Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্য – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    উপন্যাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পাতা গল্প594 Mins Read0

    পিত্রার্কা ও লরা

    এ কথা বোধ হয় বলাই বাহুল্য যে, দান্তের মতো পিত্রার্কাও একজন প্রখ্যাতনামা ইতালীয় কবি ছিলেন। দান্তে যেমন তাঁহার মহাকাব্যের মহান ভাব দ্বারা সমস্ত যুরোপমণ্ডল উত্তেজিত করিয়াছিলেন, পিত্রার্কাও তেমনি তাঁহার সুললিত গীতি ও গাথা দ্বারা সকলের মনোরঞ্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু দান্তে ও পিত্রার্কে আবার অনেক বিষয়ে এমন সৌসাদৃশ্য ছিল যে, সকল বিষয় উল্লেখ করিতে হইলে আমাদের এই প্রবন্ধটি অতি দীর্ঘকায় হইয়া পড়ে, সেইজন্য কেবল তাঁহাদের প্রণয়ের কথাই বর্ণনা করিতেছি।

    দান্তের যেমন বিয়াত্রিচে, পিত্রার্কার তেমনি লরা। দান্তের ন্যায় তাঁহার লরাও অপ্রাপ্য অনধিগম্য, দান্তের ন্যায় তিনিও দূর হইতে লরাকে দেখিয়াই আপনাকে কৃতার্থ মনে করিতেন। পিত্রার্কারও লরার সহিত তেমন ভালো করিয়া কথাবার্তা, আলাপ-পরিচয় হয় নাই। লরার ভবনে পিত্রার্কা কখনো যাইতে পান নাই, লরার নিকট হইতে তাঁহার প্রেমের কিছুমাত্র প্রত্যুপহার পান নাই। পিত্রার্কা কহিয়াছেন, লরা সংগীত ও কবিতার প্রতি উদাসীন। তাঁহার সমক্ষে তাহার মুখশ্রী সর্বদাই দৃঢ় ভাব প্রকাশ করিত। পিত্রার্কা তাঁহার অসংখ্য চিঠির মধ্যে একবার ভিন্ন কখনো লরার নামোল্লেখ করেন নাই, বোধ হয়, বন্ধুবর্গের প্রতি সাধারণ চিঠিপত্রে লরার নাম ব্যবহার করিতে তিনি কেমন সংকোচ বোধ করিতেন, বোধ হয় মনে করিতেন তাহাতে সে নামের গৌরব হানি হইবে। লরার যৌবনের অবসান, লরার মৃত্যু, তাঁহার প্রতি লরার ঔদাসীন্য কিছুই তাঁহার মহান প্রেমকে বিচলিত করিতে পারে নাই। বরঞ্চ লরার মৃত্যু তাঁহার প্রেমকে নূতন বল অর্পণ করে, কেননা এ পৃথিবীতে লরার সহিত তাঁহার সম্পর্ক অতি দূর ছিল, লরার প্রেম তাঁহার অপ্রাপ্য ও তাঁহার প্রেম লরার অগ্রাহ্য ছিল, কিন্তু লরা যখন দেহের সহিত সমাজ বন্ধন পরিত্যাগ করিয়া গেলেন, তখন পিত্রার্কা অসংকোচে লারা আত্মার চরণে তাঁহার প্রেম উপহার দিতেন ও লরা তাহা অসংকোচে গ্রহণ করিতেছেন কল্পনা করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেন। পিত্রার্কা কহিতেছেন–

    যে রাত্রে লরা এই পৃথিবীর দুঃখ যন্ত্রণা চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করিলেন, তাহার পররাত্রে তিনি স্বর্গ হইতে এই শিশিরে (শিশিরাক্ত পৃথিবীতে) নামিয়া আসিলেন, তাঁহার অনুরক্ত প্রেমিকের নিকট অবির্ভূত হইলেন ও হাত বাড়াইয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন– “সেই স্ত্রীলোক, যাহাকে দেখিয়া অবধি তোমার তরুণহৃদয় জন-কোলাহল হইতে বিভিন্ন পথে গিয়াছে, তাহাকে চেনো!’ যখন আমার অশ্রুজল তাঁহার বিয়োগ-দুঃখ সূচনা করিল, তখন তিনি কহিলেন, “যতদিন তুমি পৃথিবীর দাস হইয়া থাকিবে, ততদিন কিছুতেই সুখী হইতে পারিবে না। পবিত্র হৃদয়েরা জানেন, মৃত্যু অন্ধকার-কারাগার হইতে মুক্তি। যদি আমার আনন্দের এক-সহস্রাংশও তুমি জানিতে, তবে আমার মৃত্যুতে তুমি সুখ অনুভব করিতে।’ এই বলিয়া তিনি কৃতজ্ঞতার সহিত স্বর্গের দিকে নেত্র ফিরাইলেন। তিনি নীরব হইলে আমি কহিলাম, “ঘাতকদিগের দ্বারা প্রযুক্ত যন্ত্রণা ও বার্ধক্যের ভার কি সময়ে সময়ে মৃত্যু-যন্ত্রণাকে তীব্রতর করে না?’ তিনি কহিলেন, “স্বীকার করি, যন্ত্রণা ও সম্মুখস্থ অনন্তকালের আশঙ্কা মৃত্যুর পূর্বে অনুভব করা যায়, কিন্তু যদি আমরা ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করি, তবে প্রাণত্যাগ নিশ্বাসের ন্যায় অতি সহজ হয়! আমার বিকশিত যৌবনের সময় যখন তুমি আমাকে সর্বাপেক্ষা ভালোবাসিতে, তখন জীবনের প্রতি আমার অত্যন্ত মায়া ছিল, কিন্তু যখন আমি ইহা পরিত্যাগ করিলাম, তখন নির্বাসন হইতে স্বদেশে ফিরিয়া আসিবার আমোদ অনুভব করিতে লাগিলাম। তখন তোমার প্রতি দয়া ভিন্ন অন্য কষ্ট পাই না!’ আমি বলিয়া উঠিলাম, “সেই সত্যপ্রিয়তা যাহা তুমি পূর্বে জানিতে এবং সর্বান্তর্যামীর নিকট থাকিয়া এখন যাহা অধিকতর জান, সেই সত্যপ্রিয়তার নামে জিজ্ঞাসা করিতেছি, বলো, আমার প্রতি সেই দয়া কি প্রেমের দ্বারাই উত্তেজিত হয় নাই? আমার এই কথা শেষ না হইতে হইতেই দেখিলাম, সেই স্বর্গীয় হাস্য, যাহা চিরকাল আমার দুঃখের উপর শান্তি বর্ষণ করিয়া আসিয়াছে, সেই হাস্যে তাঁহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল– তিনি নিশ্বাস ফেলিলেন ও কহিলেন, “চিরকাল তুমি আমার প্রেম পাইয়া আসিয়াছ ও চিরকালই তাহা পাইবে। কিন্তু তোমার প্রেম সংযত করিয়া রাখা আমার উচিত মনে করিতাম!’ মাতা যখন তাহার পুত্রকে ভর্ৎসনা করেন, তখন যেমন তাঁহার ভালোবাসা প্রকাশ পায় এমন আর কখনো নয়। কতবার আমি মনে মনে করিয়াছি–“উনি উন্মত্ত অনলে দগ্ধ হইতেছেন, অতএব উঁহাকে আমার হৃদয়ের কথা কখনো বলিব না। হায়, যখন আমরা ভালোবাসি অথচ শঙ্কায় ত্রস্ত থাকি, তখন এ-সব চেষ্টা কী নিষ্ফল কিন্তু আমাদের সম্ভ্রম বজায় রাখিবার ও ধর্মপথ হইতে ভ্রষ্ট না হইবার এই একমাত্র উপায় ছিল। কতবার আমি রাগের ভান করিয়াছি, কিন্তু তখন হয়তো আমার হৃদয়ে প্রেম যুঝিতেছিল। যখন দেখিতাম তুমি বিষাদের ভরে নত হইয়া পড়িতেছ, তখন হয়তো তোমার প্রতি সান্ত্বনার দৃষ্টি বর্ষণ করিতাম, হয়তো কথা কহিতাম! দুঃখ এবং ভয়েই নিশ্চয় আমার স্বর পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল, তুমি হয়তো তাহা দেখিয়াছ! যখন তুমি রোষে অভিভূত হইয়াছ তখন হয়তো আমি আমার একটি দৃঢ়-দৃষ্টির দ্বারা তোমাকে শাসন করিতাম! এই-সকল কৌশল, এই সকল উপায়ই আমি অবলম্বন করিয়াছিলাম। এইরূপে কখনো অনুগ্রহ, কখনো দৃঢ়তার দ্বারা তোমাকে কখনো সুখী কখনো বা অসুখী করিয়াছি, যদিও তাহাতে শ্রান্ত হইয়াছিলে, কিন্তু এইরূপে তোমাকে সমুদয় বিপদের বাহিরে লইয়া গিয়াছিলাম, এইরূপে আমাদের উভয়কেই পতন হইতে পরিত্রাণ করিয়াছিলাম– এবং এই কথা মনে করিয়া আমি অধিকতর সুখ উপভোগ করি!’ যখন তিনি কহিতে লাগিলেন, আমার নেত্র হইতে অশ্রু পড়িতে লাগিল– আমি কাঁপিতে কাঁপিতে উত্তর দিলাম– যদি আমি তাঁহার কথা স্পর্ধাপূর্বক বিশ্বাস করিতে পারি, তবে আমি আপনাকে যথার্থ পুরস্কৃত জ্ঞান করি!– আমাকে বাধা দিয়া তিনি কহিলেন, বলিতে বলিতে তাঁহার মুখ আরক্তিম হইয়া আসিল “হা– অবিশ্বাসী, সংশয় করিতেছ কেন? যদিও আমার হৃদয়ে যেমন ভালোবাসা ছিল আমার নয়নে তেমন প্রকাশ পাইত কি না, সে কথা আমার রসনা কখনোই ব্যক্ত করিবে না, কিন্তু এই পর্যন্ত বলিতে পারি– তোমার ভালোবাসায়, বিশেষত তুমি আমার নামকে যে অমরত্ব দিয়াছ তাহাতে যেমন সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম এমন আর কিছুতে না। আমার এই একমাত্র ইচ্ছা ছিল তোমার অতিরিক্ততা কিছু শমিত হয়। আমার কাছে তোমার হৃদয়ের গোপন-কাহিনী খুলিতে গিয়া তাহা সমস্ত পৃথিবীর নিকট খুলিয়াছ এই কারণেই তোমার উপরে আমার বাহ্য-ঔদাসীন্য জন্মে। তুমি যতই দয়ার নিমিত্ত উচ্চৈঃস্বরে ভিক্ষা করিয়াছ, আমি ততই লজ্জা ও ভয়ে নীরব হইয়া গিয়াছি। তোমার সহিত আমার এই প্রভেদ ছিল– তুমি প্রকাশ করিয়াছিলে, আমি গোপন করিয়াছিলাম– কিন্তু প্রকাশে যন্ত্রণা যে বর্ধিত হয় ও গোপনে তাহা হ্রাস হয় এমন নহে।’ তাঁহার অনুরক্ত তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তাঁহার সহিত যুক্ত হইবার আর কত বিলম্ব আছে? লরা এই বলিয়া চলিয়া গেলেন, “যতদূর আমি জানি তাহাতে তুমি আমার বিয়োগ সহিয়া অনেক দিন পৃথিবীতে থাকিবে।’ পিত্রার্কা লরার মৃত্যুর পর ছাব্বিশ বৎসর বাঁচিয়াছিলেন।

    এইরূপে পিত্রার্কা লরার দৃঢ়তা, তাঁহার প্রতি উদাসীনতার মধ্য হইতেও তাঁহার আপনার ইচ্ছার অনুকূল অর্থ ব্যাখ্যা করিয়া লইয়াছিলেন। তিনি সহজেই মনে করিতে পারেন যে, লরার তাঁহার প্রতিই এত বিশেষ উদাসীনতার কারণ কী, তিনি তো তাহার বিরক্তিজনক কোনো কাজ করেন নাই। অবশ্যই লরা তাঁহাকে ভালোবাসে। এই মীমাংসা অনেকে বুঝিতে না পারুন, কিন্তু ইহার মধ্যে অনেকটা সত্য প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। লরা যদি তাঁহাকে ভালো না বাসিত, তবে অন্য লোকের সহিত যেরূপ মুক্তভাবে কথাবার্তা করিত, তাঁহার সহিতও সেইরূপ করিত; এ কথাটার মধ্যে অনেকটা হৃদয়-তত্ত্বজ্ঞতা আছে, কিন্তু ইহা যে ঠিক সত্য, তাহা বলা যায় না, লরা যে তাঁহাকে ভালোবাসিত, তাহার কোনো প্রমাণ নাই। পিত্রার্কা যেরূপ প্রকাশ্যভাবে কবিতা দ্বারা তাঁহার প্রণয়িনীর আরাধনা করিতেন, তাহাতে লরা তাঁহার প্রতি ঔদাসীন্য দেখাইয়া বিবেচনার কাজ করিয়াছিল– পিত্রার্কার সহিত সামান্য কতোপকথনেও তাহার উপর লোকের সন্ধিগ্ধচক্ষু পড়িত, সন্দেহ নাই। বিশেষত লরার স্বামী অতিশয় সন্ধিগ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। যতদূর জানা গিয়াছে তাহাতে লরা অতিশয় সুগৃহিণী ছিল বলিয়াই তো স্থির হইয়াছে। যদি সত্য সত্যই লরা মনে মনে পিত্রার্কাকে ভালোবাসিতেন, তবে আমরা লরার একটি মহান মূর্তি দেখিতে পাই– ভালোবাসিয়াছেন অথচ প্রকাশ করেন নাই– পিত্রার্কার প্রেমে কিছুমাত্র উৎসাহ দেন নাই– বরং তাঁহার প্রেমের স্রোত ফিরাইতেই চেষ্টা করিয়াছিলেন–প্রেম তাঁহাকে তাঁহার কর্তব্যপথ হইতে কিছুমাত্র বিচলিত করিতে পারে নাই, বরং বোধ হয় তাঁহাকে কর্তব্যপথে অধিকতর নিয়োজিত করিয়াছিল।

    জন-কোলাহল হইতে দূর থাকিবার জন্য পিত্রার্কা ভোক্লুসের উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। এই উপত্যকার দৃশ্য অতিশয় সুন্দর। এখানকার মোহিনী বিজনতার মধ্যে থাকিয়া, পিত্রর্কার হৃদয় হইতে যে প্রথম কবিতা উৎসারিত হয় তাহা লরার উদ্দেশ্যে প্রেম-গীতি। প্রকৃতির প্রতি সৌন্দর্যের মধ্যে তিনি যেন লরার সত্তা অনুভব করিতেন।

    প্রতি উচ্চ-শাখাময় সরল কানন
    প্রতি স্নিগ্ধ ছায়া মোর ভ্রমণের স্থান;
    শৈলে শৈলে তাঁর সেই পবিত্র-আনন
    দেখিবারে পায় মোর মানস-নয়ন।
    সহসা ভাবনা হতে উঠি যবে জাগি,
    প্রেমে মগ্ন মন মোর বলে গো আমায়
    “কোথায় ভ্রমিছ ওগো, ভ্রমিছ কী লাগি?
    কোথা হতে আসিয়াছ, এসেছ কোথায়?’
    হৃদে মোর এইসব চঞ্চল-স্বপন
    ক্রমে ক্রমে স্থির চিন্তা করে আনয়ন,
    আপনারে একেবারে যাই যেন ভুলি
    দহে গো আমারে শুধু তারি চিন্তাগুলি।
    মনে হয় প্রিয়া যেন আসিয়াছে কাছে
    সে ভুলে উজলি উঠে নয়ন আমার,
    চারি দিকে লরা যেন দাঁড়াইয়া আছে
    এ স্বপ্ন না ভাঙে যদি কী চাহি গো আর?
    দেখি যেন (কেবা তাহা করিবে বিশ্বাস?)
    বিমল সলিল কিংবা হরিত কানন
    অথবা তুষার-শুভ্র উষার আকাশ
    তাঁহারি জীবন্ত-ছবি করিছে বহন!
    …
    দুর্গম-সংসারে যত করি গো ভ্রমণ,
    ঘোরতর মরু মাঝে যতদূর যাই,
    কল্পনা ততই তার মুরতি মোহন
    দিশে দিশে আঁকে, যেন দেখিবারে পাই।
    অবশেষে আসে ধীরে সত্য সুকঠোর
    ভাঙি দেয় যৌবনের সুখস্বপ্ন মোর!

    কখনো বা সেই মনোহর শৈলের প্রতি নির্ঝর তটিনী বৃক্ষলতায়, তিনি তাঁহার বিষণ্ণ-মর্মের নিরাশা সংগীত গাহিয়া গাহিয়া বেড়াইতেন–

    বিমল বাহিনী ওগো তরুন-তটিনী।
    উজ্জ্বল-তরঙ্গে তব, প্রেয়সী আমার–
    ভক্ত হৃদয়ের মম একমাত্র দেবী
    সৌন্দর্য তাঁহার যত করেছেন দান!
    শুন গো পাদপ তুমি, তব দেহ-“পরে
    ভর দিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন সে দেবী,
    নত হয়ে পড়েছিল ফুল পত্রগুলি
    বসনের তলে; বক্ষ সুবিমল তার
    পরশিয়াছিলে তব সুধা আলিঙ্গনে।
    তুমি বায়ু সেইখানে বহিতেছ সদা
    যেইখানে প্রেম আসি দেখাইলা মোরে
    প্রিয়ার নয়নে শোভে ভাণ্ডার তাহার!
    শুন গো তোমরা সবে আর-একবার
    এই ভগ্ন-হৃদয়ের শেষ দুঃখ-গান!
    অবশ্য ফmবে যদি ভাগ্যের লিখন!
    অবশ্যই অবশেষে প্রেম যদি মোর
    অশ্রুময় আঁখিদ্বয় করে গো মুদিত,
    ভ্রমিবে যখন আত্মা স্বদেশ আকাশে
    তখন দেখো গো যেন এই প্রিয়-স্থানে
    অভাগার শেষ-চিহ্ন হয় গো নিহিত!
    মরণের কঠোরতা হবে কত হ্রাস,
    যদি এই প্রিয় আশা, সেই ভয়ানক
    অনন্তের পথ করে পুষ্প-বিকীরিত!
    এই কাননের মতো সুশীতল ছায়া
    কোথা আছে পৃথিবীতে, শ্রান্ত আত্মা যেথা
    এক মুহূর্তের তরে করিবে বিশ্রাম!
    নাহিকো এমন শান্ত হরিত-কবর
    যেখানে সংসার-শ্রমে পরিশ্রান্ত -দেহ
    ঘুমাইবে পৃথিবীর দুখ শোক ভুলি!
    …
    বোধ হয় একদিন সে মোর প্রেয়সী
    স্বর্গীয়-সুন্দরী সেই নিষ্ঠুর-দয়ালু–
    একদিন এইখানে আসিবে কি ভাবি,
    যেইখানে একদিন মুগ্ধ নেত্র মোর
    উজ্জ্বল সে নেত্র-‘পরে রহিত চাহিয়া!
    হয়তো নয়ন তাঁর আপনা আপনি
    খুঁজিয়া খুঁজিয়া মোরে চারি দিক পানে
    আমার কবর সেই পাইবে দেখিতে!
    হয়তো শিহরি তার উঠিবে অন্তর,
    হয়তো একটি তার বিষাদ-নিশ্বাস
    জাগাইবে মোর ‘পরে স্বর্গের করুণা!
    …
    এখনো সে মনে পড়ে — যবে পুষ্প বন
    বসন্তের সমীরণে হইয়া বিনত
    সুরভিকুসুমরাশি করিত বর্ষণ,
    তখন রক্তিম-মেঘে হইয়া আবৃত
    বসিতেন প্রকৃতির উপহার মাঝে।
    কভু বা বসনে তাঁর কভু বা কুন্তলে
    প্রকৃতি কুসুম-গুচ্ছ দিত সাজাইয়া।
    চারি দিকে তাঁর, কভু তটিনী-সলিলে–
    কভু বা তৃণের ‘পরে পড়িত ঝরিয়া
    পুষ্প বন হতে কত পুষ্প রাশি রাশি!
    চারি দিকে তরুলতা কহিত মর্মরি
    “প্রেম হেথা করিয়াছে সাম্রাজ্য বিস্তার!’

    পূর্বেই বলিয়াছি, পিত্রার্কার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, বা এক-একবার বিশ্বাস হইত যে লরা তাঁহাকে ভালোবাসে। অনেক কবিতাতেই তাঁহার এই বিশ্বাস প্রকাশ পাইত। অনুরাগের নেত্র অনুরাগের কাহিনী যেমন পড়িতে পারে, যুক্তিকে তাহার নিকট অনেক সময় পরাস্ত মানিতে হয়। লরার দৃঢ় দৃষ্টির মধ্যে হয়তো পিত্রার্কা গুপ্তপ্রেমের আভা দেখিতে পাইয়াছিলেন, যুক্তি এখন তাহা অনুধাবন করিতে পারিতেছে না, হয়তো তখনো পারিত না। এক সময়ে পিত্রার্কা যখন দূর-দেশে ভ্রমণ করিবার জন্য যাইতেছিলেন, তখন লরাকে দেখিয়া তিনি কহিতেছেন–

    সুকোমল ম্লান ভাব কপোলে তাঁহার
    ঢাকিল সে হাসি তাঁর, ক্ষুদ্র মেঘ যথা!
    প্রেম হেন উথলিল হৃদয়ে আমার
    আঁখি কৈল প্রাণপণ কহিবারে কথা!
    তখন জানিনু আমি স্বরগ-আলয়ে
    কী করিয়া কথা হয় আত্মায় আত্মায়
    উজলি উঠিল তাঁর দয়া দিকচয়ে
    আমি ছাড়া আর কেহ দেখে নি গো তায়!
    …
    সবিষাদে অবনত নয়ন তাঁহার
    নীরবে আমারে যেন কহিল সে এসে,
    “কে গো হায় বিশ্বাসী এ বন্ধুরে আমার
    লইয়া যেতেছে ডাকি এত দূর-দেশে?’

    শীতের পত্রহীন তরুশাখায় বসিয়া সন্ধ্যাকালে বিহঙ্গম বিষণ্ণ-সংগীত গাহিতেছিল, কবির হৃদয়ের স্বরে তাহার স্বর মিলিয়া গেল, তিনি গাহিয়া উঠিলেন–

    হা রে হতভাগ্য বিহঙ্গম সঙ্গীহীন!
    সুখ-ঋতু অবসানে গাহিছিস গীত!
    ফুরাইছে গ্রীষ্ম ঋতু ফুরাইছে দিন
    আসিছে রজনী ঘোর আসিতেছে শীত!
    ওরে বিহঙ্গম, তুই দুখ-গান গাস
    যদি জানিতিস কী যে দহিছে এ প্রাণ
    তা হলে এ বক্ষে আসি করিতিস বাস,
    এর সাথে মিশাতিস বিষাদের গান!
    কিন্তু হা– জানি না তোর কিসের বিষাদ,
    ভ্রমিস রে যার লাগি গাহিয়া গাহিয়া,
    হয়তো সে বেঁচে আছে বিহঙ্গিনী প্রিয়া,
    কিন্তু মৃত্যু এ কপালে সাধিয়াছে বাদ!
    সুখ দুঃখ চিন্তা আশা যা-কিছু অতীত,
    তাই নিয়ে আমি শুধু গাহিতেছি গীত!

    যখন তাঁহার লরার বর্তমানে প্রকৃতির মুখশ্রী আরও উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিত, তখন তিনি গাহিতেন–

    কী সৌন্দর্য-স্রোত হোথা পড়িছে ঝরিয়া!
    স্বর্গ দিতেছেন ঢালি কী আলোক-রাশি!
    …
    চরণে হরিত-তৃণ উঠে অঙ্কুরিয়া
    শত বর্ণময় ফুল উঠিছে বিকাশি!
    হর্ষময় ভক্তিভরে সায়াহ্ন-বিমান
    সমুদয় দীপ তার করেছে জ্বলিত,
    প্রচারিতে দিশে দিশে তার যাশোগান
    পাইয়া যাহার শোভা হয়েছে শোভিত।

    আবার কখনো বা সন্ধ্যাকালে একাকী বিজনে বসিয়া ভগ্নহৃদয়ে নিরাশার গীতি গাহিতেছেন–

    স্তব্ধ সন্ধ্যাকালে যবে পশ্চিম আকাশে
    রবি অস্তাচলগামী পড়েছে ঢলিয়া,
    বৃদ্ধ যাত্রী কোন্‌ এক অজ্ঞাত প্রবাসে
    শ্রান্ত-পদক্ষেপে একা যেতেছে চলিয়া।
    তবু যবে ফুরাইয়া যাবে শ্রম তার,
    তখন গভীর ঘুমে মজিয়া বিজনে
    ভুলে যাবে দিবসের বিষাদের ভার,
    যত ক্লেশ সহিয়াছি সুদূর-ভ্রমণে!
    কিন্তু হায় প্রভাতের কিরণের সনে
    যে জ্বালা জাগিয়া উঠে হৃদয়ে আমার
    রবি যবে ঢলি পড়ে পশ্চিম গগনে
    দ্বিগুণ সে জ্বালা হৃদি করে ছারখার!
    প্রজ্বলন্ত রথচক্র নিম্ন পানে যবে
    লয়ে যান সূর্যদেব, অসহায় ভবে
    রাখি রাত্রি-কোলে, যার দীর্ঘীকৃত ছায়া
    প্রত্যেক গিরিশিখর সমুন্নত-কায়া
    উপত্যকা- ‘পরে দেয় বিস্তারিত করি;
    তখন কৃষক হল লয়ে স্কন্ধোপরি,
    ধরি কোন্‌ গ্রাম্যগীত অশিক্ষিত স্বরে
    চিন্তা ঢালি দেয় তার বন্য-বায়ু-‘পরে!
    …
    চিরকাল সুখে তারা করুক যাপন!
    আমার আঁধার দিনে হর্ষের কিরণ
    এক তিল অভাগারে দেয় নি আরাম,
    এক মুহূর্তের তরে দেয় নি বিরাম!
    যে গ্রহ উঠিয়া কেন উজলে বিমান
    আমার যে দশা তাহা রহিল সমান!
    দগ্ধ হয়ে মর্মভেদী মর্ম-যন্ত্রণায়
    এ বিলাপ করিতেছি, দেখিতেছি হায়–
    অতি ধীর পদক্ষেপে স্বাধীনতা সুখে
    হল-যুগ-মুক্ত বৃষ ধায় গৃহ-মুখে!
    আমি কি হব না মুক্ত এ বিষাদ হতে,
    সদাই ভাসিবে আঁখি অশ্রু-জল-স্রোতে।
    তার সেই মুখপানে চাহিল যখন
    কী খুঁজিতেছিল মোর নয়ন তখন?
    এক দৃষ্টে চাহিনু স্বর্গীয় মুখপানে
    সৌন্দর্য অমনি তার বসি গেল প্রাণে
    কিছুতে সে মুছিবে না যত দিনে আসি
    মৃত্যু এই জীর্ণ-দেহ না ফেলে বিনাশি!

    এই বলিয়া আমরা এই প্রবন্ধের উপসংহার করি যে, পিত্রার্কা তাঁহার সমসাময়িক লোকদিগের নিকট হইতে যেমন আদর পাইয়াছিলেন, এমন বোধ হয় আর কোনো কবি পান নাই। একদিনেই তিনি প্যারিস ও রোম হইতে লরেল-মুকুট গ্রহণ করিবার জন্য আহূত হন। তিনি নানা দেশে ভ্রমণ করেন, এবং যে দেশে গিয়াছিলেন সেইখানেই তিনি সমাদৃত হইয়াছিলেন। নৃপতিরা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করিতেন। তিনি যে রাজসভায় বাস করিতেন, কখনো তাঁহাকে অধীনভাবে বাস করিতে হয় নাই, তিনি যেন রাজ-পরিবারমধ্যে ভুক্ত হইয়া থাকিতেন। লরার নামকে তিনি অমরত্ব প্রদান করিলেন বলিয়া তিনি মনে মনে যে সন্তোষময় গর্ব অনুভব করিতেন, তাঁহার সে গর্ব সার্থক হইল। পাঁচশত বৎসরের কালস্রোত পৃথিবীর স্মৃতিপট হইতে লরার নাম মুছিয়া ফেলিতে পারে নাই। তাঁহার নামের সহিতই চিরকাল লরার নাম যুক্ত হইয়া থাকিবে; পিত্রার্কাকে স্মরণ করিলেই লরাকে মনে পড়িবে, লরাকে স্মরণ করিলেই পিত্রার্কাকে মনে পড়িবে।

    ভারতী, আশ্বিন, ১২৮৫

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    Next Article সাহিত্যের স্বরূপ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }