Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ২ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প892 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৩. মহাকাশযান

    মহাকাশযান

    সুহানের হাতে একটি বিচিত্র অস্ত্র। অস্ত্রটি সে নিজে তৈরি করেছে। একটি ধাতব নলের সাথে একটি হাতল লাগানো। নলের মাঝে সে খানিকটা বিস্ফোরক রেখে তার সামনে ছোট একটি বুলেট রাখে। বুলেটের মাঝে থাকে চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক। হাতলের সাথে একটা ট্রিগার লাগানো আছে। ট্রিগারটি টেনে ধরার সাথে সাথে বিস্ফোরকে ছোট একটি বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ আঘাত করে। বুলেটটি ছুটে যায় সাথে সাথে। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার পর চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরকে ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণ হয়। অস্ত্রটিতে নতুন করে বিস্ফোরক ভরে সহান বহু দূরে একটি পাথরের দিকে তাক করে দাঁড়ায়। ট্ৰিনি নিচু গলায় বলল, সুহান, তুমি অযথা সময় নষ্ট করছ।

    কেন?

    এই অস্ত্রটি দিয়ে তুমি কখনো লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না।

    কেন?

    কারণ এর মাঝে দৃষ্টিবদ্ধ করার জন্যে কোনো লেজাররশ্মি নেই। লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যে কোনো মেগা কম্পিউটার নেই। তোমার হাতে যেটা রয়েছে সেটা একটি খেলনা।

    সুহান তীক্ষ্ণ চোখে দূর পাথরটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খেলনা দিয়ে খেলতে ভালবাসি।

    এটি শুধু খেলনা নয়, এটি একটি বিপজ্জনক খেলনা। তুমি এর মাঝে চার মাত্রার বিস্কোরকে তৈরী একটা বুলেট রেখেছ। এটি তোমার হাতে বিস্ফোরিত হবার সম্ভাবনা তের দশমিক চার।

    এই গ্রহে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল চার দশমিক নয়। তুমি আমাকে শুধু শুধু জ্বালাতন করছ।

    সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরল। তার ত্রাতের অস্ত্রটি থেকে ভয়ঙ্কর একটা শব্দ করে বুলেটটি বের হয়ে যায়। দূরে একটি বিক্ষেরণ হয়। তার লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে।

    ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে বলেছি, তুমি এটা দিয়ে কখনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে না।

    এক শ বার পারব। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে বুলেটটা নিচে নেমে আসছে। লক্ষ্যবস্তুর একটু উপরে তাক করলে—

    তোমার যুক্তি হাস্যকর। অস্ত্র মাত্রই এই ধরনের হিসেব করতে পারে। তোমার খালি চোখে আন্দাজ করে নিশানা করা পুরোপুরি অর্থহীন। সময় এবং শক্তির অপচয়। সবচেয়ে বড় কথা—এটি বিপজ্জনক।

    হোক বিপজ্জনক। আমি এভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে চাই। খালি চোখে আন্দাজ করে। হাতের স্পর্শে।

    কেন?

    আমার ইচ্ছে।

    ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান শুনতে পায়, তার মাথা থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। ট্ৰিনি তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সংবেদনশীল করে কিছু একটা শোনার বা দেখার চেষ্টা করছে। নিজে থেকে তাকে কিছু বলল না বলে সুহান কিছু জিজ্ঞেস করল না।

    সুহান তার অস্ত্রটিতে বিস্ফোরক ভরে আবার সেখানে একটি বুলেট ঢুকিয়ে নেয়। ভালো করে দেখে সে আবার দুই হাতে অস্ত্রটি তুলে ধরে দূরে তাক করে, আগের বার যেখানে তাক করেছিল এবারে তার থেকে একটু উপরে। সমস্ত ইন্দ্রিয় একাগ্র করে সে লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাকায়। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে এক ঝলক কালো ধোঁয়ায় তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ধোয়াটা সরে যেতেই সে অবাক হয়ে দেখে, লক্ষ্যবস্তুর পাথরটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সুহান আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেল, ট্ৰিনি তখনো সামনে তাকিয়ে আছে। তার সংবেদনশীল চোখে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। তার সংবেদনশীল শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। সুহান খানিকক্ষণ ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রিনি।

    বল।

    আমি এইমাত্র আমার অস্ত্রটি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছি।

    ও।

    তুমি শুনে অবাক হলে না? কী ব্যাপার? তুমি কী দেখছ।

    না, কিছু না।

    সুহান শব্দ করে হেসে বলল, তুমি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তোমার পক্ষে মিথ্যা কথা বলা সম্ভব নয়। তুমি যখন চেষ্টা কর সেটা আমি খুব সহজে ধরে ফেলি।

    ট্ৰিনি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি মোটেই মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করছি না। আমি কিছু দেখছি না।

    তুমি কি কিছু দেখার চেষ্টা করছ?

    আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই।

    সুহান আবার শব্দ করে হেসে ফেলে বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষি রবোট! তোমার ভিতরে একেবারে কোনোরকম জটিলতা নেই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কাল রাত থেকে তুমি খুব বিচিত্র রকম ব্যবহার করছ। আমার কাছে তুমি কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছ।

    ট্ৰিনি কোনো কথা বলল না, যার অর্থ সত্যিই সে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। সুহান বলল, আমি ইচ্ছে করলেই বের করতে পারি তুমি আমার কাছে কী লুকানোর চেষ্টা করছ। করব?

    না।

    সুহান আবার হেসে ফেলল। বলল, ঠিক আছে, তুমি থাক তোমার গোপন কথা নিয়ে।

    সে আবার তার বিচিত্র অস্ত্রটি নিয়ে তার মাঝে বিস্ফোরক ভরতে থাকে। এটি তার একটি নতুন খেলা।

    ট্ৰিনি বহুদূরে তাকিয়ে তার সংবেদনশীল চোখটি আরো সংবেদনশীল করে ফেলে। মাটিতে সে কুড়ি হার্টজ তরঙ্গের উপর সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ এবং নব্বই মেগাহার্টজ তরঙ্গের সুষম উপস্থাপন অনুভব করেছে। প্রথমত, এই গ্রহে প্রাকৃতিক উপায়ে এই কম্পন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। তাছাড়া কুরু মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনের কম্পনের প্রথম হারমোনিক সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ। বৈদ্যুতিক জেনারেটরের কম্পন নব্বই মেগাহার্টজ। তাহলে কি সত্যিই একটি কুরু মহাকাশযান নেমেছে এই গ্রহের মাটিতে? সুহানকে সে কি বলবে তার সন্দেহের কথা? যদি সেটা সত্যি না হয়? সুহানের তাহলে খুব আশাভঙ্গ হবে। আশাভঙ্গ একটি মানবিক ব্যাপার, সে আশাভঙ্গ ব্যাপারটি কী জানে না, কিন্তু দেখেছে। আশাভঙ্গ হলে সুহান দীর্ঘ সময় বিমুখে বসে থাকে। এটি অনেক বড় ব্যাপার। এবারে আশাভঙ্গ হলে সুহান কি সেটা সহ্য করতে পারবে?

    ট্রিনির কপোট্রনে পরস্পরবিরোধী বেশ কয়েকটি চিন্তা খেলা করতে থাকে। সে দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট, পরস্পরবিরোধী চিন্তায় অভ্যস্ত নয়। কিছুক্ষণের মাঝেই সে তার কপোট্রনের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কপোট্রনের সেই অংশটি তার শরীরের যে কয়টি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তার একটি হচ্ছে ডান হাত। সুহান দেখতে পায়, ট্রিনির ডান হাতটি প্রথমে দ্রুত কাঁপতে থাকে, তারপর এক সময় হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নড়তে থাকে।

    সুহান আগেও এ ধরনের ব্যাপার ঘটতে দেখেছে। ব্যাপারটির কৌতুককর অংশটি কখনো তার চোখ এড়ায় নি, এবারেও এড়াল না। সে তার বিচিত্র অস্ত্রটি শুইয়ে রেখে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে।

     

    ০২.

    সুহান মহাকাশযানের জানালায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাস। প্রথম সূর্য অস্ত গিয়েছে। দ্বিতীয় সূর্যটি মোটেও প্রখর নয়, চারদিকে কেমন এক ধরনের লালাভ আলো। বছরের এই সময়টাতে হঠাৎ করে এই গ্রহের আবহাওয়া খুব খাপছাড়া হয়ে ওঠে। ভয়ঙ্কর ঝড় হয়, উত্তপ্ত লাল বালু বাতাসে উড়তে থাকে। পাথর ভেঙে ভেঙে পড়ে, বাতাসে হু-হু করে বিচিত্র শব্দ হয় তখন। কেমন এক ধরনের মন খারাপ করা শব্দ। সুহান তখন মহাকাশযান থেকে বেশি বাইরে যায় না। চার দেয়ালের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বসে তার ছোট ছোট যন্ত্রগুলো দাঁড়া করায়। যন্ত্রগুলো সহজ এবং বিচিত্র। মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো তথ্য ব্যবহার না করে তৈরী। ট্রিনি এই যন্ত্রগুলো দেখে একই সাথে বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়, তার কপোট্রনের সহজ যুক্তিতর্কে দুটোর মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই। বিরক্তির কারণটুকু সহজ। এই ধরনের ছেলেমানুষি যন্ত্রের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। ট্রিনির ধারণা, এগুলো তৈরি করা অহেতুক সময় নষ্ট করা। বিস্ময়টুকু অবশ্যি খাটি। মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো তথ্য ব্যবহার না করে এই যন্ত্রগুলো তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। যে পরিমাণ খুঁটিনাটি এবং মৌলিক জ্ঞানের প্রয়োজন, এই শতাব্দীতে মনে হয় কোনো মানুষ একসাথে সেই জ্ঞান অর্জন করে নি। চেষ্টা করলে সম্ভব নয় সেটি সত্যি নয়, কিন্তু চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে কেউ চেষ্টা করে নি। ট্রিনির মতে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন জ্ঞান।

    সুহান জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের ঝড়ো হাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তপ্ত বালুরাশি শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক আগে বাই ভার্বালে করে ট্রিনি পাহাড়ের দিকে উড়ে গেছে। এই রকম দুর্যোগের মাঝে ট্রিনির মতো একটি রবোটের বাইরে কী কাজ থাকতে পারে কে জানে। সুহান ব্যাপারটি নিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে হাল ছেড়ে দেয়। হয়তো আবহাওয়ায় কোনো বড় পরিবর্তন আসছে, সে তার খোজ নিতে যাচ্ছে, গত ঝড়ে যেরকম হয়েছিল। কিংবা কে জানে হয়তো বিচিত্র কোনো নিশাচর প্রাণী এসেছে, গত বছর যেরকম এসেছিল। কিংবা কে জানে হয়তো পানির একটা বড় হ্রদ খুঁজে পেয়েছে, যেটা তারা অনেকদিন থেকে খুঁজছে।

    সুহান মেঝেতে রাখা তার জেনারেটরটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহাকাশযানের বেশ কয়েকটি জেনারেটর আছে। তার মাঝে একটির বেশ কিছু অংশ খুলে সে তার নিজের মতো করে একটি জেনারেটর তৈরি করেছে। বিশাল তারের কুণ্ডলী একটা শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের মাঝে ঘুরছে। জেনারেটরটি ঘোরানো নিয়ে সমস্যা, যখন এ রকম ঝড়ো হাওয়া আসে সে জানালায় একটা টারবাইন লাগিয়ে জানালাটি খুলে দেয়। আজও দিয়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় টারবাইনটি ঘুরছে, সেটি ঘোরাচ্ছে জেনারেটরটি, সেখান থেকে মোটামুটি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ হচ্ছে। সুহান মেপে দেখল, ইচ্ছে করলে সে সত্যিকারের কিছু শক্তিশালী ব্যাটারি বিদ্যুতায়িত করে ফেলতে পারে। আপাতত তার সেরকম কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করার ইচ্ছা নেই। একটা টেসলা কয়েল জুড়ে দিয়েছে, সেখান থেকে শব্দ করে নীলাভ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে উত্তপ্ত বালু এসে ঘরের মাঝে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছে, সুহান তার মাঝে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকে।

    দরজা খুলে যখন ট্ৰিনি ঘরে ঢুকেছে তখন বাতাসের ঘূর্ণিতে ঘরের জিনিসপত্র উড়ছে। বাতাসের প্রচণ্ড গজন ঘরের মাঝে গুমরে উঠছে। লাল বালুতে ঘর অন্ধকার, সুহানের সমস্ত শরীর, মাথার চুল, চোখের ভুরু পর্যন্ত ধুলায় ধূসর। ট্রিনিকে দেখে সুহান একটু লজ্জা পেয়ে যায়। জানালাটা ঠেলে বন্ধ করে দিতেই হঠাৎ ঘরের ভিতরে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। সুহান ঘরের চারদিকে তাকিয়ে একটা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ট্রিনি, তুমি যদি একটু আগে আসতে তাহলে একটা অপূর্ব জিনিস দেখতে পেতে। টারবাইনের গিয়ারে বালু জমা হয়ে গিয়ারটা বন্ধ হয়ে গেল, না হয়—

    সুহান।

    চমৎকার বিদ্যুৎপ্রবাহ হয়। ইচ্ছে করলে ব্যাটারির সাথে—

    সুহান—

    কী হল?

    সুহান, তুমি একটু স্থির হয়ে বস।

    কেন ট্রিনি?

    আমি তোমাকে খুব একটা জরুরি জিনিস বলব।

    সুহান হঠাৎ একটু ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে ট্রিনি, তুমি কী বলবে?

    জিনিসটি বলার আগে আমি নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে গিয়েছিলাম।

    কী জিনিস ট্রিনি?

    আমাদের এই গ্রহে একটা মহাকাশযান নেমেছে সুহান। পৃথিবীর মহাকাশযান।

    সুহান হতবাক হয়ে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে ঠিক বুঝতে পারছে না ট্রিনি কী বলছে।

    ট্রিনি দুই হাতে সুহানকে শক্ত করে ধরে শান্ত গলায় বলল, সুহান, আমরা এই দিনটির জন্যে গত মোলো বছর থেকে অপেক্ষা করছি। আজকে সেই দিনটি এসেছে। পৃথিবীর মানুষ এসেছে এই গ্রহে। তারা তোমাকে বুকে করে আগলে নেবে সুহান।

    সুহান তখনো বিস্ফারিত চোখে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিসফিস করে বলল, মানুষ?

    হ্যাঁ সুহান।

    সত্যিকারের মানুষ?

    হ্যাঁ।

    আমার মতো মানুষ? আমার মতো?

    হ্যাঁ সুহান। তোমার মতো।

    তুমি নিজের চোখে দেখেছ? নিজের চোখে?

    হ্যাঁ সুহান, আমি নিজের চোখে দেখেছি।

    সুহান কেমন একটা ঘোরের মাঝে ক্রোমিয়াম দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে ধুলা পরিষ্কার করতেই ঝকঝকে আয়নার মতো স্বচ্ছ দেয়ালে তার প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। সুহান অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। কতকাল সে নিজেকে দেখে নি! তাকে দেখে কী কর, মানুষ? সে কাঁপা গলায় বলল, ট্রিনি।

    বল সুহান।

    আমার—আমার চুল কি খুব বেশি বড়?

    না সুহান। মানুষের চুল এ রকম বড় হয়।

    পোশাক? আমার পোশাক?

    সুহান, তোমার পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

    কিন্তু আমার পুরো শরীর ঢেকে যেতে হবে না?

    আমি তোমাকে এক টুকরা নিও পলিমার বের করে দেব।

    তারা কি আমার ভাষায় কথা বলবে?

    নিশ্চয়ই তারা তোমার ভাষায় কথা বলবে। পৃথিবীতে মানুষের একটি ভাষা। আমি তোমাকে সেই ভাষা শিখিয়েছি সুহান।

    আমাকে দেখে পৃথিবীর মানুষ কী করবে ট্রিনি?

    আমি নিশ্চিত; তারা হতবাক হয়ে যাবে। যখন জানবে তুমি একা একা এই গ্রহে বড় হয়েছ, তারা তোমাকে বুকে টেনে নেবে।

    তুমি নিশ্চিত ট্রিনি?

    আমি নিশ্চিত।

    সুহান অনিশ্চিতের মতো ক্রোমিয়ামের স্বচ্ছ দেয়ালে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তার মতো মানুষের সাথে দেখা হবে তার? সত্যি দেখা হবে?

     

    ০৩.

    কিরি এবং লাইনা মহাকাশযানের ছোট ল্যাবরেটরিতে বসে আছে। ছোট একটা স্কাউটশিপ বাইরে থেকে কিছু পাথরের নমুনা এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে বাতাস নিয়ে এসেছে। নমুনাগুলো পরীক্ষা করে পৃথিবীর সাথে তুলনা করে সেগুলো একটি মনিটরে দেখানো হচ্ছিল। তুলনাটুকু বিস্ময়কর। জলীয় বাষ্পের অভাবটুকু ছাড়া হঠাৎ দেখে এটিকে পৃথিবী বলে ভুল করা সম্ভব। তাদের সামনে যে তথ্য রয়েছে সেটা দেখে মনে হয় পৃথিবীর মানুষ কোনোরকম পোশাক ছাড়াই এই গ্রহে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারবে। আশ্চর্য, এই তথ্যটুকু যখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে দেখছিল তখন মাথার কাছে স্ক্রিনে মহাকাশযানের নিরাপত্তা রবোটের ধাতব কণ্ঠস্বর শোনা গেল, মহামান্য কিরি, মহাকাশযানের বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।

    কিরি অবাক হয়ে বলল, কী বললে?

    একজন মানুষ।

    কিরি লাইনার দিকে তাকাল, তারপর অবাক হয়ে স্ক্রিনে নিরাপত্তা রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, একজন মানুষ?

    হ্যাঁ মহামান্য কিরি, একজন মানুষ। মনে হয় সে মহাকাশযানের ভিতরে আসতে চাইছে।

    লাইনা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল, কোথায়? কোথায় মানুষ?

    আমি স্ক্রিনে দেখাচ্ছি মহামান্য কিরি এবং মহামান্যা লাইনা।

    হঠাৎ করে দেয়ালের বিশাল স্ক্রিনে একজন অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরের মুখ ভেসে ওঠে। ঝড়ো বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার পোশাক উড়ছে। উত্তপ্ত ধুলায় ধূসর হয়ে আছে তার মুখ, তার লম্বা কালো চুল। হাত দিয়ে মুখ থেকে লম্বা চুল সরিয়ে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহাকাশযানের দিকে। কালো চোখে এক আশ্চর্য মুগ্ধ বিস্ময়।

    লাইনা কাঁপা গলায় বলল, মানুষ! একজন সত্যিকারের মানুষ।

    হ্যাঁ।

    কোথা থেকে এল?

    নিশ্চয়ই বিধ্বস্ত মহাকাশযান থেকে। নিশ্চয়ই কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিল।

    আর কেউ কি আছে?

    মনে হয় না। থাকলে এই কিশোরটি একা এখানে আসত না।

    তুমি বলছ এই কিশোরটি একা একা এই গ্রহে আছে?

    আমি জানি না কিন্তু আমার তাই মনে হয়।

    লাইনা উত্তেজিত হয়ে বলল, ওকে ভিতরে আসতে দাও। একা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে!

    কিরি মুখ ঘুরিয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানের নীতিমালায় জীবন্ত প্রাণী নিয়ে অনেক রকম বাধানিষেধ আছে।

    জীবন্ত প্রাণী? লাইনা চিৎকার করে বলল, এটি জীবন্ত প্রাণী নয় কিরি—এটি একজন মানুষ। সত্যিকারের মানুষ।

    কিরি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষ।

    এক্ষুনি দরজা খুলে ওকে ভিতরে আসতে দাও।

    কিরি লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, লাইনা, তুমি একটু শান্ত হও। আমি ওকে ভিতরে আনছি।

    কিরি প্রতিরক্ষা রবোটকে বলল, কিউ-৪৬, তুমি এই মানুষটকে ভিতরে আসতে দাও। দুই নম্বর চ্যানেল দিয়ে কোয়ারেন্টাইন ঘরে। ওর শরীর স্ক্যান শুরু কর, রোগজীবাণু ভাইরাস কিছু থাকলে রিপোর্ট কর কিন্তু তাকে সেটা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা কোরো না। হয়তো এই গ্রহে থাকার জন্যে তার কিছু একটা মাইক্রোব দরকার আমরা যেটা জানি না।

    ঠিক আছে মহামান্য কিরি।

    সাথে সাথে লাইনা ল্যাবরেটরি ঘরের দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, কিরি তাকে থামাল। জিজ্ঞেস করল, লাইনা—

    কী হল?

    কোথায় যাও?

    ছেলেটার সাথে দেখা করতে।

    একটু দাঁড়াও লাইনা। তাকে কোয়ারেন্টাইন ঘরে আসতে দাও। প্রাথমিক একটা পরীক্ষা শেষ করে নিতে দাও।

    কিন্তু–

    হ্যাঁ, আরেকটা কথা লাইনা। ছেলেটার কথা এখন যেন জানাজানি না হয়। শুধু তুমি আর আমি।

    কেন?

    কারণ আছে লাইনা। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি। ব্যাপারটা আমাদের ঠিক করে সামলে নিতে হবে। বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠো না!

    লাইনা আবার মাথা ঝাকিয়ে বলল, কিন্তু একজন মানুষ!

    আমি জানি লাইনা! আমাকে আগে তার সাথে দেখা করতে দাও। আমাকে আগে তার সাথে কথা বলতে দাও। তার কোনো ভাষা আছে কি না আমরা জানি না, যদি না থাকে, আমি তবুও তার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারব। তুমি পারবে না।

     

    ০৪.

    সুহান দীর্ঘ সময় মহাকাশযানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশযানটি ঠিক তার মহাকাশযানের মতো। সে জানে কোনটি ভিতরে প্রবেশ করার দরজা। সে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে জানে কোথায় ক্যামেরাগুলো আছে, সে দাঁড়িয়েছে যেন ঠিক করে তাকে দেখতে পায়। সে তার চুল পাট করে এসেছিল, বড় একটা নিও পলিমার কাপড় সারা দেহে জড়িয়ে। ঝড়ো বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, এখন তার পোশাক উড়ছে। মনে হয় সে নিজেও বুঝি উড়ে যাবে। যখন মনে হল সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, তখন হঠাৎ করে উপরের গোল দরজাটা খুলে গেল। সেখান থেকে প্রথমে একটা রবোটের মাথা উঁকি দিল এবং এক মুহূর্ত পরে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে আসে।

    সুহান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় ভিতরে চোখ ধাঁধানো আলো। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ লাগল তার অভ্যস্ত হতে। যখন হাত সরিয়ে চারদিকে তাকাল, দেখল একটা গোলাকার ঘরে সে কোঁ। ঘরের চারপাশে অনেক রকম যন্ত্রপাতি। উপরে একটি মনিটর। কিছু বাতি জ্বলছে এবং নিভছে, কোথা থেকে জানি তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আসছে।

    আমাকে স্ক্যান করছে, সুহান নিজেকে বোঝাল, আমাকে স্ক্যান করে দেখছে আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু আছে কি না। আমি জানি, নেই। এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ হয়েছে অন্যভাবে।

    সুহান চারদিকে তাকাল। নিশ্চয়ই মানুষেরা এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। পৃথিবীর মানুষের ভাষা তো একটিই। তার সাথে কথা বলতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়।

    হঠাৎ করে সামনের স্বচ্ছ দরজাটি খুলে গেল। সুহানের বুকে রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। উত্তেজনায় তার বুক ধকধক করতে থাকে। তাহলে কি সে সত্যিই দেখবে একজন মানুষ? পৃথিবীর মানুষ? সত্যিকারের মানুষ? সুহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখে ঠিক একজন খোলা দরজা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। দীর্ঘ দেহ, উজ্জ্বল চোখ, কপালের দুপাশে রুপালি রঙের ছোঁয়া। সুহান হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কখনো কি সে কল্পনা করেছিল একজন মানুষকে সে সত্যি দেখতে পাবে?

    মানুষের সাথে প্রথম দেখা হলে কী বলরে সব ঠিক করে রাখা আছে। সুহান মনে মনে সম্ভাষণটি কয়েকবার বলে একটু এগিয়ে যায়, তখন মানুষটি কোমল গলায় বলল, আমি কিরি। এই মহাকাশযানের দলপতি।

    সুহান অবাক হয়ে কিরির দিকে তাকাল, তার কথা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় নি। ঠিক তার ভাষাতেই কথা বলেছে, কিন্তু লোকটির কথায় কিছু একটা রয়েছে যেটাকে হঠাৎ করে খুব পরিচিত মনে হয়, সেটা কী সে ধরতে পারল না। কিরি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?

    সুহান মাথা নাড়ল, একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ তার মাথায় উঁকি দিতে থাকে।

    আমি তোমাকে আমাদের মহাকাশযানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

    সুহান বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে। কিরি মানুষ নয়। কিরি একজন রবোট। সে কেমন করে বুঝতে পেরেছে জানে না কিন্তু তার কোনো সন্দেহ নেই। খুব বড় ধাক্কা খেল সুহান, তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল কিরির দিকে, তারপর প্রায় ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি রবোট। এখানে মানুষ নেই? আমি মানুষের সাথে কথা বলতে চাই।

    কিরির মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় সাথে সাথে। কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান আমি রবোট?

    আমি জানি। সুহান প্রায় চিৎকার করে বলল, তোমাদের এখানে মানুষ নেই? মানুষ?

    সুহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিরি আহত গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে আমি রবোট? আমি দশম প্রজাতির রবোট আমার সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। আশ্চর্য!

    আমি সারা জীবন রবোটের সাথে থেকেছি, বর্বোট দেখলেই আমি বুঝতে পারি।

    কেমন করে?

    আমি জানি না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি।

    তোমার নাম কী ছেলে? তুমি কি একা এখানে?

    হ্যাঁ, আমি একা। আমার সত্যিকার নাম আমি জানি না, ট্ৰিনি আমাকে সুহান ডাকে।

    ট্রিনি?

    হ্যাঁ, ট্রিনি। একজন রবোট, সে আমাকে বড় করেছে।

    ও।

    সুহান আবার একটু অস্থির হয়ে কিরির দিকে তাকাল। বলল, কোনো মানুষ নেই এখানে? মানুষ?

    আছে। কিরি অন্যমনকের মতো বলল, আছে।

    আমি একজন মানুষ দেখতে চাই।

    দেখবে। অবশ্যি দেখবে। এস আমার সাথে।

    সুহান জীবনের প্রথম যে মানুষটি দেখল সে লাইনা। আলোকোজ্জ্বল একটি ঘরের মাঝখানে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, সেগুলো নিয়ে সুহানের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।

    লাইনা একটা দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে সুহানকে দেখে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন মানুষের দেহে এত রূপ থাকতে পারে এবং সেই মানুষটি সেই রূপ সম্পর্কে এত উদাসীন থাকতে পারে সে কখনো কল্পনা করে নি। এই অসম্ভব রূপবান মানুষটি একা একা এই নির্জন গ্রহে বড় হয়েছে, মানুষের ভালবাসা দূরে থাকুক, তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুভব করে নি, এই প্রথমবার সে একজন মানুষকে দেখেছে, চিন্তা করে হঠাৎ লাইনার বুকের মাঝে জানি কেমন করে ওঠে। কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যায়। সুহানের কাছাকাছি গিয়ে নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই সুহান। আমি লাইনা।

    মানুষের সাথে দেখা হলে কী করতে হয় সেটি সুহান থেকে ভালো করে সম্ভবত কেউ জানে না। অসংখ্যবার ব্যাপারটি সে কল্পনা করেছে কিন্তু লাইনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে তার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। সুহান জানে, একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষের দিকে তার হাত এগিয়ে দেয়, সেই হাত স্পর্শ করে ছেড়ে দিতে হয় কিন্তু সে লাইনার হাত ছেড়ে দিল না। দুই হাতে সেটিকে ধরে রেখে অনেকটা বিভ্রান্তের মতো লাইনাকে নিজের কাছে টেনে আনল। লাইনার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে হঠাৎ প্রায় আর্তস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, তুমি মেয়ে!

    লাইনা হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি মেয়ে।

    সুহান ফিসফিস করে বলল, আমি ছেলে।

    আমি জানি।

    আমি কখনো মেয়ে দেখি নি।

    আমি তাই ভাবছিলাম। তুমি আগে কখনো অন্য মানুষ দেখ নি।

    আমি তোমাকে দেখি?

    লাইনা একটু অবাক হয়ে বলল, দেখ।

    সুহান সাথে সাথে লাইনাকে কাছে টেনে আনে, দুই হাতে তার মুখটি স্পর্শ করে তার চোখের দিকে তাকায়। হঠাৎ সে কেমন জানি শিউরে উঠে বলল, মানুষের চোখ! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!

    কেন সুহান? আশ্চর্য কেন?

    আমি জানি না কেন, কিন্তু দেখ কী অপূর্ব! কী গভীর! চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আমি বুঝি হারিয়ে যাব। কী রকম একটা রহস্য।

    লাইনা সুহানের তীব্র চোখের দৃষ্টির সামনে হঠাৎ কেমন জানি অসহায় অনুভব করতে থাকে, বুকের মাঝে এক ধরনের আলোড়ন হতে থাকে। কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, সুহান–

    বল।

    তুমি তোমার নিজের চোখ দেখ নি?

    হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু নিজের চোখে তো নিজের কাছে কোনো রহস্য নেই। আমি তো আমাকে জানি। কিন্তু আরেকজনের চোখে রহস্য আছে। আমি তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। কিন্তু তোমার চোখের ভিতরে তাকালে মনে হতে থাকে আমি বুঝি তোমাকে কত কাল থেকে চিনি। মনে হয়, তোমার ভিতরে কত বিস্ময়।

    সুহান কথা থামিয়ে প্রায় হতবাক হয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

    লাইনা বিব্রত হয়ে বলল, সুহান—

    আমার আমার ইচ্ছে করছে—

    কী?

    আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে চেপে ধরি।

    লাইনা একটু কেঁপে উঠল। সুহান আবার কাতর গলায় বলল, লাইনা, তোমাকে আরেকটু দেখি?

    লাইনা কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে সুহানের দিকে তাকাল। সুহান ঠিক কী বলতে চাইছে সে বুঝতে পারল না, তবু অনিশ্চিতের মতো বলল, দেখ।

    সুহান ধীরে ধীরে তার হাত তুলে লাইনার মুখে, কপালে, গালে স্পর্শ করে। ঠোঁটে হাত বুলিয়ে তার চুলের মাঝে আঙুল প্রবেশ করিয়ে খুব সাবধানে চুলগুলো দেখে। তারপর লাইনা কিছু বোঝার আগে তাকে অনাবৃত করতে শুরু করে। লাইনা সুহানকে বাধা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল। সুহান অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কোনো কামনা নেই। শুধু কৌতূহল।

    লাইনা তাকে বাধা দিল না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আমি তপু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }