Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প627 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১.১৭ বড় গলায় আশ্বাস দিয়েছিল সুবোধ

    বড় গলায় আশ্বাস দিয়েছিল সুবোধ তার ভাদ্রবৌকে, বামুনের ছেলে, দুটো ভাত সেদ্ধ করে নিতে পারবো না?

    কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ব্ৰাহ্মণ-সন্তানের গৌরব অক্ষুন্ন থাকছে না। জগতের সহজতম এবং ওচতম কাজ ওই ভাত সেদ্ধটাই চার চারটে জোয়ান পুরুষকে হিমসিম খাইয়ে ছাড়ছে।

    হয় অতিসেদ্ধ হয়ে পিণ্ডি পাকিয়ে বসে থাকে, ফেন ঝরানোর অবস্থা থাকে না, নয়তো অতি সাবধানে প্ৰায় চালই থেকে যায়। অথবা হয়তো জলের অঙ্কে ঘাটতি ঘটে সহসা সুগন্ধে পাড়া আমোদিত করে তোলে। তা ছাড়া ফেন ঝরাতে আঙুলের ডগায় ছোটখাটো ফোস্কা চারজনেরই হয়েছে। কুর একজনের অপটুতায় ব্যঙ্গহাসি হেসে অপরজন হাত লাগাতে এসেছে কিনা!

    আনুষঙ্গিক ব্যাপার উনুন ধরানোও সোজা কাজ নয়। হয়তো বা তুল্যমূল্য। উনুনের ভিতরদিকে যুঁটে পেতে পেতে আগুন জ্বেলে দিয়ে তার উপর কয়লা ঢেলে দিতে হয়, এ পদ্ধতিটা অবিদিত কারুরই নেই! গেরস্থের ছেলে, মা চিরকাল খেটেছে, ওরা আশেপাশে ঘুরেছে।

    কিন্তু সেই জানা জগতের কাজটা যে হাতে-কলমে করতে গিয়ে এমন রহস্যময় হয়ে উঠবে এটা কে জানতো?

    পদ্ধতিমত কাজ হয়, কিছুক্ষণের মত বাড়িটা ধূম্রলোকে পরিণত হয়, কিন্তু সেই ধূমজাল থেকে মুক্ত হয়েই দেখা যায় ধূমের পিছনে বহ্নি নেই। কেন যে এমনটা হয় সেটা দুর্বোধ্য! ওই একই পদ্ধতিতেই তো আবার জ্বলেও শেষ পর্যন্ত! বার তিন-চার ধোঁয়া খেয়ে খেয়ে শেষ অবধি আগুনের দেখা মেলে।

    কাজ দুটো যে এমন গোলমেলে, তা তো কই মনে হতো না কোনোদিন? বরং চোখে একটু ধোঁয়া লাগলেই রাগারগি করা হয়েছে, এত ধোয়া কেন? রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে না কেন?

    মুখরা হরিদাসী বলতো, চুলোয় আগুন দিলে ধোঁয়া হবে না তো কি পুষ্পবৃষ্টি হবে দাদাবাবুরা? আপনারা বোঠকখানা ঘর থেকে তেরিমেরি করছে, অথচ বৌদিরা ওই ধোয়ার মধ্যে বসে কুটনোবাটনা করছে। কই তারা তো কিছু বলছে না!

    হরিদাসীর এই দুঃসাহসিকতার উপর মুক্তকেশীর ধমক এসে পড়তে, তুই থাম তো হরিদাসী! কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা? বৌদিরা ধোঁয়ায় বসে আছে বলে দাদাবাবুরাও থাকবে তাই? বলি পায়ে মাথায় এক হবে?

    হরিদাসী মুক্তকেশীকেও ছেড়ে কথা কইত না, বেজার গলায় বলতো, জানি নে মা, কে পা, কে মাথা! আর মাথাটাই দামী, পা-টাই সস্তা, তাই বা কেন, তোমরাই জানো সে-কথা। পায়ের ওপরই তো দাঁড়ায় মাথাটা। আর আমরা তো পায়ের তলা, তবু তো আমাদের নইলে তোমাদের দিন চলে না দেখি। ভগবান সকল মনিষ্যির শরীল একই বস্তু দিয়ে তৈরি করেছে, সেই কথাই কইছি।

    তা কইবি বৈকি, মেজবৌদির সাকরেদ যে! ব্রাতদিন তো ওই সব কথার চাষ করছেন মাজননী! বলে থামতেন মুক্তকেশী। কারণ জানেন। হরিদাসীর মতন পরিষ্কার কাজ শয়ে একটা মেলে কি না মেলে। ওকে বেশি চটানো চলবে না।

    ওখানে চুপ করে এখানে ছেলেদের কাছে এসে অভিযোগ করতেন মুক্তকেশী, দেখছিস তো মাগীর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! মেজবৌমাই এইটি করছেন। অনবরত ওদের সামনে গাওয়া—গরীবরা কি মানুষ নয়?… ছোটলোক কথাটা কারুর গায়ে লেখা থাকে না, ব্যাভারেই ছোটলোক ভদরলোক! … মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে বলেই কি আমরা ওর মাথা কিনে নিয়েছি? ও কাজ দিচ্ছে। আমরা পয়সা দিচ্ছি, হয়ে গেল শোধবোধ।… এতে আর ছোটলোকের মাথা বিগড়োবে না?

    ছেলেরা বলতো, বিদেয় করে দাও না মাগীকে। ঝি আর মিলবে না। কলকাতা শহরে?

    মুক্তকেশী ভিতরের রহস্য ব্যক্ত করতেন না, বলতেন, না, অমনটি আর সহজে মিলবে না। বলতেন, যে আসবে লঙ্কায়, সেই হবে রাক্ষোস! মেজবৌমা হয়তো আবার তাকে নিয়ে পাঠশালা। খুলবে। এই তো শুনি নিত্যি বলছে, হরিদাসী, তোর ছেলেটাকে এই বয়সেই পানের দোকানে কাজ করতে দিয়েছিস? কেন, একটু লেখাপড়া শেখাতে হয় না? আমাদের এখানে আনিস না সন্ধ্যেবেলা ছেলে।পুলের কাছে বসে থাকবে, পড়া শুনে শুনেও শিখবে একটু!

    এ কথা শুনে হেসে উঠেছে। ওরা হা হা করে। হরিদাসীর ছেলের লেখাপড়ার ভাবনায় মেজাগিনীর আমাদের ঘুম হচ্ছে না! ভাল ভাল। কী বলবো, ওই মেয়ে লেখাপড়া করলে নিৰ্ঘাত মামলা এঁটে কাছারি যেত।… তবে হরিদাসীর যে রকম বোলচাল ফুটছে, তাতে ওকে ছাড়িয়ে দেওয়াই দরকার। এর ওপর আবার নাকি স্বদেশীবাবু-দের চ্যােলা হচ্ছেন। বিদেয় কর, বিদেয় কর।

    কিন্তু এখন মুক্তকেশীর ছেলেরা কাতর আক্ষেপে বলছে, হরিদাসীটা সুদ্ধ ভাগলো! ওটা থাকলে তো এমন ঝঞাটে পড়তে হত না!

    প্রকাশ-ই বেশি খাপ্পা, কারণ ঐটা বাসন মাজার দায়টা পড়েছে সম্পূর্ণ তারই ঘাড়ে। সে ছোট, তারই এটা কর্তব্য। বড়রা তো আর ছোেটর এঁটো সাফ করবে না! আবার সুবোধ যে প্রস্তাবটা করেছিল, যে যার নিজ নিজ থালা সাফ করে নেবার, তাতে রাজী হতেও চক্ষুলজ্জায় বাধে।

    অতএব প্ৰকাশের কষ্ট বেশি।

    ভাত সেদ্ধ এবং চুলো ধরানো ব্যাপারে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে নস্যাৎ করতে এসে নিজে নস্যাৎ হয়েছে। এখন সকলেই একযোগে রান্নাঘরে এসে হুটোেপাটি করে, প্ৰকাশকে আবার উঠোনেও নামতে হয়।

    ঘর, দালান, সিঁড়ি সাফ করার প্রশ্ন অবশ্য ওঠে না, মেয়েরা যাওয়া পর্যন্তই ও কাজটা বাদ। হরিদাসী তো আগেই গেছে। এঁটো থালাটা যে অমোঘ, অনিবাৰ্য! তাই চৌবাচ্চার পাড়ের উপর থালাটা বসিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাজাপর্ব সারতে সারতে প্ৰকাশ খিঁচিয়ে ওঠে, আমার হাতে যদি সংসারের ভার থাকতো, মাগীকে কেমন যেতে দিতাম দেখতে! উনি সুদ্ধ ছুটলেন মড়ক থেকে প্ৰাণ বাঁচাতে! বন্ড দামী প্ৰাণ! লোকসান গেলে পৃথিবী একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে!

    কথাটা সুবোধের কানে যেতে প্রতিবাদ করে উঠল সে, তা পৃথিবীর লোকসান না হোক, তার তো লোকসান রে বাপু। নিজের প্রাণ সকলেরই নিজের কাছে দামী। মড়কের ভয়ে কে না পালাচ্ছে!

    ও বাবা! দাদাও যে দেখছি ভাদরবৌয়ের চ্যােলা হচ্ছে। প্ৰকাশ হেসে ওঠে, বলি এই আমরা তো রয়েছি। দিব্যি জলজ্যান্ত বেঁচেও রয়েছি। হরিদাসীর চাইতেও কিছু আর অধম নই আমরা!

    আহা তা কেন? আমাদের যে প্রাণের মায়ার থেকে চাকরির মায়া অধিক, ওদের তা নয়। ওরা বলবে, আগে তো বাঁচি, তারপর দেখা যাবে কাজ! –

    আচ্ছা দেখে যেন। এলে কিন্তু আমার হাতে ওর শাস্তির ভার দিতে হবে তা বলে রাখছি। দেখি কেমন করে আবার ও এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোয়!

    সহসা কথায় ছেদ পড়াতে হয়।

    একটি বাজখাই গলা কৰ্ণ বিদারণ করে চেঁচিয়ে ওঠে, কার চৌকাঠ ডিঙানো বন্ধন হুকুম হচ্ছে রে? আমি তো এই ডিঙোলাম!

    আরো জগুদা নাকি?

    এরা বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।

    জগু সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আরে, তিনটে মদতে মিলে রান্নাশালে কী করা হচ্ছে?

    কী আবার করা হবে! প্ৰবোধ বীরত্বের গলায় বলে, রান্না করা হচ্ছে!

    রান্না! তোরা আবার রান্না শিখলি কবে রে?

    জগু হা-হা করে হেসে ওঠে আকাশ-ফাটানো গলায়, দেখি নি তো কখনো অন্দরমহলের ধারেকাছে! হ্যাঁ, সে বটে। আমি। রোধে রোধে হাড়পাকা। স্বৰ্গদপি গরীয়সীর অসুখ করলেই তো এই হতভাগার প্রমোশন! ওই ভয়ে জননী আমার রোগ অসুখ লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়ান। আমিও তেমনি ঘুঘু, মুখচোখের বেভাব দেখলেই তেড়ে আসি। নাড়ি দেখি, জিভ দেখি, দিব্যি দিই। শেষ অবধি গাল পাড়তে পাড়তে গিয়ে কথা মুড়ি দিয়ে শোয়।

    প্রভাস সকৌতুকে বলে, তা বেশ! রান্নায় ওস্তাদ তো—এখন তো স্বপাক চলছে? আচ্ছা! একদিন খেয়ে আসা যাবে তোমার হাতে।

    জগু চোখ কুঁচকে বলে, কেন, এখন স্বপাক কেন? বলতে নেই। ষষ্ঠীর কৃপায় বাছা এখন আছেন ভাল।

    আছেন!

    অর্থাৎ শ্যামাসুন্দরী এখনো এই মড়কের কলকাতায় বিরাজমান?

    এরা হৈ-চৈ করে ওঠে, মামী। এখেনেই আছেন নাকি? দেশের বাড়িতে চলে যান নি?

    দেশের বাড়িতে!

    জগু আর একবার আকাশ ফাটায়।

    দেশের জ্ঞাতিদের সঙ্গে যে মায়ের আমার একেবারে গলায় গলায়! বলেছিল একবার মানদা পিসি, আমি যাচ্ছি। বড়বৌ, যাবি তো চ। আমি সাফ বলে দিলাম, কেন? এই হতভাগা গরীবটাকে মাতৃহীন করতে সাধা? হাতে পেলে শ্যামাসুন্দরীকে জ্যান্ত রাখবে তোমরা? মেরে পুকুরপাড়ে গুঁজে রাখবে কিনা বিশ্বাস কি?

    সুবোধ আক্ষেপের গলায় বলে, ইস, তা তো জানি না। ওই মানদা মাসীই মাকে বলেছিল, আমি যাচ্ছি, বড় বৌকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তাই জানি। ইস, এমন জানলে মামীকে তো মায়ের সঙ্গে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতাম। তখন একেবারে ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি—

    জগু হেসে ওঠে, হ্যাঁ, যমের বাড়িকে ফাঁকি দেবার তালে কত লোক কত শালার বাড়িতেই ঠেলে উঠলো। শালার বাড়ি, বোনাইয়ের বাড়ি, মামার বাড়ি, পিসির বাড়ি, গুরু-বাড়ি, বলি যমের বাড়িটা কোন বাড়িটায় নেই বল দিকি? পালিয়ে প্ৰাণ বাঁচিয়ে যমের হাত এড়াবি? সে ব্যাটা পেয়াদা

    তা হলেও, এটা তোমার উচিত হয় নি জগুদা! বিপদ মেয়েছেলেকে নিয়েই! প্ৰভাস বলে, আমার এক মক্কেল নবদ্বীপেই যাচ্ছে কাল, মামীকে বরং তার সঙ্গে—

    ক্ষেপেছিস? জগু সতেজে বলে, যেখানে মা, সেখানে ছা, আমার হচ্ছে এই সাদা বাংলা। দুজনে দু ঠাঁই হই, আর যম ব্যাটা দূত পাঠক, তখন? হয় মা বেটি ছেলের হাতের আগুন পাবে না, নয় ছেলে ব্যাটা মরণকালে মায়ের পায়ের ধুলো পাবে না। রক্ষে করো। জগু শৰ্মা ওসব গোলমেলে কাণ্ডর মধ্যে নেই! মা আবার মেয়েছেলে। কী রে? জগজননীর অংশ না?

    তা বটে!

    পাগলা জগার কথায় চিরকালই সবাই হাসে। এখনও হাসলো। বলল, তা বটে!

    জগু এবার এগিয়ে এসে বলে, পাকশালের ভার তাহলে এখন তোদের ঘাড়ে? দেখি তো তিন মদীয় কী পঞ্চও-ব্যঞ্জন রোধেছিস!

    দুম দুম করে রান্নাঘরে ঢুকে আসে জণ্ড, এদের একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও। রান্নার পদ যা হচ্ছে কদিন, সে তো কহন্তব্য নয়। যা কিছু আনাজ-তরকারি সবই তো সেই ভাতসেদ্ধর সঙ্গে সেদ্ধ। তাতেই তেল, নুন, কাঁচালঙ্কা মেখে যায় হয়!

    আজ আবার ভাতের ফেন পড়ে রান্নাঘরের এক কিভূতকিমাকার অবস্থা। অন্যদিন তো খানিকটা জল ঢেলে দিয়ে ঘর ধোওয়া হয়। আজ যে কী হবে!

    সারা ঘরেও যেন ভাত ছড়াছড়ি।

    জণ্ড এসেই হৈ-হৈ করে ওঠে, কী ব্যাপার! এ যে একেবারে অন্নের বৃন্দাবন, শ্ৰীক্ষেত্রের মেলা! এত ভাত ছড়াছড়ি কেন?

    ও কিছু না, ওই ফেনটা ঝরাতে গিয়েই—

    হুঁ, তা তো দেখছি-ই-, জগু বলে, দৃশ্য দেখেই মালুম হচ্ছে সব। পিসি ঠাকুরুণটি যে আমার সভ্য করে ছেলে মানুষ করেছেন! আরে বাবা অনুচিন্তা সর্বত্ৰ! কখন কোথায় কী অবস্থায় পড়তে হয়! সঙ্গে স্ত্রীলোক না গেলে খেতে পাবি না?

    পাব না মানে? প্ৰভাস বীরদৰ্পে বলে, এই তো আজ সাতদিন ওরা কেউ নেই, খাচ্ছি না দুবেলা?

    হুঁ। যা খাচ্ছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সার দিকি, আমিই আজ তোদের ভালমন্দ দুটো রোধে খাইয়ে যাই। কাল থেকে দুবেলা ও বাড়ি গিয়ে খাবি, বুঝলি? এর আর নড়াচড় হয় না যেন।

    এরা অবশ্য দুটো ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সমস্বরে প্রবল প্ৰতিবাদ জানায়। আজ রোধে খাওয়ানো এবং কাল থেকে ওবাড়ি খাওয়া, দুটোর বিরুদ্ধেই।

    কিন্তু জগু তো ততক্ষণে উনুনের সামনে গুছিয়ে বসেছে।

    ভাতের মধ্যে থেকে তরিতরকারিগুলো বাছতে বাছতে বলে, এ ভাত তো দেখছি গরুর মুখে ধরে দিতে হবে। মানুষের ভোগ্য তো হয় নি। আর চারটি চাল বার করা, চড়িয়ে দিই। মাছ-টাছ এনেছিস, না কি আনিস নি? তা না এনেছিস, নাই হল। ভাল। বড়ি আছে? আমসি? শুকনো কুল? আছে নিশ্চয়। পিসি তো আমার অগোছালো নয়!

    ওরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে।

    আছে হয়তো জিনিসগুলো, কিন্তু কোথায় আছে কে জানে?

    জগু মেয়েলী ভঙ্গীতে বঁটিতে আলু ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, বুঝতে পেরেছি, জানিস না। যাক খুঁজে নেব। মাছ আনবি তো আন।

    যত সব মেয়েলী! প্রভাস হাত ধুয়ে এদিকে সরে এসে বলে, বসেছে দেখ! যেন একটা গিন্নী! মেয়েলী ব্যাটাছেলে আমার দু-চক্ষের বিষ!

    সুবোধ বলে, বাজারে মাছ-ই বা কোথা? মেছুনী জেলেনীরা আছে? সব ভেগেছে। তোমাদের বাজারে পাচ্ছি নাকি?

    আমাদের? আমাদের খুঁজছে কে? মাছ কি আমাদের লাগে?

    সে কী? তুমি খাও না?

    দূর, কবে ও পাট চুকিয়ে দিয়েছি!

    সুবোধ অবাক গলায় বলে, কেন? তোমার তো আর বোষ্টম মন্তর নয়, শাক্ত মন্তর। তবে মাছ খেতে বাধা?

    বাধা!

    জগু আগ্রহভরে বলে, বাধা কিসের? দুই মায়ে-পোয়ে থাকি, অত ঝামেলায় দরকার? মায়ের ঘাড়েই তো দু হেঁসেলের ভার পড়বে!

    তাই বলে তুমি মাছ খাবে না?

    তুমিটার ওপর জোর দেয় সুবোধ।

    জগু চালের থেকে ধান বাছতে বাছতে বলে, তা আমি ব্যাটাই বা কি এত তালেবর? এত বিধবা হবিষ্যি করছে—

    শোন কথা! সাধে আর তোমায় পাগল বলি জগুদা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা!

    জণ্ড জুৎ করে হাঁড়িটা উনুনে বসিয়ে দিয়ে সরে এসে উদাত্ত উত্তর দেয়, কিসের সঙ্গে কিসের মানে? মানুষের সঙ্গে মানুষের তুলনাই করছি। মেয়েছেলেরা চিরজন্ম হবিষ্যির উপর থাকতে পারে, ব্যাটাছেলেরা থাকতে পারে না! বলতে চাস ব্যাটাছেলেগুলো মেয়েছেলের অধম! হুঁ! কোনো বিষয়ে খাটো হতে রাজী নই, বুঝলি? নে, সর দিকি, দেখি পিসির কোথায় কি আছে! মাছ না আনিস বয়ে গেল, দেখবি এমন পোস্তচচ্চড়ি বানাবো, খেয়ে যে বয়েসে আছিস, সেই বয়েসেই থাকিবি। কই, শিলপাটাটা কই?

    খুঁজে-পেতে শিলটা এনে পেতে, তাকের উপরকার শিশি-কোটো, হাঁড়ি-মালসা উটকোতে থাকে জগু।

    পিসি ফিরে এসে তো আর এসব নেবে না, আগাগোড়া ধোবে, মাজবে। ছুত নাড়তে বাধা কি?

    মেয়েলী কাজে যে মেয়েদের থেকে একতিলও খাটো নয় জগু, তার প্রমাণ দেয়।

    এই সাতদিন পরে ওরা আজ রান্নার গন্ধ পায় এবং ঠিকমত শব্দও। রূপও দেখা যাচ্ছে, রসাস্বাদটার জন্যে রসনা উৎকণ্ঠিত!

    রোধেবেড়ে হাত ধুয়ে কোঁচায় মুছতে মুছতে দৃঢ় আদেশ দেয় জগু, ব্যস! কাল থেকে খবরদার আর হাঁড়ি নাড়বি না! ওখানে চলে যাবি—

    মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও সুবোধ বলে ওঠে, তাই কি হয়? চার-চারটে মানুষ মামীর ঘাড়ে চাপা—

    ঘাড়ে চাপা মানে? রাধেই, দুটো বেশি করে রাঁধবে, এই তো! কেন, মা কি আমার গতিরকুড়ে? প্যান প্যান করিস নে বাবা! হ্যাঁ, মামারবাড়ির আদর জুটবে এ আশা দেব না, ডাল-চচ্চড়ি-ভাত দুটো খাবি, ব্যস।

    ডাল-চচ্চড়ি!

    হায়, ডাল-চচ্চড়ি-ভোতই যে এদের কাছে এখন কী পরম পদার্থ তা জগু কি বুঝবে! চচ্চড়ি নামটা কানে আসা মাত্ৰই তো রোমাঞ্চ এসে গেছে!

    কোন বস্তুর যে কতটা মূল্য, তা বোধ করি তার অভাব না হলে বোঝা যায় না।

    এখন যেন মনে হচ্ছে, ভাত সেদ্ধ করা বা ডাল-চচ্চড়ি রাধাটা একেবারে তুচ্ছ নয়। মনে হচ্ছে মেয়েমানুষহীন বাড়ি শশানতুল্যই বটে।

    আজকের খাওয়াটি মন্দ হল না, কাল থেকে বাড়া ভাতের আশ্বাস, মনটা ভাল হবার কথা। কিন্তু প্ৰবোধের মনের মধ্যে পাগলা জগুর কথাগুলো যেন বিধিছিল।

    জগুদা আবার মানুষ?… জগুদার কথা আবার কথা! এই তো চিরদিনের মনোভাব, কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে লোকটা যা বলে খুব ভুল বলে না।

    কোন বাড়িতে যমের বাড়ি নেই?… যমের পেয়াদার হাত এড়িয়ে যাবে কোথায় মানুষ? … নিয়তির ওপর কথা নেই।… রাখে কেষ্ট মারে কে?

    প্ৰত্যেকটি কথাই হীরের টুকরোর মত দামী!

    যতক্ষণ খুন্তি নেড়েছে ততক্ষণ বকবক করেছে, কিন্তু কথাগুলো বলেছে মূল্যবান।

    বলছিল, আমার পিসির খুরে গড় করি। তোর যাবার কি দরকার ছিল শুনি, তোর যাবার কি দরকার ছিল? এখনও মৃত্যুভয়? মরে যাবি, ড্যাং ড্যাং করে চার ছেলের কাঁধে চড়ে কাশী মিত্তিরের ঘাটে চুল যাবি, চুকে গেলা যত দিন না মরিস ছেলেদের ভাতজল কর। তা নয়।

    ঠিক।

    ঠিক বলেছে জগুদা।

    মার যাওয়া উচিত হয় নি।

    মা অনায়াসে থাকতে পারতো।

    আর মা থাকলে, অনায়াসে একটা বৌকেও রাখা যেত। বলাই যেত, যাদের বাপের বাড়ি, মাসি-পিসির বাড়ি আছে তারা যাক; যার সেসব নেই, সে থাকবে। উপায় কি? রাখে কেষ্ট মারে কে?

    হায়, জগুদা যদি তখন একবার বেড়াতে আসতো, মাকে জ্ঞান দিত!

    বিপদের কথা কি বলা যায়!

    এই যে পুকুরের দেশে রেখে এল প্ৰবোধ ছেলে।পুলেকে, তাতে বিপদ হতে পারে না? যুক্তি ক্রমশই ভারী হতে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, সামনের রবিবারেই গিয়ে নিয়ে আসবে। আর এই তো বেশ দিব্যি ঠাণ্ডা! বলা হরি কদাচিৎ শোনা যাচ্ছে।

    তবে?

    তবে কেন প্ৰাণপাখীকে খাঁচার বাইরে বার করে বেড়াল-কুকুরের মুখে রেখে আসা?

    ভগবান জানেন ইত্যবসরেই থাবা বসিয়েছে কি না!

    মেয়েমানুষটির তো বুদ্ধি-সুদ্ধির বালাই নেই, স্বদেশী শুনেই গলেছেন। নিৰ্ঘাৎ এতদিনে দিব্য মাখামাখি চলছে!

    নিশ্চয়।

    তা। নইলে চিঠি দিল না একটা? অথচ নিজমুখে বলেছিল, চিঠি দিলে রাগটাগ করবে না তো?

    হ্যাঁ, প্ৰবোধের ফেরার সময় সেই কাঠ-কাঠি ভাবটা বদলে গিয়েছিল যেন সুবৰ্ণলতার। অনেকদিন আগের মত নরম আর হাসি-খুশি দেখিয়েছিল। নিচু হয়ে নমস্কার করে পায়ের ধুলো নিয়ে হেসে বলেছিল, হঠাৎ যদি মরেটরে যাই, মাপ চেয়ে রেখে দিলাম।

    প্ৰবোধের কি ইচ্ছে হচ্ছিল সেই বনবাদাড়ের মধ্যে ওই সুবৰ্ণলতাকে ফেলে রেখে চলে আসে। কিন্তু উপায় কি? না না, ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাই বললে পাগল বলবে না লোকে?

    তা ছাড়া বোন-ভগ্নীপতির পক্ষে রীতিমত অপমানও সেটা। অতএব প্ৰাণ রেখে দেহটা নিয়ে চলে আসা!

    ইচ্ছে হচ্ছিল একবার সাপটে ধরে আদর করে নেয়। কিন্তু ছেলেগুলো আশেপাশে ঘুরছে। তাই চোখে দীনতা ফুটিয়েই মনোভাব প্ৰকাশ।.

    চিঠি দিলে রাগ করবো?

    তা কি জানি, তোমাদের বাড়িতে ও রেওয়াজ আছে কি না! বিয়ে হয়ে এস্তক তোমাদের গলাতেই তো পড়ে আছি, চিঠি লেখা কাকে বলে জানিই না।

    এইবার জেনো।

    বলে-চলে এসেছিল প্ৰবোধ, ফিরে ফিরে তাকাতে তাকাতে।

    ঠিক যে অবিশ্বাসিনী হবে সে ভয় অবশ্য নেই। কিন্তু স্বভাবটাই যে পুরুষ-ঘেষা। যেখানে পরপুরুষ, সেখানেই চোখ কান খাঁড়া। আবার বলে কিনা, কান পেতে শুনি নতুন কথা কিছু বলছে কি না। … বলে, নাঃ, সই গঙ্গাজল পাতাবার শখ আমার নেই। কার সঙ্গে পাতাবো? কারুর সঙ্গে মনই মেলে না। রাতদিন আর ওই মেয়েলী গল্প শুনতে ইচ্ছে করে না।

    তা হলেই বোঝো!

    মেয়েমানুষ তুমি, তোমার মেয়েলী গল্পে অরুচি, কারো সঙ্গে তোমার মন মেলে না!

    তবে আর কি, একটা ব্যাটাছেলে খুঁজেই তবে মনের মানুষ পাতাও! বলেছিল প্ৰবোধ কতকটা রাগে, কতকটা ব্যঙ্গে।

    সই পাতানোর একটা ঢেউ এসেছিল তখন।

    সই গঙ্গাজল বাদেও নতুন নতুন সব আঙ্গিকে।

    সেজবৌ তার বাপের বাড়ির দিকের কার সঙ্গে ল্যাভেণ্ডার পাতিয়ে এল, ছোটবৌ এখানেরই পাশের বাড়ির বৌয়ের সঙ্গে পাতালো গোলাপপাতা!

    বিরাজ তার জায়ের বোনের সঙ্গে পাতিয়ে নিল বেলফুল, এমন কি মুক্তকেশী পর্যন্ত এই বুড়ো বয়সে মকর সংক্রান্তিতে সাগরে গিয়ে দু-দুটো গিন্নীর সঙ্গে সাগর আর মকর পাতিয়ে এলেন।

    বিধবার পাতাপাতিতে তো খরচ বেশি নেই।

    মাছ নয়, মিষ্টি নয়, পান-সুপুরি নয়, শাড়ি নয়, শুধু পাঁচখানা বাতাসা আর কাঁচা সুপুরি হাতে দিয়ে সূর্য সাক্ষী করে চিরবন্ধনের প্রতিজ্ঞা!

    সধবাদের খরচ বেশী।

    তা সধবারা সাধ্যমত করেছে।

    শাড়ি সিঁদুর, পান মিষ্টি!

    কিন্তু সুবৰ্ণ কারুর সঙ্গে কিছুই পাতালো না। হেসে বললো, বন্ধুত্ব যদি হয়। কারো সঙ্গে এমনিই হবে। পূজো পাঠ করে না করলে হবে না! ওতে আমার রুচি নেই।

    ওরা আড়ালে বলেছিল, তা নয়, কাউকে তুমি যুগ্য মনে কর না, তাই!

    সুবৰ্ণর বরও রাগে ব্যঙ্গে বললো, তবে আর কি, মেয়েমানুষে যখন রুচি নেই, তখন একটা ব্যাটাছেলে খুঁজে মনের মানুষ পাতাও?

    সুবৰ্ণর চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল। সুবৰ্ণ মাথা দুলিয়ে প্ৰবোধের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া একটি ভঙ্গী করে বলেছিল, তা বলেছ মন্দ নয়! তেমনি যদি কাউকে পাই তো বন্দেমাতরম পাতাই।

    বন্দেমাতরম!

    এতদিন পরে হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল প্ৰবোধের।

    ঘটে যায় নি তো সেই ঘটনা?

    পাতানো হয়ে যায় নি তো?

    কে বলতে পারে মনের মানুষ জুটে বসে আছে কিনা?

    নাঃ, রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করার হেতু নেই। কাল-পরশুই চলে যাওয়া যাক। কাল হবে না, বেম্পতিবার। পরশু-পরশুই!

    আর দ্বিধা নয়।

    সুবৰ্ণর সেই কৌতুকের ভঙ্গীটা মনে পড়ে গেল।

    সে ভঙ্গী যেন ভুলেই গেছে সুবৰ্ণর!

    অথচ কী হাসিখুশিই ছিল আগে! সেই ছোটবেলায়!

    মাঝে মাঝে ক্ষেপতো বটে, কিন্তু স্বভাবটা কৌতুকপ্ৰিয়ই তো ছিল। এবং অত হাসিখুশি অত রঙ্গরস দেখলে বিরক্তিই ধরতো প্ৰবোধের, মাঝে মাঝে তো রাগে মাথার রক্ত আগুন হয়ে উঠত। তার জন্যে শাসনও করেছে কত!

    সেই একবার প্রকাশের ফুলশয্যায় আড়িপাতা নিয়ে? শাসনের মাত্রাটি বড় বেশিই হয়ে গিয়েছিল সেদিন! তা রাগটা যে প্ৰবোধের বেশি, সে তো প্ৰবোধ অস্বীকার করে না। মাপও তো চায় তারপর।

    কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে সামলাতে পারে না নিজেকে। বিশেষ করে ওকে পুরুষদের কাছাকাছি দেখলেই। বিরাজের ছোট দ্যাওরটা বুঝি প্রকাশের বন্ধু। সেটাও জুটেছিল সোহাগের মেজবৌদির সঙ্গে।

    আর করেও ছিল তেমনি কাণ্ড!

    রান্নাঘরের ছাতের আলসে ডিঙিয়ে কার্নিশ বেয়ে ঘুরে চলে গিয়েছিল। ফুলশয্যায় ঘরের জানলায়। তার সঙ্গে সেই ছোঁড়া। একটু ঠেলাঠেলি হলেই স্রেফ নিচের গলিতে।

    আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে গেল ঠিক প্ৰবোধেরই। কোথা থেকে? না পাশের বাড়ির ছাত থেকে—যাদের ছাতে হোগলা দিয়ে লোকজন খাওয়ানো হয়েছে। অবশেষে প্ৰবোধ তদারক করছিল বাসনপত্র কিছু পড়ে আছে কি না। হঠাৎ গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।

    ওটা কী ব্যাপার?

    ওরা কে ওখানে? সুবর্ণ? আর ও?

    পরবর্তী ঘটনাটা একটু শোচনীয়ই।

    প্ৰহারটা বড় বেশী হয়ে গিয়েছিল।

    এতদিন পরে সেই কথাটা মনে পড়ে মনটা কেমন টনাটনিয়ে উঠল প্ৰবোধচন্দ্রের। অতটা না করলেও হত! ছোঁড়াটা তো সেই বোকা হাবা গদাই! গোঁফই বেরিয়েছিল, পুরুষ নামের অযোগ্য। আর তা নইলে প্রকাশটার বন্ধু হয়?

    আশ্চৰ্য, ওই হাবাটাকে মানুষ বলে মান্য দিত সুবর্ণ।

    সুবৰ্ণর মুখের হাসি তো প্ৰবোধের চিরকাম্য, কিন্তু ঘরের বাইরে কোথাও সেই হাসি দেখলেই যে কেন মাথায় রক্ত চড়ে যায়!

    জায়ে জায়ে কথা কইতেও হয়তো কখনো হেসে উঠল, আমনি মনটা বোজার হয়ে গেল প্ৰবোধের। আমার এ রোগটা সারাতে হবে, মনে মনে ঠিক করে প্রবোধ। সুবর্ণর স্বভাবটা হয়তো ওতেই ক্রমশ এত কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নইলে এমন তো ছিল না!

    চোখের আড়ালে থাকায় সুবর্ণর দোষগুলো নিষ্প্রভ আর গুণগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে, সুবৰ্ণর মনে আপন-পর নেই। সুবর্ণ যদি সাবান কাচে তো বাড়িসুদ্ধ সবাইয়ের বিছানার ওয়াড় খুলে এনে ফর্সা করে। সুবৰ্ণ যদি জুতো সাফ করে তো সকলের জুতোয় কালি লাগাতে বসে।… ছেলেকে একটা জিনিসের বায়না করলে, বাড়ির সব কটা ছেলেমেয়েকে দিয়ে তবে নিজের ছেলেকে দেয়। এসব সদগুণ বৈকি!

    কাৰ্যকালে প্ৰবোধ আদৌ এগুলোকে সদগুণ বলে না, বরং বাড়াবাড়ি বলেই অভিহিত করে। কিন্তু এখন বোধ করি হঠাৎ নিজের মধ্যেই সদগুণের উদয় হওয়ায়, সুবর্ণর ওই গুণগুলোকে সদগুণ স্বলে মনে হচেছ তার!

     

    পিয়ন এ বাড়িতে দৈবাৎ আসে।

    সুরাজ চিঠি দেয় মাঝে মাঝে, এইটাই প্রধান, আর সবই কালে-কস্মিনের ব্যাপার।

    তথাপি পাড়ায় তার আমার একটা টাইম আছে।

    সেই টাইমে দাঁড়িয়ে থাকে প্ৰবোধ রাস্তায়।

    কিন্তু কোথায়?

    সুবৰ্ণর সেই মুক্তোর মত সাজানো অক্ষরে লেখা ঠিকানার চিঠি কোথায়?

    তার উপর ভয়ানক কষ্ট হল, বুকে হাতুড়ীর ঘা পড়ল, প্রকাশের নামে এক খামের চিঠি আসা দেখে। আঁকা-বাঁকা অপটু অক্ষর। বাড়ির মালিকের নামে লিখেছে ক্যায়ার অব সুবোধচন্দ্র মুখোপাধ্যায়!

    তবু চিঠি তো! বৌয়ের চিঠি!

    প্ৰকাশের এ ভাগ্য হল।

    অথচ প্ৰবোধের হল না।

    যার বৌ রাতদিন খাতায় গান তুলছে, ছেলেদের হাতের লেখা মক্স করাচ্ছে। হাতের লেখা দেখলে কে বলবে মেয়েমানুষের লেখা।

    ছোট ভাই। ভাবতে লাজ।

    তবু বুকের মধ্যে ঈর্ষার জ্বালা অনুভব করে প্রবোধ।

    প্ৰকাশের চিঠিটা যে তার হাতেই এসে পড়লো!

    ছোট ভাইকে তো আর হাতে হাতে দেওয়া যায় না, ওর ঘরে রেখে এসে ডেকে বলে দিল, ওরে পোকা, তোর নামে বোধ হয় একটা চিঠি এসেছে।

    মামীর কাছে খাচ্ছে কাল থেকে, কোজ নেই কিছু, কাজেই শূন্য প্ৰাণ আরও শূন্য লাগে। তাসের আজড়াও এই হুজুগে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। জমছে না তেমন।

    ঘরে বৌ না থাকলে কোনো কিছুতেই জুত্ হয় না। কারুরই না।

    তাকে দেখি বা না দেখি, তবু থাকুক।

    এই হচ্ছে কথা!

    প্ৰবোধ সংকল্পে দৃঢ় হল!

    কালই যাত্ৰা!

    বিনি খবরেই যাবে! গিয়ে বলবে, চিঠিপত্র নেই, এদিকে হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে-

    এখানে?

    এখানে বলবার কথাও ঠিক করে ফেলেছে। বলবে, মামীর ঘাড়ে আর কতদিন খাওয়া যায়? ওদিকে বোনাই-বাড়িতেই বা কতদিন স্ত্রী-পুত্র রাখা যায়?

    কিন্তু কী দেখব গিয়ে?

    আনন্দ আর আতঙ্ক এই দুয়ের তাড়নায় ছটফটিয়ে বেড়ায় প্ৰবোধ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }