Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্যের সেরা গল্প – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প671 Mins Read0

    ক্যালভেরি

    বাজারে জোর গুজব এক নির্দোষ ব্যক্তিকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কী অপরাধ সন্দেহে তাকে ধরা হয়েছিল, কত বছর সে বন্দি আছে সে খবর কেউ জানে না। এমনকি কোন দেশের জেলে সে পচছে সেটাও ঠিক করে কেউ বলতে পারে না। শুধু বিশ্ব গুজব। গুজব কানাকানিতেই ছড়ায়। তা এখন তো কানাকানি শুধু রামে-শ্যামে, টমে-ডিকে হয় না, হয় ইংল্যান্ডে-আমেরিকায়, চিনে-ফ্রান্সে, ভারতে-রাশিয়ায়…। মিডিয়া যখন খবরটা কবজা করল তখন সেটা প্রায় বাসিই হয়ে গেছে। তবে বিশদ বৃত্তান্ত তো পাবলিক জানে না। এইখানেই কাগুঁজে কেরামতি। মজা হচ্ছে সব দেশের প্রধান কাগজই ভেবেছে এটা তার স্কুপ, শেষ রাত্তিরে কোনোক্রমে পাতা করেছে সব। সকালবেলা গরমাগরম বিকোবে। হায় কপাল! সকাল হতেই সব চক্ষু চড়কগাছ। তবে ওই যে ডিটেল? ডিটেলেই রকমারি মশলা।

    হ্যাঁ, ডিটেলে নানান তফাত। বিশ্বের এক অজ্ঞাত জেলে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি অজ্ঞাত অপরাধে অজ্ঞাতসংখ্যক বছর বন্দি আছে–এরকম তো খবর হয় না। এত অজ্ঞাত দিলে পাবলিক কান মলে দেবে। কাজেই যে যার প্রতিভার পুঁটলি খোলে। কোনো কাগজে বলে লোকটা আছে ইংল্যান্ডের জেলে। কেউ বলে কুখ্যাত সাইবেরিয়ায়, কেউ বলে খোদ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র, কেউ বলে করাচির যে জেলে জুলফিকার আলি ভুট্টোকে রাখা হয়েছিল সেখানেই, কেউ আবার বিস্ময় প্রকাশ করল—আমাদের এই ভারতের মহামানবের দেশে, একেবারে নাকের গোড়ায় তিহার জেলেই নাকি লোকটি শুষছে। ফলাও তর্কবিতর্ক, চিঠি কাউন্টার চিঠি চলতে লাগল। টেলিভিশনের সব চ্যানেলে থিকথিক করছে এক নিউজ, এক বিতর্ক। বি.বি.সি এ বাবদে মার্গারেট থ্যাচার, ব্লেয়ারের বিবৃতি নিল, সি. এন. এন নিল দুই বুশ, ক্লিন্টন, কলিন পাওয়েলের, এখানেও সব প্রাইভেট চ্যানেলে জোর যুক্তি-তক্কো-গপ্পো চলতে লাগল।

    আপামর বাঙালির (রাজনৈতিক নেতারা বাদে) বিশ্বাস জায়গাটা সাইবেরিয়া এবং বন্দিটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। না-ই যদি হবে তো রেনকোজির ভস্মর ডি. এন. এ টেস্ট করালি না কেন? কেউ খুঁতখুঁত করে, সে বললে তো তাঁর বয়স একশোরও অনেক বেশি হয়ে যায়। লোকটি সে রকম বুড়ো-অথর্ব বলেও তো শোনা যাচ্ছে না! নেতাজি-গরবে গরবি বাঙালি জ্বলন্ত চোখে বলল, মহামানবদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। আবেগের চোটে বাংলা ভুলে বাঙালি স্লোগান দিতে লাগল—আওয়ার নেতাজি অমর রহে, যুগ যুগ জিও সুভাষচন্দর, নেতাজি সুভাষ জিন্দাবাদ, অবিশ্বাসী মুর্দাবাদ।

    আপামর আরববাসী, সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক-বাসী (বুশ-ব্লেয়ার বাদে) আনন্দে নৃত্য করতে লাগল, এই হল আসলি মসিহা, ওসামা বিন-লাদেনের স্পিরিচুয়াল গুরু। কেউ বললে, এটা সাদ্দাম, তেল-সংক্রান্ত চুক্তিটা ফাইনাল না করে আমেরিকা ছাড়বে না। ইজরায়েল বাদে মধ্যপ্রাচ্য কট্টর পান-ইসলামিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে লাগল।

    লোকটির নাম নাকি আন্তর্জাতিক অপরাধীর তালিকায় ছিল। দেশ থেকে দেশান্তরে জেল থেকে জেলান্তরে বদলি হয়েছে সে। কিন্তু কী যে তার সম্ভাব্য অপরাধের চরিত্র কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধবন্দি? এই তো সেদিন হিন্দি-পাকি ভাই-ভাই-এর আবেগে প্রথম কাশীর যুদ্ধের কিছু ভারতীয় বন্দি ছাড়া পেয়ে বর্ডার পেরোল। যে যুবক ছিল, সে অবশ্য এখন অতি বৃদ্ধ, বেশির ভাগেরই পরিবারের সব মরে-হেজে গেছে। কেউ কেউ যুবক নাতির গলা জড়িয়ে কাঁদবার সৌভাগ্য সুযোগ পেয়েও কাঁদতে পারল না। কান্না শুকিয়ে গেছে। তবে? কনসেনট্রেশন। ক্যাম্পের কোনো ধাঙড়-মুফরাস না কি? না কি রাজনৈতিক অপরাধী–স্তালিনের সময়ে গুইগাঁই করেছিল বলে চালান হয়ে গেছে পোল্যান্ড থেকে পূর্ব জার্মানি, পূর্ব জার্মানি থেকে উত্তর কোরিয়ায়। স্পাই সন্দেহে আটক হয়েছিল, হচ্ছে বহু লোক, তাদের কেউও হতে পারে। কিছু প্রমাণ করা যায়নি। নথিপত্রও সব ব্যাখ্যাতীতভাবে হারিয়ে গেছে।

    প্রশাসনের এই অদ্ভুত অবিচারের বিরুদ্ধে সব দেশের জনগণই খেপে উঠল। লোকটিকে মুক্তি দিতে হবে অবিলম্বে। ইংল্যান্ডে কালো পতাকা, ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজ ঘেরাও, ফ্রান্সে ছাত্র-আন্দোলন, রাশিয়ায় প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র, চিনে তিয়ানানমমেন মেন স্কোয়্যার সিলড। ইরাকে ফটাফট গাড়িবোমা, কিছু মার্কিন ও ভূরি ভূরি ইরাকি ছিন্নভিন্ন। বেশি কথা কি, ভারতেই জেলে জেলে খুনজখমের আসামিরা অনশন ধর্মঘটে শামিল হল। আমাদের আটক রাখো, পরোয়া নেই, নির্দোষী ঠাকুরদাদার মুক্তি চাই। মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল, ইউ. এন. ও সব নড়েচড়ে বসল। এরই মধ্যে ইজরায়েল ঘোষণা করল, সব বন্দি ছাড়তে পারি, প্যালেস্টিনীয় ছাড়ব না। সুইজারল্যান্ড বলল, আমরা বিদেশি টাকা ব্যাংকে রাখি, বন্দি রাখি না, স্ক্যান্ডিনেভিয়া বলল, আমরা নোবেল পুরস্কারে পর্যন্ত অবিচার করি না, আর বন্দির বেলায় করব? এই তালে ইন্ডিয়ার যত প্রাক্তন ও অধুনাতন মুখ্য ও প্রধানমন্ত্রীরা জেড প্লাস প্লাস নিরাপত্তা চাইতে লাগল। বিধায়ক, সাংসদরা নিরাপত্তার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করলেন। কে জানে খ্যাপা পাবলিক খ্যাপা মোষের মতো, কখন যে কার ভুঁড়ি ফাসিয়ে দেবে কেউ জানে না। দুগগা, দুগগা! ফলে কোনো থানাতেই আর পুলিশ রইল না। সাংসদ মশাইরা করবা চৌথ-এ স্ত্রীর পুজো পেতে যাচ্ছেন—ব্ল্যাক ক্যাট, অজ গাঁয়ের বিধায়ক মশাই মাঠ সারতে চলেছেন—ব্ল্যাক ক্যাট। চোর-জোচ্চোর বাটপাড়দের মহাফুর্তি। হাই-ফাই অপরাধীরা করুণা করে আই, পি, এসদের সঙ্গে আড্ডা দিতে লাগল। জলকর বসছে না বসছে না, হকার উঠবে কি থাকবে, গঙ্গা মহানন্দার পাড় ভাঙল কি ভাঙল না, জলে আর্সেনিক কমানো হবে কি হবে না, পারমাণবিক বর্জ্য কোথায় জমছে, ওজোন স্তরের ফুটো কতটা বাড়ল, মেরু বরফ কত ইঞ্চি গলল—এসব নিয়ে আর কারও মাথাব্যথা নেই।

    অবশেষে চাঞ্চল্যকর খবর বেরোল—লোকটির নামের আদ্যক্ষর জানা গেছে। ভিপি বা ভি-ভি। হিন্দি বেল্ট বলল, এ নির্ঘাৎ আমাদের ভানপ্ৰতাপ ভুয়ালকা সমাজসেবক মানুষ, কী একটা স্ক্যাম নিয়ে চিরুনিতল্লাশির সময়ে উবে গিয়েছিলেন আহা! পূর্বাঞ্চল বলল, এ হল গিয়ে ভবদেব ভট্টাচার্য, আদি নিবাস ভাটপাড়া, শেষের দিকে ত্রিপুরা-আসামে বরো জঙ্গি আলফা জঙ্গিদের অহিংসাধর্মে দীক্ষা দিতেন, জঙ্গি ধরবার সময়ে পুলিশে একেও ভুল করে বদমায়েশি করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কেউ বলল, লোকটা আদৌ ভারতীয় নয়, কোন দেশি কে জানে, ওর নাম ভিভিয়ান পাস্ক্যাল ভারমন্ট। এরকম আরও কত নাম। কে কোন দেশি কেউ বলতে পারে না। রিফিউজি ছড়িয়ে পড়েছে ভুবন জুড়ে! কেউ আর সীমারেখা মানছে না। এ দেশের ভুখা মানুষ ওদেশে, এদেশের শুখা মানুষ এদেশে। যেখানে রুটিরুজি, যেখানে শান্তি, নিরাপত্তা সেখানেই ঠেলে উঠছে মানুষ। পারাপারি করতে গিয়ে মরুভূমিতে, তুষারভূমিতে প্রাণ দিচ্ছে কত মানুষ, যে জাহাজের সাগরে যাওয়ার কাল কবেই শেষ, তাইতে চড়ে মরিয়া মানুষ সলিলসমাধি পাচ্ছে।

    তবে এ নিয়ে বেটিং শুরু হয়ে গেছে। বেটিং যে কত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে হয় তা তো আমরা জানি না। বুশ জিতবে না কেরি জিতবে, কংগ্রেস সি, পি, এম-এর সঙ্গে আসন-সমঝোতা করবে, না পি. ডি. এফ-এর সঙ্গে, তেণ্ডুলকর আগে ঘুমোতে যান, না সৌরভ গাঙ্গুলি? কে বেশি কেরামতি দেখাতে পারে—আমাদের লাল্লু না ত্রৈলোক্যনাথের লুন্নু? ইলিশের দর এ সিজনে তিনশো থাকবে না চারশো উঠবে? কয়েক হাজার কোটির জুয়ো খেলা। যারা সাদ্দামের ওপর বেট করেছিল সাদ্দাম ধরা পড়তে তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান হল। কয়েকজন বেটসম্যান আত্মহত্যাই করে ফেলল।

    পাবলিক এখন তেতে গেছে। তাকে রোখে কারও সাধ্য নেই। সুতরাং নানারকম স্লোগান শুরু হয়ে গেল। আমার নাম তোমার নাম—ভিভিয়ান ভিভিয়ান। ভানপরতাপ ভুয়ালকা জবাব দাও আমেরিকা। ভবদেব ভট্টাচার্য বাংলার আশ্চর্য। ভিভিয়ান ভবদেব ভানপরতাপদের মুক্তি সবাই চাইছে। শ্বেতপত্র দাবি করছে।

    বিরাট বিরাট পদযাত্রা, মিছিল দেখে যে যেখানে আছে শামিল হয়ে পড়ল। কাগজকুড়োনি ছেলে, দেহবেচা মেয়ে, জমাদার হাবিলদার সব। কেননা এত বড়ো মিছিল কেউ দেখেনি। ধরুন শুটে আর পুঁটে কাগজ কুড়োচ্ছিল। শুটের মুখে আঙুল। পুঁটের পিঠে বোঝ। হাঁ করে দেখছে, হঠাৎ দেখে আগে লোক পাছে লোক ভিভিয়ান, ভিভিয়ান। তো তারাও বলতে লাগল ভিভিয়ান-ভিভিয়ান। পারুল আর বকুল পাড়া থেকে একটু দূরে খদ্দের খুঁজতে এসেছিল। দেখতে দেখতে একটা লোককে বেশ মালদার মনে হল, পারুল চোখ মারল, বকুল মডেল পোজ দিল। লোকটা দেখতেই পেল না, হাত আকাশে ছুঁড়তে ছুঁড়তে আশ্চর্য আশ্চর্য বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকল। আরও কাছে এগোতে ভিড়ই বকুল-পারুলকে চুম্বক টানে টেনে নিল। খদ্দের-উদ্দের ভুলে তারাও চ্যাঁচাতে লাগল—ভবদেব ভশচায্যি আশ্চয্যি আশ্চয্যি। মুক্তি দাও মুক্তি চাই, নইলে গদি ছাড়াবই। পৃথিবীর সরকার নিপাত যাক। শেম শেম শেম শেম। জমাদার রামলখন, ছাতুঅলা যুধিষ্ঠির, বুটপালিশ লখিয়া, বাসের খালাসি নন্দলাল সব প্রতিধবনি তুলল—ছেম ছেম।

    সব দেশের বিরোধীপক্ষের মহা ফুর্তি। এই সুযোগে শাসকদলকে নাকানিচোকানি খাওয়ানো যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান, লেবার আর কনজারভেটিভ। কংগ্রেস-বিজেপি-সি.পি.এম যে যেভাবে পারে ব্যাপারটার ফায়দা তুলতে লাগল।

    আমাদের এ দেশে যেমন—সরকার পক্ষ বলল, ঘটনাটা ঘটে কংগ্রেস আমলে, অবভিয়াসলি। কংগ্রেস বেকায়দায় পড়ে বলল, ধুত, ও তো ব্রিটিশ আমলের কথা।

    এরকম কাজিয়া সব দেশেই পুরোদমে চলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ সম্মেলন ডেকে সবাই ঠিক করল, সত্তর কি তার চেয়ে বেশি বয়সের বন্দি যাদের প্রমাণাভাবে জেলে আটকে রেখে ভুলে যাওয়া হয়েছে, সে রকম সবাইকে খুঁজে পেতে ছেড়ে দেওয়া হবে। রাজবন্দি যুদ্ধবন্দি তো বটেই।

    এতে কিন্তু অনেক কয়েদির এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল। এতকাল হয়ে গেছে, জেলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বেচারিরা, নিশ্চিন্ত জীবন, নিশ্চিন্ত ভাত-কাপড়। সে যেমনই হোক না কেন। আত্মীয়স্বজনদের প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে, এতদিনের জেল-খাটা দাদুকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে, এ কী সমস্যা? সংসারটা বেশ গুছিয়ে ভোলা গিয়েছিল! যাই হোক, বিশ্ব পাবলিক যেমন একবগ্না, বিশ্ব সরকারও তেমন। দাও ছেড়ে, সরকারের বন্দি পোষার খরচ কমে যাবে। তাই বা কম কী! সুতরাং বহু দিনের অপরাধ-প্রমাণ-না-হওয়া বন্দিরা ছাড়া পেতে লাগল। অবশ্যই সত্তরোর্ধ্ব হতে হবে।

    যে দেশে জনতার যাকে পছন্দ হল ফুল-মালা-চন্দন দিয়ে বরণ করে শোভাযাত্রা শুরু করে দিল। বাকি জীবন এদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে সরকারগুলো এমন কথা দিয়েছিল। তারা এখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মূল লোক তো একটি। ঠিক আছে তাকে ঠিকঠাক স্পষ্ট করতে না পেরে না-হয় আরও কয়েকজনকে ছাড়া গেল। কিন্তু এ যে বেরোচ্ছে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে? এত লোক বিচার ছাড়া এতদিন বন্দি ছিল? এ তো মহা ফাঁপরে পড়া গেল! তা কী করা যাবে। কথা দিলেই যে কথা রাখতে হবে তার তো কোনও মানে নেই। ইন্ডিয়া ঠোঁট উলটে বলল—ছাড়ন তো ও রকম কত কথা নিত্য দিতে হচ্ছে, বন্যা, খরা, বাঁধ…কত রকমে লোক উৎখাত করতে হচ্ছে তা জানেন? সাহায্য-ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে তো ফেল করে যাব মশাই। জনগণ যা করছে করতে দিন। লেটস ওয়াচ অ্যান্ড ওয়েট।

    এখন জনগণ যাদের পছন্দ করল তাদের কথা বলি।

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল জেল থেকে পাক্কা ত্রিশ বছর পরে মুক্তি পেল অ্যাডাম। সেমিটিক তো বটেই। একেবারে যিশুখ্রিস্টের মতো চেহারা। অ্যাডাম একটি হত্যা-শিল্পী। শুধু খুনের জন্যেই সে একশো একটা খুন করেছে। এত নিপুণভাবে যে, খুন-হতে-থাকা ব্যক্তিটিও বুঝতে পারেনি খুনি কে! চার-পাঁচটি খুন একই পদ্ধতিতে করে ফেলায় অ্যাডাম একটু বেকায়দায় পড়ে। সন্দেহবশত তাকে ধরা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। এবং তা সত্ত্বেও উকিলের পর উকিল, বিচারকের পর বিচারকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সে-ই খুনি এবং প্রমাণ পাওয়া যাবেই। এইভাবে তার ফাইল কোথায় ফাইলের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে গেল। কত বিচারক অবসর নিলেন, কত উকিল-অ্যাডভোকেট সলিসিটর মারা গেলেন। অ্যাডামের কথা সকলে ভুলে গেল। জেলের ব্যবস্থাট্যবস্থা ভালোই, নালিশ করার কিছু নেই। সুতরাং অ্যাডাম ভালোই ছিল। একমাত্র অসুবিধে, সে খুন করতে পারছিল না। জেলের মধ্যে খুন চার-পাঁচটা করাই যায়। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করে সে প্রভু, ইহারা জানে না ইহারা কী করিতেছে—জাতীয় একটা মহাপুরুষোচিত হাবভাব নিয়ে ছিল। তার মুক্তিতে তার কয়েদি-বন্ধুরা পর্যন্ত খুশি হয়ে তাকে ফেয়ারওয়েল দেয়। কেননা সবাইকারই ধারণা ছিল তার মতো নিষ্পাপ উচ্চমার্গের ধ্যানী পুরুষ পৃথিবীতে আর দুটি নেই।

    শোভাযাত্রীরা জিজ্ঞেস করতে লাগল, হে অ্যাডাম, তোমাকে কোথায় পৌঁছে দেব?

    অ্যাডাম উদাস স্বরে বলল, তিরিশ বছর পরে আর আমি কোথায় যাব? থাকার মধ্যে এক বুড়ো বাপ ছিলেন, কবে মরে হেজে গেছেন। যেখানে হোক আমাকে ছেড়ে দাও, সরকার তো একটা ভাতা দেবেই, যেমন করে হোক চালিয়ে নেব। অনেক ধন্যবাদ, আমার সন্তানসম দেশবাসীগণ!

    এখন এখানকার হাওয়া একটু গরম, তুমি বরং তোমার দাড়িগোঁফটা কামিয়ে ফেল–একজন উপদেশ দিল। সত্যিই ওসামার সঙ্গে অ্যাডামের মিল খুব।

    তবে এসবে অ্যাডামের মন নেই। তার প্রবল খুন-পিপাসা পাচ্ছে। লেটেস্ট ফ্যাশন অনুযায়ী ন্যাড়ামুণ্ডি হয়ে, দাঁড়িগোঁফ কামিয়ে তার চেহারাটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। বয়সটাও যেন কমে গেল এক ধাক্কায়।

    শিট! বাবা-মা না থাক তার বউ ছেলেপিলে অবশ্যই ছিল। সেসব ছেলেরা এখন কে পঁয়ত্রিশ কে চল্লিশ, বউও তো বুড়ো হল। বাড়ি তার পশ্চিম-উপকূলে অরভিল নামে একটা ছোট্ট গ্রামে। বউ ছেলেপুলেদের জন্যে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বুড়ো বয়সে তাদের আদরও সে আ যাবে কোথায়? বিশেষ করে স্যারা, তার বউ, একেবারের জন্যেও বিশ্বাস করেনি সে খুনি। যতদিন পেরেছে উকিলের কড়ি গুনেছে। কান্নাকাটিও করেছে কম নয়। কিন্তু অরভিলে সে স্যারা আর তার দুই ছেলের কোনো খোঁজই পেল না। মার্কিন দেশে লোকে এই বাড়ি কিনছে তো এই আবার বেচে দিচ্ছে। এক জায়গায় খুঁটি গেড়ে বসবার ধাতই নেই কারও। অত বড়ো বড়ো ছেলে, বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে নিশ্চয়। কোথায় তাদের খুঁজবে? অ্যাডাম ভ্রাম্যমাণ খুনি হয়ে গেল।

    বরকত ছিল ধুরন্ধর জালিয়াত। দেখতে নেহাতই দেহাতি ভালোমানুষের মতো। লোকটা এমন জালিয়াতির কারবার ফেঁদেছিল যে পৃথিবীর যেখানে যত শেয়ারবাজার সর্বত্র ধস নেমেছিল। নামটা সে কখনও এক রাখত না। গায়ের রংটা মাজা মাজা, বেঁটে, মাথায় টাক। ইতালীয়, স্প্যানিশ, ভারতীয় যা ইচ্ছে হতে পারে। এই চেহারা এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি হাতিয়ার করে সে কাজ-কারবারে নেমে পড়েছিল। কখনও আন্তোনিও, কখনও রামদাস, কখনও বদরউদ্দিন নামে সে চলাফেরা করত। গোটা দশেক ভাষা জানত, তার মধ্যে ছটা ভাষায় মাতৃভাষার মতো দড় ছিল। একটি খাঁটি ভাষাবিদের যা যা গুণ থাকা দরকার সবই তার ছিল। উপরন্তু সই জাল করায় তার জুড়ি ছিল না। পঁচিশ বছর জেলের ভাত খাচ্ছে সে ফ্লোরেন্সের এক জেলখানায় মানুচ্চি নামে। এখনও তার আসল নাম ফাঁসই হয়নি। আসলে সে এবার ফেঁসে গিয়েছিল নেহাতই ছোটোখাটো একটা পাসপোর্টের সই জাল করার ব্যাপারে। কেন যে ছাড়া পায়নি সেটাই এক বিস্ময়। খুব সম্ভব শেষ যাদের জন্যে জালিয়াতি করেছিল, তারা নিজেরাই জালিয়াতির দায়ে ধরা পড়বার ভয়ে মুখ খোলেনি। বরকতও তার এক অঙ্গে অত রূপ ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে ট্যাঁ ফোঁ করেনি। জেলখানাটা সে ভালোই উপভোগ করছিল। নানান কিসিমের অপরাধী আসে জেলে। কত জনের কাছ থেকে কত কী শেখা যায়। শিক্ষক হিসেবে দু-চারজন অন্তরঙ্গ ছাত্রও যে জুটে যায় না তা নয়। মানুচ্চিবেশী বরকত শোভাযাত্রীদের বলল, পঁচাত্তর বছর পার হয়ে গেলে আর কি আত্মীয়পরিজন থাকে ক—তার চোখ ছলছল করছে। সে বলল প্যরিসের একটা টিকিট কেটে তাকে উঠিয়ে দিতে। তারপর কপালে যা আছে, ছেলে সেখানে থাকলেও থাকতে পারে। আসলে কিন্তু বরকতের বাড়ি সুদূর পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে। জালিয়াতির নেশা তার এমন সাংঘাতিক ছিল যে অসুবিধে হবে বলে বিয়ে-থাও করেনি। বরকতের সুইস ও ইতালীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বিদ্যমান। প্যারিসের রাস্তায় বরকত টুক করে হারিয়ে গেল।

    তৃতীয় যাকে জনতার ভারি পছন্দ হল সে হল এক ধর্ষণিক। গ্রামে-গঞ্জে শহরে-নগরে এ যে কত ধর্ষণ করেছে, কত যে এর অবৈধ সন্তান, কত মেয়ে যে এর জন্যে আত্মহত্যা করেছে, কতজনকে লাইনে নাম লেখাতে হয়েছে, কতজনকে যে এ খুন করে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই। পাঁচ থেটে পঁয়ষট্টি এর রেঞ্জ। একা পেলেই ধর্ষণ করে ফেলো—এই নীতিতে বড়োই বিশ্বাসী লোকটি। মুখোশ পরা থাকত বলে লোকটিকে চেনা যেত না। কয়েকটি মেয়ে গলা শুনে আন্দাজে একে শনাক্ত করে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কেস প্রমাণ করা যায়নি। তার ওপর কেস চলাকালীন আগুন লেগে নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায়, জজ উকিল সাক্ষী সব মারাত্মক আহত হওয়ায় কেসটি স্থগিত হয়ে যায়। তারপরে যা হয়। না হল কিছু প্রমাণ, না কিছু অপ্রমাণ। না পেল বেনিফিট অব ডাউটে মুক্তি না হল কোনো বিশেষ শাস্তি। বছরের পর বছর নিঃশব্দে জেলের ঘানি টানছে। মিষ্টি ব্যবহার, উদাস হাবভাব, এসব দেখে কবেই তাকে সশ্রম থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। তবু কেন যে খালাস পায়নি। সেসব অজ্ঞাত। এর নাম ট্যাঁপা অথবা বামাকান্ত। চেহারা রাশভারী প্রফেসরের মতো, ট্যাঁপাবাবুই বলা উচিত। কিংবা ট্যাঁপা স্যার। জেলে থাকলেও তাঁর অপরাধের পরিচিতি অনেকদিন হারিয়ে গেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে সে একটা আপনভোলা ঐশ্বরিক হাসি দিত। অত ধর্ষণ করায় ট্যাঁপা সারের ধবজভঙ্গ হয়, তাঁর অপরাধ অপ্রমাণের এ-ও এক কারণ। তবু সেই প্রশাসনিক বিচারবিভাগীয় এবং আধিভৌতিক গাফিলতিতে তিনি জেলে থেকে যান।

    ট্যাঁপা ছিলেন ছোটোখাটো ব্যাবসাদার। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পার্টনার স্বভাবতই ব্যাবসাটি হাত করে নেয়। তাঁর স্ত্রী লজ্জায় ঘেন্নায় তাঁকে ছেড়ে চলে যান। দুটি সন্তান নিয়ে তিনি এখন তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে ঘরকন্না করছেন। আলিপুর সেন্ট্রাল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি প্রথমে তাঁর পুরোনো বাড়ি রাজারহাট বিষ্ণুপুরে এলেন। চিনতেই পারেন না। যেখানে তাঁর বাড়ি ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে এক ঝাঁ-চকচকে পেল্লাই কমপ্লেক্স। অর্থাৎ বাড়িটা, তার জমিটা সব কেউ কেঁপে নিয়েছে। তা নিক। সংবর্ধনার গাঁদার মালা খুলে ট্যাঁপাবাবু একটি বটতলায় একটু জিরোলেন। অবশিষ্ট শোভাযাত্রীদের বললেন, আমি ভাই সংসার ত্যাগ করেই গিয়েছিলাম। তিনি কপালে ভোগান্তি লিখেছিলেন। সবই তাঁর ইচ্ছা। সংসার অনিত্য। আমি সুযোগ পেলেই নগরাজ হিমালয়ে চলে যাব। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ এত কষ্ট করলেন। তবে জেলে থাকলেই বা কী হিমালয়ে থাকলেই বা কী! পার্থক্য নাই।

    শোভাযাত্রীরা কাঁদো কাঁদো মুখে চলে যেতে ট্যাঁপাবাবু গাঁদার মালাগুলো আবার পরে নিলেন। বাজারে গিয়ে কয়েকটি জবার মালাও কিনলেন। কালীমন্দিরে গিয়ে রক্তচন্দনের ফোঁটা পরলেন। তারপর গম্ভীর গলায় ওম কালীত্তারা ব্রহ্মময়ী হাঁকতে হাঁকতে গ্রামে গ্রামান্তরে, গঞ্জ থেকে মফসসল ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। শিষ্যসামন্ত মন্দ হল না, রোজগারপাতি চমৎকার। খালি পুরোনো অভ্যাসটি মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে ওঠে। অতদিন জেলখানায় থেকে তাঁর ধবজভঙ্গ অনেকদিন সেরে গেছে। কিন্তু চট করে ও পথে পা বাড়ান না। বয়সটাও হল বাহাত্তর। ভালো সুযোগের সন্ধানে থাকেন। বছর দশ থেকে পনেরো-ষোলোর দুটি চারটি হলেই চলবে।

    উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে আরও ছাড়া পেলেন উলোলো চুল এক বৈজ্ঞানিক। ইনি সাংঘাতিক সব বিষ তৈরি করছিলেন বলে জনরব। পৃথিবীর তামাম সন্ত্রাসবাদীরা তাঁর খদ্দের। কিন্তু আবারও, তাঁর মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ জানে না কেন তিনি আলাস্কার জেলে পচছেন। শুধুমাত্র বিষবিজ্ঞানী পরিচয়টুকু থাকার জন্যই অনেক দেশের সরকারই তাঁকে সাগ্রহে পুষতে চাইল। তিনি অটাওয়ায় এসে একটি ঠান্ডা পানীয়ের কারখানায় যোগ দিলেন। কাঁচা-পাকা চুল আর গোঁফের মধ্যে দিয়ে চোখ দুটো ঝিকঝিক করছে, যেন এক্ষুনি বলে উঠবেন, কী? কেমন জব্দ?

    বলা বাহুল্য, ছাড়া পেলেন অনেক কমিউনিস্ট, অনেক স্তালিনবিরোধী, নানা ধরনের রাজনৈতিক বন্দি। যুদ্ধবন্দি এবং অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিও, যাঁদের কোনো না কোনোভাবে ফাঁসানো হয়েছিল। এঁদের কেউ পছন্দ করল না, তেমন ক্যারিশমা ছিল না নিশ্চয়, জেল থেকে বেরিয়ে এঁরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন। সরকারকে কাউকেই ভাতা দিতে হল না। সবাই ভাবলেন—বাপ রে এই বেলা পালিয়ে যাই, আবার কী ছুতোয় আটক করবে কে জানে! অনেকে আপনজন খুঁজে পেলেন, অনেকে পেলেন না, ভিক্ষাবৃত্তি নিলেন কতজন। কতজন মারাই গেলেন। আপদ চুকে গেল। শাঁখ, বিউগল, মালা, বোকে কিছু না, এঁরা মহাপৃথিবীর জনস্রোতে হারিয়ে গেলেন।

    এঁদের মতোই বেরিয়ে এসেছিল একটি ছোট্টখাট্টো শুকনো-শাকনা গোছের মানুষ। বয়স কত? গাছপাথর নেই। নাম কী?–মনে নাই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইতিউতি চায়। এত মানুষ, এত গাড়ি, এত অট্টালিকা যেন সে কখনও দেখেনি। দু-তিনবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কোথায় ছিল? কেন ছিল? এখন কোথায় এল? কেন এল? প্রশ্নগুলো মানুষটার মনে উঠছে আর লয় পাচ্ছে। এত হাবাগোবাকে কোন দেশ নেবে? গায়ের রং হলদে ঘেঁষা। মাথায় কাফ্রিদের মতো কোঁকড়া চুল পেকে করকর করছে। শরীরের গড়নটা যেন ভারতীয়, নাকটা মাঝখান থেকে খাঁটি ইউরোপীয়দের মতো চড়া।

    চারদিকের শহর-ছবি গ্রাম-ছবি মানুষ-ছবি যেন একটা গোলকধাঁধার মতো। তার যেটুকু স্মৃতি আছে, মনে হয় কিছুই যেন তেমন নেই। থাকবেই বা কী করে? গাছপাথর নেই এমনই বয়স। কত যে ঠিক তা সে নিজেও জানে না। কেমন বেভভুল। খালি মনে হয়, হাওয়াটি তো তেমন করে বইছে না। চাঁদের রংটি তো তেমন চাঁপা-চাঁপা নেই। আকাশ এমন ফ্যাকফেকে কেন? কীসের এত দুর্গন্ধ!

    খুনখুন করে হাঁটতে থাকে বুড়ো। মাঠ বায়। নৌকো বায়। জাহাজ বায়। বিশ্ব আন্দোলনে জেল থেকে ছাড়া পেরেছে শুনে কেউ তাকে না করে না। মাথা গুঁজে থাকে, চাট্টি খায়। আর সমুদ্দুরের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ঢেউ উঠছে, ঢেউ পড়ছে। কালো জলে ফেনার সারি। আকাশ কোথায় সাগরে মিশছে বোঝা যায় না। কেমন যেন চেনা-চেনা। আবার অচেনা-অচেনা। আন্তর্জতিক অপরাধী হিসেবে তাকে ধরা হয়েছিল। ঘুরেছে জেল থেকে জেলান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। কত কী-ই যে তার চেনা, আধো-চেনা!

    কী করেছিলে গো বুড়ো?

    সে মাথা নাড়ে—কিছু করি নাই।

    ধরেছিল কেন?

    মনে নাই।–ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে।

    আহা! বিনিদোষে হাজতবাস করতে করতে ম্যাদা মেরে গেছে গো!

    এইভাবে ডোভার থেকে এডেন হয়ে মুম্বই বন্দরে ভিড়ল জাহাজ।

    এবার নেমে যাও বুড়ো। মাল খালাস করব, তারপর ফিরে যাব। ভাগো এবার।

    একজন বললে, একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি এ দেশের সরকারি আপিসে দেখিয়ো। খেতে পরতে থাকতে দেবে। এখন তো বাপু তোমাদের সাত খুন মাফ।

    এক খুনই বা কী, আর সাত খুনই বা কী! লোকটা কিছুই বোঝে না।

    জেলের মধ্যে বন্ধ থাকতে খুব কষ্ট। কিন্তু একটা নিয়মে থাকা তো! তাই লোকটা বেশ শক্তপোক্ত। সরকার কী খুব আবছাভাবে মনে পড়ছে তার। কিন্তু একে ওকে জিজ্ঞেস করে যদিবা সরকারি অফিসতক পৌঁছোল, দর্শনি দিতে না পারায় দরজা থেকেই হাঁকিয়ে দিল দারোয়ান।

    যাই হোক, বুড়ো অথচ শক্তপোক্ত, উপরন্তু কেমন নিষ্পাপ নরম চেহারার কারণে সে একটা কাজ পেল। বাড়ি ঘর সামলাবে, রান্না রসুই করবে, বাচ্চা দেখবে। সে আর এমন কী! জেলে থাকতে এর চেয়েও শক্ত কাজ সে হেলায় করেছে।

    এদের নাম দারুওয়ালা। পতি পত্নী দু-জনেরই দুটো ব্যাবসা। বেরোবার বা ফেরবার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। একটি লোক তাই বড়ই দরকার। দারুওয়ালারা প্রথমেই তার ছবি তুললেন। নাম কী?–অনেক চেষ্টা করে তার মনে হল ভিভি-ভিখু। বয়স? দেখেশুনে ওঁরাই বললেন, আনুমানিক সত্তর। নিরপরাধ বলে পৃথিবীময় যাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদেরই একজন।

    নিকটবর্তী থানায় ছবি সমেত পরিচয়পত্রটি জমা দিয়ে দারুওয়ালা দম্পতি ভিখুকে বাড়িতে তুললেন। সে যে খামোখা আটক ছিল তাতে তাঁদের কোনো সন্দেহই নেই।

    ভোর থাকতে থাকতে ছোট্ট আড়াই কামরার ফ্ল্যাটটি ঝাড়াপোঁছা করে সে। জল ভরে, বাসন মাজে, প্রাতরাশ তৈরি করে, বছর সাতের মেয়ে আর বছর পাঁচের ছেলেটিকে খেতে দেয়, টিফিন তৈরি করে, রাস্তার মোড়ে তাদের স্কুলবাসে তুলে দিয়ে আসে। বাড়ির তালা খুলে এবার ভেতরে ঢোকে সে। খুব একটা ভালো দৃশ্য নেই। তবু ছোট্ট বারান্দাটাতে কীসের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। সময় হলে ছেলেমেয়ে দুটিকে বাস রাস্তা থেকে বাড়ি নিয়ে আসে। খেতে দেয়। তারা ক্লাবে খেলতে যায়। সে বারান্দাতে বসে থাকে। দুর্বল মাথা, প্রাণপণে মনে করতে চেষ্টা করে কী তার নাম, কবে কোথায় প্রথম জেলে নিয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধী…।

    রাত আটটায় হয়তো মি. দারুওয়ালা ফিরলেন। মিসেসের ফিরতে আরও দু ঘন্টা। দু-জনে খেতে বসলেন। তাঁর যা যা খান সব শিখিয়ে দিয়েছেন ভিখুকে। সে দিব্যি মাংস বানায়, মোটা মোটা তন্দুরি রুটি, লাচ্ছা পরোটা, আচার কিনে আনে, সবজি বানায়, ডালভাজি কালিড়াল সব শিখে গেছে সে। তার মনিব খুশি। মুম্বইয়ের তুলনায় অনেক কম মাইনেতে পেয়েছেন তাঁরা লোকটিকে। প্রতিবেশীরা ঈর্ষা করে। বাচ্চা দুটিও ভারি খুশি। দু-জনে দাবা খেলে, কমপিউটার গেম খেলে। শান্ত হাত পা কোলে করে ভিখু বসে থাকে। ভেতরে কেমন একটা শান্তি। বয়স হয়ে গেছে, বেশি তো সময় আর নেই, পৃথিবীর মেয়াদ ফুরিয়ে এল। এইরকম একটা খাটা-খোটা নিশ্চিন্ত জীবন ইতিমধ্যে বেঁচে নিতে খারাপ লাগে না তার। রবিবার দিন ওঁরা এক এক সময়ে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যান। কোনো কোনো দিন নিজেরা বাড়িতে থেকে তাকেই একটু ঘুরতে পাঠান। এইভাবেই তিন-চার বছর কেটে যায়। দারুওয়ালারা ভাবেন আর কী চাই! ভিখু ভাবে এই তো বেশ।

    এক রবিবার বেশ দূরে একটু ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্র দেখে হাওয়া-টাওয়া খেয়ে এসে সে অবাক হয়ে দেখে বাড়ির দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে চক্ষুস্থির। ঘরে রক্তগঙ্গা। চারটি মৃতদেহ পড়ে আছে, মহিলা এবং তাঁর বাচ্চা মেয়েটির গায়ে কাপড় নেই। আলমারিতে চাবি ঝুলছে। একটা গোঙানির মতো আওয়াজ করে জ্ঞান হারিয়ে সেইখানেই পড়ে যায় ভিখু এবং এইভাবেই পুলিশ তাকে আবিষ্কার করে।

    অনুসন্ধানে বার হয় সেই দিনই দারুওয়ালারা আঠারো লাখ টাকা বাড়িতে এনেছিলেন, কিছুর একটা পেমেন্ট। যদিও খুনের অস্ত্র বা টাকাটা পাওয়া গেল না। তবু তার ইতিহাস এবং পরিস্থিতি তাকেই খুনি বলে সাব্যস্ত করে। আশপাশে সবাই বলতে লাগল, অত কম টাকায় অত ওস্তাদ নোকর। তখনই আমাদের সন্দেহ হয়েছিল! আসলে কিন্তু মোটেই সন্দেহ হয়নি।

    সরকার বনাম ভিখু মামলায় ভিখুর তরফের সরকার-প্রদত্ত দাতব্য উকিল প্রায় সারাক্ষণই মাথা ঝুলিয়ে বসে রইল। সরকারি প্লিডার বললেন, বিশ্ব হুজুগে কোনো কোনো ঘৃণ্য-অপরাধী ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। এ ব্যক্তিটি তাদেরই একজন। এবার অপরাধের শান্তি দিয়েই ছাড়ব। ধর্ষণ, খুন এবং জালিয়াতিও। কেননা ভিখু বলে পরিচিত সেই লোকটি আসল নাম লন্ডন জেলের আধপচা নথি পত্রের থেকে পাওয়া গেছে। ভগোয়ান পরসাদ। যে ভগোয়ান সে ভিখু সাজে কেন?

    সুতরাং একদিন নির্বিঘ্নে ভিখুর ফাঁসি হয়ে গেল। জল্লাদ এই সুযোগে নিজের মজুরি বাড়িয়ে নিল। পুলিশ অফিসারের প্রমোশন হল, দপ্তরের সবাইকে একদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারি খরচে ভূরিভোজ খাইয়ে দিলেন। ভিখুর লাশটাতে জল্লাদ সুদ্ধ থুথু ফেলল—বেইমান!!

    স্মৃতিভ্রষ্ট বেকুব ভাগোয়ান পরসাদের ফাঁসি হয়ে গেল। কিন্তু প্যান্ডোরার বাক্স থেকে ছাড়া পাওয়া শয়তান-পরসাদগুলি চতুর্থণ প্রতাপে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতে লাগল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }