Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প671 Mins Read0

    অপত্য

    ব্যায়াম সমিতি থেকে ফেরবার পথটা অর্থাৎ শর্ট-কার্টটা একেবারে কাদা-জলা হয়ে আছে। অনুষ্টুপদা বলে রাবড়ি-কাদা। এই কাদার সঙ্গে রাবড়ির নাম জড়িয়ে থাকলে রাবড়িতে ঘেন্না ধরা বিচিত্র না। অবশ্য, রাবড়ি যেন কতই জুটছে! চটিজোড়া খুলে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে নিতে থাকল অঞ্জু। সে জানে কাদায় বা জলে এভাবে খালি পায়ে নামা আর প্রাণটাকে নামিয়ে দেওয়া মোটের ওপর একই কথা। ওই কাদায় মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে কাচের ফালি, পেরেক, ধারালো যে কোনো জিনিসের টুকরো। পায়ে ফুটলেই আই.ডি.হসপিট্যাল, বেলিয়াঘাটা। সেখান থেকে ফেরার কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে, পঁচিশ বছর বয়সের একটা বি.কম বেকার ছেলের ফেরাও যা, না ফেরাও তা। দাদা আছে গড়িয়াহাটার মোড়ে একটা দোকানের সেলসম্যান। ছোটো বোনটাও এক ডাক্তারের চেম্বারে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। একমাত্র অঞ্জুরই দু-পাঁচটা টিউশনি ছাড়া কিছু হল না। এদিকে ব্যায়াম সমিতিতে মুগুর ভেঁজে, প্যারালাল বারে উলটে পালটে খিদেটি আছে সাধা। মুগকলাই, ছোলা, সয়াবিন, রাজমা সবই পেটের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। যখন রান্নাঘরের একপাশে বাবা চেয়ারে আর তিন ভাই-বোন মেঝেতে খেতে বসে, দেয়ালগুলো যেন মুখ বাঁকিয়ে বলতে থাকে, কম্মের হোত টিপি! খালি থালা থালা ভাত মারতে আছিস!

    কে বলে দেয়াল থেকে? অঞ্জুর সতেরো বছর বয়সে মৃত মা না কি! দরিদ্র সংসারে দিবারাত্র খেটে খেটে মায়ের মেজাজ খুবই তিরিক্ষি ছিল। তার ওপর ছিল মাথার যন্ত্রণার রোগ। হলে, মাথায় কষে ছেঁড়া শাড়ির পাড় বেঁধে শুয়ে থাকত। কিন্তু মা অঞ্জুকে বড্ড ভালোবাসত। বোন যদি এ নিয়ে নালিশ করত, মা বলত, দ্যাখ মঞ্জু, পেটের সব সন্তানকেও সমানভাবে ভালোবাসা চাট্টিখানি কথা নয়, নিজে মা হলে বুঝবি। যে সন্তান সবচেয়ে হাসিমুখ, মায়ের দুঃখ বোঝে, যার ওপর ভরসা করা যায়, সে একটু বেশি পাবেই। তবে সেটুকু উথলোনো দুধ। আর কারও ভাগ থেকে কেড়ে কুড়ে নেওয়া নয়। অঞ্জু চিরদিনই হাসিখুশি, আড্ডাবাজ, গুমোট কাটিয়ে দিতে ওস্তাদ, মায়ের ফরমাশ সামান্যই সব, তবু সেই সামান্যটুকু মেটাবার কথা কখখনও ভুলত না অঞ্জ। সরু করে কুচোনো একটু কাঁচা সুপুরি চিবিয়ে বোধহয় মায়ের একটু নেশামতে হত। সুপুরির জোগান আসত অঞ্জুর হাত দিয়ে। কাছাকাছি ঠাকুরের আশ্রমে যেতে ভালোবাসতো মা। অঞ্জু ওসব ঠাকুর-টাকুর কস্মিনকালেও পছন্দ করে না। তবু যেত মাকে নিয়ে। সেই মাকে জীবনে যেই একবার মাত্র সে এন.সি.সি.-র সঙ্গে ট্রেনিং-এ গেল ঠিক সেবারই মারা যেতে হল? স্ট্রোক! তাকে খবর দেওয়া গেল না। সে যখন ফিরল শ্রাদ্ধ-শান্তি সুষ্ঠু মিটে গেছে, মায়ের ছবিতে রজনিগন্ধার মালা শুকনো! ছোটো ছেলে, প্রিয় ছেলের কাছ থেকে, মার কি শেষ সময়ে একটু জলও যাচা ছিল না? মানুষটা যে ছিল এবং এক সময়ে তার না থাকা নিয়ে এই বাড়িতে মানুষগুলির আচার-আচরণ পোশাক আশাকে কিছু সাময়িক পরিবর্তন হয়েছিল সেসব কিছু তখন বোঝবার উপায় পর্যন্ত নেই। শুধু দাদা আরও গম্ভীর, বোন আরও ক্লান্ত, বাবার আরও বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে যাওয়া। হতভম্ব অঞ্জু বাড়ি ঢুকতে বাবা শুকনো মৃত চোখে চেয়ে বলল, যাক, তোমাদের সংসারে, একটা মুখ কমল। সংসারটা যে কী করে তাঁর হয়ে তাঁর ছেলেদের হয়ে গেল তা অঞ্জু বোঝে না। সে তো তখন বাচ্চা, দাদা সুন্ধু চব্বিশ পেরোয় নি। কিন্তু যবে থেকে চোখ খারাপের অজুহাতে বাবার কাজটা গেছে তবে থেকেই বাবা সুযোগ পেলেই তোমাদের সংসার কথাটা বলতেন। এখন বাবার চোখে গ্লকোমা, পায়ের নার্ভ শুকিয়ে আসছে। শিরদাঁড়ায় লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস! যথাসাধ্য চিকিৎসা করানো হয়! কিন্তু সেই একটা কথা আছে না, তোমার যথাসাধ্যটাও যথেষ্ট নয়! এ হল সেই।

    দাদা ভালো করে কথা কয় না। মঞ্জুও ভুরু কুঁচকে থাকে। বাবার সদাই দীর্ঘশ্বাস। তবু অঞ্জু যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটেই যাতাযাত করে সে, তখন তার মনে হয় সে রাজা। এই পৃথিবী, এই আকাশ, বাতাস, সূর্যের কিরণ, চাঁদের আলো সব তার। কোনো ভিক্ষুক, বিকলাঙ্গ বা বৃদ্ধ দেখলে মনে হয় কাছে গিয়ে বলে, ভয় কী? আমি তো আছি! যেন সে রোদ থেকে তার নবীন ত্বক ব্যবহার করে অনায়াসে সালোকসংশ্লেষ করে যাচ্ছে। যেটুকু পুষ্টি ভোলা, মুগকলাই, রাজমা ইত্যাদি দিতে পারছে না, সেটুকু সে নিজেই বানিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত তার কোষকলায়। ভোলা গলায় সে হাসতে পারে যেন পৃথিবীর সর্বসুখ তার আয়ত্তে। বাড়ির মধ্যে তার এমন হাসি শুনলে মঞ্জু ভুরু কুঁচকে ওঠে, কী রে, কী খেয়েছিস?

    কী আবার খাব?

    এত হাসছিস যে?

    হাসির সঙ্গে খাওয়ার সম্পর্ক কী?

    মঞ্জু মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বলে, আজ এক এক বেলায় ক-টা স্লিপ কেটেছি জানিস? দুশো পঞ্চান্নটা করে। একবার ওপর আবার নীচ আবার ওপর। ভাতের ফ্যান গালতে গিয়ে আবার হাত ফসকে একটু গরম ফ্যান পড়ে গেছে হাতে। যদি বাংলা-ফাংলা পাস তো আমাকেও দিস দু-এক ঢোঁক। নইলে এত খাটুনি সয় না।

    হাতে ফ্যান পড়েছে তো কী দিয়েছিস?

    কী আবার দেব? হাতের কাছে নুনের বাটি ছিল এক খাবলা চেপে ধরেছি।

    খুব ভালো করেছিস। কিন্তু এবার ওষুধ লাগাতে হবে।

    থাক থাক তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না। তুই নিজের নিয়ে থাকগে যা।…

    তার এই এগিয়ে আসা, এই সদিচ্ছাটাকেও যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় মঞ্জু। অথচ অঞ্জু আদৌ নিজের নিয়ে থাকে না। বাবাই বরং তাকে কিছু ছাড়তে চায়। সে না কি অল্প পয়সায় গুছিয়ে বাজার করতে পারবে না। সে না কি একদিনেই গেরস্তকে ডকে উঠিয়ে দেবে। বাবার সেবার খুঁটিনাটিও বাবা মঞ্জু ছাড়া কারও কাছে করতে চায় না। কলঘরে, খাবার জায়গায় নিয়ে যাবার সময়ে খালি অঞ্জ। কিন্তু অঞ্জ যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে বাবার ব্যবহারের জিনিস। জামাকাপড় কেচে দেয়। শুধু নিজেরটা নয়, সবারই। তবু তাকেই সবচেয়ে ফিটফাট দেখায়। সবচেয়ে ঝকঝকে। উজ্জ্বল। আর সবসময়ে মনের ভেতর দিয়ে একটা আনন্দের বাতাস হিল্লোল তুলে বয়ে যায়।

    অনুষ্টুপদা বলেন, আরে ছোকা, শরীরমাদ্যং শাস্ত্রে যে বলেছে সে কি আর এমনি বলেছে? গভীর উইজডমের কথা বলেছে। এই যে ব্যায়াম করছিস, শরীরের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে। গ্ল্যান্ড-ফ্ল্যান্ড সব পার্ফেক্ট। যেখান থেকে যতটা স্টিমুলেশন দরকার আসছে। আর তার ফলেই একটা চমৎকার মানসিক ভারসাম্য, একটা স্থিতিস্থাপকতা। এটাই মানুষের আসল অবস্থা। সচ্চিদানন্দ স্টেট। বুঝলি ছোকা? —ছোকরা না বলে ডোকা বলেন অনুষ্টুপদা।

    বোঝে অঞ্জু। খুব বোঝে। এই শারীরিক আনন্দ বা সুস্বাস্থ্য থেকে ক্ষরিত আনন্দ থাকলে যে কী হত, বাবাকে দেখে খানিকটা বোঝা যায়। দাদা, মঞ্জ, শুধ তার পরিবার কেন আরও কত ছেলে-মেয়ে-নারী-পুরুষ এই শারীরিক আনন্দের খোঁজই রাখে না। তবে আরও একটা জিনিস আছে। ব্যায়াম সমিতির সবাই কি অঞ্জুর মতো? বোধহয় না। অনুষ্টুপদা হয়তো বলবেন, যে কোনো কারণেই হোক সবাইকার শরীরের ভেতরটা সমান ভালোভাবে চলে না। তাই তারতম্য হয়ে যায়। কিন্তু কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। মানুষে মানুষে একটু তফাত আছেই। এই যে নেপাল, ওই ব্যায়াম সমিতিরই ছেলে তো! নিজের এলাকাটাকে ভয়ে জুজু করে রেখে দিয়েছে একেবারে। কাউকে তোয়াক্কা করে না। যখন তখন ভয় দেখায়, চোখ গরম করে। নেপাল এখন নেউল হয়ে গেছে। অঞ্জুকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। এলাকার পলিটিক্যাল দাদার কাছে নিয়ে যাবার কথা বলেছিল। সোজাসুজি কি আর?—কী রে অঞ্জু, কমার্স গ্র্যাজুয়েট তো হলি। আর কদ্দিন ভ্যারেন্ডা ভাজবি? চল একদিন রবীনদার কাছে নিয়ে গিয়ে তোর একটা হিল্লে লাগিয়ে দিই।

    অঞ্জু বলেছিল, তুই অ্যাদ্দিন লেগে আছিস তোরই কিছু হল না! আমার? কিছু হয়নি? বলছিস কি রে? তুই একটা গ্রাজুয়েট আর আমি ইস্কুলের চৌকাঠ ডিঙোইনি। দুজনের হিল্লে কি একরকম হবে? তা ছাড়া এখন আমি পার্টির হোল টাইমার। কিছুদিন পরেই দেখবি একটা লরি কি বাস বার করে নিয়েছি। মনমোহন সিংটা আবার সময় বুঝে লোন-ফোনে গুচ্ছের গ্যাঁড়াকল ঢুকিয়ে দিল কি না।

    চলি রে দেরি হয়ে যাচ্ছে। টুউশনি আছে।—অঞ্জু পা চালায়।

    কোন কেলাস? ছাত্র না ছাত্রী?

    ছাত্র। তিনটে একসঙ্গে। হায়ার সেকেন্ডারি।—অঞ্জু কেটে পড়ে। এইভাবেই সে নেপাল-নেউলকে কাটাতে কাটাতে আসছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যেও করে না, আবার মাথায় তুলে নাচেও না। খুব সাবধানে চলতে হয়। যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে। ওদের অহং প্রচণ্ড। ভুলেও সেখানে লেগে গেলে সর্বনাশ করে ছাড়বে।

    ইদানীং নেপাল ঘন ঘন ধরছে তাকে। বিকেল তিনটে। অঞ্জু বেরিয়েছে। ছাত্রীর বাড়ি রিচি রোড। স্বভাবতই সে হেঁটে যাবে। মোড়ে নেপাল।

    কী রে অঞ্জু ছাত্তর ঠ্যাঙাতে চললি?

    আর বলিস কেন? পরীক্ষা এসে গেছে, এক্সট্রা দিন যেতে হচ্ছে।

    ছাত্রী নিশ্চয়ই।

    একটা নয় আবার, দুটো।

    তাই এত গরজ। হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিস একেবারে।

    কী যে বলিস নেপাল, ক্লাস ফাইভের দুটো পুঁচকে।

    রবীনদার কাছে কবে যাচ্ছিস?

    সময় করতে পারছি না রে। বাবার জন্যে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় ফি-মাসে। তিন ঘন্টা লাইন। তা ছাড়াও কত কাজ।

    বেশি দেরি হয়ে গেলে তুই-ই পস্তাবি, আমার কী!

    চলি রে! … তার শক্ত হাতের মুঠোয় নেপালের হাতের পাঞ্জা ধরে কষে ঝাঁকুনি দেয় অঞ্জু।

    ছাত্রীদের দেড়তলার ঘরে যখন ঢোকে তখন তার মুখ দেখে তারা বলে ওঠে, কী অঞ্জুদা, রাজ্যজয় করে এলেন মনে হচ্ছে?

    রাজ্যজয়ই বটে! মনে মনে ভাবে অঞ্জু। জানো না তো আর তোমাদের দুটো হায়ার সেকেন্ডারির মেয়ের এক ঝটকায় ক্লাস ফাইভে ডিমোশন হয়ে গেছে।

    এভাবেই চলে অঞ্জুর, চলে যায়। তার বয়সের অন্যান্য ছেলেরা যখন হতাশায় ভুগছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন অঞ্জু নীরবে চেষ্টা করে যাচ্ছে চাকরির, আর প্রাণপণ টিউশনি। সেই সঙ্গে ব্যায়াম। ব্যায়াম-ট্যায়ামের সুবাদেও তো অনেকের চাকরি-বাকরি হয়ে যায়। অঞ্জুর তাও হল না। কোনও ব্যাপারেই সে বোধহয় প্রথম সারিতে আসতে পারেনি। প্রথম সারিতে আসতে না পারলে বিধিসম্মত, সম্মানজনক আয়ের দরজাগুলো বন্ধ থাকে। তখন কি না খেয়ে মরে যেতে হয়? তা নয়। তখন থাকে উঞ্ছবৃত্তি। যেমন এটা-ওটার দালালি, যেমন নেপালের রবীনদার চামচাগিরি, যেমন অঞ্জুর টিউশনি। টিউশনিতে সে মন্দ রোজগার করে না। নিজের খরচ তো চলে যায়ই। বাড়িতেও কিছু দিতে পারে। তবু…লোকে যখন জিজ্ঞেস করে, বলা যায় না কিছু করি। বেকার! এত বড়ো ছেলে বেকার! বাবা মাথা নুইয়ে, দাদার মুখে নির্বেদ, মঞ্জু ভুরু কুঁচকে আছে। সবাইকার হীনম্মন্যতা।

    ল্যান্সডাউন দিয়ে হাঁটছে অঞ্জু। হাঁটতে হাঁটতে মনের কোণে ড্যালা পাকিয়ে আছে তার ব্যর্থতার চিন্তা। কিন্তু তার ওপর দিয়ে একটা আনন্দের ভালোলাগার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আষাঢ় মাস। দুপুর বেলা প্রচণ্ড একটা ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন গুমোটের পর। রাস্তা ভিজে, বাতাস ভিজে, ভিজে-ভিজে হাওয়া। আকাশে মেঘগুলো তখন হুড়হুড় করে ভেসে যাচ্ছে। ভীষণ একটা তাড়া পড়ে গেছে যেন। সন্ধেবেলাটা একটু কালি-কালি হয়ে আছে তাই। মেঘের ছায়া পড়েছে। পিচ রাস্তার পাতলা জমা জলের আয়নার মতো গায়ে। রাস্তায় বেশি লোক নেই। গাড়িগুলো খুব জোরে ছুটছে। এটা ঠিক নয় কিন্তু। বৃষ্টিপিছল রাস্তায় গাড়ি স্কিড করতে পারে। মানুষ আজকাল খুব বেপরোয়া হয়ে গেছে। জেনে-শুনেও কেন যে সাধারণ নিয়মগুলো মানে না!

    শরৎ ব্যানার্জি রোড থেকে এক ভদ্রমহিলা বেরোলেন। হাতে ব্যাগ, এক হাতে শাড়ির কুঁচি তুলে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। ঠিক অঞ্জুর সমকোণে। তাই সে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল। উনি রাস্তা পার হচ্ছেন। ওদিকের দোকানটায় চলে গেলেন। রাস্তায় আলোগুলো মিটমিট করছে। অঞ্জু আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। হঠাৎ একটি তীব্র কি-চ শব্দে তার চোখ চলে গেল রাস্তার মাঝবরাবর। সে কিছুক্ষণ আগেকার দেখা ভদ্রমহিলাকে শূন্যে দেখল। জামাকাপড় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা খাপছাড়া বল শূন্যে, ভীষণ বেগে নেমে আসছে নীচের দিকে। একটা ম্যাটাডর পাশ কাটিয়ে তীব্র বেগে চলে গেল। পেছনে হেলমেট মাথায় একজন মোটরসাইকেল-আরোহী ছুটছে। ধর ধর—আশপাশের দোকান থেকে কিছু লোকও ছুটে যাচ্ছে ভ্যানটার পেছনে। অঞ্জু দৌড়ে গিয়ে ওঁকে রাস্তা থেকে তুলে নিল কোলে। মুখটা ওঁর ভেঙে যাচ্ছে। অঞ্জুর দু-হাত জামাকাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর. কে. মিশনে স্ট্রাইক চলছে—সে তাড়াতাড়ি ভেবে নেয়—ট্যাক্সি-ট্যাক্সি… শিগগির শিগগির। খালি ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছে একটা। দু একজন চলুন আমার সঙ্গে চটপট। বাস, ভিড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কে ওঁর ঝুলতে থাকা পা দুটো ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কে একটা ব্যাগ তুলে দিল গাড়িতে। পুলিসের ঝামেলা…কে হ্যাঁপা পোয়াবে? ওপাশের দরজা খুলে তবু একটি অল্পবয়সি ছেলে উঠে এল।…… যদি কেউ এঁকে চেনেন, বাড়িতে খবর দিয়ে দিন। এস.এস.কে.এম-এ নিয়ে যাচ্ছি…….শরৎ ব্যানার্জি থেকে বেরিয়েছিলেন……।

    হু হু করে ছুটছে গাড়ি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ। উনি যেন কী বলছেন! অঞ্জু কান নামাল, কিছু শব্দ, কিছু গোঙানি। মানুষের ভেতরে আরও অনেক কিছুর মতো একটা ধবনি ভাণ্ডারও থাকে। সেই ভাঁড়ারের দরজা ভেঙে পড়েছে। তাই ধবনিরা বেরিয়ে আসছে। অঞ্জুর কাঁধে জলের বোতল। সে একটু জল দিল মুখে। আরও জোরে, আরও জোরে ভাই! হর্ন বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে যান…অঞ্জু প্রাণপণে ঝাঁকানি থেকে তার কোলের মানুষটিকে রক্ষা করতে করতে বলল।

    হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে অবশেষে। এমার্জেন্সির আলো। কে হন আপনি? কেউ। সে কী? আননোন? এ তো পুলিশ কেস হবেই। আপনি পাবেন না যেন। সিস্টার, ব্যাগটা নিন।

    শুনুন ডাক্তার, ব্যাগ-ট্যাগ, পরিচয়-টরিচয় পরে হবে। আগে ওঁকে অক্সিজেন আর কী কী লাগে দিন প্লিজ। টেবিলে তুলুন। ফর গডস সেক।

    তরুণ ডাক্তারটি চোখ ফিরিয়ে বলল, জানেন না তো পাবলিক আর পুলিশের হয়রানি! আগে পেপার্স ঠিক করতে হয়।

    ওহ ডক্টর, উনি আমার মা, ধরুন আমারই। আপনার, আপনারও। মায়ের মুখ মনে করতে পারছেন না? কুইক, কুইক, প্লিজ, ফর গডস সেক।

    স্যালাইনের বোতল। অক্সিজেন। অবাক চোখে চেয়ে তরুণ ডাক্তার, প্রৌঢ় নার্স……শি ইজ গ্যাসপিং। সরি, ইয়াং ম্যান!

    কী হল?

    শি হ্যাজ এক্সপায়ার্ড।

    এক্সপায়ার্ড?–হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে অঞ্জু। ওহ, পারলুম না, পারলুম, পারিনি, কত চেষ্টা করি পারি না।

    শুনুন, কী নাম আপনার?

    অঞ্জন পোরেল।

    ও. কে। এই ব্যাগে একটা কার্ড রয়েছে। ডক্টর শিশির বিশ্বাস। সাদার্ন অ্যাভিনিউ। ঠিকানাটা নিন। চটপট কনট্যাক্ট করুন।

    ট্যাক্সি ড্রাইভার এখনও দাঁড়িয়ে। দিশেহারার মতো অঞ্জুকে এদিক ওদিক চাইতে দেখে ডাকল।

    কী হল ভাই? ম্যাডাম কেমন আছেন?

    অঞ্জু মাথা নাড়ল ডাইনে-বাঁয়ে। অন্য ছেলেটিও বের হয়ে এসেছে। সে অন্যদিকে যাবে এবার। ড্রাইভার অঞ্জুকে বলল, কোন দিকে যাবেন?

    খবর দিতে।

    ঠিকানা পেয়েছেন?

    হ্যাঁ।

    চলুন নিয়ে যাচ্ছি।

    বিশাল বহুতল বাড়ি। জানলায় জানলায় পর্দা ভেদ করে আলো এসে পড়ছে। নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে এসে অঞ্জু নিজের পোশাকের দিকে তাকাল। কালো প্যান্ট, তার ওপরে মেরুন টিশার্ট। জায়গায় জায়গায় শুকিয়ে খরখরে হয়ে উঠেছে রক্তের দাগ। বোঝা যাচ্ছে একটু লক্ষ করলেই। হাতগুলো? হাতগুলো কি কোনো সময়ে ধুয়েছিল? বেল টেপবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল। একটি যুবক। এক্ষুনি বোধহয় অফিস থেকে ফিরেছে। হাতের ব্যাগটা এখনও রাখেনি। পেছনে একটি প্রৌঢ় মুখ। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা।

    তোর মা ফিরল না কি রে রঞ্জন? অনেকক্ষণ গেছে।

    কাকে চান?

    এই কার্ড কার?

    দেখি। ও, আমার বাবার।

    শুনুন, এক্ষুনি এস. এস. কে. এম. এ এমাজেন্সিতে চলে আসুন। একটা দুর্ঘটনা হয়েছে। মায়ের। বোধহয় আপনার মায়ের।

    কে রে রঞ্জন? কী বলছে?

    কী? রঞ্জন নামের ছেলেটির মুখ পালটে যাচ্ছে। সে প্রায় রুদ্ধ গলায় চিৎকার করল, কৃষ্ণা, আমার ব্যাগটা ধরো।

    ভেতর থেকে একটি অল্পবয়সি মেয়ে বেরিয়ে এল।

    আমি পি. জি-তে যাচ্ছি। মায়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

    কী-ই-ই?

    —প্রৌঢ়ের গলায়, তরুণীর গলায় আর্ত জিজ্ঞাসা শুনতে পেল অঞ্জু। প্রৌঢ় ভদ্রলোক, ইনি ডক্টর শিশির বিশ্বাস, বেরিয়ে এলেন।

    আমি যাব।

    বাবা। যেতে দিন। অঞ্জু বলল।

    নীচে নেমে সেই ট্যাক্সিই ছুটল। ডক্টর বিশ্বাস বললেন, সিরিয়াস কিছু নয় তো? কত করে বললুম সেলোটেপের এক্ষুনি দরকার নেই। সকালে হলেও হবে। কৃষ্ণা আনতে পারে। পূর্ণিমাকে পাঠালেও হয়। সেই এক গোঁ! কী বাবা! সিরিয়াস কিছু নয় তো?

    শিশির বিশ্বাস ওদিকে। মাঝখানে রঞ্জন। এদিকে অঞ্জু। পূর্ণ দৃষ্টিতে রঞ্জন চেয়ে আছে তার দিকে। তার জামাকাপড় ভিজে। রক্তর গন্ধ উঠছে। সে চোখ নামিয়ে নিল।

    ওঁর নাম মাধবী। মাধবী বিশ্বাস। ব্যাগে চশমা ছিল এক জোড়া। বাই ফোক্যাল।

    কে আইডেনটিফাই করবেন? আপনি কে?

    আমি ওঁর হাজব্যান্ড।

    আর কেউ নেই?

    এই যে আমি, ছেলে।

    আসুন, আপনি আসুন।–ঘরটায় ঢুকতে ঢুকতে তরুণ ডাক্তার বললেন, মনকে শক্ত করুন। শি হ্যাজ এক্সপায়ার্ড। ন্যাস্টি উন্ডস। বিশ্রী অ্যাকসিডেন্ট একটা। আমি আমরা কিছু করতে পারিনি। ওই ছেলেটি, অনেক চেষ্টা করেছিল, পারেনি।

    হাসপাতাল দুলছে। পৃথিবী দুলছে। ভূমিকম্প হচ্ছে দূরে কোন আগ্নেয় বলয়ে। ডক্টর শিশির বিশ্বাসকে শক্ত দু-হাতে ধরে আছে অঞ্জু। টলতে টলতে রঞ্জন বেরিয়ে আসছে, বাবা, ইটস মাদার অল রাইট। শি ইজ নো মোর। নো মোর, নো মোর, চারদিকে একটা চাপা আর্তনাদ। তারপর স্তব্ধতা। বিনা নোটিশে যখন পৃথিবীর মানুষকে এভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তখন পৃথিবী বিবরে প্রবেশ করে চুপ করে যায়। একদম চুপ।

    শুনুন, জায়গাটা এ থানার অন্তর্গত হলেও সব রোড অ্যাকসিডেন্টস লালবাজার ডিল করে। আমি চেষ্টা করছি। কনট্যাক্ট করছি। কিন্তু আপনাদের ওখানেই যেতে হবে। ও. সি. বললেন।

    লালবাজার বলল, পোস্টমর্টেম হবেই। আটকাতে পারবেন না। আপনাদের এটাতে গোলমাল নেই। কিন্তু গোলমাল হয়, হরেই থাকে। কেসগুলো ওভাবে আলাদা করা যায় না। আমাদের রেকর্ড ঠিক রাখতেই হবে। একটা কাজ করতে পারি। পি. এম. যিনি করবেন সেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। কথা বলুন। চট করে কাজটা হয়ে যেতে পারে। আগলি সিন। ডোম বডি আগলে আছে। পার্টির স্ট্রেনথ বুঝে দরাদরি করছে……..এটা অ্যাভয়েড করতে পারেন, দেখুন।

    রাত বারোটা নাগাদ মোমিনপুর থেকে রঞ্জনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে অঞ্জু বলল, আমি আসছি একটু বাড়ি থেকে। ঠিক সময়ে আবার এসে যাব।

    রঞ্জনদের ফ্লাটের সামনেটা এখন লোকারণ্য। রঞ্জন আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদের হাতে প্রায় বাহিত হতে হতে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। এত আলো এখন চারদিকে। তখন সেখানে যথেষ্ট আলো ছিল না। এত লোক! সেই বিন্দুতে একটি মাত্র মানুষকে কে আসতে বলে রেখেছিল। নির্বাচিত একজন।

    এই যে ভাই!

    আপনি এখনও আছেন?

    কী করি। বলুন–ঘামে ভেজা জবজবে মুখটা মুছতে মুছতে জবাব দিল ট্যাক্সি ড্রাইভার ভদ্রলোক।

    আপনি তো বাড়ি যাবেন, চলুন পৌঁছে দিই। কোনদিকে?

    যাদবপুর। কিন্তু আপনি কি পাগল হলেন? সেই সন্ধে থেকে….. মিটার তো আপ করে রেখেছেন দেখছি। আমি কিন্তু গোটা বিশেকের বেশি দিতে পারব না।

    আরে ভাই, কী টাকা দেখাচ্ছেন? আমরা সেন্টিমেন্টাল জাত জানেন তো? যত গরিব তত সেন্টিমেন্টাল। পয়সা নেই….. তাই বলে…… যাক গে চলুন, পৌঁছে দিই। আমাকে একটু ব্যাক করে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে গ্যারাজ করতে হবে। এতক্ষণ সমানে আপনিও তো ঘুরলেন নিজের কাজ-কম্মো ফেলে।

    ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করতে করতে অঞ্জু বললো, আমি তো বেকার!

    হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল ড্রাইভার, বলল, ভাগ্যিস, আপনি বেকার ছিলেন, তাই একজন মা শেষ সময়ে ছেলের হাতের জল পেলেন। আপনার ওই ঢাউস ওয়াটার-বটল—এ কি গঙ্গাজলই নিয়ে যাচ্ছিলেন?

    গঙ্গাজল? ধুর। কলকাতার জল এখন খেলেই আন্ত্রিক। জানেন না? আমি সব সময়ে ফোঁটানো জল ক্যারি করি। অনেক জল খেতে হয় কি না!

    ওই হল! ওই-ই আধুনিক গঙ্গাজল ভাই। ভগবানের কী বিচিত্র লীলাই না দেখলুম।

    গলির মোড়ে নেমে যেতে যেতে অঞ্জু জোর করে দশটাকার দু-খানা নোট গুঁজে দিল ভদ্রলোকের হাতে।

    আপনি বেকার না?

    আপনারও তো লস হল অনেক।

    ওই ওঁদের থেকে বেশি কী? আচ্ছা আবার দেখা হয়ে যাবে। আমার নাম বিজন সরখেল। আপনি?

    অঞ্জন পোরেল।

    সাড়ে বারোটা বাজছে। জানলায় কাছে উৎকণ্ঠিত মুখ।

    কী ব্যাপার, অঞ্জু? এত রাত? আর বোলো না। মর্মান্তিক একটা রোড অ্যাকসিডেন্ট। আটকে পড়েছিলুম। জামা কাপড়গুলো জলে ভিজিয়ে আবার যাব।

    আবার যাবি? তোর কিছু হয়নি তো?–মঞ্জু চৌকাঠে।

    আমার? অঞ্জু ভাবল, তারপর বলল, যাওয়া দরকার। তুই যা হোক কিছু খাবার দে। আমি চান করে আসছি।

    রাত তিনটেয় মোমিনপুর থেকে গাড়ি বেরোল। সকার সমিতি, গুরুদ্বার কারও গাড়ি পাওয়া যায়নি। টেম্পোয়ও আজকাল অনুমতি দিচ্ছে না। একটা গাড়ি মর্গ থেকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। সকাল এগারোটার আগে কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। এগারোটা মানেই বারোটা, কিংবা একটা। বহু অল্পবয়সি ছেলে চারদিকে। এদের আত্মীয়স্বজন, এ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘড়ির দিকে চাইল অঞ্জু। পাঁচটা বাজছে। বলল, আসুন না, আমরাই নিয়ে যাই, এই তো! কতটুকু আর পথ! সে ডান পাশের সামনের খুররাতে হাত দিল।

    আজও মেঘভরতি আকাশ। চুইয়ে পড়ছে সকালের আলো। একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, মঙ্গলবার কাজ। কী যেন নাম তোমার? অঞ্জন? এসো বাবা। এসো কিন্তু।

    অঞ্জু বাড়ির পথ ধরল। গতকাল এ সময়েও মাধবী বিশ্বাস ছিলেন। হয়তো চা দিচ্ছিলেন তাঁর স্বামী শিশির বিশ্বাস, ছেলে রঞ্জন বিশ্বাসকে। ডাকাডাকি করে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন পুত্রবধু কৃষ্ণাকে। সামনের দিকের চুলগুলো পাকা। সিঁথিতে অল্প সিঁদুর। রোগা, লম্বা, বেশ টরটরে। যখন কুঁচিগুলো হাতে ধরে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বেশ স্মার্ট! রাস্তায় চলাফেরা আজকালকার গৃহিণীদের তো বেশ অভ্যাসই আছে। তাহলে কী হল? চোখ? চোখের নজর কম হয়ে এসেছিল না কি? তার ওপর বর্ষাসন্ধ্যার ঘোলাটে আলো। ম্যাটাডরটা জ্ঞানহারা হয়ে ছটছিল। রাস্তা দিয়ে যে মানুষকেও চলতে হয় সে হুশ নেই। যন্ত্র ক্রমাগত মানুষকে চাপা দিয়ে চলেছে। সংঘর্ষ! সংঘর্ষের একমাত্র সাক্ষী, সংঘর্ষের কালে একমাত্র আশ্রয়, একটি বলিষ্ঠ বেকার যুবক শরৎ বোস রোড ধরে সোজা চলে আসছে। কে তাকে টেনে আনছে? তার তো এ রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিল না। তাহলে কেন? একি মানুষীর জন্য মনুষ্য-শাবকের ভেতরের টান?

    অজস্র ভিড়। প্রচুর জুতো। সেদিনের সেই ঘরখানাকে চেনা যাচ্ছে না। শ্বেতপদ্ম, রজনিগন্ধা, উঁই। ট্রেতে করে সন্দেশ পরিবেশন করছে দুটি মেয়ে। অনেক পরিচিত, অনেক বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন। বেশিরভাগই পরস্পরের সঙ্গে গল্পে মত্ত। জড়ো হবার একটা উপলক্ষ্য পেলেই শব্দরা উথলে ওঠে। সেতু বাঁধতে চায়। মৃত্যু? মর্মান্তিক! শেষ! কিন্তু জীবন? আহো জীবন। আহা জীবন! আমি, আমরা, তুমি, তোমরা যে পর্যন্ত আছি, আছ। আছিস? আছেন? আর থাকা দাদা। হাইপারটেনশন। ব্লাড শুগার তিনশো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বসুমল্লিকদের বাড়ি দেখা হয়েছিল না? হ্যাঁ, নাতির অন্নপ্রাশনে। সেই আর এই? এ তো আসতেই হয়। থাকি কোথায়? সিঁথি, নতুন বাড়ি করলুম যে! সিঁথি থেকে সাদার্ন অ্যাভেনিউ। বুঝুন। আপনি কি এখনও আই.সি.আই-তেই? জামাইটি তো খুব ভালো হয়েছে। লস এঞ্জেলিস। আরে বাবা আজকাল ভালো ছেলে মানেই মার্কিন দেশ। ও লিলিদি! দেখতেই পাচ্ছ না যে! সেদিন তোমার লেকচার শুনলুম। ওই তো গুরুসদয়ে। এখন সাঁই ভজনে যাস না তো কই আর? এক একটা হুজুগ আসে যেন! তা হোক, মানুষ বড়ো অসহায় রে! বুঝিস তো। একটা ভরসা চাই! কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ … দেখলি তো? নিদানকালে কিছুই কাজে আসে না। পথে পড়ে বেঘোরে যাওয়া যদি কপালে থাকে তো তাই! আহা মাধবী বড়ো ফিটফাট ছিল রে! কথায় কথায় বলত হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে বরঞ্চ আমি বিনা চিকিৎসায় থাকব! উঃ! সাবধানও ছিল খুব! কী যে হয়ে গেল! এক বিঘত দূরে বাড়ি, স্বামী, ছেলে-বউ! ভাবা যায় না। শিশিরদার দিকে যেন তাকানো যাচ্ছে না। চুলগুলো ক-দিনে আরও সাদা… বিনোদ, হ্যাঁ আমি ডাকছি। ওদিকের জানলাটা বন্ধ করে দাও না একটু। পুরুতমশাই দেশলাই জ্বালাতে পারছেন না।

    অঞ্জ মুখ বাড়িয়ে দেখল মুণ্ডিত মস্তকে রঞ্জন আসনে বসে, হাতে কুশ, সামনে কোশাকুশি। পাশে সাদা লাল পাড় শাড়ি পরে সেদিনের সেই কৃষ্ণা বলে মেয়েটি। সে গোলাপ এনেছিল কতগুলো। মাধবী দেবীর ছবির তলায় নামিয়ে রাখল। ইনি? খুব সম্ভব কয়েক বছর আগেকার। তখনও সামনের চুলগুলো অতটা পাকেনি। ছবির চোখ তার দিকে সোজা তাকিয়ে হাসছে। শেষ সময়ে বড়ো তেষ্টা পায়, অঞ্জু তুই জল দিয়েছিলি। ধুলোয় পড়েছিলুম। তুই কোল দিয়েছিলি। বলুন…… বলুন পিতৃকুলের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ। আর এই পিণ্ডটি সবার জন্য। যাঁরা জল পাননি, তাপিত, পিপাসার্ত, অথবা যাঁরা পেয়েছেন, আরও পেলে আরও তৃপ্তি। গতাসবঃ। তাঁদের কথা মনে করে, হ্যাঁ…।

    অঞ্জু আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। শ্রাদ্ধবাসর থেকে সবার অলক্ষ্যে সে পথে নেমে এসেছে। একটা মন্ত্রের ঘোর, একটা দৃষ্টির সম্মোহন তাকে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাচ্ছে। আদিগঙ্গা।

    মাতৃশ্রাদ্ধ করবেন? অপঘাত? তা মস্তক মুণ্ডন করেননি কেন? অশৌচান্ত কোন পুরুতে করাল? আমি পারব না মশায়। ওই দিকে দেখুন গেঁজেল ঠাকুর রয়েছে। ওই যে থামে ঠেস দিয়ে! ওর কাছে যান। ও রাজি হয়ে যাবে। যত তো অশাস্ত্রীয় কাণ্ড…।

    কয়েকবার ডাকবার পর গেঁজেল ঠাকুর লাল চোখ মেলে বলল, বেশ বাবা, বেশ বেশ। মাতৃশ্রাদ্ধ করবে, কিছু নেই? আরে বাবা স্বয়ং পৃথিবী মাতা এত থাকতেও নিঃস্ব। কিছু নেই তাতে লজ্জা কী? প্রকৃত বস্তু হচ্ছে অন্ন, জল আর শ্রদ্ধা। আর সব ভেবে নিলেই হবে। সবই বাহ্য। অন্ন আর জলের সূক্ষ্ম অংশ আত্মা নেন। তা বাপু, ক-টি টাকা দাও, অন্নজলটুকুর জোগাড় করি।

    চান করে এসো।

    করেছি।

    নব বস্ত্র পরো।

    পরেছি।

    তা একরকম ঠিকই বলেছ বাবা। একই বস্ত্র দেখার গুণে প্রতিদিন নতুন হয়ে ওঠে বই কি! সময়কে যদি পল-অনুপলের মালিক বলে দেখ, বস্তুকে যদি প্রতি নিমেষে লয় পেতে আবার জন্মাতে দেখ, তো নূতনে পুরাতনে কোনো ভেদ নাই। গঙ্গোদক একটু মাথায় দিয়ে বসো তবে। … নাম বলো মায়ের! মাধবী দেবী? বাঃ! গোত্র? মনু? এরকম কোনো গোত্রনাম তো শুনি নাই বৎস! পিতৃপুরুষের নাম বলো। পিতামহ?

    মানব।

    পদবি নাই? নিরুপাধিক? বেশ বেশ। তা, তৎপূর্বে? প্রপিতামহ?

    মানব।

    তৎপূর্বে?

    ইনিও মানব? বা বা বা।

    মাতৃকূলের নামগুলি জানা আছে বৎস? মাতামহ?

    মানব।

    নিরুপাধিক? প্রমাতামহ?

    মানব।

    তৎপূর্বে? বৃদ্ধ প্রমাতামহ? ইনিও মানবই হবেন নিশ্চয়! চমৎকার। তবে বলো বৎস—বিষ্ণুর ওম মনুগোত্রস্য প্রেতস্য মন্মাতুর মাধবীদেব্যা…..পিতামহস্য মানবদেবস্যে… মাতামহস্য মনুগোত্রস্য মানবদেবস্য অক্ষয়স্বৰ্গকামঃ এতদ অন্নজলং শ্রীবিষ্ণুদৈবত যথাসম্ভব গোত্ৰনাম্নে ব্রাহ্মণায় অহং দদানি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }