Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প671 Mins Read0

    নাগিনা

    সনাতনের বউটার চটক আছে। কথাটা সবাই বলছে। টিভি-তে ফিলিমের মেয়েছেলে দেখে-দেখে শালার চোখ আজকাল এমনি বিগড়ে বসে আছে যে কাউকে আর সহজে চোখে ধরতে চায় না। যদি বা চোখ-কান বুজে হাজার দশ বারো ঝেপে একটার সঙ্গে ঝুলে পড়া যায় ক-দিনের পরই নেশা ফুট। তারপরে আছে আবার কাঁথাকানি, গু-মুত, চ্যাঁ-ভ্যাঁ। শুকনো মুখ, ঝোলা বুক, ফোলা পেট। দুশ শালা। মঙ্গা, নটে, যতীন সব একধার থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। ঘরের মেয়েছেলে। মঙ্গা আজকাল যাচ্ছে বাঁধাঘাটের সোহাগির কাছে আর নটে পটেছে বিকাশ এন্টারপ্রাইজের বিড়ালচোখো সেলস-ছুকরিটার সঙ্গে। নটের। চেহারাটা আসলে এমন সাহেবমার্কা যে নটে বললে যেন ঠিক মানায় না। নটরাজ সিং বললে তবে খাপে বসে। তার গোরা মলাট, মাখুনে কথাবার্তা শুনে কেউ বলবে না সে একটা দাগি তোলাবাজ। সেলস-ছুকরি জানে মি. সিং ব্যাবসা করেন। কী ব্যাবসা? না সাপ্লাই। এখন, তা কীসের সাপ্লাই, ছোরাছুরি না ছোঁড়াছুঁড়ি সে খবরটা মহববতের এই পয়লা ইস্টেজে কি কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে? সবচেয়ে শেয়ানা কিন্তু যতীন। সে চার ফেলে বসে আছে। দাঁও পেলেই গাঁথবে। নটেকে সে বলে থাকে, গোরা রং নিয়ে কি ধুয়ে খাব? ধুস! মাল চাই। বহোৎ মাল। রাধুদিদি রাধুদিদি করে সে এখন এক রাঁধুনিমাগির পেছনে পড়ে আছে। রাধুদিদির একটা ভালোমানুষ মেয়ে আছে। সাত চড়ে রা নেই। দু-বার ক্লাস এইট ফেল করে এখন ঘরে সেলাইপাতি শিখছে। করে-কষ্মে খেতে হবে তো! একটা না একটা কিছু আজকাল সব গোত্তরের মেয়েছেলেদেরই দরকার হচ্ছে। তা এই রাধুদিদি লোকের বাড়ি রান্না করে বলে নেহাত হেঁজিপেঁজি নয়, বর রেলের চাকুরে ছিল। ইনশিয়ারের টাকা, পেনশন, পি. এফ—এ সব মিলিয়ে রাধু বেশ মালদার। তার সাধ কালো মেয়ে এই বেলা চকোসা হয়েছে, তার একটা ভালো বিয়ে দেয়। যতীন বলেছে, তোমার ছায়ার পাত্তর দেখার ভার আমার রাধুদিদি। ইতিমধ্যে নিজের ঘরের বউটাকে সে দুটো বাচ্চাসুদ্ধ স্রেফ গুম খুনের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে। সে যে নিজেই আদর্শ পাত্তর তা যতীন মুখে বলে নয়, কাজে প্রমাণ করতে চায়।

    এরই মধ্যে সনাতন ফট করে বিয়ে বসে গেল। কত ঝেড়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুতেই ভাঙছে না। জিজ্ঞেস করলেই বলছে, এই বউয়ের গায়ে হাতে যা দেখচিস– তা তোর বউয়ের গা হাত কি তুই দেখতে দিবি হারামখোর?

    দ্যাখ দেখে নে। আমার বউ তো আর মোচলমানের ঘরের বোরখাপরা বিবি নয়। মর্ডান মেয়ে। দ্যাখ।

    ফট করে বউয়ের শলমাচুমকির ঘোমটাখানা হাট করে দিল সনাতন।

    ফিক করে হাসল মেয়েটি। তারপরেই গম্ভীর হয়ে উঠে চলে গেল। মুখ ফিরিয়ে বলে গেল, চা আনছি।

    তখনই সবাই দেখল—বাপ চটক বটে।

    ভদ্দরলোকের বাড়ির মেয়ে ফুসলিয়েছিস না কী বল তো!

    সনাতন বললে, কেন? আমরা কি ভদ্দললোক নই?

    সে কথা যদি বলিস তো সে আলাদা কথা। পেলি কোথায়?

    সম্বন্ধ করেছে আমার মেসো। তেলকলের পোদ্দারবাবুকে চিনিস তো? সে-ই। বাপ মা মরা। পিসির গলায় ছিল। ঝোপ বুঝে মেসো কোপ মেরেছে।

    কী রকম?

    পোদ্দার মেসোর কাছে টাকা ধার পিসিটা। মেসো বললে, টাকা যখন খুশি দিয়ো। কিন্তু আমার শ্যালীপোর জন্যে দিতে হবে তোমার ভাঞ্জিটাকে।

    কেন? তার জন্যে অত দরদ কীসের?

    কী যে বলিস? শ্যালীপপার জন্যে মেসোর দরদ থাকবে না তো কি তোর জন্যে আমার থাকবে? …

    এই সময়ে বউ চা নিয়ে এল। একটা কেটলি আর গোটা কতক মাটির ভাঁড়।

    সবাইকে ঢেলে ঢেলে দাও। সোয়ামির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

    ক্যা নাম গো ভাবি? —নটে একটু হিন্দির মিকসি দিয়ে শুধোয়।

    নাগিনা।

    ক্যা?

    চার-পাঁচ যতজন ঘরে ছিল সববার যেন একসঙ্গে ইলেকট্রিকের শক লেগেছে। থিনঅ্যারারুটের বিস্কুট সুদ্ধ একটা স্টিলের থালা সনাতনের হাতে চালান করে চলে গেল বউ।

    সত্যি রে সনা?

    কী সত্যি?

    ওই নাম?

    সনাতন হাসতে থাকে, মিছে কথা বলতে যাবে কেন খামোখা? মলিনা, সেলিনা এত নাম হচ্ছে আর নাগিনা নাম হতে পারে না?

    এখন, দলে এক নম্বরের হিরো যদি হয় নটরাজ, তো দু নম্বর হল সনাতন। নটের মতো কটা রং, ঝাড়া ছ-ফুট না হতে পারে, কিন্তু সনার কাঠামোটাও কিছু ফ্যালনা নয়। তা ছাড়া রঙে নটে পয়লা হতে পারে, কিন্তু চুলে গুরু সনা। সনার মাথায় একেবারে আসল গুরু ফিট করে বসানো। এ বুড়ো বয়সের কে. বি. সি-র গুরু নয়, এক্কেবারে বয়সকালের রংদার শাবি। যেন পুরনো মডেলের ফোর্ড গাড়ির বনেট! ইয়া গুল, ইয়া ছাতি। বলবান পুরুষ যাকে বলে।

    এ হেন সনাতনের ঘরে সুখ-সোয়াস্তি ছিল না। মা-বুড়ির কবেই কোমর ভেঙেছে। দিনরাত কোঁকায় আর সনাতনের মরা বাপকে গাল দেয়। ইঁদুরে মাটি তুলে তুলে ঘরদোর নৈরেকার করেছে। রান্নাঘরে দুটি সানকি, একটি জনতা, একটি কড়া আর একরাশ কালিঝুলি। ডিজেল-মিশেল কেরাচিনির ঝাঁঝে ভূত পালিয়ে যায়। কিন্তু ইঁদুর, আরশুলো, টিকটিকি, মাছি, মশার কামাই নেই। একখানাই ঘর, দরমার বেড়া দিয়ে দুভাগ করা। একদিকে মা আরেক দিকে বউ নিয়ে ছেলে। বউ সনাতনের মুখ চাপা দেয়, আস্তে, আস্তে আস্তে।

    নিকুচি করেছে তোর আস্তের।

    তাহলে আমি পিসির কাছে চলে যাব। কালই। দিব্যি!

    ব্যস, জোঁকের মুখে নুন পড়ে। এখন নতুন শাদি। নতুন রংচং। তার ওপরে চটুকে বউ। বয়স ষোলো কি সতেরো। এখন সনাতন একটু বিচ্ছেদসম্ভাবনাকাতর তো হবেই।

    অ বউ? কী কচ্ছিস?

    গর্তে অ্যাসিড দিচ্ছি মা!

    দিয়ে?

    দিয়ে ইট পাথর খোলামকুচি দিয়ে ভরাট করব।

    কদ্দিন দিবি?

    যদ্দিন না গেরস্তর ঘর থেকে ইঁদুর যায়।

    অ বউ কী ঘষছিস?

    গেরস্তর কড়া কেটলি ছানতা-জালতি জনতা খন্তা খন্তি!

    ঘষে?

    রুপোর মতো চকচকে যদি না করি তো আমার নাম নেই।

    কদ্দিন রাখবি?

    যদ্দিন গতর থাকে মা আর যদ্দিন আমার মানুষের…

    মানুষের কী?

    কিছু না।

    অ বউ, কে এল?

    নিবারণদা।

    কে নিবারণ? নিবা ঘরামি?

    হ্যাঁ গো মা।

    কী করবে?

    বারান্ডা ছাইবে।

    পয়সা দেবে কেডা?

    যার ঘর সে দেবে! তোমার ছেলে, আবার কে?

    সনাতন সেদিন কাজ সেরে ফিরে দেখে ছাওয়া বারান্দায় নতুন পলতে পরানো পরিষ্কার জনতার নীল শিখায় চকচকে তাওয়া চাপিয়ে চেপে চেপে রুটি করছে। বউ। একদিকে উঁচু মাটির বেদিতে পুরোনো সানকি কড়া-কেটলি যেন বা নতুনই। ক-টি বোয়া মাটির ভাঁড় পাশে উপুড় করা।

    এ কী?

    বাচ্চা মেয়ের মতো একগাল হেসে বউ বলল, রান্নাঘর গো, এবার থেকে এখানেই রান্না করব। ভালো হয়নি?

    মুখ আঁধার করে তাকিয়ে তাকে সনাতন।

    নিবারণদাকে দিয়ে ছাইয়ে নিলুম। সবসুদ্ধ পঞ্চাশটা টাকা তুমি ওকে দিয়ে দিয়ো। এসো চা খাবে এসো।

    সনাতনের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা রাখে না বউ, ভূতপূর্ব রান্নাশালে ঢুকে যায়। এইবার সনাতনের চমৎকৃত হওয়ার পালা।

    বাড়ির একটিমাত্র তক্তপোশে গুছিয়ে বিছানা করা। মা সেখানে বসে হাসছে। ছোট্ট জানলা দিয়ে ছোট্ট একটা হাওয়া ঢুকল। ঘরেতে মশার ধূপের কড়া গন্ধ।

    বউ বললে, রুটির সঙ্গে গুড় খাবে তো?

    ভেলি?

    না এখো।

    আড়ে আড়ে চায় সনা, বউয়ের মুখে রহস্য হাসি।

    অর্থাৎ কিনা, মায়ের এখন আলাদা ঘর হল অর্থাৎ কিনা বড়ো ঘরটি এখন নিভাঁজ নিষ্কন্টক ফুলশয্যে ঘর।

    তাই বলে আমাকে না বলে-কয়ে তুই এত বড়ো কাণ্ডটা করবি? দ্যাখো,—বউ চোখ তুলে সোজা তাকায়, তুমিও যেমন কত্তা, আমিও তেমন গিন্নি। বারের ব্যবস্থা তোমার, ঘরের ব্যবস্থা আমার। তোমাকে বললে তুমি বাগড়া দিতে না? এতদিন ধরে ঘরদোরের এমন ছিরি তবে কেন করে রেখেছিলে?

    খুব গিন্নি হইচিস-কচি চিবুকখানা এবার সোহাগ করে নেড়ে দেয় সনাতন।

    এইভাবেই আস্তে আস্তে সনাতনের রান্নাঘরে বাসন হল, মায়ের ঘরে ঠাকুর বসল, নিজের ঘরে তক্তপোশ এল, তক্তপোশে নতুন বিছানা-বালিশ, ঘরে তাক, তাকে পুতুল। ঘরের বাইরে পাপোশ, ভেতরে মাদুর, বারান্দায় মোড়া, কোণে ঝাড়, চা খাবার কাপ, জল খাবার গেলাস। সন্ধের শাঁখ, ধূপ। আর সনাতনের বেতো মা আস্তে আস্তে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। কবে যে সে দাঁড়িয়েছে, কবে যে পাড়া বেড়াতে শুরু করেছে, কবে যৌবনকালের তরিবতের মাংসের কালিয়া রাঁধতে লেগেছে সনাতন সেটা খেয়ালই করেনি। খেয়াল করল যেদিন সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে মাকে দেখতে পেল না।

    মা কই রে?

    সিনেমা গেছে।

    বলিস কী? বেতো হাঁটু মচকে যদি মাঝরাস্তায় পড়ে যায়?

    পড়বে কেন? মায়ের আর পায়ের ব্যথা নেই তো!

    নেই!

    কেন, দেখতে পাও না?

    তা কী করে গেল?

    মল্লিক ডাক্তারকে দেখলুম। ওষুধ দিলে, মালিশ চলছে।

    গেল কার সঙ্গে?

    দল বেঁধে গেল সব। চার-পাঁচ জনা। ভালো বই এসেছে।

    তা তুই গেলি না?

    আমি? তোমায় ফেলে?–বউ সনার গলা জড়িয়ে ধরে, বলে, যাব, তুমি আমি। কিন্তু সিনেমা না।

    তবে?

    বেড়াতে যাব। ইলেকট্রিক ট্রেনে চড়ে, ভোঁ-করে, অনেক দূর। নিয়ে যাবে?

    বেশ। যাস এখন।

    বলে বটে, কিন্তু যাওয়াটা আর হয়ে ওঠে না। ঘরে ফিরলেই কোথা থেকে রাজ্যির আলস্য এসে সনাতনের হাত-পা মনের দখল নেয়। ইদানীং আবার তার মা সুদ্ধ ঝালর দেওয়া হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। এত আরাম! এত আরামও ঘরে থাকতে পারে?

    প্রায় দিনই সনাতন দেখে এ পাড়ার ও পাড়ার বউঝিরা তার বারান্দায় আসর জমিয়েছে। কাপে করে চা খাচ্ছে, উল বুনছে, আর গপ্পো করছে। সে ঢুকলেই আসর ভেঙে যায়। আজ চলি ভাই, চলিরে বলতে বলতে সব গা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে পড়ে। বোঝা যায় আসরটা চলছিল অনেকক্ষণ কেউ কেউ চেনা পড়োশিনি, কী মিস্তিরি, আছ কেমন? বলে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে ভদ্রতা করে যায়। কেউ আবার হাতের থলি গুটিয়ে একেবারে বার রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়।

    এত আড্ডা কীসের?—সে গম্ভীর মুখে বলে একদিন।

    বউ প্রথমটা জবাব দেয় না।

    কী রে?—আবার হাঁকে সনাতন।

    কেন? আড্ডা দিলে কী হয়?

    যদি কিছু নাই হবে তবে পালায় কেন? যেন পালে বাঘ পড়েছে!

    মুচকি হাসল মেয়ে, বলল, আচ্ছা, এবার বলে দেব, ঘরের মানুষ এলে পালিয়ো না গো।

    মুড়ির সঙ্গে থাবা-থাবা ঘুগনি খেতে খেতে সনাতন বলে, আচ্ছা হল গিয়ে মেয়েমানুষের কাল, শনির দশা যাকে বলে। বুঝলি? আজ ভাত সেদ্ধ হয়নি। কাল তরকারিতে লবণ দিতে ভুলেছি। পরশু পাশের ঘরের বচসায় তাল ঠুকতে যাচ্ছি।

    সনাতনের গলায় মুড়ি আটকে যায়। বউ হাসছে, গমকে গমকে হাসছে।

    কী হল? এত হাসি কীসের?—সে ধমকিয়ে ওঠে।

    জল খাও এক ঢোঁক–জল এগিয়ে দেয় বউ। তারপর হাসি গিলে নিয়ে সিঁদুররাঙা মুখ করে বলে, তুমি এমন করে বলো! হুলোতেও হাসবে।

    কথাটা হাসির হল?

    হাসির ছাড়া কী? একেক দিন দুপুরে দু-চারজন বন্ধুসাথি আসে, তো তার সঙ্গে ভাত ধরা, তরকারি সেদ্ধর সম্পর্ক কী! আগে অসিদ্ধ, আলুনো পাও তারপরে বোলো।

    তুই জানিস না—সনাতন এখন অনেক নরম হয়ে এসেছে—মেয়েমানুষ জাত বড্ড জাঁহাবেজে, মতলববাজ! ওই যে চৌরাস্তার শঙ্করীটা! ও তো তোর মাথায় ভূত ঢুকিয়ে দিল বলে!

    জাত তুলছ কেন মিস্তিরি! আমি যদি ব্যাটাছেলে জাত বলে খোঁটা দিই তোমার কেমন লাগবে? সব মানুষে কি আর সমান হয়? ওই যে তোমার বন্ধু যতীন, মঙ্গা, নটে…ওরা আর তুমি কি এক? শঙ্করীই বা তোমার কোন পাকা ধানে মই দিল!

    বাপ রে! কাঁড়ি কথা শুনিয়ে দিলি যে?–সনাতন হাসে। তার বন্ধুদলের থেকে সে আলাদা—এই নতুন সন্দেশটি তার বেশ লেগেছে। যেন আবার খাব সন্দেশ। সত্যি কথা বলতে কী যতই সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হোক, সনাতনের ভেতরে একটা কমপ্লেক্স কাজ করে। নটে ফিলিমস্টার, মেয়েমাত্রই তাকে দেখলে লটকে পড়ে, মঙ্গার পুলিশফুলিশের সঙ্গে এক গেলাসের ইয়ার্কি, যাকে বলে ইনফুলেন্স। যতেটার বডিতে যেমন, বাতচিতেও তেমন সর্ষের তেল মাখানো, যে কোনো বিপদ থেকে স্রেফ বাতেল্লা দিয়ে কেটে বেরিয়ে যাবে। কার্যসিদ্ধির জন্যে স্বয়ং বস নটে যতের বুদ্ধি নেয়। মঙ্গার হোল্ডের ওপর ভরসা করে। কিন্তু সে সনাতন কে? কী? একটা সাধারণ কলের মিস্তিরি যার একখানা প্রকাণ্ড থোবড়া আছে। বাস! প্লামিং কাজ সে খুব ভালোই জানে। কিন্তু কমপিটিশন এসে যাচ্ছে। ফটিককে সে নিজের হাতে কাজ শেখাল এখন সেই ফটিকেরই পাখা গজিয়েছে। অধর দাস হেড মিস্তিরিটা তো আস্ত ঘুঘু। পানি-ট্যাংকির কাছে সকালবেলা তারা জড়ো হয়। অধর দাস হেড। ওইখান থেকেই সব যে-যার ডিউটি নিয়ে সারা দিনের মতো বেরিয়ে যায়। তার শাঁসালো কাজগুলোয় অধর ঠিক ব্যাগড়া দেবে। সিঙ্গিদের ফুরুলে (ফেরুল) টি লাগিয়ে দু ফাঁক করেছিস তুই? হাঁরে সনা!

    হ্যাঁ। কেন?

    জানিস বড়ো সিঙ্গিদের কলে জল আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ফুরুলে হাত দেবার তুই কে? তোর কর্পোরেশনের লাইসেন্স আছে?

    এখন লাইসেন্স সত্যিই নেই। কিন্তু বড়ো সিঙ্গিদের কলে জল না আসার নালিশটা ডাহা মিথ্যে। ছোটো সিঙ্গিরা ডেকেছিল সনাতনকে। তাদের কলের জল তাদের বড়ো শরিক পুরো ধরে নিচ্ছে, কল নীচু করে এস্টপ-কক দিয়ে। সনাতন বুদ্ধি দিল একেবারে ফুরুল থেকে দুজনের লাইন আলাদা করে নেওয়া যাক। তাই করতে ছোটো সিঙ্গিদের যত জল আসছে বড়ো সিঙ্গিদেরও ততই আসছে। প্রেশার কম। তাই দুজনেই কম-কম পাচ্ছে। কিন্তু পাচ্ছে ঠিক।

    অন্যদের ব্যাপারে, এমনকী সেদিনের ছোঁড়া ফটিকের ব্যাপারেও যেটুকু বা প্রোটেকশন দেবার, দিয়ে থাকে অধর দাস, যার না কি কর্পোরেশনের লাইসেন্স আছে। খালি সনাতনের বেলাতেই খিস্তি, খচরামো। বললে, আইন মেনে কাজ না করলে নিজের পোঙা নিজে ঢাকিস্। আমি পারব না।

    এই অবস্থায় বউয়ের অ্যাসেসমেন্ট সনাতনের লাগে মন্দ না। মুখে অবশ্য জানতে দেয় না, বলে, এ শালি, খবদ্দার। বন্ধু তুলে কথা বলবি না। জানিস কত বড়ো বড়ো এস্টার একেক জন!

    এস্টারই বটে–বউয়ের ঠোঁট তাচ্ছিল্যে বেঁকে যায়। তোমার ওই যতীন। নিজেকে ভেবেছে খুব চালাক, মিউ মিউ করে রাধুপিসির পেছনে পেছনে ঘুরছে। রাধুপিসি যেন আর জানে না কী মার মেরে যতীন নিজের বউটাকে তাড়িয়েছে। আর ওই মঙ্গল? ও তো দারোগার চাকর। বাড়ি গিয়ে পা-ধোয়া জল খেয়ে আসে, মুখেই যত হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা।

    তা হলেও হতে পারে, কিন্তু নটে?

    বউ এবার মুখ ঘুরিয়ে বলে, ছিঃ!

    কীসের ছি, কেন ছি এসব বিশ্লেষণে সে যায় না।

    তা আমিই বা কীসে এদের চেয়ে সরেস হলুম রে।

    তুমি তো তবু সৎভাবে উপায় করছ, ঘর বসিয়েছ, বুড়ো মাকে দেখছ…

    আর যদি সত্তাবে উপায় না করি! যদি বাইরের দিকে নজর দিই, যদি মা বউকে না দেখি?

    তবে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাবে বউ আর কথা বাড়ায় না।

    ইয়ার দোস্তরা খারাপ। সে ভালো। এ একটা আমাদের ব্যাপার বটে। সনা এ আমোদ বেশিদিন চেপে রাখতে পারলে না, একদিন বাংলুর মুখে বলেই ফেললে।

    আমার বউ না তোদের দেখতে পারে না মাইরি।

    কারুর বউই সোয়ামির দোস্তদের দেখতে পারে না রে সনা। হিসকুটির ঝাড় সব।—যতে বলল।

    কিন্তু সনাতন চলে গেলে বোঝা যায় কথাটায় তিনজনেরই আঁতে লেগেছে। কিছুর মধ্যে কিছু না, যখন-তখন তারা সনাতনের বাড়ি চড়াও হতে থাকে।

    ক্যা ভাবি, একটু চা খাওয়াও, মিঠে হাতের কড়া চা! কী বল সনা?

    বা, বা, ফুলকাটা চিনে মাটির কাপ, আজকাল এতেই চা খাচ্ছিস তবে?

    আরে এ মোড়াগুলো তো আগে দেখিনি!

    এ মাদুরটাও দেখচি নতুন! তা এত নয়া নয়া চিজ কোথা থেকে আসছে রে ইয়ার?

    সনাতন তাচ্ছিল্যে ঘাড় নাড়ে, ও সব ঘরের ব্যবস্থা আমি বিলকুল বউয়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। ও যা ভালো বুঝবে করবে। কোথা থেকে কিনেছে, কবে কিনেছে এসব আমি থোড়ি শুধোই।

    বন্ধুরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ মটকে হাসে। বাস, আর কিছু না।

    সেই শীতে সনাতন বউয়ের কাছ থেকে একটি জম্পেশ উপহার পায়। খয়েরি রঙের কার্ডিগান। ফাসক্লাস জিনিস। দুদিকে পকেট, বাহারি বোতাম। পরে ঠেকে যেতে হইচই পড়ে যায়। ঠেকসুদ্ধ চালাচামুন্ডা গুরু গুরু করে ওঠে। কে এসে পকেটে হাত দিচ্ছে, কে বোতামে চুমু খাচ্ছে, কে আবার জোড়া জোড়া সাপ প্যাটার্নে হাত বুলুচ্ছে।

    সনা পকেটে কী রাখবে বল তো—নটে জিজ্ঞেস করে যতেকে।

    যতীন বলে, লুলিপপ।

    মঙ্গা বলে, বলিস কী? সনা আজকাল লুলিপপ খাওয়া ধরেছে?

    নিশ্চই—যতীন বলে-বউ রোজগার করছে সনা লুলিপপ খাবে না তো কি তুই খাবি? এবার বকলস দেওয়া পেন্টুল পরবে, মাথায় টুপি পরবে। বউই পরিয়ে দেবে।

    ঠেকসুদ্ধ লোক হেসে ওঠে।

    সনাতনের ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে যায়। সে সামনের বেঞ্চি ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। আদাছোলার চাট শালপাতাসুদু পড়ে যায়। সে কলার ধরে যতের।

    যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! থোবড়া তোর এক চড়ে ভেঙে দেব।

    নটে এসে ছাড়িয়ে দেয়, আরে ছাড় ছাড়, নিজেদের মধ্যে এসব কী রে সনা?

    গুরু তুমিই বিচার করো, এসব টুপি-ফুপি কী বলছে যতে, তার ওপর বউ তুলে কথা!

    নটে বলে, ছাড়। যেতে দে। মুখ ফসকে কথা একটা বলে ফেলেছে।

    তখনকার মতো শান্তি বিরাজ করে।

    কিন্তু মাঝে মাঝেই কখনও মঙ্গা কখনও যতে উলটোপালটা উটকো মন্তব্য করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে, কখনও সনাতন ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে। কখনও আস্তিন গুটোচ্ছে, অমনি থেমে যাচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে কথাগুলো। যতে-মঙ্গার সঙ্গে সুতরাং একটা হিচ হয়ে যাচ্ছে সনাতনের। কিন্তু নটরাজের কথা হল আলাদা। সে হল ভদ্দরলোক। তার সঙ্গে মাখামাখি দিন-কে-দিন বাড়তেই থাকে সনাতনের। লোকে বলে, সনাতনের সঙ্গে নটরাজের পটবে না তো কি তোর সঙ্গে আমার? নটে যদি তেণ্ডুলকর হয় তো সনা হল বিনোদ কাম্বলি। নটে যদি উত্তমকুমার হয় তো সনা হল সুচিত্রা সেন। নাম্বার ওয়ান নাম্বার টু বলে কথা!

    দুজনের এক নিভৃত মজলিশে নটে বলে, একটা কথা তোকে বলি সনা, মেয়েছেলেকে কখনও বিশ্বাস করবি না। অবিশ্বাস করতে তোকে বলছি না। কিন্তু চোখ কান একটু খোলা রাখতে হয়। বউ রোজগার করছে কথাটা ন্যাড়া করে বলতে সেদিন তোর গায়ে খুব লাগল, লাগবার কথা, কিন্তু সত্যিই তো কী করে তোর বউ ঘরের ছিরি অমন ফেরাল, তোর ঘরদোর তো আগেও দেখেছি।

    ও কথা বলিস নে নটে, ও তো উল বোনে। এখন উলের বোনা ফি গোলা কুড়ি টাকা মজুরি। একটা দশ-গোলার সোয়েটার বুনলে অমনি দুশো টাকা। বাড়ি বসে রোজগার, ভালো নয়? দুপুরবেলা আরও পাঁচটা মেয়ে আসে, হাতে থলিতে উলের গোলা! কথা বলতে বলতে শটাশট হাত চলে।

    চুপচাপ কথাগুলো শুনে গেল নটরাজ। শেষে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে বলল, ভালো, খুব ভালো, অর্ডারগুলো ঠিকঠাক ধরতে পারলেই ভালো।

    কথাগুলো বাড়ি এসে বউকে শোনাল সনাতন। শুনে সে গম্ভীরভাবে বলল, তোমাকে কে আমার হয়ে সাউখুড়ি করতে বলেছিল? কত রোজগার করি, কেমন করে রোজগার করি, এ সব ঘরের কথা পাঁচজনকে বলতে যাবার কী দরকার? তোমাকে বউয়ের রোজগারের খোঁটা দিচ্ছে, ওদের বউদের কী করতে হয়? বাচ্চা কাচ্চা সুষ্ঠু বউগুলোকে তো ঘরের বার করে দিয়েছে। যতীনের বউ সুন্দরীদিদি কোলে ছেলে নিয়ে লোকের বাড়ি-বাড়ি বাসন মেজে বেড়াচ্ছে। মঙ্গলের বউ লক্ষ্মীদিদির তিনটি ছেলেমেয়ে, খাওয়াতে না পেরে শেষে লাইনে দাঁড়াচ্ছে সে খবর রাখো? আর ওই নটা? ও যে কতগুলো মেয়ের সববনাশ করেছে। একটা গলায় দড়ি দিয়েছে। দুটো কোথায় চালান হয়ে গেছে কেউ হদিস করতে পারছে না।

    এতগুলো কথা স্বল্পভাষী সনাতনের বউ কোনোদিন বলেনি।

    সনাতন প্রথমটা চুপ। কথাগুলো সত্যি। সনাতনের মর‍্যালিটি অবশ্য খুব পোক্ত নয়। যতীন বা মঙ্গলের বউদের সঙ্গে বনেনি তত ছেড়ে দিয়েছে, এর মধ্যে কোনো ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তুললে চলবে কেন? ছেলে কোলে নিয়ে সুন্দরীকে যদি পেট চালাবার জন্যে বাসন মাজতে হয় তো মাজবে! ছেলে বড়ো করার ভার মায়েরাই নেয়, ওসব ঝামেলি বাপেদের পোষায় না সবাই জানে, যতীনের এত পয়সা নেই যে সে এখন বউকে খোরপোশ দিতে বসে। তেমন বুঝলে সুন্দরী বাচ্চাগুলোকে বাপের কাছ পাঠিয়ে দিক। যতীন তাদের দেখভাল করবে কিনা, তারা বাঁচবে না মরবে অত কথা ভাবার দরকার তো সুন্দরীর নেই! গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব-এ হয়? কাজেই সে তার বউকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়, যা যা চুপ কর, চুপ কর। এত খবর তোকে কে দিয়ে গেল? গলায় দড়ি, হুঃ।

    হঠাৎ একদিন নটে ভিন্ন মূর্তি ধরে। সে সনাতনের বউয়ের খুব অ্যাডমায়ারার হয়ে পড়ে। দূর থেকে অবশ্য।

    তোর অনেক ভাগ্য অমন লক্ষ্মী পেয়েছিস রে সনা। রূপসি তোর বউ একশোবার। কিন্তু গুণ তার দুশো।

    ইয়ার্কি মারছ বস?

    ইয়ার্কি কী রে? ফ্যাকট! মাইন্ড করিসনি সনা, তুই তোর বউয়ের নখের যুগ্যি নয় তাই অমন রূপগুণের কদর করতে পারিস না। এই তো সেদিন নিবারণ বলছিল…তা দ্যাখ। কদিন ঘরে রাখতে পারিস।

    নিবারণ আবার কী বলল?

    তেমন আর কী! প্রায়ই যায় কিনা। বলে লক্ষ্মীর পিতিমে, দেখলে চোখ জুড়োয়।

    জুড়োচ্ছি চোখ—সনাতন বিরক্ত হয়ে বলল, আর দ্যাখ নটে, গুরু আছিস গুরু থাক। তোকে আর আগ বাড়িয়ে আমার বউয়ের গুণ গাইতে হবে না। সব করেছে। ভারি দুশো-তিনশো রোজগার করছে অমনি সব তার করা হয়ে গেল। সনাতন আর রুজি রোজগার করে না, সনাতন আর কত ধানে কত চাল জানে না।

    নটে বলল, আমি একা নই রে শালা। সবই তোর বউয়ের গুণ গাইচে। বলচে অমন মেয়ে লাখে একটা মেলে না। তোর সংসারটাকে একেবারে মাথায় করে রেখেচে। তোকে রেখেচে হাতের তেলোয়। বল রাখেনি? কোনো কিছুর জন্যে তোকে আর ভাবতে হচ্চে?

    নিকুচি করেছে তোর হাতের তেলোর—সনাতন রেগেমেগে উঠে যায়। পেছন থেকে নটে হেঁকে বলে, একেই বলে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। শালা অমন গুণের বউ পেয়েচিস তার কদর করতে শেখ। তা নয়…নিবারণ তো বলছিল…

    সনাতন ক্রমে ক্রমে চুপচাপ হয়ে যায়। হঠাৎই একদিন বউয়ের তৈরি জলখাবার সে ছুড়ে ফেলে দেয়, এটা কি সুজি হয়েছে? রুটি গড়তে শিখিসনি? কী শিখিয়েছে তোর ঝি পিসি? ভাত সেদ্ধ করতে পারিস না বেজন্মার বেটি!

    এই ক্রোধ, এই গালির সামনে বউ ক্রমে আর নির্বাক হয়ে থাকতে পারে না। বলে, শুনি বটে এর তার কাছে সোয়ামি মানেই গালি। তা আমাকে যা বলছ বলো, আমার মরা বাপ-মা, আমার পিসি এদের গাল দিচ্ছ কেন? ছিঃ! এই তুমি মরদ?

    না, আমি মরদ হতে যাব কেন? যত মরদ তোর ওই নিবারণ।

    কেন? নিবারণদাদা আবার কী করল?

    কী করল? নিবারণের সঙ্গে তোর কী? পাড়ায় যে ঢিঢ়ি পড়ে গেল!

    পাড়ায় ঢিটি? নিবারণদা? কী ভুল বকছ?

    ভুল বকছি? আনব ডেকে পাড়াসুদ্ধ লোককে?

    বউ পত্রপাঠ স্থানত্যাগ করে।

    অর্থাৎ সাক্ষীর ভয়ে আসামির টনক নড়েছে।

    এখন থেকে সনাতন, চুল্লু পান করে এসে নিয়ম করে বউকে ঠ্যাঙায়। বাড়ির জানলা দরজাগুলো খুলে রাখে, নালিশগুলো যাতে পড়শিরা ভালো করে শুনতে পায়।

    আশনাই! নিবার সঙ্গে আশনাই চলছে? মেরে মুখ ভেঙে দেব!

    চুপ করো, চুপ করো। কারও নাম নিচ্ছ কেন শুধু শুধু?…

    আর শুধু শুধু। সনাতনের মতো মরদ কি কাউকে গেরাজি করে? শুনুক, দুধারে সবাই শুনুক যাকে তারা মাথায় তুলে নাচত কেমন গুণের গুণী সেই ধনি!

    এততেও কিন্তু দমে না সেই বউ। আরও জম্পেশ করে পাঁঠার কালিয়া রাঁধে। তরকা রুটি। তক্তপোশে নতুন লেপ। কাজ সেরে বাড়ি ফিরলে শীতের দিনে হাত পা ধোবার গরম জল। বাড়িতে বিরাজ করে শান্তি। শান্তি অবশ্য একটা মশারির মতো। ভেতরে সন্ত্রস্ত ঘুম, বাইরে মশার ক্রুদ্ধ গর্জন। দুরারোগ্য ব্যাধির বাহকরা চক্রাকারে ঘোরে, ফাঁক পেলেই ঢুকে পড়বে।

    নিবারণ বউয়ের বাপের পাড়ার লোক। পিসি তার মাধ্যমেই ভাইঝির তত্ত্ব নেয়। সে তো আর অতশত জানে না। সে বেচারির মাঝে মাঝে একেবারে কাঠবেকার দিন যায়। তখন সে সকাল থেকে রাত অব্দি ফ্রি। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, কেউ একটা ফরমাশ করলে হাসিমুখে খেটে দেয়। কিংবা নিছক গল্প জমায় কারও বাড়ির দাওয়ায় বসে।

    একদিন দরকারে অসময়ে ফিরছে, স্বগৃহে নিবারণকে দেখে থমকে আড়ালে দাঁড়ায় সনাতন।

    নিবারণ হাঁক পাড়ছে, বউ এসে ঘোমটা খুলে দাঁড়াল। মুখে হাসি আর ধরে না। কী যেন একটা বলছে নিবা, ও-ই বউয়ের হাতে একটা চিঠি দিল! বসছে দাওয়ায়, জল-বাতাস এসেছে! মা বুড়ি কোথায়? ওহ তার তো এখন পা হয়েছে, পাড়া বেড়াতে গেছেন। ঘরে সোমত্ত বউ একা, ভাঁড়ে রসগোল্লা, চারদিকে ভনভন মাছি, ফেলে উনি গেলেন মজা মারতে। ঠ্যাং ভেঙে দিব–দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে সনা। ও কী! নিবা যে তার বউয়ের পেছু পেছু ভেতরে যায়? পাঁচ মিনিট? ঘড়ি দেখেনি সনা, কিন্তু এ নির্ঘাত, পাঁচ যুগ! ওই বেরিয়ে এসেছে। বউয়ের কাপড় কি এলোমেলো নয়? নিবার মুখে যেন সিঁদুরের দাগ! নেই? মুছে দিয়েছে শালো! কম সেয়ানা নাকি? বেরিয়ে যাচ্ছে নিবা। একটু সময় দিয়ে বাড়ি ঢোকে সনাতন।

    তুমি? এখন?—ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে বউ।

    একটা যন্তর নিতে এসেছিলুম—সনাতনের আর প্রবিত্তি হয় না কালামুখীটার সঙ্গে কথা কইতে। তোম্বা মুখ করে সে বেরিয়ে যায়। বউ প্রমাদ গণে। কিছু একটা হয়েছে। কী? নিবাদা এসেছিল পিসির চিঠি নিয়ে মিস্তিরি কি আড়াল থেকে দেখেছে? নিবাদাকে দেখে কিছু ভাবল নাকি? সে আজকাল নিবাদাকে অত এসো বসো করে না। বাপের বাড়ির লোক। দাদার মতো। তাকে গহিত সন্দর কথা বলে সাবধান করতে সে মরমে মরে যায়। আজ আবার পিসির চিঠি নিয়ে তত্ত্ব করতে এসে নিজেই দেখতে চাইল কোথায় চালে কী ফুটো হয়েছে। টালি খসেছে, মাটি ধরাতে হবে…। নিবাদাকে দিয়ে আর কাজ করাবে না সে। কিন্তু দেখতে চাইলে না তো করতে পারে না। কাজ খোঁজে বেচারি, কাঠবেকার এ সময়টা। ঠিক এমন সময়েই মিস্তিরির আগমন? একটু বসল না। একটা কথা শুধোল না। সাঁঝের বেলায় বাড়ি ফিরলে সে নিজেই তুলবে কথাটা। নিবাদা এসেছিল টালি সারাতে হবে, দেয়ালে মাটি ধরাতে হবে…।

    কিন্তু সাঁঝের বেলায় আজ আর ফিরলই না সনাতন। গেল বাঁধাঘাটে সোহাগির ঠেকে। চুল্লু গিলল মাঝরাত্তির অবধি, তারপরে রক্তরাঙা চোখে একখানা কাতান হাতে বাড়ি চলল।

    বাড়ি? বাড়ি তো আর বাড়ি নেইকো তার। হয়ে গেছে নরককুণ্ডি খানকিবাড়ি। পায়ের কাছে এটা কী রে বাঞ্চোৎ? এক লাথিতে রাস্তায় পড়ে থাকা কার করোটিতে লাঠির বাড়ি মারে সনাতন মিস্তিরি। টলে একটু-আধটু। মাথায় তার আগুনের হাঁড়ি, তাতে ফুটছে সাতশো জ্বণের বাঁ হাতের কড়ে আঙুল, বুনো শুয়োরের নাড়িভুড়ি, খুনে-ডাকাতের ধোলাই মগজ, কঙ্গোর জঙ্গলের শেকড় বাকড়। আজ সে দেখিয়ে দেবে মরদের বাচ্চা কাকে বলে। ঘেউ ঘেউ ঘেউ। রাত-কুকুর চিকরে ওঠে। নির্ভুল নিশানায় কাতান চালায় মরদ। কেউ-উ-উ-বাস, মুণ্ডু একদিকে ধড় একদিকে ছিটকে পড়ে। রক্তের ফোয়ারায় ভিজে যায় রাত। পুরো কুকুরের দল ইঁদুরের আওয়াজ করে ডাকতে থাকে।

    বাড়ির দরোজায় এক লাথ মারে সনা। তার দেহে আজ হাতির বল। এক লাথ, দুই লাথ, তিন লাথে বিকট খ্যাঁচ আওয়াজ করে হাট হয়ে যায় দরোজা। বুড়ি ঘুমের ঘোরে জিগিয়ে ওঠে, কে? কে? কে রে?

    তোর যম।–দাঁতের মাঝে বলে মরদ। লাথ মারে শোবার ঘরের ঝাঁপে। এইবার মশারি হিচড়ে হ্যাঁচকা মারবে সে লাল শালুর সাধের লাউ লেপে। আজ তোরই একদিন কি আমার। ধষষণ করে মেরে ফেলে দিব।

    সড়াক।—লাফ দিয়ে পেছু হঠে যায় মরদ। সামনে লকলক লকলক করছে এক কালনাগিনা। টালির ছাদ অবধি উঠে গেছে হিলহিলে পেছল কৃষ্ণবর্ণ, বুঝি চালি ফুঁড়ে যায়। চ্যাটালো আঠালো বিরাট ফণা সনার চোখের সামনে দুলছে, ঝিলিক দিচ্ছে জিহ্বা, মাঝখানে তার ভয়াবহ চিড়। আর ফণার দু পাশ থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার নির্নিমেষে তার চোখ তাক করে রয়েছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }