Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ২ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প892 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০১. ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে

    ক্রোমিয়াম অরণ্য – সায়েন্স ফিকশন / কল্পবিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    পূর্বকথা

    শরতের এক রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্নে গভীর আকাশ থেকে নিচে নেমে এল একটি শুভ্র গোলক। মাটির কাছাকাছি এসে প্লুটোনিয়ামের সেই তুষারশুভ্র গোলক ফেটে পড়ল এক ভয়ঙ্কর আক্রোশে, ভয়াবহ পারমাণবিক বিস্ফোরণে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি নগরী। মানুষের হাহাকারে পৃথিবীর বাতাস ভারি হয়ে এল সেই বিষণ্ণ অপরাহ্নে। মানুষ কিন্তু তবু থেমে রইল না। প্রতিশোধের হিংস্র জিঘাংসা নিয়ে একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল লক্ষ লক্ষ বছরে সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল পরদিন সূর্য ওঠার আগে। পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধুলার মতো উড়ে গেল পৃথিবীর জনপদ, সুরম্য অট্টালিকা, আকাশছোঁয়া নগরী।

    তারপর বহুকাল পার হয়ে গেছে। পৃথিবী এখনো এক আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ধ্বংসস্থূপ। সেই প্রাণহীন ধ্বংসস্তূপে এখনো ধিকিধিকি করে জ্বলে আগুন, ঘুরে ঘুরে আকাশে ওঠে কালো ধোঁয়া। তার মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় বিবর্ণ, রং ওঠা নিয়ন্ত্রণহীন কিছু খেপা রবোট। সমুদ্র, হ্রদ আর নদীতে দূষিত পানি, বিষাক্ত মাটি, বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা আর তার মাঝে ধুকে ধুকে বেঁচে আছে কিছু মানুষ। সেই মানুষের জীবন বড় কঠোর, বড় নির্মম। তাদের চোখে কোনো স্বপ্ন নেই, তাদের মনে কোনো ভালবাসা নেই। তারা এক দিন এক দিন করে বেঁচে থাকে পরের দিনের জন্যে। প্রাণহীন, ভালবাসাহীন, শুষ্ক, কঠিন, নিরানন্দ ভয়ঙ্কর এক জীবন।

    পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই অল্প কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে গ্রুস্টান–ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাওয়া পৃথিবীজোড়া সুরক্ষিত কম্পিউটারের ঘাটিগুলোর যোগসূত্র। কোয়ার্টজের তন্তুতে অবলাল রশ্মিতে পরিব্যাপ্ত এক অবিশ্বাস্য শক্তিশালী অপারেটিং সিস্টেম।

    ০১.

    ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি স্থির চোখে সামনে তাকিয়েছিলাম। যতদূর চোখ যায় ততদূর এক বিশাল বিস্তৃত ধ্বংসস্তৃপ নিথর হয়ে পড়ে আছে। প্রাণহীন শুষ্ক নিষ্করুণ ভয়ঙ্কর একটি ধ্বংসস্থূপ। শুধুমাত্র মানুষই একটি সভ্যতাকে এত যত্ন করে গড়ে তুলে আবার এত নিখুঁতভাবে সেটি ধ্বংস করতে পারে। শুধুমাত্র মানুষ।

    বেলা ডুবে গেলে আমি ধসে যাওয়া ভাঙা কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ক্রোমিয়ামের এই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকি। পৃথিবীর বাতাস পুরোপুরি দূষিত হয়ে গেছে, অসংখ্য ধূলিকণায় সারা আকাশে একটি ঘোলাটে রং, সূর্য ডুবে যাবার আগে সূর্যালোক বিচ্ছুরিত হয়ে হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্যে আকাশে বিচিত্র একটি রং খেলা করতে থাকে। সেই অপার্থিব আলোতে সামনের আদিগন্ত বিস্তৃত ভয়াবহ এই ধ্বংসস্তূপকে কেমন যেন রহস্যময় দেখায়। দীর্ঘ সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ এই প্রাণহীন ধ্বংসস্তুপকে একটি জীবন্ত প্রাণীর মতো মনে হতে থাকে। মনে হয় এক্ষুনি যেন সেটি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। আমি এক ধরনের অসুস্থ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকি, কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না।

    সূর্য ডুবে যাবার পর হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তখন আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী ধ্বংস হয়ে গেছে, বেঁচে আছে কিছু বিষাক্ত বৃশ্চিক এবং কুৎসিত সরীসৃপ। রাতের অন্ধকারে তারা জঞ্জালের ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। আমি নেমে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম ঠিক তখন নিচে থেকে রাইনুক নিচু স্বরে ডাকল, কুশান, তুমি কি উপরে?

    এটি আমাদের বসতির নির্জন অংশটুকু, এখানে আশপাশে কেউ নেই, নিচু গলায় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই–কিন্তু তবুও সবাই নিচু গলায় কথা বলে। সবার ভিতরে সবসময় কেমন এক ধরনের অস্পষ্ট আতঙ্ক, কারণটি কে জানে। আমিও নিচু গলায় বললাম, হ্যাঁ রাইনুক, আমি এখানে।

    নিচে নেমে আস।

    আসছি।

    আমি আবছা অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলে নিচে নেমে আসতে আসতে বললাম, তুমি কেমন করে জান আমি এখানে?

    তোমার ঘরে গিয়েছিলাম। ক্রিশি বলেছে।

    ও।

    রাইনুক তরল গলায় হেসে বলল, আমি কখনো বুঝতে পারি না তুমি কেন ক্রিশির মতো একটা রবোটকে নিজের সাথে রেখেছ!

    কেন, কী হয়েছে? ক্রিশি খুব ভালো রবোট।

    তৃতীয় প্রজাতির কপোট্রন, একটি কথা দশবার করে বলতে হয়। চতুর্থ শ্রেণীর যোগাযোগ মডিউল–আমার মনে হয় তুমি যদি এখন ভালো একটা রবোটের জন্যে আবেদন করে দাও কিছুদিনের মাঝে একটা পেয়ে যাবে।

    আমার বেশ চলে যায়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ভালো রবোটের কোনো প্রয়োজন নেই। ভালো রবোট দিয়ে আমি কী করব?

    ঠিক। রাইনুক খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি রোজ ওই উপরে উঠে বসে থাক কেন? যদি কোনোদিন পা হড়কে পড়ে যাও? যদি হাতপা কিছু ভেঙে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। অস্ত্রোপচারের রবোটের কপোট্রন কোন মডেলের তুমি জান?

    জানি।

    লিয়ানার কাছে শুনেছি ওষুধপত্রও নাকি খুব কমে এসেছে।

    আমি কোনো কথা বললাম না। রাইনুক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চল যাই।

    কোথায়?

    মনে নেই আজ গ্রুস্টান দেখা দেবে?

    কিন্তু সে তো মাঝরাতে।

    একটু আগে যদি না যাই বসার জায়গা পাব না।

    তাই বলে এত আগে?

    এত আগে কোথায় দেখলে? রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, খাবারের ঘর থেকে খাবার তুলে নিতে দেখবে কত সময় চলে যাবে। চল যাই।

    আমি আর কিছু বললাম না। রাইনুকের সাথে কোনোকিছু নিয়ে তর্ক করা যায় না। সে অল্পতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সবকিছুকে সে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে নেয়। পৃথিবী যদি এভাবে ধ্বংস না হয়ে যেত সে নিশ্চয়ই খুব বড় একটি প্রতিষ্ঠানে খুব দায়িত্বশীল একজন মানুষ হত। অনেক বড় বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার। রকেট বিশেষজ্ঞ বা মহাকাশচারী। কিন্তু এখন সে আর কিছুই হতে পারবে না, ধ্বংসস্তূপের আড়ালে আড়ালে সে বেঁচে থাকবে। ধসে পড়া বারোয়ারী খাবারের ঘরে বিস্বাদ খাবারের জন্যে হাতাহাতি করবে। বিবর্ণ কাপড় পরে ঘুরে বেড়াবে। প্রাচীন নির্বোধ রবোটের সাথে অর্থহীন তর্ক করে অনুজ্জ্বল টার্মিনালের সামনে বসে থেকে বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে নিতে একদিন সে নিঃশেষ হয়ে যাবে। যেভাবে আরো অনেকে নিঃশেষ হয়েছে।

    আমি আর রাইনুক পাশাপাশি হাঁটছি হঠাৎ সে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কুশান–

    কী?

    তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?

    কর।

    তোমার কি মনে হয় না আমাদের জীবনের কোনো অর্থ নেই?

    রাইনুকের গলার স্বরে এক ধরনের হাহাকার ছিল যেটি হঠাৎ আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে, তার জন্যে হঠাৎ আমার বিচিত্র এক ধরনের করুণা হতে থাকে। আমি কোমল গলায় বললাম, না রাইনুক, সেটা সত্যি নয়।

    কেন নয়?

    একজন মানুষের যখন কিছু করার থাকে না তখন তার জীবন অর্থহীন হয়ে যায়। আমাদের তো এখন অনেক কিছু করার আছে।

    কী করার আছে?

    বেঁচে থাকার জন্যে কত কী করতে হয় আমাদের প্রতি মুহূর্তে একটা করে নূতন পরীক্ষা, একটা করে নূতন যুদ্ধ!

    এটাকে তুমি জীবন বল?

    জীবন বড় আপেক্ষিক। তার কোনো চরম অবস্থান নেই। তুমি এই জীবনকে যেভাবে দেখবে সেটাই হবে তার অবস্থান।

    রাইনুক কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, অন্ধকারে আমি তার চোখ দেখতে পেলাম না কিন্তু আমি জানি তার দৃষ্টি ক্রুদ্ধ!

    .

    খাবারের ঘরটিতে খুব ভিড়। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে সবাই ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে, একটি প্রতিরক্ষা রবোট স্ক্যানার হাতে নিয়ে মিছেই ছুটোছুটি করে রেটিনা স্ক্যান করে সবার পরিচয় নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করছিল। ভিতরে খাবার পরিবেশনকারী রবোটগুলো খাবারের ট্রে নিয়ে অর্থহীনভাবে ছুটোছুটি করছে, ট্রের উপরে গাঢ় বাদামি রঙের চতুষ্কোণ বিস্বাদ খাবার।

    দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে আমরা ভিতরে ঢুকে নিজের অংশের খাবারটুকু প্লেটে তুলে নিই। একটি ছোট বোতলে করে একটি রবোট আমাদের খানিকটা লাল রঙের তরল ধরিয়ে দিল, ভিতরে কী আছে কেউ জানে না, দীর্ঘদিন থেকে তবুও আমরা সেটা বিশ্বাস করে খেয়ে আসছি। ঘরের ভিতরে ভাপসা গরম, বসার জায়গা নেই। খাবারের ট্রে নিয়ে আমরা ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। কী অকিঞ্চিৎকর খাবার আর কী মন খারাপ করা পরিবেশ! শরীরের জন্যে পুষ্টিকর! তা না হলে মানুষ কেমন করে এই খাবার দিনের পর দিন খেয়ে যেতে পারে? রবোট হয়ে কেন জন্ম হয় নি ভেবে মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। তাহলে কানের নিচে একটা সৌর ব্যাটারি লাগিয়ে খাবারের কথা ভুলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার রবোট হয়ে জন্ম হয় নি তাই মাঝে মাঝেই আমার খুব ইচ্ছে করে একটা হ্রদের পাশে বসে আগুনে ঝলসিয়ে একটি তিতির পাখি খেতে, সাথে যবের রুটি আর আঙুরের রস! আমি কখনো এসব খাই নি, প্রাচীন গ্রন্থে এর উল্লেখ দেখেছি, ডাটাবেসে ছবি রয়েছে, মনে হয় নিশ্চয়ই খুব উপাদেয় খাবার হবে।

    লাল রঙের পানীয়টুকু ঢক ঢক করে খেয়ে আমি আর রাইনুক খাবারের টুকরো দুটি হাতে নিয়ে বের হয়ে আসি। বাইরে অন্ধকার, স্থানে স্থানে ছোট ছোট সৌর সেল দিয়ে খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রাখা আছে, খুব লাভ হয়েছে মনে হয় না। বরং মনে হয় তার আশপাশে অন্ধকার যেন আরো জমাট বেঁধে আছে। যদি কোনো আলো না থাকত তাহলে সম্ভবত অন্ধকারে আমাদের চোখ সয়ে আসত, আমরা আরো স্পষ্ট দেখতে পারতাম। কিন্তু মানুষ মনে হয় অন্ধকারকে সহ্য করতে পারে না, যত অল্পই হোক তাদের একটু আলো দরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের রবোটের মতো অবলাল সংবেদী চোখ নেই।

    গ্রুস্টান আমাদের দেখা দেবার জন্যে শহরের মাঝামাঝি প্রাচীন হলঘরটি বেছে নিয়েছে। হলঘরের এক অংশ খুব খারাপভাবে ধসে যাবার পরও সামনের অংশটুকু মোটামুটি অবিকৃতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই হলঘরটিতে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ বসতে পারত, এখন সেটি সম্ভব নয়–তার প্রয়োজনও নেই। আমাদের এই বসতিতে সব মিলিয়ে তেষট্টি জন মানুষ, যার মাঝে বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং অনেকগুলো রবোট। পারমাণবিক ব্যাটারির অভাব বলে বেশিরভাগ রবোটকেই অচল করে রাখা আছে, নেহাত প্রয়োজন না হলে সেগুলো চালু করা হয় না।

    প্রাচীন হলঘরটিতে এর মাঝেই লোকজন আসতে শুরু করেছে। বসার জন্যে কোনো আসন নেই, শক্ত পাথরের মেঝেতে পা মুড়ে বসতে হয়। সামনে একটি লাল কার্পেট বিছিয়ে। রাখা হয়েছে; বাম পাশে একটি যোগাযোগ মডিউল, ডান পাশে প্লাটিনামের একটি পাত্রে গাঢ় সবুজ রঙের এক ধরনের পানীয়। এটি লিয়ানার জন্যে নির্ধারিত জায়গা, সে এই বসতির তেষট্টি জন মানুষ এবং কয়েক শতাধিক সচল ও অচল রবোটের দলনেত্রী। সে এখনো আসে নি। তার জন্যে জায়গা আলাদা করে রাখা হয় তাই আগে থেকে এসে অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজনও নেই।

    আমি আর রাইনুক হলঘরের মাঝামাঝি পা মুড়ে বসে পড়ি। গ্রুস্টান যতবার আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে ততবার আমাদের মেঝেতে পা মুড়ে বসতে হয়েছে। অপার্থিব কোনো ব্যক্তিকে সম্মান দেখানোর এই পদ্ধতিটি প্রাচীন কিন্তু নিঃসন্দেহে কার্যকরী। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম। বেশিরভাগ মানুষই চুপ করে বসে আছে। যারা কথা বলছে তাদের গলার স্বর নিচু এবং চোখে এক ধরনের চকিত দৃষ্টি। একটু পরে পরে মাথা ঘুরিয়ে দেখছে। কান পেতে থাকলে ঘরে নিচু শব্দতরঙ্গের এক ধরনের ভোঁতা শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনো একটি শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাই চালু করা হয়েছে। আমি সামনে তাকালাম, একটু খুঁটিয়ে দেখার পরই চার কোনায় লেজাররশ্মি নিয়ন্ত্রণের জন্যে শক্তিশালী লেন্সগুলো চোখে পড়ল। ঘরের মেঝে থেকে ছোট ঘোট টিউব বের হয়ে এসেছে; তরল নাইট্রোজেনের সাথে জলীয় বাষ্প মিশিয়ে সাদা ধোঁয়ার মতো কিছু বের করা হবে। সংবেদী স্পিকারগুলো অনেক খুঁজেও বের করতে পারলাম না, নিশ্চয়ই সেগুলো হলঘরের দেয়ালে, ছাদে, মেঝেতে যত্ন করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রুস্টানের দেখা দেয়ার সময় পুরো ব্যাপারটির নাটকীয় অংশটুকু খুব যত্ন করে করা হয়।

    ঘরে যে মৃদু কথাবার্তা হচ্ছিল হঠাৎ সেটি থেমে যায়, আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি লিয়ানা এসেছে। লিয়ানার বয়স খুব বেশি নয়, অন্তত দেখে মনে হয় না। তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে কিন্তু শরীরটি অপূর্ব। অর্ধস্বচ্ছ নিও পলিমারের একটি কাপড়ের নিচে তার সুডৌল শরীরটি আবছা দেখা যাচ্ছে। সুগঠিত বুক, মেদহীন কোমল দেহ, মসৃণ ত্বক। তার চুলে এক ধরনের ধাতব রং সেগুলো মাথার উপরে ঝুঁটির মতো করে বাঁধা। লিয়ানার চোখের মণি নীল, দেখে মনে হয় সেখানে আকাশের গভীরতা।

    লিয়ানা কোনো কথা না বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, আমরা সবাই হাত নেড়ে তার প্রত্যুত্তর দিলাম। সে সামনে রাখা কার্পেটে পা ভাঁজ করে বসে পড়ে, তার ভঙ্গিটি খুব সপ্রতিভ এবং সাবলীল। তাকে দেখতেও বেশ লাগে, পুরুষমানুষের কামনাকে প্রশ্রয় দেয় বলেই কি না কে জানে। আমি যতদূর জানি লিয়ানা একা থাকতে ভালবাসে। মাঝে মাঝে বসতির কোনো সুদর্শন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় কিন্তু কখনো একজনের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে বলে মনে পড়ে না।

    লিয়ানা প্লাটিনামের পাত্র থেকে সবুজ রঙের তরলটি চুমুক দিয়ে খেয়ে যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করতেই ঘরের আলো আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। আমরা লিয়ানার গলার স্বর শুনতে পেলাম, তার গলার স্বরটি একটু শুষ্ক, দীর্ঘ সময় উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে গলার স্বর একটু ভেঙে গেলে যেরকম শোনায় অনেকটা সেরকম। সে চাপা গলায় বলল, মহান গ্রুস্টান আসছেন আমাদের কাছে। তোমরা সবাই আমার সাথে মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন কর মহামান্য গ্রুস্টানকে। গ্রুস্টান! আমাদের জীবন রক্ষাকারী গ্রুস্টান। মহান সর্বশক্তিশালী গ্রুস্টান।

    আমরা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বললাম, মহান সর্বশক্তিশালী গ্রুস্টান।

    হলঘরের সামনের অংশটুকু এক ধরনের সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যেতে থাকে। তরল নাইট্রোজেন বাষ্পীভূত হয়ে ঘরটাকে শীতল করে দেয়, আমি একটু শিউরে উঠি। খুব ধীরে ধীরে একটি সঙ্গীতের সুর বেজে ওঠে, সেটি একই সাথে সুখ এবং বিষাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সঙ্গীতের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে, সুখ এবং বিষাদের পরিবর্তে হঠাৎ আনন্দ এবং শঙ্কার অনুভূতি প্রবল হয়ে আসে। ধীরে ধীরে সঙ্গীতের সুর মানুষের আর্তচিৎকার আর হাহাকারের মতো শোনাতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই শব্দ বেড়ে উঠে হলঘরের দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে, আমরা এক ধরনের আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলি। হঠাৎ করে সমস্ত শব্দ থেমে গিয়ে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। আমরা চোখ খুলে তাকালাম, দেখতে পেলাম আমাদের সামনে শূন্যে গ্রুস্টান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হালকা সবুজ রঙের দেহ মনে হয় কেউ জেড পাথর কুঁদে তৈরি করেছে। শরীর থেকে এক ধরনের স্বচ্ছ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অপূর্ব কান্তিময় মুখাবয়ব, একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কঠোর এবং কোমল। একই সাথে হাসিখুশি এবং বিষাদগ্রস্ত। তার দেহ এক ধরনের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা, একদৃষ্টে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে দুই হাত উপরে তুলে ভারি গমগমে গলায় কথা বলে ওঠে, আমার প্রিয় মানুষেরা, তোমাদের জন্যে আমার ভালবাসা।

    আমরা নিচু গলায় বললাম, ভালবাসা। আমাদের ভালবাসা।

    তোমাদের সামনে আসতে পেরে আমি ধন্য।

    আমরা বললাম, ধন্য। আমি ধন্য।

    আমি অভিভূত।

    আমি অভিভূত। অভিভূত।

    তোমাদের জন্যে রয়েছে অভূতপূর্ব সুসংবাদ। গোপন এক কুঠুরিতে আবিষ্কার করেছি বিশাল প্রোটিনের সম্ভার। তোমাদের জন্যে রয়েছে অঢেল খাবার।

    আমরা হর্ষধ্বনি করে চিৎকার করে উঠি, জয়! মহান গ্রুস্টানের জয়!

    নূতন নেটওয়ার্কে যুক্ত করেছি আরেকটি বিশাল ভূখণ্ড সেখানে আবিষ্কার করেছি আরো একটি জনপদ।

    জয়! মানুষের জয়!

    পাহাড়ের গুহায় খুঁজে পেয়েছি ওষুধের কারখানা। সেখানে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের জন্যে অঢেল প্রয়োজনীয় ওষুধ। রোগশোকের বিরুদ্ধে রয়েছে তোমাদের আশ্চর্য নিরাপত্তা।

    নিরাপত্তা! আশ্চর্য নিরাপত্তা!

    শুধু তাই নয়– গ্রুস্টানের মুখ হঠাৎ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, পৃথিবীর অপর প্রান্তের এক ল্যাবরেটরিতে রয়েছে অপূর্ব সব সফটওয়ার। তাদের উৎকর্ষের কোনো তুলনা নেই। মহান শিল্পকর্মের মতো হবে তার আবেদন। আমি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব এই মহান সৃষ্টি। তোমাদের জীবন হবে অপূর্ব আনন্দময়

    আনন্দময়! অপূর্ব আনন্দময়!

    গ্রুস্টানের গলার স্বর আবেগে কাঁপতে থাকে। তার সুরেলা কণ্ঠস্বরে সারা ঘরে এক ধরনের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর নূতন মানুষ নিয়ে সে নূতন জীবনের কথা বলে, নূতন স্বপ্নের কথা শোনায়। আমাদের বুকে নূতন এক ধরনের আশা জাগিয়ে তোলে। তার গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি, গভীর আবেগ আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখে। আমাদের শরীর শিহরিত হয়ে উঠতে থাকে, আমরা এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করতে থাকি। আমরা যেন একটি স্বপ্নের জগতে চলে যাই।

    এক সময় গ্রুস্টানের কথা শেষ হল, আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বুকের ভিতর তখনো কেমন যেন শিহরন।

    লিয়ানা মাথা নিচু করে বলল, মহামান্য গ্রুস্টান।

    বল লিয়ানা।

    আমরা আমাদের এই বসতিতে আমাদের শিশুদের শিক্ষা দিতে চাই। প্রস্তুত করতে চাই নূতন জীবনের জন্যে।

    অবশ্যি লিয়ানা। অবশ্যি শিক্ষা দেবে তোমাদের শিশুদের।

    আমরা আপনার সাহায্য চাই মহামান্য গ্রুস্টান

    অবশ্যি আমার সাহায্য তোমরা পাবে লিয়ানা। অবশ্যি পাবে। আমি তোমাদের সাহায্য করব নূতন জীবনের আশার বাণী শেখাতে। ভালবাসার কথা স্বপ্নের কথা–

    আমি গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান, মহাকাশবিদ্যা জিনেটিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের কথা বলছিলাম—

    গ্রুস্টানের মুখে হঠাৎ এক ধরনের চাপা হাসি খেলা করতে থাকে। হাসতে হাসতে সে তরল গলায় বলল, না লিয়ানা, না। মানবশিশুকে তোমরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে দিও না। মানুষের শিক্ষা হবে শিল্পে, সাহিত্যে, সৌন্দর্যে। আশায় ভালবাসায়। নূতন স্বপ্লে। ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে তাদের মনকে কলুষিত কোরো না। গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত কোরো না। এই জ্ঞান খুব নিচুস্তরের জ্ঞান। এই জ্ঞান মানুষের উপযুক্ত জ্ঞান নয়। এই জ্ঞানচর্চা করবে রবোটেরা, তুচ্ছ রবোটেরা, তাদের হাস্যকর কপোট্রনে। মানুষের অপূর্ব মস্তিষ্ক এই জ্ঞানের অনেক উর্ধ্বে।

    লিয়ানা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু মহামান্য গ্রুস্টান–

    এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই লিয়ানা। মানুষের মস্তিষ্কে রয়েছে অচিন্তনীয় কল্পনাশক্তি। তাদের সেই অভূতপূর্ব শক্তিকে বিকশিত হতে আমাকে সাহায্য করতে দাও। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের যুক্তিতর্কের সীমায় তাদের আবদ্ধ কোরো না। সেই অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানটুকু আমি রবোটের কপোট্রনে সঞ্চারিত করে দেব। তোমাদের সেবায় রবোটেরা সেই জ্ঞানটুকু সমস্ত শক্তি দিয়ে নিয়োজিত করবে।

    লিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মহামান্য গ্রুস্টান

    বল লিয়ানা।

    আমাদের আরো একটি কথা ছিল।

    বল লিয়ানা। তোমাদের কথা শুনতেই আমি আজ এসেছি।

    আমাদের এই বসতিতে শিশুর সংখ্যা খুব কম। আমাদের আরো শিত্র প্রয়োজন। আমাদের পুরুষ এবং মহিলারা একটি করে পরিবার সৃষ্টি করতে পারে, একটি–দুটি শিশু নিয়ে সেই পরিবারটি নূতন জীবন শুরু করতে পারে। ভ্রূণ ব্যাংক থেকে আমরা কি কিছু নূতন শিশু পেতে পারি?

    গ্রুস্টান দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, লিয়ানা আমি তোমাদের বলেছি তোমরা যখন প্রস্তুত হবে আমি ভ্রূণ ব্যাংক থেকে তোমাদের শিশু এনে দেব। কিন্তু সে জন্যে তোমাদের প্রস্তুত হতে হবে–

    আমরা প্রস্তুত মহামান্য গ্রুস্টান।

    না– গ্রুস্টান তীব্র স্বরে বলল, তোমরা প্রস্তুত নও। তোমাদের মাঝে এখনো অসংখ্য ক্ষুদ্রতা, হীনমন্যতা, অসংখ্য কুটিলতা। তোমাদের মাঝে এখনো নানা ধরনের রূঢ়তা– এখনো ভালবাসার খুব অভাব। নূতন শিশু তোমাদের মাঝে এসে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবে না লিয়ানা। আমি জানি।

    লিয়ানা মাথা নিচু করে বসে রইল। গ্রুস্টান লিয়ানার কাছে এগিয়ে এসে বলল, লিয়ানা, আমি তোমাদের বুক আগলে বাঁচিয়ে রেখেছি, ক্ষুধায় খাবার দিয়েছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় দিয়েছি, রোগশোকে ওষুধ দিয়েছি, চিকিৎসা দিয়েছি। আমি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছি, যখন সময় হবে তোমাদের হাতে নূতন শিশু তুলে দেব। তাদের নিয়ে তোমরা আবার নূতন সভ্যতার সৃষ্টি করবে পৃথিবীতে। যে সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তার থেকে অনেক বড় হবে সেই সভ্যতা। অনেক মহান। সেটাই আমার স্বপ্ন। আমার আশা।

    লিয়ানা নিচু গলায় বলল, আপনার স্বপ্ন সফল হোক মহামান্য গ্রুস্টান।

    আমরা বিড়বিড় করে বললাম, সফল হোক। সফল হোক।

    বিদায় আমার প্রিয় মানুষেরা।

    বিদায়।

    গ্রুস্টান ভেসে ভেসে উপরে উঠে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আবার আমি আসব তোমাদের কাছে। আবার কথা বলব। কিন্তু জেনে রাখ, আমাকে যদি তোমরা নাও দেখ আমি কিন্তু তোমাদের সাথে আছি। সর্বক্ষণ আমি তোমাদের সাথে আছি। প্রতি মুহূর্তে। আমার ভালবাসার বন্ধনে তোমরা জড়িয়ে আছ আমার সাথে–তোমরা সবাই প্রতিটি মানুষ।

    সমস্ত হলঘরটি হঠাৎ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল। কয়েক মুহূর্ত এক ধরনের অসহনীয় নীরবতা, হঠাৎ এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ হতে থাকে মানুষের সম্মিলিত হাহাকারের মতো। সেই শব্দ ঘরের এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি এক সময় শব্দ থেমে আসে, সমস্ত ঘরে আবার নীরবতা নেমে আসে। তখন হঠাৎ করে ঘরের ছাদে ঘোলাটে হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। আমরা মাথা উঁচু করে একে অন্যের দিকে তাকাই, সবার চোখ এক ধরনের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না, চুপ করে বসে আছে।

    সবচেয়ে প্রথম কথা বলল বৃদ্ধ ক্লাউস। মাথার সাদা চুল পিছনে সরিয়ে সে কাঁপা গলায় বলল, গ্রুস্টানের উপস্থিতি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মনপ্রাণের সব ধরনের অবসাদ কেটে গিয়ে এক ধরনের সতেজ ভাব এসে যায়।

    কমবয়সী রিশি বলল, সমস্ত শরীর শিউরে শিউরে ওঠে! সে তার হাতটি সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

    ক্লাউস আবার বলল, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য আমরা গ্রুস্টানের স্নেহধন্য হয়েছি। তার ভালবাসা পেয়েছি।

    ক্লাউসের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, সে হঠাৎ দুই হাত উপরে তুলে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে ওঠে, জয় হোক। রুস্টানের জয় হোক।

    ঘরের অনেকে তার সাথে যোগ দিয়ে বলল, জয় হোক।

    ঠিক তখন হেঁটে হেঁটে লিয়ানা কাছে এসে দাঁড়াল, তাকে একই সাথে ক্লান্ত এবং বিষণ দেখাচ্ছে। ক্লাউস লিয়ানার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য গ্রুস্টান আমাদের এত স্নেহ করে।

    লিয়ানা কিছু বলল না। ক্লাউস আবার বলল, গ্রুস্টানের সাথে সময় কাটালে মনপ্রাণ পবিত্র হয়ে যায়।

    আমার কী হল জানি না হঠাৎ করে বলে ফেললাম, কিন্তু গ্রুস্টান তো একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছু না!

    ঘরের ভিতরে হঠাৎ যেন একটা বজ্রপাত ঘটে গেল। যে যেখানে ছিল সেখানে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঘুরে সবার দিকে তাকালাম, হঠাৎ করে কেমন জানি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি।

    লিয়ানা খুব ধীরে ধীরে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ কুশান?

    আমি আবার মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালাম, কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিয়ানা আবার বলল, কুশান–

    বল।

    তুমি কী বলেছ?

    আমি–আমি হঠাৎ প্রায় মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম, আমি বলেছি যে গ্রুস্টান একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। রিকিভ ভাষায় লেখা একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। মানুষের সাথে তার যোগাযোগ হয় হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে। ত্রিমাত্রিক ছবিতে। সে একটি কৃত্রিম চরিত্র। সে সত্যিকারের কিছু নয়–

    লিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যিকারের বলতে তুমি কী বোঝাও? ঈশ্বর ধরাছোঁয়ার অনুভবের বাইরে ছিল তবুও কি পৃথিবীর মানুষ হাজার হাজার বছর ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে নি?

    আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, সবকিছুর একটা সময় আছে কুশান। উৎসবের সময় আছে, শোকেরও সময় আছে। বিপ্লবের সময় আছে, বিদ্রোহেরও সময় আছে। সময়ের আগে কিছু করতে চাইলে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে হয়। আমাদের মানুষের এখন সেই ঝুঁকি নেয়ার শক্তি নেই কুশান।

    আমি অবাক হয়ে লিয়ানার দিকে তাকালাম, তাকে হঠাৎ কী দুঃখী একটা মানুষের মতো মনে হচ্ছে। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল তার মুখ স্পর্শ করে বলি, না লিয়ানা তুমি ভুল বলছ। আমাদের মানুষের সেই শক্তি আছে। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না।

    লিয়ানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা পাহাড়ের উপর থেকে তুমি একটা পাথর গড়িয়ে দিয়েছ কুশান। নিচে পড়তে পড়তে পাথরটা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে আবার গতি সঞ্চয় করে অন্য পাথরকে স্থানচ্যুত করে বিশাল একটা ধস নামিয়ে দিতে পারে। কোনটা হবে আমি জানি না। লিয়ানা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি কিন্তু এখন কোনোটাই চাই নি।

    আমি তখনো কিছু বলতে পারলাম না। লিয়ানা খানিকক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক ধরনের বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান গ্রুস্টান আমাদের এই কথোপকথনটি শুনছে।

    আমি জানতাম তবু কেন জানি একবার শিউরে উঠলাম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আমি তপু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }