Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ৩ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প1002 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ক্যাপ্টেন জুক

    ক্যাপ্টেন জুক

    নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেয়ালে লাগানো বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে নিশির হঠাৎ নূতন করে মনে হল যে মহাকাশচারীর জীবন প্রকৃতপক্ষে খুব নিঃসঙ্গ হতে পারে। শৈশব এবং কৈশোরে মহাকাশ অভিযান নিয়ে নিশির এক ধরনের মোহ ছিল, প্রথম কয়েকটি অভিযানে অংশ নিয়েই তার সেই মোহ কেটে যায়। সে আবিষ্কার করেছিল মহাকাশ অভিযান প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত কঠোর কিছু নিয়মকানুন দিয়ে বাঁধা অত্যন্ত কঠিন একটি জীবন। যদিও মহাকাশযানের বাইরে অসীম শূন্যতা, কিন্তু মহাকাশচারীদের থাকতে হয় ক্ষুদ্র পরিসরে। তাদের আপনজন যন্ত্র এবং যন্ত্রের কাছাকাছি কিছু মানুষ, তাদের বিনোদন অত্যন্ত জটিল কিছু যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাদের সঙ্গীত শক্তিশালী ইঞ্জিনের নিয়মিত গুঞ্জন। প্রথম কয়েকটি অভিযান শেষ করেই নিশি পৃথিবীর প্রচলিত জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সেখানে। গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে–তার অনুপস্থিতিতে পৃথিবীতে অর্ধ শতাব্দী কেটে গিয়েছে। তার পরিচিত মানুষের কেউ পৃথিবীতে নেই। যারা আছে তাদের কথাবার্তা, চাল–চলন মনে হয়। অপরিচিত, তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি গেলে নিজেকে মনে হয় অনাহূত। পৃথিবীর জীবনকে নিশির মনে হয়েছে দুঃসহ, আবার তখন সে মহাকাশচারীর জীবনে ফিরে এসেছে।

    নিশি জানে এই জীবনেই সে বাঁধা পড়ে গেছে, মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে শুনতে একদিন সে আবিষ্কার করবে তার চুল ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে, মুখের চামড়ায় বয়সের বলিরেখা–দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। তখন মহাকাশচারীর পরীক্ষায় বাতিল হয়ে কোনো এক উপগ্রহের অবসরকেন্দ্রে কৃত্রিম জোছনাতে বসে বসে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। নিশি নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–ঠিক তখন তার পাশে লিয়ারা এসে বসেছে, সে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের একজন পরিচালক। নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর নিশি? তুমি এতবড় একটি দীর্ঘশ্বাস কেন ফেললে?

    লিয়ারার প্রশ্ন শুনে নিশি হেসে ফেলল, বলল, সাধারণ নিশ্বাসে অক্সিজেন যদি অপ্রতুল হয়, তখন দীর্ঘ নিশ্বাসের প্রয়োজন। ব্যাপারটি একটি জৈবিক ব্যাপার, তুমি সত্যি যদি জানতে চাও শরীররক্ষা যন্ত্রের সাথে কথা বলতে পারি।

    লিয়ারা মাথা নেড়ে বলল, মহাকাশচারী না হয়ে তোমার এটর্নি হওয়া উচিত ছিল।

    নিশি হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। এতদিনে তাহলে হয়তো কোনো একটা উপগ্রহ কিনে ফেলতে পারতাম। তোমার কী খবর বল?

    লিয়ারা হাসিমুখেই বলল, খবর বেশি ভালো না।

    কেউ যদি হাসিমুখে বলে খবর ভালো নয় তাহলে সেটি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেয়ার কথা নয়, নিশিও নিল না। বলল, সব খবর যদি ভালো হয় জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়।

    তোমার পক্ষে বলা খুব সহজ। তোমাকে তো আর মান্ধাতা আমলের একটা প্রোগ্রামকে পালিশ করতে হয় না। তুমি জান মূল সিস্টেমে দুটি চার মাত্রার ক্রটি বের হয়েছে?

    তাই নাকি? নিশি হাসতে হাসতে বলল, ভালোই তো হল। তোমরা কয়েকদিন এখন কাজকর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকবে।

    লিয়ারা চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি সত্যিই মনে কর আমরা এমনিতে কোনো কাজকর্ম করি না?

    নিশি হাত তুলে বলল, না, না, না। আমি কখনোই সেটা বলি নি।

    লিয়ারা তার মনিটরে কিছু দুর্বোধ্য সংখ্যা প্রবেশ করাতে করাতে বলল, তুমি সেটা হয়তো মুখে বল নি, কিন্তু সেটাই বোঝাতে চেয়েছ।

    নিশি এবারে শব্দ করে হেসে বলল, লিয়ারা, তুমি দেখেছ, তোমার সাথে কথা বলা আজকাল কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

    কেন?

    আমি একটা জিনিস না বললেও তুমি ধরে নাও আমি সেটা বলতে চেয়েছি। কয়দিন পরে ব্যাপারটা হয়তো আরো গুরুতর হবে, কিছু একটা বলতে না চাইলেও তুমি ধরে নেবে আমি অবচেতন মনে সেটা বলতে চাই। আমি আগেই বলে রাখছি লিয়ারা, শুধুমাত্র যেটা আমি সচেতনভাবে করব তার দায়–দায়িত্ব আমি নেব।

    নিশির কথা শুনে লিয়ারা তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে নিশি হঠাৎ বুকের ভিতরে এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করে। লিয়ারা সম্ভবত সাদাসিধে একটি মেয়ে, তার কুচকুচে কালো চুল, বাদামি চোখ, মসৃণ ত্বক–সবই হয়তো খুব সাধারণ, কিন্তু তাকে দেখে সব সময়েই নিশি নিজের ভিতরে এক ধরনের ব্যাকুলতা অনুভব করে। মেয়েটির চেহারায়, কথা বলার ভঙ্গিতে বা চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা রয়েছে যেটি নিশিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। নিশি প্রাণপণ চেষ্টা করে তার মনের ভাবকে লিয়ারার কাছে গোপন রাখতে, কিন্তু মানুষ অত্যন্ত রহস্যময় একটি প্রাণী, কিছু কিছু জিনিস না চাইলেও প্রকাশ হয়ে যায়। লিয়ারার কাছে সেটা প্রকাশ হয়ে থাকলে নিশি খুব অবাক বা অখুশি হবে না।

    নিশি লিয়ারাকে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মনিটরে একটা লাল বাতি কয়েকবার জ্বলে উঠল এবং সাথে মহাকাশযানের দলপতি রুহানের অবিন্যস্ত চেহারাটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। রুহান বাম হাতে নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, নিশি, শুনেছ, কক্ষপথের কাছাকাছি একটা বিপদে পড়া মহাকাশযানের সিগনাল আসছে।

    তাই নাকি?

    হ্যাঁ। চার মাত্রায় সংকেত।

    নিশি শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, সর্বনাশ! চার মাত্রা হলে তো অনেক বড় বিপদ!

    হুঁ। রুহান নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, অনেক বড় বিপদ।

    কী করতে চাও এখন?

    রুহান দীর্ঘদিন থেকে মহাকাশে মহাকাশে সময় কাটিয়ে এসেছে বলেই কি না কে জানে সমস্ত জগৎসংসারের প্রতি তার একটা বিচিত্র উদাসীনতা জন্ম হয়েছে। সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী করতে চাই যদি জিজ্ঞেস কর তাহলে বলব কিছু হয় নি এরকম ভান করে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে যেতে চাই।

    নিশি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো করতে পারবে না। আসলে কী করবে?

    কী করব যদি জিজ্ঞেস কর তাহলে বলব আমাদের একটা স্কাউটশিপ পাঠাতে হবে।

    স্কাউটশিপ?

    হ্যাঁ।

    তার মানে আমাকে যেতে হবে?

    রুহান মাথা নেড়ে বলল, স্কাউটশিপ নিয়ে ভরসা করতে পারি এই মহাকাশযানে সেরকম মানুষ তুমি ছাড়া আর কে আছে বল।

    নিশি একটা নিশ্বাস ফেলল। মহাকাশচারীর জীবনে এটাই হচ্ছে নিয়ম। বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি না নিয়ে বিশাল একটি দায়িত্ব নেয়া। অসংখ্যবার করে করে অভ্যাস হয়ে গেছে, আজকাল আর সে অবাকও হয় না।

    রুহান বলল, আমি জানি একেবারেই শুধু শুধু যাওয়া হচ্ছে, মহাকাশযানটিতে কেউ বেঁচে নেই।

    কেমন করে জান?

    যেসব সংকেত এসেছে তাতে মনে হচ্ছে এটা অক্ষের উপর ঘুরছে না অর্থাৎ ভেতরে কৃত্রিম মহাকর্ষ নেই। জীবিত মানুষ থাকলে মহাকর্ষ থাকবে না এটা তো হতে পারে না।

    তা ঠিক।

    ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে নিশি প্রস্তুত হয়ে নেয়। বিধ্বস্ত মহাকাশযানটির কাছাকাছি যেতে কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টার মতো লেগে যাবে, ফিরে আসতে আরো চব্বিশ ঘণ্টা। মহাকাশচারীদের জীবনের জন্যে এটি এমন কিছু বেশি সময় নয়, কিন্তু তবুও অনেকেই স্কাউটশিপের কাছে তাকে বিদায় জানাতে এল। স্কাউটশিপের প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করে ইঞ্জিন চালু করার জন্যে যখন মূল প্রবেশপথ বন্ধ করতে যাচ্ছে তখন লিয়ারা উঁকি দিয়ে বলল, নিশি।

    কী হল লিয়ারা?

    সাবধানে থেকো।

    নিশি চোখ মটকে বলল, থাকব লিয়ারা।

    ***

    বিধ্বস্ত মহাকাশযানের ডকিং বে’তে স্কাউটশিপটা নামিয়ে নিশি কিছুতেই প্রবেশপথ উন্মুক্ত করতে পারল না। মহাকাশযানের মূল সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে তাকে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হল। প্রবেশপথের কিছু অংশ লেজার দিয়ে কেটে শেষ পর্যন্ত তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে হল, যার অর্থ ভিতরে কোনো জীবিত মানুষ নেই। নিশি গোলাকার প্রবেশপথ দিয়ে ভেসে ভেসে মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষের দিকে যেতে থাকে। রুহানের অনুমান সত্যি, মহাকাশযানটি তার অক্ষে ঘুরছে না, ভিতরে কৃত্রিম মহাকর্ষ নেই। নিশি ভেসে ভেসে করিডোর ধরে যেতে যেতে আবিষ্কার করে, ভিতরে তুলকালাম কিছু কাণ্ড ঘটে গেছে। মহাকাশযানের পুরোটি বিধ্বস্ত হয়ে আছে, জায়গায় জায়গায় বিস্ফোরণের চিহ্ন, আগুনে পোড়া কালো যন্ত্রপাতি ইতস্তত ভাসছে। দেয়ালে ফাটল, বাতাসের চাপ অনিয়মিত। নিয়ন্ত্রণকক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে সে একাধিক মৃতদেহকে ভেসে বেড়াতে দেখল, সেগুলিতে ভয়ানক আঘাতের চিহ্ন, দেখে মনে হয়, এই মহাকাশযানে কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। নিশি সাবধানে তার পায়ের সাথে বাধা স্বয়ংক্রিয় এটমিক ব্লাস্টারটি তুলে নিল, ভিতরে হঠাৎ করে কেউ আক্রমণ করতে চাইলে তাকে প্রতিহত করতে হবে।

    নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বের হয়ে নিশি বড় করিডোর ধরে ভাসতে ভাসতে মহাকাশযানের দলপতির ঘরটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। ঘরটির দরজা বন্ধ ছিল, হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই খুলে গেল। ভিতরে আবছা অন্ধকার, তার মাঝে নিশির মনে হল দেয়ালের কাছে কোনো একজন মানুষ ঝুলে আছে। নিশি পায়ে ধাক্কা দিয়ে কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল একজন মানুষ নিজেকে দেয়ালের সাথে বেঁধে ঝুলে রয়েছে, মানুষটি এখনো জীবিত। নিশি চমকে উঠে বলল, কে? কে ওখানে?

    মানুষটি জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এই মহাকাশযানে তোমাকে শুভ আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

    নিশি দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কী হয়েছে?

    আমার নাম জুক। ক্যাপ্টেন জুক। আমি এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন। এখানে একটা বিদ্রোহ হয়েছে। সেনা বিদ্রোহ।

    সেনা বিদ্রোহ?

    হ্যাঁ। বিদ্রোহটা দমন করা হয়েছে, কিন্তু শেষরক্ষা করা যায় নি। বিদ্রোহী মহাকাশচারীরা মারা গেছে। আমি এখনো বেঁচে আছি, কিন্তু অচিরেই মারা যাব।

    কেন?

    ক্ষতগুলি দূষিত হয়ে গেছে। সারা শরীরে পচন শুরু হয়েছে।

    তোমাকে আমি স্কাউটশিপে করে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের মহাকাশযানে তোমাকে চিকিৎসা করব। প্রয়োজন হলে শীতলঘরে করে তোমাকে পৃথিবীতে নিয়ে যাব।

    ক্যাপ্টেন জুক বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল, তার সুযোগ হবে না। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে।

    নিশি আরো একটু এগিয়ে গেল, ক্যাপ্টেন জুকের সময় সত্যি শেষ হয়ে আসছে। কৃত্রিম জীবনধারণ একাধিক জ্যাকেট তাকে কোনোভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে। মাথার ভিতর থেকে কিছু তার বের হয়ে এসেছে, শরীরের নানা জায়গায় নানা ধরনের যন্ত্র এবং নানা আকারের টিউব বিভিন্ন ধরনের তরল পাঠাচ্ছে এবং বের করে আনছে। ক্যাপ্টেন জুক তার শীর্ণ দুই হাতে কিছু একটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। ভিতরে আবছা অন্ধকার, জিনিসটি কী ভালো করে দেখতে গিয়ে নিশি চমকে উঠল, এটি একটি স্টান্টগান।

    নিশি নিজেকে রক্ষা করার জন্যে এটমিক ব্লাস্টারটা তুলে নেয়ার আগেই ক্যাপ্টেন জুক স্টান্টগান দিয়ে তাকে গুলি করল। পাজরে তীক্ষ্ণ একটি ব্যথা অনুভব করল নিশি, স্টান্টগানের ক্যাপসুল থেকে জৈব রসায়ন ছড়িয়ে পড়ছে তার শরীরে, নিশি হঠাৎ করে সমস্ত শরীরে এক ধরনের খিঁচুনি অনুভব করে। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে সে দেখতে পেল ক্যাপ্টেন জুক হাত বাড়িয়ে তার ভাসমান দেহটিকে আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলছে–এস বন্ধু! আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

    নিশির জ্ঞান হল লিয়ারার গলার স্বরে, পিঠে ঝুলিয়ে রাখা যোগাযোগ মডিউল থেকে তাকে সে ডাকছে। জ্ঞান হওয়ার পরেও নিশি ঠিক বুঝতে পারল না সে কোথায়, মনে হল সে একটি ঘোরের মাঝে আছে, ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত মানুষের মতো তার চিন্তা বারবার জট পাকিয়ে যেতে থাকে। কষ্ট করে সে চোখ খুলে তাকাল, তার আশপাশে অনেক কিছু ভাসছে, ঘরে একটা কটু গন্ধ, নিশির মনে হয় সে বুঝি আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সে জাগিয়ে রেখে মাথা ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেন জুকের দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় তীক্ষ্ণ একটি যন্ত্রণা অনুভব করে, চোখের সামনে লাল একটা পরদা ভেসে আসে, মাথার ভিতরে কিছু একটা দপদপ করতে থাকে। নিশি মাথায় স্পর্শ করতেই চমকে উঠল, তার মাথার মাঝে জমাট বাধা রক্ত, সেখান থেকে সরু একটা নমনীয় টিউব বের হয়ে আসছে। নিশি চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, তাল সামলাতে না পেরে সে মহাকর্ষহীন পরিবেশে বারকয়েক ঘুরে যায়, দেয়াল ধরে কোনোমতে সামলে নিল নিশি। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালের পাশে বেঁধে রাখা ক্যাপ্টেন জুকের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল মানুষটি মৃত। তার মাথায় একটি হেলমেট পরানো, সেখান। থেকে কিছু তার দেয়ালে লাগানো একটি যন্ত্রে গিয়েছে, যন্ত্রটি অপরিচিত, সে আগে কখনো দেখে নি। নিশি কাছে গিয়ে দেখল সেটি এখনো গুঞ্জন করে যাচ্ছে।

    নিশি হঠাৎ আবার মাথায় তীব্র এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করে, মাথার ভিতরে কিছু। একটা দপদপ করতে থাকে, চোখের সামনে বিচিত্র সব রং খেলা করতে থাকে। যোগাযোগ মডিউলে আবার সে লিয়ারার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, কী হয়েছে নিশি?

    নিশি কাতর গলায় বলল, বুঝতে পারছি না। আমার মাথায় একটা টিউব ঢোকানো হয়েছে, মনে হয় কোনো একটা তথ্য পাঠানো হচ্ছে।

    কী বলছ তুমি?

    ঠিকই বলছি। আমার মস্তিষ্কে কিছু একটা হচ্ছে। আমি বিচিত্র সব জিনিস দেখছি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না।

    তুমি কোনো চিন্তা কোরো না নিশি, আমি রুহানের সাথে কথা বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।

    নিশি ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যা দেখ কিছু করতে পার কি না?

    নিশি চোখ বন্ধ করে আবার জ্ঞান হারাল, তার মনে হতে লাগল মস্তিষ্কের ভিতর অসংখ্য প্রাণী কিলবিল করছে।

    মহাকাশযান থেকে তার মস্তিষ্কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে যখন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হল তখন সে বিড়বিড় করে কিছু একটা কথা বলছিল, মনে হল সে অদৃশ্য কোনো মানুষের সাথে কথা বলছে, কী বলছে ঠিক বোঝা গেল না, শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন জুক এর নামটা কয়েকবার শোনা গেল।

    ***

    নিশির মস্তিষ্কে কয়েকটা ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করে তাকে শেষ পর্যন্ত আবার সুস্থ করে তোলা হয়েছে। শারীরিক দিক দিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু মানসিকভাবে তাকে। সব সময়েই খানিকটা বিপর্যস্ত দেখায়। লিয়ারা একদিন জিজ্ঞেস করল, নিশি, তোমার কী হয়েছে? তোমাকে সব সময় এত চিন্তিত দেখায় কেন?

    নিশি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি ব্যাপারটা ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না, কিন্তু সব সময় মনে হয় আমি আসলে এক জন মানুষ নই, আমার ভিতরে আরো এক জন মানুষ আছে।

    আরো এক জন মানুষ? কী বলছ?

    হ্যাঁ।

    তোমার পুরো শরীর ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, বলা যেতে পারে তোমার মস্তিষ্কের একটা একটা নিউরন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।

    হ্যাঁ, কিন্তু সেই নিউরনে কী তথ্য রয়েছে সেটা পেরীক্ষা করে দেখা হয় নি। আমার ধারণা

    তোমার ধারণা?

    বিধ্বস্ত মহাকাশযানটাতে ক্যাপ্টেন জুক তার স্মৃতিটা জোর করে আমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

    লিয়ারা শান্ত গলায় বলল, তুমি সেটা আগেও বলেছ নিশি, কিন্তু তুমি তো জান সেটি ঠিকভাবে করার মতো যন্ত্র পৃথিবীতে নেই। একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি রাখার মতো কোনো মেমোরি মডিউল নেই।

    ক্যাপ্টেন জুকের মহাকাশযানে একটা অপরিচিত যন্ত্র ছিল, হয়তো সেটাই মানুষের মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কে স্মৃতি স্থানান্তর করে।

    সেটি তোমার একটি অনুমান মাত্র।

    কিন্তু আমার ধারণা আমার এই অনুমান সত্যি।

    লিয়ারা ভয় পাওয়া চোখে বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?

    আমি বুঝতে পারি।

    বুঝতে পার?

    হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মনে হয় ক্যাপ্টেন জুক মস্তিষ্কের ভিতরে আমার সাথে কথা বলে।

    কথা বলে? লিয়ারা অবাক হয়ে বলল, কী বলে?

    সে বের হয়ে আসতে চায়।

    কেমন করে বের হয়ে আসতে চায়?

    নিশি বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না।

    লিয়ারা শংকিত দৃষ্টিতে নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নিশির মস্তিষ্কে যে ক্যাপ্টেন জুক রয়েছে এবং সে যে বের হয়ে আসতে চায় সেই কথাটির প্রকৃত অর্থ কী সেটা তার পরদিনই প্রকাশ পেল। নিয়ন্ত্রণকক্ষে নিশি আর লিয়ারা মিলে মূল সিস্টেমের একটা ত্রুটি সারাতে সারাতে হালকা কথাবার্তা বলছিল। সূক্ষ্ম একটি তার নির্দিষ্ট জায়গায় বসানোর জন্যে লিয়ারা নিশ্বাস বন্ধ করে রেখে কাজটি সেরে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষের ডিজাইনটি ঠিক নয়।

    নিশি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, কেন ঠিক নয়?

    এই যেমন মনে কর নিশ্বাস নেয়ার ব্যাপারটা। প্রায় প্রতি সেকেন্ডে আমাদের একবার নিশ্বাস নিতে হয়। কী ভয়ানক ব্যাপার!

    নিশি হেসে বলল, তুমি নিশ্বাস নিতে চাও না?

    আমি চাই কি না চাই সেটা কথা নয়, বেঁচে থাকতে হলে আমাকে নিশ্বাস নিতেই হবে, আমার সেখানেই আপত্তি।

    লিয়ারার কথার ভঙ্গিতে নিশি শব্দ করে হেসে ফেলল, বলল, তোমার আর কিসে কিসে আপত্তি বল দেখি!

    লিয়ারা মুখ শক্ত করে বলল, তুমি আমার কথার সাথে একমত হবে না?

    নিশি কিছু একটা বলার জন্যে লিয়ারার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু না বলে বিচিত্র এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সে তার মেরুদণ্ড সোজা করে শক্ত হয়ে বসল। লিয়ারা অবাক হয়ে দেখল নিশির চেহারা কেমন যেন পাল্টে গেছে, তার চোখেমুখে হাসিখুশির ভাবটি নেই, সেখানে কেমন যেন অপরিচিত কঠোর একটি ভাব চলে এসেছে। লিয়ারা শংকিত গলায় বলল, নিশি, কী হয়েছে তোমার?

    নিশি খুব ধীরে ধীরে লিয়ারার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টি কঠোর। সে কঠিন গলায় বলল, আমি নিশি নই।

    তুমি কে?

    আমি জুক। ক্যাপ্টেন জুক।

    জুক?

    হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত আমি বের হয়েছি। নিশি তার হাত চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, আমার হাত। শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, আমার শরীর!

    লিয়ারা ভয় পাওয়া গলায় বলল, নিশি! নিশি–তোমার কী হয়েছে নিশি?

    নিশি ক্রুদ্ধ চোখে লিয়ারার দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলল, আমি নিশি নই।

    লিয়ারা ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল, সাথে সাথে নিশিও উঠে দাঁড়িয়ে খপ করে লিয়ারার হাত ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

    লিয়ারা কাতর গলায় বলল, নিশি! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?

    না। নিশি বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে বলল, কিন্তু চিনতে কতক্ষণ? এস। আমার কাছে এস।

    লিয়ারা প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে মুক্ত করে ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। লিয়ারার কাছে খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই রুহান এবং অন্যেরা এসে আবিষ্কার করল নিশি দুই হাতে তার মাথা ধরে টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রুহান নিশির কাছে গিয়ে। ডাকল, নিশি।

    নিশি সাথে সাথে মাথা তুলে তাকাল। বলল, কী হল রুহান?

    তোমার কী হয়েছিল?

    আমার? আমার কী হবে?

    তুমি নিজেকে ক্যাপ্টেন জুক বলে দাবি করছিলে কেন?

    মুহূর্তে নিশির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রক্তশূন্য মুখে বলল, করেছিলাম নাকি?

    লিয়ারা কাছে এসে নিশির হাত স্পর্শ করে বলল, হ্যাঁ, নিশি করেছিলে।

    নিশি দুই হাতে নিজের চুল খামচে ধরে বলল, আমি জানতাম! আমি জানতাম!

    কী জানতে?

    আমার মাঝে সেই শয়তানটা ঢুকে গেছে। এখন সে বের হতে শুরু করেছে! কী হবে এখন?

    রুহান নিশির কাঁধ ধরে একটা ছোট আঁকুনি দিয়ে বলল, তুমি শুধু শুধু ঘাবড়ে যাচ্ছ নিশি। মহাকাশযানের ডাটাবেসে অন্তত এক ডজন মনোবিজ্ঞানী আছে! এখানকার চিকিৎসকদের নিয়ে তারা কয়েকদিনে তোমার সমস্যা সারিয়ে তুলবে।

    নিশি অবশ্যি কয়েকদিনে সেরে উঠল না, দ্বিতীয়বার তার ভিতর থেকে ক্যাপ্টেন জুক বের হয়ে এল তিন দিন পর। নিশি ব্যাপারটা টের পেল পরদিন ভোরবেলা, নিজেকে হঠাৎ করে আবিষ্কার করল মহাকাশযানের ডকিং বে’তে। রাতের পোশাক পরে সে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে কেন এসেছে, কীভাবে এসেছে সে জানে না। নিশি শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে ফিরে এসে আবিষ্কার করল তার পুরো ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। মনে হয় কেউ একজন ইচ্ছে করে সেটি তছনছ করে রেখেছে, মানুষটি কে হতে পারে বুঝতে তার দেরি হল না। মাথার কাছে ভিডি সেন্টারে কেউ একজন তার জন্যে একটা ভিডিও ক্লিপ রেখে গেছে।

    ভিডি সেন্টার স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝামাঝি তার নিজের চেহারা ফুটে উঠল–সে নিজেই তার জন্যে কোনো একটা তথ্য রেখে গেছে! নিশি অবাক হয়ে তার নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটি সে নিজে কিন্তু তবু সে জানে মানুষটি অন্য কেউ। নিশি অবাক হয়ে তার নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল, চোখের দৃষ্টি ক্রূর, মুখের ভঙ্গিতে একই সাথে বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং অবজ্ঞা। হাত তুলে এই মানুষটি হিংস্র গলায় বলল, তুমি নিশ্চয়ই নিশি–আমি তোমাকে কয়টা কথা বলতে চাই।

    মানুষটি নিজের দেহকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই যে শরীরটা দেখছ এটা আমার শরীর। আমার। তুমি যদি ভেবে থাক তুমি জন্ম থেকে এই শরীরটাকে ব্যবহার করে এসেছ বলে এটি তোমার, তাহলে জেনে রাখ–~এটা সত্যি নয়। এটা ভুল। এটা মিথ্যা। তুমি স্বীকার কর আর নাই কর আমি এই দেহের মাঝে প্রবেশ করেছি। আমি খুব খুঁতখুঁতে মানুষ, আমার ব্যক্তিগত জিনিস অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে ভালো লাগে না। তাই তুমি এই শরীর। থেকে দূর হয়ে যাও।

    মানুষটি হঠাৎ ষড়যন্ত্রীদের মতো গল নিচু করে বলল, তুমি যদি নিজে থেকে এই শরীর ছেড়ে না যাও আমি তোমাকে এখান থেকে দূর করব। আমার নাম ক্যাপ্টেন জুক, আমার অসাধ্য কিছু নেই।

    ভিডি সেন্টারটি অন্ধকার হয়ে যাবার পরও নিশি হতচকিত হয়ে বসে রইল, পুরো ব্যাপারটি তার কাছে একটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। নিশি তার সমস্ত শরীরে এক ধরনের অবসাদ অনুভব করে। তার চোখ রক্তবর্ণ, শরীরের নানা জায়গায় চাপা যন্ত্রণা, ক্যাপ্টেন জুক নামের এই মানুষটি সারারাত তাকে নিদ্রাহীন রেখে শরীরের ওপর কী কী অত্যাচার করেছে কে জানে!

    তৃতীয়বার ক্যাপ্টেন জুকের আবির্ভাব হল আরো তাড়াতাড়ি এবং সে নিশির শরীরে অবস্থান করল আরো দীর্ঘ সময়ের জন্যে। মহাকাশযানের সবাই তাকে এবার একটা বিচিত্র বিতৃষ্ণা নিয়ে লক্ষ করল। নিশি নামক যে মানুষটার সাথে মহাকাশযানের প্রায় সবার এক ধরনের আন্তরিক হৃদ্যতা রয়েছে তার মাঝে প্রায় দানবীয় একটা চরিত্রকে আবিষ্কার করে সবাই আতংকে শিউরে উঠল। নিশির দেহের মাঝে অবস্থান করা ক্যাপ্টেন জুক মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণকক্ষে গিয়ে মহাকাশযানের অস্ত্র সরবরাহ কেন্দ্রটি খোলার। চেষ্টা করল। খবর পেয়ে রুহান তাকে থামাতে এল, বলল, তুমি এটা করতে পারবে না নিশি।

    নিশির দেহে অবস্থান করা মানুষটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো করে জান আমি নিশি নই। আমি একটি মহাকাশযানের সর্বাধিনায়ক। আমি ক্যাপ্টেন জুক। আমার অস্ত্র সরবরাহ কেন্দ্র খোলার অধিকার আছে।

    রুহান বলল, একজন মানুষের পরিচয় তার দেহ দিয়ে। তোমার দেহটি নিশির, কাজেই তার মস্তিষ্কে এই মুহূর্তে যে–ই থাকুক না কেন, মহাকাশযানের হিসেবে তুমি হচ্ছ নিশি। মহাকাশযানের ডাটাবেসে ক্যাপ্টেন জুক বলে কেউ নেই। আমি তাকে চিনি না।

    না চিনলে এখন চিনে নাও। এই যে আমি–ক্যাপ্টেন জুক।

    তুমি যদি এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে না যাও আমি তোমাকে নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে নিয়ে যাব।।

    ক্যাপ্টেন জুক হা হা করে হেসে বলল, তোমার বিশ্বস্ত সহকর্মীকে তুমি গ্রেপ্তার করবে? মহাকাশযানের আইন কি তোমাকে সেই অধিকার দিয়েছে?

    রুহান তীব্র দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন জুকের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।

    নিশি দুই দিন পর নিজেকে আবিষ্কার করল মহাকাশযানের এক পরিত্যক্ত ঘরে। তার সারা শরীর দুর্বল এবং অবসাদগ্রস্ত, চোখ লাল, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা, নিশির মনে হয় মাথার। ভিতরে কিছু একটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে নিজের ঘরে ফিরে যেতে থাকে। বড় করিডোরে তার লিয়ারার সাথে দেখা হল, সে অবাক হয়ে বলল, তুমি কে? নিশি নাকি ক্যাপ্টেন জুক?

    নিশি।

    লিয়ারা এসে তার হাত ধরে কোমল গলায় বলল, তোমার এ কী চেহারা হয়েছে। নিশি?

    নিশি দুর্বলভাবে বলল, জানি না লিয়ারা। ক্যাপ্টেন জুক আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।

    কী চায় সে?

    আমার শরীরটা। আমাকে সরিয়ে দিয়ে সে আমার শরীরটাকে ব্যবহার করবে।

    লিয়ারা ভয়ার্ত চোখে নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে আমরা কীভাবে সাহায্য করব?

    জানি না। নিশি মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় আমাকে সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে লিয়ারা। আমাকে আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।

    লিয়ারা নরম গলায় বলল, এরকম কথা বোলো না নিশি। নিশ্চয়ই আমরা কিছু একটা ভেবে বের করব। চল, আমি তোমাকে তোমার ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।

    ধন্যবাদ লিয়ারা। নিজের ঘরে নিশির জন্যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তার টেবিলের উপর একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ভিডি সেন্টারে আরো একটা ভিডিও ক্লিপ। সেখানে কী থাকতে পারে নিশির অনুমান করতে কোনো সমস্যা হল না। ভিডি সেন্টারটি চালু করতে তার ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু না করে কোনো উপায় ছিল না।

    এবারের ভিডিও ক্লিপটি ছিল আগেরবারের থেকেও উদ্ধত। মানুষটি তীব্র স্বরে চিৎকার করে বলল, আহাম্মক! এখনো আমার কথা বিশ্বাস করলে না? আমি এই শরীরটাকে নিজের জন্যে চাই। পুরোপুরি চাই।

    ক্যাপ্টেন জুক দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে হিংস্র গলায় বলল, নির্বোধ কোথাকার। তুমি দেখেছ আমি বারবার ফিরে আসছি? প্রত্যেকবার আসছি আগেরবার থেকে তাড়াতাড়ি, কিন্তু থাকছি বেশি সময়ের জন্যে। এর পরেরবার আমি আসব আরো আগে, থাকব আরো বেশি সময়। এমনি করে আস্তে আস্তে এমন একটা সময় আসবে যখন আমি থাকব পুরো সময় আর তুমি একেবারেই থাকবে না। শরীরটা হবে আমার। পুরোপুরি আমার।

    নিশি অবাক হয়ে দেখল তার শরীরের মাঝে মানুষটা হা হা করে হাসতে শুরু করেছে। হাসতে হাসতে সে অস্ত্রটা দেখিয়ে বলল, দেখেছ আমি একটা অস্ত্র যোগাড় করেছি? কী করব এই অস্ত্র দিয়ে শুনতে চাও? আমার মহাকাশযানে কী ঘটেছিল মনে আছে এখানেও তাই হবে। তবে এখানে কোনো ভুল হবে না। তুমি কী ভাবছ নিশি? এই অস্ত্র তুমি ফিরিয়ে দেবে? তোমাকে বলি আমি শুনে রাখ, আমার কাছে আরো অস্ত্র আছে, আমি লুকিয়ে রেখেছি এই মহাকাশযানে। যখন সময় হবে বের করে আনব।

    নিশি কোনোভাবে টেবিলটা ধরে হতবাক হয়ে ভিডি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল।

    পরবর্তী দুদিন নিশির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে রইল। মহাকাশযানের চিকিৎসা কেন্দ্রে তার শরীরের মাঝে কিছু বিচিত্র ধরনের বিষাক্ত জিনিস আবিষ্কার করা হল। তার নিদ্রাহীন বিশ্রামহীন দেহ পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। নিশিকে চিকিৎসা কেন্দ্রে। শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিতে হল দুই দিন। বিশ্রাম নিয়ে শরীরটি যখন মোটামুটিভাবে সুস্থ হয়ে এল তখন ক্যাপ্টেন জুক ফিরে এল আবার, এবারে আগের চাইতেও তীব্রভাবে, আগের চাইতেও নৃশংসভাবে।

    ক্যাপ্টেন জুক এবারে নিশির দেহ নিয়ে ফিরে গেল অস্ত্রাগারে। নিজেকে অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে নিশি লিয়ারাকে জিম্মি করে নিয়ন্ত্রণ দখল করে নিল খুব সহজে। সে নির্বিচারে অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত, কিন্তু কেউ তাকে স্পর্শ করবে না সেটি সে খুব ভালো করে জানে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের সবরকম প্রবেশপথ বন্ধ করে সে মহাকাশযানের গতিপথ পাল্টানোর চেষ্টা করল, কাছাকাছি মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সাথে সংঘর্ষ ঘটানোর জন্যে ডাটাবেসে বিচিত্র সব তথ্য প্রবেশ করতে শুরু করল।

    নিশি অবশ্য তার কিছুই জানল না। যখন সে জ্ঞান ফিরে পেল, সে নিজেকে আবিষ্কার করল নিয়ন্ত্রণকক্ষের গদিআঁটা নরম চেয়ারে। তার সামনেই আরেকটা চেয়ারে লিয়ারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। নিশি অবাক হয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে লিয়ারা?

    লিয়ারা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল, তোমার সেটা জেনে কোনো লাভ নেই নিশি। তুমি বরং এসে আমাকে খুলে দাও।

    নিশি উঠে দাঁড়াতেই তার মাথা হঠাৎ ঘুরে উঠল, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে টলতে টলতে সে লিয়ারার কাছে এগিয়ে যায়। তার সারা শরীরে এক বিচিত্র অসুস্থ অনুভূতি, মনে হয় এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। নিশি বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, কী হয়েছিল এখানে লিয়ারা?

    ভিডি স্ক্রিনে তোমার জন্যে কিছু তথ্য রেখে গেছে ক্যাপ্টেন জুক।

    নিশি টলতে টলতে ভিডি স্ক্রিনটা স্পর্শ করতেই সেখানে নিজেকে দেখতে পেল ভয়ংকর খ্যাপা একটা মানুষ হিসেবে। তীব্র স্বরে হিসহিস করে বলল, আবার আমি ফিরে গেলাম নির্বোধ আহাম্মক। তবে জেনে রাখ, এর পরেরবার যখন ফিরে আসব আমি আর ফিরে যাব না। তোমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে নিশি। জীবনের শেষ কয়টা দিন যদি পার উপভোগ করে নাও। তবে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি সেটি খুব সহজ হবে না। আমি তোমার শিরায় শিরায় নিহিলা বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছি–তুমি মারা যাবে না, কিন্তু প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তোমার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠবে, মনে হবে তোমার ধমনী দিয়ে গলিত সীসা বয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের সব চিকিৎসক মিলে যখন তোমাকে সুস্থ করে তুলবে তখন আমি ফিরে আসব সেই সুস্থ দেহে।

    নিশি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল মানুষটা হা হা করে হাসতে শুরু করেছে খ্যাপার। মতো। সে হঠাৎ নিজে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছিল, লিয়ারা জাপটে ধরে তাকে দাঁড়া করিয়ে রাখল। কাতর গলায় ডাকল, নিশি, নিশি

    বল লিয়ারা।

    কী হবে এখন নিশি।

    নিশি দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি ক্যাপ্টেন জুককে হত্যা করব লিয়ারা।

    হত্যা করবে? ক্যাপ্টেন জুককে?

    হ্যাঁ।

    কিন্তু তুমি আর ক্যাপ্টেন জুক তো একই মানুষ।

    তাতে কিছু আসে যায় না লিয়ারা। তবু আমি তাকে হত্যা করব। এন্ড্রোমিডার কসম।

    ***

    চোখ খুলে তাকাল ক্যাপ্টেন জুক, আবার ফিরে এসেছে সে নিশির শরীরে। এবারে আর কেউ তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, এখন থেকে নিশির শরীরটি পুরোপুরি তার। কীভাবে অন্যের দেহে অনুপ্রবেশ করে তাকে দখল করতে হয় সেটা সে খুব ভালো করে জানে। কতবার করেছে সে! এক দেহ থেকে অন্য দেহে, সেখান থেকে আবার অন্য দেহে। জরাজীর্ণ দুর্বল বৃদ্ধের দেহ থেকে সুস্থ–সবল কোনো যুবকের দেহে। ক্যাপ্টেন জুক উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে আবিষ্কার করল তার হাতপা বিছানার সাথে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা। চমকে উঠে যাচকা টান। দিতেই টেবিলের হলোগ্রাফিক ভিডি স্ক্রিন চালু হয়ে উঠল। নিশির একটি পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক অবয়ব দেখতে পেল ক্যাপ্টেন জুক। শুনতে পেল নিশি মাথা বঁকিয়ে বলছে, শুভ সকাল ক্যাপ্টেন জুক। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমি নিশি। আমার জন্যে অনেকবার তুমি ভিডি স্ক্রিনে তথ্য রেখেছ এবারে আমি রাখছি। একটা দেহ যখন দুজন মানুষ ব্যবহার করে তখন কথা বলার আর অন্য উপায় কী?

    ক্যাপ্টেন জুক, তুমি সম্ভবত তোমার হাতপায়ের বাঁধনকে টানাটানি করেছ, ভিতরে মাইক্রোসুইচ ছিল, সেটা এই ভিডি স্ক্রিনকে চালু করেছে। আমি সেভাবেই এটা প্রস্তুত করেছি। তুমি জেগে ওঠার পর আমি তোমার সাথে কথা বলব। হাতকড়াগুলি টেনে খুব লাভ হবে না। স্টেনলেস স্টিলে শতকরা পাঁচ ভাগ জিরকলাইট দিয়ে এটাকে বাড়াবাড়ি শক্ত করা হয়েছে। মানুষ যদি টাইরানোসোরাস রেক্সকে বেঁধে রাখতে চাইত সম্ভবত এই ধরনের কিছু ব্যবহার করত! কাজেই টানাটানি করে তুমি এটা খুলতে পারবে না। শুধু শুধু চেষ্টা করে লাভ নেই, আমি চাই তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোন।

    ক্যাপ্টেন জুক, আমি তোমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি আমার তৈরি করা যন্ত্রপাতি ঠিক ঠিক কাজ করে থাকে তাহলে এই মুহূর্তে উপরের দেয়াল থেকে একটা বিশাল পেণ্ডুলাম দুলতে শুরু করবে। দোলনকালটা আমি হিসেব করেছি, এটা হবে পাঁচ সেকেন্ড, তার বেশিও না, কমও না।

    নিশি কথা বলা বন্ধ করল এবং সাথে সাথে ক্যাপ্টেন জুক আবিষ্কার করল সত্যি সত্যি তার গলার উপর দিয়ে বিশাল একটা পেন্ডুলাম বাম দিক থেকে ডান দিকে ঝুলে গেল। ডান দিকে শেষ প্রান্তে পৌঁছে আবার সেটা দুলে এল বাম দিকে। তারপর আবার ডান দিকে।

    নিশি ভিডি স্ক্রিনে আবার কথা বলতে শুরু করে, দোলনকালটা অনেক চিন্তাভাবনা করে পাঁচ সেকেন্ড দাঁড় করিয়েছি। আমার ধারণা, মানুষের স্নায়ুতে চাপ ফেলার জন্যে পাঁচ সেকেন্ড যথাযথ সময়। কী হচ্ছে সেটা বোঝার জন্যে যথেষ্ট আবার অপেক্ষা করার জন্যে খুব বেশি দীর্ঘ নয়। একটা পেন্ডুলাম তোমার গলার উপর দিয়ে দুলে যাবে সেটি কেন তোমার স্নায়ুতে চাপ ফেলবে তুমি নিশ্চয়ই সেটা ভেবে অবাক হচ্ছ। অবাক হবার কিছু নেই, তুমি পেন্ডুলামটির নিচে ভালো করে তাকাও। একটা ধারালো ব্লেড দেখেছ ক্যাপ্টেন জুক? স্টেনলেস স্টিলের পাতলা একটা ব্লেড। শক্ত কিছু কাটতে পারবে না–কিন্তু মানুষের টিস্যু, চামড়া, ধমনী কেটে ফেলবে সহজেই। আমি তার চাইতে শক্ত কিছু কাটতেও চাই না

    ক্যাপ্টেন জুক। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ একটা পেন্ডুলাম যদি তোমার গলার উপর দিয়ে প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একবার করে দুলে আসে_হোক না সেটা যতই ধারালো–তাতে ভয় পাবার কী আছে? আমি তোমার সাথে একমত–এতে ভয় পাবার কিছু নেই। কিন্তু

    নিশি থেমে গিয়ে সহৃদয়ভাবে সে বলল, এই পেন্ডুলামটির একটা বৈশিষ্ট্য আছে, তুমি যদি খুব ভালো করে এর যান্ত্রিক কৌশলটি লক্ষ্য করে দেখে থাক তাহলে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ পেন্ডুলামটি খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে। কেন এটা করেছি নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ। আমি তোমাকে খুব ধীরে ধীরে হত্যা করতে চাই। এই ধারালো পেন্ডুলামটি তোমার গলাকে দু ভাগ করতে অনেকক্ষণ সময় নেবে–এই সারাক্ষণ সময় তুমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। মানুষের ওপর অত্যাচার করার এর চাইতে ভালো কিছু আমি খুঁজে পেলাম না। তবে এই আইডিয়াটা আমার নিজের নয়। এডগার এলেন পো নামে একজন অত্যন্ত প্রাচীন লেখক ছিলেন, এটি তার গল্পের আইডিয়া। কী মনে হয় ক্যাপ্টেন জুক? আইডিয়াটি চমৎকার না?

    ক্যাপ্টেন জুক। আমি এখন তোমার সম্পর্কে জানি। খানিকটা খোঁজখবর নিয়েছি, খানিকটা চিন্তাভাবনা করেছি। তুমি কী যন্ত্র দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে যাও সেটাও খানিকটা বুঝতে পেরেছি। মস্তিষ্কের যে অংশ মানুষের মূল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশে তুমি অনুপ্রবেশ কর। নিউরন ম্যাপিং দিয়ে সেটা হয়। চমৎকার বুদ্ধি। একজন মানুষের একাধিক চরিত্র থাকতে পারে, কাজেই কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। একবার মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করার পর তুমি কীভাবে তার দেহ দখল কর সেটাও আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার পদ্ধতিটি খুব সহজ। যতক্ষণ দেহটা তোমার দখলে থাকে তুমি তার যত্ন নাও। যখন তোমার দেহটা ছেড়ে যাবার সময় হয় তুমি দেহের মাঝে একটা যন্ত্রণা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে যাও যেন তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী এই দেহ নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করে। এক বার, দুই বার, বার বার এটা তুমি কর। মস্তিষ্ক তখন আর যন্ত্রণার মাঝে দিয়ে যেতে চায় না, সেটি তোমার কাছে থাকে। তুমি নিয়ন্ত্রণ কর। একটা মানুষকে তুমি চিরদিনের জন্যে শেষ করে দাও।

    নিশি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আজ আমি এর সবকিছুর নিস্পত্তি করব। চিরদিনের মতো। সেজন্যে আমার খানিকটা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী, খানিকটা নয় অনেকটাই! আমি তোমাকে হত্যা করব, কিন্তু তোমাকে তো আলাদা করে হত্যা করা যাবে না, হত্যা করতে হবে তোমার শরীরকে। সেটা তো আমারও শরীর– সেটাকে হত্যা করলে আমিও তো থাকব না। তবু আমি অনেক ভেবেচিন্তে এইে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। নিজে যদি না নিতাম তাহলে রুহানকে এই সিদ্ধান্তটা নিতে হত, গভীর একটা অপরাধবোধ তখন কাজ করত রুহানের মাঝে। এভাবেই ভালো।

    ভিডি স্ক্রিনে নিশি চুপ করে গিয়ে স্থির চোখে ক্যাপ্টেন জুকের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্যাপ্টেন জুক আতংকিত হয়ে তাকিয়ে আছে ঝুলন্ত পেন্ডুলামের দিকে, খুব ধীরে ধীরে সেটা ঝুলছে বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে, প্রতিবার দোলনের সময় সেটা একটু করে নিচে নেমে আসছে। ধারালো তীক্ষ্ণ পেন্ডুলামটা ঝুলছে ঠিক তার গলার উপরে। তার দুই হাতপা শক্ত করে বাঁধা হাতকড়া দিয়ে, এতটুকু নড়ার উপায় নেই, কিছুক্ষণের মাঝেই দুলতে দুলতে নেমে আসবে পেন্ডুলামের ধারালো ব্লেড। প্রথমে আলতোভাবে স্পর্শ করবে তার গলার চামড়াকে, তারপর সূক্ষ্ম একটা ক্ষতচিহ্ন হবে সেখানে। সেটি গভীর থেকে গভীরতর হবে খুব ধীরে ধীরে। প্রথমে কণ্ঠনালী, তারপর মূল ধমনীগুলি কেটে ফেলবে এই ভয়ংকর পেণ্ডুলাম। প্রচণ্ড আতংকে ক্যাপ্টেন জুক চিৎকার করে উঠল হঠাৎ।

    সাথে সাথে নিশি নড়েচড়ে উঠল হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে, মৃদু হেসে বলল, আমি যদি ভুল করে না থাকি তাহলে তুমি একটা চিৎকার করেছ ক্যাপ্টেন জুক। মনে হয় আর্তচিৎকারে খুব ভয় পেয়ে সেই চিৎকার করেছ। আমি ছোট একটা সিস্টেম দাঁড় করিয়েছি, কোনো চিৎকার শুনলে সেটা এই অংশটুকু চালু করে দেয়।

    ক্যাপ্টেন জুক। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, আমার এই ঘরটাকে কিন্তু পুরোপুরি শব্দনিরোধক করা হয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পার। বাইরের কোনো শব্দ তুমি শুনবে না, এখানকার কোনো শব্দও বাইরে যাবে না। চিৎকার করে করে তোমার ভোকাল কর্ডকে ছিঁড়ে ফেললেও কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না ক্যাপ্টেন জুক। আমার কী মনে হয় জান? তোমার চিৎকার শুনতে পেলেও কেউ আসত না!

    ক্যাপ্টেন জুক! আমি যদি হিসেবে ভুল করে না থাকি তাহলে আর কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ধারালো পেন্ডুলামটি তোমার গলার মাঝে প্রথম পোঁচটি দেবে, খুব সূক্ষ্ম একটা পোঁচ। প্রথম প্রথম হয়তো তুমি শুধু তার স্পর্শটাই অনুভব করবে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা গম্ভীর হতে শুরু করবে। আমার কী মনে হয় জান? তুমি ছটফট না করে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাক ক্যাপ্টেন জুক। যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা শেষ হবে ততই মঙ্গল। মৃত্যুটা তোমারই হোক– আমি এই ভয়ংকর মৃত্যুর মাঝে জেগে উঠতে চাই না।

    বিদায় ক্যাপ্টেন জুক। তুমি কত দিন থেকে কত জন মানুষের মাঝে বেঁচে আছ আমি জানি না। আমার ভাবতে ভালো লাগছে এটা শেষ হল। ক্যাপ্টেন জুক বলে আর কেউ কখনো থাকবে না।

    হলোগ্রাফিক ডিডি স্ক্রিনটি অন্ধকার হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন জুক অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল ভয়ংকর পেন্ডুলামটির দিকে, সেটি দুলতে দুলতে নেমে আসছে নিচে। গলার চামড়ার প্রথম স্তরটি কেটে ফেলেছে–আস্তে আস্তে আরো গম্ভীর হতে শুরু করেছে। প্রথমে কাটবে কণ্ঠনালী, তারপর মূল ধমনী দুটি। ভয়ংকর আতংকে আবার চিৎকার করে উঠল ক্যাপ্টেন জুক, অমানুষিক আতংকের এক ভয়াবহ চিৎকার। বদ্ধঘরে সেই বিকট আর্তনাদ পাক খেতে থাকে, মনে হয় ছোট এই ঘরটিতে বুঝি নরক নেমে এসেছে।

    হঠাৎ জেগে উঠল নিশি। রক্তে ভিজে গেছে সে, তার গলার উপর চেপে বসেছে। ধারালো পেন্ডুলাম–দুলছে সেটি বাম থেকে ডানে ডান থেকে বামে। ডান হাতের কাছে সূক্ষ্ম একটা গোপন মাইক্রোসুইচ রয়েছে, সাবধানে সে স্পর্শ করল সেটি, পরপর দুবার। সাথে সাথে ঘরঘর শব্দ করে পেন্ডুলামটি উপরে উঠতে শুরু করল, ঘরের বামপাশে চারটি দরজা খুলে গেল শব্দ করে। অপেক্ষমাণ ডাক্তার, সহকারী রবোট, তাদের যন্ত্রপাতি, জরুরি জীবন ধারণ যন্ত্র, কৃত্রিম রক্ত, শ্বাসযন্ত্র অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে এল ভিতরে। নিশ্বাস। বন্ধ করে দরজার বাইরে তারা অপেক্ষা করছিল গোপন মাইক্রোসুইচে পরিচিত সংকেতের জন্যে। এক মুহূর্তে ঘরটি একটি অত্যাধুনিক জীবনরক্ষাকারী জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্রে পালটে যায়, নিশির উপরে ঝুঁকে পড়ে সবাই, কী করতে হবে সবাই জানে, অসংখ্যবার তারা মহড়া দিয়েছে গত দুই দিন।

    লিয়ারা ভীত পায়ে ঢুকল ঘরটিতে। একজন ডাক্তার সরে গিয়ে জায়গা করে দিল তাকে। লিয়ারা নিশির হাত স্পর্শ করে তার উপর ঝুঁকে পড়ল। নিশি ফিসফিস করে বলল, আমি করেছি লিয়ারা। হত্যা করেছি ক্যাপ্টেন জুককে।

    সত্যি?

    সত্যি।

    আর আসবে না সে?

    না, লিয়ারা। আর আসবে না। আমি জানি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    Next Article বৃষ্টির ঠিকানা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }