Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ২ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প892 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪. আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে

    আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে দেয়ালে বিশাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। স্ক্রিনে ছোট একটা হলঘরের ছবি। হলঘরের এক কোণায় মিয়ারা বসে আছে, তার সামনে কুচকুচ কালো একটি টেবিল। টেবিলের চারপাশে আরো পাঁচজন মানুষ। মানুষগুলির দুজন পুরুষ, একজন মহিলা এবং অন্য একটি নবম প্রজাতির ট্রিটন রবোট–যাকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। পঞ্চম মানুষটি পুরুষ কী মহিলা বোঝার উপায় নেই। হলঘরে শুধু মিয়ারাই সত্যি সত্যি শারীরিক ভাবে বসে আছে। অন্যেরা সরাসরি উপস্থিত নেই যতদূর সম্ভব নেটওয়ার্কে এসেছে। এই পাঁচজন। মানুষ মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশের নেতৃত্ব দখল করেছে।

    ট্রিটন রবোটটি নিচু গলায় বলল, আমার ধারণা আমরা এখানে সময় নষ্ট করছি। আমরা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করি না। কাজেই এখানে বসে আলোচনা করা অর্থহীন। এখানে কেউ সত্যি কথা বলছে না।

    মিয়ারা হাসির মতো শব্দ করে বলল, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতুককর যে একটি ট্রিটন রবোট নৈতিকতার কথা বলছে।

    রবোটটি মিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, মিয়ারা, তুমি খুব ভাল করে জান আমি নৈতিকতার কথা বলছি না। এই মহাকাশযানে এক ধরনের সংঘাত হচ্ছে, আমরা সেখানে একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি, সেখানে সম্মিলিত শক্তির কথা বলা অর্থহীন।

    হলঘরের দ্বিতীয় মহিলাটি নরম গলায় বলল, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন। মূল তথ্যকেন্দ্র এখনো বিশাল শক্তি নিজের কাছে রেখেছে, আমাদের প্রথমে সেটা বের করে আনতে হবে, শুধুমাত্র তাহলেই আমরা তার জন্যে হানাহানি শুরু করতে পারি।

    মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি-গোঁফের জংগল এরকম মানুষটি তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ভালই বলেছ তুমি। সবাই মিলে আক্রমণ করে খানিকটা সম্পদ কেড়ে নিয়ে নিজেরা মারামারি শুরু করি

    মিয়ারা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, এবারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, তোমরা জান মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে আমরা এখন বড় ধরনের বোঝাপোড়া করতে পারি। মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ আদেশে যে আটজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে আমার কাছে সেই মানুষগুলি রয়েছে।

    দেখে বোঝা যায় না পুরুষ না মহিলা সেরকম মানুষটি বলল, আমি জানি তুমি আমাকে সত্যি কথাটি বলবে না, তবু জিজ্ঞেস করছি, এই মানুষগুলির কি বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য রয়েছে?

    মিয়ারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি সেটা বলব না। তবে আমি উচ্চমূল্যে তাদের বিক্রি করতে রাজি আছি।

    ঘরের সবাই নড়ে চড়ে বসল এবং তাদের চোখে মুখে হঠাৎ আগ্রহ উত্তেজনা এবং কৌতূহল ফুটে ওঠে। মুখে মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফের মানুষটি একটু সামনে ঝুঁকে এসে বলল, আমি কমপক্ষে দুজন মানুষ কিনতে চাই। তুমি কী মূল্য চাও মিয়ারা?

    অষ্টম এবং নবম স্তরের এক চতুর্থাংশ জায়গা। মানুষটির চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে, কী বলছ তুমি?

    আমার পক্ষে এই ধূর্ত মানুষ এবং মানুষ জাতীয় রবোটগুলির কথাবার্তা শোনা রীতিমত কষ্টকর হয়ে ওঠে। নিচু গলায় মনিটরটিকে বললাম, আমি আর দেখতে চাই না।

    সাথে সাথে স্ক্রিনটি অন্ধকার হয়ে আসে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। আমার বুকের ভিতরে গভীর বিষণ্ণতা এসে ভর করতে থাকে।

    এরকম সময় আমার মাথায় কে যেন স্পর্শ করে নিচু গলায় ডাকল, কিহা–

    আমি চোখ খুলে ঘুরে তাকালাম। লেন বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে লেন?

    তোমার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন কিহা। খুব জরুরি।

    বল।

    তুমি তো জান মিয়ারা আমাকে খাদ্য সরবরাহের একটা সমস্যা সামাধান করতে দিয়েছে–

    হ্যাঁ জানি।

    আমি সেটা নিয়ে কাজ করছিলাম, কোনো মানুষের জন্যে কতটুকু খাবার রয়েছে তার একটা তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। আমি শিশুগুলির ফাইল খুলে দেখেছি। মূলতথ্যকেন্দ্র থেকে তাদের জন্যে মাত্র চার দিনের খাবার রাখা হয়েছে।

    আমি চমকে উঠে বললাম, কী বলছ তুমি?

    হ্যাঁ। এই শিশুগুলিকে শীতল ঘর থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে হত্যা করার জন্যে।

    সত্যি?

    হ্যাঁ।

    কেন?

    আমি জানি না।

    মিয়ারা কী জানে?

    আমি বলতে পারবো না।

    আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, আমার মনে হয় সে জানে।

    কেন বলছ সে জানে?

    আমি একটু আগে দেখছিলাম, সে মহাকাশযানের অন্য এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলছে। সে শিশুগুলিকে বিক্রি করে দিচ্ছে। সে নিশ্চয়ই জানে আর চারদিন পর শিশুগুলির কোনো মূল্য নেই।

    লেন আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলল, কিহা!

    কী হয়েছে লেন?

    আমি শিশুগুলির সাথে সময় কাটিয়েছি, তাদের নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। এরা একেবারে সাধারণ শিশু–একেবারে সাধারণ। এদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা নেই, কৃত্রিম অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই বিশেষ জিনেটিক কোড নেই। এদের রবোট ফার্মে বড় করা হয়েছে, এরা কথা জানে না কেউ ওদের কথা শেখায় নি। এরা কখনো মানুষ দেখে নি, ওরা কখনো মানুষের ভালবাসা পায় নি, আমি ভেবেছিলাম তাই ওরা বুঝি ভালবাসা বুঝে না। কিন্তু–

    কিন্তু কী?

    বাচ্চাগুলি ভালবাসা বুঝে। আমি–আমি–লেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার চোখ দুটিতে হঠাৎ পানি জমে ওঠে। আমি অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, শেষবার কবে আমি সত্যিকার মানুষকে কাঁদতে দেখেছি মনে করতে পারলাম না।

    লেন হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাকে দুই হাতে ধরে বলল, কিহা

    আমি লেনের দিকে তাকালাম, হাসার চেষ্টা করে বললাম, লেন, এই ঘরে এই মুহূর্তে আমাদের দিকে অসংখ্য যান্ত্রিক চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অসংখ্য সংবেদনশীল কান আমাদের কথা শুনছে। তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই লেন। আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছ।

    তুমি জান?

    হ্যাঁ, আমি জানি।

    সামনের মনিটর থেকে হঠাৎ রীয়ের কথা ভেসে এল, সে বলল, বিস্ময়কর। যখন আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে আমি মানুষকে বুঝতে পারি, ঠিক তখন তোমরা এমন একটা কাজ কর যে আমি আবার বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

    কেন রী, কী হয়েছে?

    লেন কথাটি বলার আগে তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে সে কী বলবে?

    আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, চেষ্টা কর, তুমিও পারবে।

    সে কী শিশুগুলির জীবন বাঁচানোর কথা বলছে? কিন্তু সেটা তো হতে পারে না, সেটা তো অসম্ভব। শুধু যে অসম্ভব তা নয়, এর সাথে আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আমাদের অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে। তাহলে কী হতে পারে—

    আমি লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। হ্যাঁ, আমাকে একটা অসম্ভব কাজ করতে হবে। মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে আটটি অত্যন্ত সাধারণ শিশুর প্রাণ বাঁচাতে হবে। এর সাথে হয়তো আমাদের নিরাপত্তার এবং অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে কিন্তু আমার কিছু করার নেই।

    লম্বা করিডোরের আবছা অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমি আবিষ্কার করলাম আমার বুকের ভিতরের গুমোট বিতাটি কেটে গেছে, সেখানে এসে ভর করেছে বিচিত্র এক ধরনের ক্রোধ।

     

    আমি মিয়ারার আস্তানায় করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি, আমার পিছু পিছু একটু দূরত্ব রেখে ত্রিনিও হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আমি পুরো সমস্যাটি চিন্তা করে দেখি–স্বাভাবিক অবস্থায় মাহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ আদেশ উপেক্ষা করে কিছু একটা করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মহাকাশযানে এখন স্বাভাবিক অবস্থা নেই। সেটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র শক্তি।’

    আমাদের সবার জন্যে এখন সবচেয়ে সহজে পালিয়ে যাবার একটি মাত্র উপায়। আমাদের শরীরে যে ট্রাকিওশানটি দিয়ে মহাকাশযানের মূল এবং আনুষাঙ্গিক তথ্যকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রাখা হয় সেই ট্রাকিওশানটি বের করে সেখানে অন্য একটি ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দেওয়া। সেই ট্রাকিওশানে থাকবে ভিন্ন একজনের পরিচয় যার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পরিচয় নিয়ে আমরা শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব। আগামী শতাব্দী পর্যন্ত কেউ আর আমাদের খুঁজে পাবে না। ব্যাপারটি অনেকটা আত্মহত্যা করার মতো, মহাকাশযানের বিশাল তথ্যকেন্দ্র থেকে নিজেকে অদৃশ্য করে দেয়া। ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে যদি এই মহাকাশযান পৃথিবীতে পৌঁছায়, সবকিছু আবার নূতন করে শুরু হয় তখন হয়তো সত্যিকারের পরিচয় নিয়ে জীবন শুরু করতে পারব। হয়তো পারব না। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন ভেবে লাভ নেই।

    আমি হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে এলাম, আটটি শিশুর জন্যে এখানে আলাদা একটা ঘর তৈরি করা হয়েছে। ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখি লেন ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় হাটু মুড়ে বসে আছে, তাকে ঘিরে আটটি শিশু বসে আছে। শিশুগুলির মুখ আনন্দোজ্জ্বল এবং কিছু একটা নিয়ে সেখানে প্রচণ্ড হৈ-চৈ হচ্ছে। আমাকে দেখে লেন হাসি মুখে বলল, কিহা, দেখ বাচ্চাগুলি কথা শিখে যাচ্ছে!

    সত্যি?

    হ্যাঁ। আমি এর মাঝে অনেক কিছু শিখিয়েছি। দেখবে?

    দেখাও।

    লেন তার হাত উঁচু করে বলল, এইটা কী?

    বাচ্চাগুলি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলল, হাত! হাত!

    লেন নিজের চুল স্পর্শ করে বলল, এইটা কী?

    চুল! চুল!

    লেন নিজের নাক স্পর্শ করে বলল, এইটা কী?

    নাক! নাক!

    আমরা সবাই মিলে কোথায় যাব?

    পৃ! পৃ!

    পূ? আমি একটু অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকালাম। লেন হেসে ফেলে বলল, একটা শব্দ কঠিন হয়ে গেল সেটাকে কেটে ছেটে সহজ করে ফেলে!

    পৃথিবীকে করেছে পৃ। কী বুদ্ধি দেখেছ?

    তাই তো দেখছি।

    আরো অনেক মজার ব্যাপার আছে–নিজেরা নিজেরা একটা ভাষা তৈরি করে ফেলেছে। কিচির মিচির করে নিজেদের ভিতর কী বলে আমি কিছুই বুঝি না।

    মজার ব্যাপার তো।

    হ্যাঁ–ছোট বাচ্চার মাঝে এত মজার ব্যাপার লুকানো আছে তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবে। একটু আগে কী হয়েছে শোন

    লেন একটু আগে খাবার সময় বাচ্চাগুলি তাদের পানীয় নিয়ে কী দুষ্টুমি করেছে সেটা খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করে। আমি নিজের বিস্ময়টুকু গোপন করে মুখে একাগ্রতার একটা ভাব ফুটিয়ে তুলি। আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতে পারতাম না লেনের মতো একটি মেয়ে ছোট শিশুদের নিয়ে এ ধরনের উচ্ছাস দেখাতে পারে।

    আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, বাচ্চাগুলিকে বাঁচাতে হবে, যেভাবেই হোক।

     

    চতুর্থ স্তরে নানা ধরনের স্কাউটশিপ রাখা আছে আমি সেগুলি দেখে একটাকে বেছে রাখলাম। এটা তৈরি হয়েছিল মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে, বায়ুশূন্য মহাকাশে যেতে পারে বলে এটি বায়ু নিরোধক, ছোটখাট গোলাগুলি সহজে সহ্য করতে পারবে। নিয়ন্ত্রণটুকু পুরোপুরি যান্ত্রিক আমাকে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমি স্কাউটশিপের কোড নাম্বারটি নিয়ে তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ। করলাম। বিশেষ অনুমতি ছাড়া এটি ব্যবহার করার উপায় নেই। আমি পর্যবেক্ষণ করার জন্যে কয়েক মিনিট ব্যবহার করার একটা সাময়িক অনুমতি যোগাড় করে রাখলাম। মিয়ারায় আস্তানা থেকে কয়েক মিনিটের মাঝে কেউ বের হতে পারবে না কাজেই এটা নিরাপত্তার জন্যে কোনো রকম হুমকি নয়।

    বাচ্চাগুলিকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনার পরের অংশটুকু জটিল, যার জন্যে আমাদের শরীর থেকে ট্রাকিওশান গুলি আলাদা করতে হবে। একজন মানুষের যাবতীয় তথ্য এই ট্রাকিওশানের মাঝে থাকে–এটি শরীর থেকে বের করা মাত্রই আমরা এই মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালে পরিণত হব। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন আর চিন্তা করার সময় নেই। ট্রাকিওশানগুলি বের করতে আমাদের কষ্ট হল, চামড়ার নিচে লুকানো থাকে, সেটা কেটে বের করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ছোট পাতলা একটা চাকতির মতো শক্তিশালী ট্রান্সমিটারগুলি আপাততঃ শরীরের উপরে লাগিয়ে রাখা হল, শেষ মুহূর্তে সেগুলি অন্য কোথাও লাগিয়ে দিয়ে মূল তথ্যকেন্দ্রকে বিভ্রান্ত করা হবে।

    নির্দিষ্ট সময়ে আমি স্কাউটশিপের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, তিনি সারাক্ষণই আমার সাথে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে আমার পিছু পিছু এসেছে। স্কাউটশিপের কাছাকাছি এসে আমি আমার ট্রাকিওশানটি চলমান একটি রবোটের দিকে ছুড়ে দিলাম–পুরো জিনিসটা করতে হল তথ্যকেন্দ্রের চোখকে আড়াল করে, সেটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। ত্রিনি সাথে সাথে সেই রবোটটির পিছু পিছু হটতে শুরু করেযখন সে বুঝতে পারবে আমি পালিয়ে গেছি তার প্রতিক্রিয়া কী হবে জানার আমার একটু সূক্ষ্ম কৌতূহল হল!

    স্কাউটশিপের দরজায় টোকা দিতেই সেটা ঘর ঘর শব্দ করে খুলে গেল। আমি মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে গেলাম, বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরে বেশ প্রশস্ত। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে হাত দিতেই সেটি মিষ্টি সুরে কথা বলে উঠল, মহামান্য কিহা, আপনি কয়েক মিনিটের এটা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছেনআপনাকে কী আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

    অবশ্যি পার। এই স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু কী?

    কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরের ভাগে ভারসাম্য রক্ষার মডিউলটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার নিচে রয়েছে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি।

    চমৎকার–আমি পকেট থেকে ছোট একটা বিস্ফোরকের টিউব বের করে আনলাম। আমাকে নূতন ধরনের অস্ত্র আবিষ্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বলে এ ধরনের জিনিস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে সরবরাহ কেন্দ্র থেকে দিতে আপত্তি করে নি।

    মহাকাশযানের কন্ট্রোল প্যানেল অবশ্যি তীক্ষ্ণ স্বরে বিপদ সংকেত বাজাতে বাজাতে আপত্তি জানাতে শুরু করে। কণ্ঠস্বরটি উঁচু গলায় বলল, স্কাউটশিপের মাঝে বিস্ফোরক অত্যন্ত বিপজ্জনক–

    সেজন্যেই এনেছি।

    তুমি কী করবে বিস্ফোরক দিয়ে?

    ভারসাম্য রক্ষার মডিউল এবং স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি উড়িয়ে দেব।

    অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি কাজ করতে যাচ্ছ।

    হ্যাঁ। আমার ভাসা ভাসা মনে আছে যদি স্কাউটশিপে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে ভেতরের আরোহীদের জীবন রক্ষার একটি শেষ চেষ্টা করা হয়। তখন স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ আরোহীদের হাতে দেয়া হয়। আমার স্কাউটশীপের নিয়ন্ত্রণটুকু দরকার–

    কিন্তু তার যথাযথ নিয়ম রয়েছে। তুমি যেটা করতে যাচ্ছ সেটা বিপজ্জনক এবং বেআইনি।

    সম্ভবত। আমি কথা না বাড়িয়ে বিস্ফোরকের টিউবটি কন্ট্রোল প্যানেলে বসিয়ে একটু দূরে সরে গেলাম। তিন সেকেন্ডের মাঝে প্রচণ্ড শব্দে একটা বিস্ফোরণে কন্ট্রোল প্যানেলের বড় একটা অংশ উড়ে গেল এবং সাথে সাথে তীব্র স্বরে ভেতরে বিপদ সংকেত বাজতে থাকে, উজ্জল লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। আমি স্কাউটশিপের ভেতরে এবারে ভিন্ন একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, সেটি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, মহা বিপদ সংকেত। আরোহীদের নিরাপত্তার জন্যে বলছি, স্কাউটশিপের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি দ্বিতীয় ধাপের নিয়ন্ত্রণ–

    আমি গলায় ভয় এবং আতংক ফুটিয়ে বললাম, বাইরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ কেটে দাও।

    দিচ্ছি।

    আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে দাও।

    দিচ্ছি–

    আমি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে গিয়ে বসে বললাম, নিচু দিয়ে উড়তে শুরু কর। দ্বিতীয় স্তরে থামতে হবে।

    কিন্তু–

    কোন কথা বলার সময় নেই, তাড়াতাড়ি—

    সাথে সাথে স্কাউটশিপের গর্জন করে উড়তে শুরু করে।

    দ্বিতীয় স্তরে লেন বাচ্চাগুলিকে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। আমি এক মুহূর্তের জন্যে দরজা খুলতেই সে সবাইকে নিয়ে হুঁড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আমি গলা উচিয়ে বললাম, মূল প্রবেশপথ দিয়ে বের হয়ে যাও। তাড়াতাড়ি

    কিন্তু–

    এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। তোমাকে বুঝিয়ে বলার সময় নেই।

    স্কাউটশিপের ভেতরে আর কোনো কথা শোনা গেল না। সেটা নিচু হয়ে ছুটতে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে এর বেগ বেড়ে যেতে থাকে।

    লেন নিচু গলায় বলল, আমরা এখন কোথায় যাব?

    কাছাকাছি কোনো শীতল ঘরে। আমি কিছু নকল ট্রাকিওশান তৈরি করে রেখেছি, এখান থেকে বের হয়ে শরীরে লাগিয়ে নিতে হবে।

    লেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন স্কাউটশিপটা ঝাকুনী দিয়ে থেমে যায় এবং ভেতরে আমরা সবাই হুঁড়মুড় করে পড়ে গেলাম। ছোট বাচ্চাগুলি ব্যাপারটা এক ধরনের খেলা মনে করে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে।

    আমি একটু শংকিত হয়ে বললাম, কী হয়েছে? থামছ কেন?

    প্রতিরক্ষাকেন্দ্র তোমাদের পরিচয় জানতে চাইছে।

    আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমাকে আমি বলেছি আমাদের হাতে কোনো সময় নেই। তুমি বের হয়ে যাও।

    প্রতিরক্ষাকেন্দ্র তাহলে আমাদের আক্রমণ করবে।

    করলে করবে। আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি তুমি এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও।

    এটি বেআইনি–

    আমি তোমাকে এই বেআইনি কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছি।

    স্কাউটশিপের বিধ্বস্ত কন্ট্রোল প্যানেলে কিছু আলোর ঝলকানী দেখা গেল, তারপর যেরকম হঠাৎ করে এটি থেমেছিল ঠিক সেরকম করে হঠাৎ এটি ছুটতে শুরু করল।

     

    স্কাউটশিপটি যখন তার গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশযানের বিশাল করিডোর ধরে নির্দিষ্ট পথে ছুটতে শুরু করেছে তখন লেন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার কি মনে হয় কিহা, আমরা কী পালিয়ে যেতে পারব?

    নিশ্চয়ই পারব।

    প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে আমাদের পিছু নেবে না?

    আমরা আমাদের ট্রাকিওশান ফেলে এসেছি, আমরা কে তারা এখনো জানে। তারা জানার আগেই আমরা শীতল ঘরে ঢুকে যাব।

    আমরা কি পারব?

    আমি উত্তর দেবার আগেই স্কাউটশিপের কন্ট্রোল প্যানেল থেকে উত্তর ভেসে এল, সেটি বলল, আমার ধারণা পারবেন না।

    কেন?

    এই মাত্র তিনটি বাই ভার্বাল স্কাউটশিপের কন্ট্রোল লক ইন করেছে। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরক দিয়ে এটিকে ধ্বংস করে দেবে।

    আমি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে একটি চেয়ারে বসে নিজেকে চেয়ারের সাথে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিতে নিতে বললাম, লক ইন করার মাইক্রো-সেকেন্ডের মাঝে আঘাত করা যায়। এখনো যখন করে নি–তার মানে তারা আঘাত করবে না।

    কেন করবে না?

    সম্ভবত তারা আমাদের পরিচয় জেনে গেছে।

    লেন ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! আমরা তাহলে কী করব?

    দেখি কী করা যায়। আমি দ্রুত চিন্তা করতে করতে বললাম, তুমি বাচ্চাগুলিকে চেয়ারগুলির মাঝে শক্ত করে বেঁধে দাও, আমার মনে হয় স্কাউটশিপটা নিয়ে কিছু লাফঝাঁপ দিতে হবে।

    কী রকম লাফঝাঁপ?

    বড় ধরনের। আমি একটা পর্যবেক্ষণকেন্দ্র ভেঙে মহাকাশে বের হয়ে যাবার কথা ভাবছি।

    লেন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি দুর্বলভাবে হেসে বললাম, আমাদের স্কাউটশিপ মহাকাশে যেতে পারে, আমাদের পিছু নিয়েছে সাধারণ বাই ভার্বাল সেগুলি মহাকাশে যেতে পারবে না।

    কিন্তু আমরা কেমন করে মহাকাশে যাব?

    আমি এখনো জানি না।

    পর্যবেক্ষন কেন্দ্রের জানালা সবসময় বন্ধ থাকে।

    কিন্তু যদি প্রচণ্ড গতিতে সোজাসুজি পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে শুরু করি সম্ভবত একটা জানালা খুলে যাবে। আমরা সেই জানালা দিয়ে বের হয়ে যাব।

    কেন জানালা খুলবে?

    মহাকাশযানকে রক্ষা করার জন্যে। একটা স্কাউটশিপ প্রচণ্ড গতিতে যেতে পারে, এর গতিশক্তি মেগাজুল পর্যন্ত হতে পারে। মহাকাশযান তার দেয়ালে মেগাজুল শক্তিতে আঘাত করতে দেবে না। সেটি মহাকাশযানের জন্য বিপজ্জনক।

    লেন কোনো কথা না বলে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু তোমার ধারণা যদি ভুল হয়?

    আমি লেনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে বললাম, স্কাউটশিপ, আমি চাই তুমি ধীরে ধীরে গতিবেগ বাড়িয়ে উপরে ওঠে এস।

    মহাকাশযানের ভেতরে আমার গতিবেগ বাড়ানোর উপায় নেই। স্কাউটশিপটি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, এটি বিপজ্জনক।

    ঠিক আছে, তুমি নিয়ন্ত্রণটি আমার হাতে দিয়ে দাও।

    তোমার হাতে? তুমি স্কাউটশিপ কখনো নিয়ন্ত্রণ করেছ?

    আমি সেটা নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না। আমি কোনো জটিল কাজ করতে যাচ্ছি না। সোজাসুজি মহাকাশযানের দেয়ালে আঘাত করতে যাচ্ছি–

    স্কাউটশিপের মূল নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে বোম রয়েছে সেটা স্পর্শ করতেই নিয়ন্ত্রণটুকু আমার হাতে চলে এল। আমি শক্তিকেন্দ্রে চাপ দিয়ে স্কাউটশিপের গতিবেগ বাড়াতে শুরু করি, আমার দুই পাশে দিয়ে মহাকাশযানের করিডোর পিছনে ছুটে যেতে শুরু করল। আমি গতিবেগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করতেই যোগাযোগ মডিউলে আমাদের পিছনে লেগে থাকা বাই ভার্বালের আরোহীর গলায় স্বর শুনতে পেলাম, চিৎকার করে কঠোর গলায় বলল, কিহা, আমি জানি তুমি স্কাউটশিপে আছ। এই মুহূর্তে নিচে নেমে আস, না হয় তোমাকে গুলি করব–

    আমি কোনো উত্তর না দিয়ে স্কাউটশিপের গতিবেগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি। কণ্ঠস্বরটি আবার কঠোর গলায় বলল, এই মুহূর্তে নিচে নেমে আস–এই মুহূর্তে–

    আমি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে মহাকাশযানের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকি, উপরে স্বচ্ছ জানালাগুলি দেখা যাচ্ছে, এর কোনো একটিতে আমার আঘাত করতে হবে, আমি সাহস সঞ্চয় করতে থাকি, একটি স্কাউটশিপ নিয়ে প্রচণ্ড বেগে সোজাসুজি মহাকাশেনের দেয়ালে আঘাত করার মতো সাহস সম্ভবত আমার নেই।

    আমি মহাকাশযানের উপরে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে নিচে তাকালাম, অনেক নিচে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি–যানবাহন দেখা যাচ্ছে, আমাকে ঘিরে নানা ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে। সম্ভবত অনেকেই আমাকে লক্ষ করছে। আমি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণটুকু ধরে রাখি। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, আমার নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে, আমি স্কাউটশিপটাকে সোজাসুজি ওপরের দিকে ঘুরিয়ে আনতে শুরু করতেই হঠাৎ ভিতরে একটা নূতন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সেটি চাপা গলায় বলল, স্কাউটশিপের আরোহী, আমি একটি গোপন চ্যানেলে তোমার সাথে যোগাযোগ করছি, আমার কথা তুমি ছাড়া আর কেউ শুনছে না। তুমি আমার কথার কোনো উত্তর দেবে না।

    কণ্ঠস্বরটি এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলল, মাহাকাশযানের দেয়ালে আঘাত করে বের হয়ে যাবার পরিকল্পনাটির সাফল্যের সম্ভাবনা দশমিক দুই তিন। তুমি যদি চাও তোমাকে আমি অন্যভাবে রক্ষা করতে পারি। তার জন্যে স্কাউটশীপের পুরো নিয়ন্ত্রন আমাকে দিতে হবে। আমার কোড নম্বর সাত চার তিন দুই।

    আমি অবাক হয়ে বিচিত্র কণ্ঠস্বরটি শুনছিলাম, ব্যাপারটি একটি ষড়যন্ত্র কী না যাচাই করার কোনো উপায় নেই। কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাকে কয়েকটি বাই-ভার্বাল ধাওয়া করছে, তোমাকে গুলি করার সুযোগ পেয়েও গুলি করছে না, যার অর্থ এই স্কাউটশিপে তোমরা যারা আছ তারা সম্ভবত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের ট্রাকিওশান নেই যার অর্থ তোমরা পালিয়ে যাচ্ছ। মহাকাশযানের প্রচলিত পদ্ধতি থেকে যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের জন্যে আমার সমবেদনা রয়েছে, সেই জন্যে আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাইছি। তুমি যদি আমার সাহায্য গ্রহণ করতে চাও কোড়-নম্বর সাত চার তিন দুইয়ে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণটুকু হস্তান্তর কর। আমাদের হাতে সময় খুব কম।

    আমি লেনের দিকে তাকালাম, সে ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে। তার দুই পাশে বাচ্চাগুলি বসে আছে, তাদের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। স্কাউটশিপের পুরো ব্যাপারটুকু তারা অত্যন্ত মজার কোনো খেলা হিসেবে ধরে নিয়েছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে কন্ট্রোল প্যানেলের একপাশে কোড়-নম্বরটি প্রবেশ করিয়ে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণটুকু হস্তান্তর করে দিলাম।

    সাথে সাথে স্কাউটশিপটা বিদ্যুৎবেগে তার দিক পরিবর্তন করে উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করে। খানিকদূর গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে গিয়ে আবার সোজাসুজি উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। আমি উপরে তাকিয়ে হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমাদেরকে কোথাও নেয়া হচ্ছে।

    মহাকাশযানটি একটি বিশাল চাকার মতো, এটি তৈরি করা হয়েছে মহাকাশে, দীর্ঘ সময় নিয়ে এর বিভিন্ন অংশ তৈরি করে এনে একটু একটু করে জুড়ে দেয়া হয়েছে। চাকার মতো অংশটির ঠিক মাঝখানে রয়েছে মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিন। ইঞ্জিনগুলি মহাকাশযানের সাথে ছয়টি রড দিয়ে লাগানো। রডগুলি ফাপা এবং এর ভেতর দিয়ে অনায়াসে কয়েকটা স্কাউটশিপ ঢুকে যেতে পারে। এই মুহূর্তে আমাদের স্কাউটশিপটা এরকম একটি ফাঁপা টিউবের মাঝে দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মহাকাশযানের এই অঞ্চলটি মানুষ বাসের অনুপোযোগী। এখানে বাতাস নেই, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই, মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। মহাকাশযানে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি করার জন্যে এটি তার অক্ষের উপর ঘুরছে। সেন্ট্রিফিউগাল বল থেকে তৈরি হয়েছে মাধ্যকর্ষণের অনুভূতি। কেন্দ্রে সেই মাধ্যকর্ষন বলও নেই। এখানে এসে কেউ আশ্রয় নিতে পারে সেটি আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম সত্যি সত্যি সেখানে আশ্রয় নেবার জন্যে আমরা স্কাউটশীপে ছুটে যাচ্ছি।

    মহাকাশযানটি বিশাল এবং আমরা দীর্ঘ সময় এই অন্ধকার গহ্বর দিয়ে ছুটে যেতে থাকলাম। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমরা জানি না আমার কথা বলা নিষেধ বলে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ মনিটরে একটা অনুজ্জ্বল আলো দেখা গেল। আলোটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে এবং আমি বুঝতে পারলাম সেটি একটি ডকিং স্টেশন। স্কাউটশিপটার গতিবেগ কমে আসে এবং ডকিং স্টেশনের নির্দিষ্ট জায়গায় সেটি নিজেকে শক্ত করে লাগিয়ে নিয়ে স্থির হয়ে দাড়াল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক তখন আগের কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম। সেটি বলল, তোমরা স্কাউটশিপটা থেকে বের হয়ে আসতে পার। এখানে মাধ্যাকর্ষণ নেই, কাজেই তোমাদের ভেসে বের হয়ে আসতে হবে, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হতে হয়তো একটু সময় নেবে।

    আমি কথা বলতে পারব কী না বুঝতে পারছিলাম না, নিঃশব্দে চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই ভেসে উপরে উঠে এলাম, তাল সামলে কোনোমতে দরজার কাছাকাছি এসে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখলাম। কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, তোমরা এখন নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছ, ইচ্ছে করলে কথা বলতে পার।

    আমি দরজা খুলতে খুলতে বললাম, আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ। কেন বাঁচিয়েছ জানলে আরো স্বস্তি বোধ করতাম।

    কণ্ঠস্বরটি হালকা গলায় বলল, বলতে পার অল্প খানিকটা সমবেদনা এবং অনেকখানি কৌতূহল! তোমাদের স্কাউটশিপে যারা আছে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারা সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ? তুমি নাকি অন্য কেউ?

    আমি হেসে বললাম, না আমি নই। তারা আসছে।

    আমার কথা শেষ হবার আগেই শিশুগুলি উচ্চঃস্বরে হাসতে হাসতে এবং আনন্দে গড়াগড়ি খেয়ে ভাসতে ভাসতে স্কাউটশিপের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে। এক মুহূর্ত পর আমি আবার কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম সেটা শিস দেবার মতো শব্দ করে বলল, এরাই তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ?

    আমি মাধ্যকর্ষণহীন অবস্থায় অভ্যস্ত নই। শুধু মনে হতে থাকে যে কোথাও পড়ে যাচ্ছি, কোনোভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে বললাম, হ্যাঁ, এরাই সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কিন্তু তুমি কে?

    আমি?

    হ্যাঁ তুমি।

    আমি সেরকম কেউ নই। একটু পরেই দেখবে। তোমরা ডকিং স্টেশন পার হয়ে ভিতরে চলে এসো।

    স্কাউটশিপ থেকে নেমে শিশুগুলি একেকজন একেকদিকে ভেসে চলে যেতে শুরু করে এবং তাদের সবাইকে আবার ধরে আনতে লেন এবং আমার বিশেষ বেগ পেতে হল। শিশুদের সম্পূর্ণ বিনা কারণে আনন্দ পাওয়ার এবং সেই অকারণ আনন্দ অন্যদের মাঝে সঞ্চালিত করে দেয়ার একটা বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। দেখা গেল আমরাও শিশুগুলির পিছনে ছুটতে ছুটতে হাসাহাসি করছি।

     

    পাশের ঘরটি মাঝারি আকারের, মাধ্যকর্ষণহীন যেকোনো জায়গার মতো এখানেও অসংখ্য যন্ত্রপাতি এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘরটিতে অনুজ্জ্বল একটা আলো জ্বলছে এবং ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পিলারে একজন মানুষ উল্টো করে বাধা। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় উল্টো সোজা বলে কিছু নেই কিন্তু তবুও দৃশ্যটি দেখে আমরা চমকে উঠলাম। মানুষটি বৃদ্ধ, সত্যি কথা বলতে কী আমি এর আগে কোনো বৃদ্ধ মানুষ দেখি নি। নূতন প্রযুক্তিতে মানুষের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই মানুষটির চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ভয়াবহ ভাবে এসে স্থান নিয়েছে। তার মাথায় ধবধবে সাদা চুল, মুখে সাদা লম্বা দাড়ি-গোঁফ। তার মুখের চামড়া কুঞ্চিত, চোখ কোটরাগত। সেই কোটরাগত চোখ অঙ্গারে মতো জ্বলছে। মানুষটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি লী। সবাই ডাকে বুড়ো-লী। আমি বুড়ো-লীয়ের আস্তানায় তোমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি দুঃখিত তোমাদের কাছে আসতে পারছি না। বয়স হয়ে গিয়েছে, শরীরে জোর নেই, নিজেকে তাই পিলারের সাথা বেঁধে রেখেছি আজ প্রায় তিরিশ বছর।

    লেন আর্ত শব্দ করে বলল, তিরিশ বছর?

    হ্যাঁ। মহাকাশযানে যখন হানাহানি শুরু হল, তোমরা তখন নিশ্চয়ই শীতল ঘরে ঘুমিয়ে, আমাকে কিছু খুনোখুনির দায়িত্ব দিয়েছিল। করতে রাজি হই নি বলে খুব যন্ত্রণা গিয়েছে। পালিয়ে শেষ পর্যন্ত বুড়ো লী হঠাৎ কথা থামিয়ে বলল, তোমাদের কেমন জানি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তোমরা বিশ্রাম নিয়ে এসো। দেখতেই পাচ্ছ এটা নিয়মিত মানুষের আস্তানা নয় তোমাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হবে। তবে জায়গাটা নিরাপদ। একেবারে শক্তিকেন্দ্রে আস্তানা করেছি তো কারো ধারে কাছে আসার ক্ষমতা নেই। আমার এখানে মানুষজন নেই, কাজ চালানোর মতো কিছু রবোট তৈরি করেছি, তারাই সাহায্য করে।

    বুড়ো লী মুখ ঘুরিয়ে ডাকল, কিশি–

    ঘরের মাঝে ইতস্তত যেসব যন্ত্রপাতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাদের মাঝে বড় ধরনের একটি যন্ত্র হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে দুপাশে দুটি যান্ত্রিক হাত এবং একটি বিদঘুটে মাথা গজিয়ে ওঠে। পিছনে ছোট একটা জেট ইঞ্জিন চালু হয়ে যায় এবং সেটি ভাসতে ভাসতে বুড়ো-লীয়ের দিকে এগিয়ে আসে।

    বুড়ো লী রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে অতিথি এসেছে। তুমি তাদের নিয়ে যাও। বিশ্রাম এবং খাবারের ব্যবস্থা কর।

    রবোর্টটি কোনো কথা না বলে এগিয়ে যেতে থাকে। আমি এবং লেন কোনোভাবে শিশুগুলিকে ধরে বেঁধে তার পিছু পিছু যেতে থাকি। আসলে বুঝতে পারি নি, আমি সত্যিই অসম্ভব ক্লান্ত।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আমি তপু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }