Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প978 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৫. কপোট্রনিক অস্ত্ৰোপচার

    কপোট্রনিক অস্ত্ৰোপচার

    ডাক্তার এসে বললেন, বুলাকে বাঁচানো যাবে না। খবরটি শুনে আমার ভেঙে পড়ার কথা, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, আমার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। একটু পরে পারলাম, আমি আসলে ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করি নি। কেন বিশ্বাস করি নি জানি না, বুলা বেঁচে থাকবে এই অর্থহীন বিশ্বাস তখন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই অযৌক্তিক একরোখা বিশ্বাসের উৎস কী আমার জানা নেই, আমি আপাতত শুধু এই বিশ্বাসটি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। যদিও সামনা—সামনি দুটি গাড়ির ধাক্কা লেগে বুলার মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার দেহের শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপ সবই বাইরে থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তবু আমি আমার বিশ্বাসে অটল থাকলাম। আমি জানি, বুলা মারা গেলে আমি যে নিঃসঙ্গতায় ড়ুবে যাব, সেখান থেকে কেউ আমাকে টেনে তুলতে পারবে না। বুলার জন্যে নয়, আমার নিজের জন্যেই বুলাকে বাঁচানো দরকার।

    এক সপ্তাহ আগে বুলা এই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে অচেতন হয়ে আছে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের যতটুকু চিকিৎসা হওয়া দরকার, বুলাকে তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার অনুরোধে বিশেষ একটি সার্জন-রবোটকে পর্যন্ত বিশেষ বিমানে আনা হয়েছিল এবং সেটি অপারগতা জানিয়েছে। তিন দিনের বেশি কাউকে কৃত্রিম দৈহিক ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু আমার অনুরোধে বুলা এক সপ্তাহ যাবৎ কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস, রক্তসঞ্চালন আর তরল খাদ্যসার নিয়ে বেঁচে আছে। এখনো তার জ্ঞান হয় নি, ডাক্তাররা বলেছেন, জ্ঞান হবে না। যেই মুহূর্তে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস বা রক্তসঞ্চালন বন্ধ করে দেয়া হবে, ঠিক তক্ষুণি তার মৃত্যু ঘটবে। বলা বাহুল্য, আমি বিশ্বাস করি নি।

    একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর ব্যাঙ্কে যে-পরিমাণ টাকা থাকা দরকার আমার টাকা তার থেকে অনেক বেশি। মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতি বিক্রয় করে আমি এই অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা পেয়েছিলাম। আমি ব্যাঙ্ক থেকে আমার সব টাকা তুলে নিলাম। সে-টাকা দিয়ে প্রথমে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের পুরো সেট, কৃত্রিম রক্তসঞ্চালনের নিওক্লিও পাম্প, জীবনরক্ষাকারী প্লাজমা জ্যাকেট ইত্যাদি কিনে বাসায় বুলার জন্যে একটি জীবাণুন্নিরোধক ঘর প্রস্তুত করলাম। তারপর হাসপাতাল থেকে বুলাকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাসায় নিয়ে এলাম। এর পরের দিনই তার কৃত্রিম দৈহিকব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার কথা। ডাক্তাররা বুলার জীবনরক্ষার জন্যে এই অহেতুক অকাতর টাকা ব্যয় করতে দেখে একটু বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাঁরা বললেন, বুলা আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর প্লাজমা জ্যাকেটে উষ্ণ দেহে শুয়ে থাকবে সত্যি, কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এরকম কোনো আশা নেই। বলা বাহুল্য, আমি তবু আমার একরোখা বিশ্বাসে অবিচল থাকতাম।

    আমার মনে একটি ক্ষোভ জন্মেছিল। বুলা যদি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক না হয়ে প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী হত, তা হলে তাকে বাঁচানোর আরও অনেক চেষ্টা করা হত। সে যতটুকু বাড়তি চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছে, সেটিও আমার স্ত্রী হিসাবেই। বুলা দেশের কাছে একজন সাধারণ নাগরিক, কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু, আমার ছেলে টোপনের কাছেও। বলতে দ্বিধা নেই, এই ধরনের আবেগে ব্যাকুল হয়ে উঠতে আমার এতটুকু লজ্জা করছিল না।

    অচেতন বুলার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি প্রথম দুটি দিন কাটিয়ে দিলাম। বুলা সুন্দরী, কিন্তু কাচের গোলকে এই অসহায় সমর্পণের ভঙ্গিতে তার ফর্সা মুখ যেভাবে স্থির হয়ে ছিল, দেখতে গিয়ে আমি প্রথমবারের মতো তার অস্বাভাবিক সৌন্দর্য অনুভব করলাম। কালো চুলের বন্যায়। তার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠত। আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হত, বুলা এক্ষুণি জেগে উঠবে, তারপর আমার চোখে চোখ রেখে হাসবে, গত দশ দিন আমি যেটি দেখি নি, ডাক্তাররা বলেছেন, সেটি আমি আর কোনোদিন দেখিব না।

     

    চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ, বিশেষত অস্ত্ৰোপচারে অভিজ্ঞ সার্জন-রবোট সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। সরকারি নিয়ন্ত্রণে এগুলি বিভিন্ন হাসপাতাল এবং রিসার্চ সেন্টারে কাজ করে। আমি বিশেষ উপায়ে এই নিয়ম ভঙ্গ করে একটি সর্বশেষ মডেলের সার্জন-রবোট কিনে আনলাম। সেটির নাম রু-টেক।

    বুলাকে নিয়ে আমি কী করতে যাচ্ছি বুঝিয়ে বলার পর রু-টেক অনেকক্ষণ ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খানিকটা দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, কিন্তু এর সফলতার সম্ভাবনা শতকরা মাত্ৰ দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য পাঁচ।

    সম্ভাবনা শূন্য হলেও আমি বুলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব।

    অহেতুক পরিশ্রম হবে না কি? একটি সাধারণ মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে এত কিছু করার প্রয়োজন আছে?

    আছে। তুমি বোধশক্তিহীন রবোট, তাই একজন সাধারণ মেয়ে আমার কাছে কতটুকু হতে পারে বুঝতে পারছি না।

     

    রবোট রু-টেক শেষ পর্যন্ত এই জটিল অস্ত্ৰোপচার শুরু করল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ওকে নির্দেশ দিই, কখনো কখনো নিজেও হাতে চাকু তুলে নিই। টোপনকে অস্ত্ৰোপচারের শুরুতেই নার্সারি স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যাবার সময় বুলার কাছে যাবার জন্য খুব কাঁদছিল, আমি ধমক দিয়ে নিরস্ত করেছি।

    সারা বাসায় আমরা তিনজন। প্লাজমা জ্যাকেটে অচেতন বুলা, তার মাথার পাশে দুটি যন্ত্র; একটি রু-টেক, যে যন্ত্র হয়ে জন্মেছে, আরেকটি আমি, যে বুলাকে বাঁচানোর জন্যে যন্ত্র হয়েছি, আহার-নিদ্ৰা ত্যাগ করেছি। ঘড়ির কাঁটা টিক্‌টিক করে সময়কে বয়ে নিয়ে চলল। সেকেণ্ড মিনিট ঘন্টা একটির পর একটি দিনকে আমার অজান্তে জীবন থেকে খরচ করে ফেলতে লাগল, আর বদ্ধ ঘরে আমি কুলার মাথার উপর রু-টেককে নিয়ে এক জটিল অন্ত্রোপচার করতে থাকলাম। মাঝে মাঝে অস্ত্ৰোপচার করতে করতে ক্লাস্তিতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, হাত অবশ হয়ে কাঁপতে থাকে, আমি কাঁচি নামিয়ে রেখে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি। রু-টেকের ডাক শুনে একসময় উঠে টলতে টলতে আবার বুলার মাথার সামনে ঝুঁকে পড়ি।

    এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কেউ করতে পারত না, কিন্তু তবু আমি করে যাচ্ছিলাম, কারণ আমি জানি বুলা আবার বেঁচে উঠবে। আমার একরোখা বিশ্বাস এখন শুধু বিশ্বাস নয়, এটি এখন নিশ্চিত সত্য। আমি জানি আর দেরি নেই, অচেতন বুলা আবার চোখ মেলে তাকাবে।

    তারপর সত্যি একদিন রু-টেক হাতের কাঁচি নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকাল, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কাজ শেষ, স্যার।

    চমৎকার। কথা বলতে গিয়ে আমার গলা কোঁপে উঠল। বুলার মুখের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে আমি তার উপর ঝুঁকে পড়লাম। তারপর আলতোভাবে ওর কপাল স্পর্শ ডাকলাম, বুলা, বুলা–

    খুব ধীরে ধীরে বুলা চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল, অনিশ্চিতভাবে। তারপর তাকিয়ে রইল।

    বুলা।

    বুলার চোখে প্রশ্ন জমে উঠল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমি আবার ডাকলাম, বুলা, বুলা—

    বুলা তবু কোনো কথা বলল না। কী করে বলবে? ওর কোনো স্মৃতি নেই। মস্তিষ্কে তীব্র আঘাত পেয়ে ও সব ভুলে গেছে। ওর কিছু মনে নেই—একটি কথাও নয়।

     

    রু-টেককে আমি বিদায় দিচ্ছিলাম। বাসার সামনে তাকে নেয়ার জন্যে একটি স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, রু-টেক, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার সাহায্য ছাড়া কখনো বুলাকে বাঁচাতে পারতাম না।

    রু-টেক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ধন্যবাদ।

    এই প্রতিভাধর রবোটটি সত্যি ভীষণ সাহায্য করেছে। কিন্তু তবুও আমি ওকে খুব তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিচ্ছিলাম। দরকার ছাড়া কোনো রবোট আমি বাসায় রাখতে চাই না, বুলার এই মানসিক অবস্থাতে তো একেবারেই নয়।

    রু-টেক আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরের দিকে পা দিতেই আমি ডাকলাম, শোন।

    বলুন।

    এখানে তুমি যা যা করেছ সব ভুলে যাবে।

    কেন, স্যার?

    কারণ আছে। আমি দৃঢ়স্বরে বললাম, তুমি কাউকে কিছু বলবে না, সব ভুলে যাবে। ভুলে যাও…

    রবোটকে মানুষের কথা মানতে হয়। তাই কপোট্রনে বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে রু-টেক তার সব স্মৃতি ধ্বংস করে ফেলল।

     

    বুলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, আমি তুকে সবু নূতন করে শেখাচ্ছি— একেবারে গোড়া থেকে। বুলা অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার কথা শোনে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, আশ্চর্য! আমার একটুও মনে নেই।

    আমি তাকে তার ছেলেবেলার গল্প করলাম। একসময় সেগুলি তার মুখেই শুনেছিলাম। তারপর তার ছাত্রজীবনের গল্প করে শোনালাম, ব্যক্তিগত ডাইরি, কিছু চিঠিপত্র খুব কাজে দিল। শেষে তার সাথে আমার বিয়ের পুরো ঘটনাটি বললাম। শুনতে শুনতে ও লজ্জা পেল, হাসল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, কী বোকা ছিলাম!

    সবশেষে ওকে ওর অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটি শোনালাম। ও নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে গেল। ডাক্তারদের অপারগতার কথা শুনতে শুনতে ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। আমার একরোখা বিশ্বাস আর জোর করে বাঁচিয়ে তোলার ঘটনা শুনতে শুনতে ওর চোখ কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বলে, কেন বাঁচালে আমাকে?

    বাঃ! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচিব কেমন করে?

    বুলা সরলভাবে হাসে। বলে, ভাগ্যিস তুমি ছিলে, নইলে কবে মরে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াতাম!

    আমার সবরকম পরামর্শ শুনে শুনে ও ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠতে থাকে। একদিন টেপ রেকর্ডারে ওর দুর্ঘটনার আগে টেপ করে রাখা গান শুনে বুলা অবাক হয়ে যায়। বলে, আমি নিজে গেয়েছিলাম?

    হ্যাঁ। তুমি চমৎকার গান গাইতে পারতে। এখনও নিশ্চয়ই পার।

    যাঃ।

    সত্যি। চেষ্টা করে দেখ। গাও দেখি–

    বুলা প্রথমে একটু লজ্জা পায়, তারপর চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে ওঠে।

    একদিন হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আমি কি আগের থেকে খুব বদলে গেছি?

    তা তো গিয়েছ অল্প কিছু। এত বড় একটা দুর্ঘটনা—

    আমাকে শুধরে দিও, আমি ঠিক আগের মতো হতে চাই।

    বেশ। আমি বুলাকে খুঁটিনাটি সব বিষয় শুধরে দিই—আর ও ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠতে থাকে।

    একদিন ওকে আমি টোপনের কথা বললাম। ও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে শুনল, তারপর ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলে?

    হ্যাঁ, আমাদের ছেলে।

    সত্যি বলছি? আমার-মানে আমার নিজের ছেলে?

    হ্যাঁ, তোমার নিজের ছেলে।

    ওর নাম কি? কী রকম দেখতে? কত বড়?

    আস্তে আস্তে! আমি বুলাকে শান্ত করি, দেখতেই তো পাবে।

    কখন দেখব? কোথায় আছে?

    নার্সরি স্কুলে। কাল নিয়ে আসব।

    না না, কাল নয়, এক্ষুণি নিয়ে এস। কত বড়? কি নাম?

    পাঁচ বছর বয়স। টোপন নাম।

    টোপন?

    হ্যাঁ।

    আমাকে দেখলে চিনতে পারবে?

    বাঃ! মাকে বুঝি ছেলেরা চিনতে পারে না।

    সত্যি চিনতে পারবে তো? আমি যে চিনি না। বুলার কণ্ঠস্বর করুণ হয়ে ওঠে।

    আমি সত্ত্বনা দিই, তাতে কী হয়েছে, একবার দেখলেই চিনে ফেলবে, আর কখনো ভুলবে না।

    তুমি নিয়ে এস। বুলা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর হাত আঁকড়ে ধরে বলে, আমার ছেলেকে দেখব।

    তবু আমি দেরি করতে থাকি, আর চোখের সামনে বুলা মা হয়ে উঠে। টোপনের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।

    টোপনকে নিয়ে আসার পর সে তার মাকে দেখে একমুহূৰ্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বুলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুলার বুকে মুখ গুঁজে জড়িত স্বরে আমার বিরুদ্ধে একরাশ নালিশ করতে থাকে, আমি কীভাবে তাকে তার মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি বলতে বলতে তার চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। বুলা বিস্ফারিত চোখে টোপনকে আকড়ে ধরে, তারপর ফিসফিস করে বলে, কী আশ্চর্য! আমার ছেলে! আমার নিজের ছেলে।

    আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।

     

    দীর্ঘ দু বছর সময়ে বুলা ধীরে আগের বুলা হয়ে ওঠে। ও এখন ঠিক আগের মতো গান গাইতে পারে, ঠিক আগের মতো হাসে, আগের মতো হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সব কবিতার লাইন আউড়ে ওঠে। সারাদিন পরিশ্রম করে ফিরে এলে ও গভীর মমতায়। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকিয়ে থাকে। দুঃস্বপ্নের মতো অসহায় অচেতন স্মৃতিহারা বুলাকে আমি দ্রুত ভুলে যেতে থাকি।

    ও এখন ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠেছে—শুধু একটি বিষয় ছাড়া। ওকে আমি বিজ্ঞানবিষয়ক একটি অক্ষরও শেখাই নি। কেন জানি আমার ধারণা হয়েছে, নিষ্ঠুর বিজ্ঞান বুলার জন্যে নয়, বুলা অফুরন্ত মমতার উৎস–ভালবাসার ধারা।

     

    সেদিন টোপন, ওর বয়স এখন সাত, এসে বলল, ওদের স্কুলে বিজ্ঞানমেলা। আমাকে আর বুলাকে যেতে হবে। আমার অনেক কাজ, স্কুলের ছেলেমানুষি বিজ্ঞানমেলায় যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বুলা যাক, সেটিও আমার ঠিক ইচ্ছে নয়। কিন্তু টোপনকে সেকথা বোঝাবে কে? টোপন বহু আগে থেকেই তার মার কাছে অনেক গল্প করে রাখল।

    আমরা নিজেরা টেলিস্কোপ তৈরি করেছি। মঙ্গল গ্রহের দুটো চাঁদই সেটা দিয়ে দেখা যায়।

    সত্যি।

    হ্যাঁ। একটা ডিমোস, আরেকটার নাম ফোবোস।

    বাঃ। বুলা ওকে উৎসাহ দেয়।

    ইলেকট্রন মাইক্রোঙ্কোপও তৈরি করেছি।

    যাঃ।

    সত্যি। বিশ্বাস করা। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে একটা রবোট। তুমি গেলে তোমার সাথেও কথা বলবে। সেখানে ভিড় সবচেয়ে বেশি।—তবু তোমাকে ঠিক আমি নিয়ে যাব। আমি আবার ক্যাপ্টেন কিনা।

    কাজেই বুলাকে টোপন বিজ্ঞানমেলায় নিয়ে গেল। আমি গেলাম অফিসে, মনে খানিকটা অস্বন্তি কেন জানি খচখচ করতে লাগল।

     

    সন্ধেয় ফিরে এসে দেখলাম বাসা অন্ধকার। একটু অবাক হয়ে সিঁড়ি বেয়ে শোবার ঘরে হাজির হলাম। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দেখলাম, জানালার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

    কে?

    কোনো কথা না-বলে মূর্তিটি খুব ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সেটি বুলা পরনের কাপড় অবিন্যস্ত, চুল এলোমেলো। দু চোখ টকটকে লাল আর গাল বেয়ে চোখের পানির শুকনো ধারা। আমি বিক্ষিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, বুলা, কী হয়েছে?

    বুলা পাথরের মতো চুপ করে রইল। আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না।

    বুলা! আমি আর্তম্বরে চিৎকার করে উঠলাম। সে হঠাৎ তীব্র দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি মিথ্যা কথা বললে কেন?

    কি?

    তুমি বলেছ। আমি বুলা, আসলে আমি একটা রবোট। তারপর ও হঠাৎ আকুল হয়ে হু-হু করে কোঁদে উঠল।

    আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম-আমার এত চেষ্টার পরও বুলা সব জেনে গেছে। হঠাৎ কেন জানি অসহায় বোধ করলাম, আমার কিছু করার নেই। বুলার ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক বদলে আমি একটি কপোট্রন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওর মস্তিষ্ক কোনোভাবেই সারানো যেত না, তাই আমি এই বিকল্পটি বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি সত্যিই তো ও বুলা হয়েছিল! গভীর বেদনায় আমার বুক টনটন করে ওঠে। আমি ডাকলাম, বুলা!

    বুলার চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। বলল, বল রবোট!

    না—আমি চিৎকার করে উঠলাম। বুলা, পাগল হয়ো না। আমার কথা শোন। তোমায় কে বলেছে তুমি রবোট?

    টোপনের বিজ্ঞানমেলায় একটা মেটাল ডিটেকটর ছিল, বুলা কান্না সামলে বলতে থাকে, আমি কাছে যেতেই সেটি টিকটিক করে উঠল। তারপর আমি গিয়েছি কপোট্রনের ফার্মে। ওরা বলেছে, আমার মাথায় মস্তিষ্ক নেই, তার বদলে পারমাণবিক ক্যাটারিসহ একটা কপোট্রন কাজ করছে।

    আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। তারপর বললাম, তাতে ক্ষতি হয়েছে কি? তুমি কাঁদাছ কেন?

    তবে কি হাসব? আনন্দে চিৎকার করব? বুলা কান্না সামলাতে সামলাতে বিকৃত স্বরে বলল, কী আশ্চর্য! আমি তুচ্ছ একটা রবোট, অথচ আমি ভাবছি আমি বুলা, টোপনের মা, তোমার স্ত্রী–কুলা কান্নার বেগ সামলাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল।

    আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। এত কষ্ট করে বুলার দেহে আমি আবার বুলাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। আমার সামনেই তা আবার ধ্বংস হয়ে যাবে? আমি বুলাকে দু হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলাম, তারপর চিৎকার করে ডাকলাম, বুলা।

    কি? ওর সারা মুখ চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে।

    শোন বুলা, তুমি যদি এখনও এরকম কর—আমি তীব্র স্বরে বললাম, তা হলে এক্ষুনি তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলব।

    বুলা বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে আমার দিকে তাকাল।

    হ্যাঁ। তোমাকে অজ্ঞান করে আবার তোমার মাথায় নূতন কপোট্রন বসাব, আবার নূতন করে তোমার মাঝে বুলাকে ফিরিয়ে আনব…

    বুলা বিশ্বফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বলে চললাম, তোমাকে আমার চাই-ই চাই। তোমার জন্যে শোন বুলা, শুধু তোমার জন্যে আমি তোমার ধ্বংস হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক বদলে নূতন কপোট্রন বসিয়েছি। তোমার ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, ভালবাসা আছে। তোমার টোপন আছে, আমি আছি—তবু তুমি এরকম করছ?

    তুমি বুকে হাত দিয়ে বল, তোমার বুকে আমার জন্য ভালবাসা নেই? টোপন তোমার ছেলে না? থাকুক তোমার মাথায় কপোট্রন। মানুষ কৃত্রিম চোখ, কৃত্রিম হাতপা, ফুসফুস নিয়ে বেঁচে নেই? তবে কেন পাগলামি করছ?

    কথা বলতে বলতে আমার সব আবেগ স্রোতের মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। কে জানত আমার ভিতরে এত আবেগ লুকিয়ে ছিল।

    তোমার নিজেকে তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, তুমি বুলা কি না। বুলার চোখ, মুখ, হাতু, পা, চুল—সবকিছু বুলার, শুধু তোমার মস্তিষ্কটি কৃত্রিম, তাতে যে-অনুভূতি, সেটি পর্যন্ত বুলার, আমি নিজের হাতে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি। তবু তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ।

    আমার কী স্বাৰ্থ? তোমাকে প্ৰাণ দেয়ার আমার কী স্বাৰ্থ? রবোটের সাহায্যে তোমার মস্তিষ্ক বদলে মানবিক আবেগসম্পন্ন কপোট্রন তৈরি করে সেখানে বসানোতে আমার কী স্বাৰ্থ? শুধু তোমাকে পাওয়া-তোমাকে তোমাকে তোমাকে…

    আমি বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে বুলাকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে লাগলাম।

    বুলা আমার বুকে মাথা গুঁজে বলল, তাহলে আমিই বুলা?

    হ্যাঁ, তুমিই বুলা। পৃথিবীতে আর কোনো বুলা নেই।

    টোপনি আমার ছেলে?

    হ্যাঁ। টোপন তোমার ছেলে, তোমার আর আমার।

    তুমি আমার—

    আমি তোমার?

    বুলা উত্তর না দিয়ে হাসল। আমি ওর চুলে হাত বোলাতে লাগলাম। এই চুলের আড়ালে বুলার মাথায় একটি কপোট্রন লুকানো আছে। কিন্তু ক্ষতি কি? এই কপোট্রন আমাকে ভালবাসে, টোপনকে স্নেহ করে, আনন্দে হাসে, দুঃখ পেলে কাঁদে। হলই-বা কপোট্রন!

    আমি বুলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleটুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }