Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সাহিত্য – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    উপন্যাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পাতা গল্প594 Mins Read0

    বাঙালি কবি নয় কেন?

    “বাঙালি কবি নয় কেন?” এ প্রশ্ন লইয়া গম্ভীর ভাবে আলোচনা করিতে বসিলে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের হয়তো ঈষৎ হাস্যরসের উদ্রেক হয়। তাঁহারা বলিবেন, প্রথম প্রশ্ন হউক, “বাঙালি কী” পরে দ্বিতীয় প্রশ্ন হইবে, “বাঙালি কী নয়”! যদি জিজ্ঞাসাই করিতে হইল, তবে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করা যায় “বাঙালি দার্শনিক নয় কেন”, “বাঙালি বৈজ্ঞানিক নয় কেন” “বাঙালী শিল্পী নয় কেন”, “বাঙালি বণিক নয় কেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। বাঙালি জাতির মতো এমন একটা অবাবাত্মক গুণসমষ্টির সম্বন্ধে যদি প্রশ্ন করা যায় যে বাঙালিতে অমুক বিশেষ গুণের অভাব দেখা যায় কেন, তাহা হইলে শ্রোতারা সকলে সমস্বরে হাসিয়া উঠিয়া কহিবেন বাঙালিতে কী গুণের ভাব দেখিতে পাইতেছ? এরূপ ঘটনায় আমাদের মনে আঘাত লাগিতে পারে কিন্তু ইহার বিরুদ্ধে কি আমাদের একটি কথা কহিবার আছে? “বাঙালি কী” ইহা অপেক্ষা সুরূহ সমস্যা কি আর কিছু হইতে পারে? ও “বাঙালি কী নয়” ইহা অপেক্ষা সহজ প্রশ্ন কি আর আছে?

    তবে আজ, বাঙালি কবি নয় কেন, এ প্রশ্ন লইয়া আলোচনা করিতে বসিবার তাৎপর্য কী? তাহার তাৎপর্য এই যে, আজকাল শত সহস্র বঙ্গীয় বালক আধ পয়সা মূলধন লইয়া (বিদেশী মহাজনদিকের নিকট হইতে ধার করা) দিন রাত প্রাণপণপূর্বক বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে কবিত্ব চাষ করিতেছেন; আজ যখন দেখিলেন বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্র তাঁহাদের যত্নে কাঁটা গাছ ও গুল্মে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, তখন তাঁহারা কপালের ঘাম মুছিয়া হর্ষ-বিস্ফারিত নেত্রে দশ জন প্রতিবাসীকে ডাকিয়া কহিতেছেন, “আহা, জমি কী উর্বরা!” বঙ্গবাসীগণ স্বপ্নেও স্বজাতিকে দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক বলিয়া অহংকার করিয়া বেড়ান না, অতএব সে বিষয়ে তাঁহাদের আত্মবিস্মৃতি লক্ষিত হয় না; কিন্তু সম্প্রতি দেখিতেছি তাঁহারা রাশীকৃত অসার কবিত্বের খড় তাঁহাদের কাক-পুচ্ছে গুঁজিয়া দিন রাত্রি প্রাণপণে পেখম তুলিয়া থাকিতে চেষ্টা করেন, এমন-কি, ভালো ভালো কুলীন ময়ূরদের মুখের কাছে অম্লান বদনে পেখম নাড়িয়া আসেন; অতএব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে ময়ুর বলিয়া তাঁহাদের মনে মনে অত্যন্ত অভিমান হইয়াছে। কিন্তু তাঁহাদিগকে দশ জন লোক নিযুক্ত রাখিতে হইয়াছে, যাহারা অগ্রে অগ্রে যাইয়া উচ্চেঃস্বরে ঘোষণা করিতে থাকে, “আমাদের পশ্চাতে যাঁহাদের দেখিতেছ, তাঁহারা কাক নন, তাঁহারা ময়ূর!” আজকাল তো এইরূপ দেখিতেছি। বহু দিন হইতে ভাবিতেছি, বাঙালি কেন আপনাকে কবি বলিয়া এত অহংকার করে, জিজ্ঞাসা করিলে অনেকে বলে, “দেখিতেছ না, আজকাল বাংলার সকলেই কবিতা লেখে!” সকলেই মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাংলা বর্ণমালা কাগজে গাঁথিতেছে, তাহা দেখিয়াই যদি বাঙালি জাতিকে বিশেষ রূপে কবি জাতি আখ্যা দেও, হে চাষা,ক্ষেত্রে অগণ্য কাঁটা গাছ দেখিয়া ফসল ভ্রমে যদি তোমার মনে বড়ো আনন্দ হইয়া থাকে, তবে তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমার সে ভ্রম ভাঙা আবশ্যক।

    যদি এমন একটা কথা উঠে যে, ইংরাজ কবি কেন, তবে তাহা দুই দণ্ড আলোচনা করিতে ইচ্ছা করে। ভাবিয়া দেখিলে কি আশ্চর্য বোধ হয় না যে, যে ইংরাজেরা এমন কাজের লোক, বাণিজ্যবৃত্তি যাহাদের ব্যবসায়, সময়কে যাহারা কান ধরিয়া খাটাইয়া লয়, একটি মিনিটকেও ফাঁকি দিতে দেয় না, জীবিকার জন্য যাহাদিগকে সংগ্রাম করিতে হয়, বাহ্য সুখসম্পদই যাহাদের উপাস্য দেবতা, যাহারা রাজ্যতন্ত্রীয় মহাসাগরে দিনরাত মগ্ন থাকিয়া প্রত্যেকেই নিজ নিজ পুচ্ছ আস্ফালনে সেই সমুদ্রকে অবিরত ফেনিত প্রতিফেনিত করিতেছে, তাহারা এমন কবি হইল কিরূপে? ইংলন্ড দেশে, অমন একটা ঘোরতর কাজের ভিড়ের মধ্যে, হাটবাজারের দর-দামের মধ্যে, বড়ো রাস্তার ঠিক পাশেই– যেখানে আমদানি ও রপ্তানির বোঝাই করা গাড়ি দিনরাত আনাগোনা করিতেছে– সেখানে কী করিয়া কবিতার মতো অমন একটি সুকুমার পদার্থ নিজের সাধের নিকেতন বাঁধিল? আর আমরা যে, এই বঙ্গদেশে সূর্যাতপে বসিয়া ঘুমন্ত ঝিমন্ত স্বপ্নন্ত জীবন বহন করিতেছি, শত শহস্র অভাব আছে অথচ একটি অভাব অনুভব করি না, বাঁচিয়া থাকিলেই সন্তুষ্ট, অথচ ভালো করিয়া বাঁচিয়া থাকিবার অবশ্যক বিবেচনা করি না, আমরা কেন উচ্চ শ্রেণীর কবি হইলাম না? অনেক কারণ আছে।

    আমাদের জাতীয় চরিত্রে উত্তেজনা নাই। উত্তেজনা নাই বলিতে বুঝায়, আমরা কিছুই তেমন গভীর রূপে, তেমন চূড়ান্ত রূপে অনুভব করিতে পারি না। ঘটনা ঘটে, আমাদের হৃদয়ের পদ্মপত্রের উপর পড়িয়া তাহা মুহূর্তকাল টলমল করে, আবার পিছলিয়া পড়িয়া যায়। এমন কিছুই ঘটিতে পারে না, যাহা আমাদের হৃদয়ের অতি মর্মস্থলে প্রবেশ করিয়া সেখানে একটা আন্দোলন উপস্থিত করিতে পারে। আমরা সন্তুষ্ট প্রকৃতির লোক। সন্তুষ্ট প্রকৃতির অর্থ আর কিছুই নহে। তাহার অর্থ এই যে, আমাদের অনুভাবকতা তেমন তীব্র নহে, আমরা সুখ ও দুঃখ তেমন প্রাণপণে অনুভব করিতে পারি না। সুখ যদি আমাদের চক্ষে তেমন স্পৃহনীয় ঠেকিত, দুঃখ যদি আমাদের নিকট তেমন ভীতিজনক দন্ত বিকাশ করিত, তাহা হইলে কি আমরা অদৃষ্ট নামে একটা বল্‌গা-রজ্জুহীন ছুটন্ত অন্ধ অশ্বের উপর চড়িয়া বসিয়া নিশ্চিন্ত ভাবে ঢুলিতে পারিতাম? আমাদের ঘৃণা নাই, আমাদের ক্রোধ নাই, অন্তর্দাহী জ্বলন্ত আগ্নেয় পদার্থের ন্যায় চিরস্থায়ী প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি নাই। একটা অন্যায় ব্যবহার শুনিলে ঘৃণায় আমাদের আপাদমস্তক জ্বলিতে থাকে না। একটা অন্যায়াচরণ পাইলে আমরা ক্রোধে আত্মহারা হই না, ও যতক্ষণ না তাহার প্রতিহিংসা সাধন করিতে পারি ততক্ষণ আমাদের হৃদয়ের মধ্যে রক্ত ফুটিতে থাকে না। আমাদের ক্ষীণ দুর্বল শরীরে অত উত্তেজনা সহিবেই বা কেন? আমাদের এই অল্প পরিসর বক্ষের মধ্যে, আমাদের এই জীর্ণ-জর্জর হাড় কখানির ভিতরে অত ঘৃণা, অত ক্রোধ যদি জ্বলিতে থাকে, সুখে ও দুঃখে যদি অত তরঙ্গ তুলিতে থাকে, তবে আমাদের পঞ্চাশ বৎসরের পরমায়ু কত সংক্ষিপ্ত হইয়া আসে! আমাদের মতো এমন একটি ভগ্নপ্রবণ এঞ্জিনে অত অগ্নি, অত বাষ্প সহিবে কেন? মুহূর্তে ফাটিয়া যাইবে। আমাদের হৃদয়ে বিস্ফারক মনোবৃত্তি সকল যেমন হীনপ্রভ, সংকোচক মনোবৃত্তি সকল তেমনি স্ফূর্তিমান। আমরা ভয়ে জড়োসড়ো হই, লজ্জায় মাটিতে মিশাইয়া যাই। সে লজ্জা আবার আত্মগ্লানি নহে, আত্মগ্লানির দাহকতা আছে; দোষ করিয়া নিজের নিকট নিজে লজ্জিত হওয়া তো পৌরুষিকতা। আমাদের লজ্জা, দশ জনের চোখের সুমুখে পড়িয়া জড়োসড়ো হইয়া যাওয়া, পরের নিন্দা-সূচক ঘৃণার দৃষ্টিপাতে মরোমরো হইয়া পড়া, একটা ঘোমটা থাকিলেই আর এ-সকল লজ্জা থাকিত না। যে-সকল মনোবৃত্তিতে উত্তেজিত করে ও একটা-কোনো কার্যে উদ্যত করে তাহা আমাদের নাই, কিন্তু যে-সকল মনোবৃত্তিতে আমাদের সংকুচিত করে ও সকল কার্য হইতে বিরত করে তাহা আমাদের কাছে। আমাদের দেশে রাগারাগি হইয়া তৎক্ষণাৎ একটা খুনাখুনি হইয়া যায় না। বলবান জাতিদের মতো বিশেষ রাগ হইলেই অমনি ঘুষি আগেই লাফাইয়া উঠে না, রাগ হওয়া ও হাতাহাতি হওয়ার মধ্যে একটি দীর্ঘ ব্যবধান গালাগালিতেই কাটিয়া যায় এবং আমাদের দুর্বল-শরীরে ক্রোধ সেই সময়ের মধ্যেই প্রায় প্রাণ ত্যাগ করে। কেবল রাগ নহে আমাদের সমস্ত মনোবৃত্তিই এত দুর্বল যে তাহারা তাহাদের ক্ষীণ হস্তে ধাক্কা মারিয়া আমাদের কোনো একটা কাজের মধ্যে ঠেলিয়া দিতে পারে না। যদি বা দেয় তো সে কাজ সমাপ্ত হইতে-না-হইতে সে নিজে পলায়ন করে; যদি বা লিখিতে বস তবে বড়োজোর কর্তা ও কর্ম পর্যন্ত লেখা হয়, কিন্তু ক্রিয়া কোনো কালে লেখা হয় না; যেমন, যদি লিখিতে চাও যে, “বঙ্গনন্দন বাবু দেশলাই প্রস্তুত করিতেছেন” তবে বড়োজোর “বঙ্গনন্দন বাবু” ও “দেশলাই” পর্যন্ত লেখা হয়, কিন্তু “প্রস্তুত করিতেছেন” পর্যন্ত আর লেখা হয় না। বলাই বাহুল্য যে, যাহার মনোবৃত্তি সকল অত্যন্ত দুর্বল, সে কখনো কবি হইতে পারে না। যে বিশেষরূপে অনুভব করে না সে বিশেষ রূপে প্রকাশ করিতে পারে না। বলা বাহুল্য যে, বাঙালির হৃদয়ে ভাবের অর্থাৎ অনুভাবকতার গভীরতা, বলবত্তা নাই, তাহা যদি থাকিত তবে কার্যের এত দরিদ্রদশা কেন থাকিবে? অতএব বাঙালি জাতি যদি না ভাবে তো সে প্রকাশ করিবে কীরূপে? কবি হইবে কীরূপে?

    আমরা যে এত অনুভব কম করি কেবলমাত্র অনুভাবকতার অল্পতা তাহার কারণ নহে। তাহার কারণ আমাদের কল্পনার দৃষ্টি অতি সামান্য। যে ব্যক্তির কল্পনা অধিক, সে ব্যক্তির অনুভাবকতাও তেমনি তীক্ষ্ণ। কল্পনা আমাদের হৃদয়ে দর্পনের ন্যায় বর্তমান। যাহার কল্পনা মার্জিত ও মসৃণ তাহার হৃদয়ে প্রতিবিম্ব অতি সমগ্র ও সম্পূর্ণ হয়; প্রতিবিম্বও সত্য পদার্থের মতো প্রতিভাত হয়, কিন্তু মলিন কল্পনায় প্রতিবিম্ব অতি অস্পষ্ট হয়, ভালো করিয়া দেখা যায় না। একটা ঘটনা যদি হৃদয়ে ভালো করিয়া প্রতিবিম্বিতই না হইল, যদি তাহা ভালো করিয়া দেখিতেই না পাইলাম, তবে তজ্জনিত সুখ বা দুঃখ হইবে কেন? একজন কাল্পনিক ব্যক্তি যখন বহুদিন পরে বিদেশ হইতে দেশাভিমুখে যাত্রা করে, তখন দেশে আসিলে তাহার আত্মীয় বন্ধুদিগের নিকট কীরূপে সমাদর পাইবে, তাহার এমন একটি জাজ্বল্যমান চিত্র তাহার কল্পনাপটে অঙ্কিত হয় যে, সে আনন্দে অধীর হইয়া পড়ে। সে চক্ষু মুদিয়া স্পষ্ট অনুভব করিতে পারে, যেন সে তাহার সেই পুরাতন বাটির প্রাঙ্গণে গিয়া পৌঁছিয়াছে, সেই সম্মুখে আতা গাছটি রহিয়াছে, এক পাশে গাভীটি বাঁধা রহিয়াছে, ছোটো মেয়েটি দাওয়ায় বসিয়া খেলা করিতেছে, সে তাহাকে দেখিয়া কী বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, মা কী বলিয়া ছুটিয়া আসিলেন, বাড়িতে কিরূপ একটা কোলাহল পড়িয়া গেল, সমস্ত সে দেখিতে পায়; কে তাহাকে কী প্রশ্ন করিবে তাহা সে কল্পনা করিতে থাকে এবং সে তাহার কী উত্তর দিবে তাহা পর্যন্ত ঠিক করিয়া রাখে। কল্পনা যদি এমন জাজ্জ্বল্যমান না হয়, তবে সে কখনো স্পষ্ট সুখ অনুভব করিতে পারে না। যখন একজন ভাবী দারিদ্র্য-দুঃখ ভাবিয়া আত্মহত্যা করে, তখন সে তাহার ভবিষ্যৎ দুঃখের দশা বর্তমানের মতো অতি স্পষ্ট ও জীবন্ত করিয়া দেখে, নহিলে আত্মহত্যা করিতে পারে না।

    যে ব্যক্তির অনুভাবকতা অধিক সে ব্যক্তি কাজ করে, সে কখনো নিরুদ্যম থাকিতে পারে না। সুখ তাহাকে এত আনন্দ দেয় যে, সুখের জন্য সে প্রাণপণ করে, দুঃখ তাহাকে এত কষ্ট দেয় যে, দুঃখের হাত এড়াইতে সে বিধিমতে চেষ্টা করে। বাঙালিরা কাজ করিতে চাহে না, কেননা তাহারা জানে যে, কোনোরূপে দিনপাত হইয়া যাইবে। কষ্ট হউক দুঃখ হউক কোনো রূপে দিনপাত হইলেই সন্তুষ্ট। যাহাদের অনুভাবকতা অধিক, তাহাদের কি এরূপ ভাব? এমন হয় বটে, যে, অনেক সময় আমরা অনুভব করি কিন্তু শরীরের দৌর্বল্যবশত সে অনুভাবকতা আমাদের কাজে নিয়োগ করিতে পারে না। কিন্তু তেমন অবস্থায় ক্রমেই আমাদের অনুভাবকতা কমিয়া যায়। অনবরত যদি দুঃখের কারণ ঘটে, অথচ তাহার প্রতিকার করিতে না পারি; চুপচাপ বসিয়া দুঃখ সহিতেই হয়, জানি যে, কোনো চারা নাই, তাহা হইলে মন হইতে দুঃখবোধ কমিয়া যায় ও অদৃষ্টবাদ শাস্ত্রের উপর বিশ্বাস জন্মে। যেমন করিয়াই হউক অনুভাবকতার হ্রাস হয়ই!

    বহুকাল হইতে একটা জনশ্রুতি চলিয়া আসিতেছে যে, কাজের সহিত কল্পনার মুখ-দেখাদেখি নাই। কল্পনা যদি এখানে থাকে তো কাজ ওখান দিয়া চলিয়া যায়। সচরাচর লোকে মানুষকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে, কাজের লোক ও কল্পনাপ্রধান লোক। কাজের লোক যদি উত্তর মেরুতে থাকে তো কল্পনাপ্রধান লোক দক্ষিণ মেরুতে থাকিবে। কিন্তু ভাবনা ও প্রকাশের মধ্যে যেরূপ অকাট্য সম্বন্ধ কল্পনা ও কাজের মধ্যে কি ঠিক তেমনি নহে? তুমি একটি ছবি আঁকিতে চাও, আগে কল্পনায় সে ছবি না উঠিলে কীরূপে তাহা আঁকিবে? মাটির উপর তোমাকে একটি বাড়ি গড়িতে হইবে কিন্তু তাহার আগে শূন্যের উপর সে বাড়ি না গড়িলে চলে কি? যদি কাজের বাড়ি গড়িবার পূর্বে কল্পনার বাড়ি গড়া নিতান্তই আবশ্যক, তবে কল্পনার বাড়ি যত পরিষ্কার ও ভালো করিয়া গড় কাজের বাড়িও তত ভালো হইবে সন্দেহ নাই। কল্পনার ভিত্তিতে বাড়ি যদি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ না হয় তবে মাটির উপর গড়িতে তাহা পাঁচবার করিয়া ভাঙিতে হইবে।

    অতএব দেখা যাইতেছে যে, কল্পনা কাজের বাধাজনক নহে বরঞ্চ শ্রীবৃদ্ধিসাধক। তবে কেন কল্পনার নামে অনর্থক এরূপ একটা বদনাম হইল? বোধ হয় তাহার কারণ এই যে, যাহারা নিত্যনিয়মিত ধরাবাঁধা কাজ করে, যে কাজে একটা যন্ত্রের অপেক্ষা অধিক বুদ্ধি থাকিবার আবশ্যক করে না, কালও যাহা করিয়াছিলাম আজও তাহা করিতেছি, আর কালও তাহাই করিতে হইবে, তাহাদের কল্পনা খোরাক না পাইয়া অত্যন্ত ম্রিয়মাণ হইয়া পড়ে। এবং যাহাদের কল্পনা অধিক, তাহারা এরূপ কাজ করিতে সম্মত হয় না। তাহারা এমন কাজ করিতে চায় যাহাতে কিছু সৃষ্টি করিবার আছে, ভাবিবার আছে। একজন কাল্পনিক পুত্রকে যখন তাহার পিতা কহেন “ইহার কিছু হইবে না” তখন তাঁহার কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এ হতভাগ্যের পুত্র কেরানি হইতে পারিবে না বা হিসাব রাখিবার সরকার হইতে পারিবে না। কিন্তু একটা মহান কাজ মাত্রেই কল্পনার আবশ্যক করে তাহা বলাই বাহুল্য। নিউটন বা নেপলিয়নের কল্পনা কি সাধারণ ছিল? ইংলন্ডের লোকেরা কাজের লোক। এ কথা সত্য বটে কাজের লোক বলিতে বুঝায় যে তাহার মধ্যে অধিকাংশই চিঠি কাপি করা হিসাব রাখা প্রভৃতি ধরাবাঁধা কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তাহা হইতে কি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়? যে দেশে যন্ত্রের বাহুল্য সে দেশের যন্ত্রীর বাহুল্য। একজন বা দুই জন বা কতকগুলি লোকে মিলিয়া একটা প্রকাণ্ড কাজের সৃজন ও স্থাপন করে ও তাহাতেই দশ জনে মিলিয়া খাটে। অন্ধকারে যদি কেবল দেখিতে পাও যে, দুইটি হাত ভারি কাজে ব্যস্ত আছে, তৎক্ষণাৎ জানিবে কাছাকাছি একটা মস্তক আছে। যে শরীরের মাথা নাই, সে শরীরের হাতে কোনো কাজ থাকে না। ইংলন্ডে অত্যন্ত কাজের ভিড় পড়িয়াছে তাহা হইতে প্রমাণ হইতেছে ইংলন্ডের মাথা আছে। যখন তুমি দেখ যে শরীরের অধিকাংশ অঙ্গপ্রতঙ্গ না ভাবিয়া যন্ত্রের মতো কাজ করে, পা চলিতেছে কিন্তু পায়ের ভিতরে মস্তিষ্ক নাই, পা ভাবিয়া চিন্তিয়া চলে না, অন্যান্য প্রায় সকল অঙ্গই সেইরূপ, যখন তুমি মনে কর না যে সে শরীরটায় মস্তিষ্ক নাই। একজন ব্যক্তির কল্পনা আছে বলিয়া দশজন অকাল্পনিক লোক কাজ পায়। ইংলণ্ডে যে এত কাজ দেখিতেছি তাহার অর্থ ইংলন্ডে অনেক কাল্পনিক লোক আছে। একজন দরিদ্র ইংরাজ যে তাহার স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া অতি দূরদেশে গিয়া ধন সঞ্চয় করিয়া সম্পত্তিশালী হইয়া উঠে তাহার কারণ তাহার কল্পনা আছে। এই কল্পনায় ইংরাজদের কোথায় না লইয়া গিয়াছে বলো দেখি। কোথায় আফ্রিকার রৌদ্রতপ্ত জ্বলন্ত হৃদয়, আর কোথায় উত্তর মেরুর তুষারময় জনশূন্য মরু প্রদেশ, কোথায় তাহারা না গিয়াছে? যাহা অনুপস্থিত, যাহা অনধিগম্য, যাহা দুষ্প্রাপ্য, যাহা কষ্টসাধ্য, অকাল্পনিক লোকেরা তাহার কাছ দিয়া ঘেঁসিবে না। যাহা উপস্থিত নাই অকাল্পনিক লোকদের কাছে তাহার অস্তিত্বই নাই। বর্তমানে যাহার মূল নিতান্ত স্পষ্ট প্রতক্ষ না হইতেছে, এমন কিছু তাহারা বিশ্বাস করিতে চাহে না, এমন-কি, অনুভব করিতে পারে না। এইজন্য অকাল্পনিক লোকেরা একটা কিছু সৃষ্টিছাড়া আশা করে না। সুতরাং কাল্পনিক লোকেরা যেমন অনেক বিষয়ে ঠকে, এক-একটা সৃষ্টিছাড়া খেয়ালে নিজের ও পরের সর্বনাশ করে, অকাল্পনিকদের তাহার কোনো সম্ভাবনা নাই। এইজন্যও বোধ করি কাল্পনিকদের একটা নাম খারাপ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যে ব্যক্তি ঘরের মধ্যে বসিয়া থাকে সে ব্যক্তি ওই বাহিরের কূপটার মধ্যে পড়িয়া মরিবার কোনো সম্ভাবনা নাই কিন্তু সে ব্যক্তির ওই ফুলবাগানে বেড়াইবার বা বিদেশে গিয়া টাকা রোজগার করিবারও কোনো সম্ভাবনা নাই। একজন কাল্পনিক ব্যক্তির বুদ্ধি না থাকিলে সে অনেক হানিজনক কাজ করে, কিন্তু সে তাহার বুদ্ধির দোষ না কল্পনার দোষ? এক কথায় পৃথিবীতে যত বড়ো বড়ো কাজ হইয়াছে সকলই কল্পনার প্রসাদে। তবে কেন আজ, কাজ অমন মুখ ভার করিয়া কল্পনার প্রতি মহা অভিমান করিয়া বসিয়া আছে?

    যে দেশে শেক্‌সপিয়র জন্মিয়াছে সেই দেশেই নিউটন জন্মিয়াছে, যে দেশে অত্যন্ত বিজ্ঞানদর্শনের চর্চা, সেই দেশেই অত্যন্ত কাব্যের প্রাদুর্ভাব, ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে, কল্পনার কাজ কেবলমাত্র কবিতা সৃজন করা নয়। যে দেশে কাল্পনিক লোক বিস্তর আছে, সে দেশের লোকেরা কবি হয়, দার্শনিক হয়, বৈজ্ঞানিক হয়; সকলই হয়, বাঙালি বৈজ্ঞানিক নয়, বাঙালি দার্শনিক নয় বাঙালি কবিও নয়।

    লোকেরা যে মনে করে যে, অকেজো লোকেরা অত্যন্ত কাল্পনিক হয় তাহার একটি কারণ এই হইবে যে, যাহাদের হাতে কাজ নাই তাহারা কল্পনা না করিয়া আর কী করিবে? নানা লঘু অস্থায়ী ভাবনাখণ্ডের ছায়া মনের উপর পড়াকেই যদি কল্পনা বল, তবে তাহারা কাল্পনিক বটে। কিন্তু সেরূপ কল্পনার ফল কী বলো? সেরূপ কল্পনায় লোককে কবি করিতে পারে না। মনে করো এক ব্যক্তি যতক্ষণ বসিয়া থাকে ততক্ষণ সে নখ দিয়া ধীরে ধীরে মাটিতে আঁচড় কাটিতে থাকে,ইহাতে তাহার অতি ঈষৎ পদচালনা হয়; চলিতে আরম্ভ করিলে তাহার মাটিতে আঁচড় কাটিবার অবসর থাকে না কিন্তু তাহাই বলিয়া কি বলা যাইতে পারে যে, বসিয়া থাকিলেই তাহার যথার্থ পদচালনা হয়? কাজ করিতে যে কল্পনার আবশ্যক করে তাহাই পদচালনা, বসিয়া থাকিলে যে কল্পনা আপনা হইতে আসে তাহা মাটিতে আঁচড় কাটা। যদি কিছুতে সে পদের বলবৃদ্ধি করে, তবে সে চলাতেই। একটি কবিতা লিখিতে হইলে কল্পনাকে একটি নিয়মিত পথে চালন করিতে হয়, তখন তাহার একটি ক্রম থাকে, একটি পরিমাণ থাকে শুদ্ধ তাহাই নহে, সে সময়ে কল্পনা অলস-কল্পনা অপেক্ষা অনেকটা গভীর ও বিশেষ শ্রেণীর হওয়া আবশ্যক করে। যাহার সর্বদা কবিতা লেখা অভ্যাস আছে, সে যখন কবিতা নাও লিখিতেছে, তখনও মাঝে মাঝে হয়তো সেই ক্রমানুযায়িক, পরিমিত, বিশেষ শ্রেণীর কল্পনা মনে মনে চালনা করিতে থাকে। সেরূপ চালনাতেও মনোনিবেশ আবশ্যক করে, পরিশ্রম বোধ হয়। অলস ব্যক্তি, ও যে কখনো কবিতা লেখে না, সে কখনো অবসরকাল এরূপ শ্রমসাধ্য কল্পনায় অতিবাহন করে না। স্বপ্ন ও সত্য ঘটনায় যত তফাত অলস ও কাজের কল্পনায় তাহা অপেক্ষা অল্প তফাত নয়। অতএব কাজের লোকের কল্পনা আসল লোকের কল্পনা অপেক্ষা অধিক জাগ্রত। যে জাতির মধ্যে বাণিজ্যের প্রাদুর্ভাব, বৈজ্ঞানিক সত্যের আবিষ্কার হয়, দর্শনের আলোচনা চলে, সে জাতির মধ্যে কল্পনার অত্যন্ত চর্চা হয় ও সবশুদ্ধ ধরিয়া কল্পনার ভাণ্ডার অত্যন্ত বাড়িতে থাকে; সুতরাং সে দেশে অলস দেশ অপেক্ষা কবি জন্মিবার অধিক সম্ভাবনা। বাঙালি কাজও করে না, বাঙালি কল্পনাও করে না।

    স্বাভাবিক আলস্য, স্বাভাবিক নির্জীবভাব, সকল বিষয়ে বৈরাগ্য, ইহারাই বাঙালিকে মানুষ হইতে দিতেছে না। আমরা সকল দ্রব্যই অর্ধেক চক্ষু মুদিয়া দেখি। আমাদের কৌতুহল অত্যন্ত অল্প। হাতে একটা দ্রব্য পড়িলে তাহা উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতে ইচ্ছাই হয় না। কোনো স্থান দিয়া যখন যাই তখন দুই দিকে চাই না, মাটির দিকেই নেত্র। সত্য জানিবার জন্য কৌতুহল নাই। আমি জানি, ইংলন্ডে সামান্য শ্রমজীবীদিগের জন্য নানা সভা আছে। সেখানে সন্ধ্যাবেলা নানা বিষয়ে বক্তৃতা হয়। সমস্ত দিনের শ্রমের পর ৬ পেন্স খরচ করিয়া কত গরিব লোক শুনিতে আছে। একজন হয়তো ইজিপ্‌টের প্রাচীন দেবদেবীদের বিষয়ে বক্তৃতা দিবেন। একজন নিরক্ষর শ্রমজীবীর যে, সে বিষয় শুনিতে কৌতুহল হইবে ইহা আমাদের কাছে বড়োই আশ্চর্য বোধ হয়, সামান্য কৌতুকের বিষয় হইল ছোটো বড়ো সকল লোকে একেবারে ঝাঁকিয়া পড়ে। য়ুরোপে যেখানে যাহা-কিছু দেখিবার আছে, সেইখানেই ইংরাজদের হোটেল নিশ্চয়ই আছে, এবং অন্যান্য বিদেশীয়দের মধ্যে ইংরাজদেরই আধিক্য। এটনার গর্ভের মধ্যে একজন ইংরাজই প্রথম অবতরণ করেন, এবং ইটালিয়নরা বলিয়াছিল এ ব্যক্তি হয় ইংরাজ নয় শয়তান হইবে। আমাদের সাধারণত কৌতূহলের অভাব। সেইজন্য আমরা যাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহার সমস্তটা আমাদের চক্ষে পড়ে না। সুতরাং সে দ্রব্যটা আমরা সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করিতেই পারি না। ইংরাজেরা একটা ভালো দ্রব্যের প্রতি খুঁটিনাটি পর্যন্ত উপভোগ করে। সুইজর্লন্ডের দৃশ্য রমণীয় বলিয়া তাহারা অবসর পাইলেই সেখানে যায়। সেখানে আবার একটা বিশেষ পর্বত-শিখর হইতে সূর্যোদয় অতি সুন্দর দেখায়; সেই সূর্যোদয় দেখিবার জন্য তাড়াতাড়ি অর্ধরাত্রে উঠিয়া হয়তো সেখানে যাত্রা করে, ঠিক পাঁচটার সময় সেখানে গিয়া পৌঁছায়, সূর্যোদয়টুকু দেখিয়া আবার ফিরিয়া আসে। তাহারা সেই উদয়োন্মুখ সূর্যের চতুর্দিকস্থ প্রতি মেঘ খণ্ড আলোচনা করে। আমাদের দেশে কত দিন রমণীয় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়। কিন্তু কয়জন একবার চাহিয়া দেখে? এমন সকল উদাসীন, বাহ্য বিষয়ে নির্লিপ্ত লোকদের জন্য কেন এমন সুন্দর দেশ সৃষ্ট হইয়াছিল? কয়জন বাঙালি কেবলমাত্র চক্ষু চরিতার্থ করিবার জন্য হিমালয়ে যায়? আমাদের পাঠকদের মধ্যে কয়জন ঘাটগিরি দেখিয়াছেন, ইলোরার গুহা দেখিয়াছেন? একটু কৌতূহল থাকিলে দেখিবার শত সহস্র অবসর ও উপায় পাইতেন। বাহ্য দৃশ্য আমরা উপভোগ করিতেই জানি না। একটি সামান্য গুল্মের পর্ণ যতই সুন্দর হউক-না-কেন, আমরা তাহা মাড়াইয়া যাই; কখনো একবার নত হইয়া দেখি? আর আমার পার্শ্বস্থ আমার ইংরাজ সহচরটি কেন তাড়াতাড়ি সেটি তুলিয়া লইয়া শুকাইয়া যত্নপূর্বক রাখিয়া দেয়? বাহ্য বিষয়ে ঔদাসীন্য বোধ করি আমাদের কুলক্রমাগত গুণ। সংসার অনিত্য, সংসার স্বপ্ন। একটা ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে, উহাতে অত মনোনিবেশ করিয়া কী দেখিতেছ|? উহা তো দুদণ্ডেই শুকাইয়া পড়িবে! সকলই তুচ্ছ, কিছুই চক্ষু মেলিয়া দেখিবার নাই। যাহা-কিছু দেখিবার আছে, সকলই চক্ষু মুদিয়া। জীবনের কূট সমস্যা সকল মীমাংসা করো। কিন্তু ইহা কি বুঝিবে না, ঐ অস্থায়ী ফুল যাহা শিক্ষা দেয় তাহা চিরস্থায়ী! সুন্দর দ্রব্যের প্রতি ভালবাসার চর্চা, যেমন শিক্ষা তেমন শিক্ষা আর কী হইতে পারে? এই বাহ্য প্রকৃতির প্রতি ঔদাসীন্য আমাদের কবিতাতে স্পষ্টই লক্ষিত হয়। যে ভালো কবি অর্থাৎ যাহার মনে সৌন্দর্যজ্ঞান বিশেষ রূপে আছে, সে কি কখনো এমন সুন্দর জগতের বাহ্য মুখশ্রী দেখিয়া মুগ্ধ না হইয়া থাকিতে পারে? আমাদের বাংলা কবিতাতে এমন কেন দেখা যায় যে, একজন কবি একটি কাননের যেরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, আর-এক জনও ঠিক সেইরূপ করিয়াছেন। তাহার কারণ এই যে, যখন আমরা একটি কানন দেখি তখন সে কাননের মুখের দিকে আমরা ভালো করিয়া চাহিয়া দেখি না; কাননের যে কী ভাব আছে তাহা আমরা বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন চোখে দেখি না। দেখিবার ইচ্ছাই নাই, দেখিবার ক্ষমতাই নাই। আমরা কেবল জানি যে, কানন অর্থে একটি ভূমিখণ্ড, যেখানে ফুলের গাছ আছে। আমরা জানি যে, মল্লিকা, মালতী প্রভৃতি ফুল দেখিতে ভালো এবং কবিতায় সে-সকল ফুলের নামোল্লেখ করিলে ভালো শুনাইবে; তাহা তুমিও জান, তাহা আমিও জানি। কিন্তু কাননের মুখে এমন সকল ভাব বিকাশ পায়, যাহা ভাগ্যক্রমে তুমিই দেখিতে পাও, আমি দেখিতে পাই না, তুমিই জানিতে পার, আমি জানিতে পারি না, সে-সকল ভাব আমাদের চক্ষে পড়ে না। এইজন্যই বাংলা কাব্যে নিম্নলিখিত রূপে কানন বর্ণিত হয়–

    মোহিনী মোহকর মহীরুহ রাজি
    প্রকাশিল সুন্দর কিশলয় সাজি।
    ধাবিল সমীরণ মলয় সুগন্ধি;
    চুম্বনে ঘন ঘন কুসুম আনন্দি।
    কাঁপিল ঝর ঝর তরুশিরে সাধে,
    শিহরিত পল্লব মরমর নাদে।
    হাসিল ফুলকুল মঞ্জুল মঞ্জুল,
    মোদিত মৃদুবাসে উপবন ফুল।
    কোকিল হরষিল কুহুরবে কুঞ্জ,
    শোভিল সরোবরে সরোজিনী পুঞ্জ।
    নাচিল চিত সুখে ময়ূর কুরঙ্গ;
    গুঞ্জরে ঘন ঘন মধুপানে ভৃঙ্গ।
    সুন্দর শতদল প্রিয়তর আভা
    সূরয অরধ, অরধ শশি শোভা।
    শোভিল সুতরুণ স্থল জল অঙ্গে;
    বিরচিল হ্লাদিনী মায়াবন রঙ্গে।

    ইহাতে না আছে কাননের শরীর না আছে কাননের প্রাণ। বীরবর সিংহের বর্ণনা করিতে গিয়া যদি তুমি বল যে, তাহার এক জোড়া হাত, এক জোড়া চোখ ও এক জোড়া কান আছে, তাহা হইলে শ্রীযুক্ত বীরবর সিংহের চিত্র আমাদের মনে যেরূপ উদিত হয়, উপরি-উদ্‌ধৃত বর্ণনায় কাননের চিত্র আমাদের হৃদয়ে তেমনি উঠিবার কথা। বীরবর সিংহের ওরূপ হাস্যজনক বর্ণনা করিলে বলা যায় যে, বর্ণনাকারী বীরবরের চেহারা একেবারে কল্পনাই করেন নাই। বাহ্য আকার বর্ণনা ছাড়া আর-এক প্রকারে বীরবরের বর্ণনা করা যাইতে পারে; বলা যাইতে পারে, বীরবরের দৃঢ়সংলগ্ন ওষ্ঠাধর তাহার স্থির প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করিতেছে, তাহার জ্যোতির্ময় নেত্রের দৃষ্টিপাত মর্মভেদী, ও তাহার উন্নত ললাট ভাবনার ভরে যেন ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। এরূপ বর্ণনার গুণ এই যে, এক মুহূর্তে বীরবরের সহিত আমাদের আলাপ হইয়া যায়। ইহাতে বুঝায়, বর্ণনাকারী বীরবরের চেহারা বিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়াছেন। Shelley-র কবিতা হইতে একটি দ্বীপের বর্ণনা উদ্‌ধৃত করিয়া দিতেছি, ইহার বাংলা অনুবাদ অসম্ভব।

    ‘It is an isle under Ionian skies,
    Beautiful as a wreck of paradise,
    The light clear element which the isle wears
    Is heavy with the scent of lemon flowers,
    Which floats like mist laden with unseen showers;
    And falls upon the eyelids like faint sleep,
    And from the moss violets and jonquils peep,
    And dart their arrowy odour through the brain
    Till you might faint with that delicious pain.
    And every motion, odour, beam, and tone,
    With that deep music is in unison
    Which is a soul within the soul :
    . . .
    The winged storms, chanting their thunder psalm
    To other lands, leave azure chasms of calm
    Over this isle, or weep themselves in dew,
    From which its fields and woods ever renew
    Their green and golden immortality.
    And from the sea their rise, and from the sky
    There fall, clear exhalations, soft and bright,
    Veil after veil, each hiding some delight;
    Which sun or moon or zephyr draw aside.
    Till the isle’s beauty like a naked bride
    Glowing at once with love and loveliness,
    Blushes and trembles at its own excess.
    . . .
    But the Chief marvel of the wilderness
    Is a lone dwelling, built by whom or how
    None of the rustic island people know.
    . . .
    And, day and night aloof from the high towers
    And terraces, the earth and ocean seem
    To sleep in one another’s arms, and dream
    Of waves, flowers, clouds, woods; rocks, all that we
    Read in their smiles, and call reality.’

    অত্যন্ত দীর্ঘ বলিয়া মাঝে মাঝে ছাড়িয়া দিতে হইল এজন্য ইহার অত্যন্ত রসহানি করা হইয়াছে। Shelley এমন করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন যে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, ওই দ্বীপটি তিনি মনে মনে বিশেষ রূপে উপভোগ করিয়াছেন, বড়ো ভালো লাগিয়াছে তাই এত উচ্ছ্বাস। কেবলমাত্র কতকগুলি সত্যের উল্লেখ করিয়া যান নাই, প্রতি ছত্রে তাঁহার নিজের মনোভাব দীপ্তি পাইতেছে। যে দ্রব্য আমাদের ভালো লাগে, যে দ্রব্য আমরা প্রাণের সহিত উপভোগ করি, তাহা বর্ণনা করিতে হইলে আমরা নানা বস্তুর সহিত তাহার তুলনা করিতে চাই; তাহার নানা প্রকার নামকরণ করি। আমরা আমাদের ভালোবাসার লোককে, “নয়ন-অমৃত রাশি,” “জীবন-জুড়ানো ধন,” “হৃদি-ফুল হার” এবং এক নিশ্বাসে এমন শত প্রকার সম্বোধন করি কেন? সে যে, কতখানি আমাদের আনন্দদায়ক তাহা ঠিকটি প্রকাশ করিতে আমরা কথা হাতড়াইয়া বেড়াই, এটা একবার, ওটা একবার পরীক্ষা করিয়া দেখি কিছুতেই মনস্তুষ্টি হয় না। আমাদের কল্পনার ভাণ্ডারে তাহার সহিত ওজন করিবার উপযুক্ত বাটখারা খুঁজিয়া পাই না। মনের আগ্রহে ছটাক হইতে মণ পর্যন্ত যাহা-কিছু হাতে পাইতেছি সমস্তই তুলাদণ্ডে চড়াইতেছি, কিন্তু কিছুতেই সমান ওজন হইতেছে না। মনে হয়, আমাদের ভাষার ডানা এমন লৌহময়, যে, আমার ভালোবাসা যে উচ্চে অবস্থিত সে পর্যন্ত সে উড়িতে পারে না, বার বার করিয়া চেষ্টা করে ও বার বার করিয়া পড়িয়া যায়। একটি Nightingale-এর গানের বিষয়ে Shelley কী লিখিতেছেন পাঠ করো। কেবলমাত্র যদি বলা যায় যে, কোকিল অতি মিষ্ট গান করিতেছে, তাহার এক কবিতা, আর নিম্নলিখিত বর্ণনার এক স্বতন্ত্র কবিতা।

    A woodman whose rough heart was out of tune
    Hated to hear, under the stars or moon,
    One nightingale in an interfluous wood
    Satiate the hungry dark with melody
    And as a vale watered by a flood,
    Or as the moonlight fills the open sky
    Struggling with darkness– as a tube-rose
    Peoples some Indian dell with scents which lie
    Like clouds above the flowers from which they rose–
    The singing of that happy nightingale
    In this sweet forest, from the golden close
    Of evening till the star of dawn may fail
    Was interfused upon the silentness.
    The folded roses and the violets pale
    Heard her within their slumbers; the abyss.
    Of heaven with all its planets; the dull ear
    Of the night-cradled earth; the loneliness
    Of the circumfluous waters. Every sphere,
    And every flower and beam and cloud and wave,
    And every wind of the mute atmosphere,
    And every beast stretched in its rugged cave
    And every bird lulled on its mossy bough,
    And every silver moth fresh from the grave
    Which is its cradle . . .
    . . . and every form
    That worshipped in the temple of night.
    Was awed into delight, and by the charm
    Girt as with an interminable zone,
    Whilst that sweet bird, whose music was a storm
    Of sound, shook forth the dull oblivion
    Out of their dreams. Harmony became love
    In every soul but one.”

    মনে হয় না কি যে, গান শুনিতে শুনিতে কবির চক্ষু মুদিয়া আসিয়াছে, মনুষ্যহৃদয়ে যতদূর সম্ভব তত দূর পর্যন্ত উপভোগ করিতেছেন? এই মুহূর্তে আমার হস্তে অবকাশরঞ্জিনী দ্বিতীয় ভাগ রহিয়াছে। সমস্ত বহি খুঁজিয়া দুই-একটি মাত্র স্বভাব বর্ণনা দেখিলাম। তাহাও এমন নির্জীব ও নীরস, যে, পড়িয়া স্পষ্ট মনে হয়, কবি যাহা বর্ণনা করিতেছেন, প্রাণের সহিত তাহা উপভোগ করেন নাই। লিখা আবশ্যক বিবেচনায় লিখিয়াছেন। একটি সন্ধ্যার বর্ণনা। মন্দগমনা, বিষণ্ণ সায়াহ্নের মুখ যাহার বিশেষ ভালো লাগে, সে কখনো এরূপ নির্জীব বর্ণনা করিতে পারে না। সূর্যের সহিত আলোকের অপসরণ, এই প্রাকৃতিক ঘটনা মাত্রকে সে সন্ধ্যা বলিয়া জানে না। তাহার হৃদয়ে সন্ধ্যার একটি স্বতন্ত্র জীবন্ত অস্তিত্ব আছে। সন্ধ্যা তাহার মনের ভিতরে বসিয়া কথা কহে।

    “আইল গোধূলি সৌর রঙ্গ ভূমে,–
    নামিল পশ্চিমে ধীরে যবনিকা,
    ধূসর বরণা; ফুরাইল ক্রমে
    দিনেশ দৈনিক গতি অভিনয়।
    অষ্টমীর চন্দ্র– রজতের চাপ!
    নভোমধ্যস্থলে বিষণ্ণ বদনে
    ভাসিল; লভিতে যেন প্রিয় রবি
    আলিঙ্গন, ভ্রমি’ অলক্ষেতে শশি
    অর্ধ সৌর রাজ্য বিরহেতে কৃশ,
    নিরাশা মলিন।”

    যখন তুমি বল, আমি অমুক স্থানে একটি মানুষকে দেখিলাম, তখন জানিলাম, তুমি খুব অল্পই দেখিয়াছ; যখন বল যে, হরিহরকে দেখিয়াছ, তখন জানিলাম, যে, হাঁ, একটু ভালো করিয়া দেখিয়াছ; আর যখন বল যে, হরিহরকে দেখিলাম তাহার চোখে ও অধরে ক্রোধ, ও সমস্ত মুখে একটি গুপ্ত সংকল্প প্রকাশ পাইতেছে, তখন বুঝিলাম যে, একটি মানুষকে যতদূর দেখিবার তাহা দেখিয়াছ। আমরা কবিতার যেরূপ স্বভাব বর্ণনা করি, তাহাতে প্রকাশ পায় যে, আমরা সেই মানুষটিকে মাত্র দেখিয়াছি, হরিহরকে দেখি নাই। যদি বা হরিহরকে দেখিয়া থাকি, অর্থাৎ সেই মানুষটির নাক কান চোখ মুখ বিশেষরূপে দেখিয়া থাকি, তথাপি তাহার নাক কান চোখ মুখের মধ্যে আর কিছু দেখিতে পাই নাই। যখন আমরা একটি মানুষের ঠোঁটে, চোখে ও সমস্ত মুখে একটা কিছু বিশেষ ভাব দেখিতে পাই তখন আমরা কেবলমাত্র সেই মানুষকে জীবন্ত বলিয়া দেখি না; তখন তাহার ঠোঁট ও চোখকে আমরা জীবন্ত করিয়া দেখি। তখন আমরা তাহার ঠোঁটের ও চোখের একটি হৃদয়, একটি প্রাণ দেখিতে পাই। এই হৃদয়, এই প্রাণ দেখিতে পাওয়া দেখিতে পাওয়ার চূড়ান্ত ফল। বাংলা কবিতার স্বভাব বর্ণনায় প্রকৃতির এই হৃদয়, এই প্রাণ দেখিতে পাই না।

    “সরোবরে সরোরুহ, কুমুদ কহ্লার সহ
    শরতে সুন্দর হোয়ে শোভা দিয়ে ফুটেছে।”

    ইহা লক্ষ্য করিয়া দেখিতে একরূপ চক্ষুর আবশ্যক, আর–

    “Then the pied wind flowers and the tulip tall,
    And narcissi, the fairest among them all,
    Who gaze on their eyes in the stream’s recess
    Till they die of their own dear loveliness
    And the rose, like a nymph to the bath addressed.
    Which unveiled the depth of her glowing breast,
    Till, fold after fold, to the fainting air
    The soul of her beauty and love lay bare.”

    ইহ দেখিতে স্বতন্ত্র চক্ষুর আবশ্যক করে। একটি narcissus ফুল, যে স্রোতের পার্শ্বে ফুটিয়া দিন রাত্রি জলের মধ্যে নিজের মুখখানি, নিজের সৌন্দর্য দেখিতে দেখিতে শুকাইয়া মরিয়া যায়, তাহার সে একটি মিষ্ট ভাব, অথবা একটি বিকাশোন্মুখ গোলাপের পাপড়িগুলি যখন একটি একটি করিয়া খুলিতে থাকে অবশেষে তাহার অতুল রূপ একেবারে অনাবৃত হইয়া পড়ে তখন তাহার সেই লাজুক সৌন্দর্য কয়জন লোক দেখিতে পায়? কিন্তু–

    “মরাল আনন্দ মনে ছুটিল কমল বনে,
    চঞ্চল মৃণাল দল ধীরে ধীরে দুলিল;
    বক হংস জলচর ধৌত করি কলেবর
    কেলি হেতু কলরবে জলাশয়ে নামিল।”

    এ ঘটনাগুলি দেখিতে কতটুকুই বা কল্পনার আবশ্যক করে? ইহা হয়তো সকলেই স্বীকার করিবেন, যাহাকে আমরা বিশেষ ভালোবাসি, যাহাকে আমরা বিশেষ করিয়া নিরীক্ষণ করি, যাহাকে আমরা মুহূর্তকাল আমাদের চক্ষের আড়াল হইতে দিই না, তাহার নাক চোখ আমরা দেখিতে পাই না, অর্থাৎ দেখি না। তাহাকে যখন দেখি তখন তাহার মুখের ভাবটি মাত্র দেখি, আর কিছুই নয়। এইজন্যই সে মুখকে আমরা পদ্ম বলি বা চন্দ্র বলি। যখন আমরা মুখপদ্ম কথা ব্যবহার করি তখন তাহার অর্থ এমন নহে, যে, মুখ বিশেষে পদ্মের মতো পাপড়ি আছে, তখন তাহার অর্থ এই যে, পদ্মেরও যে ভাব সে মুখেরও সেই ভাব। আমার প্রেয়সীর মুখের গঠন বাস্তবিক ভালো কি মন্দ, তাহার নাক ঈষৎ চেপ্টা হওয়াতে ও তাহার ভুরু ঈষৎ বাঁকা হওয়াতে তাহাকে কতখানি খারাপ দেখিতে হইয়াছে, তাহাকে চব্বিশ ঘণ্টা নিরীক্ষণ করিয়াও তাহা আমি বলিতে পারি না, অথচ একজন অচেনা ব্যক্তি মুহূর্তকাল দেখিয়াই বলিয়া দিতে পারে আমার প্রেয়সীর গঠন বাস্তবিক কতখানি ভালো দেখিতে। তাহার কারণ, আমি তাহার মুখের ভাবটি ছাড়া আর কিছু দেখিতে পাই না। যে কবি প্রকৃতিকে যত অধিক ভালোবাসেন সেই কবি প্রকৃতির নাক মুখ চোখ তত অল্প দেখিতে পান। যে কবি গোলাপকে বিশেষরূপে দেখিয়াছেন ও বিশেষরূপে ভালোবাসেন, তিনি সেই গোলাপটিকে একটি আকারবিশিষ্ট ভাব মনে করেন, তাহাকে পাপড়ি ও বৃন্তের সমষ্টি মনে করেন না। এইজন্যই একটি লাজুক বালিকার সহিত একটি গোলাপের আকারগত সম্পূর্ণ বিভেদ থাকিলেও তিনি উভয়ের মধ্যে তুলনা দিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহেন। এইজন্য শেলী একটি nightingale-এর কণ্ঠস্বরের সহিত স্রোতের বন্যা, জ্যোৎস্নাধারা ও রজনীগন্ধার পরিমলের তুলনা করিয়াছেন। কোথায় পাখির গান, আর কোথায় বন্যা, জ্যোৎস্না ও ফুলের গন্ধ? জড়ই হউক আর জীবন্তই হউক, একটি আকারের মধ্যে একটি ভাব দেখিতে যে অতি সূক্ষ্ম কল্পনার আবশ্যক, তাহা বোধ করি আমাদের নাই। যদি থাকিত, তবে কেন আমাদের বাংলা কবিতার মধ্যে তাহার কোনো চিহ্ন পাওয়া যাইত না? বোধ করি অত সূক্ষ্ম ভাব আমরা ভালো করিয়া আয়ত্তই করিতে পারি না, আমাদের ভালোই লাগে না। আমাদের খুব খানিকটা রক্তমাংস চাই, যাহা আমরা ধরিতে পারি, যাহা দুই হাতে লইয়া আমরা নাড়াচাড়া করিতে পারি। আমাদের গণ্ডার-চর্ম মন অতি মৃদু সূক্ষ্ম স্পর্শে সুখ অনুভব করিতে পারি না। এইজন্য আমরা বাইরনের ভক্ত। শেলীর জ্যোৎস্নার মতো অতি অশরীরী কল্পনা খুব কম বাঙালির ভালো লাগে।

    “দেখিয়াছি ভাগীরথী ভাদ্র মাসে ভরা,
    পূর্ণ জোয়ারের জল মন্থর যখন;
    দেখিয়াছি সুখস্বপ্নে নন্দনে অপ্সরা
    কিন্তু হেন চারু চিত্র দেখি নি কখনো।
    বিরহেতে গুরুতর উরসের ভারে
    ঢলিয়া পড়েছে বামা কুসুমেষু শরে
    কুসুম শয়নে; কিন্তু কুসুমে কি পারে
    নিবাইতে যে অনল জ্বলিছে অন্তরে?
    সুগোল সুবর্ণনিভ চারু ভুজোপরে
    শোভে পূর্ণ বিকশিত বদন কমল,
    (রূপের কমল মরি কাম সরোবরে),
    ভানুর বিরহে কিন্তু নিমীলিত দল!
    শোভিতেছে অন্য করে বাক্য মনোহর,
    স্খলিত অলকারাশি, পয়োধর থর
    বিশ্রামিছে অযতনে কাব্যের উপর,
    পুণ্যবান কবি– কাব্য পুণ্যের আকর।
    বিনোদ বদনচন্দ্র, বিনোদ নয়ন
    পল্লবে আচ্ছন্ন, পাঠে স্থির সন্নিবেশ,
    অতুল বিনোদতম, ত্রিদিব মোহন,
    অঙ্গে অঙ্গে অনঙ্গের বিলাস আবেশ।
    বিলাস বঙ্কিম রেখা, কুহকী যৌবন
    চিত্রিয়াছে কী কৌশলে সর্ব অঙ্গে মরি
    পূর্ণতার পূর্ণাবেশ– সুনীল বসন
    বিকাশিছে তলে তলে কনক লহরী।”

    এমনতর একটা স্থূল নধর মাংসপিণ্ড নহিলে বাঙালি হৃদয়ের অসাড়, অপূর্ণ স্নায়ুবিশিষ্ট, কর্কশ ত্বকে তাহার স্পর্শই অনুভব হয় না। আর নিম্নলিখিত কবিতাটি পড়িয়া দেখো–

    Wherefore those dim looks of thine
    Shadowy, dreaming Adeline.
    Whence that aery bloom of thine
    Like a lily which the sun
    Looks thro’ in his sad decline
    And a rose-bush leans upon,
    Thou that faintly smilest still,
    As a Naiad in a well,
    Looking at the set of day.
    . . .
    Wherefore those faint smile of thine
    Spiritual Adeline?
    Who talketh with thee, Adeline?
    For sure thou art not all alone.
    Do beating-hearts of salient springs
    Keep measure with thine own?
    Hast thou heard the butterflies
    What they say betwixt their wings?
    Or in stillest evenings
    With what voice the violet woos
    To his heart the silver dews?
    Or when little airs arise
    How the merry bluebell rings
    To the moss underneath?
    Hast thou look’d upon the breath
    Of the lilies at sunrise?”

    এমন জ্যোৎস্নাশরীরী প্রতিমাকে কি বাঙালিরা প্রাণের সহিত ভালোবাসিতে পারেন? না। কেননা, শুনিয়াছি নাকি যে, বাঙালি কবিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় “কেন ভালোবাস” তখন তিনি উত্তর দেন–

    “দেখিয়াছ তুমি সেই মার্জিত কুন্তল
    সুকুন্তল কিরীটিনী, প্রেমের প্রতিমাখানি,
    আচরণ বিলম্বিত দীর্ঘ কেশরাশি
    দেখিয়াছ কহো তবে, কেন ভালোবাসি?”

    “আচরণ বিলম্বিত দীর্ঘ কেশরাশি” দেখিলে, “কেশের আঁধারে সেইরূপ কহিনুর” দেখিলে তবে যাঁহাদের প্রেমের উদ্রেক হয়, তাঁহারা অমন একটি ভাবটিকে কিরূপে ভালোবাসিবেন? আর এদিকে চাহিয়া দেখো–

    “একদিন দেব তরুণ তপন,
    হেরিলেন সুরনদীর জলে,
    অপরূপ এক কুমারী রতন
    খেলা করে নীল নলিনীদলে।
    বিকসিত নীল কমল আনন,
    বিলোচন নীল কমল হাসে,
    আলো করে নীল কমল বরন,
    পুরেছে ভুবন কমল বাসে।
    তুলি তুলি নীল কমল কলিকা,
    ফুঁ দিয়া ফুটায় অফুট দলে;
    হাসি হাসি নীল নলিনী বালিকা,
    মালিকা গাঁথিয়া পরেছে গলে।
    লহরী লীলায় নলিনী দোলায়
    দোলে রে তাহায় সে নীলমণি;
    চারি দিকে অলি উড়িতে বেড়ায়,
    করি গুনু গুনু মধুর ধ্বনি।
    চারি দিক দিয়ে দেবীরা আসিয়ে
    কোলেতে লইতে বাড়ান কোল;
    যেন অপরূপ নলিনী হেরিয়ে,
    কাড়াকাড়ি করি করেন গোল।
    তুমিই সে নীল নলিনী সুন্দরী,
    সুরবালা সুর-ফুলের মালা;
    জননীর হৃদিকমল-উপরি,
    হেসে হেসে বেশ করিতে খেলা।
    হরিণীর শিশু হরষিত মনে,
    জননীর পানে যেমন চায়;
    তুমিও তেমনি বিকচ নয়নে,
    চাহিয়ে দেখিতে আপন মায়।
    শ্যামল বরন, বিমল আকাশ;
    হৃদয় তোমার অমরাবতী;
    নয়নে কমলা করেন নিবাস,
    আননে কোমলা ভারতী সতী।
    কথা কহে দূরে দাঁড়ায়ে যখন,
    সুরপুরে যেন বাঁশরি বাজে;
    আলুথালু চুলে করে বিচরণ
    মরি গো তখন কেমন সাজে!
    মুখে বেশি হাসি আসে যে সময়
    করতল তুলি আনন ঢাকে;
    হাসির প্রবাহ মনে মনে বয়,
    কেমন সরেস দাঁড়ায়ে থাকে!”

    ইহাতে নিবিড় কেশভার, ঘন কৃষ্ণ আঁখিতারা, সুগোল মৃণাল ভুজ নাই তাই বোধ করি ইহার কবি বঙ্গীয় পাঠক সমাজে অপরিচিত, তাঁহার কাব্য অপঠিত। আন বিষ, মার ছুরি, ঢাল মদ– এমনতর একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড না হইলে বাঙালিদের হৃদয়ে তাহার একটা ফলই হয় না। এক প্রকার প্রশান্ত বিষাদ, প্রশান্ত ভাবনা আছে, যাহার অত ফেনা নাই, অত কোলাহল নাই অথচ উহা অপেক্ষা ঢের গভীর তাহা বাংলা কবিতায় প্রকাশ হয় না। উন্মত্ত আস্ফালন, অসম্বদ্ধপ্রলাপ, “আর বাঁচি না, আর সহে না, আর পারি না” ভাবের ছট্‌ফটানি, ইহাই তো বাংলা কবিতার প্রাণ। এমন সফরী অপেক্ষা রোহিত মৎস্যের মূল্য অধিক। বাঙালির কল্পনা চোখে দেখিতে পায় না, বাঙালির কল্পনা বিষয় স্থূল। তথাপি বাঙালি কবি বলিয়া বড়ো গর্ব করে।

    আর-একটি কথা বলিয়া শেষ করি। যেখানে নানাপ্রকার কাজকর্ম হইতে থাকে, সেইখানেই মানুষের সকল প্রকার মনোবৃত্তি বিশেষরূপে বিকশিত হইতে থাকে। সেইখানে রাগ, দ্বেষ, হিংসা, আশা, উদ্যম, আবেগ, আগ্রহ প্রভৃতি মানুষের মনোবৃত্তিগুলি ফুটিতে থাকে। সেখানে মানুষের অত্যাকাঙক্ষা উত্তেজিত হয়, (বাংলা ভাষায় তলথভঢ়ভষশ-এর একটা ভালো ও চলিত কথাই নাই) ও অবস্থার চক্রে পড়িয়া তাহার সমস্ত আশা নির্মূল হয়। সেখানে বিভিন্ন দিক হইতে বিভিন্ন স্রোত একত্র হইয়া মিশে, তুমুল সংঘর্ষ উপস্থিত হয়, আশা নিরাশা, আগ্রহ, উদ্যম, স্রোতের উপরিভাগে ফেনাইয়া উঠে। এই অনবরত সমুদ্রমন্থনে মহা মহা ব্যক্তিদের উৎপত্তি হয়। আর আমাদের এই স্তব্ধ অন্ধকার ডোবার মধ্যে স্রোত নাই, তরঙ্গ নাই, জল পচিয়া পচিয়া উঠিতেছে, উপরে পানা পড়িয়াছে, গুপ্ত নিন্দা ও কানাকানির একটা বাষ্প উঠিতেছে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ভালোবাসার একটা স্বাধীন আদানপ্রদান নাই, ঢাকাঢাকি, লুকোচুরি, কানাকানির মধ্যে ঢাকা পড়িয়া সূর্যের কিরণ ও বায়ুর অভাবে ভালোবাসা নির্মল থাকিতে পারে না, দূষিত হইয়া উঠে। আমাদের ভালোবাসা কখনো সদর দরজা দিয়া ঘরে ঢোকে না; খিড়কির সংকীর্ণ ও নত দরজা দিয়া আনাগোনা করিয়া করিয়া তাহার পিঠ কুঁজা হইয়া গিয়াছে, সে আর সোজা হইয়া চলিতে পারে না, কাহারো মুখের পানে স্পষ্ট অসংকোচে চাহিতে পারে না, নিজের পায়ের শব্দ শুনিলে চমকিয়া উঠে। এমনতর সংকুচিত কুব্জ ভালোবাসার হৃদয় কখনো তেমন প্রশস্ত হইতে পারে না। মনে করো, “পিরীতি” কথার অর্থ বস্তুত ভালো, কিন্তু বাঙালিদের হাতে পড়িয়া দুই দিনে এমন মাটি হইয়া গিয়াছে যে, আজ শিক্ষিত ব্যক্তিরা ও কথা মুখে আনিতে লজ্জা বোধ করেন। বাংলা প্রচলিত প্রণয়ের গানের মধ্যে এমন গান খুব অল্পই পাইবে, যাহাতে কলঙ্ক নাই, লোক-লাজ নাই ও নব যৌবন নাই, যাহাতে প্রেম আছে, কেবলমাত্র প্রেম আছে, প্রেম ব্যতীত আর কিছুই নাই। আমাদের এ পোড়া দেশে কাজকর্ম নাই, অদৃষ্টের সহিত সংগ্রাম নাই, আলস্য তাহার স্থূল শরীর লইয়া স্থূলতর উপধানে হেলিয়া হাই তুলিতেছে, ইন্দ্রিয়পরতা ও বিলাস, ফুল মোজা কালাপেড়ে ধুতি, ফিন্‌ফিনে জামা পরিয়া, বুকে চাদর বাঁধিয়া, পান খাইয়া ঠোঁট ও রাত্রি-জাগরণে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া গুড়গুড়ি টানিতেছে, এই তো চারি দিকের অবস্থা! এমন দেশের কবিতায় চরিত্র-বৈচিত্র্যই বা কোথায় থাকিবে, মহান চরিত্র-চিত্রই বা কোথায় থাকিবে, আর বিবিধ মনোবৃত্তির খেলাই বা কীরূপে বর্ণিত হইবে? সম্প্রতি বাহির হইতে একটা নূতন স্রোত আসিয়া এই স্থির জলের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছে। ইহা হইতে শুভ ফল প্রত্যাশা করিতেছি, ইতস্তত তাহার চিহ্নও দেখা দিতেছে।

    ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৭

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসাময়িক সাহিত্য সমালোচনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    Next Article সাহিত্যের স্বরূপ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }