Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প671 Mins Read0

    জোলি চেপ

    এদিকটায় মারোয়াড়ি এসে কপালখানা স্রেফ খুলে গেছে জলি দাসের। শুধু জলিই বা কেন? বিজলি, রেণু, ঝুমা, কাজলি, টুনটুনি… জলির যত বন্ধু আছে সববারই।

    জলি যখন গুড়গুড়ে ছিল, তখন এত সব আকাশছোঁয়া বাতাস-ঢাকা বাড়ি ছিল কিন্তু। ছিল দোতলা, বড়ো জোর তিনতলা, গলির মধ্যে থাম-টাম-অলা পেল্লাই প্রাসাদও কয়েকটা, কিন্তু ওই—তিনতলার বেশি নয়। সাতপুরোনো আদ্যিকালের বাড়ি সব। নোনা ধরেছে কোনোটায়, কোনোটায় হলুদ কি গোলাপি রং জ্বলে গিয়ে ছাতলা পড়ে গেছে। এক-একটা অবশ্য নতুন রংচং মেখে, সেজেগুঁজে ওঠে কখনও সখনও, দেখায় যেন এক ডালা শিঙি-মাগুরের মধ্যে একখানা ঝাঁ-চকচকে বাংলাদেশি ইলিশ। কিন্তু এখন? এখন এ তল্লাটের চেহারাই পালটে গেছে। আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি ডবসন রোডটা তো সদাসর্বদা ঝমঝম ঝমঝম করছে। তিরিশ ফুট কুল্লে হবে কি রাস্তাটা? আগে ছিল একটা সাবেক চার্চ, ক-টা দোকানপাট। পাঞ্জাব-লাইনের এ পাশে খোলামেলা ছড়ানো খান দুই বাড়ি রাস্তাটাতে রাজত্ব করত। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির কোনো আত্মীয়ের বাড়ি একটা, অন্যটা এ অঞ্চলের বিখ্যাত ধনী ও দানবীর বিরজা ঘোষদের। হাওড়া স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেলে ডানদিকে রেলওয়ে কোয়াটার্স বেশ খানিকটা খোলা জায়গা জমি নিয়ে। সেখানে এদিককার অনেক স্কুল-কলেজেরই বচ্ছরকার স্পোর্টস হয়। এখন এ রাস্তায় যত এগোবে তত দোকানপাট, যত এগোবে তত দোকানপাট। এ সি মার্কেট, স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্রের দোকান, পাওভাজি-দহিবড়া-পাপড়িচাট, ইডলি-ধোসা এ সবের দোকান। হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার শ্বেতপাথরের সিঁড়িঅলা ঠান্ডা দোকান তো আছেই আর আছে দু গজ অন্তর একটা করে ওষুধের দোকান আর প্রতি মোড়ে একখানা করে জলিদের পাল্লার। সেই পাল্লারে একবার ঢুকে পড়ো অমনি চেরা-চেরা চোখের নেপালি দিদিরা হাতের কেরামতিতে বেমালুম তোমার ভোল পালটে দেবে। ঢুকল জলি, বেরুল জুলেখা সুলতানা, ঢুকল টুনটুনি, বেরুল টুইঙ্কল খান্না। আর সেই পাল্লারের স্বর্গদ্বারে ঢোকবার রেস্ত জোগাতেই উঠছে পরের পর পরের পর তাল ঢ্যাঙা বাড়ি। সাততলা আটতলা নতলা। মার্বেলের সিঁড়ি, রেলিংয়ের ওপর পেতলের পাত। দরজার বাহার কী। চৌখুপি চেঁছে মাথা গোল করে যেন সুন্দরী-অপ্সরাদের নেলপালিশ লাগানো পেল্লাই নখ এক-একটা। মন্দিরও আছে একাধিক। হনুমানজি বজরংবলি, শিউজি। মন্দিরে বারোমাস গাঁদাফুলে কেয়ারি ঝোলে। দেখলে বুঝবে কী একটা বিশেষ পরব। তা কিন্তু নয়। রোজ রোজই প্রবল ঘন্টা-ঘড়ি বাজিয়ে আরতি হচ্ছে। রোজই কাতার দিয়ে দাঁড়াচ্ছে ভক্তরা। আপিস যেতে-আসতে মারোয়াড়ি বাবু দণ্ডবৎ হয়ে যাচ্ছে একবার করে। মহা ধূম। আকাশ ঢেকে গেছে বলে যে খুব একটা ক্ষতি হয়েছে, তা নয়। আকাশে কী থাকে? চাঁদ, তারা, সুয্যি—এই তো! তা দোকানে দোকানে কি এখন অমন হাজার তারা জ্বলছে না? সাদা সিঁড়ির মোড়ে, গেটের ওপর ঘষা কাচের গোল বাতিগুলোর থেকে যে আলো বেরোচ্ছে, সেটা কি জোছনার চেয়ে কম সুন্দর!

    এ তো গেল একটা রাস্তা। এটাই সবচেয়ে জমজমাট, সবচেয়ে দামি। কিন্তু আরও আছে। রয়েছে শহরের বুক ফুঁড়ে জি টি রোড, হাওড়া রোড, হরগঞ্জ রোড, আর সেসব রোডের এ পাশ ওপাশ দিয়ে ডালপালার মতো নেংটি-নেংটি গলি। কত লেন, কত স্ট্রিট, কত যে রোড। ক্ষেত্তর মিত্তির লেন, সীতেনাথ বোসের লেন, জেলেপাড়া, শৈলেন বোসের রোড়, অবনী দত্ত রোড, আরও ওদিকে যাও তো উত্তম ঘোষের লেন, শ্রীরাম ঢ্যাং রোড, জালান রোড, ধর্মতলা রোড। রোডের আর শেষ নেই। সেই সব রোডের দু ধারে টপাটপ দাঁড়িয়ে পড়ছে ঢ্যাঙা-ঢ্যাঙা মাল্টিস্টোরি। আলাদিনের ম্যাজিক যেন! এ জায়গায় পুরোনো বাসিন্দারা গজগজ করে অবশ্য আসতে যেতে—শহরটাকে একবারে বেচে দিলে? আকাশটাকে সুন্ধু বেচে দিলে এই মেয়র আর মিউনিসিপ্যালিটি! ছি, ছি, ছি! কিন্তু করবেটা কী! মুরোদ তো ঘন্টা। আর জলি তো দেখে দিব্যি শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে শহরের। বিল্ডিং দেখলে বুক দশ হাত হয়ে যায়, দোকানপাট দেখলে চোখ ধকধক করে, জিভ দিয়ে দিয়ে লাল ঝরে। শহরের মতো শহর একখানা।

    তা চোখে দেখে থ মেরে থাকলেই তো হবে না। পয়সা চাই। বাঙালিরা মোটে পয়সা দিতে চায় না। মাইনে দেখো বছরের পর বছর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ছে না? বলি তোমরা মাগগিভাতা পাও না? তোমাদের ইনকিমেন নেই?—ক্যাঁট ক্যাঁট করে জলি শুনিয়ে দিয়েছে কোণের বাড়ির রীতা বউদিকে। এই বউদিটা আবার তাদের সঙ্গে একটু গলাগলি মেশে। বাড়ির, বাপ-মায়ের খবর নেয়, হোমিয়োপ্যাথিকের ওষুধ দেয়, জ্বরজ্বারি-পেটের গোলমাল, সর্দি-কাশি, পা টনটন, দাঁত কনকন-সেরেও যায় বেশ। এখন জলি আর তার বন্ধু টুনটুনি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে—আদিখ্যেতা! জলির মায়ের যখন হঠাৎ অ্যাপেনডিসের ব্যথা উঠল। সে তো চোখের গুলি ঠিকরে যায় আর কী! রীতা বউদি আর অশোক দাদা তাদের কোনো চেনাশোনা লোক ধরে হাসপাতালে ভরতি করে দিল। কোন কেলাব থেকে অ্যাম্বুলেন্স আনাল। ডাক্তার বলেছিল, তক্ষুনি অপারেশন না করলে নাকি বার্স করত। জলির সেই মা আবার উঠে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আবার বাড়ি-বাড়ি বাসনমাজার কাজ ধরেছে। তবে, সে তো কোন কালের কথা। তখন জলি ছোটো, কাজ ধরেনি।

    স্লেট-পেনসিল-বর্ণপরিচয় কিনে জলিকে খানিকটা লেখাপড়াও অবশ্য শিখিয়েছে রীতা বউদি। ইংরেজি ঠিকানা সে পড়তে পারে, বাংলা তো পারেই। তা সে তো অবৈতনিক ইস্কুলে গেলেও শেখা যেত। বাড়ি-বাড়ি কাজ করে জলির সেখানে যাবার সময় হত না এই যা। রিক্তাকেও পড়াশোনা শিখতে ডেকে নিয়েছিল বউদি। তবে রিক্তাটা একটু মাথামোটা, তা ছাড়াও রিক্তার নাম নিয়ে খামোখা রীতা বউদি আর জলির মায়ের মধ্যে একটা মন কষাকষি হয়ে যায়। তার ফলে, রিক্তাকে পড়তে পাঠানো বন্ধ করে দেয় তাদের মা।

    রিক্তা নাম শুনে মুখ টিপে বুঝি হেসেছিল বউদি, হ্যাঁ গো কমলামাসি, হঠাৎ রিক্তা নাম দিতে গেলে কেন? রিক্তা মানে জানোনা?

    তা অবশ্য কমলামাসি জানে না। রিক্তা হল গিয়ে রিক্তা, জলি হল জলি, আর টিংকু, তার ছোটো মেয়ে টিংকু হল টিংকু—তার আবার মানে কী? তার নিজের নামটি যে মা-লক্ষ্মীর নাম সেটুকু অবশ্য কেন যেন সে ছোট্টবেলা থেকেই জানে, মানেটা হাওয়ায় বাতাসে ভেসে থাকে। তবে ওসব নামের এখন আর তেমন ধক নেই।

    মানে জানে না, উৎসটি সোৎসাহে বলে কমলামাসি।

    বিরজা ঘোষদের বাড়ি কাজ করতুম বউদি, তাদেরই কুটুমবাড়ির বউ এয়েছিল। কী সুন্দর! কী সুন্দর! এই অ্যাত্ত গয়না, এ-ই বেনারসি শাড়ি…তার নাম ছিল রিক্তা।

    রীতা বউদি হেসে বলেছিল, এই গয়না আর সেই শাড়িতেই সুন্দর হয়ে গেল?

    না গো বউদি, কী রং! কী চোখমুখ!

    তাই বলো।

    তারই নাম থেকে নাম রেখেছি। নইলে আমাদের আর বিদ্যে কী? তবে কী জানো বউদি, মুকখু-সুকখু গরিবগুর্বো মানুষেরও তো শখ যায়—বাক্যের শেষে কমলামাসির অভিমানের সুর গোপন থাকেনি।

    নিশ্চয়ই। শখেতে তো দোষ নেই—রীতা বউদি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে—কিন্তু রিক্তা মানে যার কিছু নেই। কিচ্ছুটি না। অমন নাম রাখতে গেলে কোন আক্কেলে?

    তা হবে-কমলা যেমন ন্যাতা টানছিল তেমনি টানতে থাকে, তার কোনো ভাবান্তর হয়নি। ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। তা ছাড়া, কমলামাসি কোনো কোনো ব্যাপারে আলট্রা-মডার্ন। জোর অসুখবিসুখ করলে সে শনি-মঙ্গলবারের ভরের দিনে চণ্ডীমায়ের ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস করে, কতবার জলপড়া তেলপড়া নিয়ে এসেছে সে মায়ের থানের ঠাকুরমশাইয়ের কাছ থেকে, টিংকুর পাছে নজর লেগে যায় বলে তার কপালের কোণে ভুষো কালির ধ্যাবড়া ফোঁটাটি দিতেও তার কোনোদিন ভুল হয়নি। যে বর লাথি মেরে তাকে ঘর থেকে দূর করে দিয়েছে তার জন্যে সধবার জয়-মঙ্গলবার, সাবিত্রী বের্তো, তারকেশ্বর এসবও সে নিয়ম মেনে করে–এগুলো মেয়েমানুষের কর্তব্য, লাথি-ঝাঁটার বরই হোক আর সোহাগ সিঁদুরের বরই হোক, আর যতই তাকে সে নিজে দু বেলা মর মর বলে শাপান্ত করুক। বড়ো মা (শীতলা) যখন ফি বছর ফাগুন মাসে চানে বেরোন, তখনও সে নতুন কাপড় পরে, নতুন গামছা বুকে জড়িয়ে, উপোস করে এলোচুলে দণ্ডি কেটে থাকে। কিন্তু রিক্তা নামের মেয়ে নিঃস্ব রিক্তই হবে এমন বাজে কুসংস্কার তার নেই। এই যে তার নাম কমলা, তা লক্ষ্মী ঠাকরুনটি কি ট্যারচা চোখের কোণ দিয়েও কোনো দিন দেখেছেন তার সংসারের দিকে? নিজের মনেই চোখ গরম করে ভেংচি কাটে সে। হ্যাঁ, কিছু নেই, কিছু নেই, তোকে বলেছে! রিক্তা নাম হলেও কিছু নেই, কমলা নাম হলেও কিছু নেই। তফাতটা কী? আসল কথা, নিজেদের নাম তো! ঝি-চাকরে নিচ্ছে, গায়ে ফোসকা পড়ছে তাই ভদ্দরলোকদের।

    রিক্তার পরে যে জলি! সে-ও তো এক ধনীর দুলালি নেকি চণ্ডীর নাম থেকে নেওয়া। সে মেয়েটা সব সময় লাফাচ্ছে। স্কিপিংদড়ি নিয়ে, লাল রবারের বল নিয়ে, ছোট্ট ছোট্ট পায়রার ডিমের মতো সাদা-সাদা বল নিয়ে। ধাড়ি মেয়ে, যতই কেন ফ্রকে-স্কার্টে বয়স লুকোক! ওর বয়সে তার রিক্তা হয়ে গিয়েছিল নির্ঘাত। ফ্রক দিয়ে বয়স ফুটে বেরোচ্ছে। নেচে বেড়াচ্ছেন ধিঙ্গি। তবু সে মেয়েটার বাবা মা-দাদু যখন জলি-জলি ডাকত গায়ের লোমগুলো তার খাড়া হয়ে যেত। সত্যি, সত্যি, এই তিন সত্যি। একটা নীল দরজার কপাট খুলে সে যেন ঢুকে পড়েছে এক মোজাইক-মেহগিনি-কার্পেটের স্বপ্নের জগতে, যেখানে মেয়েরা খালি বল খেলে আর গান যায়, বউয়েরা খালি ক্রিম মাখে আর অর্ডার করে আর ভালো ভালো সিল্কের শাড়ি পরে বেড়াতে যায়, আর বরেরা হাসি হাসি মুখে বউয়েদের দিকে ঘোর-লাগা চোখে তাকায় আর চুমো দেয়। হ্যাঁ, জলির বাবা জলির মাকে যখন তখন চুমো খেত, এ কমলা নিজের চোখে চুপচুপিয়ে দেখেছে। ভূত নয় প্রেত নয়, চণ্ডীমায়ের নল-চালা নয়, সুষ্ঠু জলি-জলি ডাক। মায়ে ডাকছে, ঠাকুমায় ডাকছে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন সুরে। বাস! কমলার নোম খাড়া। চোখের ওপর সেই দৃশ্য, জলির বাবা জলির মাকে টুক করে চুমো খেয়ে নিচ্ছে।

    এমনটাও হয়! রিক্তাদের বাপ তো ওসব চুমো-ফুমো জানত না। মাসমাইনে পেলে আগে নিজেরটা ফুর্তি করে ওড়াবে। তারপর চুলের ঝুটি ধরে তার মাথা দেয়ালে ঠুকে ঠুকে তার থেকেও আদায় করবে ফুর্তির টাকা। রাত্তিরে মালের ঘোরে, ছেড়া কাঁথায় দু-পাশে দুই মেয়ে, হুঁশ খেয়াল নেই, ভুতের মতো লম্বা লম্বা হাত বাড়িয়ে তার ন্যাতানো বুক ধরে হিড়হিড় করে টানত লোকটা। তার ঝাঁপাই কী! বাপ রে! যেন রাক্কস। কচিকাঁচা জেগে যাবে বলে সে মুখ বুজে গোঁ গোঁ করে যন্তন্না সইত। একদিন সেই গোঙানি শুনে রিক্তা জেগে উঠে কচি-কচি হাত দিয়ে বাপকে পিটতে শুরু করে, মাকে মারছ কেন? মাকে মারছ কেন? এক ঝটকায় মেয়েকে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল বাপ, এবার তোকেও মেরে পাট করে দেব মেলা হম্বিতম্বি করলে।

    নেহাত নিকষ অন্ধকার, তাই।

    ধুস। তোকে দিয়ে নেশা জমে না—পরবর্তী মন্তব্য রিক্তার বাপের, জড়ালে গায়ে হাড় ফোটে। বডি বলতে কিছু নেই, মমতা কুলকান্নির বডি দেখেচিস?

    কে আমার গতর এমন করেছে? চারবেলা গতর খাঁটিয়ে মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছি। বছর-বছর ছেলেপিলে আর দুবেলা মার, আবার কুলকান্নি দেখাচ্ছেন। কে আমার অক্ষয়কুমার এলেন রে!

    তা সে নেশা জমাবার পাত্তর অন্যত্র পেয়ে গেল বোধহয়। তাই তাকে মেরে ধামসে তার সোনার জল করা কগাছি রুপোর চুড়ি আর হার ছিনিয়ে নিয়ে সেই যে পিঠটান দিল, আর এ মুখো হয়নি।

    গেছে, ভালো হয়েছে।

    খালি জলি ডাক শুনলেই সে যেন ভূতগ্রস্ত হয়ে যায়, মনে হয় সে একটা সুন্দরপানা বউ, হাওয়াই শাড়ি পরেছে, ঝমঝম করছে সোনার চুড়ি, বালা। গা থেকে সেন্টের পাগল করা গন্ধ বেরোচ্ছে আর সে, সেই রিক্তা-জলি-টিংকুর রূপের ধুচুনি বাপ হঠাৎ কার সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ওই জলির বাপের মতন লম্বা, ফরসা, লাল-চশমার এক ম্যাজিক মানুষ হয়ে গেছে, তাকে আদর করছে, চুলে হাত বুলিয়ে, কপালে চুমো খেয়ে। এই স্বপন দেখতে-দেখতেই তার হাতের ঝাড়ন হাতেই থেকে যায়, ফ্যালফ্যাল করে সে সামনের দিকে চেয়ে থাকে।

    ও বউ! ও কী! কী ভাবছ? হাত চলছে না যে তোমার মা! কিছু হয়েছে?

    আর কী হয়েছে! হয়েছে যা হবার তাই। বা যা না হওয়ার তা না হওয়াই।

    তা আসল বৃত্তান্তটি হল কমলা মাসিদের সাধ-আহ্বাদের সঙ্গে তাদের মেয়ে জলিদের সাধ-আহ্লাদের কিন্ত অনেক ফারাক। জলির সাধ অন্যরকম।

    ও কীরে? তুই কি ভুরু প্লাক করে এলি নাকি?—রীতা বউদি একদিন অবাক হয়ে বলল।

    ভেতরে ভেতরে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে জলির। সে বলল, কেন বউদি, তুমিও তো করো, করো না?

    কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল বউদি। তাড়াতাড়ি সামলে নিল, হাসি চেপে বলল, হ্যাঁ…তা অবশ্য। সে যাহোক বেশ করেছিস। ধনুকের মতো হয়েছে। একেবারে, পঞ্চশরের পুষ্পধনু!

    শেষের কথাগুলোর মানে ঠিক ধরতে পারল না জলি, ইচ্ছে করে শক্ত করে বলেছে, যাতে সে বুঝতে না পারে! কিন্তু ওটা যে একটা ঠাট্টা, বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ এটুকু সে বেশ বুঝেছে। বুঝে অঙ্গ জ্বলে গেছে তার।

    কী রে? আজকে পড়তে এলি না! পড়তে আমার হারগিজ ভালো লাগে না বউদি-ঝাঁঝিয়ে ওঠে সে। বউদি না আরও কিছু! মামি আসলে! তার মা যদি বউদি ডাকে তার ডাকা উচিত মামি, ডেকেও ছিল সে, মনিবই বারণ করল, বলল, বউদি, বউদিই ডাকবি।

    আমি কিন্তু হারগিজ পড়ি রে জলি। খবরের কাগজ, পত্রিকা-টত্রিকা, বই…রীতা বউদি মুচকি হেসে বলল।

    তুমি পড়ো তো আমার কী!

    না, সেদিন বলছিলি না আমি ভুরু প্লাক করি তাই তুই করেছিস, তাই বলছিলুম আমি যখন পড়ি তুইও পড়।

    খবর তো টিভি, দেখলেই জানা যায়। কোন পার্টি ভালো, কোন পার্টি শয়তানের পার্টি, কেরোসিনের দাম বাড়ল, নতুন মারুতি বেরিয়েছে… আসল প্রসঙ্গটা সামান্য পাশ কাটিয়ে যায় সে।

    বাস? এইটুকু জানলেই তোর হয়ে যাবে? তোকে কেউ উলটো পালটা কাগজে সই করিয়ে নিলে বুঝতে পারবি?

    কাগজে সই? কত একেবারে জমি-বাড়ি-ঘরদোর রয়েছে আমার! হুঁঃ! ঠকিয়ে নেবে!

    শুধু বাড়িঘরদোর কেন? ঠকিয়ে নেবার অনেক কিছু আছে রে জলি! তা ছাড়াও লেখাপড়া শিখলে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারবি। এটা বুঝিস না? কোনটা ভালো কোনটা মন্দ—বোঝবার জন্যেও একটু পড়তে হয় রে। আর সুযোগ যখন পেয়েছিস!

    জলি মুখ ঝামটে বলল, আমি তো আর তোমার মতো মাস্টারি করতে যাচ্ছি। উন্নতি? কী উন্নতি? ভদ্দরলোকে আমাদের বিয়ে করবে?

    রীতা বউদি এ প্রশ্নের সদুত্তর জানে না। সে চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, ঠিক আছে, যা ভালো বুঝিস কর, আমি তো চেষ্টা করলুম। তারপর…। ছোটোবেলায় আমার বাপের বাড়িতে রঘু বলে একজন কাজ করতে এসেছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে। আমাদেরই মতো বয়স ছিল। আমরা ভাইবোনেরা মিলে তাকে লেখাপড়া শেখাতুম। স্কুলফাইন্যাল পাস করল। ড্রাইভিং শিখল, আস্তে আস্তে নিজের ট্যাক্সি করল। এখন রঘুনাথের নিজেরই তিনটে ট্যাক্সি। ডিপ্লোমা এনজিনিয়ারিং পড়েছে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, দেখিস—ভালো ছেলে। মানে আমার দাদা ভাইয়েদের সঙ্গে তফাত বুঝবি না।

    দাদা ভাইয়েদের সঙ্গে তফাত বুঝবি না। হুঁ! কে চেয়েছে তোমার বোন হতে! অষ্টপ্রহর পরনে ফ্যাসফেসে সাদা শাড়ি, খাতা দেখছে তো দেখছেই, টিভিতে ভালো ভালো মারপিট কি নাচগান রোমান্সের সিনগুলো এলেই নব ঘুরিয়ে দেবে। কাজ নেই অমন ভদ্দরলোক হয়ে!

    সেইদিনই জলি মনে মনে সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয়। চন্দ্রলোক। এই বিল্ডিংটার তিনতলায় একটা, চারতলায় একটা, মোট দুটো কাজ সে পেয়েছে। সুরানাদের বাড়িতে পাঁচশো, আর একটু চাপ দিয়ে ছশো সে আদায় করে নেবে। দেওরারা একটু কিপটে। ওরা চারশোর বেশি কিছুতেই উঠল না। কিন্তু সুবিধে হচ্ছে ওদের বাড়িতে তার সাইজের দুটো মেয়ে আছে। তাদের পুরনো সালোয়ার কামিজ সে এখনই গোটা-তিন পেয়ে গেছে। টিকে থাকতে পারলে আরও কত পাবে। ম্যাকসি, নাইটি, ঘাগরা চোলি…ফাটা নয়, চটা নয়, খালি পুরোনো। রীতা বউদি শুধু শাড়ি পরে। বেড়াতে যাবার সময়ে সে চুড়িদারগুলো পরে। কম ব্যবহার হয় সেগুলো, সেগুলোর আশায় বসে থাকবার কোনো মানেই হয় না। তা ছাড়া রীতা বউদি তার থেকে মোটাও বেশি। লম্বাতেও একটু বেশি। রিক্তার গায়ে ঠিক হয়। তা সে রিক্তা বুঝুক গিয়ে। চেহারাটাই ভ্যাসকা, রিক্তার গতর নেই। মা আর জলি দুজনে মিলে বাড়ি বাড়ি খেয়ে রোজগার করে, রিক্তা আর টিংকু ঘর সামলায়। তা ছাড়া, অবশ্য ওরা দুজনেই চেয়ার বোনে।

    রীতাবউদির বাড়ি ছাড়াও আরও দুবাড়ি কাজ করে সে। একজন বুড়ো, তাকে বেঁধে বেড়ে, ঘরদোর গুছিয়ে ছিষ্টি করে দিতে হয়। তবে কিছুই দেখে না বুড়োটা। চাল ডাল সবজি, বালিশের ওয়াড়, মোমদান এসব হারগিজ সরায় সে। বুড়োর বাড়ির কাজ হল তার লক্ষ্মী। আরেক পার্টি আছে সাহা বাড়ি। ও বাড়ির মেম্বারও যত, কাজের লোকও তত। রান্নার লোক, ঘর ঝাড়ার লোক, ঝাঁটপাটের লোক, কাপড়কাচার লোক…। মাইনে মোটামুটি, কিন্তু কামাইয়ের সুখ খুব, হপ্তায় একদিন দুদিন না গেলে টেরও পায় না। মনিব নয়, হয়তো অন্য কোনো কাজের লোকই খেয়াল করে, বলে—কাল যে বড়ো এলি না জলি!

    মাথাটা খুব যন্তননা করছিল—কাতর মুখে জলি বলে দেয়, বাস। মারোয়াড়িদের কাজগুলোয় ভালোমতো বসে গেলে সে রীতা বউদিদের কাজটা ছেড়ে দেবে। মাকে বলাবলির দরকার নেই। খামখা ব্যাগড়া দেবে। অ্যাদ্দিনের বাড়ি, আমাদের বিপদ-আপদে বুক দিয়ে করেছে। একটু মাইনে কম ঠিকই কিন্তু খাটুনিও কম, ব্যবহার ভালো। তো ব্যবহার নিয়ে কি জলি ধুয়ে খাবে? আর ব্যবহার না আরও কিছু ভুলিয়ে ভালিয়ে হোমিয়োপ্যাথিকের গুলি খাইয়ে, অ্যাত করলুম, ত্যাত-করলুম…কিনে রেখেছে নাকি!

    কী রে? কাল এলি না। আজও এত বেলা…অসুখবিসুখ না কী?

    ভুরু কুঁচকে রীতা বউদি বলল।

    সাত সক্কালে কু গাইছে দেখো। অসুকবিসুখ তার হতে যাবে কেন? শত্তুরের হোক! অসুক-বিসুক ছাড়া কি তোদের লোকজন ছুটি পেতে পারে না?

    শরীরটা ঢিসঢিস করছিল বউদি—সে ব্যাজার মুখে বলে।

    হ্যাঁরে শুনছি নাকি তুই ওই মাল্টিস্টোরিড-এ কাজ নিয়েছিস?

    কে বললে?

    যে-ই বলুক। কথাটা কি সত্যি?

    কেন? ওদের বাড়ি কি আমাদের কাজ করা মানা?

    তা কেন? কিন্তু তুই অলরেডি আমার, বিপিন জ্যাঠার ওখানে, সাহা বাড়িতে কাজ করছিস। এর ওপরে আরও কাজ নিলে, শরীর তো টিসটিস করবেই। এত লোভ করিস না।

    লোভ?—ফোঁস করে উঠল জলি—ভালো খেতে, ভালো পরতে আমাদের বুঝি শখ সাধ হতে নেই? খাটব, খাব, তা-ও পারব না? সবই তোমাদের একচেটে?

    অমন করে কথা বলছিস কেন জলি? তুই তো আগে এমন ছিলি না। কোত্থেকে এসব শিখে আসছিস?

    তুমিই আমাকে যা শেখাবার শিখিয়েচ বউদি, আর কেউ অমন যেচে পড়ে আমার উপকার করতে যায়নি।

    ঠিক, ঠিক বলেছিস। আমি তোর উপকার করতে গিয়েছিলুম। তাই তুই ভালো করে দক্ষিণা দিচ্ছিস।

    মুখখানা আষাঢ়ে মেঘের মতো, থমথম করছে একেবারে। কী রে বাবা? কাঁদবে নাকি? ঘরগুলো ঝটপাট দিয়ে চলে যা জলি। বাসন আমি মেজে নিয়েছি। এক্ষুনি বেরোব।… রীতা বউদি ঝটকা মেরে চলে গেল।

    এর ঠিক তিনদিন পরে রীতা বউদির বাড়ির কাজটা ছেড়ে দিল জলি। সে কি আর বলে করে ছেড়েছে? দূর! যায়নি! একদিন, দুদিন, তিনদিন স্রেফ ডুব মেরে দিয়েছে। এদিকে অন্য বাড়িগুলোতে ঠিকই আসা-যাওয়া করছে। এর থেকে বোঝা যা বোববার।

    বুড়োই বললে চারদিনের দিন, হ্যাঁ রে জলি, রীতা বউমাদের বাড়ি যাচ্ছিস না? আমার কাছে সে খোঁজ করতে এসেছিল! জলি গম্ভীরভাবে বলল, ছেড়ে দিয়েছি।

    সে কী! বলা নেই, কওয়া নেই…

    বলতে কইতে গেলে ফালতু এক কাঁড়ি কথা শুনতে হবে দাদু।

    তাই বলে…-বউটা বড়ো ভালো রে…ওকে ভোগাচ্ছিস?

    দেখো দাদু, প্রেশার কুকার নামাতে নামাতে জলি বলে, কে ভালো কে মন্দ অতশত জানি না, পোষাচ্ছে না, ছেড়ে দিয়েছি, বাস।

    বুড়ো আর কিছু বলল না।

    হাতে পয়সা এসেছে, ভালো পয়সা। এখন নিয়ম করে পাল্লারে যাচ্ছে জলি। কদিন পরেই চুলটা ঝপ করে কেটে ফেলল, একে বলে স্টেপ-কাট। পাল্লারের ঝকঝকে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারে না জলি। রুমুঝুমু চুল। বাঁকানো ধনুকের মতো ভুরু। বিলিচ করে মুখটা ফরসা চকচকে লাগছে। পূজা দেওরার জর্জেটের চুড়িদার কামিজ পরে শ্যাম্পু করা চুল ঝাঁকিয়ে, লাল টুকটুকে লিপস্টিক লাগিয়ে, হাত ভরতি লাল-সোনালি কাচের চুড়ি ঝমঝমিয়ে জলি চন্দ্রলোক থেকে আসছে। আবার পিঙ্কি দেওরার লাহেঙ্গা চোলি পরে ফ্রস্টেড লিপস্টিক লাগিয়ে বেগুনি চুড়ি ঝমঝমিয়ে জলি চন্দ্রলোকে যাচ্ছে।

    জলি কত মাইনে পায় তার মা বোনেরা জানে না। আগে যে টাকাটা পেত সেটাই সে মাস গেলে মাকে ফেলে দেয়, বলে—বাকিটা আমার, আমি যা খুশি করব, একটা কথা বলতে পাবে না।

    রিক্তা জুলজুল করে তার ভুরু দেখে, কত নিল রে?

    আট টাকা।

    আর চুল?

    তোর অত খোঁজে দরকার কী? তোর টাকা?

    শুধু বোনেরাই নয়, পাড়ার মস্তানরাও তাকে লক্ষ করেছে। পিন্টু কোন কারখানায় লেদের কাজ করে, চুল ফাঁপিয়ে, হাতে বালা পরে চলে, একদিন বললে, এ জলি! সিনেমা যাবি নাকি?

    কী সিনেমা?

    মোহরা। ফাস্টো কেলাস রে…তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত…আধ-গাওয়া গেয়েই দিল পিন্টু তাকে লক্ষ করে।

    পাত্তা দিল না জলি, কী খাওয়াবি?

    ঝালমুড়ি।

    আইসক্রিম খাওয়াস তো যাব। পেস্তা-আইসক্রিম।

    সিনেমা, আবার আইসক্রিম, বড্ড বেশি হয়ে গেল না?

    তাহলে থাক—জলি আর দাঁড়ায় না।

    সাট্টার পেনসিলের লাডডু সিংও তাকে নজর করেছে। লাড়ুর পকেট ভারী বেশি।

    কী রে জলি? একেবারে মাধুরী দীক্ষিত হয়ে গেছিস যে রে।

    নাকি?—মুখ বেঁকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে জলি বলে।

    এক থাবড়ায় মুখ ভেঙে দেব অমন করে কথা বললে—লাডু বাবা মেজাজি লোক, এ প্যাংলা পিন্টু নয়!

    সিনেমা যাবি?

    কী সিনেমা?

    মোহরা। ফ্ল্যাট হয়ে যাবি নাচ দেখলে—তু চিজ বড়ি হ্যায়…

    ও আমার টি.ভি.-তে দেখা হয়ে গেছে। অনেক বার।

    আরে! কোথায় টিভি আর কোথায় বড়ো ইস্কিন…যাবি তো বল।

    কী খাওয়াবে?–খুব সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন জালির।

    ধর রোল।

    কী রোল, এগ না চিকেন না মাটন।

    ধর এগ!

    আর?

    আর? আচ্ছা আইসক্রিম, তোর ওই ঘাগরামতো ড্রেসটা পরে আসিস।

    লাড্ডুর সঙ্গে পারিজাত-এ মোহরা দেখতে চলে যায় জলি। এগ নয়, চিকেন রোল খাইয়েছে লাড্ডু, ভ্যানিলা আইসক্রিম।

    সিনেমা দেখতে দেখতে লাড্ড জলির চুলে ইলিবিলি কাটে, পেট খিমচে ধরে।

    ভ্যাট, হাত সরান, কাতুকুতু লাগছে।

    আইসক্রিম খাওয়ালুম না।

    আইসক্রিমে যেটুকু হয় হয়ে গেছে।

    আরে!—লাড়ু চমৎকৃত হয়ে বলে, তুই তো শেয়ানা মাল আছিস রে।

    হল কাঁপিয়ে উল্লাসে সিটি দেয় লাড়ু। অন্যরা প্রতিধবনি করে। আসল কথাটা বুঝেই অবশ্য, একটা শেয়াল ডেকে উঠলে যেখানে যত শেয়াল আছে ডেকে ওঠে, সেই নিয়মে।

    নিজের বুদ্ধিবৃত্তির এ হেন তারিফে মাটিতে পা পড়ে না জলির। রীতা বউদির মুখখানা মনে পড়ে। তার মুখ ঝামটা খেয়ে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গিয়েছিল! হু, দুখানা খবরের কাগজ মুখস্ত করলেই যদি বুদ্ধি হয়ে যেত, তাহলে আর ভাবনা ছিল না। জলিকে নাকি ঠকিয়ে নেবে! অত সস্তা!

    লাড্ড থেকে, পিন্টু থেকে ক্রমশ নন্দীর বাগান, পিরতলা, ঘুসুড়ি, পর্যন্ত সারা তল্লাটের অনেকের জানা হয়ে যায়—কীসে জলি মাধুরী দীক্ষিতের কতটা পাওয়া যায়। জলি হল গিয়ে গরিব লোকেদের মাধুরী দীক্ষিত। আর সেই হিসেবে, এখন জলির তোরঙ্গে ওনলি ভিমল আর প্রফুল জমতে থাকে, জমতে থাকে নেল এনামেল, লিপস্টিক, লিকুইড মেকাপ, কাজল, ব্লাশার, হাজারো রঙের বিন্দি আর কাচ-মেটালের চুড়ি, সেন্ট, রুমাল, ব্রা, প্যান্টি, ঘাগরা চোলি, জরির কাজ করা শলমাচুমকির কাজ করা চুড়িদার, শ্যাম্পু, ফরসা হবার রকম রকম ক্রিম।

    কমলা, তার মা বলে, এত কিনছিস? জলি এসব তো বেশ দামি রে!

    দামি কিনব না তত সস্তা কিনব?

    না, তাই বলচি, বোনেদেরও একটু আধটু দে। আহা মুখ শুকিয়ে থাকে। চেয়ার বেঁধে বেঁধে হাতে কড়া।

    অবহেলাভরে জলি পূজা-পিঙ্কির কাছ থেকে পাওয়া চুড়িদার-ফুড়িদারগুলো রিক্তা-টিংকুকে দিয়ে দেয়। ক্ষয়া লিপস্টিক, জমে যাওয়া কমপ্যাক্ট—তা-ও দেয়।

    এখন, লাড়ু-পিন্টুদের আওতা যে সে ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটা লাডুরা প্রথমটায় বোঝেনি। কিন্তু একদিন পিলখানার ফলের কারবারি মোয়াজ্জমের সঙ্গে ধর্মতলার হিন্দ-সিনেমায়, আর একদিন বাঁধাঘাটের তুলোর দোকানের কুঁড়িয়াল ভজুবাবুর সঙ্গে কাফে ডি মনিকোয় তাকে এরা আবিষ্কার করে ফেলল। আর তখনই শুরু হয়ে গেল বখেভা। এ পাড়ার সঙ্গে ও পাড়ার, এ তল্লাটের সঙ্গে ও তল্লাটের। এরা বলে জলি আমাদের মাধুরী দীক্ষিত ওকে আমরা একা চাখব, ওরা বলে জলি আমাদের রোবিনা ট্যান্ডন ওকে আমরা একা চাটব। এরা বলে জলি আমাদের মিস ইউনিভার্স, ও আমাদের সঙ্গে নাচবে, ওরা বলে খবর্দার জলি আমাদের মিস ওয়ার্ল্ড, ওর সঙ্গে নাচার হক খালি আমাদের, আমাদের আমাদের।

    প্রথমটা ঝগড়া শুরু হয়েছিল খিস্তাখিস্তি দিয়ে। তারপর ক্রমে ঘুষোঘুষি, লাঠালাঠি, পাইপগান, সাইকেলের চেন, তারপর বোমবাজি। দুটো চারটে লাশ পড়ে গেল, কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, কয়েকজন গুরুতররূপে আহত। পুলিশ এল। কয়েকটাকে রুলের গুঁতো দিয়ে কয়েদে পুরল, কয়েকটাকে আবার নেতৃ-ফোন পেয়ে চটপট ছেড়েও দিল। লাশগুলো বেশির ভাগই মর্গে পচতে লাগল, কেননা ডোম ফোমদের সঙ্গে বড়ো করে কে সেসব ছাড়ায়। যাঃ, যা খুশি কর গে যা। আর ইতিমধ্যে একদিন কমলামাসি এসে রীতা বউদিদির কাছে কেঁদে পড়ল, ও বউদিদি গো, আমার জলিকে তুলে নিয়ে গেচে গো-ও-ও! কিছু করো, কিছু একটা উপায় করো বউদিদি!

    কে তুলে নিয়ে গেল? পুলিশ?

    না বউদিদি, অন্য কেউ, চুপচাপ কখন তুলে নিয়ে গেছে টেরটি পাইনি।

    খুবই রাগ রীতা বউদি অশোক দাদাবাবুর। হাতের ছাত্রী ফসকে গেলে কার না রাগ হয়! তবু মানুষটা বিপদে পড়েছে, অনেক দিনের লোক। আর সত্যি, ওর তো কোনো দোষ নেই। পাঁচ বাড়ি কাজ করে বেড়ায়, কখন আর সে মেয়ের ওপর নজর রাখবে, মেয়ে বিগড়ে গেলেই বা সে করবেটা কী! তবু মায়ের প্রাণ তো! অতএব দাদা-বউদিদি কমলামাসিকে সঙ্গে করে পুলিশে ডায়েরি করে আসে। খরচ-খরচা করে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, ধরা পড়া করে টিভিতেও বলায়। ছবি আর কোথায় পাবে? শুধু বিবরণ। দৈর্ঘ্য-পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, লাল চুড়িদার, বয়স পনেরো-ষোলো, জলি দাস। সন্ধান পেলে… ইত্যাদি ইত্যাদি।

    টিঙ্কু আর রিক্তা কিন্তু তালে ছিল। মা যখন দোরে দোরে হা জলি যো জলি করতে করতে ঘুরে মরছে, তখন দুই বোন চোখে চোখে তাকায়, পরিষ্কার ইশারা। তক্তপোশের তলা থেকে জলির তোরঙ্গটি তারা টেনে বের করে, এর ভেতরেই তাদের আলিবাবার রত্নভাণ্ডার। কোনটা আগে পরবে আর কোনটা পরে পরবে ঠিকঠাক অর্ডারটা ঠিক করতে না পেরে দুই বোনেরই গা শিরশির করতে থাকে। ডালা কিন্তু সহজেই খুলে যায়। তালাই ছিল না। ও মা! এ যে ফক্কা! কিচ্ছুটি নেই। ভিমল হাপিস, পাউডার, ক্রিম, কাজল, সেন্ট, রুজ, লিপস্টিক, সায়া-ব্লাউজ, চুড়িদার, মায় বিন্দি আর হেয়ারক্লিপগুলো পর্যন্ত হাপিস। ভ্যাবাচ্যাকা মেরে থাকে দুজনে। যারা জলিকে তুলে নিয়ে গেল, তারা কি জলির তোরঙ্গের মালও তুলে নিয়ে গেল? যা বাববা! কী করে! কখন?

    আসলে, জলিকে তো কেউ তুলে নিয়েই যায়নি! জলি নিজেই নিজেকে সুযোগমতো তুলে নিয়েছে। তার সামনে এখন সিনেমা-রঙা ঝিলিমিলি পথ। সে পথ দিয়ে কত মেয়ের মেলা, তাদের জন্যে কত জিনিস! ফরসা, আরও ফরসা, আরও আরও ফরসা। আরও হেয়ার স্টাইল, আরও হেয়ার স্টাইল, এখন জলিও তো…..। জলিও তো কী! মাস্টার হবে? সরকারি চাকুরে হবে? স্বাধীন ব্যবসাজীবী হবে? আই.এ.এস, হবে? নাকি হবে পাইলট বা খেলোয়াড়? না, এ সব না, এখন ইচ্ছে করলেই জরি-চিকমিক চুমকি-ঝিকমিক সিকি পোশাকে জলি আপামর ব্যাটাছেলে সাধারণের লেহ্য হয়ে উঠতে পারে। রিক্তা-টিঙ্কুদের ঈর্ষা, জলিদের গৌরব।

    খারাপ থাকবে কেন? চারদিকের সাইকেডেলিক আলোয় জলি হারগিজ ভালোই আছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }