Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প671 Mins Read0

    পরমায়ু

    কুঞ্জ মাঝির চক্ষু দুটি গেল। পুরোপুরি নয়। রোদ থাকলে চোখে একটা লালচে আভা ঠাহর হয়। মানুষজনের চেহারার আদলটুকুও ধরতে পারে।

    কে গেলি? নারান? উঠে আয় দিকি একবার!

    সুবুচনীর মা নাকি গো? বউমার কাছে এয়েচ? বেশ বেশ।

    এই পর্যন্ত। সম্পন্ন চাষি। ঘরে চিড়ে, মুড়ি, সরষের খোল অপর্যাপ্ত। চিকিৎসার ত্রুটি হতে দেয়নি ছেলে। সদরে যেতে হলে নদী পার। সেভাবেই একে একে দুটি চোখেরই ছানি অস্ত্র হল। প্রথমে কালো ঠুলি, তারপর বেশি পাওয়ারের চশমা উঠল নাকে। কালো ডাঁটির। চলল ওইভাবে বছর ছয়েক। তারপর ধীরে ধীরে আবার সব আবছা হচ্ছে। দিনের বেলাতেই যেন মনে হয় সাঁঝ নেমে গেছে। ভুরুর ওপর হাত দিয়ে মানুষ ঠাহর করতে করতে সে বলে, কইরে রানি, বিমলি! গেলি কই? পিদ্দিম দিলি নে যে বড়ো…

    পিদ্দিম দোব যে পাখপাখালির ডাক শুনতে পেয়েছ? বলি অ ঠাকুদ্দা।

    তা পাইনি, ডিমের মতো চুকচুকে হয়ে আসা মাথাটি নাড়তে নাড়তে কুঞ্জ বলে। রান্নাশালের পেছন দিক থেকেই আরম্ভ হয়েছে তার ন কাঠা সাত ছটাকের বাগান। সন্ধের ছায়া নামলেই তার আম জাম জামরুল পেয়ারা গাছ সব ঘরফিরতি পাখির প্রচন্ড কলরোলে ঝমঝম করতে থাকে। তা সেও যেন আজকাল রূপনারায়ণ, কংসাবতী, মুণ্ডেশ্বরীর জল পার হয়ে তার তীব্রতা অনেকখানি হারিয়ে ফেলে তবে আসছে কুঞ্জ মাঝির ভোঁ লাগা কানে। কান দুটি তার আগেভাগেই গেছে। মেয়ের ঘরের নাতি সুজন বেশ লেখাপড়া করেছে, সে বলে ইস্টোন ডেফ।

    যে ডাক্তার ছানি অস্তর করেছিল সেই দেখল আবার, দেখে-টেখে হাতের যন্তর নামিয়ে বলল, চোখের নার্ভ সব শুকিয়ে গেছে তোমার বাবার। জরায়, বার্ধক্যে, বুঝলে কিছু?

    এজ্ঞে, তার কোনো চিকিচ্ছে বার হয়নি? পঞ্চাননের ভাবটা যেন চিকিচ্ছে বার হয়ে থাকলে সে তার বাপকে জেনিভা-টেনিভা পাঠাবে।

    ডাক্তার বললে, না। বার হয়নি। নার্ভগুলির পরমায়ু ফুরিয়ে গেছে। আর পঁচানববুই তো পার করল তোমার বাবা, অনেক তো দেখলও। দেখবে যে, এখন আর দেখবার আছেটাই বা কী? যেদিকে তাকাও খালি দুঃখ, দুর্দশা, দুর্নীতি।

    পঞ্চা বিড় বিড় করে বলে, দেখতে চাচ্ছে যে! বড্ডই দেখতে চাচ্ছে। ডাক্তারবাবু। বুঝেন না কেন, হাত বুইলে বুইলে মুখের চামড়াগুলো আমার তুলে নিচ্ছে বুড়ো।

    পঞ্চা! পঞ্চা! তুই পঞ্চই তো রে!

    হ্যাঁ গো হ্যাঁ। তোমার সন্দ হচ্ছে কেন আজকাল?

    কানে শুনিনে বাবা। তোর হেঁয়াটা গলা ভারী করে আমার ঠেয়ে টাকা পয়সা নিয়ে যায়। আজ এক কুড়ি, কাল দু-কুড়ি…।

    ভোলো কেন? তার মুখ বুলোও?

    বুলুই তো!

    আমার যে খাটা-খোটা ফাটা বুড়োটে চামড়া, আর তারটা যে মিহিন টের পাও।

    কুঞ্জ এইবার রেগে ওঠে। তুই কতো বড়োটা হলি যে বুড়োটে চাম হবে? শুখো চাম তোর শত্তুরের হোক।

    এত দুঃখেও হাসি আসে পঞ্চাননের। যে বাপের পঁচানববুই পার হতে যায় তার ছেলের চামড়া এখনও কিশোর ছেলের মতো হবে? আবদার মন্দ নয়।

    পঞ্চানন ঠাকুরের দোর-ধরা ছেলে। চারটি পর পর নষ্ট হয়ে অনেক কষ্টের ওই একটিই ছেলে কুঞ্জর। পাঁচ পাঁচ খানি ধুমসো ধুমসো মেয়ের পরে। মড়ঞ্চে পোয়াতি বলে সে সময়ে পঞ্চুর মা-র কী অচ্ছেদ্দাটাই না হয়েছিল। চাঁদপানা মুখ দেখে বিয়ে দেওয়া, সেই বউ যদি পাঁচ ছ বছরেও গর্ভ না ধরে কি মরা ছেলের জন্ম দেয় তো তার খোয়ার কুঞ্জ কেন ধম্মেঠাকুরের বাবা এলেও আটকাতে পারবে না। তারপর যদি বা হল, হতেই থাকল। ধুমবো ধূমবো মেয়ে সব। একটু একটু করে বড়ো হয় আর গাছকোমর বেঁধে নাকে নোলক, কপালে টিপ, কই মাগুরের মতো খলবলিয়ে খেলে বেড়ায়। কতখানি বয়েস পর্যন্ত কুঞ্জ মাঝির একার হাতে জমি, জিরেত, খেত, খামার, হেলে-বলদ, গাই-গোরু। চারটে-পাঁচটে মুনিষ দিনরাত হাঁ-হাঁ করছে। মুরুক্ষু সুরুক্ষু মানুষ খাটুনির ভাগটুকু না হয় সামলাল, কিন্তু ধরিত্তির মা যে তুষ্ট হয়ে সোনা তুলে দিচ্ছেন হাতে তার হিসেবপত্তর সে রাখে কী করে? কোমরের গেজেতে পয়সাকড়িগুলো তার শুধু ঠুসে রাখাই সার। চালানের অভাবে কত আনাজপাতি তার ফি বছর নষ্টই হতে থাকত। এখন দেখো, কেমন সব গোনা-গাঁথা। লাল খেরোর খাতা, কানে কলম, কড়া-ক্রান্তি হিসেব ছেলের, এক কানি এদিক ওদিক হবার উপায় নেই।

    কুঞ্জ মাঝির শব্দহীন বর্ণহীন ভুতুড়ে জগতে পঞ্চই একমাত্র মানুষ। মানুষটি মাঝে মাঝে তার মানসপটে দেবতাই হয়ে ওঠে। এক জমির থেকে তিন তিনটি ফসল অবলীলায় ওঠায় যে, ভ্যানগাড়ি কিনে বাগানের ফুল-ফুলুরি নিজ হাতে চালান দিয়ে মুঠো মুঠো টাকা আনে আর বাপের গেঁজে ভরতি করে যে, সে ছেলে দেবতা নয় তো আর কী? কোমর ভরতি টাকা, তা হোক না কোমর ভাঙা, চৌদিকে এমন টাল হয়ে থাকা সবুজ, না-ই বা চোখে দেখল এত সুখ শরীরে সইলে হয়। দুগগোপুর থেকে জল ছাড়লে দাওয়ায় উঠে আসে, সত্যি কথা। কদিন নৌকোর ওপর দোল-দোল দুলুনি। গরমেন্টের রিলিফ সরকার এসে বলে গেল, আপনারা এ গ্রাম ছাড়ন, এসব জল-নিকেশি জায়গা। আমাদের কিছু করবার নেই। পঞ্চা গাঁয়ের পাঁচজনকে একত্তর করে বোঝাল, নিজের হাতে গড়া ভূঁই কেউ ছাড়ে?

    এখন গরমের দিনে বউমা ঘন দুধের মধ্যে বাড়ির ভাজা ডবকা ডবকা মুড়ির ধামি উপুড় করে দেয়, তাতে কলমের আমের ঘন রস, গন্ধে নীল ডুমো মাছি ওড়ে। দুই নাতনি দু-দিক থেকে ঝাপটে ঝাপটে বাতাস করে। গ্রাস মুখে তুলে কুঞ্জ মাঝি হাপুসহুপুস মা লক্ষ্মীর পেসাদ পায় যেন। লক্ষ্মী তো নয় গণেশ। সিদ্ধিদাতা গণেশ ঠাকুরটি তার মানুষের রূপ ধরে দাওয়ায় পায়ের খসখস শব্দ তুলে উঠে আসে, গামছা ঝাড়ে, বলে, কী গো বাবা? খাচ্ছ ক্ষীর-মুড়ি? খাও, খাও বেশ করে খাও।

    রানি, বিমলা দুধার থেকে খিল খিল করতে থাকে।

    হাসির কী হল? বলি, হাসির কী হল রে ছুঁড়ি? হ্যাঁ গো বাবাকে জামরুল দিলে

    যে বড়ো! অমন ডাঁশা ডাঁশা জামরুল, চুড়ি ভরতি সব সাজানো রইল যে! মাথায় ঘোমটা, রানি বিমলার মা বেরিয়ে এসে বলে, তারপর পেট কামড়ালে?

    অবাক করলে, দাঁতে একটা ফুটো নেই, ফাটা নেই, বাটি বাটি ক্ষীর সাবড়ে দিচ্ছে, জামরুল খেলে পেট কামড়াবে? ছিটেলের ঘরের মেয়ে দেখছি?

    হিন্ডেলের বাটি ভরতি জামরুল এনে বউ বসিয়ে দিয়ে যায়।

    এক ছিটে জল দে রে রানি। মুখ কুলকুচি করি। নইলে মিষ্টি মুখে জামরুলের সোয়াদ পাবনি।

    কুলকুচি করে ঢকঢক গেলাস খানেক জল খেয়ে কুঞ্জ জামরুলের গায়ে হাত বুলোয়। আহা কী চিকন গো, এই নাতিনদের মুখের মতো। কামড় দিলেই রসের ফোয়ারা ছুটবে। তার দাঁতগুলি সব অটুট। দু-চারটি কশ ছাড়া ওই সব যাকে বলে একেবারে বিদ্যমান। সারাজীবন দাঁত দিয়ে আখ ছুলে চিবিয়ে খেয়েছে, মাংসের হাড় চিবিয়ে ধুলোতঁড়ি করে দিয়েছে সে কি অমনি-অমনি। দাঁতের বাহার দেখলে এই বয়সেও লোকের চোখ ঠিকরে যাবে। চোখ দুটি আর কান দুটি কেন গেল? সেই সঙ্গে শালোর কোমর, তা কুঞ্জ আজও বুঝতে পারে না। আর একটি জিনিস বোধের অগম্য তার। কার্তিক পড়তে না পড়তেই জাড় অমন জেঁকে বসে কেন? পোষ-মাঘে সে রেজাই গায়ে দিয়ে ঘরে আংরা রেখেও শীতে ঠকঠক করে কেঁপে সারা হয়। জামা-কাপড়-শয্যে সব যেন জলে চুবিয়ে এনেছে। অথচ এই সিদিনের কথা, অঘ্রানমাসের সন্ধেবেলায় মাঠের কাজ সেরে সে গাঙে ডুব দিয়ে এসেছে। নাতি এক বাঁদুরে টুপি এনে দেয় শহর থেকে। সেইটে পরে এখন জাড় খানিকটা সামলেসুমলে আছে। এ ছাড়াও হচ্ছে তলপেটে একটা খামচানি ব্যথা। ডাক্তার বললে এ রোগকে বলে হার্নি। অস্ত্র করতে হবে। অস্তর! আবার অস্তর! হাঁট মাউ করে উঠেছিল সে, চোখের ওপর ছুরি চালিয়ে তো তার দফা নিকেশ করে দিলে, এবার পেটে ছুরি বসিয়ে আমারই কম্মো কাবার করতে চাও নাকি গো, ডাক্তারবাবু?

    ডাক্তার হেসে বলেছিলেন, কম্মো কাবার হবে না। কিন্তু যদি হয়ই, তো কি খুড়ো? অনেকদিন তো জীবনটা চেখে চেখে বাঁচলে। আর এই ঘিনঘিনে ব্যথা নিয়ে বাঁচতে ভালো লাগবে?

    কুঞ্জ অর্ধেক কথা শুনতে পায় না। এগুলি ঠিক শুনেছে। পঞ্চুকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে, বলে, পঞ্চু আমাকে খবরদার টেবিলে তুলবিনি। বাড়ি নিয়ে চ। ঘিনঘিনে ব্যথা সে আমার, আমি বুঝব, ও শালোর ডাক্তারকে বুঝতে হবেনি।

    পঞ্চু হাসে, জোর করে কে তোমাকে টেবিলে তুলছে?

    ডাক্তারের পরামর্শমতো নীচ-পেটে পরবার বেল্টো কিনে দিয়েছে পধু, ঘুমের সময় আর প্রাতঃকৃত্যের সময় ছাড়া পেট সাপটে থাকে। এই তো সবেরই সুসার আছে, শুধু শুধু ছুরি-কাঁচি ইসব কী? শরীর থাকলেই রোগ-বালাই। তা যেমন রোগ তার তেমন ওষুধ! ঘাবড়ালে চলে? বুনো ওলের জন্যে চাই বাঘা তেঁতুল, নয় কী?

    দুপুরবেলা দুই নাতিন বেশ করে তেল ডলে দেয়। পিঠটা বড্ড রুখু হয়ে যাচ্ছে। কুঞ্জ পিঠে তেল থাবড়ে দেয় হাত বেঁকিয়ে। পঞ্চুর বউ রাঁধে ভালো, তাকে বলে, পুঁইডগা আর লাউ দিয়ে চিংড়িমাছ অনেক দিন রাঁধো না তো বউমা। বেশ চনকো চনকো চিংড়ি।

    বউ বলে, চিংড়ি কই! পোকা মারার ওষুধে চিংড়ি হবার উপায় আছে?

    গুগলির ঝোল সে-ও তো অনেক দিন খাওয়াওনি, খেলে পরমাই বাড়ে তা জানো?

    রানি-বিমলা হাসির বেগ সামলাতে পারে না। এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। রানি কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, কার পরমাই বাড়ার দরকার পড়ল গো অ ঠাকুরদা?

    কেন রে ছুঁড়ি? তোর, তোর বাপের, মায়ের, আমার…

    ওইটেই আসল কথা। তোমার পরমাইটাই আরও একটু নাম্বা করা দরকার। রানির মা চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তাদের বাবা ঠাকুরদার সঙ্গে এ ধরনের তামাশা পছন্দ করে না। বলে, জানিস আমি বাবার কত বয়সের ছালা। ও তো আমারই ঠাকুরদার মতন!

    কুঞ্জ তেল-টেল মেখে আবার বলে, আজকাল কি ছাতু আর হচ্ছে না বউমা! প্যাঁজ, রশুন, নংকা দিয়ে বেশ করে একদিন ছাতু রাঁধো তো! তোমার শাউড়ি রাঁধত। এক থাবা ছাতু দিয়ে এক থালা ভাত উঠে যেত।

    রানির মা বিরক্ত হয়ে সামনে থেকে সরে যায়। তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে, কোথায় ধম্মোকথা কইবে তা না পুঁই-চিংড়ি, গুগলির ঝোল, ছাতু। ঘোর কলি একেই বলে। বুড়ো মানুষের মনেও ধম্মো নেই।

    পঞ্চানন বুঝদার মানুষ। সে স্ত্রীকে বোঝায়, বুঝো না কেন বউ। চোখ নাই, কান নাই যার, তার পরানের সবটুকুখানিই যে জিবে এসে ঠেকেছে গো! এর সঙ্গে ধম্মো অধম্মোর সম্প ক কি? কুঞ্জমাঝি কোনোদিন অধম্মে করে নাই বুড়ো বয়সে নাই বা ভেক নিল।

    বউ গজগজ করে, স্পষ্টই বোঝা যায়, ধর্ম-অধর্মের ধারণায় সে তার স্বামীর মতে মত দিতে পারছে না। সে অসন্তুষ্ট গলায় বলে, যত অনাচ্ছিস্টি কাণ্ড।

    ফাগুন চোতে আকাশ যেন রক্ত-পলাশ! কাছে ভিতে জঙ্গল, বাগান, চরের মাটি, নদীর পাড়, এমনকি মেঠো হেটো রাস্তার দুধার অবধি সবুজে সবুজ! ন্যাড়া গাছের ডালে ডালে দ্যাখ-না-দ্যাখ কচি পাতা তিড়িং বিড়িং নেচে নেচে বার হয়ে যাচ্ছে। দুই বোনের এক লগ্নে বিয়ে দিয়ে সারল পঞ্চানন। বলল, বাবা, তোমার একটুখানি খালি খালি লাগবে। তোমার বউমার তো শতেক কাজ! তার মাঝে তোমার নাতিনদের মতো হাতে-হাতে মুখে মুখে তো বেচারি পারবে না। একটু বুঝো!

    যার বলবার কথা সে বলল। এখন যার শোনাবার কথা সে তো শোনেনি। এমন দিনে রানি-বিমলা দুই বোন ঠাকুর্দাদার দুই পাশ থেকে পাকা চুল তোলবার ভান করত, ও মা, মা, ঠাকুরদা, কোথায় যাব গো! তোমার যে কাঁচা চুল উঠছে গো, খুশি হয়ে উঠত কুঞ্জ, অবাক নয় কোনোমতেই। এটাই যেন স্বাভাবিক।

    কটা? কটা? গুনে দেখ তো দিদি!

    একটা ছিঁড়ে তোমায় দেখাব?

    উ হু হু প্রবল প্রতিবাদ তুলত কুঞ্জ, পাঁচ কুড়ি পুন্ন হলে নতুন পাতার মতো নতুন চুলও গজায় রে, শরীল নতুন হয়ে ওঠে। দেখছিস না গাছপালায় সব পাতাপুতি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে!

    তুমি দেখতে পাচ্ছ?

    তা একরকম পাচ্চি বইকি! বলরামচুড়োয় কেমন কালচে সবুজ পাতার টুপি এসেছে। মানুষেরও অমনি হয়!

    হবেই তো দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় কুঞ্জর, আবার কোমর সোজা করে দাঁইড়ে লাঙল ধরবুনি? হেঁয়াটা তো সদরে দোকান দিচ্ছে, না পয়সা জলে দিচ্ছে! পঞ্চার পাশে কে দাঁড়ায় দিদি! পঞ্চাটা আমার খেটে খেটে হেলে গেল।

    হেলে কিন্তু পঞ্চানন যায়নি। চোত মাসের সকাল ন-টা থেকেই কাঠ ফাটে। ভাঁটরোর গ্রামাঞ্চলটুকু সবুজে সবুজ, তবু একটুখানি ছায়া ছায়া। কিন্তু ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাজার হাটে বেসাতি করতে গেলে নৌকোয় নদী পেরিয়ে আগে পড়বে মাঠ। তাতে আদিগন্ত কোথাও জিরেন নেই, বাস রাস্তায় একবার ঠেলে উঠতে পারলে ভ্যানগাড়ি শনশনশন চলবে, তখন কোনো বড়োসড়ো গাছের ছায়ায় দুদন্ড গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খেয়ে নেওয়াও যেতে পারে। পঞ্চার গাড়িতে কাঁচকলার কাঁদি, কাঁটালি কলা, এঁচোড়, থোড়, পাকা পেঁপে, কাঁচা পেঁপে, সজনে ডাঁটা, বেগুন, লঙ্কা, নেবু! সব কুঞ্জর বাগানের।

    সন্ধে ঘুরে গেল। তুলসীতলার পিদিমটি নিবুনিবু। অন্ধকার ঘোর হচ্ছে। আনাচে কানাচে ঝিঝির প্রবল প্রতিপত্তিতে ঝিনিঝিনি খত্তাল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে, কুঞ্জ বলল, পঞ্চা যে এখনও এল না বউমা। ছেলে বাড়ি না থাকলেই সে সন্ধে থেকেই কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে ঘর বার করে।

    বউ বললে, বেরুতে একটু বেলা তো হল, মাংসটা কাটল, কুটুল, রাঁধল, তবে না বেরুননা। গাড়ি চুড়ো করে আনাজপাতি নিয়ে গেছে বাবা। ভাঙা হাট অবধি না দেখে কি আর সে আসছে! তুমি খেয়ে নাও।

    খাব কী গো? হেঁয়াটা আসুক।

    সে যদি আসে এখন তেতপ্পরে। চান না করে ভাতেও বসবে না। তুমি বুড়ো মানুষ। এখনই তো চুলছ দেখছি …..

    তালে দিয়েই দাও। মাংসটা আছে তো?

    মুখ টিপে হেসে বউ বলে, আছে গো আছে, আর কারুর না থাক তোমার আছে। তা চোতের গরমে দুবেলা মাংস, খাবে তো?

    চোতের গরম? কোথায়? সাঁঝ হতে না হতেই তোমার চোত পালিয়েছে, ফুরফুর করে গাঙের হাওয়া দিচ্ছে এমন! …

    দাওয়ায় পাতা করে বুড়োকে এনে গুছিয়ে বসিয়ে দিয়ে যায় বউ। কাঁসার বড়ো বাটিতে মাংস। আজ অনেকদিন পর গাঁয়ে খাসি কাটা হল, পঞ্চা তার নিজের ভাগ পাতা মুড়ে নিয়ে এসে নিজেই টুকরো টুকরো করেছে, নিজেই বেঁধেছে, কবে ঝাল দিয়ে। খেতে খেতে ঝালে টকাটক আওয়াজ তোলে কুঞ্জ। চোখ দিয়ে জল পড়ে। কিন্তু সোয়াদ কী? মুখ যেন ছেড়ে গেল।

    ভাত-টাত ঝোল মেখে শেষ করে সবে দাঁত বসিয়েছে একখানা হাড়ের ওপর জুত করে, বাইরে লোকজনের আওয়াজ পাওয়া গেল। লণ্ঠন তুলে বউ সদরে আলো দেখায়। চার পাঁচজন জোয়ান লোক ভ্যানগাড়ি থেকে পঞ্চাকে নামিয়ে দাওয়ায় রাখলে। মাঠের মধ্যেই নাকি ভ্যানগাড়ি থেকে উলটে পড়েছিল। হাটফিরতি লোক দেখতে পেয়ে তক্ষুনি আবার হাসপাতালে নিয়ে গেছে, ডাক্তার দেখে বলেছে, ইস্টেরোক। হাসপাতালে ভরতি করার জায়গা নেই। ওষুধ পত্র দিয়ে, উঁচ ফুঁড়ে, যা করবার করে ছেড়ে দিয়েছে। এখন কী কী খাওয়াতে হবে না হবে গোপাল কর্মকার পঞ্চার বউকে সব বুঝিয়ে বলছে।

    হাড়টা এতক্ষণে ভালো করে ভাঙতে পেরে গেছে কুঞ্জ। ভেতরের রসটুকু জিভ সরু করে চুষতে চুষতে বলছে, পঞ্চা এলি? সঙ্গে কে যা! নিধু নাকি? শালো খচ্চর তুমি খাসির রাঙের লোভে লোভে কুঞ্জ মাঝির ঘরে রাত দুপুরে সেঁদিয়েছ। তোমায় আমি চিনি নে?

    নিধু বললে, খুড়োকে আর ভেঙে কাজ নেই।

    গোপাল বললে, রাখ, রাখ সেঞ্চুরি করতে যাচ্ছে, এখন আর হ্যান নেই ত্যান নেই ছাড়। বল বুড়োকে। হাড় ছেড়ে উঠুক। পঞ্চাদার অবস্থা একদম ভালো নয়। দেখলি না চোখের পাতা টেনে টর্চ মেরেই ডাক্তার ছেড়ে দিল। রাত কাটবে না। সুজন, পরাণ সব খবর দে।

    ভোর রাতের দিকে পঞ্চানন অজ্ঞাতলোকে যাত্রা করল। বেচারির জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। সরু-মোটা গলার হাহাকারে গগন ফাটছে। কুঞ্জবুড়ো দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে রয়েছে। সারাদিন একই ভাব। পাড়া ভেঙে সান্ত্বনা দিতে এল সব! মেয়েরা পড়েছে কুঞ্জর বউকে নিয়ে। বুড়োরা পড়েছে কুঞ্জকে নিয়ে। মাধব ঠাকুর পুরুতও বটে, জ্যোতিষীও বটে, বললে, মুখ তোলো কুঞ্জ, কোমর সোজা করে তোমাকেই তো এখন দাঁড়াতে হবে গো! কুঞ্জ কোনোমতে দুই ঠ্যাঙের মধ্যবর্তী গহ্বর থেকে ডিমের মতো মাথাটি তুলে বলে, হাত পা আমার পাতা পাতা হয়ে যাচ্ছে ঠাকুর, বুকের মধ্যেটা ঘোর যনতন্না, শরীলটা আর বশে নেই গো!

    আহা, অমন জলজ্যান্ত ছেলেটা ঠিক দুককুরে…গেল, শরীর আর বশে থাকে কুঞ্জ! তবে ছেলে তোমার দুপোয়া দোষ পেয়েছে। বিহিত করো, নইলে বাড়িতে আরও ক-টা অমঙ্গল অপঘাত কেউ আটকাতে পারবে না।

    বিকেল নাগাদ মড়া-পোড়ানিরা সব ফিরে এল। মটর ডাল দাঁতে কেটে, নিম ছুঁয়ে, আগুন ছুঁয়ে যে যার মতো ঘরে গেল। পঞ্চুর ঘরে বাতি জ্বলছে। বউ মেঝে আঁকড়ে শুয়ে। মাথার কাছে মেয়ে দুটি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুজন পরাণ দুই নাতি অনেক রাতে খুটখুট শব্দ পেয়ে ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াল। শোকাতাপা শরীর, ঘুম তো সহজে আসে না। যদি-বা আসে একটু আওয়াজেই খান খান হয়ে যায়। পরাণের ওপর আবার নতুন দায়দায়িত্বের দুর্ভাবনা। চাষবাসের বিশেষ কিছুই সে জানে না। তা বলে খুটখুট শব্দ এরই মধ্যে? চোর ডাকাত সব বোধহয় জেনে গেছে, এখন থাকার মধ্যে এক অথর্ব বৃদ্ধ, এক সন্তপ্ত বিধবা আর এক উঠতি বয়সের অকালকুষ্মাণ্ড যে নাকি বাপ-পিতেমোর ধারাও নেবে না, অন্য ধারা নিতে গিয়েও খালি মার খাবে। কুঞ্জমাঝির ভাষায় হেঁয়া।

    দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে আসে, লোহার ডান্ডা থাকে ঘরের কোণে, সেটাকে হাতে তুলে নেয় পরাণ। খুটখাট আওয়াজ আসছে দক্ষিণের দাওয়া থেকে। কুঞ্জর ঘরেই যতেক কাঁচা টাকা। নজর ওদিকেই হবে। দাওয়া ঘুরে পেছনে যেতেই দেখল চাঁদ চালের বাতা ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে। দাওয়া ফরসা। ঠাকুরদাদার ঘরের চৌকাঠে চোর হামাগুড়ি দিচ্ছে, তার বেটপ ছায়া পড়েছে দাওয়ার ওপর।

    তবে রে! বিকট হাঁকড়ে উঠল সুজন।

    চোরের কানে শব্দ পৌঁছেছে ঠিক। কিন্তু যতটা জোর হাঁক ততটা জোরে নয়। হাত থেকে ঠক করে কী যেন দাওয়ায় পড়ে গেল।

    সুজন-পরাণ নীচু হয়ে বলল, একি। কী করছ গো ঠাকুদ্দা, এই দুপুর রেতে।

    ফ্যালফেলে দৃষ্টি মাঝির দৃষ্টিহীন চোখে। ধরা পড়ার গলায় বলল, এই যে দাদা দুটো ঘোড়ার নাল, বেশ কালো কালো খয়াটে। ঠাকুরমশাই বলে গেল কিনা তোর বাপ দোষ পেয়েচে, দিষ্টি পড়বে, তাই দোরে নাল দুটো বাবলার আটা দে সেঁটে দিচ্ছিলুম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }