Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সীতারাম – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প190 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    সীতারাম – ৩য় খণ্ড – ১৬-২০

    ষোড়শ পরিচ্ছেদ

    সেই দিন দৈবগতিকে চিত্তবিশ্রামের দ্বারদেশে এক জন ভৈরবী আসিয়া দর্শন দিল। এখন চিত্তবিশ্রাম ক্ষুদ্র প্রমোদগৃহ হইলেও রাজগৃহ; জনকত দ্বারবানও দ্বারদেশে আছে। ভৈরবী দ্বারবানদিগের নিকট পথ ভিক্ষা করিল।
    দ্বারবানেরা বলিল, “এ রাজবাড়ী—এখানে একটি রাণী থাকেন। কাহারও যাইবার হুকুম নাই |” বলা বাহুল্য যে, রাজাদিগের উপরাণীরাও ভৃত্যদিগের নিকট রাণী নাম পাইয়া থাকে।
    ভৈরবী বলিল, “আমার তাহা জানা আছে। রাজাও আমায় জানেন। আমার যাইবার নিষেধ নাই। তোমরা গিয়া রাজাকে জানাও |”
    দ্বারবানেরা বলিল, “রাজা এখন এখানে নাই-রাজধানী গিয়াছেন |”
    ভৈরবী। তবে যে রাণী এখানে থাকেন, তাঁহাকেই জানাও। তাঁর হুকুমে হইবে না?
    দ্বারবানেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করিল। চিত্তবিশ্রামের অন্তঃপুরে কখনও কেহ প্রবেশ করিতে পায় নাই-রাজার বিশেষ নিষেধ। রাণীরও নিষেধ। রাজার অবর্তমানে দুই এক জন স্ত্রীলোক (নন্দার প্রেরিতা) অন্তঃপুরে যাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু রাণীকে সংবাদ দেওয়াতে তিনি কাহাকেও আসিতে দিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। তবে আবার রাণীকে খবর দেওয়া যাইবে কি? তবে এ ভৈরবীটার মূর্তি দেখিয়া ইহাকে মনুষ্য বলিয়া বোধ হয় না-তাড়াইয়া দিলেও যদি কোন গোলযোগ ঘটে!
    দ্বারবানেরা সাত পাঁচ ভাবিয়া পরিচারিকার দ্বারা অন্তঃপুরে সংবাদ পাঠাইল। ভৈরবী আসিতেছে শুনিয়া শ্রী তখনই আসিবার অনুমতি দিল। জয়ন্তী অন্তঃপুরে গেল।
    দেখিয়া শ্রী বলিল, “আসিয়াছ, ভাল হইয়াছে। আমার এমন সময় উপস্থিত হইয়াছে যে, তোমার পরামর্শ নহিলে চলিতেছে না |”
    জয়ন্তী বলিল, “আমি ত এ সময়ে তোমার সংবাদ লইতে আসিব বলিয়া গিয়াছিলাম। এখন সংবাদ কি, বল। নগরে শুনিলাম, রাজ্যের নাকি বড় গোলযোগ। আর তুমিই নাকি তার কারণ? টোলে টোলে শুনিয়া আসিলাম, ছাত্রেরা সব রঘুর ঊনবিংশের শ্লোক আওড়াইতেছে। ব্যাপারটা কি?”
    শ্রী বলিল, “তাই তোমায় খুঁজিতেছিলাম |” শ্রী তখন আদ্যোপান্ত সকল বলিল। জয়ন্তী বলিল, “তবে তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম করিতেছ না কেন?”
    শ্রী। সেটা ত বুঝিতে পারিতেছি না।
    জয়ন্তী। রাজধানীতে যাও। রাজপুরীমধ্যে মহিষী হইয়া বাস কর। সেখানে রাজার প্রধান মন্ত্রী হইয়া তাঁহাকে স্বধর্মে রাখ। এ তোমারই কাজ।
    শ্রী। তা ত জানি না। মহিষীর ধর্ম ত শিখি নাই। সন্ন্যাসিনীর ধর্ম শিখিয়াছ, তাই শিখিয়াছি। যাহা জানি না, যাহা পারি না, সেই ধর্ম গ্রহণ করিয়া সব গোল করিব। সন্ন্যাসিনী মহিষী হইলে কি মঙ্গল হইবে?
    জয়ন্তী ভাবিল। বলিল, “তা আমি বলিতে পারি না। তোমা হইতে সে ধর্ম পালন হইবে না, বোধ হইতেছে-তাহা হইবার সম্ভাবনা থাকিলে কি এতদূর হয়?”
    শ্রী। বুঝি সে একদিন ছিল। যে দিন আঁচল দোলাইয়া মুসলমান সেনা ধ্বংস করিয়াছিলাম-সে দিন থাকিলে বুঝি হইত। কিন্তু অদৃষ্ট সে পথে গেল না, সে শিক্ষা হইল না। অদৃষ্ট গেল ঠিক উলটাদ পথে-বনবাসে-সন্ন্যাসে গেল। কে জানে আবার অদৃষ্ট ফিরিবে?
    জ। এখন উপায়?
    শ্রী। পলায়ন ভিন্ন ত আর উপায় দেখি না। কেবল রাজার জন্য বা রাজ্যের জন্য বলি না। আমার আপনার জন্যও বলিতেছি। রাজাকে রাত্রি দিন দেখিতে দেখিতে অনেক সময় মনে হয়, আমি গৃহিণী, উঁহার ধর্মপত্নী।
    জ। তা ত বটেই।
    শ্রী। তাতে পুরাণ কথা মনে আসে; আবার কি ভালবাসার ফাঁদে পড়িব? তাই, আগেই বলিয়াছিলাম, রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করাই ভাল। শত্রু, রাজা লইয়া বার জন।
    জ। আর এগার জন আপনার শরীরে? ভারি ত সন্ন্যাস সাধিয়াছ, দেখিতেছি! যাহা জগদীশ্বরে সমর্পণ করিয়াছিলে, তাহা আবার কাড়িয়া লইয়াছ, দেখিতেছি! আবার আপনার ভাবনাও ভাবিতে শিখিয়াছ, দেখিতেছি! একে কি বলে সন্ন্যাস?
    শ্রী। তাই বলিতেছিলাম, পলায়নই বিধি কি না?
    জ। বিধি বটে।
    শ্রী। রাজা বলেন, আমি পলাইলে তিনি আত্মঘাতী হইবেন।
    জ। পুরুষ মানুষের মেয়ে ভুলান কথা! পুষ্পশরাহতের প্রলাপ!
    শ্রী। সে ভয় নাই?
    জ। থাকিলে তোমার কি? রাজা বাঁচিল মরিল, তাতে তোমার কি? তোমার স্বামী বলিয়া কি তোমার এত ব্যথা? এই কি সন্ন্যাস?
    শ্রী। তা হোক না হোক—রাজা মরিলেই কোন সর্বভূতের হিতসাধন হইল?
    জ। রাজা মরিবে না, ভয় নাই। ছেলে খেলানা হারাইলে কাঁদে, মরে না। তুমি ঈশ্বরে কর্মসংন্যাস করিয়া যাহাতে সংযতচিত্ত হইতে পার, তাই কর।
    শ্রী। তা হইলে এখান হইতে প্রস্থান করিতে হয়।
    জ। এখনই।
    শ্রী। কি প্রকারে যাই? দ্বারবানেরা ছাড়িবে কেন?
    জ। তোমার সে গৈরিক, রুদ্রাক্ষ, ত্রিশূল সবই আছে দেখিতেছি। ভৈরবীবেশে পলাও, দ্বারবানেরা কিছু বলিবে না।
    শ্রী। মনে করিবে, তুমি যাইতেছ? তার পর তুমি যাইবে কি প্রকারে?
    জয়ন্তী হাসিয়া বলিল, “এ কি আমার সৌভাগ্য! এত কালের পর আমার জন্য ভাবিবার একটা লোক হইয়াছে! আমি নাই যাইতে পারিলাম, তাতে ক্ষতি কি দিদি?”
    শ্রী। রাজার হাতে পড়িবে—কি জানি, রাজা যদি তোমার উপর ক্রুদ্ধ হন!
    জ। হইলে আমার কি করিবেন? রাজার এমন কোন ক্ষমতা আছে কি যে, সন্ন্যাসিনীর অনিষ্ট করিতে পারে?
    জয়ন্তীর উপর শ্রীর অনন্ত বিশ্বাস। সুতরাং শ্রী আর বাদানুবাদ না করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার সঙ্গে কোথায় সাক্ষাৎ হইবে?”
    জ। তুমি বরাবর—গ্রামে যাও। সেখানে রাজার পুরোহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। তোমার ত্রিশূল আমাকে দাও, আমার ত্রিশূল তুমি নাও। সে গ্রামের রাজার পুরোহিত আমার মন্ত্রশিষ্য। তিনি আমার চিহ্নিত ত্রিশূল দেখিলে তুমি যা বলিবে, তাই করিবেন। তাঁকে বলিও, তোমাকে অতি গোপনীয় স্থানে লুকাইয়া রাখেন। কেন না, তোমার জন্য বিস্তর খোঁজ তল্লাশ হইবে। তিনি তোমাকে রাজপুরীমধ্যে লুকাইয়া রাখিবেন। সেইখানে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইবে।
    তখন শ্রী জয়ন্তীর পদধূলি গ্রহণ করিয়া আবার বনবাসে নিষ্ক্রান্ত হইল। দ্বারবানেরা কিছু বলিল না।

    সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

    রা। ভয়ানক ব্যাপার! লোক অস্থির হ’য়ে উঠলো।
    শ্যা। তাই ত দাদা। আর তিলার্ধ এ রাজ্যে থাকা নয়।
    রা। তা তুমি ত আজ কত দিন ধ’রে যাই যাই ক’চ্ছো—যাও নি যে?
    শ্যা। যাওয়ারই মধ্যে, মেয়ে ছেলে সব নলডাঙ্গা পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে আমার কিছু লহনা পড়ে রয়েছে, সেগুলা যতদূর হয়, আদায় ওসুল ক’রে নিয়ে যাই। আর আদায় ওসুল বা করবো কার কাছে—দেনেওয়ালারাও সব ফেরার হয়েছে।
    রা। আচ্ছা, এ আবার নূতন ব্যাপার কি? কেন এত হাঙ্গামা, তা কিছু জান? শুনেছি না কি, হাবুজখানায় আর কয়েদী ধরে না, নূতন চালাগুলাতেও ধরে না, এখন না কি গোহালের গোরু বাহির করিয়া কয়েদী রাখছে?
    শ্যা। ব্যাপারটা কি জান না? সেই ডাকিনীটা পালিয়েছে।
    রা। তা শুনেছি। আচ্ছা, সে ডাকিনীটা ত এত যাগ-যজ্ঞে কিছুতেই গেল না—এখন আপনি পালাল যে?
    শ্যা। আপনি কি আর গিয়েছে? (চুপি চুপি) বল্তেজ গায়ে কাঁটা দেয়। সে নাকি দেবতার তাড়নায় গিয়েছে।
    রা। সে কি?
    শ্যা। এই নগরে এক দেবী অধিষ্ঠান করেন শুন নি? তিনি কখন কখন দেখা দেন— অনেকেই তাঁকে দেখেছে। কেন, যে দিন ছোট রাণীর পরীক্ষা হয়, সে দিন তুমি ছিলে না?
    রা। হাঁ! হাঁ! সেই তিনিই! আচ্ছা, বল দেখি তিনি কে?
    শ্যা। তা তিনি কি কারও কাছে আপনার পরিচয় দিতে গিয়েছেন! তবে পাঁচ জন লোকে পাঁচ রকম বলচে।
    রা। কি বলে?
    শ্যা। কেউ বলে, তিনি এই পুরীর রাজলক্ষ্মী; কেউ বলে, তিনি স্বয়ং লক্ষ্মীনারায়ণজিউর মন্দির হইতে কখনও কখনও রূপ ধারণ ক’রে বা’র হন, লোকে এমন দেখেছে। কেউ বলে,তিনি স্বয়ংদশভূজা; দশভূজার মন্দিরে গিয়া অন্তর্ধান হ’তে তাঁকে না কি দেখেছে।
    রা। তাই হবে। নইলে তিনি ভৈরবীবেশে ধারণ করবেন কেন? সে সভায় ত তিনি ভৈরবীবেশে অধিষ্ঠান করেছিলেন?
    শ্যা। তা যিনিই হ’ন, আমাদের অনেক ভাগ্য যে, আমরা তাঁকে সে দিন দর্শন করেছিলাম। কিন্তু রাজার এমনই মতিচ্ছন্ন ধরেছে যে—
    রা। হাঁ-তার পর ডাকিনীটা গেল কি ক’রে শুনি।
    শ্যা। সেই দেবী, ডাকিনী হ’তে রাজ্যের অমঙ্গল হ’চ্ছে দেখে, এক দিন ভৈরবীদেশে ত্রিশূল ধারণ ক’রে তাকে বধ করতে গেলেন।
    রা। ইঃ! তার পর?
    শ্যা। তার পর আর কি? মার রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে, সেটা তালগাছপ্রমাণ বিকটাকার মূর্তি ধারণ ক’রে ঘোর গর্জন করতে করতে কোথায় যে আকাশপথে উড়ে গেল, কেউ আর দেখতে পেলে না।
    রা। কে বললে?
    শ্যা। বললে আর কে? যারা দেখেছে, তারাই বলেছে। রাজা এমনই সেই ডাকিনীর মায়ায় বদ্ধ যে, সেটা গেছে ব’লে চিত্তবিশ্রামের যত দ্বারবান দাস—দাসী, সবাইকে ধরে এনে কয়েদ করেছেন। তারাই এই সব কথা প্রকাশ করেছে। তারা বলে, “মহারাজ! আমাদের অপরাধ কি? দেবতার কাছে আমরা কি করব?”
    রা। গল্প কথা নয় ত?
    শ্যা। এ কি আর গল্প কথা!
    রা। কি জানি। হয় ত ডাকিনীটা মড়া ফড়া খাবার জন্য রাত্রিতে কোথা বেরিয়ে গিয়েছিল, আর আসে নি। এখন রাজার পীড়াপীড়িতে তারা আপনার বাঁচন জন্য একটা রচে-মচে বলচে।
    শ্যা। এ কি আর রচা কথা? তারা দেখেছে যে, সেটার এমন এমন মূলোর মত দাঁত, শোণের মত চুল, বারকোশের মত চোখ, একটা আস্ত কুমীরের মত জিব, দুটো জালার মত দুটো স্তন, মেঘগর্জনের মত নিশ্বাস, আর ডাকেতে একেবারে মেদিনী বিদীর্ণ!
    রা। সর্বনাশ! এ ত বড় অদ্ভুত ব্যাপার! রাজার মতিচ্ছন্ন ধরেছে বলছিলে কি?
    শ্যা। তাই বল‍‍চি শোন না। এই ত গেল নিরপরাধী বেচারাদের নাহক কয়েদ। তার পর, সেই ডাকিনীটাকে খুঁজে ধরে আনবার জন্য রাজা ত দিক‍‍বিদিকে কত লোকই পাঠাচ্চেন। এখন সে আপানার স্বস্থানে চলে গেছে, মনুষ্যের সাধ্য কি, তাকে সন্ধান ক’রে ধ’রে আনে। কেউ ত পারচে না—সবাই এসে জোড় হাত ক’রে এত্তেলা করছে যে, সন্ধান করতে পারলে না।
    রা। তাতে রাজা কি বলেন?
    শ্যা। এখন যাই কেউ ফিরে এসে বলচে যে, সন্ধান পেলে না, অমনই রাজা তাকে কয়েদে পাঠাচ্চেন। এই করে ত হাবুজখানা পরিপূর্ণ। এ দিকে রাজপুরুষদের এমনই ভয় লেগেছে যে, বাড়ী, ঘর, দ্বার, স্ত্রী, পুত্র ছেড়ে পালাচ্ছে। দেখাদেখি নগরের প্রজা দোকানদারও সব পালাচ্চে।
    রা। তা, দেবী কি করেন? তিনি কটাক্ষ করিলেই ত এই সকল নিরপরাধী লোক রক্ষা পায়।
    শ্যা। তিনি সাক্ষাৎ ভগবতী! তিনি এই সকল ব্যাপার দেখিয়া ভৈরবীবেশে রাজাকে দর্শন দিয়া বলিলেন, “রাজা! নিরপরাধীর পীড়ন করিও না। নিরপরাধীর পীড়ন করিলে, রাজার রাজ্য থাকে না। এদের কোন দোষ নাই। আমিই সেটাকে তাড়াইয়াছি—কেন না, সেটা হ’তে তোমার রাজ্যের অমঙ্গল হতেছিল। দোষ হয়ে থাকে, আমারই হয়েছে। দণ্ড করিতে হয়, ওদের ছেড়ে দিয়ে আমারই দণ্ড কর।
    রা। তার পর?
    শ্যা। তাই বলছিলাম, রাজার বড় মতিচ্ছন্ন ধরেছে। সেটা পলায়ন অবধি রাজার মেজাজ এমন গরম যে, কাক পক্ষী কাছে যেতে পাচ্চে না। তর্কালঙ্কার ঠাকুর গিয়েছিলেন, বড় রাণী কাছে গিয়েছিলেন, গাল খেয়ে পালিয়ে এলেন।
    রা। সে কি! গুরুকে গালি—গালাজ? নির্বংশ হবেন যে!
    শ্যা। তার কি আর কথা আছে? তার পর শোন না। গরম মেজাজের প্রথম মোহড়াতেই সেই দেবতা গিয়া ঐ কথা বললেন। বলতেই রাজা চক্ষু আরক্ত করিয়া তাঁকে স্বহস্তে প্রহার করিতেই উদ্যত। তা না ক’রে, যা করেছে, সে ত আরও ভয়ানক!
    রা। কি করেছে?
    শ্যা। ঠাকুরাণীকে কয়েদ করেছে। আর হুকুম দিয়েছে যে, তিন দিনের মধ্যে ডাকিনীকে যদি না পাওয়া যায়, তবে সমস্ত রাজ্যের লোকের সমুখে (সেই দেবীকে) উলঙ্গ ক’রে চাঁড়ালের দ্বারা বেত মারিবে।
    রা। হো! হো! হোহো! দেবতার আবার কি করিবে! রাজা কি পাগল হয়েছে! তা, মা কি কয়েদ গিয়েছেন না কি? তাঁকে কয়েদ করে কার বাপের সাধ্য?
    শ্যা। দেবচরিত্র কার সাধ্য বুঝে! রাজার না কি রাজ্যভোগের নির্দিষ্ট কাল ফুরিয়েছে, তাই মা ছল ধরিয়া, এখন স্বধামে গমনের চেষ্টায় আছেন। রাজা কয়েদের হুকুম দিলেন, মা স্বচ্ছন্দে গজেন্দ্রমনে কারাগারমধ্যে গিয়া প্রবেশ করিলেন। শুনিতে পাই, রাত্রে কারাগারে মহাকোলাহল উপস্থিত হয়। যত দেবতারা আসিয়া স্তব পাঠ করেন—ঋষিরা আসিয়া বেদ পাঠ, মন্ত্র পাঠ করেন। পাহারাওয়ালা বাহির হইতে শুনিতে পায়, কিন্তু দ্বার খুলিলেই সব অন্তর্ধান হয়। (বলা বাহুল্য যে, জয়ন্তী নিজেই নিজেই রাত্রিকালে ঈশ্বরস্তোত্র পাঠ করেন। পাহারাওয়ালারা তাহাই শুনিতে পায়।)
    রাম। তার পর?
    শ্যাম। তার পর এখন আজ সে তিন দিন পুরিল। রাজা ঢেঁট্য়‍রা দিয়েছেন যে, কাল এক মাগী চোরকে বেইজ্জৎ করিয়া বেত মারা হইবে, যাহার ইচ্ছা হয় দেখিতে আসিতে পারে। শুন নাই?
    রাম। কি দুর্বুদ্ধি! তর্কালঙ্কার ঠাকুরই বা কিছু বলেন না কেন? বড় রাণী বা কিছু বলেন না কেন? দুটো গালাগালির ভয়ে কি তাঁরা আর কাছে আসিতে পারেন না?
    শ্যাম। তাঁরা না কি অনেক বলেছেন। রাজা বলেন, ভাল, দেবতাই যদি হয়, তবে আপনার রক্ষা আপনিই করিবে, তোমাদের কথা কবার প্রয়োজন কি? আর যদি মানুষ হয়, তবে আমি রাজা, চোরের দণ্ড আমি দিব, তোমাদের কথা কবার প্রয়োজন কি?
    রাম। তা এক রকম বলেছে মন্দ নয়—ঠিক কথাই ত। তা ব্যাপারটা কি হয়, কাল দেখতে যেতে হবে। তুমি যাবে?
    শ্যাম। যাব বৈ কি! সবাই যাবে। এমন কাণ্ড কে না দেখতে যাবে?

    অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

    আজ জয়ন্তীর বেত্রাঘাত হইবে। রাজ্যে ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে যে, তাহাকে বিবস্ত্রা করিয়া বেত্রাঘাত করা হইবে। প্রভাত হইতে লোক আসিতে আরম্ভ করিল। বেলা অল্প হইতেই দুর্গ পরিপূর্ণ হইল, আর লোক ধরে না। ক্রমে ঠেসাঠেসি ঘেঁসাঘেঁসি পেষাপেষি মিশামিশি হইতে লাগিল। এই দুর্গমধ্যে আর এক দিন এমনই লোকারণ্য হইয়াছিল— দিন রমার বিচার। আজ জয়ন্তীর দণ্ড। বিচার অপেক্ষা দণ্ড দেখিতে লোক বেশী আসিল। নন্দা বাতায়ন হইতে দেখিলেন, কালো চুল মাথার তরঙ্গ ভিন্ন আর কিছু দেখা যায় না; কদাচিৎ কোন স্ত্রীলোকের মাথায় আঁচল বা কোন পুরুষের মাথায় চাদর জড়ান, সেই কৃষ্ণসাগরে ফেনরাশির ন্যায় ভাসিতেছে। সেই রমার পরীক্ষা নন্দার মনে পড়িল, কিন্তু মনে পড়িল যে, সে দিন দেখিয়াছিলেন যে, সেই জনার্ণব বড় চঞ্চল, সংক্ষুব্ধ, যেন বাত্যাতাড়িত; রাজপুরুষেরা কষ্টে শান্তি রক্ষা করিয়াছিল;–আজ সকলেই নিস্তব্ধ। সকলেরই মনে রাজ্যের অমঙ্গল আশঙ্কা বড় জাগরূক। সকলেই মনে মনে ভয় পাইতেছিল। আজ এই লোকারণ্য সিংহব্যাঘ্রবিমর্দিত মহারণ্য অপেক্ষাও ভয়ানক দেখাইতেছিল। সেই বৃহৎ দুর্গপ্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে এই উচ্চ মঞ্চ নির্মিত হইয়াছিল। তদুপরি এক কৃষ্ণকায় বলিষ্ঠগঠন বিকটদর্শন চণ্ডাল, মূর্তিমান অন্ধকারের ন্যায় দীর্ঘ বেত্র হস্তে লইয়া দণ্ডায়মান আছে। জয়ন্তীকে তদুপরি আরোহণ করাইয়া সর্বসমক্ষে বিবস্ত্রা করিয়া সেই চণ্ডাল বেত্রাঘাত করিবে, ইহাই রাজাজ্ঞা।
    জয়ন্তীকে এখনও সেখানে আনা হয় নাই। রাজা এখনও আসে নাই—আসিলে তবে তাহাকে আনা হইবে। মঞ্চের সম্মুখে রাজার জন্য সিংহাসন রক্ষিত হইয়াছে। তাহা বেষ্টন করিয়া চোপদার ও সিপাহীগণ দাঁড়াইয়া আছে। অমাত্যবর্গ আজ সকলেই অনুপস্থিত। এমন কুকাণ্ড দেখিতে আসিতে কাহারও প্রবৃত্তি হয় নাই। রাজাও কাহাকে ডাকেন নাই।
    কতক্ষণে রাজা আসিবেন, কতক্ষণে সেই দণ্ডনীয় দেবী বা মানবী আসিবে, কতক্ষণে কি হইবে, সেই জন্য প্রত্যাশাপন্ন হইয়া লোকারণ্য ঊর্ধ্বমুখ হইয়াছিল। এমন সময়ে হঠাৎ নকিব ফুকরাইল; স্তাবকেরা স্তুতিবাদ করিল। দর্শকেরা জানিল, রাজা আসিতেছেন।
    রাজার আজ বেশভূষার কিছুমাত্র পারিপাট্য নাই—বৈশাখের দিনানন্তকালের মেঘের মত রাজা আজ ভয়ঙ্করমূর্তি! আয়ত চক্ষু রক্তবর্ণ-বিশাল বক্ষ মধ্যে মধ্যে স্ফীত ও উচ্ছ্বসিত হইতেছে। বর্ষণোন্মুখ জলধরের উন্নমনের ন্যায় রাজা আসিয়া সিংহাসনের উপর বসিলেন। কেহ বলিল না, “মহারাজাধিরাজকি জয়!”
    তখন সেই লোকরণ্য ঊর্ধমুখ হইয়া ইতস্ততঃ দেখিতে লাগিল—দেখিল, সেই সময়ে প্রহরিগণ জয়ন্তীকে লইয়া মঞ্চোপরি আরোহণ করিতেছে। প্রহরীরা তাহাকে মঞ্চোপরি স্থাপিত করিয়া চলিয়া গেল। কোন প্রাসাদশিখরোপরি উদিত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় জয়ন্তীর অতুলনীয় রূপরাশি সেই মঞ্চোপরি উদিত হইল। তখন সেই সহস্র সহস্র দর্শক ঊর্ধ্বমুখে, উৎক্ষিপ্তলোচনে গৈরিকবসনাবৃতা মঞ্চস্থা অপূর্ব জ্যোতির্ময়ী মূর্তি নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। সেই উন্নত, সম্পূর্ণায়ত, ললিত মধুর অথচ উজ্জ্বল জ্যোতির্বিশিষ্ট দেহ; তাহার দেবোপম স্থৈর্য্য—দেবদুর্ল্লভ শান্তি; সকলে বিমুগ্ধ হইয়া দেখিতে লাগিল। দেখিল, জয়ন্তীর নবরবিকরপ্রোদ্ভিন্ন পদ্মবৎ অপূর্ব প্রফুল্ল মুখ; এখনও অধরভরা মৃদু মৃদু মধুর স্নিগ্ধ বিনম্র হাস্য—সর্ববিপৎসংহারিণী শক্তির পরিচয়স্বরূপ সেই স্নিগ্ধ মধুর মন্দহাস্য! দেখিয়া, অনেকে দেবতা জ্ঞানে যুক্তকরে প্রণাম করিল। তখন কতকগুলি লোক দেখিল, আর কতকগুলি লোক জয়ন্তীকে প্রণাম করিতেছে-তখন তাহাদের মনে সেই ভক্তিভাব প্রবেশ করিল। তখন তাহারা “জয় মায়িকি জয়!” “জয় লছ‍‍মী মায়িকি জয়!” ইত্যাদি ঘোর রবে জয়ধ্বনি করিল। সেই জয়ধ্বনি ক্রমে ক্রমে প্রাঙ্গণের এক ভাগ হইতে অপর ভাগে, এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্তে গিরিশ্রেণীস্থিত বজ্রনাদের মত প্রক্ষিপ্ত ও প্রবাহিত হইতে লাগিল। শেষ সেই সমবেত লোকসমারোহ এককণ্ঠ হইয়া তুমুল জয়শব্দ করিল। পুরী কম্পিতা হইল। চণ্ডালের হস্ত হইতে বেত্র খসিয়া পড়িল। জয়ন্তী মনে মনে ডাকিতে লাগিল, “জয় জগদীশ্বর! তোমারই জয়! তুমি আপনি এই লোকারণ্য, আপনিই এই লোকের কণ্ঠে থাকিয়া, আপনার জয়বাদ আপনিই দিতেছ! জয় জগন্নাথ! তোমারই জয়! আমি কে?”
    ক্রুদ্ধ রাজা তখন অগ্নিমূর্তি হইয়া মেঘগম্ভীস্বরে চণ্ডালকে আজ্ঞা করিলেন, “কাপড় কাড়িয়া নিয়া বেত লাগা!”
    এই সময়ে চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার সহসা রাজসমীপে আসিয়া রাজার দুইটি হাত ধরিলেন। বলিলেন, “মহারাজ! রক্ষা কর! আমি আর কখনও ভিক্ষা চাহিব না, এইবার আমায় এই ভিক্ষা দাও—ইঁহাকে ছাড়িয়া দাও |”
    রাজা। (ব্যাঙ্গের সহিত) কেন—দেবতার এমন সাধ্য নাই যে, আপনি ছাড়াইয়া যায়! বেটী জুয়াচোরের উচিত শাসন হইতেছে।
    চ। দেবতা না হইলে-স্ত্রীলোক বটে।
    রাজা। স্ত্রীলোকেরও রাজা দণ্ড করিতে পারেন।
    চ। এই জয়ধ্বনি শুনিতেছেন? এই জয়ধ্বনিতে আপনার রাজার নাম ডুবিয়া যাইতেছে।
    রাজা। ঠাকুর! আপনার কাজে যাও। পুঁথি পাঁজি নাই কি?
    চন্দ্রচূড় চলিয়া গেলেন। তখন চণ্ডাল পুনরপি রাজাজ্ঞা পাইয়া আবার বেত উঠাইয়া লইল—বেত উঁচু করিল—জয়ন্তীর মুখ প্রতি চাহিয়া দেখিল; বেত নামাইয়া-রাজার পানে চাহিল—আবার জয়ন্তীর পানে চাহিল—শেষ বেত আছাড়িয়া ফেলিয়া দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
    “কি!” বলিয়া রাজা বজ্রের ন্যায় শব্দ করিলেন।
    চণ্ডাল বলিল, “মহারাজ! আমা হইতে হইবে না |”
    রাজা বলিলেন, “তোমাকে শূলে যাইতে হইবে |”
    চণ্ডাল জোড়হাত করিয়া বলিল, “মহারাজের হুকুমে তা পারিব। এ পারিব না |”
    তখন রাজা অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন, “চণ্ডালকে ধরিয়া লইয়া গিয়া কয়েদ কর |”
    রক্ষিবর্গ চণ্ডালকে ধরিবার জন্য মঞ্চের উপর আরোহণ করিতে উদ্যত দেখিয়া, জয়ন্তী সীতারামকে বলিলেন, “এ ব্যক্তিকে পীড়ন করিবেন না, আপনার যে আজ্ঞা, আমি নিজেই পালন করিতেছি-চণ্ডাল বা জল্লাদের প্রয়োজন নাই |” তথাপি রক্ষিবর্গ চণ্ডালকে ধরিতে আসিতেছে দেখিয়া, জয়ন্তী তাহাকে বলিল, “বাছা! তুমি আমার জন্য কেন দুঃখ পাইবে? আমি সন্ন্যাসিনী, আমার কিছুতেই সুখ—দুঃখ নাই; বেতে আমার কি হইবে? আর বিবস্ত্র—সন্ন্যাসিনীর পক্ষে সবস্ত্র বিবস্ত্র সমান। কেনদুঃখপাও-বেত তোল |”
    চণ্ডাল বেত উঠাইল না। জয়ন্তী তখন চণ্ডালকে বলিল, “বাছা! স্ত্রীলোকের কথা বলিয়া বিশ্বাস করিলে না—এই তার প্রমাণ দেখ |” এই বলিয়া জয়ন্তী আপনি বেত উঠাইয়া লইয়া, দক্ষিণ হস্তে দৃঢ়মুষ্টিতে তাহা ধরিল। পরে সেই জনসমারোহ সমক্ষে, আপনার প্রফুল্লপদ্মসন্নিভ রক্তপ্রভ ক্ষুদ্র করপল্লব পাতিয়া, সবলে তাহাতে বেত্রাঘাত করিল। বেত মাংস কাটিয়া লইয়া উঠিল-হাতে রক্তের স্রোত বহিল। জয়ন্তীর গৈরিক বস্ত্র এবং মঞ্চতল তাহাতে প্লাবিত হইল। দেখিয়া লোকে হাহাকার করিতে লাগিল।
    জয়ন্তী মৃদু হাসিয়া চণ্ডালকে বলিল, “দেখিলে বাছা! সন্ন্যাসিনীকে কি লাগে? তোমার ভয় কি?”
    চণ্ডাল একবার রুধিরাক্ত ক্ষত পানে চাহিল—একবার জয়ন্তীর সহাস্য প্রফুল্ল মুখ পানে চাহিয়া দেখিল—দেখিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া, অতি ত্রস্তভাবে মঞ্চসোপান অবরোহণ করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। লোকারণমধ্যে সে কোথায় লুকাইল, কেহ দেখিতে পাইল না।
    রাজা তখন অনুচরবর্গকে আজ্ঞা করিলেন, “দোস‍‍রা লোক লইয়া আইস-মুসলমান |”
    অনুচরবর্গ, কালান্তক যমের সদৃশ এক জন কসাইকে লইয়া আসিল। সে মহম্মদপুরে গোরু কাটিতে পারিত না—কিন্তু নগরপ্রান্তে বক‍‍রি মেড়া কাটিয়া বেচিত। সে ব্যক্তি অতিশয় বলবান ও কদাকার। সে রাজাজ্ঞা পাইয়া মঞ্চের উপর উঠিয়া, বেত হাতে লইয়া জয়ন্তীর সম্মুখে দাঁড়াইল। বেত উঁচু করিয়া কসাই জয়ন্তীকে বলিল, “কাপ‍ড়া উতার—তেরি গোশ‍ত টুক‍‍রা টুক‍রা করকে হাম দোকানমে বেচেঙ্গে |”
    জয়ন্তী তখন অপরিম্লান মুখে, জনসমারোহকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “রাজাজ্ঞায় এই মঞ্চের উপর বিবস্ত্র হইব। তোমাদের মধ্যে যে সতীপুত্র হইবে, সেই আপনার মাতাকে স্মরণ করিয়া ক্ষণকালের জন্য এখন চক্ষু আবৃত করুক। যাহার কন্যা আছে, সেই আপনার কন্যাকে মনে করিয়া, আমাকে সেই কন্যা ভাবিয়া চক্ষু আবৃত করুক। যে হিন্দু, যাহার দেবতা ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে, সেই চক্ষু আবৃত করুক। যাহার মাতা অসতী, যে বেশ্যার গর্ভে জন্মিয়াছে, সে যাহা ইচ্ছা করুক, তাহার কাছে আমার লজ্জা নাই, আমি তাহাদের মনুষ্যের মধ্যে গণ্য করি না |”
    লোকে এই কথা শুনিয়া চক্ষু বুজিল, কি না বুজিল, জয়ন্তী তাহা আর চাহিয়া দেখিল না। মন তখন খুব উঁচু সুরে বাঁধা আছে—জয়ন্তী তখন জগদীশ্বর ভিন্ন আর কাহাকে দেখিতে পাইতেছে না। জয়ন্তী কেবল রাজার দিকে ফিরিয়া বলিল, “তোমার আজ্ঞায় আমি বিবস্ত্র হইব। কিন্তু তুমি চাহিয়া দেখিও না। তুমি রাজ্যেশ্বর; তোমায় পশুবৃত্ত দেখিলে প্রজারা কি না করিবে? মহারাজ, আমি বনবাসী, বনে থাকিতে গেলে অনেক সময়ে বিবস্ত্র হইতে হয়। একদা আমি বাঘের মুখে পড়িয়াছিলাম-বাঘের মুখ হইতে আপনার শরীর রক্ষা করিতে পারিয়াছিলাম, কিন্তু বস্ত্র রক্ষা করিতে পারি নাই। তোমাকেও আমি, তোমার আচরণ দেখিয়া সেইরূপ বন্য পশু মনে করিতেছি, অতএব তোমার কাছে আমার লজ্জা হইতেছে না। কিন্তু তোমার লজ্জা হওয়া উচিত-কেন না, তুমি রাজা এবং গৃহী, তোমার মহিষী আছেন, চক্ষু বুজ |”
    বৃথা বলা! তখন মহাক্রোধান্ধাকারে রাজা একেবারে অন্ধ হইয়াছেন। জয়ন্তীর কথার কোন উত্তর না দিয়া কসাইকে বলিলেন, “জবরদস্তী কাপ‍ড়া উতার লেও |”
    তখন জয়ন্তী আর বৃথা কথা না কহিয়া, জানু পাতিয়া মঞ্চের উপর বসিল। জয়ন্তী আপনার কাছে আপনি ঠকিয়াছে,–এখন বুঝি জয়ন্তীর চোখে জল আসে। জয়ন্তী মনে করিয়াছিল, “যখন পৃথিবীর সকল সুখ-দুঃখে জলাঞ্জলি দিয়াছি, যখন আর আমার সুখও নাই, দুঃখও নাই, তখন আমার আবার লজ্জা কি? ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আমার মনের যখন কোন সম্বন্ধ নাই, তখন আমার আর বিবস্ত্র আর সবস্ত্র কি? পাপই লজ্জা, আবার কিসে লজ্জা করিব? জগদীশ্বরের নিকট ভিন্ন, সুখ-দুঃখের অধীন মনুষ্যের কাছে লজ্জা কি? আমি কেন এই সভামধ্যে বিবস্ত্র হইতে পারিব না?” তাই জয়ন্তী এতক্ষণ আপনাকে বিপন্নই মনে করে নাই—বেত্রাঘাতটা ত গণ্যের মধ্যে নহে। কিন্তু এখন যখন বিবস্ত্র হইবার সময় উপস্থিত হইল-তখন কোথা হইতে এই পাপ লজ্জা আসিয়া সেই ইন্দ্রিয়বিজয়িনী সুখ—দুঃখ বর্জিতা জয়ন্তীকেও অভিভূত করিল। তাই নারীজন্মকে ধিক্কার দিয়া জয়ন্তী মঞ্চতলে জানু পাতিয়া বসিল। তখন যুক্তকরে, পবিত্রচিত্তে জয়ন্তী আত্মাকে সমাহিত করিয়া মনে মনে ডাকিতে লাগিল, “দীনবন্ধু! আজ রক্ষা কর! মনে করিয়াছিলাম, বুঝি এ পৃথিবীর সকল সুখ দুঃখে জলাঞ্জলি দিয়াছি, কিন্তু হে দর্পহারী! আমার দর্প চূর্ণ হইয়াছে, আমায় আজ রক্ষা কর! নারীদেহ কেন দিয়াছিলে, প্রভু! সব সুখ—দুঃখ বিসর্জন করা যায়, কিন্তু নারীদেহ থাকিতে লজ্জা বিসর্জন করা যায় না। তাই আজ কাতরে ডাকিতেছি, জগন্নাথ! আজ রক্ষা কর |”
    যতক্ষণ জয়ন্তী জগদীশ্বরকে ডাকিতেছিল, ততক্ষণ কসাই অঞ্চল ধরিয়া আকর্ষণ করিতেছিল। দেখিয়া সমস্ত জনমণ্ডলী এককণ্ঠে হাহাকার শব্দ করিতে লাগিল-বলিতে লাগিল, “মহারাজ! এই পাপে তোমার সর্বনাশ হইবে-তোমার রাজ্য গেল |” রাজা কর্ণপাত করিলেন না। নিরুপায় জয়ন্তী আপনার অঞ্চল ধরিয়া টানাটানি করিতেছিল, ছাড়িতেছিল না। তাহার চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছিল। শ্রী থাকিলে বড় বিস্মিতা হইত—জয়ন্তীর চক্ষুতে আর কখনও কেহ জল দেখে নাই। জয়ন্তী রুধিরাক্ত ক্ষত হস্তে আপনার অঞ্চল ধরিয়া ডাকিতেছিল, “জগন্নাথ! রক্ষা কর |”
    বুঝি জগন্নাথ সে কথা শুনিলেন। সেই অসংখ্য জনসমূহ হাহাকার করিতে করিতে সহসা আবার জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। “রাণীজিকি জয়! মহারাণীজিকি জয়! দেবীকি জয়!” এই সময়ে অধোমুখী জয়ন্তীর কর্ণে অলঙ্কারশিঞ্জিত প্রবেশ করিল। তখন জয়ন্তী মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, সমস্ত পৌরস্ত্রী সঙ্গে করিয়া মহারাণী নন্দা মঞ্চোপরি আরোহণ করিতেছেন। জয়ন্তী উঠিয়া দাঁড়াইল।
    সেই সমস্ত পৌরস্ত্রী জয়ন্তীকে ঘেরিয়া দাঁড়াইল। মহারাণী নিজে জয়ন্তীকে আড়াল করিয়া, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইলেন। দর্শকেরা সকলে করতালি দিয়া হরিবোল দিতে লাগিল। কসাই জয়ন্তীর হাত ছাড়িয়া দিল, কিন্তু মঞ্চ হইতে নামিল না।
    রাজা অত্যন্ত বিস্মিত ও রুষ্ট হইয়া অতি পরুষভাবে নন্দাকে বলিলেন, “এ কি এ মহারাণী!”
    নন্দা বলিলেন, “মহারাজ! আমি পতিপুত্রবতী। আমি জীবিত থাকিতে তোমাকে কখনও এ পাপ করিতে দিব না। তাহা হইলে আমার কেহ থাকিবে না |”
    রাজা পূর্ববৎ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “তোমার ঠাঁই অন্তঃপুরে, এখানে নয়। অন্তঃপুরে যাও |”
    নন্দা সে কথার কোন উত্তর না দিয়া বলিল, “মহারাজ! আমি যে মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়াছি, এই কসাইটা সেই মঞ্চে দাঁড়াইয়া থাকে কোন সাহসে? উহাকে নামিতে আজ্ঞা দিন |”
    রাজা কথা কহিলেন না। তখন নন্দা উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “এই রাজপুরীমধ্যে আমার কি এমন কেহ নাই যে, এটাকে নামাইয়া দেয়?”
    তখন সহস্র দর্শক এককালে “মার! মার!” শব্দ করিয়া কসাইয়ের প্রতি ধাবমান হইল। সে লম্ফ দিয়া মঞ্চ হইত পড়িয়া পলাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু দর্শকগণ তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়া, মারিতে মারিতে দুর্গের বাহিরে লইয়া গেল। পরে অনেক লাঞ্ছনা করিয়া, প্রাণ মাত্র রাখিয়া ছাড়িয়া দিল।
    নন্দা জয়ন্তীকে বলিল, “মা! দয়া করিয়া অভয় দাও। মা! আমার বড় ভয় হইতেছে, পাছে কোন দেবতা ছলনা করিতে আসিয়া থাকেন। মা! অপরাধ লইও না। একবার অন্তঃপুরে পায়ের ধূলা দিবে চল, আমি তোমার পূজা করিব |”
    তখন রাণী পৌরস্ত্রীগণ সমভিব্যাহারে জয়ন্তীকে ঘেরিয়া অন্তঃপুরে লইয়া চলিলেন। রাজা কিছু করিতে না পারিয়া সিংহাসন হইতে উঠিয়া গেলেন। তখন মহাকোলাহলপূর্বক, এবং নন্দাকে আশীর্বাদ করিতে করিতে দর্শকমণ্ডলী দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল।
    অন্তঃপুরে গিয়া জয়ন্তী ক্ষণকালও অবস্থিতি করিল না। নন্দা অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া, স্বহস্তে গঙ্গাজলে জয়ন্তীর পা ধুয়াইয়া, সিংহাসনে বসাইতে গেলেন। কিন্তু জয়ন্তী হাসিয়া উড়াইয়া দিল। বলিল, “মা! আমি কায়মনোবাক্যে আশীর্বাদ করিতেছি, তোমাদের মঙ্গল হউক। ক্ষণমাত্র জন্য মনে করিও না যে, আমি কোন প্রকার রাগ বা দুঃখ করিয়াছি। ঈশ্বর না করুন, কিন্তু যদি কখনও তোমার বিপদ পড়ে, জানিতে পারিলে আমি আসিয়া আমার যথাসাধ্য উপকার করিব। কিন্তু রাজপুরীমধ্যে সন্ন্যাসিনীর ঠাঁই নাই। অতএব আমি চলিলাম |” নন্দা এবং পৌরবর্গ জয়ন্তীর পদধূলি লইয়া তাঁহাকে বিদায় করিল।

    ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

    রাজবাড়ীর অন্তঃপুরের কথা বাহিরে যায় বটে, কিন্তু কখনও ঠিক ঠিক যায় না। স্ত্রীলোকের মুখে মুখে যে কথাটা চলিয়া রটিতে থাকে, সেটা কাজেই মুখে মুখে বড় বাড়িয়া যায়। বিশেষ সেখানে একটুখানি বিস্ময়ের গন্ধ থাকে, সেখানে বড় বাড়িয়া যায়। জয়ন্তী সম্বন্ধে অতিপ্রকৃত রটনা পূর্বে যথেষ্টই ছিল, নাগরিকদিগের কথাবার্তায় আমরা দেখিয়াছি। এখন জয়ন্তী রাজপুরীমধ্যে প্রবেশ করিয়াই বাহির হইয়া চলিয়া গিয়াছিল, এই সোজা কথাটা যেরূপে বাহিরে রটিল, তাহাতে লোকে বুঝিল যে, দেবী অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিয়াই অন্তর্ধান হইলেন, আর কেহ তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।
    কাজেই লোকের দৃঢ় প্রত্যয় হইল যে, তিনি নগরের অধিষ্ঠাত্রী এবং রক্ষাকর্ত্রী দেবতা, রাজাকে ছলনা করিয়া, এক্ষণে ছল পাইয়া রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। অতএব রাজ্য আর থাকিবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময়ে জনরব উঠিল যে, মুরশিদাবাদ হইতে নবাবী ফৌজ আসিতেছে। কাজেই রাজ্যধ্বংস যে অতি নিকট, সে বিষয়ে আর বড় বেশী লোকের সন্দেহ রহিল না। তখন নগরমধ্যে বোচ‍কা বাঁধিবার বড় ধুম পড়িয়া গেল। অনেকেই নগর ত্যাগ করিয়া চলিল।
    সীতারাম এ সকলের কোন সংবাদ না রাখিয়া চিত্তবিশ্রামে গিয়া একাকী বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহার চিত্তে ক্রোধই প্রবল—সে ক্রোধ সর্বব্যাপক, সর্বগ্রাসক। অন্যকে ছাড়িয়া ক্রোধ শ্রীর উপরেই অধিক প্রবল হইল।
    উদ্‍ভ্রান্তচিত্তে সীতারাম কতকগুলি নীচব্যবসায়ী নীচাশয় অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন, “রাজ্যে যেখানে যেখানে যে সুন্দরী স্ত্রী আছে, আমার জন্য চিত্তবিশ্রামে লইয়া আইস |” তখন দলে দলে সেই পামরেরা চারি দিকে ছুটিল। যে অর্থের বশীভূতা, তাহাকে অর্থ দিয়া লইয়া আসিল। যে সাধ্বী, তাহাকে বলপূর্বক আনিতে লাগিল। রাজ্যে হাহাকারের উপর আবার হাহাকার পড়িয়া গেল।
    এই সকল দেখইয়া শুনিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুর এবার কাহাকে কিছু না বলিয়া তল্পি বাঁধিয়া মুটের মাথায় দিয়া তীর্থযাত্রা করিলেন। ইহজীবনে আর মহম্মদপুরে ফিরিলেন না।
    পথে যাইতে যাইতে চাঁদশাহ ফকিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। ফকির জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরজি, কোথায় যাইতেছেন?”
    চ। কাশী।-আপনি কোথায় যাইতেছেন?
    ফকির। মোক্কা।
    চ। তীর্থযাত্রায়?
    ফকির। যে দেশে হিন্দু আছে, সে দেশে আর থাকিব না। এই কথা সীতারাম শিখাইয়াছে।

    বিংশ পরিচ্ছেদ

    জয়ন্তী প্রসন্নমনে মহম্মদপুর হইতে নির্গত হইল।দুঃখ কিছুই নাই-মনে বড় সুখ। পথে চলিতে চলিতে মনে মনে ডাকিতে লাগিল— “জয় জগন্নাথ! তোমার দয়া অনন্ত। তোমার মহিমার পার নাই! তোমাকে যে না জানে, যে না ভাবে, সেই ভাবে বিপদ! বিপদ কাহাকে বলে প্রভু? তাহা বলিতে পারি না; তুমি যাহাতে আমাকে ফেলিয়াছিলে, তাহা পরম সম্পদ! আমি এত দিন এমন করিয়া বুঝিতে পারি নাই যে, আমি ধর্মভ্রষ্টা; কেন না, আমি বৃথা গর্বে গর্বিতা, বৃথা অভিমানে অভিমানিনী, অহঙ্কারবিমূঢ়া। অর্জ্জুন ডাকিয়াছিলেন, আমিও ডাকিতেছি প্রভু, শিখাও প্রভু! শাসন কর!

    যচ্ছ্রেয় স্যান্নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে
    শিষ্যস্তেহং সাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ |”

    জয়ন্তী, জগদীশ্বরকে সম্মুখ রাখিয়া, তাঁর সঙ্গে কথোকথন করিতে শিখিয়াছিল। মনের সকল কথা খুলিয়া বিশ্বপতির নিকট বলিতে শিখিয়াছিল। বালিকা যেমন মা—বাপের নিকট আবদার করে, জয়ন্তীও তেমনই সেই পরম পিতামাতার নিকট আবদার করিতে শিখিয়াছিল। এখন জয়ন্তী একটা আবদার লইল। আবদার, সীতারামের জন্য। সীতারামের যে মতি গতি, সীতারাম ত উৎসন্ন যায়, বিলম্ব নাই। তার কি রক্ষা নাই? অনন্ত দয়ার আধারে তাহার জন্য কি একটু দয়া নাই? জয়ন্তী তাই ভাবিতেছিল। ভাবিতেছিল, “আমি জানি, ডাকিলে তিনি অবশ্য শুনেন। সীতারাম ডাকে না-ডাকিতে ভুলিয়া গিয়াছে—নহিলে এমন করিয়া ডুবিবে কেন? জানি, পাপীর দণ্ডই এই যে, সে দয়াময়কে ডাকিতে ভুলিয়া যায়। তাই সীতারাম তাঁকে ডাকিতে ভুলিয়া গিয়াছে, আর ডাকে না। তা, সে না ডাকুক, আমি তার হইয়া জগদীশ্বরকে ডাকিলে তিনি কি শুনিবেন না? আমি যদি বাপের কাছে আবদার করি যে, এই পাপিষ্ঠ সীতারামকে পাপ হইতে মোচন কর, তবে কি তিনি শুনিবেন না? জয় জগন্নাথ! তোমার নামের জয়! সীতারামকে উদ্ধার করিতে হইবে |”
    তার পর জয়ন্তী ভাবিল যে, “যে নিশ্চেষ্ট তাহার ডাক ভগবান শুনেন না। আমি যদি নিজে সীতারামের উদ্ধারের জন্য কোন চেষ্টা না করি, তবে ভগবান কেন আমার কথায় কর্ণপাত করিবেন? দেখি, কি করা যায়। আগে শ্রীকে চাই। শ্রী পলাইয়া ভাল করে নাই। অথবা না পলাইলেও কি হইত বলা যায় না। আমার কি সাধ্য যে, ভগবন্নির্দিষ্ট কার্যকারণপরম্পরা বুঝিয়া উঠি |”
    জয়ন্তী তখন শ্রীর কাছে চলিল। যথাকালে শ্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। জয়ন্তী শ্রীর কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত সবিশেষ বলিল। শ্রী বিষণ্ণ হইয়া বলিল, “রাজার অধঃপতন নিকট। তাঁহার উদ্ধারের কি কোন উপায় নাই?”
    জ। উপায় ভগবান। ভগবান‍‍কে তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন। ভগবান‍কে যে দিন আবার তাঁর মনে হইবে, সেই দিন তাঁহার আবার উন্নতি আরম্ভ হইবে।
    শ্রী। তাহার উপায় কি? আমি যখন তাঁহার কাছে ছিলাম, তখন সর্বদা ভগবৎপ্রসঙ্গই তাঁর কাছে কহিতাম। তিনি মনোযোগ দিয়া শুনিতেন।
    জ। তোমার মুখের কথা, তাই মনোযোগ দিতেন। তোমার মুখপানে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিতেন, তোমার রূপে ও কণ্ঠে মুগ্ধ হইয়া থাকিতেন, ভগবৎপ্রসঙ্গ তাঁর কানে প্রবেশ করিত না। তিনি কোন দিন তোমার এ সকল কথার কিছু উত্তর করিয়াছিলেন কি? কোন দিন কোন তত্ত্বের মীমাংসা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন কি? হরিনামে কোন দিন উৎসাহ দেখিয়াছিলে কি?
    শ্রী। না। তা বড় লক্ষ্য করি নাই।
    জ। তবে সে মনোযোগ তোমার লাবণ্যের প্রতি,–ভগবৎপ্রসঙ্গে নয়।
    শ্রী। তবে, এখন কি কর্তব্য?
    জ। তুমি করিবে কি? তুমি ত বলিয়াছ যে, তুমি সন্ন্যাসিনী, তোমার কর্ম নাই?
    শ্রী। যেমন শিখাইয়াছ।
    জ। আমি কি তাই শিখাইয়াছিলাম? আমি যে শিখাই নাই যে, অনুষ্ঠেয় যে কর্ম, অনাসক্ত হইয়া ফলত্যাগপূর্বক তাহার নিয়ত অনুষ্ঠান করিলেই কর্মত্যাগ হইল, নচেৎ হইল না?14 স্বামিসেবা কি তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম নহে?
    শ্রী। তবে আমাকে পলাইতে পরামর্শ দিয়াছিলে কেন?
    জ। তুমি যে বলিলে, তোমার শত্রু, রাজা নিয়া বার জন। যদি ইন্দ্রিয়গণ তোমার বশ্য নয়, তবে তোমার স্বামিসেবা সকাম হইয়া পড়িবে। অনাসক্তি ভিন্ন কর্মানুষ্ঠানে কর্মত্যাগ ঘটে না। তাই তোমাকে পলাইতে বলিয়াছিলাম। যার যে ভার সয় না, তাকে সে ভার দিই না। “পদং সহেত ভ্রমরস্য পেলবং” ইত্যাদি উপমা মনে আছে ত?
    শ্রী বড় লজ্জিতা হইল। ভাবিয়া বলিল, “কাল উহার উত্তর দিব |”
    সে দিন আর সে কথা হইল না। শ্রী সে দিন জয়ন্তীর সঙ্গে বড় দেখা-সাক্ষাৎ করিল না। পরে জয়ন্তী তাহাকে ধরিল। বলিল, “আমার কথার কি উত্তর সন্ন্যাসিনী?”
    শ্রী বলিল, “আমায় আর একবার পরীক্ষা কর |”
    জয়ন্তী বলিল, “এ কথা ভাল। তবে মহম্মদপুর চল। তোমার আমার অনুষ্ঠেয় কর্ম কি, পথে তাহার পরামর্শ করিতে করিতে যাইব |”
    দুই জনে তখন পুনর্বার মহম্মদপুর অভিমুখে যাত্রা করিল।

    ======================
    14- কার্য্যমিত্যেব যৎ নিয়তং ক্রিয়তেঅর্জ্জুন।
    সঙ্গং ত্যক্তা ফলঞ্চৈব স ত্যাগঃ সাত্ত্বিকো মতঃ || -গীতা, ১৮।৯
    ======================

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী চৌধুরাণী – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article ব্রেজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }