Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সুধাময়ের বাবা

    উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প10 Mins Read0

    সুধাময়ের বাবা

    ধানের বদলে এবার রজনীগন্ধার চাষ দিয়েছে জয়কেষ্ট। নতুন রকমের চাষ, তাই তার শরীরে এসেছে নতুন শক্তির জোয়ার।

    বুদ্ধিটা দিয়েছিল কাশেম আলি। ফুলের চাষের কথা জয়কেষ্ট সাতজন্মে শোনেনি। ফুল ফোটে বসত বাড়ির ধারে পাশে, চাষের জমিতে ফলে ধান, পাট, গম রবিশস্য! কিন্তু কাশেম আলি বললেন, ফুলেরও ভালো বাজার আছে, দরও বেশ চড়া, ঝপ করে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

    ফুলের বাগান নয়, ফুল চাষের খেতে ঘুরছে জয়কেষ্ট, এর মধ্যেই কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে, ফসল তোলার আর দেরি নেই। এই মাল বেচবার জন্য হাটে যেতে হয় না, কলকাতার হাওড়া ব্রিজের নীচে বিরাট ফুলের বাজার, সেখানকার পাইকাররা এসে মাল তুলে নিয়ে যায়।

    একটা ঝাড়ে কুঁড়ি ফুটে গেছে, সবুজের মধ্যে ফুটফুট করছে সাদা-সাদা ফুলের গন্ধ। জয়কেষ্ট আপন মনে বলল, আহা রে। ধান কাটার সময় মায়া লাগে না। অনেকখানি ডাঁটা শুষ্টু এই গাছ কেটে ফেলতে হবে।

    হঠাৎ জয়কেষ্টর মনে হল, তার পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। এ কী, ভূমিকম্প শুরু হল নাকি? জয়কেষ্টর পা কাঁপছে, বুক কাঁপছে, মাথা ঘুরছে। না, এ তো তার শরীরের অসুখ নয়, ফুলগাছগুলোও দুলছে খুব জোরে-জোরে, অথচ বাতাস নেই, তাহলে দুলছেন বসুমতী।

    কিন্তু একটু দুরের তালগাছ জোড়া স্থির, তার জমির দুপাশের ধানের খেতে ঢেউ নেই, আর কোথাও কোনও চাঞ্চল্য নেই। তাহলে কি ফুলের খেতই শুধু কাঁপে? হবেও বা। মাটি থেকে ধানের চারায় যে রস ওঠে, আর ফুলের চারায় যে রস ওঠে, তা নিশ্চয়ই আলাদা।

    জয়কেষ্ট গুটিগুটি পায়ে বাড়ি ফিরতে লাগল। এসেছে সেই কাকভোরে। এখন সূর্য মাথার ওপরে। এখন আর জমিতে অত তদারকি লাগে না, কীটনাশক স্প্রে করে দিয়েছে, দুদিন বৃষ্টির জন্য ভিজে আছে জমি। তবু জয়কেষ্ট এখানে এসে বসে থাকে। বসে থাকতে তার ভালো লাগে। নতুন রকম চাষ তো!

    বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। হাঁটতে-হাঁটতে জয়কেষ্ট দুপাশের জমির দিকে তাকায়। আগে এইসব অনেকটাই ছিল তাদের বংশের। দুই কাকা মামলা করে অনেকখানি নিয়ে নিয়েছে। জয়কেষ্টর তিন মেয়ের বিয়ের জন্য মোট চোদ্দো বিঘে জমি বেচতে হয়েছে। এখন আছে মাত্র পাঁচ বিঘে। তাতে সম্বৎসরের খোরাকি জোটানো কষ্টকর, একটা বড় পুকুরের ছআনি মালিকানা আছে বলে কিছু টাকা পায়। চলে যায় কোনওক্রমে। আগে জয়কেষ্ট নিজের হাতে চাষও করত না। তারা। আসলে তাঁতি, তারা কখনও হাল ধরেনি। কিন্তু এখন মিলের যুগ, কো-অপারেটিভের যুগ, একলা তাঁত বুনে কোনও সুসার নেই, পড়তা পোষায় না। তাঁতগুলো পড়ে-পড়ে পচছিল, কিছুদিন আগে উনুনে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। জমিও অন্যদের হাতে ফেলে রাখা যায় না। বর্গাদার নাম লিখিয়ে নেবে।

    জয়কেষ্ট নিজেই মাঝে-মাঝে হাসতে-হাসতে বলে, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে।

    বাড়ির কাছাকাছি এসে জয়কেষ্ট একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেল। তার বাড়িতেই কেউ কাঁদছে।

    উঠোনে জয়কেষ্টর স্ত্রী দামিনীকে ঘিরে রয়েছে গুটিপাঁচেক রমণী। দামিনী মাথা চাপড়ে চাপড়ে ডাক ছেড়ে কান্নাকাটি করছে। প্রতিবেশী পুরুষরা দাঁড়িয়ে আছে অনেক দূরে, তারা বাড়ির মধ্যে আসবে না।

    এই কিছুক্ষণ আগে, দশ-বারোজন লোক লাঠি-সোঁটা-বর্শা নিয়ে এসেছিল। তারা লুটপাট করেনি, শুধু সুধাময়কে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে ধরে নিয়ে গেছে। সুধাময় তখন পড়তে বসেছিল। এই দম্পতির প্রথমেই একটি ছেলে জন্মেছিল, সে বেঁচে নেই, তিন মেয়ের পর ছোট ছেলে সুধাময়, সে কলেজে দুটো পাস দিয়েছে, আর-একটা পাস বাকি। এ-বংশের কেউ আগে স্কুলের পাঁচ ক্লাসের বেশি পেরোয়নি। সুধাময় একেবারে কলেজে। তাও তার মাইনে লাগে না, জলপানি। পায়। পড়ার দিকে তার এত ঝোঁক যে, বই নিয়ে বসলে নাওয়া-খাওয়ার জ্ঞান থাকে না। কিন্তু তাঁতির ছেলের পেটে অত বিদ্যে সহ্য হবে কেন, উগ্রপন্থী রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সে ইদানীং আর কলেজে যায় না। ছেলে একটা মাস্টারির চাকরি পেলেও জয়কেষ্ট বর্তে যেত, এই বয়েসে তাকে আর জমির জন্য খেটে মরতে হত না। কিন্তু শুধু নিজেদের সংসার নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই সুধাময়ের। সারা পৃথিবীর দায়িত্ব তার ঘাড়ে চেপেছে যে! এখনকার দিনকালে এক দঙ্গল লোক মিলে যদি কোনও একটা জোয়ান ছেলেকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়, তবে তার পরিণতি একটাই। খানিক বাদে মাঠের মধ্যে কিংবা খাল ধারে পাওয়া যাবে সুধাময়ের লাশ।

    একটা গাছের মতন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল জয়কেষ্ট। দামিনীর বুকফাটা কান্নায় সে কী সান্ত্বনা দেবে! দামিনীও তো বুঝেছে, তাই এত কান্না।

    এখন বদলাবদলির যুগ। খুনোখুনি জল ভাত। যাদের বাপ চোদ্দোপুরুষ কোনওদিন যুদ্ধ করেনি, যাদের কোনও সাহস নেই, তারা দশ-বারোজন মিলে একজন নিরস্ত্র লোককে অনায়াসে মেরে ফেলে। সুধাময়ের দলের লোকেরাও নিশ্চয়ই অন্য দলের কোনও ছেলেকে বেকায়দায় পেয়ে খুন করেছে। সেই খুনের সময় সুধাময় উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক, দলের তো বটে। হাতের কাছে। তাকে পাওয়া গেছে। সুধাময়ের দলের ছেলেরা যখন এখবর শুনবে, তখন তারা সুধাময়কে। বাঁচাবার জন্য একটুও চেষ্টা করবে না, এখন লুকিয়ে পড়বে, মনে-মনে বলবে, ঠিক আছে, সুধাকে মারুক না, আমরাও পরে ওদের একটাকে মেরে শোধ নেব।

    ছেলের জন্য শোক করবে কী, খিদেয় জয়কেষ্টর পেট জ্বলছে। সকাল থেকে কিছু খায়নি, এখন তার ভাত খাওয়ার কথা। এই বয়েসে খিদে সহ্য হয় না। ছেলে মরছে বলে কি তার পেটের আগুন চুপ করে থাকবে?

    একটা কিছু করা দরকার ঠিকই। পার্টির নেতাদের কাছে যেতে হবে, পুলিশের কাছে যেতে হবে। কিন্তু খিদেয় দুর্বল শরীর নিয়ে জয়কেষ্ট যে এক পা-ও হাঁটতে পারবে না।

    স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সে মনে-মনে বলল, দামিনী, ছেলের জন্য কষ্ট সহ্য করতে যদি না পারিস, তাহলে আর কী করবি, মরে যা! তিপান্ন বছর তো বাঁচলি। মায়ের কান্না শুনে খুনোখুনি বন্ধ হয় না। যারা খুন হচ্ছে এবং পরে আরও যারা খুন হবে, তাদের প্রত্যেকেরই তো মা আছে।

    রান্নাঘরে ঢুকে নিজেই সে খেতে বসে গেল।

    এ-গ্রামে সুধাময়দের দলের কোনও ঘাঁটি নেই। লেখাপড়া জানা ছেলের কী বুদ্ধি, কাছাকাছি কোনও মুরব্বি না ধরে, সে এগারো মাইল দূরে কলেজপাড়ার দলে নাম লেখাতে গেল! এ-গ্রাম থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। নিজের দলের ছেলে না হলে আজকাল কোনও পার্টিই মাথা ঘামায় না। এ-গ্রামের নেতা নরেনবাবু। তিনি বলবেন, সুধাময় খুন হয়েছে। ও তো একটা সমাজবিরোধী।

    আর পুলিশ? নরেনবাবুর পার্টির ছেলে হলে পুলিশ তবু ব্যস্ত হওয়ার ভান করত, সুধাময়দের পার্টির নাম শুনলেই পুলিশ দাঁত কিড়মিড় করে। নিশ্চয়ই বলবে, যাক গেছে, একটা আপদ গেছে! সমাজবিরোধীর বাবা হিসেবে জয়কেষ্টকেই না গরাদে ভরে দেয়!

    তবু তো যেতে হবে জয়কেষ্টকে।

    রোগাপাতলা চেহারা সুধাময়ের। একসঙ্গে অত লোককে আসতে দেখে সে দিশাহারা হয়ে শূন্য গোয়ালঘরে লুকিয়েছিল। সেখান থেকে চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে বার করা হয়েছে। দামিনী। বাধা দিতে এসেছিল, তাকে প্রচণ্ড ধাক্কায় মাটিতে ফেলে বুকের ওপর পা ধরেছিল একজন। উঠোনে ছড়িয়ে আছে দামিনীর ভাঙা কাচের চুড়ি, সুধাময়ের একপাটি চটি, গেঞ্জির ভেঁড়া টুকরো ঠোঁট থেকে গড়ানো কয়েক ফোঁটা রক্ত। এখনও কি বেঁচে আছে সুধাময়?

    গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল জয়কেষ্ট।

    অনেকের মনেই নেই যে জয়কেষ্টও একসময় জেল খেটেছিল। তার বয়েস কি কম হল? ইংরেজ আমলে, সেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তার বয়েস ছিল সুধাময়ের সমান। জয়কেষ্ট অবশ্য পার্টি-ফার্টিতে নাম লেখায়নি, কিন্তু সেই বিয়াল্লিশ সালে আবেগের একটা জোয়ার এল, কংগ্রেসের নেতারা সবাইকে ডাক দিলেন, সবার ঘরে-ঘরে গান্ধীজির ছবি। জয়কেষ্টও মিছিলের সঙ্গে গিয়েছিল আদালত ঘেরাও করতে। কী মার মেরেছিল পুলিশ। একটা দৃশ্য জয়কেষ্টর এখনও মনে আছে। এই অঞ্চলে কংগ্রেসের নেতা ছিলেন সত্যময় সেন, কী সুন্দর, সৌম্য চেহারা ছিল তাঁর। অনেকটা যেন সুভাষ বসুর মতন। সাদা খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, মাথায় গান্ধী টুপি, মিছিলের একেবারে সামনে ছিলেন তিনি। পুলিশ এসে লাঠি চালাল, সত্যময় সেনের কপাল থেঁতলে গিয়ে রক্তে ভিজে গেল সাদা জামা। তিনি একটুও বিচলিত হলেন না, হাত তুলে। সবাইকে বললেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য। জয়কেষ্ট অবশ্য মার খায়নি। তবে সত্যময়বাবুর কাছাকাছি ছিল বলে সে-ও ধরা পড়ে জেল খেটেছিল দু-মাস। ছাড়া পাওয়ার পর বাবার ধমক খেয়ে বাড়ি থেকে আর বেরুত না। তারপর তো স্বাধীনতা এল। সত্যময়বাবু তখন বাতে পঙ্গু। এখানকার কংগ্রেসের নেতা হলেন তাঁর ভাই অঘোরনাথ। একদিন জয়কেষ্ট দেখল, সত্যময়বাবুদের বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে দারোগাবাবু, লুচি আর মাংস খাচ্ছেন। শিউরে উঠেছিল জয়কেষ্ট। যে পুলিশ সত্যময়বাবুকে অমনভাবে মেরেছিল, আজ তাঁর বাড়িতেই পুলিশের এত খাতির? পুলিশরা সব গঙ্গাজলে ধোয়া শুষ্টু হয়ে গেল নাকি? কোথায় কী, এক একটা বছর যায়, জয়কেষ্ট দেখতে পায় পুলিস ঠিক সেইরকমই আছে। কিংবা আগেকার চেয়েও বেশি লোভী! জমিদার-জোতদার ঠিকাদারদের কথায় ওঠে বসে, গরিবের কথা কেউ শোনে না। অঘোরনাথবাবুরও ওইসব লোকদের সঙ্গেই ওঠা-বসা। প্রায়ই তিনি থানায় যান। একবার কংগ্রেসের দুটো ছেলে ডাকাতির দায়ে ধরা পড়ল, অঘোরনাথবাবু দিব্যি তাদের ছড়িয়ে। আনলেন। তারা ড্যাং-ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায়।

    সেই সময় সেই তল্লাটে এলেন জীবন ঘোষাল। তখন এখানে কেউ কমিউনিস্ট পার্টির নামও শোনেনি। জীবন ঘোষাল একাই এখানে পার্টির তিনটে শাখা অফিস গড়ে তুললেন, কী পরিশ্রমটাই না করতে পারতেন তিনি। কোথায় খাবেন, কোথায় ঘুমোবেন তার ঠিক নেই। গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে-কোনও চাষির বাড়ির দাওয়ায় শুয়ে থাকবেন। চাষি-মজুর-তাঁতি-জেলেদের তিনি এককাট্টা করেছিলেন, তিনি সবসময় বলতেন, গরিবরা চিরকাল পড়ে-পড়ে মার খাবে নাকি? দিন বদলাচ্ছে, বুঝলি জয়কেষ্ট, চাষি মজুররাই এরপর গভর্নমেন্ট চালাবে।

    একবার জ্বরে পড়ে জীবন ঘোষাল পরপর তিনরাত ছিলেন জয়কেষ্টদের বাড়ি। যেমন জ্বর, তেমনি কাশি। ওষুধপত্তর কিছু খেলেন না, অসাধারণ তাঁর মনে জোর। জীবন ঘোষালের কথা চিন্তা করলে এখনও শ্রদ্ধায় জয়কেষ্টর মাথা নীচু হয়ে আসে। নিজস্ব বাড়ি, ঘর সংসার কিছুই ছিল তাঁর। পুলিসের হাতে কম মার খেয়েছেন? তখন অবশ্য খুনোখুনি ছিল না, কংগ্রেসিরা নানান ছুতোয় তাঁকে গ্রেপ্তার করায় তিন-তিনবার জেল খাটলেন, জেল থেকে বেরিয়ে এসেই আরও। বেশি উৎসাহে কাজে লেগে পড়তেন। একবার জেল থেকে বেরিয়ে এসে দেখিয়েছিলেন, পুলিশ তাঁর ডানহাতের কনুই ছেঁচে দিয়েছিল, সেই হাত আর তুলতে পারতেন না তিনি, ভাত খাওয়া অভ্যেস করলেন বাঁ-হাত দিয়ে।

    শেষদিকে থাকতেন পার্টি অফিসে। টি বি রোগের কথা কারুকে জানতে দেননি, মারা গেলেন পঁয়ষট্টি সালে, তার পরের বারের ভোটেই কংগ্রেস এদিকে হেরে ভূত হয়ে গেল। জীবন ঘোষাল তাঁর পার্টির সুদিন দেখে যেতে পারলেন না। পরবর্তী নেতা হলেন বীরেনবাবু। এখন নরেনবাবু। কংগ্রেস আর একবারও জিততে পারেনি, এখান থেকে প্রায় মুছেই গেছে। নরেনবাবুর সঙ্গে এখন পুলিসের খুব দহরম-মহরম। দারোগারা হাত কচলিয়ে স্যার-স্যার করে। নরেনবাবুর পার্টির ছেলেরা জোর জুলুম করে চাঁদা তোলে, যাকে-তাকে ধরে পিটিয়ে দেয়, পুলিশ কিছু বলে না। নরেনবাবুর চেহারাটাও যেন দিন-দিন অঘোরনাথবাবুর মতন হয়ে যাচ্ছে!

    সুধাময়টা কী বোকা, সে যদি নরেনবাবুর পার্টিতে গিয়ে জুটত, তাহলে কিছুদিনের মধ্যে নেতা গোছের হয়ে যেতে পারত, পয়সাকড়িরও অভাব থাকত না। তা নয়। সে গিয়ে জুটল আর এক সর্বহারার পার্টিতে।

    জয়কেষ্ট ফিরে এল সাতদিন পর। সুধাময়ের লাশ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি বটে, কিন্তু তার বাঁচার সম্ভাবনাও কেউ বিশ্বাস করে না। বিভিন্ন পার্টি অফিস, স্থানীয় থানা, সদর থানা, মন্ত্রীর দালাল—এইসব জায়গায় ঠোক্কর খেতে-খেতে জয়কেষ্টর মন বাড়ি ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠল।

    তার বাড়িতে কেউ নেই, দরজা হা-হা করছে। দামিনী খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার বড় ভাইয়ের ছেলে সুধীর এসেছিল, দামিনীকে সে হাসপাতালে ভরতি করে দিয়েছে। এখন-তখন অবস্থা। বাড়ি ফাঁকা পেয়ে এরমধ্যে চোরেরা দরজা ভেঙে যা পেরেছে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।

    জয়কেষ্ট এসব কিছুই গায়ে মাখল না। দামিনীকে দেখতে একবার হাসপাতালে তো যেতেই হবে। কিন্তু তার আগে সে তার ফুলের চাষ দেখে যাবে না? ওইটানেই তো বেশি করে ছুটে এসেছে।

    এই সাতদিন আর বৃষ্টি হয়নি, জল দেয়নি কেউ, তবু ফুটে গেছে সব কুঁড়ি। নিজের ফুলের খেতে এসে অভিভূত হয়ে গেল জয়কেষ্ট! এত ফুল সে নিজের হাতে ফুটিয়েছে। পৃথিবীটাই এখন শ্বেতশুভ্র। কী সুন্দর গন্ধ! আর বেশি ফুটে গেলে এ ফুল আর বিক্রি হবে না। বিক্রি করবার তার সময়ই বা কোথায়!

    কাশির দমক শুনে সে ঘুরে তাকাল। তালগাছ দুটির ফাঁকে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা চেহারা, কালো রং, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। আধময়লা পাঞ্জাবি পরা। চিনতে ভুল হল না জয়কেষ্টর। এ তো জীবন ঘোষাল!

    মৃত্যুর ওপারের দেশ থেকে এই দিনদুপুরে জীবন ঘোষাল কী করে ফিরে আসবে সে প্রশ্নই তার মনে জাগল না। এইভাবে জীবন ঘোষালকে কতবার দেখেছে।

    জয়কেষ্ট জিগ্যেস করল, কেমন আছ, জীবনদা?

    জীবন ঘোষাল কোনওদিন নিজের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা পছন্দ করতেন না। আজও এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ছেলেটাকে খুঁজে পেলি না তো, জয়কেষ্ট? পাবি না। এখন ধরে নিয়ে গেলে আর ছাড়ে না। আধমরাও করে না, একেবারে জানে মেরে দেয়। বুকে গুলি করার পরও ছুরি দিয়ে পেট ফাঁসায়। নদীতে ফেলে দিলে লাশও পাওয়া যায় না।

    সাতদিনের মধ্যে এই প্রথম দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে এল জয়কেষ্টর চোখ দিয়ে। এই কদিন অন্যদের কথা ঠিক সে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু জীবন ঘোষালের কথা অবিশ্বাস করা যায় না। সুধাময় আর নেই।

    একটুক্ষণ জীবন ঘোষালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর সে পটাপট করে কিছু ফুল ছিড়ল। তারপর এগিয়ে গিয়ে বলল, জীবনদা, তোমার মতো খাঁটি মানুষ আমি আর দেখিনি। তুমি মরার পর তোমার পায়ে আমি ফুল দিতে পারিনি–

    জীবন ঘোষাল বললেন, দূর বোকা! ফুল দিয়ে কী হবে। তুই মরলে কে তোকে ফুল দেবে, কেউ না! ও, তুই নিজেই তো ফুলের চাষ করেছিস! তাহলে এক কাজ কর জয়কেষ্ট, তুই এখানেই মরে যা! আর বেঁচে থেকে কী করবি? তোর ছেলেটা গেছে, বউটারও আর আশা নেই, আর কে আছে? তোদের মতন মানুষদের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছুরি-ছোরা-বন্দুক-বোমা নিয়ে আর কি লড়তে পারবি? যদি না পারিস–

    জীবন ঘোষাল অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর জয়কেষ্ট শুয়ে পড়ল তার জমিতে। জীবনদা ঠিক সময় এসে ঠিক কথাটা বলে গেছেন। অন্য জায়গায় তার মৃত্যু হলে কে তাকে ফুল দিত! এই তো কী সুন্দর, কী শান্তি, তার নিজের হাতে তৈরি করা ফুল!

    জয়কেষ্ট টের পেল, তলার মাটি কাঁপছে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুখস্বপ্ন
    Next Article সুনেত্রার কথা

    Related Articles

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }