Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সার্থকতা

    উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প9 Mins Read0

    সার্থকতা

    বুকের কাছে দু-হাত জোড় করে মহিলাটি বললেন, নমস্কার, কেমন আছেন? চিনতে পারেন?

    অভ্যেসবশতই আধো-হেসে বাসুদেব বললেন, হ্যাঁ, আপনি ভালো তো? অনেকদিন পর দেখা।

    তিনি মহিলাটির মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে নিজের বুকের ছবিঘরে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। মশাল জ্বেলেও এখন পুরোটা দেখা যায় না। কিছুটা অন্ধকার থেকেই যায়। সম্পূর্ণ অচেনা মুখ, টসটসে দুটি ঠোঁট, অচেনা-অচেনা, চোখ দুটিতে মৃদু হাসি মাখা। অনেকের মধ্যেও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতন মুখ ও শরীর, কিন্তু যৌবন একেবারে ঝুঁকে এসেছে শেষ প্রান্তে, রূপ যাই-যাই শব্দ তুলেছে।

    মহিলাটি চিবুক উঁচু করে বললেন, চিনতে পারেননি তো? আমার কিন্তু ঠিক মনে আছে। আচ্ছা—

    অন্য ঢেউ আসে, মহিলাটি দূরে সরে যান। হলঘরটিতে পঁচিশ-তিরিশজন নারী-পুরুষ। এঁদের অনেককেই বাসুদেব চেনেন না, তিনি দীর্ঘকাল বোম্বাই প্রবাসী। আজকের আপ্যায়নকর্তা তার এক বন্ধুর বন্ধু। কয়েক রকম সুরা আছে, নরম পানীয়, গান-বাজনা আছে। কলকাতা হিসেবে। আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। বোম্বাই-দিল্লি-মাদ্রাজ সব জায়গাতেই আজকাল এই একই রকম পার্টি হয়। মেয়েদের নানারকম সাজপোশাক দেখা যায়, পুরুষদের নানারকম রসিকতায় যোগ দিতে হয়।

    বাসুদেবের মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি রয়ে গেল। কে ওই মহিলাটি? অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেও বাসুদেব ওকেই খুঁজছেন, দূরে দু-একবার চোখাচোখি হতেই মহিলাটি আস্তে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তাঁর ভুরুতে অভ্রবিন্দুর মতন ঝিকমিক করছে কৌতুক।

    আগে অচেনা লোকজনের মধ্যে বাসুদেব খুব লাজুক হয়ে পড়তেন। চেহারা ছিল রোগা পাতলা, সব সময়েই যেন থাকতেন আড়ালে। কারুর সঙ্গে যেচে আলাপ করতে পারতেন না। এখন চেহারা বদলে গেছে অনেক, বেশ ভারিক্কি হয়েছেন, কিছুটা মেদ আসায় মুখের ধারাল ভাবটা সরে গিয়ে সৌম্য ভাব এসেছে। তা ছাড়া সার্থকতাও এক ধরনের ব্যক্তিত্ব এনে দেয়। কলকাতা। ছেড়ে বম্বের নতুন পরিবেশে গিয়ে মানিয়ে নিতে প্রথম-প্রথম খুবই অসুবিধে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কাজের সুনামের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকে যেচে এসে খাতির করতে লাগল তাঁকে।

    অনেকদিন পর কলকাতায় এলে বোঝা যায় চেনাশুনো মানুষেরা বদলে যাচ্ছে। শুধু নিজের বদলটাই চোখে পড়ে না। সিদ্ধার্থর স্ত্রী রুমা একসময় খুব চুপচাপ স্বভাবের ছিল, কথা না বলে শুধু মৃদু হাসত, সেই রুমা কীরকম জোরে-জোরে হাসছে। ব্যবহারে ককেটিস ভাব। অথচ তার মুখের চামড়ায় আগেকার ঔজ্জ্বল্য নেই।

    হাসতে-হাসতে রুমা একবার বাসুদেবের কাছে এসে বলল, কী বাসুদা, আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন? আসুন, সবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

    এইসব পার্টির নিয়ম, ঘুরে-ঘুরে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলা। বাসুদেবের এখনও এটা রপ্ত হয়নি। তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, হয়েছে, অনেকের সঙ্গে।

    রুমা হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, আপনি বোম্বাইতে ফ্ল্যাট কিনেছেন? আপনার তো এখন খুব নাম, গত রবিবার টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় ছবি ছাপা হয়েছিল আপনার।

    বাসুদেব রীতিমতন অবাক হলেন। সাতেরো পাতায় এক কলম একটা অস্পষ্ট ছবি ছাপা হয়েছিল, তাও বোম্বের কাগজে। এখানে বাসুদেব সেকথা তো কারুকে বলেননি।

    —তুমি জানলে কী করে?

    —আমরা কলকাতায় বসে বুঝি বোম্বের খবর রাখি না? আপনারা, বোম্বের লোকেরা মনে করেন, কলকাতাটা একটা গণ্ডগ্রাম!

    —না, না, না, সেকথা বলছি না। আমি বোম্বের লোক নই। বোম্বের লোক তো কলকাতার কাগজ পড়ে না, তাই আমি ভাবছিলুম বোম্বের কাগজ এখানে…

    —আমি লাইব্রেরিতে কাজ করি, সেখানে অনেক রকম কাগজ আসে। দেখলুম, আপনি কী একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এর আগে সায়েন্স টু-ডে কাগজেও আপনার সম্পর্কে লেখা পড়েছি। আমাদের কত গর্ব হয়!

    রুমা যে চাকরি করে সে খবরই বাসুদেবের জানা ছিল না। আগে মনে হতো রুমা বিশেষ পড়াশুনোর ধার ধারে না। জীবনের বাঁকে-বাঁকে কত বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে। একটু আগে রুমার তীক্ষ্ণ হাসি তাঁর খারাপ লাগছিল, এখন রুমাকে বেশ পছন্দ হল।

    –বাসুদা, আমি সামনের মাসে বোম্বে যাব একবার। আপনার ওখানে উঠতে পারি?

    —নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। সিদ্ধার্থর সঙ্গে একটু আগে কথা হল, কই ও তো বম্বে যাওয়ার কথা কিছু বলল না।

    ও তো যাবে না। আমি একলা যাব।

    বাসুদেব একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন। পুরোনো ধারণা থেকে তিনি মনে করেছিলেন রুমা সবসময় তার স্বামীর সঙ্গেই বাইরে যায়। রুমাকে তিনি বোম্বাইয়ের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন, কিন্তু রুমা কি জানে না যে সেখানে তিনি একা থাকেন?

    দূরের মহিলাটির দিকে বাসুদেব আর একবার তাকালেন। একবার ভাবলেন রুমাকে জিগ্যেস করবেন এ মহিলারা পরিচয়। কিন্তু করলেন না। এক মহিলার কাছে অন্য মহিলার প্রসঙ্গ তোলা সব সময় নিরাপদ নয়। কী জানি এদের মধ্যে কী রকম সম্পর্ক।

    রুমা অবশ্য আর সুযোগও দিল না, সে বাসুদেবের হাত ধরে টেনে আর একজন সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন পুরুষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। এরকম চশমা আজকাল পুরুষ মানুষদের চোখে দেখা যায় না। তবে ভদ্রলোক ভালো সেতার বাজান শুনে বাসুদেব নিশ্চিন্ত হলেন। যারা। প্রকাশ্য মঞ্চে অনুষ্ঠান করে, তাদের সাজপোশাক একটু অন্যরকম হয়ই। ওই ভদ্রলোকের মতন সবুজ সিল্কের পাঞ্জাবি পরার কথা বাসুদেব কল্পনাও করতে পারেন না।

    সেই মহিলাটি একজন কিশোরীর সঙ্গে কথা বলছেন। বাসুদেব রুমা ও সেতার বাদকের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে-যেতে কান খাড়া করে ওদের কথা শুনবার চেষ্টা করলেন। যদি দু-একটা টুকরো থেকে পরিচয়ের কোনও সূত্র পাওয়া যায়। পাওয়া গেল না, রহস্যময়ী মহিলাটি বলছেন কালিম্পং-এর কথা, শিগগিরই ঘুরে এসেছেন সেখান থেকে। ক্যামেলিয়া ফুলের বর্ণনায় উচ্ছ্বসিত। কালিম্পং? বাসুদেব কখনও যাননি।

    একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, অথচ কিছুই মনে পড়ছে না, এটা বড় কষ্টের। ওঁর নামটাও জিগ্যেস করা হয়নি। উনি হাসিমুখে যেভাবে কেমন আছেন বললেন, তারপর আর নাম জিগ্যেস করা যায় না।

    এবারে একজন কেউ গান গাইবেন। কলরব প্রথমে গুঞ্জনে পরিণত হল, তারপর ফিসফিস নীরবতা। গায়কটিকে বেশ বিখ্যাত মনে হল, অনেকের মুখ উদগ্রীব, শুধু সেতার-বাদকটির মুখে চাপা অবজ্ঞার ভাব। তিনি সঙ্গে সেতার আনেনি, তাঁকে শ্রোতার ভূমিকা নিতে হবে। গায়কটি। চোখে সুর্মা দিয়েছেন মনে হচ্ছে, ডান হাতের আঙুলে তিনটে আংটি, এখন হারমোনিয়াম নিয়ে প্যাঁ-পোঁ করছেন।

    শুভাশিস গায়কের পাশ থেকে চেঁচিয়ে বলল, বাসু, তুমি একেবারে পেছনে বসে আছ কেন? সামনে এসো, তোমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দিই।

    বাসুদেব হাত তুলে বললেন, ঠিক আছে। পরে—।

    শুভাশিসের সঙ্গেই তিনি এখানে এসেছেন। ও বড্ড বেশি কথা বলে অতিশয়োক্তিতে ওস্তাদ। বাসুদেবের সম্পর্কে লোকজনের কাছে এমন পরিচয় দিতে শুরু করে যে তাঁর লজ্জায় মাথা নুয়ে যায়।

    হাতের সিগারেটটা ফেলবার জন্য অ্যাশট্রে খুঁজতে-খুঁজতে বাসুদেব সেই মহিলাটির কাছে চলে এলেন। এঁর সঙ্গে কোনও পুরুষ নেই, বাসুদেব এতক্ষণ লক্ষ্য করে তা বুঝেছেন।

    বাসুদেব হেসে জিগ্যেস করলেন, আপনি এখন কোথায় থাকেন?

    মহিলাটি বাসুদেবের চোখে চোখ রেখে বললেন, অর্থাৎ আমার নামটা এখনও মনে পড়েনি তো? আমি বলব না, ভুলেই গেছেন যখন

    —খুব চেনা-চেনা লাগছে!

    —মিথ্যে কথা! আমার চেহারা বদলে গেছে। সবাই বলে আজকাল। আমার কিন্তু আপনার কথা ঠিক মনে আছে। তখন ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন, চঞ্চলদের বাড়ির আড্ডায় এক কোণে চুপচাপ বসে থাকতেন। ঠিক বলছি কি না?

    —চঞ্চলদের বাড়ি?

    গান শুরু হতেই কথা থামিয়ে দিতে হল। মহিলাটি ইচ্ছে করে বাসুদেবের পাশ থেকে সরে গিয়ে একটু দূরে সেই কিশোরী মেয়েটির পাশে বসলেন।

    চঞ্চলদের বাড়ির কথা শুনেই সব মনে পড়ে গেছে বাসুদেবের। অনেকদিন আগেকার কথা, চোদ্দ-পনেরো বছর তো হবেই। এই সেই দুর্ধর্ষ তরুণী, মূর্তিমতী অহংকার? চেহারা অনেক বদলেছে ঠিকই, যেমন বাসুদেবেরও বদলেছে কি মুখের রেখা ও চাহনির ঝিলিক তো সেই একইরকম। নাম মনে পড়েনি। কারণ, ওর কোনও নামই ছিল না। অনামিকা কোনও মেয়ের নাম হয়? অনামিকা দত্ত চৌধুরী। সুশোভন দত্ত চৌধুরীর স্ত্রী, সেই সুশোভন, যিনি এশিয়ান গেমসে পরপর দু-বার ব্যাডমিন্টন চাম্পিয়ান হয়েছিলেন। অত নামকরা খেলোয়াড়, অথচ ছিলেন নিপাট ভালোমানুষ, খুবই নম্র আর বিনীত! অনামিকাও তো রাইফেল শুটিং-এ অংশ নিয়েছে, নিজেই সেদিন যেন রাইফেলের কার্তুজ…!

    চঞ্চলদের বাড়ির আচ্ছা, প্রত্যেক শনিবার, তুমুল এলাহি, রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত। সেখানে সবাই খ্যাতিমান, অথবা বড়-চাকুরে। বাসুদেব তখন একটা কলেজে ফিজিক্সের সামান্য। লেকচারার, নেহাত চঞ্চল তার বাল্যবন্ধু বলেই সেই আড্ডায় সে স্থান পেত। চঞ্চলই ডেকে নিয়ে যেত জোর করে। অত সব নামকরা লোকজনদের মাঝখানে বাসুদেব হীনমন্যতায় ভুগত, তা ছাড়া নিজের গোটানো স্বভাবের জন্য সে সহজভাবে মিশতেও পারত না।

    অনেকেই স্ত্রীদের নিয়ে আসতেন সেই আড্ডায়, কেউ-কেউ বান্ধবীকেও। সেইসব মহিলাকুলের মধ্যে এই অনামিকা ছিল একটা আগুনের গোলা। তার সঙ্গে অন্য কারুর তুলনাই চলত না। হাসি-ঠাট্টা, গান, তাসখেলা, মদ্যপান, নাচ কোনওটাতেই তার জুড়ি ছিল না কেউ।

    বাসুদেবের সঙ্গে অনামিকার কোনওদিনই ভালো করে আলাপ হয়নি। কোনওদিন তিনি ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ একটি বাক্য বিনিময় করেছেন কিনা সন্দেহ, বাসুদেব ছিলেন পিছনের সারির মানুষ, তিনি দূর থেকে দেখতেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, অনামিকার মতন নারীরা বাসুদেব মজুমদারের মতন মানুষের বৃত্তে কোনওদিনই আসবে না। ওরা অন্য বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়।

    তবু বাসুদেবের আকাঙ্ক্ষা ছিল, গভীর দুঃখবোধ ছিল। অনামিকাকে তিনি নিজের মতন করে চেয়েছিলেন, সে অন্যরকম চাওয়া। পরস্ত্রীর প্রতি লোভ করার স্বভাব ছিল না তাঁর। ছেলেবেলা থেকেই বই-পত্রের মধ্যে মানুষ হয়েছেন, মেয়েদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাননি। অনামিকার অহংকার ছটফটানি আর সবকিছুর মধ্যেই একটা চমৎকার সারল্য ছিল। কেউ কোনও মিথ্যে কথা বললে অনামিকা দারুণ বিস্ময়ের শব্দ করে উঠতো। কেউ আড়ালে অন্য কারুর নিন্দে করলে অনামিকা খাঁটি ভৎসনার সুরে বলে উঠত, ছিঃ এসব কী! অনামিকার ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, বাঁ হাতে মদের গেলাস, তবু কোনওরকম অরুচিকর কথাবার্তা শুনলে তার মুখে একটা বেদনার ছায়া পড়ত, সে বলত আমি কিন্তু তাহলে আর এখানে থাকব না। তোমরা আনন্দ করতে জানোনা, খারাপ কথা বলো কেন?

    অনামিকার সারল্যের ঝাপটায় অন্যরাও বিশুদ্ধ হয়ে উঠত। এই সারল্যের সঙ্গে রূপ মিশে যে মাধুর্যের সৃষ্টি হয়েছিল, বাসুদেব চেয়েছিলেন সেই মাধুর্যের ভাগ নিতে। শারীরিক স্পর্শ নয়, শুধু মাধুর্যের ছোঁয়া। অনামিকা তার সামনে এসে বসবে, তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলবে, কোথাও কিছু হারাবে না, কিন্তু অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যাবে।

    কিন্তু সে রকম পাওয়া হয়নি। অন্যান্য চৌখস পুরুষরাই সবসময় অনামিকার সামনে থেকেছে বাসুদেব পড়ে থেকেছেন পেছনের সারিতে। অনামিকার চোখে চোখ ফেলতেও পারেননি ভালো করে। সেজন্য অবশ্য অনামিকাকে দোষ দেওয়া যায় না।

    শুধু চঞ্চলের বাড়িতেই নয়, অন্য যে-কোনও জায়গায় গেলেই অনামিকার ওই মাধুর্যের জন্য তৃষ্ণাটা জেগে উঠত বাসুদেবের মনে। অন্য নারীদের সঙ্গে সে অনামিকার তুলনা করত মনে মনে। যেখানে মানুষ সবচেয়ে একা থেকে সেই বাথরুমে বসে সে ধ্যান করত অনামিকার।

    সর্বভারতীয় একটি বিজ্ঞান-মেধা প্রতিযোগিতায় একটি যন্ত্রের মডেল পাঠিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন বাসুদেব, পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার পান। সেই সুবাদে বম্বে থেকে ভালো চাকরির আমন্ত্রণ। তারপর কলকাতা ত্যাগ। তারপর ব্যস্ত জীবন। চার বছর বাদে একবার চঞ্চলের বাড়িতে এসে দেখেছিলেন আড্ডা ভেস্তে গেছে। চঞ্চল ট্রান্সফার হয়ে গেছে দুর্গাপুরে।

    বম্বেতে প্রথম গিয়ে সমুদ্র দেখেও অনামিকার কথা মনে হয়েছিল। সব সৌন্দর্যের মধ্যেই একটা মিল থাকে। সমুদ্রকে যেমন কেউ নিজের বাড়ির চৌবাচ্চায় আনতে চায় না, সেই রকমই বাসুদেব অনামিকাকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ে আসতে চাননি। শুধু তার রূপের মাধুর্যই তিনি চোখে নিতে চেয়েছিলেন। কলকাতা থেকে চলে আসার পর অনামিকার মুখচ্ছবি যেন বেশি ঝকঝক করত তাঁর মনে। অনেক দুঃখ, ব্যর্থতার মুহূর্তে ওই মুখ মনে করে তিনি শান্তি পেয়েছেন।

    তারপর আস্তে-আস্তে দুঃখ কমতে লাগল। ব্যর্থতার বদলে একে-একে দেখা দিতে লাগল। সার্থকতা। বাসুদেব মজুমদার টমাস এডিসনের মতন আবিষ্কারক নন বটে, কিন্তু ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বেশ সার্থকই বলতে হবে। সাতচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে তিনি যথেষ্ট উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি মৌলিক যন্ত্রের মডেল তিনি তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করিয়েছেন নিজের দেশের। আর এই সার্থকতার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন সৌন্দর্যতৃষ্ণা। অনামিকা কবে যে মন থেকে হারিয়ে গেছে। তিনি খেয়ালই করেননি। এই সেই অনামিকা। যাকে দেখলেই একসময় বুক কেঁপে উঠত, আজ। তাকে দেখে তিনি চিনতেই পারলেন না।

    বাসুদেব কোনওদিন অনামিকার চোখেই পড়েননি, অথচ অনামিকা তাঁকে মনে রেখেছে কী। করে? অনামিকা তাঁকে লক্ষ্য করত তা হলে? অনামিকার মনে তাঁর জন্য একটু স্থান ছিল? ধুতি পাঞ্জাবি পরা সাধারণ একজন কলেজের লেকচারার, যে মেয়েদের সঙ্গে চোখ তুলে কথা বলতেই

    জানত না, তাকে অনামিকার মনে থাকবে কীজন্য?

    এবারে এক ঝলক মনে পড়ল, সুশোভন দত্ত চৌধুরীর কী যেন একটা অ্যাকসিডেন্টের খবর তিনি পড়েছিলেন খবরের কাগজে। বেঁচে আছে না মরে গেছে?

    এসব কথা কি এখন জিগ্যেস করা যায়? তিনি চিনতে পারেননি বলে অনামিকা কি অপমান বোধ করে চলে গেল এখান থেকে? বাসুদেব এবার ভাবলেন উঠে গিয়ে অনামিকার খোঁজ করবেন। কিন্তু উঠলেন না, তাঁর ভয় করছে, তাঁর বুক কাঁপছে। তিনি বসেই রইলেন মুখ নীচু করে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসাপলুডোর সিঁড়ি
    Next Article সুখস্বপ্ন

    Related Articles

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }