্ষমতা বেশি তার ইচ্ছেটাই হচ্ছে নিয়ম। ঠিক গ্রাউস যেভাবে বলেছে।

     

    খাবার টেবিলে মা বলল, রুহান এত রাত করে ফিরেছিস! দিন কাল ভালো না জানিস না?

    রুহান প্লেটের শুকনো রুটিটা পাতলা স্যুপে ভিজিয়ে নরম করে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, কেন মা? দিন কাল নতুন করে আবার খারাপ হলো কেন?

    দেখছিস না কী হচ্ছে? যার যা খুশি সেটা করা শুরু করেছে।

    মা কী নিয়ে কথা বলছে রুহান সেটা ভালো করে জানে। পৃথিবীর এক এলাকার সাথে এখন অন্য এলাকার কোনো যোগাযোগ নেই, প্রত্যেকটা এলাকা। এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কোনোভাবে টিকে আছে। কোথাও কোথাও পরিবেশ একেবারে নারকীয় কোথাও কোথাও সবাই মিলে এখনো মোটামুটি শান্তিতে বেঁচে আছে।

    রুহানদের এলাকাটা এতদিন বেশ ভালোই ছিল, বেঁচে থাকার জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করে সবাই দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সেটা আর থাকবে বলে মনে হয় না। একটু আগে সে নিজেই কিসিমার বাসায় গ্রাউসের কাজকর্ম দেখে এসেছে। তবুও সে কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, নতুন কিছু হয়েছে নাকি?

    মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে বলল, হয়নি আবার। প্রত্যেকদিনই কিছু একটা হচ্ছে। এই তো সেদিন কয়জন এসে তিয়াশার বাসার একটা সোলার প্যানেল খুলে নিয়ে গেছে।

    রুহান এটার কথাও জানে, তারপরেও না জানার ভান করে বলল, তাই নাকি?

    হ্যাঁ। মা গলা নামিয়ে বলল, কিসিমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে গ্রাউস কয়দিন থেকে হুমকি দিচ্ছে শুনেছিস?

    রুহান একটু আগেই সেটা নিজের চোখে দেখে এসেছে, শেষ মুহূর্তে গ্রাউস পিছিয়ে না গেলে কিছু একটা হয়ে যেতে পারত কিন্তু মাকে সেটা বলার ইচ্ছে। করল না।

    মা আড় চোখে তারা ছোট দুটি মেয়ে নুবা আর ত্রিনার দিকে তাকাল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, এই দুজন যখন বড় হবে তখন যে কী হবে!

    রুহান তার ছোট দুই বোনের দিকে তাকাল। সে তার মায়ের সাথে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এই মুহূর্তে ক্রিস্টাল রিডারে নতুন একটা ক্রিস্টাল ঢুকিয়ে বিচিত্র একটা সঙ্গীতের মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করছে। এই বয়সের ছেলে-মেয়ের নিজেদের একটা জগত আছে, তার বাইরে যারা থাকে তারা সেই জগতটার কিছুই বুঝতে পারে না।

    মা নুবা আর ত্রিনার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো? তোরা খাবার টেবিলে বসে কী শুরু করেছিস? খাচ্ছিস না কেন?

    নুবা ঠোঁট উল্টে বলল, তোমার এই শুকনো রুটি আর জ্যালজেলে স্যুপ দুই মিনিট পরে খেলে কিছু ক্ষতি হবে না।

    মা একটু আহত গলায় বলল, এটাই যে পাচ্ছিস তার জন্যেই খুশি থাক। সামনে কী দিন আসছে কে জানে?

    ক্রিস্টাল রিডার থেকে একটা বিদঘুটে শব্দ বের হয়ে এলো। সাথে সাথে দুই বোন হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। মা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, কী হচ্ছে? এই বিদঘুটে শব্দের মাঝে তোরা হাসির কী পেলি?

    ত্রিনা মুখ গম্ভীর করে বলল, তুমি বিদঘুটে কী বলছ মা? এটা নতুন ধরনের সঙ্গীত। এটা যে তৈরি করেছে তার চেহারা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। সবুজ রঙের চুল, গোলাপি-

    ব্যস! অনেক হয়েছে। মা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, যে মানুষের চুল সবুজ, তাকে নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।

    নুবা বলল, কী বলছ মা? ক্রোমোজমের একটা জিনকে পাল্টে দিলেই চুল সবুজ হয়ে যায়। আমার যদি একটা ছোট জিনেটিক ল্যাব থাকত-

    থাক। এমনিতেই পারি না, এখন আবার জিনেটিক ল্যাব।

    নুবা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, রুহান, একটা জিনেটিক ল্যাব তৈরি করতে কত ইউনিট লাগবে?

    রুহান লাল রঙের পানীয়টা এক ঢোক খেয়ে বলল, সেটা তো জানি না! এখন তো আর ইউনিটেরও কোনো মূল্য নেই। পৃথিবীতে যখন নেটওয়ার্ক ছিল তখন সবকিছু করা যেত। এখন তো কিছু করারও উপায় নেই।

    ত্রিনা মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীটা কেন এরকম হয়ে গেলা রুহান?

    রুহান একটু মাথা নেড়ে বলল, সেটাই যদি জানতাম তাহলে তো কাজই হতো!

    ত্রিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে, বার বছরের ছোট কচি একটা মুখের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান একটা বিষণ্ণতা সেখানে এসে ভর করে। বলে, সবাই মিলে

    পৃথিবীকে কেন আগের মতো করে ফেলে না?

    এই প্রশ্নটির উত্তর রুহানের জানা নেই। সে নিঃশব্দে খাবার টেবিলে বসে রইল।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleভূত সমগ্র – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article নাট বল্টু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }