Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সীতারাম – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প190 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    সীতারাম – ১ম খণ্ড – ১১-১৪

    একাদশ পরিচ্ছেদ

    “এই ত বৈতরিণী! পার হইলে না কি সকল জ্বালা জুড়ায়! আমার জ্বালা জুড়াইবে কি?”
    খরবাহিনী বৈতরিণী-সৈকতে দাঁড়াইয়া একাকিনী শ্রী এই কথা বলিতেছিল। পশ্চাৎ অতি দূরে নীলমেঘের মত নীলগিরির।2 শিখরপুঞ্জ দেখা যাইতেছিল; সম্মুখে নীলসলিলবাহিনী বক্রগামিনী তটিনী রজতপ্রস্তরবৎ বিস্তৃত সৈকতমধ্যে বাহিতা হইতেছিল; পারে কৃষ্ণপ্রান্তরনির্মিত সোপানাবলীর উপর সপ্ত মাতৃকার মণ্ডপ শোভা পাইতেছিল; তন্মধ্যে আসীনা সপ্ত মাতৃকার প্রস্তরময়ী মূর্তিও কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল; রাজ্ঞীশোভাসমন্বিতা ইন্দ্রাণী, মধুররূপিণী বৈষ্ণবী, কৌমারী, ব্রহ্মাণী, সাক্ষাৎ বীভৎসসরূপধারিণী যমপ্রসূতি ছায়া, নানালঙ্কারভূষিতা বিপুললোরুকরচরণোরসী কম্বুকণ্ঠান্দোলিতরত্নহারা লম্বোদরা চীনাম্বরা বরাহবদনা বারাহী, বিশুষ্কাস্থিচর্মমাত্রাবিশেষা পলিতকেশা নগ্নাবেশা চণ্ডমুণ্ডধারিণী ভীষণা চামুণ্ডা, রাশি রাশি কুসুম চন্দন বিল্বপত্রে প্রপীড়িতা হইয়া বিরাজ করিতেছে। তৎপশ্চাৎ বিষ্ণুমণ্ডপের উচ্চ চূড়া নীলাকাশে চিত্রিত; তৎপরে নীলপ্রস্তরের উচ্চস্তম্ভোপরি আকাশমার্গে খগপতি গুরুড় সমাসীন।3 অতিদূরে উদয়গিরির ও ললিতগিরির বিশাল নীল কলেবর আকাশপ্রান্তে শয়ান।4 এই সকলের প্রতি শ্রী চাহিয়া দেখিল; বলিল, “হায়! এই ত বৈতরিণী! পার হইলে আমার জ্বালা জুড়াইবে কি?”

    “এ সে বৈতরিণী নহে-
    যমদ্বারে মহাঘোরে তপ্তা বৈতরিণী নদী-
    আগে যমদ্বারে উপস্থিত হও-তবে সে বৈতরিণী দেখিবে |”

    পিছন হইতে শ্রীর কথার কেহ এই উত্তর দিল। শ্রী ফিরিয়া দেখিল, এক সন্ন্যাসিনী।
    শ্রী বলিল, “ওমা! সেই সন্ন্যাসিনী! তা, মা, যমদ্বার বৈতরিণীর এ পারে, না ও পারে?”
    সন্ন্যাসিনী হাসিল, বলিল, “বৈতরিণী পার হইয়া যমপুরে পৌঁছিতে হয়। কেন মা, এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে? তুমি এ পারেই কি যমযন্ত্রণা ভোগ করিতেছ?”
    শ্রী। যন্ত্রণা বোধ হয় দুই পারেই আছে।
    সন্ন্যাসিনী। না, মা, যন্ত্রণা সব এই পারেই। ও পারে যে যন্ত্রণার কথা শুনিতে পাও, সে আমরা এই পার হইতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই। আমাদের এ জন্মের সঞ্চিত পাপগুলি আমরা গাঁটরি বাঁধিয়া, বৈতরিণীর সেই ক্ষেয়ারীর ক্ষেয়ায় বোঝাই দিয়া, বিনা কড়িতে পার করিয়া লইয়া যাই। পরে যমালয়ে গিয়া গাঁটরি খুলিয়া ধীরে সুস্থে সেই ঐশ্বর্য্য একা একা ভোগ করি।
    শ্রী। তা মা, বোঝাটা এ পারে রাখিয়া যাইবার কোন উপায় আছে কি? থাকে ত আমায় বলিয়া দাও, আমি শীঘ্র শীঘ্র উহার বিলি করিয়া বেলায় বেলায় পার হইয়া চলিয়া যাই, রাত করিবার দরকার দেখি না—
    সন্ন্যা। এত তাড়াতাড়ি কেন মা? এখনও তোমার সকাল বেলা।
    শ্রী। বেলা হলে বাতাস উঠিবে।
    সন্ন্যাসিনীর আজিও তুফানের বেলা হয় নাই-বয়সটা কাঁচা রকমের। তাই শ্রী এই রকমের কথা কহিতে সাহস করিতেছিল। সন্ন্যাসিনীও সেই রকম উত্তর দিল, “তুফানের ভয় করি মা! কেন, তোমার কি তেমন পাকা মাঝি নাই?”
    শ্রী। পাকা মাঝি আছে, কিন্তু তাঁর নৌকায় উঠিলাম না। কেন তাঁর নৌকা ভারি করিব?
    সন্ন্যা। তাই কি খুঁজিয়া বৈতরিণী-তীরে আসিয়া বসিয়া আছ?
    শ্রী। আরও পাকা মাঝির সন্ধানে যাইতেছি। শুনিয়াছি, শ্রীক্ষেত্রে যিনি বিরাজ করেন, তিনিই না কি পারের কাণ্ডারী।
    সন্ন্যা। আমিও সেই কাণ্ডারী খুঁজিতে যাইতেছি। চল না, দুই জনে একত্রে যাই। কিন্তু আজ তুমি একা কেন? সে দিন সুবর্ণরেখাতীরে তোমাকে দেখিয়াছিলাম, তখন তোমার সঙ্গে অনেক লোক ছিল—আজ একা কেন?
    শ্রী। আমার কেহ নাই। অর্থাৎ আমার অনেক আছে, কিন্তু আমি ইচ্ছাক্রমে সর্র্বত্যাগী। আমি এক যাত্রীর দলে জুটিয়া শ্রীক্ষেত্রে যাইতেছিলাম, কিন্তু যে যাত্রাওয়ালার (পাণ্ডা) সঙ্গে আমরা যাইতেছিলাম, তিনি আমার প্রতি কিছু কৃপাদৃষ্টি করার লক্ষণ দেখিলাম। কিছু দৌরাত্ম্যের সম্ভাবনা বিবেচনা করিয়া কালি রাত্রিতে যাত্রীর দল হইতে সরিয়া পড়িয়াছিলাম। সন্ন্যা। এখন?
    শ্রী। এখন, বৈতরিণী-তীরে আসিয়া ভাবিতেছি, দুই বার পারে কাজ নাই। একবারই ভাল। জল যথেষ্ট আছে।
    সন্ন্যা। সে কথাটা না হয়, তোমায় আমায় দুই দিন বিচার দেখা যাইবে। তার পর বিচারে যাহা স্থির হয়, তাহাই করিও। বৈতরিণী ত তোমার ভয়ে পলাইবে না! কেমন, আমার সঙ্গে আসিবে কি?
    শ্রীর মন টলিল। শ্রীর এক পয়সা পুঁজি নাই। দল ছাড়িয়া আসিয়া অবধি আহার হয় নাই; শ্রী দেখিতেছিল, ভিক্ষা এবং মৃত্যু, এই দুই ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। এই সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে যেন উপায়ান্তর হইতে পারে বোধ হইল, কিন্তু তাহাতেও সন্দেহ উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব মা? তুমি দিনপাত কর কিসে?”
    সন্ন্যা। ভিক্ষায়।
    শ্রী। আমি তাহা পারিব না-বৈতরিণী তাহার অপেক্ষা সহজ বোধ হইতেছিল।
    সন্ন্যা। তাহা তোমায় করিতে হইবে না—আমি তোমার হইয়া ভিক্ষা করিব।
    শ্রী। বাছা, তোমার এই বয়স-তুমি আমার অপেক্ষা ছোট বৈ বড় হইবে না। তোমার এই রূপের রাশি।
    সন্ন্যাসিনী অতিশয় সুন্দরী—বুঝি শ্রীর অপেক্ষাও সুন্দরী। কিন্তু রূপ ঢাকিবার জন্য আচ্ছা করিয়া বিভূতি মাখিয়াছিল। তাহাতে হিতে বিপরীত হইয়াছিল—ঘসা ফানুষের ভিতর আলোর মত রূপের আগুন আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল।
    শ্রীর কথার উত্তরে সন্ন্যাসিনী বলিল, “আমরা উদাসীন, সংসারত্যাগী, আমাদের কিছুতেই কোন ভয় নাই। ধর্ম আমাদের রক্ষা করেন |”
    শ্রী। তা যেন হইল। তুমি সন্ন্যাসিনী বলিয়া নির্ভয়। কিন্তু আমি বেলপাতের পোকার মত, তোমার সঙ্গে বেড়াইব কি প্রকারে? তুমিই বা লোকের কাছে এ পোকার কি পরিচয় দিবে? বলিবে কি যে, উড়িয়া আসিয়া গায়ে পড়িয়াছে?
    সন্ন্যাসিনী হাসিল—ফুল্লাধরে মধুর হাসিতে বিদ্যুদ্দীপ্ত মেঘাবৃত আকাশের ন্যায়, সেই ভস্মাবৃত রূপমাধুরী প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল।
    সন্ন্যাসিনী বলিল, “তুমিও কেন বাছা এই বেশ ধারণ কর না?”
    শ্রী শিহরিয়া উঠিল,-বলিল, “সে কি? আমি সন্ন্যাসিনী হইবার কে?”
    সন্ন্যা। আমি তাহা হইতে বলিতেছি না। তুমি যখন সর্বত্যাগী হইয়াছ বলিতেছ, তখন তোমার চিত্তে যদি পাপ না থাকে, তবে হইলেই বা দোষ কি? কিন্তু এখন সে কথা থাক-এখন তা বলিতেছি না। এখন এই বেশ ছদ্মবেশস্বরূপ গ্রহণ কর না—তাতে দোষ কি?
    শ্রী। মাথা মুড়াইতে হইবে? আমি সধবা।
    সন্ন্যা। আমি মাথা মুড়াই নাই দেখিতেছ।
    শ্রী। জটা ধারণ করিয়াছ?
    সন্ন্যা। না, তাও করি নাই। তবে চুলগুলাতে কখনও তেল দিই না, ছাই মাখিয়া রাখি, তাই কিছু জট পড়িয়া থাকিবে।
    শ্রী। চুলগুলি যেরূপ কুণ্ডলী করিয়া ফণা ধরিয়া আছে, আমার ইচ্ছা করিতেছে, একবার তেল দিয়া আঁচড়াইয়া বাঁধিয়া দিই।
    সন্ন্যা। জন্মান্তরে হইবে,–যদি মানবদেহ পাই। এখন তোমায় সন্ন্যাসিনী সাজাইব কি?
    শ্রী। কেবল চুলে ছাই মাখিলেই কি সাজ হইবে?
    সন্ন্যা। না—গৈরিক, রুদ্রাক্ষ, বিভূতি, সব আমার এই রাঙ্গা ঝুলিতে আছে। সব দিব।
    শ্রী কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ করিয়া সম্মত হইল। তখন নিভৃত এক বৃক্ষতলে বসিয়া সেই রূপসী সন্ন্যাসিনী শ্রীকে আর এক রূপসী সন্ন্যাসিনী সাজাইল। কেশদামে ভস্ম মাখাইল, অঙ্গে গৈরিক পরাইল, কণ্ঠে ও বাহুতে রুদ্রাক্ষ পরাইল, সর্ব্বাঙ্গে বিভূতি লেপন করিল, পরে রঙ্গের দিকে মন দিয়া শ্রীর কপাকে একটি চন্দনের টিপ দিয়া দিল। তখন ভুবনবিজয়াভিলাষী মধুমন্মথের ন্যায় দুই জনে যাত্রা করিয়া, বৈতরিণী পার হইয়া, সে দিন এক দেবমন্দিরের অতিথিশালায় রাত্রি যাপন করিল।

    ==========================================
    2- বালেশ্বর জেলার উত্তরভাগস্থিত কতকগুলি পর্বতকে নীলগিরি বলে। তাহাই কোন কোন স্থানে বৈতরিণীতীর হইতে দেখা যায়। এই গরুড়স্তম্ভ দেখিতে অতি চমৎকার।
    3- *বালেশ্বর জেলার উত্তরভাগস্হিত কতকগুলি পর্বতকে বলে। তাহাই কোন কোন স্হানে বৈতরণীতীর্ইতে দেখা যায়। **এই গরুড়স্তম্ভ দেখিতে অতি চমৎকার।
    4- পুরুষোত্তম যাইবার আধুনিক যে রাজপথ, এই সকল পর্বত, তাহার বামে থাকে। নিকট নহে।
    ==========================================

    দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
    পরদিন প্রাতে উঠিয়া, খরস্রোতা5 জলে যথাবিধি স্নানাহ্নিক সমাপন করিয়া শ্রী ও সন্ন্যাসিনী, বিভূতি রুদ্রাক্ষাদি-শোভিতা হইয়া পুনরপি “সঞ্চারী দীপশিখা”দ্বয়ের ন্যায় শ্রীক্ষেত্রের পথ আলো করিয়া চলিল। তৎপ্রদেশবাসীরা নানাবিধ যাত্রীকে সেই পথে যাতায়াত করিতে দেখে, কোন প্রকার যাত্রী দেখিয়া বিস্মিত হয় না, কিন্তু আজ ইহাদিগকে দেখিয়া তাহারাও বিস্মিত হইল। কেহ বলিল, “কি পরি মাইকিনিয়া মানে যাউছন্তি পারা?” কেহ বলিল, “সে মানে দ্যাবতা হ্যাব |” কেহ আসিয়া প্রণাম করিল; কেহ ধন দৌলত বর মাঙিল। একজন পণ্ডিত তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া বলিল, “কিছু বলিও না; ইঁহারা বোধ হয় রুক্মিণী সত্যভামা স্বশরীরে স্বামিদর্শনে যাইতেছেন |” অপরে মনে করিল যে, রুক্মিণী সত্যভামা শ্রীক্ষেত্রেই আছেন, তাঁহাদিগের গমন সম্ভব নহে; অতএব নিশ্চয়ই ইঁহারা শ্রীরাধিকা এবং চন্দ্রাবলী, গোপকন্যা বলিয়া পদব্রজে যাইতেছেন। এই সিদ্ধান্ত স্থিরীকৃত হইলে, এক দুষ্টা স্ত্রী বলিল, “হউ হউ! যা! যা! সেঠিরে তা ভৌঁউড়ি।6 অচ্ছি, তুমানঙ্কো মারি পকাইব |”
    এ দিকে শ্রীরাধিকা চন্দ্রাবলী আপন মনে কথোপকথন করিতে করিতে যাইতেছিল। সন্ন্যাসিনী বিরাগিণী প্রব্রজিতা, অনেকদিন হইতে তাহার সুহৃদ কেহ নাই; আজ একজন সমবয়স্কা প্রব্রজিতাকে পাইয়া তাহার চিত্ত একটু প্রফুল্ল হইয়াছিল। এখনও তার জীবনস্রোতঃ কিছুই শুকায় নাই।বরং শ্রীর শুকাইয়াছিল; কেন না, শ্রী দুঃখ কি, তাহা জানিয়াছিল সন্ন্যাসী বৈরাগীরদুঃখনাই। কথাবার্তা যাহা হইতেছিল, তাহার মধ্যে গোটা দুই কথা কেবল পাঠককে শুনান আবশ্যক।
    সন্ন্যা। তুমি বলিতেছ, তোমার স্বামী আছেন। তিনি তোমাকে লইয়া ঘর—সংসার করিতেও ইচ্ছুক। তাতে তুমি গৃহত্যাগিনী হইয়াছ কেন, তাও তোমায় জিজ্ঞাসা করি না। কেন না, তোমার ঘরের কথা আমার জানিয়া কি হইবে? তবে এটা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি যে, কখনও ঘরে ফিরিয়া যাইবার তোমার ইচ্ছা আছে কি না?
    শ্রী। তুমি হাত দেখিতে জান?
    সন্ন্যা। না। হাত দেখিয়া কি তাহা জানিতে হইবে?
    শ্রী। না। তাহা হইলে আমি তোমাকে হাত দেখাইয়া, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া, সে বিষয় স্থির করিতাম।
    সন্ন্যা। আমি হাত দেখিতে জানি না। কিন্তু তোমাকে এমন লোকের কাছে লইয়া যাইতে পারি যে, তিনি এ বিদ্যায় ও আর সকল বিদ্যাতেই অভ্রান্ত।
    শ্রী। কোথায় তিনি?
    সন্ন্যা। ললিতগিরিতে হস্তিগুম্ফায় এক যোগী বাস করেন। আমি তাঁহার কথা বলিতেছি।
    শ্রী। ললিতগিরি কোথায়?
    সন্ন্যা। আমরা চেষ্টা করিলে আজ সন্ধ্যার পর পৌঁছিতে পারি।
    শ্রী। তবে চল।
    তখন দুই জনে দ্রুতগতি চলিতে লাগিল। জ্যোতির্বিদ দেখিলে বলিত, আজ বৃহস্পতি শুক্র উভয় গ্রহ যুক্ত হইয়া শীঘ্রগামী হইয়াছে।7

    ======================================
    5- নদীর নাম।
    6- সুভদ্রা।
    7- হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে Accelerated Motionকে শীঘ্রগতি বলে। দুইটি গ্রহকে পৃথিবী হইতে যখন এক রাশিস্থিত দেখা যায়, তখন তাহাদিগকে যুক্ত বলা যায়।
    ======================================

    ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

    এক পারে উদয়গিরি, অপর পারে ললিতগিরি, মধ্যে স্বচ্ছসলিলা কল্লোলিনী বিরূপা নদী, নীলবারিরাশি লইয়া সমুদ্রাভিমুখে চলিয়াছে।8 গিরিশিখরদ্বয়ে আরোহণ করিলে নিম্নে সহস্র সহস্র তালবৃক্ষ শোভিত, ধান্য হরিৎক্ষেত্রে চিত্রিত, পৃথ্বী অতিশয় মনোমোহিনী দেখা যায়—শিশু যেমন মার কোলে উঠিলে মাকে সর্বাঙ্গসুন্দরী দেখে, মনুষ্য পর্বতারোহণ করিয়া পৃথিবী দর্শন করিলে সেইরূপ দেখে। উদয়গিরি (বর্ত্তমান অল্ত‍তিগিরি) বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ, কিন্তু ললিতগিরি (বর্ত্তমান নাল্ ‍তিগিরি) বৃক্ষশূন্য প্রস্তরময়। এককালে ইহার শিখর ও সানুদেশ অট্টালিকা, স্তূপ এবং বৌদ্ধ মন্দিরাদিতে শোভিত ছিল। এখন শোভার মধ্যে শিখরদেশে চন্দনবৃক্ষ, আর মৃত্তিকাপ্রোথিত ভগ্নগৃহবিশিষ্ট প্রস্তর, ইষ্টক বা মনোমুগ্ধকর প্রস্তরগঠিত মূর্তিরাশি। তাহার দুই চারিটা কলিকাতার বড় বড় ইমারতের ভিতর থাকিলে কলিকাতার শোভা হইত। হায়! এখন কি না হিন্দুকে ইণ্ডষ্ট্রিয়াল স্কুলে পুতুল গড়া শিখিতে হয়! কুমারসম্ভব ছাড়িয়া সুইন‍‍বর্ণ পড়ি, গীতা ছাড়িয়া মিল পড়ি, আর উড়িষ্যার প্রস্তর-শিল্প ছাড়িয়া সাহেবদের চীনের পুতুল হাঁ করিয়া দেখি। আরও কি কপালে আছে বলিতে পারি না।
    আমি যাহা দেখিয়াছি, তাহাই লিখিতেছি। সেই ললিতগিরি আমার চিরকাল মনে থাকিবে। চারি দিকে-যোজনের পর যোজন ব্যাপিয়া—হরিদ্বর্ণ ধান্যক্ষেত্র,-মাতা বসুমতীর অঙ্গে বহুযোজন—বিস্তৃতা পীতাম্বরী শাটী! তাহার পর মাতার অলঙ্কার স্বরূপ, তালবৃক্ষশ্রেণী-সহস্র সহস্র, তার পর সহস্র সহস্র তালবৃক্ষ; সরল সুপত্র, শোভাময়! মধ্যে নীলসলিলা বিরূপা, নীল পীত পুষ্পময় হরিৎক্ষেত্র মধ্য দিয়া বহিতেছে-সুকোমল গালিচার উপর কে নদী আঁকিয়া দিয়াছে। তা যাক—চারি পাশে মৃত মহাত্মাদের মহীয়সী কীর্তি। পাথর এমন করিয়া যে পালিশ করিয়াছিল, সে কি এই আমাদের মত হিন্দু? এমন করিয়া বিনা বন্ধনে যে গাঁথিয়াছিল, সে কি আমাদের মত হিন্দু?
    আর এই প্রস্তরমূর্তিসকল যে খোদিয়াছিল- এই দিব্য পুষ্পমাল্যাভরণভূষিত বিকম্পিতচেলাচঞ্চল -প্রবৃদ্ধসৌন্দর্য্য, সর্বাঙ্গসুন্দরগঠন, পৌরুষের সহিত লাবণ্যের মূর্তিমান্ সম্মিলনস্বরূপ পুরুষমূর্তি যাহারা গড়িয়াছে, তাহারা কি হিন্দু?এই কোপপ্রেমগর্বসৌভাগ্যস্ফুরিতাধরা, চীনাম্বরা, তরলিরত্নহারা,পীবরযৌবনভারাবনতদেহা—
    তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পকবিম্বাধরোষ্ঠী
    মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভি:–

    এই সকল স্ত্রীমূর্তি যারা গড়িয়াছে, তারা কি হিন্দু? তখন হিন্দুকে মনে পড়িল। তখন মনে পড়িল, উপনিষদ্, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কুমারসম্ভব, শকুন্তলা, পাণিনি, কাত্যায়ন, সাংখ্য, পাতঞ্চল, বেদান্ত, বৈশেষিক, এ সকলই হিন্দুর কীর্তি—এ পুতুল কোন্ ছার! তখন মনে করিলাম, হিন্দুকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছি।
    সেই ললিতগিরির পদতলে বিরূপা-তীরে গিরির শরীরমধ্যে, হস্তিগুম্ফা নামে এক গুহা ছিল। গুহা বলিয়া, আবার ছিল বলিতেছি কেন? পর্বতের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কি আবার লোপ পায়? কাল বিগুণ হইলে সবই লোপ পায়। গুহাও আর নাই। ছাদ পড়িয়া গিয়াছে, স্তম্ভ সকল ভাঙ্গিয়া গিয়াছে,-তলদেশে ঘাস গজাইতেছে। সর্বস্ব লোপ পাইয়াছে, গুহাটার জন্য দুঃখে কাজ কি?
    কিন্তু গুহা বড় সুন্দর ছিল। পর্বতাঙ্গ হইতে খোদিত স্তম্ভপ্রাকার প্রভৃতি বড় রমণীয় ছিল। চারি দিকে অপূর্ব প্রস্তরে খোদিত নরমূর্তি সকল শোভা করিত। তাহারই দুই চারিটি আজিও আছে। কিন্তু ছাতা পড়িয়াছে, রঙ জ্বলিয়া গিয়াছে, কাহারও নাক ভাঙ্গিয়াছে, কাহারও হাত ভাঙ্গিয়াছে, কাহারও পা ভাঙ্গিয়াছে। পুতুলগুলাও আধুনিক হিন্দুর মত অঙ্গহীন হইয়া আছে।
    কিন্তু গুহার এ দশা আজকাল হইয়াছে। আমি যখনকার কথা বলিতেছি, তখন এমন ছিল না—গুহা সম্পূর্ণ ছিল। তাহার ভিতর পরম যোগী মহাত্মা গঙ্গাধর স্বামী বাস করিতেন। যথাকালে সন্ন্যাসিনী শ্রীকে সমভিব্যাহারে লইয়া তথা উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, গঙ্গাধর স্বামী তখন ধ্যানে নিমগ্ন। অতএব কিছু না বলিয়া, তাঁহারা সে রাত্রি গুহাপ্রান্তে শয়ন করিয়া যাপন করিলেন।
    প্রত্যূষে ধ্যান ভঙ্গ হইলে, গঙ্গাধর স্বামী গাত্রোত্থানপূর্বক বিরূপায় স্নান করিয়া প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিলেন। পরে তিনি প্রত্যাগত হইলে সন্ন্যাসিনী প্রণতা হইয়া তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিল; শ্রীও তাহাই করিল।
    গঙ্গাধর স্বামী শ্রীর সঙ্গে তখন কোন কথা কহিলেন না, বা তৎসম্বন্ধে সন্ন্যাসিনীকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিলেন না; তিনি কেবল সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। দুর্ভাগ্য—সকল কথাই সংস্কৃত ভাষায় হইল। শ্রী তাহার এক বর্ণ বুঝিল না। যে কয়টা কথা পাঠকের জানিবার প্রয়োজন, তাহা বাঙ্গালায় বলিতেছি।
    স্বামী। এ স্ত্রী কে?
    সন্ন্যা। পথিক।
    স্বামী। এখানে কেন?
    সন্ন্যা। ভবিষ্যৎ লইয়া গোলে পড়িয়াছে। আপনাকে কর দেখাইবার জন্য আসিয়াছে। উহার প্রতি ধর্মানুমত আদেশ করুন।
    শ্রী তখন নিকটে আসিয়া আবার প্রণাম করিল। স্বামী তাহার মুখপানে চাহিয়া দেখিয়া হিন্দীতে বলিলেন, “তোমার কর্কট রাশি”9
    শ্রী নীরব।
    “তোমার পুষ্যা নক্ষত্রস্থিত চন্দ্রে জন্ম |”
    শ্রী নীরব।
    “গুহার বাহিরে আইস—হাত দেখিব |”
    তখন শ্রীকে বাহিরে আনিয়া, তাহার বাম হস্তের রেখা সকল স্বামী নিরীক্ষণ করিলেন। খড়ি পাতিয়া জন্মশক, দিন, বার, তিথি, দণ্ড, পল, সকল নিরূপণ করিলেন। পরে জন্মকুণ্ডলী অঙ্কিত করিয়া, গুহাস্থিত তালপত্রলিখিত প্রাচীন পঞ্জিকা দেখিয়া দ্বাদশ ভাবে গ্রহগণের যথাযথ সমাবেশ করিলেন। পরে শ্রীকে বলিলেন, “তোমার লগ্নে স্বক্ষেত্রস্থ পূর্ণচন্দ্র এবং সপ্তমে বুধ বৃহস্পতি শুক্র তিনটি শুভগ্রহ আছেন। তুমি সন্ন্যাসিনী কেন মা? তুমি যে রাজমহিষী |”10
    শ্রী। শুনিয়াছি, আমার স্বামী রাজা হইয়াছেন। আমি তাহা দেখি নাই।
    স্বামী। তুমি তাহা দেখিবে না বটে। এই সপ্তমস্থ বৃহস্পতি নীচস্থ, এবং শুভগ্রহত্রয় পাপগ্রহের ক্ষেত্রে11 পাপদৃষ্ট হইয়া আছেন। তোমার অদৃষ্টে রাজ্যভোগ নাই।
    শ্রী তা কিছুই বুঝে না, চুপ করিয়া রহিল। আরও একটু দেখিয়া স্বামীকে বলিল, “আর কিছু দুর্ভাগ্য দেখিতেছেন?”
    স্বামী। চন্দ্র শনির ত্রিংশাংশগত।
    শ্রী। তাহাতে কি হয়?
    স্বামী। তুমি তোমার প্রিয়জনের প্রাণহন্ত্রী হইবে।
    শ্রী আর বসিল না—উঠিয়া চলিল। স্বামী তাহাকে ইঙ্গিত করিয়া ফিরাইলেন। বলিলেন, “তিষ্ঠ। তোমার অদৃষ্টে এক পরম পুণ্য আছে। তাহার সময় এখনও উপস্থিত হয় নাই। সময় উপস্থিত হইলে স্বামিসন্দর্শনে গমন করিও |”
    শ্রী। কবে সে সময় উপস্থিত হইবে?
    স্বামী। এখন তাহা বলিতে পারিতেছি না। অনেক গণনার প্রয়োজন। সে সময়ও নিকট নহে। তুমি কোথা যাইতেছ?
    শ্রী। পুরুষোত্তমদর্শনে যাইব, মনে করিয়াছি।
    স্বামী। যাও। সময়ান্তরে, আগামী বৎসরে, তুমি আমার নিকট আসিও। সময় নির্দেশ করিয়া বলিব।
    তখন স্বামী সন্ন্যাসিনীকেও বলিলেন, “তুমিও আসিও |”
    তখন গঙ্গাধর স্বামী বাক্যালাপ বন্ধ করিয়া ধ্যানস্থ হইলেন। সন্ন্যাসিনীদ্বয় তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গুহা হইতে বহির্গত হইল।

    ======================================
    8- এখন বিরূপা অতিশয় বিরূপা। এখন তাহাকে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে। ইংরেজের প্রতাপের বৈতরিণী স্বয়ং বাঁধা-বিরূপাই বা কে-আর কেই বা কে?
    9 পরকনকশরীরো দেবনম্রপ্রকাশ্যো।
    ভবতি বিপুলবক্ষাঃকর্কটো যস্য রাশিঃ।–কোষ্ঠপ্রদীপ।
    10 জায়াস্থে চ শুভত্রয়ে প্রণয়িনী রাজ্ঞী ভবেদ্।‍ভূপতে:।
    11- মকরে
    ======================================

    চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

    আবার সেই যুগল সন্ন্যাসিনীমূর্তি উড়িষ্যার রাজপথ আলো করিয়া পুরুষোত্তমাভিমুখে চলিল। উড়িয়ারা পথে সারি দিয়া দাঁড়াইয়া হাঁ করিয় দেখিতে লাগিল। কেহ আসিয়া তাহাদের পায়ের কাছে লম্বা হইয়া শুইয়া পড়িয়া বলিল, “মো মুণ্ডেরে চরড় দিবারে হউ |” কেহ কেহ বলিল, “টিকে ঠিয়া হৈকিরি ম দুঃখ শুনিবারে হউ |” সকলকে যথাসম্ভব উত্তরে প্রফুল্ল করিয়া সুন্দরীদ্বয় চলিল।
    চঞ্চলগামিনী শ্রীকে একটু স্থির করিবার জন্য সন্ন্যাসিনী বলিল, “ধীরে যা গো বহিন! একটু ধীরে যা। ছুটিলে কি অদৃষ্ট ছাড়াইয়া যাইতে পারিবি?”
    স্নেহসম্বোধনে শ্রীর প্রাণ একটু জুড়াইল। দুই দিন সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে থাকিয়া শ্রী তাহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এই দুই দিন, মা! বাছা! বলিয়া কথা হইতেছিল,–কেন না, সন্ন্যাসিনী শ্রীর পূজনীয়া। সন্ন্যাসিনী সে সম্বোধন ছাড়িয়া বহিন সম্বোধন করায় শ্রী বুঝিল যে, সেও ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছে। শ্রী ধীরে চলিল।
    সন্ন্যাসিনী বলিতে লাগিল, “আর মা বাছা সম্বোধন তোমার সঙ্গে পোষায় না-আমাদের দুজনেরই সমান বয়স, আমরা দুই জনে ভগিনী |”
    শ্রী। তুমিও কি আমার মত দুঃখে সংসার ত্যাগ করিয়াছ?
    সন্ন্যা। আমার সুখ-দুঃখ নাই। তেমন অদৃষ্ট নয়। তোমার দুঃখের কথা শুনিব। সে এখনকার কথা নয়। তোমার নাম এখনও পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয় নাই—কি বলিয়া তোমায় ডাকিব?
    শ্রী। আমার নাম শ্রী। তোমায় কি বলিয়া ডাকিব?
    সন্ন্যা। আমার নাম জয়ন্তী। আমাকে তুমি নাম ধরিয়াই ডাকিও। এখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, স্বামী যাহা বলিলেন, তাহা শুনিলে? এখন বোধ হয় তোমার আর ঘরে ফিরিবার ইচ্ছা নাই। দিন কাটাইবারও অন্য উপায় নাই। দিন কাটাইবে কি প্রকারে, কখনও কি ভাবিয়াছ?
    শ্রী। না। ভাবি নাই। কিন্তু এত দিন ত কাটিয়া গেল।
    জ। কিরূপে কাটিল?
    শ্রী। বড় কষ্টে—পৃথিবীতে এমনদুঃখবুঝি আর নাই।
    জ। ইহার এক উপায় আছে-আর কিছুতে মন দাও।
    শ্রী। কিসে মন দিব?
    জ। এত বড় জগৎ–কিছুই কি মন দিবার নাই?
    শ্রী। পাপে?
    জ। না। পুণ্যে।
    শ্রী। স্ত্রীলোকের একমাত্র পুণ্য স্বামিসেবা। যখন ছাড়িয়া আসিয়াছি—তখন আমার আবার পুণ্য কি আছে?
    জ। স্বামীর এক জন স্বামী আছেন।
    শ্রী। তিনি স্বামীর স্বামী—আমার নন। আমার স্বামীই আমার স্বামী-আর কেহ নহে।
    জ। যিনি তোমার স্বামীর স্বামী, তিনি তোমারও স্বামী-কেন না, তিনি সকলের স্বামী।
    শ্রী। আমি ঈশ্বরও জানি না—স্বামীই জানি।
    জ। জানিবে? জানিলে এতদুঃখথাকিবে না।
    শ্রী। না। স্বামী ছাড়িয়া আমি ঈশ্বরও চাহি না। আমার স্বামীকে আমি ত্যাগ করিয়াছি বলিয়া আমার যে দুঃখ, আর ঈশ্বর পাইলে আমার যে সুখ, ইহার মধ্যে আমার স্বামিবিরহদুঃখই আমি ভালবাসি।
    জ। যদি এত ভালবাসিয়াছিলে—তবে ত্যাগ করিলে কেন?
    শ্রী। আমার কোষ্ঠীর ফল শুনিলে না? কোষ্ঠীর ফল শুনিয়াছিলাম।
    জ। এত ভালবাসিয়াছিলে কেন?
    শ্রী তখন সংক্ষেপে আপনার পূর্ববিবরণ সকল বলিল। শুনিয়া জয়ন্তীর চক্ষু একটু ছল-ছল করিল। জয়ন্তী বলিল, “তোমার সঙ্গে তাঁর ত দেখা—সাক্ষাৎ নাই বলিলেও হয়-এত ভালবাসিলে কিসে?
    শ্রী। তুমি ঈশ্বর ভালবাস-কয় দিন ঈশ্বরের সঙ্গে তোমার দেখা—সাক্ষাৎ হইয়াছে?
    জ। আমি ঈশ্বরকে রাত্রি দিন মনে মনে ভাবি।
    শ্রী। যে দিন বালিকা বয়সে তিনি আমায় ত্যাগ করিয়াছিলেন, সে দিন হইতে আমিও তাঁহাকে রাত্রি দিন ভাবিয়াছিলাম।
    জয়ন্তী শুনিয়া রোমাঞ্চকলেবর হইয়া উঠিল। শ্রী বলিতে লাগিল, “যদি একত্র ঘর-সংসার করিতাম, তাহা হইলে বুঝি এমনটা ঘটিত না। মানুষ মাত্রেরই দোষ-গুণ আছে। তাঁরও দোষ থাকিতে পারে। না থাকিলেও আমার দোষে আমি তাঁর দোষ দেখিতাম। কখন না কখন, কথান্তর, মন ভার, অকৌশল ঘটিত। তা হইলে, এ আগুন এত জ্বলিত না। কেবল মনে মনে দেবতা গড়িয়া তাঁকে আমি এত বৎসর পূজা করিয়াছি। চন্দন ঘষিয়া, দেয়ালে লেপন করিয়া মনে করিয়াছি, তাঁর অঙ্গে মাখাইলাম। বাগানে বাগানে ফুল চুরি করিয়া তুলিয়া, দিনভোর কাজকর্ম ফেলিয়া অনেক পরিশ্রমে মনের মত মালা গাঁথিয়া, ফুলভরা গাছের ডালে ঝুলাইয়া মনে করিয়াছি, তাঁর গলায় দিলাম। অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া ভাল খাবার সামগ্রী কিনিয়া পরিপাটি করিয়া রন্ধন করিয়া নদীর জলে ভাসাইয়া দিয়া মনে করিয়াছি, তাঁকে খাইতে দিলাম। ঠাকুরপ্রণাম করিতে গিয়া কখনও মনে হয় নাই যে, ঠাকুরপ্রণাম করিতেছি—মাথার কাছে তাঁরই পাদপদ্ম দেখিয়াছি। তার পর জয়ন্তী—তাঁকে ছাড়িয়া আসিয়াছি। তিনি ডাকিলেন, তবু ছাড়িয়া আসিয়াছি |”
    শ্রী আর কথা কহিতে পারিল না। মুখে অঞ্চল চাপিয়া প্রাণ ভরিয়া কাঁদিল। জয়ন্তীরও চক্ষু ছল-ছল করিল। এমন সন্ন্যাসিনী কি সন্ন্যাসিনী?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী চৌধুরাণী – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article ব্রেজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }