Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ৩ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প1002 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. ভিডি টিউবের সুইচটা স্পর্শ করতেই

    ভিডি টিউবের সুইচটা স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝামাঝি আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক একটা প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছবিটা এত জীবন্ত যে আমার মনে হলো আমি বুঝি তাকে স্পর্শ করতে পারব।

    আমার মায়ের প্রতিচ্ছবিটি ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ইবান, আমি জানি না আমাকে তুই দেখছিস কি না! সেই কোন নক্ষত্রের কোন গ্রহপুঞ্জে তুই আছিস আমি জানিও না। তবু আমার ভাবতে ইচ্ছে করে তুই আমার সামনে আছিস, চুপ করে বসে আমার কথা শুনছিস।

    মা কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, মনে হলো সত্যিই যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। মায়ের চেহারা সতেরো-আঠারো বৎসরের একটা বালিকার মতো কথার ভঙ্গিও সেরকম, চেহারায় বিন্দুমাত্র বয়সের ছাপ পড়ে নি।

    মা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। হাত দিয়ে লালচে চুলগুলোকে পিছনে সরিয়ে বললেন, বুঝলি ইবান, কয়দিন থেকে নিজের ভেতরে কেমন জানি অস্থিরতা অনুভব করছি। শুধু মনে হচ্ছে এই জগতে কেন এসেছি, কী উদ্দেশ্য তার রহস্যটা বুঝতে পারছি না। আমি কি শুধু কয়েকদিন বেঁচে থাকার জন্যে এসেছি নাকি তার অন্য উদ্দেশ্য আছে? যদি অন্য উদ্দেশ্য থেকে থাকে তাহলে সেটা কী? প্রাণীজগতের যেরকম বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য থাকে মানুষের জন্যে তো আর সেটা সত্যি নয়! মানুষকে তো আর জন্ম নিতে হয় না। জিনম ফ্যাক্টরিতে অর্ডারমাফিক শিশুর জন্ম দেয়া যায়। তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটা কী?

    মা কয়েকমুহূর্তের জন্যে থামলেন তারপর ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন, কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললেন, আমার মনে সারাক্ষণ এরকম প্রশ্ন দেখে আমার চারপাশে যারা আছে তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল, তারা ভাবল আমার চিকিৎসা দরকার! একদিন আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল চিকিৎসক রবোটের কাছে, সেটি আমাকে টিপেটুপে দেখে বলল আমার মাথায় মস্তিষ্কের ভিতরে একটা দ্বৈত কপোট্রন বসাতে হবে, যেটি আমার ভাবনা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সোজা কথায় আমাকে মানুষ থেকে পাল্টে একটা রবোটে তৈরি করে ফেলবে।

    মা কথা থামিয়ে আবার ছেলেমানুষের মতো হাসতে শুরু করলেন, হাসি ব্যাপারটি নিশ্চয়ই সংক্রামক, আমিও মায়ের সাথে সাথে হাসতে শুরু করলাম। মা হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বললেন, আমি চিকিৎসক রবোটের কথা শুনি নি। আমার মাথায় দ্বৈত কপোট্রন বসানো হয় নি। মাথার ভিতরে এখনো আমার একশ ভাগ খাঁটি মস্তিষ্ক রয়েছে তাই এখনো আমি বসে বসে এইসব ভাবি! মা হঠাৎ সুর পাল্টে বললেন, বাবা ইবান, আমার কথা শুনে তুই আবার অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিস না তো?

    আমি মাথা নাড়লাম, ফিসফিস করে বললাম, না মা অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি না।

    অধৈর্য হলে হবি। আমার কিছু করার নেই। কেন জানি তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার মনে হয় তুই যদি আমার কাছে থাকতি তাহলে আমার প্রশ্নগুলোর গুর ত্বটা বুঝতে পারতি। এখানে আর কাউকে বোঝাতে পারি না।

    প্রথম প্রথম মনে হতো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ত জ্ঞানের অনুসন্ধান করা। কিন্তু গত একশ বৎসরের ইতিহাসে দেখেছিস বড় আবিষ্কারগুলো কে করেছে? রবোট। কম্পিউটার। কপোট্রন। যেগুলো মানুষ করেছে তার পিছনেও রয়েছে যন্ত্রপাতি, নিউরাল নেটওয়ার্ক। তাহলে মানুষের জন্যে থাকল কী? মানুষ বেঁচে থাকবে কেন? তাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী?

    মা কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন তারপর আবার হেসে ফেললেন মা যখন হাসেন তখন তাকে কী সুন্দরই না দেখায়! হাসি থামিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি না কেন আমি তোকে এসব বলছি। আসলে তোকে বলছি কি

    সেটাও আমি জানি না— তাহলে কেন বলছি এসব? মাঝে মাঝে আসলে তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে— মনে হয় তুই হয়ত আমাকে বুঝতে পারবি। সে জন্যে বলছি— আমি কল্পনা করে নিচ্ছি তুই আমার সামনে বসে। আছিস, এই এখানে আমার কাছাকাছি।

    কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন একটু একটু বুঝতে পারছি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী। ঠিক পুরোটুকু ধরতে পারছি না কিন্তু একটু যেন আন্দাজ করতে পারছি। আগে যেরকম মনে হতো আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই, কোনো অর্থ নেই— এখন সেরকম মনে হয় না। একসময় ভাবতাম তোর ভিতরে জিনেটিক কোনো প্রাধান্য না দিয়ে খুব ভুল করেছি, তোকে অতিমানব জাতীয় কিছু একটা তৈরি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু এখন আর তা মনে হয় না। এখন মনে হয় আমি ঠিকই করেছি, তোকে সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করেছি কিন্তু ভিতরে দিয়েছি। একটা চমৎকার হৃদয়। যেখানে রয়েছে ভালোবাসা। সবাইকে বড় হতে হবে কে বলেছে? মনে হয় যত ছোটই হোক জীবনের একটা অর্থ থাকে, একটা উদ্দেশ্য থাকে। কেউ এই জগতে অপ্রয়োজনীয় না। ছোট বড় সবাই মিলে সৃষ্টিজগৎ।

    মা একটু থামলেন, থেমে হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, বেশি বড় জ্ঞানের কথা বলে ফেললাম? অন্য সবাইকে তো বলছি না তোকে বলছি। তুই আমার ছেলে, তোকে আমি পেটে ধরেছি। যখন পেটের মাঝে ছিলি তখন প্ল্যাসেন্টা দিয়ে তোর শরীরে পুষ্টি দিয়েছি, বড় করেছি। তোকে যদি এসব কথা বলতে না পারি তাহলে কাকে বলব?

    বুঝলি ইবান, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন আসে আমার মাথায়, কাউকে জিজ্ঞেস করে তার উত্তর পাওয়া যায় না। নিজে নিজে তার উত্তর খুঁজে পেতে হয়। আমি তাই করছি। তবে একজন আমাকে খুব সাহায্য করেছে। মানুষটার নাম রিতুন। রিতুন ক্লিস। আলগল নক্ষত্রের কাছে মানুষের যে কলোনিটা আছে সেখানে থাকত সে। প্রায় দুইশ বছর আগে মানুষটা মারা গেছে, বেঁচে থাকলে আমি নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে যেতাম, যেভাবেই হোক।

    এই মানুষটার লেখা কিছু বইপত্র আছে, কিছু ভিডিও ক্লিপ আছে কিছু মেটা ফাইল১৬ আছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, দেখেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। মানুষটা অসম্ভব বুদ্ধিমান, অসম্ভব প্রতিভাবন। মনে হয় ঈশ্বর বুঝি নিজের হাতে তার মাথায় একটা একটা করে নিউরনকে সাজিয়েছে, সিনান্সে সংযোগ দিয়েছে! তার ভাবনাচিন্তার সাথে পরিচিত হয়ে আমার নিজের ভেতরকার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি!

    সেদিন রিতুন ক্লিস সম্পর্কে একটা নতুন তথ্য পেয়েছি। মানুষটা দুই শ বত্সর আগে মারা গেলেও তার মস্তিষ্কের পুরো ম্যাপিং নাকি রক্ষা করা আছে। পৃথিবীর বড় বড় মানুষ, বড় বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিল্পীদের মস্তিষ্ক নাকি এভাবে ম্যাপিং করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। তার মানে রিতুন ক্লিস মারা গেলেও তার মস্তিষ্ক বেঁচে আছে। বিশাল কোনো নিউরন নেটওয়ার্কে সেটা বসালে তার সাথে কথা বলা যাবে! কী আশ্চর্য ব্যাপার।

    কিন্তু দুঃখের কথা কী জানিস? মানুষের মস্তিষ্কের ম্যাপিং নিয়ে কাজ করার মতো নিউরাল নেটওয়ার্ক খুব বেশি নেই। যে কয়টি আছে সেগুলো আমার নাগালের বাইরে। আমার মতো সাধারণ মানুষ কখনো সেটা ব্যবহার করতে পারবে না। আমি খবর পেয়েছি তুই চতুর্থ মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হয়েছিস। যদি কোনোভাবে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারিস তাহলে তুই তোর মহাকাশযানে সেরকম একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক পাবি। তুই তাহলে রিতুন ক্লিসের সাথে কথা বলতে পারবি। কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হবে চিন্তা করতে পারিস?

    আমার মা উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর আবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন, দেখ, কতক্ষণ থেকে আমি বক বক করছি! আমার এরকম উদ্ভট জিনিস নিয়ে কৌতূহল বলে ধরে নিচ্ছি তোরও বুঝি এরকম কৌতুহল। আমার সব কথা ভুলে যা বাবা ইবান। ধরে নে এইসব হচ্ছে পাগলের প্রলাপ! তুই যদি পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারিস তাহলে মহাজগতের একেবারে শেষমাথায় মানুষের যে কলোনি আছে সেখানে অভিযান করতে যাবি। আমি রাত্রিবেলা আকাশের একটা নক্ষত্র দেখিয়ে সবাইকে বলব, আমার ছেলে ওখানে গেছে! আমার নিজের ছেলে— যেই ছেলেকে আমি পেটে ধরেছি!

    আমার মা কথা শেষ করে আমার দিকে হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু আমি দেখতে পেলাম তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে, আর আমার মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে তার সেই চোখের পানি গোপন করতে।

    যেরকম হঠাৎ করে আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি আমার ঘরের মাঝখানে এসে হাজির হয়েছিল ঠিক সেরকমভাবে আবার হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বুকের ভিতর কেমন জানি একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। উঠে দাঁড়িয়ে আমি কিছুক্ষণ খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। তারপর ফিরে এসে ভিডি টিউবটা স্পর্শ করে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতেই, ছোট স্ক্রিনটাতে লি-হানের ছবি ভেসে উঠল। সে আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খবর ইবান? তুমি কি শেষপর্যন্ত মন স্থির করেছ?

    করেছি লি-হান। আমি যাব।

    চমৎকার। তাহলে দেরি করে কাজ নেই, তুমি কাল ভোরবেলা থেকে কাজ শুরু করে দাও, বুঝতেই পারছ আমাদের হাতে সময় নেই। আমাদের চার নম্বর এস্ট্রোডোম থেকে একটা স্কাউটশিপ১৭ তোমাকে ফোবিয়ানে নিয়ে যাবে।

    ফোবিয়ান?

    হ্যাঁ আমাদের পঞ্চম মাত্রার নতুন মহাকাশযানটির নাম ফোবিয়ান। স্থিতিশীল একটা কক্ষপথে সেটাকে আটকে রাখা হয়েছে।

    কক্ষপথে?

    হ্যাঁ, পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানকে সাধারণত গ্রহে নামানো হয় না।

    ও। আমি একমুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, লি-হান।

    বল।

    তোমাকে একটা প্রশ্ন করি— তুমি সত্যি উত্তর দেবে?

    প্রশ্নটা না শুনে আমি তোমাকে কথা দিতে পারছি না। বেঁচে থাকার জন্যে অনেক সময় অনেক সত্যকে আড়াল করে রাখতে হয়।

    আজ ভোরবেলা তোমার সাথে আমি রিশি নক্ষত্রের কাছাকাছি মানুষের কলোনিতে অভিযান নিয়ে যে কয়টি কথা বলেছিলাম তার প্রত্যেকটা সত্যি ছিল, তাই না?

    লি-হান একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল। তাতে কিছু আসে যায়?

    না যায় না।

    তাহলে আমরা সেটা নিয়ে কথা নাইবা বললাম!

     

    মহাকাশযান ফোবিয়ানকে দেখে আমি চমকৃত হয়ে গেলাম। বিশাল এই মহাকাশযানটি একটি ছোটখাট উপগ্রহের মতো। টাইটেনিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের সংকর ধাতুর দেয়ালের উপর তাপ অপরিবাহী নতুন একধরনের আস্তরণ দিয়ে ঢাকা। মূল ইঞ্জিনটি পদার্থ-প্রতিপদার্থ৮ জ্বালানি দিয়ে চালানো হয়। বিশেষ পরিস্থিতির জন্যে প্লাজমা-৯ ইঞ্জিনও রয়েছে। আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ পরিভ্রমণের জন্যে একটি অপূর্ব যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করে রাখা আছে। পুরো ফোবিয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে নিউরাল নেটওয়ার্কটি বসানো হয়েছে সেটি দেখে নিজের ভিতরে হীনমন্যতা এসে যায় মানুষের মস্তিষ্ক সত্যিকার অর্থেই এই নেটওয়ার্কের তুলনায় একেবারেই অকিঞ্চিতকর। চতুর্থ মাত্রার মহাকাশযানের সাথে ফোবিয়ানের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে, এটি নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে বোঝাই, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরক থেকে শুরু করে এক্স-রে লেজার কিছুই বাকি নেই। সৌভাগ্যক্রমে আমার নিজেকে এই অস্ত্র চালানো শিখতে হবে না— ফোবিয়ানে অস্ত্র চালাতে অভিজ্ঞ রবোটেরা রয়েছে।

    আমাকে পুরো ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিতে খুব বেশি সময় দেয়া হলো না। মস্তিষ্ক উত্তেজক ড্রাগ নিহিলিন২১ নিয়ে নিয়ে আমি না ঘুমিয়ে একটানা চৌদ্দ দিন কাজ করে গেলাম। আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লাইসেন্স দেয়ার সময়টিতে আমি মোটামুটিভাবে একটা ঘােরের মাঝে ছিলাম এবং অনুষ্ঠানটি থেকে আমি কীভাবে নিজের ঘরে ফিরে এসেছি সেটি আমার মনে নেই, নিহিলিনের মতো উত্তেজক ড্রাগও আমাকে জাগিয়ে রাখতে পারছিল না। আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।

    ঠিক কখন আমি ঘুম থেকে উঠেছি সেটি আমি নিজেও জানি না— আমার ধারণা ছিল একবেলা পার করে দিয়েছি, কিন্তু ক্যালেন্ডার দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, এর মাঝে ছত্রিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যখন আমার ঘুম ভেঙেছে তখন আমার ঘরটি অন্ধকার এবং শীতল, আমি ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত। ঘরের ভিডি টিউবটি ক্রমাগত একটা জরুরি সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। আমি কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে টলতে টলতে ভিডি টিউবের কাছে গিয়ে সেটা স্পর্শ করতেই আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালক লি-হানের ছবিটি ছোট স্ক্রিনে ফুটে উঠল। সে একধরনের আতঙ্কিত গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার ইবান?

    আমি জড়িত গলায় বললাম, ঘুমাচ্ছিলাম। নিহিলিন নিয়ে কয়দিন জেগে ছিলাম তো, শরীর আর চলছিল না।

    আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে এত দীর্ঘ সময় ঘুমুবে বুঝতে পারি নি।

    আমিও বুঝতে পারি নি। যা-ই হোক কেন ডেকেছ বল।

    আমাদের হাতে সময় নেই। তোমাকে এক্ষুনি যাত্রা শুরু করতে হবে।

    এক্ষুনি মানে কখন?

    আগামী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে। একটা চৌম্বকীয় ঝড় আসছে, সেটা আসার আগে শুত্র না করলে অনেক দেরি হয়ে। যাবে।

    ও। আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিন্তু আমার নিজেরও তো একটু প্রস্তুতি নিতে হবে।

    না। তোমার নিজের প্রস্তুতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সবকিছুর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

    আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ—

    লি-হান অধৈর্য হয়ে বলল, তোমার কোনো কিছু আর ব্যক্তিগত নেই। যখন থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তোমাকে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক করা হবে সেদিন থেকে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে-চোখে রাখা হয়েছে। তোমার ব্যক্তিগত সবকিছু আমরা জানি— ঠিক সেভাবে ফোবিয়ানে সবকিছু রাখা হয়েছে। তোমার পছন্দসই বইপত্র মেটা ফাইল থেকে শুরু করে প্রিয় খাবার, প্রিয় পোশাক, প্রিয় সঙ্গীত সবকিছু পাবে। তোমার কোনো ব্যক্তিগত কাজ বাকি নেই ইবান।

    কিন্তু—

    কোনো কিন্তু নেই। তা ছাড়া ফোবিয়ানের চরম গতিবেগ তোলার আগে পর্যন্ত তুমি নেটওয়ার্কে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে।

    আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি সাথে আরো একটি জিনিস নিতে চেয়েছিলাম।

    কী?

    রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং।

    লি-হান এবারে থেমে গিয়ে একটা শিস দেবার মতো শব্দ করল।

    আমি ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পাওয়া যাবে না?

    একটু কঠিন হবে কিন্তু আমি চেষ্টা করব।

    চেষ্টা করলে হবে না। আমাকে পেতেই হবে। তুমি জানো আমি প্রায় একযুগ এই মহাকাশযানে একা-একা বসে থাকব। আমার কথা বলার জন্যে একজন মানুষ দরকার।

    লি-হান হাসার শব্দ করে বলল, আমাদের সময়ে তুমি প্রায় একযুগ থাকবে, কিন্তু তোমার নিজের ফ্রেমে তো এতো দীর্ঘ সময় নয়। খুব বেশি হলে তিন বছরের মতো।

    তিন বছর আর একযুগে কোনো পার্থক্য নেই। একই ব্যাপার। একটা-কিছু গোলমাল হলেই তিন বছর সত্যিসত্যি একযুগ নয় একেবারে এক শতাব্দী হয়ে যেতে পারে।

    বুঝেছি।

    আমি গলার স্বরে যথেষ্ট গুরত্ব দিয়ে বললাম, আমাকে রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং না দেয়া হলে আমি কিন্তু এই অভিযানে যাব না।

    লি-হান একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আহ্! তুমি দেখি মহাকাশ-দস্যুদের মতো ব্ল্যাক মেইলিং শুরু করলে।

    এটা ব্ল্যাক মেইলিং নয়— এটা সত্যি।

    ঠিক আছে আমি যোগাড় করে দেব।

    আমার আরো একটা জিনিস দরকার।

    কী?

    আমার মায়ের জন্যে একটা উপহার।

    কী উপহার নিতে চাও?

    ঠিক বুঝতে পারছি না।

    বায়োডোমের বাইরে ঝড়ো বাতাসের গর্জনের সাথে মিল রেখে একটা সঙ্গীত- ধ্বনি তৈরি হয়েছে। শুনলেই বুকের মাঝে কেমন জানি করতে থাকে। সেই সঙ্গীত-ধ্বনি নিতে পার।

    ঠিক আছে।

    কিংবা এই গ্রহের প্রাচীন সভ্যতার কোনো চিহ্ন। কোনো রেলিক। গ্রানাইটের ছোট কোনো মূর্তি?

    বেশ। তুমি যদি মনে করো সেরকম কিছু খুঁজে পাবে—

    সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে করে একটা সৌভাগ্য-বৃক্ষ নিয়ে যাও।

    সৌভাগ্য-বৃক্ষ?

    হ্যাঁ। এই গ্রহের একটি বিশেষ ধরনের গাছ রয়েছে, ছোট গাছ তার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট নীল পাতা। এখানকার মানুষ বলে যখন জীবনে বড় ধরনের সৌভাগ্য আসে তখন সেখানে ফুল ফোটে। উজ্জ্বল কমলা রংয়ের ফুল। ভারি চমৎকার দেখতে!

    বেশ। তাহলে এই গাছটাই নেয়া যাক। কিন্তু আন্তঃনক্ষত্র পরিবহনে গাছপালা বা জীবন্ত প্রাণী আনা-নেয়ার উপর নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে না?

    লি-হান হা হা করে হেসে বলল, তুমি তোমার মহাকাশযানে করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে নিয়ে যাচ্ছ। যাকে ম্যাঙ্গেল জ্বাসের মতো একটি বস্তুকে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় তাকে যে-কোনো জীবন্ত প্রাণী নেয়ার অনুমতি দেয়া হবে। সেটা নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না!

    ঠিক আছে আমি চিন্তা করব না।

    তাহলে তুমি চার নম্বর এস্ট্রোডোমে চলে আসো। প্রস্তুতি শুরু করা যাক। তোমাকে তিন ঘণ্টা সময় দেয়া হলো।

    তিন ঘণ্টা? মাত্র তিন ঘণ্টার মাঝে আমি সারা জীবনের জন্যে একটা গ্রহ ছেড়ে চলে যাব?

    লি-হান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেউ যদি আমাকে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিত, আমি তিন মিনিটে চলে যেতাম!

    আমি কোনো কথা না বলে বাইরে তাকালাম। কুৎসিত বেগুনি আলোতে গ্রহটাকে কী ভয়ঙ্করই-না দেখাচ্ছে। লিহান মনে হয় সত্যি কথাই বলছে।

     

    ফোবিয়ানের কারগো ভল্টে স্টেনলেস স্টিলের কালো একটি সিলিন্ডারকে দেওয়ালের সাথে আটকে দিয়ে সামরিকবাহিনীর উচ্চপদস্থ মানুষটি বলল, এটি হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ফোবিয়ানের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে একে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

    মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে আমি সিলিন্ডারটির কাছে গিয়ে সেটি স্পর্শ করে বললাম, এই মানুষটি সম্পর্কে আমি এত বিচিত্র ধরনের গল্প শুনেছি যে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে মানুষটি মাঝপথে জেগে উঠবে না।

    সামরিক অফিসারটি হেসে বলল, সে-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, তাকে তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায়২২ জমিয়ে রাখা আছে। জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।

    তোমার-আমার বেলায় সেটি সত্যি হতে পায়ে, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের বেলায় আমি এত নিশ্চিত নই!

    এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র তোমার-আমার জন্যে যেটুকু সত্যি ম্যাঙ্গেল কৃাসের জন্যেও ততটুকু সত্যি। তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায় মানুষের শরীরে কোনো জৈবিক অনুভূতি থাকে না। সে আক্ষরিক অর্থে একটি জড়বস্তু।

    বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলতে পারবে না?

    না, এই সিলিন্ডারটিকে বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত পাঠাতে পারবে না। এটি বলতে পারো তথ্য বা সঙ্কেতের দিক থেকে একেবারে নিচ্ছিদ্র।

    সামরিক অফিসারটি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাথে আনুষ্ঠানিক বোঝাপড়া শেষ করে আমাকে ছোট একটি ক্রিস্টাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ইবান, তুমি এখন তোমার যাত্রা শুরু করতে পার।

    আমি ভল্টের দেওয়ালে আটকে রাখা সারি সারি সিলিন্ডারগুলোর দিকে তাকালাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ছাড়াও এখানে অন্য মানুষ রয়েছে। কেউ-কেউ প্রতিরক্ষা বাহিনীর, কেউ-কেউ একেবারে সাধারণ যাত্রী। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে তাদের পরিচয় দেওয়া রয়েছে, আমার আলাদা করে জানার কোন প্রয়োজন নেই। মানুষ ছাড়াও এই মহাকাশযানে অন্য জিনিসপত্র রয়েছে, যার কিছু কিছু আমার জানার কথা নয়। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমাকে সেগুলি মানুষের এক কলোনি থেকে অন্য কলোনিতে পৌছে দেবার কথা। ম্যাঙ্গেল কৃাসের কথা আলাদা, সে যে কোন মহাকাশযানে থাকলে সেটি মহাকাশযানের অধিনায়কের জানা প্রয়োজন। জড় বস্তু হিসেবে থাকলেও সেটি জানা প্রয়োজন।

    সামরিক অফিসার এবং তার সাথে আসা টেকনিশিয়ানরা নিজেদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিতে শুরু করে। ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে যাওয়া যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেয়া খুব সহজ নয় কিন্তু এই টেকনিশিয়ানরা দক্ষ, তাদের হাতের কাজ দেখতে ভালো লাগে। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। একজন একজন করে সবাই এসে আমার সামনে মাথা নিচু অভিবাদন করে তাদের স্কাউটশিপে উঠে গেল। সামরিক অফিসার আমার হাত ধরে সেখানে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইবান।

    আমি হেসে বললাম, আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না!

    সামরিক অফিসার আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে তার স্কাউটশিপে ঢুকে গেল, আমি ফোবিয়ানের গোল বায়ু-নিরোধক দরজাটা বন্ধ করে দিতেই স্কাউটশিপের ইঞ্জিনের চাপা শব্দ শুনতে পেলাম, আমি এখন এখানে একা।

    আমি নিজের ভিতরে একধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম, এই বিশাল মহাকাশযানটিতে আমি একা একা-এক বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করব— এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে। এই দীর্ঘ সময়ে আমার সাথে কথা বলার জন্যেও কোনো সত্যিকার মানুষ থাকবে না। মহাকাশের নিকষ কালো অন্ধকারে, হিম শীতল পরিবেশে এই বিশাল মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন তুলে উড়ে যাবে। নতুন এই মহাকাশযানে হয়ত অজানা কোনো বিপদ অপেক্ষা করে আছে, মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি দুটি বিশাল ব্ল্যাক হোল, তার পাশে দিয়ে বিপজ্জনক একটি কক্ষপথ দিয়ে আমাকে যেতে হবে। সেখানে মহাকাশ-দস্যুরা ওৎ পেতে আছে, কে জানে, হয়ত বিচিত্র কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হতে হবে! জানি না সেই দীর্ঘ যাত্রা কখনো শেষ হবে কি না, রিশি নক্ষত্রের সেই মানবকলোনিতে পৌঁছাতে পারব কি না। যদিওবা পৌঁছাই সেই একযুগ পর আমার মায়ের সাথে দেখা হবে কি না সে কথাটিই-বা কে বলতে পারে!

    আমি জোর করে আমার ভেতর থেকে সব চিন্তা দূর করে সরিয়ে দিয়ে ভেসে ভেসে মহাকাশযানের ওপরের দিকে যেতে থাকি। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে আমাকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। ফোবিয়ানের শক্তিশালী ইঞ্জিন যখন প্রচণ্ড গর্জন। করে এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে উপেক্ষা করে মহাকাশে পাড়ি দেবে তখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।

    কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসার সাথে সাথে আমি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণকারী মূল। নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, পঞ্চম মাত্রার আন্তঃ

    নক্ষত্র মহাকাশযান ফোবিয়ানের পক্ষ থেকে আপনাকে এই মহাকাশযানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মহামান্য ইবান।

    মানুষের কণ্ঠস্বরে এধরনের যান্ত্রিক কথা শুনলে সবসময়েই আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি— আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়েই মনে করি যন্ত্র এবং মানুষের কথার মাঝে একটা স্পষ্ট পার্থক্য থাকা দরকার। মানুষের কথা শোনার সময় তাকে সবসময়েই আমরা দেখতে পাই, মুখের ভাবভঙ্গি থেকে কথার অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যন্ত্রের বেলায় সেটা সম্ভব নয়— সত্যি কথা বলতে কী কথাটা কোথা থেকে আসছে অনেক সময় সেটাও বুঝতে পারি না।

    আমি চেয়ারে নিজেকে নিরাপত্তা বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিতে নিতে বললাম, আমি যদি বলি তোমার আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম না!

    নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর তরল গলায় বলল, মহামান্য ইবান, আপনি ইচ্ছে করলে অবশ্যি সেটা বলতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না।

    তুমি কে?

    আমি ফোবি। ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মানুষের সংযোগকারী মডিউল ফোবি।

    আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করতে করতে বললাম, আচ্ছা ফোবি, আমি যদি এখন তোমাকে জঘন্য ভাষায় গালাগাল করি তাহলে কী হবে?

    কিছুই হবে না মহামান্য ইবান। আমি মানুষ নই, আমার ভেতরে কোনো মান-অপমান বোধ নেই— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি, যেভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করা যায় সেভাবে সাহায্য করব।

    আমি কন্ট্রোল প্যানেলে ফোবিয়ানের ইঞ্জিনগুলোর খুঁটিনাটি পরীক্ষা করতে করতে বললাম, ফোবি, আমি যতদূর জানি তোমার নিউরাল নেটওয়ার্ক মানুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেক গুণ ভালো বলা হয়, মানুষ থেকে বারো গুণ বেশি তোমার বুদ্ধিমত্তা— যার অর্থ তুমি আসলে আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। কাজেই প্রকৃত অর্থে আমার তোমাকে বলা উচিৎ মহামান্য ফোবি—

    ফোবি এবারে প্রায় হাসার মতো করে শব্দ করল, বলল, আপনি ভুল করছেন মহামান্য ইবান, আমি নিউরাল নেটওয়ার্ক নই— আমি শুধুমাত্র নিউরাল নেটওয়ার্কের মানুষের সাথে যোগাযোগকারী মডিউল। নিউরাল নেটওয়ার্ক যদি একটা মানুষ হয় তাহলে আমি তার কণ্ঠস্বর। আমার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা নেই। আর সম্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার কোনো অর্থ নেই মহামান্য ইবান। দীর্ঘদিন গবেষণা করে দেখা গেছে একজন মানুষ এবং একজন যন্ত্রকে পাশাপাশি কাজ করতে দেয়া হলে মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে খানিকটা প্রাধান্য দিতে হয়, পুরো ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়, এর বেশি কিছু নয়।

    ও! আমি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, এই মহাকাশযানে আমি দীর্ঘ সময়ের জন্যে আছি তোমার সাথে যন্ত্র এবং মানুষ নিয়ে কথা বলা যাবে। এখন ফোবিয়ানকে শুরু করা যাক।

    বেশ।

    আমি কন্ট্রোল প্যানেল পরীক্ষা করে মূল ইঞ্জিন দুটো চালু করলাম, সাথে সাথে ফোবিয়ানের দুইপাশে বসানো শক্তিশালী ইঞ্জিন দুটি গর্জন করে উঠল। আমি ফোবিয়ানের জানালা দিয়ে বিদ্যুঝলকের মতো আয়োনিত গ্যাস বের হতে দেখলাম। আমি অসংখ্যবার মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিন চালু করে মহাকাশযানকে নিয়ে মহাকাশে ছুটে গিয়েছি। কিন্তু প্রথম মুহূর্তটি প্রত্যেকবারই আমাকে একইভাবে অভিভূত করেছে।

    আমি ফোবিয়ানে তীব্র কম্পন অনুভব করি, মহাকাশযানটি শেষবারের মতো গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করেছে, শক্তিশালী ইঞ্জিন দুটি প্রদক্ষিণ শেষ করার আগেই এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে ছিন্ন করে উড়ে যাবে।

    আমি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশ দূর হয়ে এখন এখানে ত্বরণ থেকে প্রচণ্ড আকর্ষণ শুরু হচ্ছে। আরামদায়ক চেয়ারটিতে অদৃশ্য কোনো শক্তি আমাকে ধীরে ধীরে চোপ ধরতে শুরু করেছে। সাধারণ যে-কোনো মানুষ থেকে আমি অনেক বেশি মহাকর্ষ শক্তি সহ্য করতে পারি। কন্ট্রোল প্যানেলে দেখতে পাচ্ছি আমার ওজন বাড়তে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে বুকের ওপর অদৃশ্য একটি দানব চেপে বসেছে। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, চোখের সামনে একটা লাল পর্দা কাঁদতে শুরু করে।

    আমার কানের কাছে ফোবি ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ইবান, আপনাকে অচেতন করে দিই?

    আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, না।

    কেন? কেন আপনি এই কষ্ট সহ্য করছেন?

    জানি না।

    আর কিছুক্ষণের মাঝে আপনার মাথার মাঝে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি এমনিতেই অচেতন হয়ে পড়বেন।

    তবু আমি দেখতে চাই। আমি বুঝতে পারি অদৃশ্য শক্তির টানে আমার মুখের চামড়া পিছনে সরে আসছে, চোখ খোলা রাখতে পারছি না, মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ একটা বিশাল পাথর চাপিয়ে রেখেছে, আমি একবারও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

    ফোবি আবার ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ইবান। আপনার নিরাপত্তার খাতিরেই এখন আপনাকে অচেতন করে রাখা প্রয়োজন। এটি নিছক পাগলামি—

    আমি জানি।

    কিন্তু—

    ফোবি— তোমরা কি কখনো পাগলামি করো? যন্ত্র কি পাগলামি করতে পারে?

    ফোবি উত্তরে কী বলল আমি শুনতে পেলাম না কারণ এর আগেই আমি অচেতন হয়ে পড়লাম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    Next Article বৃষ্টির ঠিকানা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }