Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প671 Mins Read0

    পিঁপড়ে

    কাদাগোলদিয়া গ্রামে একটা খুন হয়ে গেল। খবরের কাগজে খুন আর ধর্ষণের খবর অবশ্য নিয়ম করেই থাকছে। ব্রেকফাস্ট যেমন নিয়ম, সে চা-মুড়িরই হোক আর চা টোস্টেরই হোক, খুনও তেমন নিয়ম। হোটেলে জিজ্ঞেস করবে—ডিম কি সিদ্ধ না ওমলেট? পোচ না স্ক্র্যামবলড? তেমনি ধর্ষণ কি সিঙ্গল ধর্ষণ না গণধর্ষণ? শুধু ধর্ষণ না তারপরে খুনও? কী ধরনের খুন? গলা-ফলা টিপে, না কুচি কুচি করে কেটে? এইগুলোই হল যাকে বলে ডিটেলের কাজ। এগুলোর দিকেই মনোযোগ চট করে চলে যায়। শুধু খুন-ধর্ষণের খবর এখন বড়ো জোলো হয়ে গেছে। বস্তুত খুনের খবরটার চেয়ে অকুস্থলের নামটা কাগজ পড়য়াদের। আমোদ দিল বেশি। কাদাগোলদিয়া! আচ্ছা উদ্ভট নাম তো! এখন, পিচকুড়ির ঢাল যদি কোনো গ্রামের নাম হতে পারে, ঘোকসাডাঙা বলে যদি কোনো জায়গা থেকে থাকে তাহলে কাদাগোলদিয়া কী এমন দোষ করল? তবু লোকের হাসি থামতে চায় না। কাদাগোলদিয়া! ছেলেমানুষরা বলছে, বলটায় এত কাদা লেগেছে যে কাদার বল বলে মনে হচ্ছে। সেটাকেই কেউ কোনো সময়ে এক শটে গোলপোস্টে পাঠিয়ে দেয়। বুঝলি? কিংবা কাদা বলে একটা ছেলে গোলটা দেয়। কাদা গোল দিয়া।

    কিন্তু অন্যে অপরে হাসছে বলেই তো কাদাগোলদিয়ার লোকে হাসতে পারে না। খুনটা তাদেরই গ্রামের প্রান্তিক বনবাদাড়ে হয়েছে কিনা! কোনো গুন্ডা বদমাশও নয়। গেছে এক মাঝারি চাষি বাড়ির চালাকচতুর করিৎকর্মা ছেলে হাসান। সব দিকে নজর ছিল হাসান মিঞার তা যদি বল।

    বডি আবিষ্কার করে, পরান মণ্ডল। সে ভোরের দিকে মাঠ সারতে গিয়েছিল। যেমন যায়। সবাই জানে পরান রাত থাকতেই যায়। ঝোপের আড়ালে কার পা দেখে উঁকি মারে কে রে? নিজের আবরু ক্ষুণ্ণ হওয়াটা সে ভালো মনে করেনি। তা তারপরেই মাঠ মাথায় উঠেছিল। লুঙ্গি হড়কানো অবস্থায় সে দিগবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে ছুটেছিল, খখুন। খখুন…

    পুকুরের ধারে আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায় পরান। খুন হওয়া কাউকে তো সে কখনও দেখেনি! আশ্চর্যের কথা হলেও কাদাগোলদিয়ার এই প্রথম খুন। কিছু কিছু লোকে তার চিৎকার শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু কোথায় কে আগডুম বাগড়ম চ্যাঁচাচ্ছে ভেবে কিছু লোক আসেনি, কিছু আবার ভয় পেয়েছিল, খুনটা হয়ে গেছে এখন ঘটছে এইটা না বুঝতে পারাই তাদের ঠকঠকানির কারণ। কিছু লোক অবশ্য বেরিয়ে আসে, যেমন শেখ আমিন, মৃত্যুঞ্জয় মাঝি, রজব মণ্ডল, গদাধর পণ্ডিত, সুরেন গুছাইত। এঁরা দায়িত্বশীল ব্যক্তি, কলজেতে হিম্মত আছে। সহসা ভিরমি খান না।

    কী হয়েছে রে পরান? কী বলছিস, এ কী দাঁতে দাঁতে লেগে গেছে যে! জল ঢাল, জল ঢাল, চামচে আন, চামচে আন!

    কী হয়েছে বাবা!–শেখ আমিন মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহস্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ভয় পেয়েছ? কেন?

    বাক্যশূন্য পরান দূরে জঙ্গলের দিকে কম্পিত আঙুল তোলে।

    অতঃপর দল বেঁধে সবাই জঙ্গলের দিকে চলে, সে জঙ্গলের নাম বুজিডোবার জঙ্গল। কাদাগোলদিয়া নামটা ব্যাখ্যা করা কঠিন, কিন্তু বুজিড়োবাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। একটা বড়ো পুকুর বুজে বুজে জায়গায় জায়গায় দক হয়ে গেছে। সেই আধবোজা পুকুরের সৌজন্যেই হয়তো গাছ-আগছার এত বাড়বাড়ন্ত এখানটায়। আর তাই এই নাম।

    হাসান পড়ে আছে, চিৎপটাং একেবারে। কোপটা গলার পেছনে, অর্ধেকটা হাঁ হয়ে রয়েছে। সামনে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, রক্ত কালচে বেঁধে আছে চারপাশটায়। চোখ যদিও খোলা, তবু মনে হয় না খুনিকে দেখতে পাওয়ায় কোনো ভয়ভীতি বা বিস্ময় সে চোখে আছে। পেছন থেকে ঝোপ বুঝে কোপ, সঙ্গে সঙ্গে ধড়মুণ্ডু ফাঁক। পিঁপড়ে ধরে গেছে লাশে, ডাঁশ ডাঁশ লাল বিষ-পিঁপড়ে।

    ক্রমশই লোক জমে, ছেলেবুড়ো, ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে যে যেখানে আছে। একটা মৃদু জোঁ-ও-ও মতো আওয়াজ। এত লোকে শ্বাস ফেললেও তো একটা আওয়াজ হয়! বাস, নইলে সব স্তব্ধ। কে মারল, কেন মারল, কখন মারল— এসব প্রশ্ন এখনও ওঠেনি। বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে সব বোবা হয়ে গেছে। এমনকি হাসানের বউ, মা পর্যন্ত। ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। এরা কেউ কখনও খুন হয়ে যাওয়া মানুষ দেখেনি তো! এ যেন একটা সিনেমা! মারপিট, রাগারাগি দেখেছে। কিন্তু হয় গদাধর পণ্ডিত, নয় শেখ আমিন, নয়তো রাশভারী হারান ঘোষ মশাই সেসব থামিয়ে দিয়েছেন। স্তবকবচমালা গড়গড় করে বলে যাবে গঙ্গাজল ছিটোতে ছিটোতে। তুমি কমা দাঁড়ি পাবে না। শেখ সাহেব পঞ্চায়েত-প্রধান—তাঁর কাজই হল গরমেন্টের গ্রান্ট সব ভাগবাটোয়ারা করা, ঝগড়া-কাজিয়া থামানো, ছোটো-আদালত হলেন তিনি গাঁয়ের। আর হারান ঘোষ? প্রচুর গোধনের মালিক। ভূমিসংস্কারে সিলিং এর জমি চলে যাওয়ার পরে উনি দুধের কারবার ফলাও করেছেন। ধনীও বটে, আবার অভিভাবকও বটে সবার, ফাদার-ফিগার যাকে বলে। হারান ঘোবের কথা অমান্য করবে এত বড়ো বেয়াদব এ চত্বরে কেউ নেই। তা ছাড়া সবাই-ই পঞ্চায়েতের মেম্বার। কাদাগোলদিয়া ভাগ্যবিধাতা।

    সংবিৎ ফিরে পেয়ে হাসানের মা ছেলের বুকের ওপর ঝাঁপাই ছুঁড়তে যাচ্ছিল। প্রধান তাকে অনেক কষ্টে থামায়।—অমন করো না হাসানের মা। এ এখন পুলিশ কেস। একটি জিনিসে হাত দিলে ফটকে উঠে যাবে, তাদের কাজের অসুবিধে হবে। তুমি তো চাও তোমার ছেলের খুনি ধরা পড়ক। না কি?

    খুনি পেলে কি আমার ছেলাটা ফিরে আসবে গো-ও-ও-মদিনার শাশুড়ি আমিনা আর লোকলাজ মানে না, চুল ছিঁড়ে কাপড় ছিঁড়ে একশা করে। হন্তার শাস্তির চেয়ে নিহতের পুনর্জীবনের জন্য তার আকিঞ্চন অধিক। এই উথালপাথাল মড়াকান্নার আসরেই কাটা গাছের মতো ধড়াস করে পড়ে যায় বাক্যহীন হাসান বিবি মদিনা।

    এতক্ষণে ব্যাপারটার নিষ্ঠুর নগ্ন বাস্তবটার মুখোমুখি হল সবাই। মুখর হয়ে উঠল শোকে, রাগে, প্রতিশোধ-স্পৃহায়। যথাসময়ে পুলিশ এল, মাপজোক, ফোটো, সরেজমিন তদন্ত যা করার করল। সাংবাদিকও এল ঝাঁকে ঝাঁকে।

    কী দেখলেন পরানবাবু?

    পরান বেচারি কিছুই দেখেনি। তখনও অন্ধকার, তবে তার চোখ-সওয়া। সে দেখেছে শুধু একজোড়া পা। রক্তগঙ্গার মধ্যে একখানা মুখ, একখানা ধড়। সেই হতভম্ব মুহূর্তে ঠিকঠাক চিনতেও পারেনি যে এ তারই হতভাগ্য সাঙাত।

    তবে যে বলছিলেন আপনার দোস্ত হাসান মিঞা?

    এই পুলিশি এবং সাংবাদিকি জেরার উত্তরে মূখ পরান কী বলবে? চিনতে না পারা! ছুট দেবার আগের ভগ্নাংশ মুহূর্তে চিনতে পারা, চোখ ও মনের এবং তাদের পেছনের মস্তিষ্কের এই জটিল ব্যবহার সে ব্যাখ্যা করে বলতে পারে না।

    আমি খুন করিনি গো। আমি কিছু জানি না-চিকরে, ডুকরে ওঠে পরান। সবাই চোখ চাওয়াচাওয়ি করে, পুলিশ কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে। সাংবাদিক লেখে—কাদাগোলদিয়ার হাসান মিঞাকে হত্যার অপরাধে তার প্রতিবেশী ও বন্ধু পরান মণ্ডলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।

    গ্রেপ্তার করা আর প্রমাণ করার মধ্যে অবশ্য আসমান-জমিন ফারাক। কিন্তু খবরের কাগজ পড়া লোকেরা বড়ো কুঁড়ে। তাদের একটা খবর দিলেই সেটা গল্প করে গিলে নেবে, তারপর যখন-তখন উগরোতে থাকবে। যাক একটা খুন হয়েছে, খুনিও পাওয়া গেছে। মিটে গেল। তার কী-কেন নিয়ে লোকে ক-দিন মাথা ঘামাবে? তদ্দিনে আর কতকচাট্টি খুন ধর্ষণ তো খবরে এসেই গেছে!

    এদিকে পরানের জেরা চলছে।

    হাসানের বউ মদিনার সঙ্গে তোর আশনাই ছিল?

    এমন কথা বললে তোমার জিব খসে পড়বে গো পুলিশবাবু।—এক লাথি বুটের।

    এক সীমানা তোদের জমিনের। মাঝের শিমুল গাছটা নিয়ে অনেকদিনের মনকষাকষি। হাসানের মা বলেছে।

    চাচির জিব খসে পড়বে গো এমন কথা বললে। শিমুল গাছ? শিমুল গাছ দিয়ে কী হবে গো! তেমন ছায়া পজজন্য নি। দুকুরবেলা শিমুলতলায় খেতে বসতুম মাথায় ভিজে গামছা বেঁধে। এত রোদ্দুর, এত রোদ্দুর, যেন শলার মতো ফুটতেছে।…

    গ্রামের বোর্ডও বিশ্বাস করতে পারে না, পরান এমন কাজ করেছে। সে ষণ্ডাগন্ডা ঠিকই, রাগিয়েছ কি মাথায় খুন চেপে যাবে। বউকে সে যে মাঝে মধ্যে পিটুনি দেয়, ছেলে প্রাইমারিতে ফেল করেছিল বলে যে তাকে সে চোরের ঠ্যাঙানি দিয়েছিল, একথা সবাই জানে। কিন্তু মানুষটা এমনিতে খুবই নিরীহ। উপরন্তু পরান-হাসান মানিকজোড়। পরানের গতর আর হাসানের মগজ এই দুটি খুব ভরসার জিনিস এদের।

    গদাধর পণ্ডিত বললেন, পরান এ কাজ করতেই পারে না।

    শেখ আমিন বলেন, করবেই বা কেন? ধরো ভোরের বেলা মাঠ সারতে গিয়ে কোনো তু কথায় কাজিয়া লেগে গেল। মারামারি করবে? তো বদনা দিয়ে করুক। হেঁসো পাবে কোথায়? হেঁসো নিয়ে যাবে কেন?

    হারান ঘোষ মোটা মানুষ। তায় ভয়ও পেয়েছেন বিলক্ষণ, হাঁপিয়ে-হুঁপিয়ে বললেন, সেকালে আগে থেকে একটা রাগ পোষা ছিল বলতে হয়।

    গ্রামের মাথারই যখন এমন ধন্ধে পড়ে গেছে তখন অন্যে পরে কা কথা। মাঝখান থেকে হাসানের মদিনা আর পরানের ময়না কেঁদে বুক ভাষায়। হাসানের মা শয্যা নিয়েছে। পরানের বাপ দু-বেলা প্রধানের বাড়ি হাঁটাহাঁটি করছে।আর কেউ না জানুক, আপনি তো জানো পরান আমার হাট্টা-কাট্টা হলে কী হয় ভারি মায়াবি মানুষ, তার ওপর ভীতু, শেখ সাহেব ওকে আমার ছাইড়ে আনো।

    গ্রামের তিন মাথা চিন্তিত, বিষাদগ্রস্ত মুখে চেয়ে থাকে। অজ পাড়াগাঁয় মানুষ তারা। পঞ্চায়েত-প্রধানই হোক আর সংস্কৃতজ্ঞ পুরুতঠাকুরই হোক। পুলিশে ধরলে কী করতে হয় না হয়, তেমন জানা নেই। এ ফৈজত তো ছিল না এখানে।

    অবশেষে তিনজনে পরামর্শ করে সদরে যায়, উকিল ভাড়া করে।

    আমাদের ঘরের ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে হবেই উকিল স্যার।

    জোড় হাত করে শেখ দাঁড়িয়ে থাকে যেন উকিল স্বয়ং আল্লার রসুল। গদাধরও জোড়হস্ত। নেহাত বামুন তাই পায়ে পড়তে পারছে না। কিন্তু মুখখানি যারপরনাই কাতর। হারু ঘোষ আসেনি বটে, কিন্তু উকিলের খরচ মেটাতে সবচেয়ে বেশি চাঁদা সে-ই কবুল করেছে। না করেই বা করে কী! গরিবগুর্বো লোক সব। চাষিভুষো। সরকারের কাছ থেকে কিছু জমির পাট্টা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বীজ কই? সেচের জল কই? সার কই? যদি বলো পঞ্চায়েত তো আছে। গরমেন্টও তো দিচ্ছে। দিচ্ছে একশোবার, কিন্তু পঞ্চায়েতের কি একটা হ্যাপা? এই বান ডেকে গেল তো এই আবার রোদের জ্বলুনি। এই ডেঙ্গুর মড়ক তো এই টিউকলে বিষ উঠছে। মানুষ যায় কোথায়? যাক হারান গাঁয়ের মাথা, সে দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না, চায়ও না। এর বদলে সে যে সারা গাঁয়ের মান্যিগন্যি পাচ্ছে?

    শেখসাহেব আর গদাপণ্ডিত কখন আসে, কখন আসে। সারা গাঁ পথ চেয়ে রয়েছে। হারু ঘোষ আপন গোলার পাশটিতে কাঠের চেয়ারে বসে আছে। পরানের বাবা পেছন চুলকোতে চুলকোতে বলে উঠল, কী পিমড়ে, কী পিমড়ে! হারুদাদা কী পিমড়েই না হয়েছে তোমার উঠোনে। এ যে করাতের কামড় গো!

    যা বলেছিস নেপু, আমাকেও ক-দিন যেন বড্ড কামড়াচ্ছে! মিনিটা চাদ্দিকে এঁটোকাঁটা ছড়িয়েছে বোধহয়। ওরে ও করালী, কেরোসিন জল ঢেলে উঠোনটা মুছে দিয়ে যা না?

    গরম পড়লেই এই বিপদ। পিঁপড়েরও গরম লাগে, সে গর্ত থেকে বেরিয়ে মানুষের বিছানাপাতির ঠান্ডা খোঁজে। আর ফাঁকতালে ঠান্ডা গায়ের গরম রক্ত খেয়ে নেয়। মজা হল এই যে, পুত্রশোকে মানুষ নাকি ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে অসাড়মতো হয়ে যায়—এমনটাই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল খুনের আসামি ছেলের কাতর বাবা পিঁপড়ের কামড়টুকুও সইতে পারছে না। ধুত্তেরি ছাই বলে নেপু মণ্ডল কিছুক্ষণ পরেই উঠে পড়ল।

    এদিকে পুলিশের হয়েছে মহা ঝামেলা। এ শালা সমানে থার্ড ডিগ্রি খেয়ে যাচ্ছে। জিব বেরিয়ে যাচ্ছে তবু বলবে না মদিনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক হয়েছিল। ও সি মমতাময় সবজান্তা হাসি হেসে বলেছিলেন, আরে গাড়ল, এতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন? এ তো হয়েই থাকে! ইয়ারবকশি বিবি তো এক হিসেবে তোরও বিবির মতন। একটু আধটু ফস্টিনস্টি করেছিস বই তো নয়! তাতেই হাসানের অত খচে যাবার কী হল! একেবারে খুন করব বলে শাসানি! ভোরবেলায় ডাক দিয়েছে যাতে কাকপক্ষীটিও টের না পায়। নাও এখন বোঝো ঠ্যালা, নিজের হেঁসোয় নিজেই খুন  প্রসঙ্গত হত্যার অস্ত্র সেই হেঁসোটা বুজিড়োবার কোনো অগভীর জলার কাদা থেকে উদ্ধার হয়েছে, দেখা গেছে ওটি হাসানেরই।

    শেখসাহেব, হারু ঘোষ এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে। তবে কি হাসান কোনো গোপন কারণে আত্মঘাতী হল? গদাধর কথাটা উড়িয়ে দিয়েছে। নিজের ঘাড়ে কোপ দেবে তারপর দশ হাত দূরের কাদায় হেঁসো পুঁতে আসবে এমন আত্মঘাতী এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

    যাই হোক, ও. সি বাবুর কথায় মার-খেয়ে-সর্বাঙ্গের-ছাল-উঠে-যাওয়া পরান ঝেঝে বলে, ও তোমাদের ঘরে হয় গো পুলিশবাবু। দোস্তের বিবির সঙ্গে কথা বলতেই মোরা চোখ নীচে থুই। হাসান শাসানি দিয়েছিল এমন মিছে কথা আমায় মেরে ফেললেও বলতে পারবোনি। ওরে হাসান রে…হাসানের নাম ধরেই ডুকরে ওঠে পরান। এবং ও.সি দাঁতে দাঁতে ঘষে বলেন, বজ্জাতের ঝাড়, কথা বলতেই চোখ নীচে থুই, কলির লক্ষ্মণ!

    তবে একটা কেস পুলিশ দাঁড় করিয়েছে ঠিকই। বনবাদাড়, জলাজঙ্গল, কাকপক্ষী ডাকেনি, পরানের হাতে গাড়, হাসানের হাতে হেঁসো, হাসান খুন, পরান আবিষ্কারক, দুজনে ঘরেও পড়শি, জমিজমাতেও পাশাপাশি। দু-জনেই বর্গায় জমি পেয়েছে, সোনা ফলাচ্ছে। পরানের গতর, হাসানের মাথা। একটা না একটা সুতো এর মধ্যেই আছে। আসামি পরান মণ্ডল সদরে চালান হয়ে গেল। পুলিস ফাটকে। কেস উঠবে মহামান্য সরকার বনাম পরানকেষ্ট মণ্ডল। কাদাগোলদিয়া চাঁদা তুলে উকিল দিয়েছে, ঘোড়েল উকিল। হাঁ করলে কথা বুঝে যায়।

    বলে, শুনুন মশাই। কোর্টে কেস ওঠবার আগে আমি আপনাদের এখানে জেরা করতে চাই। বলুন দিকিনি গ্রামে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে কি না।

    হায় আল্লা–শেখ আমিন বললেন, হোল কাদাগোলদিয়া এক রং, এক মন, এক প্রাণ। তাতেই না গাঁয়ের এমন রবরবা!

    আপনি পঞ্চায়েত-প্রধান আপনি তো বলবেনই। তা ছাড়া রবরবা বলতে তো কিছু আমি দেখতে পাচ্ছি না। একটা ভালো পুষ্করিণী নেই, নদী মজে এসেছে, ক টা মাত্র পাতি কুয়ো, বড়ো চাষিদের কিছু শ্যালো ম্যালো আছে হয়তো, রাস্তায় গোছডোবা কাদা, অর্ধেক লোক মজুর খাটে। আপনি ঘোষমশাই না হয় সম্পন্ন লোক, নিয়মিত মাদার ডেয়ারিতে দুধ সাপ্লাই দিয়ে থাকেন—চোখ মটকে শেখের দিকে চাইল উকিল—আপনার কথাও স্বতন্ত্র। আপনার হাত দিয়েই তো সরকারি টাকার বিলিবন্দোবস্ত হয়। কিন্তু আর সব? বেশিটাই তো হাঘরে-হাভাতে।

    গদাধর টিকি নেড়ে বললেন, এ আপনার অন্যাই অন্যায্য কথা উকিলবাবু। গরিব বড়োলোক সর্বত্তর থাকবেই, ও আপনি যতই কেন সাম্য করুন। দেখতে হবে মিলমিশটা আছে কিনা। এই যে আপনাকে সব চাঁদা করে ফি দেওয়া হল, তা কি হত যদি এক মন এক প্রাণ একটি না থাকত! নিজ কথা নিজ মুখে বলতে নাই…কই রে তোরা বল না!

    পরানের বাবা নেপু মণ্ডল চোখ মুছে বলল, তা সত্যি কথা বাবু, ও ঘোষমশাই আর পণ্ডিত মশাই-ই আপনার ফিস-এর বারো আনা দিচ্ছেন, আমার পরানকে ছাইড়ে আনার জন্যে।

    ভালো—উকিল বললেন, তা এ তো দেখছি মিক্সড গাঁ। হিন্দু-মোছলমান সম্পক্ক কেমন? দুই কমিউনিটি হয়তো ভেতরে ভেতরে খেপে আছে। হাসানের খুন হল গিয়ে দাঙ্গার প্রথম স্টেজ।

    কথা শেষ হতে না হতে তড়াং করে উঠে দাঁড়ায় সুরেন, বদর। তেরিয়া গলায় বলে—খবর্দার।

    রবিউল, নিতাইপদ, ওমর, কালোবরণ যে যেখানে ছিল যার যার মতো কসম খেলো, ওসব পাপ-কথা আমাদের বলবেন নে। যদি বলো কেন তো আমরা সব এক দরের লোক—পুজোই করি আর নামাজই করি। দুটো ভাতের জোগাড় করতে জিব বেরিয়ে যায়। আবার দাঙ্গা!

    গদাই পণ্ডিত বললেন, ঠিকই তো, ঠিকই তো—আসাদ, সুরেন, বদর ঠিক বলেছে। এ গাঁয়ে আমিই একমাত্তর বিশুদ্ধ ভটচায্যি আর সব…

    খুন হতে হলে তালে আপনাকেই হতে হয় বলছেন?

    উকিল চতুর হেসে পণ্ডিতের দিকে তাকালেন…আপনিই প্রকৃত মাইনরিটি!

    খখুন কেন? ওরে বাপরে…এসব কী অলুক্ষুনে কথাবাত্রা আপনার? রামঃ।

    গদাই যেমনই ভয় পেয়েছে তেমনই চটেছে।

    দুঃখের কথা ভুলে দু-চারজন মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। উকিলের ইশারায় এবার শেখ আমিন তার দশাসই চেহারা মেলে উঠে দাঁড়াল। বাজের মতো গলায় বলল, মদিনা বিবি, ময়না-বউ সত্যপিরের কসম খেয়ে বলল দিকিনি এ ব্যাপারে তোমরা কিছু জানো কি না! ভয় কিছু নেই।

    দুই বউ ঘোমটার আড়ে এ ওর মুখে চায়। বলে কী! ঘরের মানুষ খুন হল বনজঙ্গলে, আমরা জানব কী?

    শেখ আরও গম্ভীর গলায় বলল, পুলিশ সন্দেহ করছে ময়না বউয়ের সঙ্গে হাসানের…

    বউগুলি তো ছেলেমানুষ! ময়না-বউয়ের শাশুড়ি এবার একটা বাঁকারি নিয়ে তেড়ে আসে। বাতাসে শপাত করে চালায় আর রক্তচক্ষে বলে, মোদের এক ছেল্যা অক্ত গঙ্গা, আরেক ছেল্যা পুলিশের ঠ্যাঙায়। ইয়ার্কি পেয়েছ শেখ? দেখে নিবো। অন্যের বিবি-বউয়ের দিকে কোন ভামের নজর সে হাঁড়ি হাটে ভেঙে দিব না কি?

    লোক সব মুচকি মুচকি হাসল। তেমন কিছু নয়। ও শেখসাহেবের একটু দোষ আছে। বউ মানুষ কি ডবকা মেয়ে একা পেলে দুটো বেশি কথা কন। তা সে দোষ কি আর কারও কারও নেই?

    উকিলবাবু বললেন, আহা রাগ করছ কেন পরানের মা। আমি সত্য বার করবার চেষ্টা করছি। সত্যি-সত্যি কি কাউকে দুষেছি! যাক, এখন তা হলে দাঁড়াল—এ গাঁয়ে পার্টিপুটি নেই, হিন্দু-মোচলমান নেইকো। পিরিত-আশনাই তা-ও নেই, জমিজিরেত নিয়ে হল্লাগুল্লা কিছু না, তবু শেষ রাতের ঝুঝকো আঁধারে একটা লোক খামোখা খুন হয়ে যায়। কেউ তাকে খুন করেছে পেছন থেকে, তারই হেঁসো দিয়ে তারপর সেটি দশ হাত দূরে কাদায় নিক্ষেপ করেছে, কিংবা পুঁতে দিয়ে এসেছ। আর হবি তো হ সে লাশ প্রথম দেখল কি না তারই স্যাঙাত। ভূতে করে গেছে বোধহয়!

    দেখো সব, সাক্ষীসাবুদ নেই, তবু পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে মার্ডার ইন ডিফেন্স দাঁড় করানো যেতে পারে। কোনো কারণে হাসান পরানের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। সে পরানকে আক্রমণ করতে আসে, পরান জোয়ান বেশি, সে হেঁসো কেড়ে নিয়ে হাসানের গলাতেই বসিয়ে দেয়। তারপর যা-যা করবার করে। আত্মরক্ষার খাতিরে খুন করলে ফাঁসি হবে না, যাবজ্জীবনও হবে না। কিন্তু কথাটি তো বাবাজিকে স্বীকার করতে হবে! ইতিমধ্যে আবার যদি সাক্ষীসাবুদ বেরিয়ে পড়ে, পড়তেই পারে, তা হলেই সর্বনাশের মাথায় পা। এখন গ্রামের মাথা যারা আর পরানের বাপ তোমরা তাকে কবুল করাও। তারপর দেখছি তার সাজা কমানোর জন্যে কী করতে পারি।

    পরানের বাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কাজটি সে করেনি, তবু তাকে কবুল যেতে হবে?

    কী করে জানছ করেনি?

    আমার ছেল্যাকে, তার স্যাঙাতকে আমি জানব না?

    আরে বাবা, জোয়ান ছেলেদের ভেতরে কী চলছে না চলছে সে আন্দাজ করা কি বাপ-জ্যাঠার কম্মো —উকিল ডিবে থেকে জোড়া পান বার করে মুখে পোরে।হাসান কেন হেঁসো নিয়ে জঙ্গলে যায়? শৌচকার্য করতে কি হেঁসো লাগে?

    এই সময়ে দূর শহর থেকে একটি বাবুমশাই আসছিলেন সাদা অ্যামবাসাডর চড়ে। পরনে পরিষ্কার বাঙালি ধুতি পাঞ্জাবি। আধ মাইলটাক দূরে দাঁড় করাতে হল গাড়ি। খারাপ রাস্তা। কাদা, কাঁটা জঙ্গল খুব। জিপ নিয়ে এলেই হত। ধুতি-পাঞ্জাবি হাঁটু অবধি তুলে বাবুটি এলেন, সঙ্গে কিছু সঙ্গীসাথি। হাসি-হাসি মুখখানি, দেখলেই বোঝা যায় মনটা সাদা, খুব মায়াও শরীরে। গাঁয়ে অতিথ। সব ঘটনা গোড়ার দিকে শুনে বললেন, ঘোষমশাই, আমায় মাফ করবেন, আমি আপনার বাড়িতে থাকতে পারছি না।

    কেন? কী অন্যাই আমি করেছি বাবু?

    আরে না না, অন্যায় করবেন কেন? হাত তুলে হারু ঘোষকে আশ্বস্ত করেন তিনি, এলাম একটা শুভ কার্যে আর তার আগেই এমন মর্মবিদারক ঘটনা ঘটে গেল? আসলে আমি হাসান আর পরানের ফ্যামিলির সঙ্গে থাকতে চাই। ওদের এই দুঃখের দিনে…তিনি চুপ করে গেলেন।

    শেখ সাহেব বললেন, কিন্তু আপনার অভ্যাস নেই, বড্ড যে কষ্ট হবে বাবুমশাই!

    তুড়ি দিয়ে সে কথা উড়িয়ে দিয়ে বাবুটি হেসে বললেন, আজই ধপধবে জামাকাপড় দেখছেন, গাড়ি দেখছেন মশাইরা। গোটা জীবনটা যে বনজঙ্গলে চাষিভাইদের ঘরে কাটিয়েছি! তাঁদের কাঁজি আমানিই মেরে দিয়েছি নুন লঙ্কা দিয়ে। ছারপোকা ভরতি চারপাইতেই অঘোর ঘুম ঘুমিয়েছি। সকালবেলা দেখি সারা গায়ে বিজবিজ করে মরে রয়েছে ব্যাটারা। এত রক্ত খেয়েছে, এত রক্ত।

    আপনি টের পেলেন না?

    টেরটিও পেলাম না। সে ঘুম কি যে সে ঘুম? যাকগে সে কথা, আমি পরানের দাওয়ায় শুয়ে থাকব, হাসানের মা একটু যা হোক দেবে। ওতেই ঢের হয়ে যাবে।

    কিন্তু বাবুমশাই আপনার কষ্ট না হলেও ওদের যে কষ্ট হবে গো! পণ্ডিত বললেন।

    সে কী? ওদের কী কষ্ট?

    ওদের তো নিজেদের চারপাই আপনাকে দিতে হবে। নিজেদের ভাগের অন্ন!…

    মহা কোলাহল শুরু হল। শেষ পর্যন্ত অনেক বাগবিতণ্ডার পর ঠিক হল— চারপাই দেবেন হরেন ঘোষ, তার সঙ্গে একপ্রস্ত বিছানা। রাতের খাবার শেখ সাহেব। সকালের জলখাবার গদাই পণ্ডিত। তারপর বেরোবার আগে মধ্যাহ্নভোজটি খাওয়াবেন স্বয়ং হারু ঘোষ। কিন্তু বাবুর এক গোঁ, উনি হাসান মিঞা কিংবা পরান মণ্ডলের দাওয়ায় গায়ে মশার তেল মেখে শোবেনই শোবেন। তা, তাই তাই। বদর, গুছাইত, আসাদ, নিতাই, কালো সব চোখে চাওয়াচাওয়ি করতে করতে ঘরে গেল। এমন ধারার বাবুমশাই তারা কোনো ভোটের আগেই দেখেনি।

    মঞ্চ বাঁধা হল। মাইক্রোফোন হল। জাতীয় পতাকা এল।

    এই গরিবি, এই ভুখা, এই ব্যামো আর দেখতে পারা যাচ্ছে না। আপনাদের বৃথা স্বপ্ন দেখাব না। বলব না পাকা বাড়ি, নদীবাঁধ, বড় ইস্কুল, হাসপাতাল, গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ…এসব আমরা চক্ষের নিমেষে করে দেব। কিন্তু দূষণমুক্ত পানীয় জল, সস্তায় শিক্ষা, সস্তায় বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা এগুলোতে আপনাদের জন্মগত মৌলিক অধিকার। কেউ দেবে না। আপনারা বুঝে নেবেন আপনাদের হিসেবের কড়ি। আমরা শুধু পাশে থাকব। যতদূর পারি সাহায্য করব। করবই।

    বক্তৃতা প্রতিবারই হয়। লোক জড়ো হয় নিছক কৌতূহলে। কিন্তু এবার জয়জয়কারের মধ্যে দিয়ে বক্তৃতা শেষ হল।

    ক-দিন পর পঞ্চায়েতের ভোটাভুটি রুটিনমতো শেষ। নিশ্চিন্দি। বাবুমশাই হাসান মিঞার কবরে নিজের সংবর্ধনার মালাটি এবং পরানের বাবাকে মঞ্চের জাতীয় পতাকাটি দিয়ে গেলেন।

    এই সময়ে নতুন ও অভাবনীয় আর একটি শোকের কারণ ঘটল।

    খবর এলো পরান কয়েদে আত্মহত্যা করেছে। উঁচু জানলার গরাদে নিজের পরনের শাড়িটি (জেলে যাবার সময়ে বউয়ের একটি শাড়ি পরে গিয়েছিল পরান) বেঁধে ঝুলে পড়েছে।

    সারা গ্রাম চুপ। আর কদিন পরই কেস উঠবে। পুলিশ ফটক থেকে হাজতে যাবে পরান। এর মধ্যে কী করল? সে কি মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মারিয়াছে? বেশিরভাগ লোকেরই এখন এই সন্দেহ হচ্ছে। ঠিকই, দুই স্যাঙাত যেন ইদানীং বড্ড গুজগুজ ফুসফুস করত! ওরই মধ্যে সুতোটি লুকিয়ে আছে। পরানের মা আর কাঁদতে পারে না। তার শুকনো তোবড়ানো মুখের দিকে চেয়ে পরানের বাপ বলল, কী জানি বউ, জোয়ান ছেল্যাদের ভেতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে বাপে-জ্যাঠায় তার কটুকু জানে?

    গভীর রাতে শেখ আমিনের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হল। কীসে যেন বড্ড কামড়াচ্ছে। টর্চ জ্বেলে দেখবার চেষ্টা করেন। দেখতে পান না। কনুইয়ের ভাঁজে, গলায়, ঘাড়ে, হাঁটুর নীচে, গুহ্যদ্বারে। কী রে বাবা! এমন খাসা বেলুনের মতো লাইলনের মশারি—তার ভেতর ডাঁশ আসবে কোত্থেকে? তবে কি বিবিজান ঠিকঠাক গোঁজেননি? অভিসম্পাত দেন তিনি। ছারপোকা না কি? বাবুমশাইয়ের ছারপোকার গপ্পো মনে পড়ে গেল। ছার হওয়াই সম্ভব। এখানে সেখানে দু চারটে চাপড় মেরে, আঙুল দিয়ে আঁধার পিষে ঘুম যান। দূর ছাই, ঘুম কি হয়। জ্বালিয়ে দিচ্ছে একেবারে। আবার টর্চ জ্বালেন, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন। চক্ষু স্থির হয়ে যায়। বিছানাময় থিকথিক করছে টকটকে লাল বিষ পিঁপড়ে। আতঙ্কে মশারি খুলে বাইরে আসেন হারু ঘোষ। জামা কাপড় ক্রমে ক্রমে খুলে একেবারে নাঙ্গা হয়ে যান। ঝাড়তে থাকেন, মারতে থাকেন, ফু দিয়ে চিপটে, চাপড়ে। কিছুতেই শালারা নড়ে না। চারটে মরে তো চল্লিশটি রক্তবীজ তার জায়গা নেয়। গোঁসাই তাঁর ধর্মপত্নীকে ডাকতে যান, ছেলেমেয়েদের নাম করে চ্যাঁচান, গলা বেরোয় না। মুখগহ্বর দিয়ে, নাসাবিবর কর্ণবিবর দিয়ে শরীরের ভেতরে লংমার্চ করতে করতে ঢুকে যাচ্ছে রক্তলাল পিপীলিকা বাহিনী। অসহ্য যাতনায় মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যান।

    ভোরবেলা। ঘরে ঘরে লোক জেগে উঠেছে, দাঁতন চিবোচ্ছে কেউ, বলদে লাঙল জুতছে কেউ, গোরুবাছুর হামলাচ্ছে, পাখ-পাখালি মনের সুখে গলা সাধছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে জঙ্গলের দিক থেকে ফিরে আসে তারা, যারা গিয়েছিল। গাড় হাতে, বদনা হাতে। কী রে? কেন গো? না শাড়ির লাল পাড়ের মতো টসটসে লাল, অস্বাভাবিক বড়ো পিঁপড়ের সারি ঢুকছে জঙ্গলে। আসছে গাঁয়ের ভেতর থেকে। একটা নয় দুটো নয়, তিনটে। জঙ্গলের দশ বারো গজ দূরে ত্রিবেণির মতো তিনটি ধারা মিশে যায়। চওড়া হয়ে যায়, আশে তাকায় না পাশে তাকায় না। অনম্য শৃঙ্খলার সঙ্গে ঢুকে যেতে থাকে সেই ঝোপটির তলাকার গর্তে যার ওপাশে পরান আর ওপাশে ছিল হাসান। মাত্র কদিন আগে।

    ভয়ে, বিস্ময়ে মূক জনতা ফিরে যেতে থাকে, জানে না গিনেস বুকে লিপিবদ্ধ করবার মতো একটা প্রাকৃতিক ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করল আজ। কিন্তু ও কী? স্তব্ধ ভোরের বিস্ময় চিরে তীব্র মড়াকান্না উঠছে না তিন দিক থেকে? কেন? যার যার নিজ নিজ শোবার ঘরে রক্তাক্ত যন্ত্রণাবিকৃত তিনটে আতঙ্কস্থির মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে তাদের স্বজনবর্গ।

    বস্তুত মানুষ সংখ্যায় অগণ্য, ক্ষমতায় কালান্তক ও বুদ্ধিতে বেস্পতিতুল্য হলেও সেই তিমিরেই থেকে যায় যে তিমিরে অদ্যাপি ছিল, কেননা সে নাকে-তেল কানে তুলো দিয়ে জেগে জেগে ঘুমোয়। কিন্তু পিপীলিকাদি প্রাচীন ঐতরেয়গণ এখনও বাতাসে পাপের গন্ধ পান।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }