Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প627 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২.০৭ একই দিনে মা-বাপ হারালাম

    সুবৰ্ণলতা বলেছিল, মনে জানবো একই দিনে মা-বাপ হারালাম আমি!

    কিন্তু মা-বাপ কি ছিল সুবর্ণর? তাই হারানোর প্রশ্ন?

    কবে ছিল?

    কবে পেয়েছে সেই থাকার প্রমাণ?

    তবে?

    যে বস্তু ছিল না, তার আর হারাবার প্রশ্ন কোথায়?

    তবু নির্বোধ সুবৰ্ণলতা অসীম নক্ষত্রে ভরা আকাশের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে একটি নতুন নক্ষত্রের সন্ধান করতে করতে সেই বলে-আসা কথাটাই আবার মনে মনে উচ্চারণ করে, একই দিনে মা-বাপ দুই-ই হারালাম আমি!

    কোনো এক নতুন নক্ষত্র কি শুনতে পাবে সে কথা? আর শুনতে পেয়ে হেসে উঠবে? বলবে, যা ছিল না। তাই নিয়ে হারানোর দুঃখ ভোগ করতে বসলি তুই? ছি, ছি!

    সুবৰ্ণলতা সে হাসি সে কথা শুনতে পাবে না হয়তো। তাই সুবৰ্ণলতা ওই আকাশটা থেকে চোখ সরাতে পারছে না।

    এ বাড়িতে আকাশ আছে।

    সুবৰ্ণলতার এই গোলাপী-রঙা দোতলায়। কারণ এ বাড়িতে আছে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। আছে দক্ষিণের বারান্দা। যে বারান্দায় বাতাসের অফুরন্ত দাক্ষিণ্য, যে ছাদে অন্তহীন অন্ধকারের নিবিড় গভীর প্রগাঢ় প্রশান্তি।

    ছাদেই তো মুক্তি!

    এখানে—উধৰ্ব্বসীমায় স্থির হয়ে আছে সেই অসংখ্য নক্ষত্রের মালা-পরানো নির্মল আকাশ।

    সুবৰ্ণলতার কি তবে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত নয়? যদি না দেয় তো সুবর্ণ অকৃতজ্ঞ।

    কিন্তু সুবর্ণ অকৃতজ্ঞ নয়।

    তাই সে যখন সেই অন্তহীন অন্ধকারের মাঝখানে উঠে এসে দাঁড়ায়, তার হৃদয়ের শান্ত ধন্যবাদ উঠে আসে একটি গভীর নিঃশ্বাসের অন্তরাল থেকে।

    এখানে ছাদে উঠে আসতে পারে সুবৰ্ণলতা।

    আর সেটা পারে বলেই দুদণ্ডের জন্যেও অন্তত ভুলে থাকতে পারে—সুবৰ্ণলতা নামের মানুষটা হচ্ছে একটা কর্মে উত্তাল আর শব্দে মুখর স্কুল আর ক্ষুদ্র সংসারের গৃহিণী। ভুলে থাকতে পারে, সেই সংসার তার স্থূলতা আর ক্ষুদ্রতা নিয়ে অহরহ সুবৰ্ণলতাকে ডাক। তার দায় এড়াবার উপায় নেই সুবৰ্ণলতার।

    তবু আজ বোধ হয়। আর কেউ ডাক দিতে আসবে না।

    আজ সুবৰ্ণলতাকে বোধ হয় কিছু কিঞ্চিৎ সমীহ করবে। সুবৰ্ণলতার ছেলেমেয়েরা।

    ডাক দেবে না, অতএব সুবৰ্ণলতা স্তব্ধ হয়ে বসে মনে ভাবতে পারে, মা ছিল তার! রাজরাজেশ্বরী মা!

    ছিল সুবৰ্ণর সমস্ত চেতনার মধ্যে, সমস্ত ব্যাকুলতার মধ্যে, সমস্ত অনুভবের মধ্যে। মূর্খ সুবর্ণলতার শুধু একটা মূঢ় অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে সিএ ম্যের দিক থেকে।

    নইলে একবার কি সবদিকের সব মান-অভিমান ধুলোয় বিকিয়ে দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়া যেত না? বলা যেত না, মা, তোমায় একবার দেখবার জন্যে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল তাই চলে এলাম!

    সুবৰ্ণ তা করে নি।

    সুবৰ্ণ তার অভিমানকেই বড় করেছে। সুবৰ্ণ ভেবেছে, মা তো কই একবারও ডাক দেন নি।

    সুবৰ্ণ ভেবেছে, স্বামীর কাছে হেঁট হব না আমি!

    তাই সুবর্ণর মা ছিল না!

    এখন সুবৰ্ণলতা সব মান-অভিমান ধুলায় লুটিয়ে দিলেও আছড়ে পড়ে বলতে পারবে না সেই

    কথাটি।

    মা, তোমাকে একবার দেখবার জন্যে মরে যাচ্ছিলাম আমি।

    কিন্তু অভিমান কি দূর হয়?

    এখনো তো বাপের উপর একটা দুরন্ত অভিমানে পাথর হয়ে আছে সুবর্ণ। সেই পাথর যদি ফেটে পড়তো তো, হয়তো কপাল কুটে চীৎকার করে উঠতো, কেন? কেন তোমরা সবাই মিলে আমাকে ঠকাবে? কেন এমন করে নিষ্ঠুরতা করবে। আমার সঙ্গে? কী ক্ষতি হতো। যদি তোমার সুবৰ্ণলতার মায়ের চিঠিটা সুবৰ্ণলতাকে চুপি চুপি পাঠিয়ে দিতে?

    যদি বলতে, সুবৰ্ণ রে, তোর মা বলছে, সে মরে না গেলে চিঠিটা না দিতে, কিন্তু আমি পারলাম না। অত নিষ্ঠুর হতে, আমি দিয়ে গেলাম তোকে। এখন তুই বোঝ, খুলবি কি খুলবি না!

    সুবৰ্ণ বুঝতো!

    কিন্তু সুবৰ্ণর বাবা তা করেন নি!

    আর সুবর্ণর মা তার চিঠির জবাব চায় না বলে গেছে—আমি মরলে তবে দিও সুবৰ্ণকে!

    কী দরকার ছিল এই মুষ্টিভিক্ষায়?

    সারা শরীর তোলপাড়-করা একটা প্ৰবল বাম্পোচ্ছাস যেন সেই পাথরকে ভাঙতে চাইছে।

    হাতের মুঠোর মধ্যে বন্ধ রয়েছে সেই মুষ্টিভিক্ষার নমুনাটুকু।

    বন্ধ খাম বন্ধই রয়েছে।

    সুবৰ্ণলতা খুলবে না ও খাম, দেখবে না। কী লেখা আছে ওতে।

    নিরুচ্চার থাক সুবৰ্ণলতার নিষ্ঠুর মায়ের নিষ্ঠুরতার নমুনাটা।

    মাকে যদি দিয়েও যদি এত বড় জীবনটা কেটে গিয়ে থাকে সুবর্ণর তো বাকী জীবনটাও যাবে।

    সুবৰ্ণলতা ভাবুক, যে বস্তু ছিল না, তার আবার হারানো কি? সুবৰ্ণলতার মা নেই, মা ছিল না।

    কিন্তু সত্যই কি ছিল না?

    কোনোদিনই না?

    সুবৰ্ণলতার জীবনের নটা বছর একেবারে নয় হয়ে যাবে?

    সুবৰ্ণলতার সেই নবছরের জীবনের সমস্ত জীবনাকাশ জুড়ে নেই একখানি অনির্বাণ জ্যোতি? সেই জ্যোতির পরিমণ্ডলে ও কার মুখ?

    সুবৰ্ণলতার মায়ের মুখ কি ভুলে গেছে সুবৰ্ণ?

    সুবৰ্ণর জীবন-আকাশের সেই জ্যোতি চিরতরে মুছে গেছে? মুছেই যদি গেছে তো সুবৰ্ণলতা কোন আলোতে দেখতে পাচ্ছে ওই ফ্রক-পরা ছোট মেয়েটাকে?

    যে মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরেই হাতের বইখাতা নামিয়ে রেখে দুদ্দাড়িয়ে ছুটে এগিয়ে গেছে তার মায়ের কাছে দু হাত বাড়িয়ে?

    মা! মা! মা!

    মা অবশ্য হাঁ-হাঁ করে উঠেছে, ছুসনে, ছুসনে, ইস্কুলের জামাকাপড়-

    কিন্তু মায়ের চোখের কোণে প্রশ্রয়, মায়ের ঠোঁটের কোণে হাসি।

    আর শোনে কেউ তাঁর মিথ্যে নিষেধের সাজানো বুলি! জড়িয়ে না ধরে ছাড়ে?

    অন্ধকার, নিঃসীম অন্ধকার। এই অন্ধকারের সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে বুঝি ঐ ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে সুবৰ্ণ।

    কিন্তু ওই অতল অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টি তেমন চলে না। শুধু শব্দতরঙ্গ পড়ে আছড়ে আছড়ে।

    সেই তরঙ্গে তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছে সুবর্ণ।

    শব্দ, শব্দ!

    স্মৃতির কোটোয় ভরা বুঝি স্তরে স্তরে? আজকের ধাক্কা লেগে তারা উঠে আসছে, ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন করে ধ্বনিত হচ্ছে।

    প্রথম ভোরে যে শব্দটা সেই ছোট মেয়েটার ঘুমের শেষ রেশকে সচকিত করে ধাক্কা দিয়ে যেত, সে হচ্ছে হাড়-পাজরা বার করা ঘোড়ায় টানা ময়লা-গাড়ির বানাৎ বানাৎ শব্দ।

    অবিশ্বাস্য একটা জঞ্জালের স্তূপ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। আর শব্দ উঠছে ঝন-ঝন-ঝনাৎ। সেই শব্দের সঙ্গে আর এক শব্দ, সুবর্ণ এবার উঠে পড়া। সুবর্ণ অবশ্যই এক কথায় উঠে পড়তো না, তখন একটু মৃদু ধমক। কিন্তু সেই ধমকের অন্তরালে যেন প্রশ্রয়ের মাধুর্য। সুবৰ্ণ উঠে পড়তো, আর শব্দ শুনতে পেতো মায়ের রান্নাঘরের বাসনপত্র নাড়ার শব্দ। সেই শব্দের মধ্যে মা মাখানো। দুপুরের নির্জনতায় আর একটা শব্দ উঠতো, ঠেং ঠং ঠং! বাসনওলা চলেছে চড়া রোদ্দুরে, তার মাথার ওপর। বাসনের ঝাঁকা, আর হাতে একটা কাসির সঙ্গে একটুকরো কাঠ। সেই কাঠটুকুতেই কাসির গা থেকে শব্দ উঠছে— ঠং, ঠং, ঠং!

    সেই শব্দ–

    দুপুরের নির্জনতায় যেন একটা শিহরণ জাগিয়ে দিয়ে যেত। মনটা হু-হু করে উঠতো। শেলেট পেনসিল রেখে মায়ের কাছে গিয়ে গা ঘেষে। বসতে ইচ্ছে করতো।

    মা বলতো, কি হল? লিখতে লিখতে উঠে এলি যে?

    মেয়েটা মায়ের গা ঘেষে বসে বলতো, এমনি।

    মা মেয়েটার ঝুমরো চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে স্নেহভরা গলায় বলতো, এমনি মানে? এমনি কিছু হয় নাকি?

    মেয়েটা মায়ের গালে গাল ঘষে ঘষে বলতো, হয়, হয়! এই তো হলো!

    তখন যদি দুপুরের সেই নির্জনতা ভেদ করে আবার হাঁকি উঠতো, ট্যাপারি, টোপাকুল, নারকুলে কু-ল!

    অথবা হাঁক উঠতো—চীনের সিঁদুর! চাই চীনে-র সিঁদুর- কিছুই এসে যেত না মেয়েটার।

    বুক গুরগুর করে উঠতো না, গা ছমছম করে উঠতো না। যেন সব ভয় জয়ের ওষুধ মজুত আছে ঐ মিষ্টি গন্ধেভরা গা-টার মধ্যে!

    কিসের সেই মিষ্টি গন্ধ?

    চুলের? শাড়ির? না শুধু মাতৃহৃদয়ের?

    শব্দ উঠতো—

    বেলোয়ারি চুড়ি চাই, কাচের পুতুল খেলনা চাই! সাবান, তরল আলতা চাই! শব্দ উঠতো, পাংখা বরো।–ফ! পাংখা বরো-ফ!

    তখন আর ভয় নয়, আহ্লাদ।

    আহ্লাদ, আগ্রহ, উৎসাহ।

    শুনতে পেলেই জানালার কাছে ছুটে যেত মেয়েটা, তারপর সরে এসে উতলা গলায় বলতো, মা, মাগো।

    মা হেসে হেসে বলতো, ভারী যে আদর দেখছি! কী চাই শুনি?

    কাচের পুতুল একটা—

    আর পুতুল কি হবে রে? কত রয়েছে—

    মেয়েটা তীক্ষ্ণ গলায় বলতো, বা রে, আমার বুঝি কচি পুতুল আছে?

    অতএব কচি পুতুল!

    অথবা বরফ! পাংখা বরফ! তখন মা বলতো, দূর, দূর, ও বরফ বিচ্ছিরি জলে তৈরি হয়। ওসব কি খায় মানুষে?

    খায় না তো বিক্রি করে কেন? পরনে খাটো ফ্রক থাকলেও তর্কে খাটো ছিল না মেয়েটা। বলতো, খায় না তো বিক্রি করে কেন?

    মা পয়সা বার করতো আর বলতো, বিক্রি তো সাপের বিষও করে। খাবি তাই?

    বলতো, আবার পয়সা দিতো।

    বলতে, শুধু আজ, আর নয় কিন্তু।

    তাই, তাই, তাতেই সই।

    নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক। আর একদিনের কথা পরে ভাবা যাবে।

    এক-একদিন আবার মা বকতো।

    বলতো, কেবল কেবল পড়া ফেলে উঠে আসিস কেন বল তো? মন নেই কেন পড়ায়?

    মেয়েটা বলে ফেললেই পারতো ভরদুপুরে ওইরকম শব্দ শুনলে ভয় করে আমার। বললে অনেক কিছু সোজা হয়ে যেত। কিন্তু মেয়েটা তা বলতো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো।

    মা বলতো, যাও, হাতের লেখা করে ফেল গে।

    মেয়েটা আস্তে আস্তে চলে যেত।

    আর সময় মিনিট গুনতো কখন রাত্তির আসবে। রাত্তিরে তো আর মা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলতে পারবে না, যাও পড় গে!

    রাত্তিরে মায়ের বুকের কাছে ঘোষটে শুয়ে গায়ের ওপর হাত রেখে পরম সুখময় একটু আবেশ নিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া!

    ছোট সেই মেয়েটার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে থাকে সুবৰ্ণলতা। তার মায়ের কাছে বসে চুল বাঁধে, ভাত খায়, পড়া মুখস্থ করে। বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে স্কুলে যায়।

    যায় দুর্গাপূজার প্রতিমা দেখতে। যেখানে যায় তার নামগুলো যেন ভেসে ভেসে উঠছে চালচিত্ৰঘেরা জগজ্জননী মূর্তির ধারে ধারে।

    রাণী রাসমণির বাড়ি, শোভাবাজারের রাজবাড়ি, শ্যামবাজারের মিত্তির বাড়ি।… কোথায় যেন নাগরদোলা চড়ে আসে, কোথায় যেন সঙের পুতুল দেখে।

    তারপর ব্যথা-করা পা নিয়ে বাড়ি ফিরে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে, মা, মাগো, কতো ঠাকুর দেখেছি জানো? পাঁ-চ-খান!

    মা হেসে বলতো, ঠাকুর তো দেখেছিস? নমস্কার করেছিস?

    আহা রে নমস্কার করবো না? আমি যেন পাগল!

    মা ওর কপালের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলতো, করেছিস তাহলে? নমস্কার করে কি বর চাইলি?

    বর? এই যাঃ, কিছু চাই নি তো?

    মা হেসে ফেলতো।

    চাস নি? তা ভালোই করেছিস! না চাওয়াই ভালো। তবে এইটুকু চাইতে হয়, মা, আমার যেন বিদ্যে হয়!

    বিদ্যে!

    বিদ্যে!

    উঠতে বসতে মা ওই কথাই বলতো।

    বিদ্যেই হচ্ছে আসল, বুঝলি? মেয়েমানুষের বিদ্যে-সাধ্যি নেই বলেই তাদের এত দুৰ্দশা!. তাই তাদের সবাই হেনস্থ করে। আর যে-সব মেয়েমানুষরা বিদ্যে করেছে, করতে পেরেছে, বিদুষী হয়েছে?… কত গৌরব তাদের-কত মান্য। সেই মান্য, সেই গৌরব তোরও হবে।

     

    সুবৰ্ণলতার সর্বশরীরে প্রবল একটা আলোড়ন ওঠে।

    সুবৰ্ণলতা ছাদে ধুলোর ওপর শুয়ে পড়ে মুখটা ঘষটে বলে, শেষরক্ষা করতে পারনি মা! শুধু তোমার দেওয়া সেই মন্ত্রের দাহে সারাজীবন জর্জরিত হয়েছে তোমার সুবর্ণ!

    অনেক চোখের জল ফেলে ফেলে দুঃসহ যন্ত্রণাটা স্তিমিত হয়ে আসে। সুবৰ্ণলতা আবার এখন তাই দেখতে পায়। শব্দের তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে দৃশ্যের ঘাটে এসে ঠেক খায়।

    তাই সুবৰ্ণলতা দেখতে পায়, সুবৰ্ণলতার মা রান্নাঘরে বসে রাঁধছে, মা ছাদে উঠে কাপড় শুকোতে দিচ্ছে, মা ঝেড়ে ঝেড়ে বিছানা পাতিছে!… মা মাটিতে আরশি রেখে চুল বাধছে!

    ধবধবে মুখখানি ঘিরে একরাশ কালো পশমের মত চুলের রাশি! কপালে ঘষে-যাওয়া সিঁদুরটিপের আভাস!

    প্রাণভরা, বুকভরা, চোখভরা!

    আশ্চর্য!

    এতখানি মা ছিল সুবর্ণর, আর সুবর্ণ কিনা তুচ্ছ একটু অভিমান নিয়ে নিজেকে ঘিরে প্রাচীর তুলে রেখে বসেছিল।

    ঠিক হয়েছে সুবর্ণ, তোর উপর্যুক্ত শাস্তিই হয়েছে! মা একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে সুবৰ্ণকে, তাও আদেশ দিয়ে গেছে, আমি মরে গেলে তবে দিও।

    এ ছাড়া আর কি হবে তোর?

    অভিমান আর আত্মধিক্কার এরা দুজন যেন ঠেলা ঠেলি করে নিজের শিকড় পুঁততে চায়।

    আর শেষ পর্যন্ত আত্মধিক্কারই বুঝি জয়ী হয়।

    মা, মাগো, এই নির্মায়িক লোকটার পায়ে ধরেও কেন একবার দেখতে গেলাম না তোমায়? এখন যে আমার জীবনের সব গান থেমে গেল, সব আলো মুছে গেল!

    টের পাই নি আমার জীবনের অন্তরালে তুমি ছিলে আলো হয়ে, গান হয়ে। যেন আমার একটা বিরাট ঐশ্বৰ্য নিজের লোহার সিন্দুকে ভরা ছিল। মনে হতো, ইচ্ছেমত ওটাকে খুলবো। আমি। খুললেই দেখতে পাবো!

    বুঝতে পারি নি, হঠাৎ একদিন দেখবো শূন্য হয়ে গেছে সে সিন্দুক!… কেবল অন্যের দোেষই দেখেছি আমি, আর অভিমানে পাথর হয়েছি। নিজের দোষ দেখি নি। মা না হয় দূরে ছিল আমার,

    বাবা?? বাৰীক অপরাধী করে রেখে ভাগ করেছিলাম আমি। আজও ভাগ করে এলাম। জীবন্ত মানুষটার মুখের ওপর বলে এলাম, মনে জানবো। আমি মা-বাপ দুই-ই হারিয়েছি।

    আমি কি!

    আমি কি গো!

    শুধু কঠোর কঠিন!

    সারাটা জীবন শুধু সেই কাঠিন্যের তপস্যাই করলাম! আমার ছেলেমেয়েরা কি অনেকদিন পরে ভাবতে বসবে মায়ের কাছে এলেই কিসের সেই সৌরভ পেতাম? চুলের? না শুধু মাতৃহৃদয়ের?

    কিন্তু সুবৰ্ণলতা কবে কখন সময় পেয়েছে সেই স্নেহ-সৌরভো কোমল হতে? সুবৰ্ণলতাকে যে অবিরাম যুদ্ধ করে আসতে হচ্ছে। সুবৰ্ণলতা যদি কোমল হতো, মুক্তকেশীর সংসার থেকে মুক্তি পেত কোনোদিন? পেত না। মুক্তকেশীর ছেলে গ্রাস করে রেখে দিত তাকে। তার ইচ্ছায় উঠতে বসতে হতো, তার চোখরাঙানিতে জড়সড় হয়ে যেতে হতো, আর তার লুব্ধ ইচ্ছার দাসীত্ব করতে করতে আত্মাকে বিকিয়ে দিতে হতো!

    কিন্তু আজো কি আছে সেই আত্মা?

    বিকিয়ে যেতে দেব না পণ করে যুদ্ধ করতে করতে ধ্বংস হয়ে যায় নি?

    সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া আত্মাকে কি আৰান্ন গড়ে তুলতে পারা যায়?

    চেষ্টায়, যত্নে, সাধনায়?

    হয় না!

    হতে পারে না!

    সুবৰ্ণ বলে ওঠে, অসুরের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হলে দেবীকেও চামুণ্ডা হতে হয়। বীণাবাদিনী সরস্বতীর, কড়ির ঝাঁপি হাতে লক্ষ্মীর সাধ্য নেই। সে ভূমিকা পালনের।

    সুবৰ্ণলতা কি তবে লড়াই থেকে অব্যাহতি নেবে এবার? তার সংসারকে নিজের ইচ্ছেয় চলতে হবে?

    নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একান্তে বসে ধ্বংস-আত্মার ইতিহাস লিখবে বসে বসে? লিখে রাখবে?

    লিখে রাখবে—শুধু একজন সুবৰ্ণলতাই নয়, এমন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সুবৰ্ণলতা এমনি করে দিনে দিনে তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে? কেউ লড়াই করে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে কেউ ভীরুতায় অথবা সংসারের শান্তির আশায় আপন সত্তাকে বিকিয়ে দিয়ে পুরুষসমাজের ইচ্ছের পুতুল হয়ে বসে আছে।

    আগে আমি ওদের অবজ্ঞা করতাম— সুবৰ্ণলতা ভাবে, যারা লড়াইয়ের পথ ধরে নি, নির্বিচারে বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছে। এখন আর অবজ্ঞা করি না তাদের। বুঝতে পারি, এদের লড়াইয়ের শক্তি নেই, তাই নিরুপায় হয়ে ঐ দ্বিতীয় পথটা বেছে নিয়েছে। ওদের অনুভূতি নেই, ওরা ওতেই খুশি,–এ কথা আমাদের ভাবা ভুল হয়েছে।

    সত্তার বদলে শান্তি কিনেছে। ওরা, আত্মার বদলে আশ্রয়। কারণ এ ছাড়া আর উপায় নেই ওদের!

    সমাজ ওদের সহায় নয়, অভিভাবকরা ওদের অনুকুল নয়, প্রকৃতি পর্যন্ত ওদের প্রতিপক্ষ! ওরা অন্ধকারের জীব!

    খামে বন্ধ চিঠিটা একবার হাত নিয়ে অনুভব করলো সুবৰ্ণলতা। এই নিঃসীম অন্ধকারে বসে যদি পড়া যেত!

    যদি দিনের আলোয় কি দীপের আলোয় এমন একটু নিঃসীম নির্জনতাও পেত সুবর্ণ, হয়তো খুলে ফেলতো। রুদ্ধ কপাট। বিহ্বল দৃষ্টি মেলে দেখতো কোন কথা দিয়ে গেছে তাকে তার মা।

    কিন্তু কোথায় সেই নির্জনতা?

    চারিদিকে চোখ।

    বিদ্রূপে অথবা কৌতুকে, কৌতূহলে অথবা অনুসন্ধিৎসায় যে চোখেরা সর্বদা প্রখর হয়ে আছে। কত বেশি চোখ পৃথিবীতে! সুবৰ্ণলতার এই নিজের গোলাপী-রঙা দোতলাটাতেও এতে বেশী লোক ওমে উঠেছে? এত বেশী চোখ? অথচ এদের জন্যে অসহিষ্ণু হওয়া চলে না, এরা সুবৰ্ণলতার। এদের সমস্ত দায়-দায়িত্ব বহন করেই চলতে হবে শেষ দিনটি পর্যন্ত। এদের বিয়ে দিতে হবে, সংসারী করে দিতে হবে, অসুখ করলে দেখতে হবে, আঁতুড়ে ঢুকলে আঁতুড় তুলতে হবে, আর এদের মন-মেজাজ বুঝে বুঝে কথা বলতে হবে। এদের অবহেলা করা চলবে না, এড়ানো যাবে না, তুচ্ছ করা যাবে না। তা করতে গেলে এরা তৎক্ষণাৎ ফোঁস করে উঠে তার শোধ নেবে। কারণ সুবৰ্ণলতাই এদের শিখিয়েছে–সব মানুষই সমান। শিখিয়েছে–মানুষ মাত্রেরই স্বাধীনতার অধিকার আছে।

    ওরা যদি শিক্ষার আলাদা একটা অর্থ বোঝে, নিশ্চয় সেটা ওদের দোষ নয়, দোষ সুবৰ্ণলতার শেখানোর।

    নিজের হাতের তৈরি ড্রাগনের হাঁ থেকে পালাবে কি করে সুবৰ্ণ?

    সুবৰ্ণ উপায় খোঁজে।

    পালাবার, অর্থাৎ পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চিরাচরিত পদ্ধতিগুলোয় আর রুচি নেই সুবর্ণর। অনেকবার চেষ্টা করেছে, যম তাকে ফেরত দিয়ে গেছে, একবার নয়, বার বার।

    আহা, যদি অকারণ শুধু শুয়ে পড়ে থাকা যেত! কোনোদিকে তাকাতে হতো না, শুধু দিনে-রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে পড়ে থাকা!

    মৃত্যুর পরে যেমন করে সংসারের দিকে মুখ ফিরোয় মানুষ তেমনি!

    আজ এই ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতার মুহূর্তে সংসারটা যেন তার সমগ্র মূল্য হারিয়ে একটা মৃৎপিণ্ডের মত পড়ে থাকে। সুবৰ্ণলতা সেই মৃৎপিণ্ডটাকে ত্যাগ করবার উপায় খোঁজে। সুবৰ্ণলতা বুঝি ঐ মাটির বোঝার ভার আর বইতে পারবে না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }