Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সীতারাম – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প190 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    সীতারাম – ৩য় খণ্ড – ১১-১৫

    একাদশ পরিচ্ছেদ

    সেই যে সভাতলে রমা মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল, সখীরা ধরাধরি করিয়া আনিয়া শুয়াইল, সেই অবধি রমা আর উঠে নাই। প্রাণপণ করিয়া আপনার সতী নাম রক্ষা করিয়াছিল। মান রক্ষা হইল, কিন্তু প্রাণ বুঝি গেল।
    এখন রোগ পুরাতন হইয়াছে। কিন্তু গোড়া থেকে বলি। রাজার রাণীর চিকিৎসার অভাব হয় নাই। প্রথম হইতেই কবিরাজ যাতায়াত করিতে লাগিল। অনেকগুলা কবিরাজ রাজবাড়ীতে চাকরি করে, তত কর্ম নাই, সচরাচর ভৃত্যবর্গকে মসলা খাওয়াইয়া, এবং পরিচারিকাকে পোষ্টাই দিয়া কালাতিপাত করে; এক্ষণে ছোট রাণীকে রোগী পাইয়া কবিরাজ মহাশয়েরা হঠাৎ বড়লোক হইয়া বসিলেন, তখন রোগনির্ণয় লইয়া মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। মূর্ছা, বায়ু, অম্লপিত্ত, হৃদ্রো গ ইত্যাদি নানাবিধ রোগের লক্ষণ শুনিতে শুনিতে রাজপুরুষেরা জ্বালাতন হইয়া উঠিল। দেহ নিদানের দোহাই দেন, কেহ বাগ্ভোটের, কেহ চরকসংহিতার বচন আওড়ান, কেহ সুশ্রুতের টীকা ঝাড়েন। রোগ অনির্ণীত রহিল।
    কবিরাজ মহাশয়েরা, কেবল বচন ঝাড়িয়া নিশ্চিন্ত রহিলেন, এমন নিন্দা আমরা করি না। তাঁহারা নানাপ্রকার ঔষধের ব্যবস্হা করিলেন। কেহ বটিকা, কেহ গুড়া, কেহ ঘৃত, কেহ তৈল; কেহ বলিলেন, ঔষধ প্রস্তুত করিতে হইবে, কেহ বলিবেন, আমার কাছে যাহা প্রস্তুত করিতে হইবে, কেহ বলিলেন, আমার কাছে যাহা প্রস্তুত আছে, তেমন আর হইবে না। যাই হউক, রাজার বাড়ী, রাণীর রোগ, ঔষধের প্রয়োজন থাক, না থাক, নূতন প্রস্তুত হইবে না, এমন হইতে পারে না। হইলে দশ জনে দুটাকা দুসিকা উপার্জন করিতে পারে, অতএব ঔষধ প্রস্তুতের ধুম পড়িয়া গেল। কোথাও হামানদিস্তায় মূল পিষ্ট হইতেছে, কোথাও ঢেঁকিতে ছাল কুটিতেছে, কোথাও হাঁড়িতে কিছু সিদ্ধ হইতেছে, কোথাও খুলিতে তৈলে মূর্ছনা পড়িতেছে। রাজবাড়ীর এক জন পরিচারিকা এক দিন দেখিয়া বলিল, “রাণী হইয়া রোগ হয়, সেও ভাল |”
    যার জন্য ঔষধের এত ধুম, তার সঙ্গে ঔষধের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ বড় অল্প। কবিরাজ মহাশয়েরা ঔষধ যোগাইতেন না, তা নয়। সে গুণে তাঁহাদের কিছুমাত্র ত্রুটি ছিল না। তবে রমার দোষে সে যত্ন বৃথা হইল–রমা ঔষধ খাইত না। মুরলার বদলে, যমুনা নাম্নী একজন পরিচারিকা, রাণীর প্রধানা দাসী হইয়াছিল। যমুনাকে একটু প্রাচীন দেখিয়া নন্দা তাহাকে এই পদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন। আমরা এমন বলিতে পারি না যে, যমুনা আপনাকে প্রাচীনা বলিয়া স্বীকার করিত; শুনিয়াছি, কোন ভৃত্যবিশেষের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ মতান্তর ছিল; তথাপি স্থূল কথা এই যে, যমুনা একটু প্রাচীন চালে চলিত, রমাকে বিলক্ষণ যত্ন করিত; রোগিণীর সেবার কোন প্রকার ত্রুটি না হয়, তদ্বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী ছিল। রমার জন্য কবিরাজেরা যে ঔষধ দিয়া যাইত, তাহারই হাতে পড়িত; সেবন করাইবার ভার তাহার উপর। কিন্তু সেবন করান তাহার সাধ্যাতীত; রমা কিছুতেই ঔষধ খাইত না।
    এ দিকে রোগের কোন উপশম নাই, ক্রমেই বৃদ্ধি, রমা আর মাথা তুলিতে পারে না। দেখিয়া শুনিয়া যমুনা স্থির করিল যে, সকল কথা বড় রাণীকে গিয়া জানাইবে। অতএব রমাকে বলিল, “আমি বড় মহারাণীর কাছে চলিলাম; ঔষধ তিনি নিজে আসিয়া খাওয়াইবেন |”
    রমা বলিল, “বাছা! মৃত্যুকালে আর কেন জ্বালাতন করিস! বরং তোর সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করি |”
    যমুনা জিজ্ঞাসা করিল, “কি বন্দোবস্ত মা?”
    র। তোমার এই ঔষধগুলি আমারে বেচিবে? আমি এক এক টাকা দিয়া একটা বড়ি কিনিতে রাজি আছি।
    য। সে আবার কি মা! তোমার ঔষধ তোমায় আবার বেচিব কি?
    র। টাকা নিয়া তুমি যদি আমায় বড়ি বেচ, তা হলে তোমার আর তাতে কোন অধিকার থাকিবে না। চাই আমি খাই, চাই না খাই, তুমি আর কথা কহিতে পাবে না।
    যমুনা কিছুক্ষণ ভাবিল। সে বুদ্ধিমতী; মনে মনে বিচার করিল যে, এ ত মরিবেই, তবে আমি টাকাগুলা ছাড়ি কেন? প্রকাশ্যে বলিল, “তা মা, তুমি যদি খাও, ত টাকা দিয়াই নাও, আর অমনিই নাও, নাও না কেন! আর যদি না খাও ত আমার কাছে ওষুধ পড়ে থেকেই কি ফল?”
    অতএব চুক্তি ঠিক হইল। যমুনা টাকা লইয়া ঔষধ রমাকে বেচিল। রমা ঔষধের কতকগুলা পিকদানিতে ফেলিয়া দিল, কতক বালিশের নীচে গুঁজিল। উঠিতে পারে না যে, অন্যত্র রাখিবে।
    এ দিকে ক্রমশঃ শরীরধ্বংসের লক্ষণ সকল দেখা দিতে লাগিল। নন্দা প্রত্যহ রমাকে দেখিতে আসে, দুই এক দণ্ড বসিয়া কথাবার্তা কহিয়া যায়। নন্দা দেখিল যে, মৃত্যুর ছায়া পড়িয়াছে; যাহার ছায়া, সে নিকটেই। নন্দা ভাবিল, “হায়! রাজবাড়ীর কবিরাজগুলোকেও কি ডাকিনীতে পেয়েছে?” নন্দা একেবারে কবিরাজের দলকে ডাকিয়া পাঠাইল। সকলে আসিলে নন্দা আড়ালে থাকিয়া তাহাদিগকে উত্তম মধ্যম রকম ভরৎসনা করিল। বলিল, “যদি রোগ ভাল করিতে পার না, তবে মাসিক লও কেন?”
    একজন প্রাচীন কবিরাজ বলিল, “মা! কবিরাজে ঔষধ দিতে পারে, পরমায়ু দিতে পারে না |”
    নন্দা বলিল, “তবে আমাদের ঔষধেও কাজ নাই, কবিরাজেও কাজ নাই। তোমরা আপনার আপনার দেশে যাও |”
    কবিরাজমণ্ডলী বড় ক্ষুণ্ণ হইল। প্রাচীন কবিরাজটি বড় বিজ্ঞ। তিনি বলিলেন, “মা! আমাদের অদৃষ্ট নিতান্ত মন্দ, তাই এমন ঘটিয়াছে। নহিলে, আমি যে ঔষধ দিয়াছি, তাহা সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। আমি এখনও আপনার নিকট স্বীকার করিতেছি যে, তিন দিনের মধ্যে আরাম করিব, যদি একটা বিষয়ে আপনি অভয় দেন |”
    নন্দা জিজ্ঞাসা করিল, “কি চাই?”
    কবিরাজ বলিল, “আমি নিজে বসাইয়া থাকিয়া ঔষধ খাওয়াইয়া আসিব |” বুড়ার বিশ্বাস, “বেটি ঔষধ খায় না; আমার ঔষধ খাইলে কি রোগী মরে!”
    নন্দা স্বীকৃত হইয় কবিরাজদিগকে বিদায় দিল। পরে রমার কাছে আসিয়া সব বলিল। রমা অল্প হাসিল, বেশী হাসিবার শক্তিও নাই, মুখে স্থান নাই; মুখ বড় ছোট হইয়া গিয়াছে।
    নন্দা জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিলি যে?”
    রমা আবার তেমনি হাসি হাসিয়া বলিল, “ঔষধ খাব না |”
    ন। ছি দিদি! যদি এত ঔষধ খেলে, ত আর তিনটা দিন খেতে কি?
    র। আমি ঔষধ খাই নাই।
    নন্দা চমকিয়া উঠিল,–বলিল, “সে কি? মোটে না?”
    র। সব বালিশের নীচে আছে।
    নন্দা বালিশ উল্টাইয়া দেখিল, সব আছে বটে। তখন নন্দা বলিল, “কেন বহিন—এখন আর আত্মঘাতিনী হইবে কেন? পাপ ত মিটিয়াছে |”
    র। তা নয়-ঔষধ খাব।
    ন। আর কবে খাবি?
    র। যবে রাজা আমাকে দেখিতে আসিবেন।
    ঝর-ঝর করিয়া রমার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। নন্দারও চক্ষে জল আসিল। আর এখন সীতারাম রমাকে দেখিতে আসেন না। সীতারাম চিত্তবিশ্রামে থাকেন। নন্দা চোখের জল মুছিয়া বলিল, “এবার এলেই তোমাকে দেখিতে আসিবেন |”

    দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

    “এবার এলেই তোমাকে দেখিতে আসিবেন,” এই কথা বলিয়া নন্দা রমাকে আশ্বাস দিয়া আসিয়াছিল। সেই আশ্বাসে রমা কোন রকমে বাঁচিয়াছিল-কিন্তু আর বুঝি বাঁচে না। নন্দা তাহাকে যে আশ্বাসবাক্য দিয়া আসিয়াছে, নন্দাও তাহা জপমালা করিয়াছিল, কিন্তু রাজাকে ধরিতে পারিতেছিল না। যদি কখনও ধরে, তবে “আজ না–কাল” করিয়া রাজা প্রস্থান করিলেন। নন্দা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, কিছুতেই সে সীতারামের উপর রাগ করিবে না। ভাবিল, রাজাকে ত ডাকিনীতে পেয়েছে সত্য, কিন্তু তাই বলে আমায় যেন ভূতে না পায়। আমার ঘাড়ে রাগ ভূত চাপিলে–এ সংসার এখন আর রাখিবে কে? তাই নন্দা সীতারামের উপর রাগ করিল না–আপনার অনুষ্ঠেয় কর্ম প্রাণপাত করিয়া করিতে লাগিল। কিন্তু ডাকিনীটার উপর রাগ বড় বেশী। ডাকিনী যে শ্রী, তাহা নন্দা জানিত না; সীতারাম ভিন্ন কেহই জানিত না। নন্দা অনেকবার সন্ধান জানিবার জন্য লোক পাঠাইয়াছিল, কিন্তু সীতারামের আজ্ঞা ভিন্ন চিত্তবিশ্রামে মক্ষিকা প্রবেশ করিতে পারিত না, সুতরাং কিছুই হইল না। তবে জনপ্রবাদ এই যে, ডাকিনীটা দিবসে পরমসুন্দরী মানবী মূর্তি ধারণ করিয়া গৃহধর্ম করে, রাত্রিতে শৃগালীরূপ ধারণ করিয়া শ্মশানে শ্মশানে বিচরণপূর্বক নরমাংস ভক্ষণ করে। অতিশয় ভীতা হইয়া নন্দা, চন্দ্রচূড় ঠাকুরকে সবিশেষ নিবেদন করিল। চন্দ্রচূড় উত্তম তন্ত্রবিৎ ব্রাহ্মণ সংগ্রহ করিয়া রাজার উদ্ধারার্থ তান্ত্রিক যজ্ঞ সকল সম্পাদন করাইলেন, কিন্তু কিছুতেই ডাকিনীর ধ্বংস হইল না। পরিশেষে একজন সুদক্ষ তান্তিক বলিলেন, মনুস্য হইতে ইহার কিছু উপায় হইবে না। ইনি সামান্যা নহেন। ইনি কৈলাসনিবাসিনী সাক্ষাৎ ভবানী সহচরী, ইঁহার নাম বিশালাক্ষী। ইনি রুদ্রের শাপে কিছুকালের জন্য মর্ত্যলোকে মনুষ্যসহবাসার্থ আসিয়াছেন। শাপান্ত হইলে আপনিই যাইবেন |” শুনিয়া চন্দ্রচূড় ও নন্দা নিরস্ত ও চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন। তবু নন্দা মনে মনে ভাবিত, “ভবানীর সহচরী হউক, আর যেই হউক, আমি একবার তাকে পাইলে নখে মাথা চিরি |”
    তাই, নন্দার সীতারামের উপর কোন রাগ নাই। সীতারামও রাজধানীতে আসিলে নন্দার সঙ্গে কখন কখন সাক্ষাৎ করিতেন; এই সকল সময়ে, নন্দার রমার কথা সীতারামকে জানাইত, বলিত, “সে বড় ‘কাতর’-তুমি গিয়া একবার দেখিয়া
    এসো |” সীতারাম যাচ্ছি যাব করিয়া, যান নাই। আজ নন্দা জোর করিয়া ধরিয়া বসিল-বলিল, “আজ দেখিতে যাও–নহিলে এ জন্মে আর দেখা হবে না |”
    কাজেই সীতারাম রমাকে দেখিতে গেলেন। সীতারামকে দেখিয়া রমা বড় কাঁদিল। সীতারামকে কোন তিরস্কার করিল না। কিছুই বলিতে পারিল না। সীতারামের মনে কিছু অনুতাপ জন্মিল কি না, জানি না। সীতারাম স্নেহসূচক সম্বোধন করিয়া রোগমুক্তির ভরসা দিতে লাগিলেন। ক্রমে রমা প্রফুল্ল হইল, মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। কিন্তু কি হাসি! হাসি দেখিয়া সীতারামের শঙ্কা হইল যে, আর অধিক বিলম্ব নাই।
    সীতারাম পালঙ্কের উপর উঠিয়া বসিয়াছিলেন। সেইখানে রমার পুত্র আসিল। আবার রমার চক্ষুতে জল আসিল-কিছুক্ষণ অবাধে জল শুষ্ক গণ্ড বহিয়া পড়িতে লাগিল। ছেলেও মর কান্না দেখিয়া কাঁদিতেছিল। রমা ইঙ্গিতে অস্ফুটস্বরে সীতারামকে বলিল, “ওকে একবার কোলে নাও |” সীতারাম অগত্যা পুত্রকে কোলে লইলেন। তখন রমা, সকাতরে ক্ষীণকণ্ঠে রুদ্ধশ্বাসে বলিতে লাগিল, “মার দোষে ছেলেকে ত্যাগ করিও না। এই তোমার কাছে আমার শেষ ভিক্ষা। বড় রাণীর হাতে ওকে সমর্পণ করিয়া যাব মনে করিয়াছিলাম—কিন্তু তা না করিয়া তোমারই হাতে সমর্পণ করিলাম। কথা রাখিবে কি?”
    সীতারাম কলের পুতুলের মত স্বীকৃত হইলেন। রমা তখন সীতারামকে আরও নিকটে আসিয়া বসিতে ইঙ্গিত করিল। সীতারাম সরিয়া বসিলে, রমা তাঁর পায়ে হাত দিয়া, পায়ের ধূলা লইয়া আপনার মাথায় দিল। বলিল, “এ জন্মের মত বিদায় হইলাম। আশীর্বাদ করিও, জন্মান্তরে যেন তোমাকেই পাই |”
    তার পর বাক্য বন্ধ হইল। শ্বাস বড় জোরে জোরে পড়িতে লাগিল। চক্ষুর জ্যোতি গেল। মুখের উপর কালো ছায়া আরও কালো হইতে লাগিল। শেষে সব অন্ধকার হইল। সব জ্বালা জুড়াইল। রমা চলিয়া গেল।

    ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

    যে দিন রমা মরিল, সে দিন সীতারাম আর চিত্তবিশ্রামে গেলেন না। এখনও তত দূর হয় নাই। যখন সীতারাম রাজা না হইয়াছিলেন, তখন আবার শ্রীকে না দেখিয়াছিলেন, তখন সীতারাম রমাকে বড় ভালবাসিতেন–নন্দার অপেক্ষাও ভালবাসিতেন। সে ভালবাসা গিয়াছিল। কিসে গেল, সীতারাম তাহার চিন্তা কখনও করেন নাই। আজ একটু ভাবিলেন। ভাবিয়া দেখিলেন–রমার দোষ বড় বেশী নয়,–দোষ তাঁর নিজের। মনে মনে আপনার উপর বড় অসন্তুষ্ট হইলেন।
    কাজেই মেজাজ খারাব হইয়া উঠিল। চিত্ত প্রফুল্ল করিবার জন্য শ্রীর কাছে যাইতে প্রবৃত্তি হইল না; কেন না, শ্রীর সঙ্গে এই আত্মগ্লানির বড় নিকট সম্বন্ধ; রমার প্রতি তাঁহার নিষ্ঠুরাচরণের কারণই শ্রী। শ্রীর কাছে গেলে আগুন আরও বাড়িবে। তাই শ্রীর কাছে না গিয়া রাজা নন্দার কাছে গেলেন। কিন্তু নন্দা সে দিন একটা ভুল করিল। নন্দা বড় চটিয়াছিল। ডাকিনীই হউক আর মানুষীই হউক, কোন পাপিষ্ঠার জন্য যে রাজা নন্দাকে অবহেলা করিতেন, নন্দা তাহাতে আপনার মনকে রাগিতে দেয় নাই। কিন্তু রমাকে এত অবহেলা করায়, রমা যে মরিল, তাহাতে রাজার উপর নন্দার রাগ হইল; কেন না, আপনার অপমানও তাহার সঙ্গে মিশিল। রাগটা এত বেশী হইল যে, অনেক চেষ্টা করিয়াও নন্দা সকলটুকু লুকাইতে পারিল না।
    রমার প্রসঙ্গ উঠইলে, নন্দা বলিল, “মহারাজ! তুমিই রমার মৃত্যুর কারণ |”
    নন্দা এইটুকু মাত্র রাগ প্রকাশ করিল, আর কিছুই না। কিন্তু তাহাতেই আগুন জ্বলিল; কেন না, ইন্ধন প্রস্তুত। একে ত আত্মগ্লানিতে সীতারামের মেজাজ খারাব হইয়াছিল–কোন মতে আপনার নিকটে আপনার সাফাই করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তাহার উপর নন্দার এই উচিত তিরস্কার শেলের মত বিঁধিল। “মহারাজ! তুমিই রমার মৃত্যুর কারণ |” শুনিয়া রাজা গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “ঠিক কথা। আমি তোমাদের মৃত্যুর কারণ। আমি প্রাণপাত করিয়া, আপনার রক্তে পৃথিবী ভাসাইয়া তোমাদিগকে রাজরাণী করিয়াছি–কাজেই এখন বলবেি বৈ কি, আমিই তোমাদের মৃত্যুর কারণ। যখন রমা গঙ্গারামকে ডাকিয়া আমার মৃত্যুর কারণ হইবার চেষ্টা করিয়াছিল, কৈ তখন ত কেহ কিছু বল নাই?”
    এই বলিয়া রাজা রাগ করিয়া বহির্বাটীতে গেলেন। সেখানে চন্দ্রচূড় ঠাকুর, রাজাকে রমার জন্য শোকাকুল বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিবার জন্য নানা প্রকার আলাপ করিতে লাগিলেন। রাজার মেজাজ তপ্ত তেলের মত ফুটিতেছিল, রাজা তাঁহার কথার বড় উত্তর করিলেন না। চন্দ্রচূড় ঠাকুরও একটা ভুল করিলেন। তিনি মনে করিলেন, রমার মৃত্যুর জন্য রাজার অনুতাপ হইয়াছে, এই সময়ে চেষ্টা করিলে যদি ডাকিনী হইতে মন ফিরে, তবে সে চেষ্টা করা উচিত। তাই চন্দ্রচূড় ঠাকুর ভূমিকা করিবার অভিপ্রায়ে বলিলেন, “মহারাজ! আপনি যদি ছোট রাণীর প্রতি আর একটু মনোযোগী হইতেন, তা হইলে তিনি আরোগ্য লাভ করিতে পারিতেন |”
    জ্বলন্ত আগুন এ ফুৎকারে আরও জ্বলিয়া উঠিল। রাজা বলিলেন, “আপনারও কি বিশ্বাস যে, আমিই ছোট রাণীর মৃত্যুর কারণ?”
    চন্দ্রচূড়ের সেই বিশ্বাস বটে। তিনি মনে করিলেন, “এ কথা রাজাকে স্পষ্ট করিয়া বলাই উচিত। আপনার দোষ না দেখিলে, কাহারও চরিত্র শোধন হয় না। আমি ইঁহার গুরু ও মন্ত্রী, আমি যদি বলিতে সাহস না করিব, তবে কে বলিবে?” অতএব চন্দ্রচূড় বলিলেন, “তাহা এক রকম বলা যাইতে পারে |”
    রাজা। পারে বটে। বলুন। কেবল বিবেচনা করুন, আমি যদি লোকের মৃত্যুকামনা করিতাম, তাহা হইলে এই রাজ্যে এক জনও এত দিন টিকিত না।
    চন্দ্র। আমি বলিতেছি না যে, আপনি কাহারও মৃত্যুকামনা করেন। কিন্তু আপনি মৃত্যুকামনা না করিলেও, যে আপনার রক্ষণীয়, তাহাকে আপনি যত্ন ও রক্ষা না করিলে, কাজেই তাহার মৃত্যু উপস্থিত হইবে। কেবল ছোট রাণী কেন, আপনার তত্ত্বাবধানের অভাবে বুঝি সমস্ত রাজ্য যায়। কথাটা আপনাকে বলিবার জন্য কয় দিন হইতে আমি চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু আপনার অবসর অভাবে, তাহা বলিতে পারি নাই।
    রাজা মনে মনে বলিলেন, “সকল বেটাই বলে–তত্ত্বাবধানের অভাব–বেটারা করে কি?” প্রকাশ্যে বলিলেন, “তত্ত্বাবধানের অভাব-আপনারা করেন কি?”
    চন্দ্র। যা করিতে পারি–সব করি। তবে আমরা রাজা নহি। যেটা রাজার হুকুম নহিলে সিদ্ধ হয় না, সেইটুকু পারি না। আমার ভিক্ষা, কাল প্রাতে একবার দরবারে বসেন, আমি আপনাকে সবিশেষ অবগত করি, কাগজপত্র দেখাই; আপনি রাজাজ্ঞা প্রচার করিবেন।
    রাজা মনে মনে বলিলেন, “তোমার গুরুগিরির কিছু বাড়াবাড়ি হইয়াছে–আমারও ইচ্ছা তোমায় কিছু শিখাই |” প্রকাশ্যে বলিলেন, “বিবেচনা করা যাইবে |”
    চন্দ্রচূড়ের তিরস্কারে রাজার সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছিল, কেবল গুরু বলিয়া সীতারাম তাঁহাকে বেশী কিছু বলিতে পারেন নাই। কিন্তু রাগে সে রাত্রি নিদ্রা গেলেন না। চন্দ্রচূড়কে কিসে শিক্ষা দিবেন, সেই চিন্তা করিতে লাগিলেন। প্রভাতে উঠিয়াই প্রাতঃকৃত্য সমস্ত সমাপন করিয়া দরবারে বসিলেন। চন্দ্রচূড় খাতাপত্রের রাশি আনিয়া উপস্থিত করিলেন।

    চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

    যে কথাটা চন্দ্রচূড় রাজাকে জানাইতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহা এই। যত বড় রাজ্য হউক না কেন, আর যত বড় রাজা হউক না কেন, টাকা নইলে কোন রাজ্যই চলে না। আমরা একালে দেখিতে পাই, যেমন তোমার আমার সংসার টাকা নহিলে চলে না–তেমনই ইংরেজের এত বড় রাজ্যও টাকা নহিলে চলে না। টাকার অভাবে তেমনই রোমক সাম্রাজ্য লোপ পাইল–প্রাচীন সভ্যতা অন্ধকারে মিশাইল। সীতারামের সহসা টাকার অভাব হইল।
    সীতারামের টাকার অভাব হওয়া অনুচিত; কেন না, সীতারামের আয় অনেক গুণ বাড়িয়াছিল। ভূষণার ফৌজদারীর এলাকা তাঁহার করতলস্থ হইয়াছিল–বারো ভুঁইঞা তাঁহার বশে আসিয়াছিল। তচ্ছাসিত প্রদেশ সম্বন্ধে দিল্লীর বাদশাহের প্রাপ্য যে কর, সীতারামের উপর তাহার আদায়ের ভার হইয়াছিল। সীতারাম এ পর্যন্ত তাহার এক কড়াও মুরশিদাবাদে পাঠান নাই-যাহা আদায় করিয়াছিলেন, তাহা নিজে ভোগ করিতেছিলেন। তবে টাকার অকুলান কেন?
    লোকের আয় বাড়িলেই অকুলান হইয়া উঠে। কেন না, খরচ বাড়ে। ভূষণা বশে আনিতে কিছু খরচ করিয়াছিল–বারো ভুঁইঞাকে বশে আনিতে কিছু খরচ হইয়াছিল। এখন অনেক ফৌজ রাখিতে হইত-কেন না, কখন কে বিদ্রোহী হয়, কখন কে আক্রমণ করে–সে জন্যও ব্যয় হইতেছিল। অভিষেকেও কিছু ব্যয় হইয়াছিল। অতএব যেমন আয়, তেমনই ব্যয় বটে।
    কিন্তু যেমন আয়, তেমনই ব্যয় হইলে অকুলান হয় না। অকুলানের আসল কারণ চুরি। রাজা এখন আর বড় কিছু দেখেন না–চিত্তবিশ্রামেই দিনপাত করেন। কাজেই রাজপুরুষেরা রাজভাণ্ডারের টাকা লইয়া যাহার যাহা ইচ্ছা সে তাহাই করে,–কে নিষেধ করে? চন্দ্রচূড় ঠাকুর নিষেধ করেন, কিন্তু তাঁহার নিষেধ কেহ মানে না। চন্দ্রচূড় জনকত বড় বড় রাজকর্মচারীর চুরি ধরিলেন,–মনে করিলেন, এবার যে দিন রাজা দরবারে বসিবেন, সেই দিন খাতাপত্র সকল তাঁহার সম্মুখে ধরিয়া দিবেন। কিন্তু রাজা কিছুতেই ধরা দেন না, “কাজ যা থাকে, মহাশয় করুন” বলিয়া কোন মতে পাশ কাটাইয়া চিত্তবিশ্রামে পলায়ন করেন। চন্দ্রচূড় হতাশ হইয়া শেষে নিজেই কয় জনের বর্তকরফের হুকুম জারি করিলেন। তাহারা তাঁহাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিল–বলিল, “ঠাকুর! যখন স্মৃতির ব্যবস্থা প্রয়োজন হইবে, তখন আপনার কথা শুনিব। রাজার সহি মোহরের পরওয়ানা দেখান, নহিলে ঘরে গিয়া সন্ধ্যা–আহ্নিক করুন |”
    রাজার সহি মোহর পাওয়া কিছু শক্ত কথা নহে। এখন রাজার কাছে যা হয় একখানা কাগজ ধরিয়া দিলেই তিনি সহি দেন-পড়িবার অবকাশ হয় না–চিত্তবিশ্রামে যাইতে হইবে। অতএব চন্দ্রচূড় এই অপরাধীদিগের বর্র‍তরফি পরওয়ানাতে রাজার সহি করাইয়া লইলেন। রাজা না পড়িয়াই সহি দিলেন।
    কিন্তু তাহাতে চন্দ্রচূড়ের কার্যসিদ্ধি হইল না। প্রধান অপরাধী খাতাঞ্জি দরবারে উপস্থিত ছিল, সে দেখিল যে, রাজা না পড়িয়াই সহি দিলেন। রাজা চলিয়া গেলে, সে বলিল, “ও হুকুম মানি না। ও তোমার হুকুম–রাজার নয়। রাজা কাগজ পড়িয়াও দেখেন নাই। যখন রাজা স্বয়ং বিচার করিয়া আমাদিগকে বর্তারফ করিবেন, তখন আমরা যাইব,-এখন নহে |” কেহই গেল না। খুব চুরি করিতে লাগিল। ধনাগার তাহাদের হাতে, সুতরাং চন্দ্রচূড় কিছু করিতে পারিলেন না।
    তাই আজ চন্দ্রচূড় রাজাকে পাকড়াও করিয়াছিলেন। রাজা দরবারে বসিলে, অপরাধীদিগের সমক্ষেই চন্দ্রচূড় কাগজপত্র সকল রাজাকে বুঝাইতে লাগিলেন। রাজা একে সমস্ত জগতের উপর রাগিয়াছিলেন, তাহাতে আবার চুরির বাহুল্য দেখিয়া ক্রোধে অত্যন্ত বিকৃতচিত্ত হইয়া উঠিলেন। রাজাজ্ঞা প্রচার করিলেন যে, অপরাধী সকলেই শূলে যাইবে।
    হুকুম শুনিয়া আম দরবার শিহরিয়া উঠিল। চন্দ্রচূড় যেন বজ্রাহত হইলেন। বলিলেন, “সে কি মহারাজ! লঘু পাপে এত গুরু দণ্ড?”
    রাজা ক্রোধে অধীর হইয়া বলিলেন, “লঘু পাপ কি? চোরের শূলই ব্যবস্থা |”
    চন্দ্র। ইহার মধ্যে কয় জন ব্রাহ্মণ আছে। ব্রহ্মহত্যা করিবেন কি প্রকারে?
    রাজা। ব্রাহ্মণদিগের নাক কান কাটিয়া, কপালে তপ্ত লোহার দ্বারা “চোর” লিখিয়া ছাড়িয়া দিবে। আর সকলে শূলে যাইবে।
    এই হুকুম জারি করিয়া রাজা চিত্তবিশ্রামে চলিয়া গেলেন। হুকুম মত অপরাধীদিগের দণ্ড হইল। নগরে হাহাকার পড়িয়া গেল। অনেক রাজকর্মচারী কর্ম ছাড়িয়া পলাইল।

    পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

    চুরি বন্ধ হইল, কিন্তু টাকার তবু কুলান হয় না। রাজ্যের অবস্থা রাজাকে বলা নিতান্ত আবশ্যক, কিন্তু রাজাকে পাওয়া ভার, পাইলেও কথা হয় না। চন্দ্রচূড় সন্ধানে সন্ধানে ফিরিয়া আবার একদিন রাজাকে ধরিলেন-বলিলেন, “মহারাজ! একবার কথায় কর্ণপাত না করিলে রাজ্য থাকে না!”
    রাজা। থাকে, থাকে, যায় যায়। ভাল শুনিতেছি, বলুন কি হয়েছে?
    চ। সিপাহী সব দলে দলে ছাড়িয়া চলিতেছে।
    রাজা। কেন?
    চ। বেতন পায় না।
    রাজা। কেন পায় না?
    চ। টাকা নাই।
    রাজা। এখনও কি চুরি চলিতেছে না কি?
    চ। না, চুরি বন্ধ হইয়াছে। কিন্তু তাতে কি হইবে? যে টাকা চোরের পেটে গিয়েছে, তা ত আর ফেরে নাই।
    রাজা। কেন, আদায় তহসিল হইতেছে না?
    চ। এক পয়সাও না।
    রাজা। কারণ কি?
    চ। যাহাদের প্রতি আদায়ের ভার, তাহারা কেহ বলে, “আদায় করিয়া শেষ তহবিল গরমিল হইলে শূলে যাব না কি?”
    রাজা। তাহাদের বর্তদরফ করুন।
    চ। নূতন লোক পাইব কোথায়? আর কেবল নূতন লোকের দ্বারায় কি আদায় তহসিলের কাজ হয়?
    রাজা। তবে তাহাদিগকে কয়েদ করুন।
    চ। সর্বনাশ! তবে আদায় তহসিল করিবে কে?
    রাজা। পনের দিনের মধ্যে যে বাকি বকেয়া না করিবে, তাহাকে কয়েদ করিব।
    চ। সকল তহসিলদারেরও দোষ নাই। দেনেওয়ালারা অনেকে দিতেছে না।
    রাজা। কেন দেয় না?
    চ। বলে, “মুসলমানের রাজ্য হইলে দিব। এখন দিয়া কি দোকর দিব?”
    রাজা। যে টাকা না দিবে, যাহার বাকি পড়িবে, তাহাকেও কয়েদ করিতে হইবে।
    চন্দ্রচূড় হাঁ করিয়া রহিলেন। শেষ বলিলেন, “মহারাজ, কারাগারে এত স্থান কোথা?”
    রাজা। বড় বড় চালা তুলিয়া দিবেন।
    এই বলিয়া বাকিদার ও তহসিলদার, উভয়ের কয়েদের হুকুমে স্বাক্ষর করিয়া রাজা চিত্তবিশ্রামে প্রস্থান করিলেন। চন্দ্রচূড় মনে মনে শপথ করিলেন, আর কখনও রাজাকে রাজকার্যের কোন কথা জানাইবেন না।
    এই হুকুমে দেশে ভারি হাহাকার পড়িয়া গেল। কারাগার সকল ভরিয়া গেল-চন্দ্রচূড় চালা তুলিয়া কুলাইতে পারিলেন না। বাকিদার, তহসিলদার, উভয়েই দেশ ছাড়িয়া পলাইতে লাগিল।
    তাই বলিতেছিলাম যে, আগে আগুন ত জ্বলিয়াই ছিল, এখন ঘর পুড়িল; যদি শ্রী না আসিত, তবে সীতারামের এতটা অবনতি হইত কি না জানি না; কেন না, সীতারাম ত মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, রাজ্যশাসনে মন দিয়া শ্রীকে ভুলিবেন-সে কথা যথাস্থানে বলিয়াছি। অসময়ে শ্রী আসিয়া দেখা দিল, সে অভিপ্রায় বালির বাঁধের মত আসক্তির বেগে ভাসিয়া গেল। রাজ্যে মন দিলেই যে সব আপদ ঘুচিত, তাহা নাই বলিলাম, কিন্তু শ্রী যদি আসিয়াছিল, তবে সে যদি নন্দার মত রাজপুরীমধ্যে মহিষী হইয়া থাকিয়া নন্দার মত রাজার রাজধর্মের সহায়তা করিত, তাহা হইলেও সীতারামের এতটা অবনতি হইত না বোধ হয়; কেন না, কেবল ঐশ্বর্য্য মদে যে অবনতিটুকু হইতেছিল, শ্রী ও নন্দার সাহায্যে সেটুকুরও কিছু খর্বতা হইত। তা শ্রী, যদি রাজপুরীতে মহিষী না থাকিয়া, চিত্তবিশ্রামে আসিয়া উপপত্নীর মত রহিল, তবে সন্ন্যাসীর মত না থাকিয়া, সেই মত থাকিলেই এতটা প্রমাদ ঘটিত না। আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হইলে তাহার মোহিনী শক্তির অনেক লাঘব হইত। কিছু দিনের পর রাজার চৈতন্য হইতে পারিত। তা, যদি শ্রী সন্ন্যাসিনী হইয়াই রহিল, তবে সোজা রকম সন্ন্যাসিনী হইলেও এ বিপদ হইত না। কিন্তু এই ইন্দ্রাণীর মত সন্ন্যাসিনী বাঘছালে বসিয়া বাক্যে মধুবৃষ্টি করিতে থাকিবে, আর সীতারাম কুকুরের মত তফাতে বসিয়া মুখপানে চাহিয়া থাকিবে–অথচ সে সীতারামের স্ত্রী! পাঁচ বৎসর ধরিয়া সীতারাম তাহার জন্য প্রায় প্রাণপাত করিয়াছিলেন। এ দুঃখের কি আর তুলনা হয়! ইহাতেই সীতারামের সর্বনাশ ঘটিল। আগে আগুন লাগিয়াছিল মাত্র,–এখন ঘর পুড়িল! সীতারাম আর সহ্য করিতে না পারিয়া মনে সঙ্কল্প করিলেন, শ্রীর উপর বলপ্রয়োগ করিবেন।
    তবে যাকে ভালবাসে, তাহার উপর বলপ্রয়োগ বড় পামরেও পারে না। শ্রীর উপর রাজার যে ভালবাসা, তাহা এখন কাজেই ইন্দ্রিয়বশ্যতায় আসিয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু ভালাবাসা এখনও যায় নাই। তাই বলপ্রয়োগে ইচ্ছুক হইয়াও সীতারাম তাহা করিতেছিলেন না। বলপ্রয়োগ করিব কি না, এ কথার মীমাংসা করিতে সীতারামের প্রাণ বাহির হইতেছিল। যত দিন না সীতারাম একটা এদিক ওদিক স্থির করিতে পারিলেন, তত দিন সীতারাম এ প্রকার জ্ঞানশূন্যাবস্থায় ছিলেন। সেই ভয়ানক সময়ের বুদ্ধিবিপর্যয়ে রাজপুরুষেরা শূলে গেল, আদায় তহসিলের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা কারাগারে গেল, বাকিদারেরা আবদ্ধ হইল, প্রজা সব পলাইল, রাজ্য ছারখারে যাইতে লাগিল।
    শেষ সীতারাম স্থির করিলেন, শ্রীর প্রতি বলপ্রয়োগই করিবেন। কথাটা মনোমধ্যে স্থির হইয়া কার্যে পরিণত হইতে না হইতেই অকস্মাৎ এক গোলযোগ উপস্থিত হইল। চন্দ্রচূড় ঠাকুর রাজাকে আর একদিন পাকড়া ও করিয়া বলিলেন, “মহারাজ! তীর্থপর্যটনে যাইব ইচ্ছা করিয়াছি। আপনি অনুমতি করিলেই যাই |”
    কথাটা রাজার মাথায় যেন বজ্রাঘাতের মত পড়িল। চন্দ্রচূড় গেলে নিশ্চয়ই শ্রীকে পরিত্যাগ করিতে হইবে, নয় রাজ্য পরিত্যাগ করিতে হইবে। অতএব রাজা চন্দ্রচূড় ঠাকুরকে তীর্থযাত্রা হইতে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
    এখন চন্দ্রচূড় ঠাকুরের স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, এ পাপ রাজ্যে আর বাস করিবেন না, এই পাপিষ্ঠ রাজার কর্ম আর করিবেন না। অতএব তিনি সহজে সম্মত হইলেন না। অনেক কথাবার্তা হইল। চন্দ্রচূড় অনেক তিরস্কার করিলেন। রাজাও অনেক উত্তর প্রত্যুত্তর করিলেন। শেষে চন্দ্রচূড় থাকিতে সম্মত হইলেন। কিন্তু কথায় কথায় অনেক রাত্রি হইল। কাজেই রাজা সে দিন চিত্তবিশ্রামে গেলেন না। এদিকে চিত্তবিশ্রামে সেই রাত্রে একটা কাণ্ড উপস্থিত হইল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী চৌধুরাণী – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article ব্রেজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }